প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা

বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা - জানুয়ারি, ১৫, ২০১৭

 

গোয়েন্দা গল্প কতটা সাহিত্য

পল্লব চট্টোপাধ্যায়


(১)

গোয়েন্দা গল্প বা উপন্যাস সাহিত্যপদবাচ্য কিনা তা নিয়ে রসিক ও পণ্ডিতমহলে নানা কথা বহুকাল ধরে চলে এসেছে। ‘পাঠকের মন পায়, তবু মান পায় না’- এই ছিল গোয়েন্দাকাহিনি সম্বন্ধে আবহমান প্রচলিত একটি ধারণা। আমি মনে করি এতদিনে বোধহয় সে ধারণার অবসান ঘটেছে বা ঘটতে চলেছে, আর তাই নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাই।

শরদিন্দু ব্যোমকেশকে নিয়ে তাঁর প্রথম গল্প-সংগ্রহ ‘ব্যোমকেশের ডায়েরী’র ভূমিকায় (১৯৩৩) লেখেন :

“ডিটেকটিভ গল্প সম্বন্ধে অনেকের মনে একটা অবজ্ঞার ভাব আছে- যেন উহা অন্ত্যজশ্রেণীর সাহিত্য- আমি তাহা মনে করি না। Edgar Allan Poe, Conan Doyle, G.K. Chesterton যাহা লিখিতে পারেন, তাহা লিখিতে অন্ততঃ আমার লজ্জা নাই।”

তাহলে কি উক্ত তিনজন বিদেশি সাহিত্যিকই গোয়েন্দা গল্পকে জাতে তুলে দিয়েছেন? আর বাংলা সাহিত্যের জগতে দীনেন্দ্রকুমার রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীহাররঞ্জন গুপ্ত বা সত্যজিৎ রায়ের মত সেরা সাহিত্যিকরা আসরে নেমেছেন বলেই কি সাহিত্যজগতে এর উত্তরণ ঘটল? উত্তর হবে হ্যাঁ এবং না দুটোই। তবে আমরা বিদেশি গল্পের জগতে আপাতত যেতে চাই না, আমাদের আলোচনা সীমিত রাখতে চাই বাংলা সাহিত্য, মতান্তরে বাংলা গল্প-উপন্যাসের মধ্যেই।

আচার্য সুকুমার সেন তাঁর একটি প্রবন্ধে জানিয়েছেন যে শাসনকার্যে পুলিশী সহায়তা আমাদের দেশে বৈদিক যুগ থেকেই প্রচলিত আছে, আর তা নিয়ে ভাল রচনারও অভাব নেই আমাদের দেশের সনাতন সাহিত্যে। তবে বাংলায় রচিত প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি শ্রী সেন সংগ্রহ করেছেন উইলিয়াম কেরীর ‘ইতিহাসমালা’ থেকে, প্রসঙ্গের প্রয়োজনে তা আমি উদ্ধৃত করছি :

“কোনও এক নগরে এক ঘাটের উপর এক ব্রাহ্মণ একশত টাকার তোড়া বস্ত্রে বাঁধিয়া স্নান করিতে জলে নামিলে পর ডুব দিয়া উঠিয়া দেখে আপন বস্ত্রে তঙ্কার তোড়া নাই। ইহাতে বড় দুঃখী হইয়া ঐ স্থানের বিচারকর্তার স্থানে নিবেদন করিলে তিনি আপন অন্তঃকরণে বিবেচনা করিয়া আজ্ঞা দিলেন এবং পাঁচজন পেয়াদা ও দুইজন কোড়াবরদার তাহার সাথে দিয়া আজ্ঞা করিয়া দিলেন-‘যে স্থানে ব্রাহ্মণ তঙ্কার তোড়া রাখিয়াছিলেন সে স্থানে পেয়াদারা ঘিরিয়া থাকহ এবং তথা কোড়া ক্ষেপণ করহ।‘ তারপর তাহারা সেইমত করিলে যে সে টাকা লইয়াছে সে একজন ভারি জলবহা গোয়ালা সেই স্থানে আসিয়া বলিল যে, ‘তোমরা এইস্থানে কোড়া মারিলে কি তোমাদের টাকা পাইবা?’ তখন পেয়াদারা বলিল, ‘আমরা টাকা পাইবার ফিকির করিতেছি তুই কিমতে জ্ঞাত হইলি।‘ এই কহিয়া তাহাকে কর্তার সাক্ষাৎ প্রহার করিলে গোপ সে টাকা ফিরিয়া দিল।
এই কৌশলে তথাকার বিচারকর্তা বাঙালি ব্রাহ্মণের হারানিয়া মুদ্রা দেওয়াইলে ব্রাহ্মণ বড়ই সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে আশীর্বাদ করিয়া প্রস্থান করিলেন।”

(২)

গোয়েন্দা সাহিত্য ঠিক কতটা প্রাচীন তা বলা কঠিন। তবে সাহিত্যিক-যুগল রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় ও সিদ্ধার্থ ঘোষের মতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ঋগবেদের দশম মণ্ডলের একটি সুক্তে পাওয়া যায় একটি ঘটনার সন্ধান। এবং আশ্চর্য, সেই প্রথম গোয়েন্দাটি ছিল একটি কুকুরী, নাম সরমা। ‘পণি’ নামে কুখ্যাত একদল ভিনদেশি ডাকাত দেবতাদের গরু চুরি করে। সরমা গোয়েন্দার কাজ করে ও তারই নির্দেশিত পথে হারানো গরু উদ্ধার করেন দেবতারা। কুকুরের ঘ্রাণশক্তির সঙ্গে সঙ্গে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিও এইভাবেই স্বীকৃতি পায় সেই বৈদিক আমল থেকেই। পাশ্চাত্যে প্রথামাফিক গোয়েন্দা গল্পের প্রথম আবির্ভাব ঘটান আমেরিকার এডগার অ্যালান পো, তাও প্রায় ১৭০ বছর আগে। তাঁর প্রবর্তিত ধারায় একে একে আসেন উইলকি কলিন্স, চেস্টারটন, কোন্যান ডয়েল, ফ্রিম্যান, আগাথা ক্রিস্টি ও আরো অনেকে। কেরী সাহেবের গল্পটি বাদ দিলে বাংলায় প্রথম পূর্ণাঙ্গ গোয়েন্দা কাহিনি লেখেন তখনকার প্রখ্যাত সাহিত্যিক-সাংবাদিক নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। মুখ্যতঃ সম্পাদিকা স্বর্ণকুমারী দেবীর অনুপ্রেরণায় ১৮৮৭ সালের মে মাসে তিনি ভারতী পত্রিকায় লেখেন ‘চুরি না বাহাদুরি’ (গল্পটি পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন।) নামে প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি। তার ঠিক তিন বছর পরে এই ভারতীতেই প্রকাশিত হয় ঐতিহাসিক উপন্যাসকার হিসাবে খ্যাত সাহিত্যিক হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা গল্প ‘হত্যাকারী কে?’ (পাঁচকড়ি দের রচনাটি আলাদা)। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রায় ঊষালগ্ন থেকে নামকরা সাহিত্যিকরা দু-একটি করে গোয়েন্দা কাহিনি লেখা শুরু করেন | তাও কেন এই সাহিত্য যথাযোগ্য মর্যাদা পেতে কাটিয়ে দিল আরও প্রায় পঞ্চাশ থেকে একশ বছর, ব্রাত্য হয়ে থাকল মা ভারতীর দোরগোড়ায়? চিন্তার বিষয়, তাই না!

কালে দেখা গেল যে খুচরো গোয়েন্দা গল্প জনপ্রিয়তা পেলেও যথেষ্ট নজর কাড়ে না যতক্ষণ না পর্যন্ত একজন বিশেষ গোয়েন্দার ধারাবাহিক সাফল্যর কথা সুলিখিত হয়। এভাবে ডিটেকটিভ গল্পকে সাহিত্যের দরবারে এনে হাজির করেন পো তাঁর গোয়েন্দা দুপ্যাঁকে নিয়ে, ডয়েল আনেন শার্লক হোমসকে। তাঁদের জয়যাত্রার কাহিনি পাঠককে উৎসুক করে রাখে পরবর্তী গল্পের জন্যে, গোয়েন্দা-প্রবরের নতুন কীর্তির জন্যে। ঠিক তখনই সরকারি গোয়েন্দা বিভাগের একজন চাকুরে, নাম প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়, রচিত ‘দারোগার দপ্তর’ নামের ধারাবাহিক কাহিনিমালার প্রথমটি বেরোয় ১৮৯২ সালে, নাম ‘বনমালী দাসের হত্যা’। তাঁদের অনেক আগে ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ নামে একটি গোয়েন্দা-গল্পমালা লেখেন ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, তবে সে গল্পগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকলেও আধুনিক পাঠকের কাছে তা ঠিক গ্রহণযোগ্য হয়নি। হ্যাঁ, প্রিয়নাথ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে দীনেন্দ্রকুমার রায় ‘ভারতী’তে লেখেন তাঁর প্রথম সরস গল্প ‘উদোর বোঝা বুধোর ঘাড়ে’ তবে সাহিত্যিক খ্যাতিলাভের পরবর্তী জীবনে তিনি ‘ব্লেক ও স্মিথ’ নামের বিদেশি গোয়েন্দাযুগলকে নিয়ে বিলেতি গল্পের অনুসরণে বহু গল্প লিখে জনপ্রিয় হন। প্রসঙ্গতঃ জানাই যে কোথাও ইতিমধ্যে পড়লাম যে গোয়েন্দা-সাহিত্যের মানোন্নয়নের প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘ডিটেকটিভ’ নামে একটি ছোট গল্প, তবে তা নিতান্তই এক নারী, তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক আর তাঁর গোয়েন্দা স্বামীকে নিয়ে ত্রিভুজাকৃতি সম্পর্কের কাহিনি, এর মধ্যে প্রকৃত চোর-ধরা নামের কোনও বস্তু নেই।(গল্পটি পড়তে চাইলে এইখানে ক্লিক করুন।)

এরপর ধারাস্রোতের মত গোয়েন্দা গল্পের আসরে নেমে পড়লেন একে একে খ্যাতনামা সব সাহিত্যিক। প্রভাত মুখোপাধ্যায়, পাঁচকড়ি দে, ক্ষেত্রমোহন ঘোষ, শরচ্চন্দ্র সরকার, হেমেন্দ্রকুমার রায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ও অবশেষে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। গোয়েন্দা সাহিত্যকে প্রথম ‘ব্রেক’ দিয়েছিলেন ভারতী-সম্পাদিকা রবীন্দ্র-অগ্রজা স্বর্ণকুমারী, এবার ১৮৯৬এ এগিয়ে এলেন ‘কুন্তলীন’ আর ‘দেলখোশ’-খ্যাত হেমেন বোস, মৌলিক গল্পের জন্যে প্রবর্তন করলেন ‘কুন্তলীন পুরস্কার’, পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে যার অন্যতম হল গোয়েন্দা কাহিনি। এই পুরস্কার পর্যায়ক্রমে লাভ করেন রজনীচন্দ্র দত্ত, দীনেন্দ্রকুমার রায়, শান্তিনিকেতনের শিক্ষক জগদানন্দ রায়, সরলাবালা সরকার ইত্যাদি। তবু কেন তার অভিষেক হয় না সাহিত্যের অন্দরমহলে, কেন তার সিংদরজা খোলে না গোয়েন্দা সাহিত্যের জন্য ? একটা সঙ্গত ও যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা করেছেন সুজন দাশগুপ্ত একটি প্রবন্ধে-

“গোয়েন্দা গল্পের কাঠামোর সীমাবদ্ধতার মধ্যে কি সাহিত্যসৃষ্টি করা সম্ভব? গোয়েন্দা গল্পের ধারা মোটামুটিভাবে তিনটে ভাগে বিভক্ত। প্রথমে ভাগে থাকে সমস্যাটা কী , দ্বিতীয় ভাগে খোঁজ চলে সমস্যার সমাধান সূত্রের, শেষ পর্বে সমাধান (দোষীকে খুঁজে বার করা , হারানো রত্ন পুনরুদ্ধার ইত্যাদি) এবং কীভাবে সেটা করা হল তার বর্ণনা। অর্থাৎ একটা (সুনির্দিষ্ট) পরিণতির দিকে গল্পকে এগোতেই হবে– কল্পনা লাগামছাড়া হলে চলবে না।......এক দিক থেকে এটা ছোটদের রূপকথার মত। সেই জন্যেই অনেক সাহিত্যিকই এটা সাহিত্য পদবাচ্য মনে করেন না।”

কিন্তু ডারউইনের বিবর্তনবাদের নিয়ম সাহিত্যের ক্ষেত্রেও খাটে। তাই এই ধারার গল্পের জনপ্রিয়তাকে সম্বল করে নামকরা সাহিত্যিকরা এগিয়ে এলেন, অনেক পরিবর্তন ও বিবর্তন ঘটল এর আঙ্গিকে, গঠনশৈলীতে, ভাবে ও ভাষায়- যেমন প্রাকৃতিক নিয়মে ও অপ্রয়োজনীয় বলে মানুষ একসময় লেজ খসিয়েছে, আর প্রয়োজনের খাতিরে বেড়েছে তার মস্তিষ্কের আকার। ফল কী হল দেখা যাক।

(৩)

‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না?’

তখনও গোয়েন্দা কাহিনি শুধুমাত্র অবসর বিনোদনের খোরাক। অভিজাত সাহিত্যের আসরে উন্নাসিকতার উপকরণ। কবে হবে তার সাহিত্য-লক্ষ্মীর দরবারে অভিষেক, রসিকের যথার্থ স্বীকৃতি লাভের সৌভাগ্য ?

ভাবতে ভাবতে এসে পড়ল ১৯৩২ খৃষ্টাব্দ। শার্লক হোমস অবসর নিয়েছেন ১৯১৪ সালে, এরকুল পোয়রো খ্যাতির মধ্যগগনে। হঠাৎ বাঙলা সাহিত্যের আসরে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়লেন দুটি নবীন যুবক, নাম ব্যোমকেশ বক্সী আর অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা এলেন, দেখলেন আর জয় করলেন পাঠকহৃদয়। মাসিক বসুমতীতে প্রকাশিত গল্পটির নাম ‘পথের কাঁটা’, লেখক শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এই বসুমতীতেই এর পর একে-একে বেরোয় ‘সীমন্ত-হীরা’ আর ‘সত্যান্বেষী’। শুরু হয় এক নতুন ধারার উন্নততর গোয়েন্দাকাহিনির অধ্যায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে। তারপর শুরু হল উলটো-পুরাণের খেলা। খ্যাতনামা-অখ্যাত লেখকের দল ভীড় বাড়াতে লাগলেন দলে দলে তাঁদের গোয়েন্দা গল্পের সম্ভার নিয়ে। উদ্দেশ্য কি গোয়েন্দা গল্পকে মর্যাদিত করা, না নিজেদের মর্যাদা বাড়ানো বা নিছক পাঠকের চিত্তজয় ও মনোরঞ্জন? হয়ত সবই। হেমেন্দ্রকুমার ত ছিলেনই, একে একে এলেন নীহাররঞ্জন গুপ্ত, বিমল কর, প্রেমেন্দ্র মিত্র, পরশুরাম, পরিমল গোস্বামী, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, অদ্রীশ বর্ধন, সন্তোষকুমার ঘোষ, সমরেশ বসু, মঞ্জিল সেন, এমনকি হাস্যসম্রাট শিবরাম চক্রবর্তী এবং যাঁকে বাদ দিলে আজকের পাঠক তথা চলচ্চিত্রানুরাগীরাও সমভাবে ‘চটিত’ হবেন- সেই সত্যজিৎ রায়।

পরিশেষে আরেকটি কথা বলি। সাহিত্যের মূল বৃক্ষটি কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে নবরসের শিকড়ের আধারে। সফল সাহিত্যের আসরে স্থান পাকা করে নিতে গেলে যাতে রসিকজন মুখ না ফিরিয়ে নেন তার জন্য এই রসের সম্ভার সঠিক প্রয়োগে আনতে হবে গোয়েন্দা গল্পের মধ্যেও। উপরোক্ত লেখকদের প্রায় প্রত্যেকের লেখা গোয়েন্দা গল্পই হয়ত সে কারণে হয়ে উঠেছে রসোত্তীর্ণ। উদাহরণ হিসেবে দেখি শরদিন্দুকে। সত্যবতী তো আছেনই, তাছাড়া আদিরসের একটি ছদ্মধারা খুব শোভনভাবে বইছে ‘আদিম-রিপু’, ‘বহ্নি-পতঙ্গ’, ‘মগ্ন-মৈনাক’, ‘শজারুর কাঁটা’ ইত্যাদি গল্পে। বীররসের আধিক্য না থাকলেও ব্যোমকেশের সাহসের অভাব ঘটেনি কোনোদিনও। ‘রক্তমুখী নীলা’, ‘বেণী-সংহার’, ‘রুম-নম্বর দুই’ -তে বীভৎস রস আর মাঝে মাঝে হাস্য-রসের আমদানী করেছেন কখনও বিধু দারোগা (অর্থমনর্থম) বা প্রায়শঃই ভৃত্য পুঁটিরাম বা অজিতের সাথে রহস্যালাপে। আর অদ্ভুত রস! ‘মাকড়সার রস’ বা ‘অদ্বিতীয়’ তাহলে কী ? আদিরসের প্রভাব না থাকলেও ঠিক সেভাবেই বীররস এনেছেন মগজাস্ত্রের কারবারি ফেলুদার মধ্যে সত্যজিৎ রায়। জটায়ূ না থাকলে হয়ত হাস্যরসের সাথে সাথে ফেলুদার গল্পের অর্ধেক মজাই মাটি হয়ে যেত। তাঁর একাধিক গল্পে শিশু-চরিত্রের সার্থক প্রয়োগ যদিও সরাসরি বাৎসল্য-রসসঞ্চার করে না ফেলু-কাহিনিতে, কিন্তু শিশুদেরকে শিশু না ভেবে মানুষ হিসেবে দেখতে বাধ্য করেছেন পাঠককে আর শিশুর সারল্য এনেছেন লালমোহনবাবুর মত প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে। এঁরা প্রত্যেকেই কিংবদন্তী -সমান।

(৪)

অনেক আলোচনা হল। এবার আবার ফিরে আসি শরদিন্দুবাবুর কথায়। এক সাক্ষাৎকারে তিনি একবার বলেন, “রহস্য রোমাঞ্চ গল্প নিশ্চয়ই সাহিত্যে স্থান পেতে পারে। কারণ এখানেও মনুষ্যচরিত্র এবং মানবীয় ধর্ম নিয়ে রচনা। শুধু একটু রহস্য থাকে বলেই কেন নিম্নশ্রেণীর হবে? নোবেল পুরস্কার পাওয়া কোন কোন লেখকও এই জাতের লেখা লিখেছেন।......ভাষা হচ্ছে গল্পের বাহন। সেই বাহন যদি ভাল না হয় তাহলে গল্পও ভাল ভাবে বলা যায় না। হোক না গোয়েন্দা গল্প, তবু সেটা গল্প তো! সুতরাং মনোজ্ঞ করে বলা চাই।”

এরই প্রসঙ্গ ধরে জানাই যে আশির দশক থেকে আনন্দমেলা জাতীয় কিশোর পত্রিকা দাপটে রাজত্ব চালাতে থাকে বঙ্গভাষীদের মাঝে। দেশ, আনন্দমেলা ও আরো কিছু পূজাবার্ষিকীতে কিশোরদের উপযোগী দুঃসাহসিক অভিযান, রহস্য-রোমাঞ্চ আর গোয়েন্দা গল্পের সম্ভার নিয়ে আসেন সত্যজিৎ রায় (ফেলুদা), বিমল কর(কিকিরা), সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ (কর্ণেল), নারায়ণ সান্যাল (শার্লক হেবো), সমরেশ মজুমদার (অর্জুন), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (কাকাবাবু- অবশ্য তিনি ঠিক গোয়েন্দা নন), প্রেমেন্দ্র মিত্র (পরাশর বর্মা), সুচিত্রা ভট্টাচার্য (মিতিনমাসী), সমরেশ বসু (গোগোল)। এঁরা প্রত্যেকেই সাহিত্যক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত শক্তিমান লেখক। এঁদের দৌলতে গোয়েন্দা সাহিত্য আজ আর অস্পৃশ্য বা ব্রাত্য নয় বরং রীতিমতো মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত।

এই সময় অর্থাৎ ১৯৮৩ সালের নষ্টচন্দ্র তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের চৌর্যবৃত্তির সম্মানার্থে সুকুমার সেনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় গোয়েন্দাসাহিত্য-চক্র ‘হোমসিয়ানা’। সঙ্গে থাকেন প্রতুল গুপ্ত, সন্তোষ ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমরেশ বসু, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। উল্লেখনীয় যে সুকুমার সেনই প্রথম উপহার দিয়েছেন দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা কাহিনির প্রথম ইতিহাস ‘ক্রাইম কাহিনির কালক্রান্তি’।

এবং শেষ অথচ বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা এই যে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের বাংলা সহায়ক পাঠে গোয়েন্দা কাহিনীর অনুপ্রবেশ, পাঠ্য হিসেবে অনুমোদিত হল ব্যোমকেশ-কাহিনী ‘লোহার বিস্কুট’।

পরিশেষে জানাই এ সম্বন্ধে একজন আলোচকের একটি সুচিন্তিত মতামত- “সাহিত্য মানুষের রুচি পাল্টায় না মানুষের রুচির বুনিয়াদের ওপর ভিত্তি করে সাহিত্য বদলায়? প্রশ্নটি যেমন শক্ত এর উত্তরটিও তেমনই। স্থান, কাল আর পাত্র ভেদে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর আজও অজানা।”

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ

১) গোয়েন্দা আর গোয়েন্দা- রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায় ও সিদ্ধার্থ ঘোষ সম্পাদিত।
২) ব্যোমকেশ সমগ্র- আনন্দ।
৩) গল্পগুচ্ছ- রবীন্দ্রনাথ।
৪) ভারতী- প্রবন্ধ, দীপক সেনগুপ্ত, অবসর পুরনো সংখ্যা।
৫) সেরা সত্যজিৎ ও আরো সত্যজিৎ- আনন্দ।
৬) রহস্য রোমাঞ্চ কাহিনি - সাহিত্য না অন্য কিছু? ‘রহস্য রোমাঞ্চের ঊর্ণস্থল’- সুব্রত মজুমদার। ওয়েব-লিঙ্ক http://www.bengalimystery.com/Bengali_mystery_subrata.htm
৭) ওয়েব-লিঙ্ক http://www.abasar.net/sharadindu_sujan.html
৮) অন্যান্য কিছু ওয়েব সাইটের তথ্যাবলী।


লেখক পরিচিতি - জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিহার (অধুনা ঝাড়খন্ডের) ধানবাদ কয়লাখনি ও শিল্পাঞ্চলে, সেখানে 'নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধান' হলেও বাংলা ও বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল একসময়। ১৯৮২ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে পেট্রোলিয়াম লাইনে চাকুরী, বর্তমানে কুয়েত অয়েল কোম্পানিতে কর্মরত। শখ-গান-বাজনা আর একটু-আধটু বাংলাতে লেখালেখি। কিছু লেখা ওয়েব ম্যাগাজিনে (ইচ্ছামতী, আদরের নৌকো ও অবসর) প্রকাশিত ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।