বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা

বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা - জানুয়ারি, ১৫, ২০১৭
বাংলাদেশের গোয়েন্দা লেখক ও তাঁদের লেখা
সত্যজিৎ রায় মজুমদার
বাংলাদেশের গোয়েন্দা কাহিনির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে শক্তিশালী কোনো
লেখা বা ধারা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বেশিরভাগ ধার করা কাহিনি এবং এগুলির
প্রায় শতভাগ কিশোর-উপযোগী। সাহিত্য সমালোচক থেকে শুরু করে বোদ্ধা
পাঠকবৃন্দের কাছে এই ধারাটি যথেষ্ট ঋদ্ধ নয়। এমনকী অনেকে গোয়েন্দা
কাহিনিকে সাহিত্যপদবাচ্য মনে করেন না। ফলে ঘটনাপ্রধান সাহিত্যের
এই ধারাটি শিশু-কিশোর পাঠকদের উপর ভর করে প্রসারিত হয়েছে। এই কারণে
দেখা যায় মৌলিক গল্প-কাহিনি এখানে কম। অধিকাংশ অনুবাদ এবং মৌলিক
ঘটনাগুলিও ওয়েস্টার্ন গল্পের প্রভাব বলয় থেকে বের হতে পারেনি।
তবে কিশোর -উপযোগী হলেও গোয়েন্দা কাহিনির বয়স্ক পাঠকও একেবারে
কম নয়।
বাংলাদেশের পটভূমিতে সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বিদেশি কাহিনি
অবলম্বনে গোয়েন্দা কাহিনিগুলির যাত্রা শুরু। লেখক ও প্রকাশক কাজী
আনোয়ার হোসেন এবং তাঁর পরিবার এ ক্ষেত্রে একটি একছত্র প্রতিষ্ঠানে
পরিণত হয়েছে। কাজী আনোয়ার হোসেন, রকিব হাসান প্রমুখ লেখক বিভিন্ন
সময় বিভিন্ন জনপ্রিয় সিরিজ উপহার দেন। এর মধ্যে ‘মাসুদ রানা’ ও
‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি।
কাজী আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯ জুলাই, ১৯৩৬ ঢাকায়। একজন লেখক,
অনুবাদক এবং প্রকাশক। তিনি সেবা
প্রকাশনীর
কর্ণধার হিসাবে ষাটের দশকের মধ্যভাগে বাংলাদেশের জনপ্রিয় মাসুদ
রানা সিরিজের মাসুদ রানা নামে গুপ্তচর চরিত্রকে সৃষ্টি করেন। ১৯৬৪
খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে প্রকাশিত হয় কুয়াশা-১। এ সময় তিনি ‘সেগুনবাগান
প্রকাশনী’ প্রতিষ্ঠা করেন। দু-জন কর্মচারী নিয়ে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের
মে মাসে সেগুনবাগিচায় প্রেস প্রতিষ্ঠার পরবর্তীকালে এর নাম হয়
‘সেবা প্রকাশনী’। তার প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশে পেপারব্যাক গ্রন্থ
প্রকাশ, বিশ্ব সাহিত্যের প্রখ্যাত উপন্যাসের অনুবাদ এবং কিশোর
সাহিত্যের ধারাকে অগ্রসর করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কুয়াশা চরিত্রটি নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন প্রায় ৭৬টির মতো কাহিনি
রচনা করেছেন। তিনি ছদ্মনাম হিসেবে বিদ্যুৎ মিত্র ও শামসুদ্দীন
নওয়াব নাম ব্যবহার করে থাকেন। কাজী আনোয়ার হোসেনের পুরো নাম কাজী
শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম নবাব। তাঁর পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী,
গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন। তাঁরা
৪ ভাই, ৭ বোন।
কাজী আনোয়ার হোসেন ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে
ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন।
১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ
পাস করেন। পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর রেডিওতে তিনি নিয়মিত গান গাইতে
শুরু করেন। তাঁর তিন বোন সনজিদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা
খাতুন এখনও রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে গভীরভাবে জড়িত। তিনি ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে
কণ্ঠশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন। কাজী আনোয়ার হোসেনের এক
মেয়ে ও দুই ছেলে। ছেলেরা হলেন কাজী শাহনূর হোসেন এবং কাজী মায়মুর
হোসেন। তারা পিতার মতো লেখালেখি এবং সেবা প্রকাশনীর সাথে জড়িত।
কাজী আনোয়ার হোসেনের অধিকাংশ উপন্যাস ও গল্প বিদেশি কাহিনির ছায়া
অবলম্বনে রচিত। তাঁর পাঠকপ্রিয় ভাষাশৈলী সাধারণ পাঠকের কাছে মনোরম।
মৌলিক রচনাগুলিও চমকপ্রদ। বয়সের কারণে এখন তিনি প্রধানত সম্পাদনার
কাজ করেন। উল্লেখ্য যে, যাঁরা তাঁর হয়ে লিখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম
হলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
মাসুদ রানা তাঁর সৃষ্টি করা একটি কাল্পনিক চরিত্র। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে
ধ্বংস পাহাড় নামের প্রথম গ্রন্থটি থেকে শুরু করে সেবা প্রকাশনী
হতে মাসুদ রানা সিরিজে এই চরিত্রকে নিয়ে চার শতাধিক বই প্রকাশিত
হয়েছে। সিরিজের প্রথম তিনটি বই ধ্বংস পাহাড়, ভারতনাট্যম এবং হ্যাকার
ছাড়া বাকিগুলো ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষার বইয়ের ভাবানুবাদ। মাসুদ
রানার চরিত্রটিকে মূলত ইয়ান ফ্লেমিংয়ের সৃষ্ট জেমস বন্ড চরিত্রটির
বাঙালি সংস্করণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
১৯৬৯-৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে সাংবাদিক রাহাত খানের অনুপ্রেরণায়
রহস্যপত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা নেন কাজী আনোয়ার হোসেন। পত্রিকাটির
প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে। চারটি
সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রিকাটির প্রকাশনা
স্থগিত রাখা হয়েছিল। এরপর ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে রহস্যপত্রিকা আবার
প্রকাশিত হয়। আজও তা অব্যাহত রয়েছে।
কাজী আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি মাসুদ রানা সিরিজে
যৌনতার আমদানি করেছেন। ফলে ‘প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য’ সেবা প্রকাশনীর
লোগো প্রজাপতি মার্কাওয়ালা বই পড়াই নিষিদ্ধ হয়ে যায় এক সময়। এখন
যৌনতার অংশ পরিহার করে সকলের জন্য লেখা হচ্ছে এই সিরিজের বইগুলি
। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার ও সংলাপ রচয়িতা
হিসেবে বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন।
বাংলাদেশের সাহিত্যে জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র খুব কমই রয়েছে। বিশেষত
বাংলাদেশে গোয়েন্দা সাহিত্যে হাতে গোনা দু-একটি চরিত্র পাঠকের
হৃদয় ছুঁয়ে আছে। আর এ রকমই একটি সিরিজ ‘তিন গোয়েন্দা’। কম করে
হলেও তিনটি প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় এক সিরিজ এটি। কিশোর-মুসা-রবিন
নাম তিনটির সঙ্গে কোটি কোটি বাংলাদেশির কৈশোরের সব দুরন্ত দিনের
রয়েছে আত্মিক এক মেলবন্ধন। শিশু-কিশোরদের সামনে নতুন এক পৃথিবী
তৈরি করেছে কিশোর, মুসা আর রবিন। তিন গোয়েন্দার একটির পর একটি
জটিল রহস্যের জাল ছিন্ন করার অভিজ্ঞতা যে কাউকেই মুগ্ধ করে। এ
তিন গোয়েন্দার সঙ্গে ঘরে বসেই বেড়িয়ে আসা যায় আমাজনের জঙ্গলে কিংবা
দুর্গম পাহাড়ের কোলে। অদ্ভুত রহস্যময়তার সেই জগৎটা এ দেশের শিশু-কিশোরদের
বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম মোহিত করে রেখেছে। দুই যুগেরও
বেশি সময় ধরে চলছে একটি গোয়েন্দা সিরিজ, অথচ তার জনপ্রিয়তায় ভাটা
পড়েনি। এ ঘটনাটির কেন্দ্রে আছেন রকিব হাসান। বাংলাদেশের সাহিত্যে
‘তিন গোয়েন্দা’ লিখে তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন ২৫-২৬ বছর। স্বনামে-বেনামে
তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা সাড়ে চার শ’রও বেশি। কিন্তু মিডিয়া
কিংবা বইয়ের ফ্ল্যাপ সব জায়গাতেই নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন লেখালেখির
চল্লিশটি বছর। কখনও কোথাও কোনো ছবি ছাপতে দেননি। সবাই তাঁর নাম
ও তিন গোয়েন্দাকে চেনে। কিন্তু এর পরেও তিন গোয়েন্দার জনক মানুষের
সামনে আসতে চান না। এখানেই রকিব হাসানের বিশেষত্ব। সাধারণ মানুষের
মতো সাধারণের ভিড়ে মিশে থাকার জন্যই নিজেকে সব সময় আড়াল করে রেখেছেন
তিনি।
রকিব হাসানের জন্ম ১৯৫০ সালে কুমিল্লায়। তাঁর লেখা প্রথম বই প্রকাশিত
হয় ১৯৭৭ সালে, ছদ্মনামে। স্বনামে প্রথম প্রকাশিত বইটি ছিল অনুবাদগ্রন্থ,
ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’। এরপর অনুবাদ করেছেন জুল ভার্ন, জিম
করবেট, কেনেথ এন্ডারসন, মার্ক টোয়েন, হেনরি রাইডার হ্যাগার্ড,
এরিক ফন দানিকেনের মতো বিখ্যাত লেখকদের অনেক ক্লাসিক বই। অনুবাদ
করেছেন মহাক্লাসিক ‘অ্যারাবিয়ান নাইটস’ ও এডগার রাইস বারোজের ‘টারজান’
সিরিজ। এ ছাড়া লিখেছেন কিশোরদের উপযোগী কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ ‘খুদে
গোয়েন্দা’। জাফর চৌধুরী ছদ্মনামে ‘রোমহর্ষক’ সিরিজ, ‘আবু সাঈদ’
ছদ্মনামে ‘গোয়েন্দা রাজু’ সিরিজ এবং কিশোরদের উপযোগী বেশকিছু ভূতের
বই ও সায়েন্স ফিকশন। আপাদমস্তক সোজাসাপ্টা এই মানুষটি বছরের পর
বছর পাঠক বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের মনের ভেতর বসবাস করছেন ভালোবাসার
মানুষ হয়ে।
১৯৮৫
সালে আগস্ট মাসে বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে শুরু হয় তিন গোয়েন্দা
সিরিজ। রকিব হাসান একটানা ১৬০টি কাহিনি লেখেন এই সিরিজে। এর পর
এই সিরিজ চালিয়ে যান ‘শামসুদ্দীন নওয়াব’ ছদ্মনামে কাজী আনোয়ার
হোসেন। তিনি এখনও এই কাহিনি লিখে চলেছেন। সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে।
প্রতিটি কাহিনি আলাদা।
রকিব হাসানের খুদে গোয়েন্দা সিরিজির কয়েকটা বই ‘পানির দানব মুখোশ
পরে না’, ‘মায়ানেকড়ে বেড়াতে যায় না’, ‘ডাইনোসরের ডিম’ ইত্যাদি।
সেবা প্রকাশনী থেকে বরেণ্য লেখকদের গ্রন্থ অনুবাদ করেছেন, কাজী
আনোয়ার হোসেন, খসরু চৌধুরী, নিয়াজ মোরশেদ, সায়েম সোলায়মান, ইসমাইল
আরমান, সাইফুল আরেফিন অপু, তারক রায়, জাহিদ হাসান, সেলিম আনোয়ার,
অনীশ দাস অপু, এ.টি.এম. শামসুদ্দীন, কাজী শাহনূর হোসেন, কাজী মায়মুর
হোসেন প্রমুখ
কাজী আনোয়ার হোসেনের ছোট ভাই কাজী মাহবুব হোসেনও গোয়েন্দা কাহিনির
সফল লেখক। তিনি পেশায় প্রকৌশলী। তিনি ২০০৬ সালে মারা যান। তার
গোয়েন্দা কাহিনির অনুবাদগুলি হল আলেয়ার পিছে, পাতকী, রক্তাক্ত
খামার, জ্বলন্ত পাহাড়, মানুষ শিকার, ভাগ্যচক্র, এপিঠ ওপিঠ, লুটতরাজ,
অপমৃত্যু, দাবানল, মৃত্যুর মুখে এরফান ইত্যাদি। এগুলি সেবা প্রকাশনী
থেকে প্রকাশিত। বাংলাদেশে ‘আলেয়ার পিছে’ প্রথম ওয়েস্টার্ন-গল্পের
বাংলা অনুবাদ।
১৯৮৩ সালে কাজী মাহবুব হোসেন রচিত বাংলা ভাষায় প্রথম ওয়েস্টার্ন
সিরিজ প্রকাশিত হয় সেবা থেকে। এ সব কাহিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
গোড়াপত্তনের সময়ে রুক্ষ, বৈরী প্রকৃতি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে
সাধারণ মানুষের দুঃসাহসিক লড়াই নিয়ে রচিত। এর অনুবাদে আছেন রওশন
জামিল, খোন্দকার আলী আশরাফ, শওকত হোসেন, কাজী শাহনূর হোসেন প্রমুখ।
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন রোমেনা আফাজ।
তার বাড়ি বগুড়ায়। তাঁর পিতা কাজেম উদ্দীন আহম্মদ এবং মাতা বেগম
আছিয়া খাতুন।
‘দস্যু বনহুর’ এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক রোমেনা আফাজ কর্তৃক সৃষ্ট
একটি চরিত্র। দস্যু বনহুর সিরিজে এই চরিত্র ভিত্তি
করে
১৩৬টি গোয়েন্দা কাহিনি প্রকাশিত হয়েছে। দস্যু বনহুরের মূল কাহিনি
হচ্ছে : ছোটবেলায় নৌদুর্ঘটনায় চৌধুরী বাড়ির ছেলে মনির হারিয়ে যায়।
দস্যু সরদার কালু খাঁ তাকে কুড়িয়ে পায় ও ‘দস্যু বনহুর’ রূপে গড়ে
তোলে। দস্যু বনহুর যেমন গরীবের কাছে পূজনীয় তেমনি চোরাকারবারী
ও সন্ত্রাসীদের কাছে যমদূত। এই সিরিজের স্লোগান হচ্ছে ‘সত্য ও
ন্যায়ের প্রতীক দস্যু বনহুর’। দস্যু বনহুরের সহায়ক চরিত্র হিসেবে
রয়েছে রহমান ও কায়েস, তাঁরা একাধারে বনহুরের বন্ধু ও সহযোদ্ধা।
বনহুরের দু’জন স্ত্রী। শহুরে স্ত্রীর নাম মনিরা ও অপরজনের নাম
নূরী। মনিরার গর্ভে দস্যু বনহুরের বড় ছেলে নুরুজ্জামান নূর-এর
জন্ম, যে পরবর্তীকালে দেশের সৎ ও সাহসী ডিটেকটিভ হিসেবে পরিচয়
লাভ করে। নূরীর গর্ভে জাভেদ নামে অন্য একটি ছেলের জন্ম হয়, যে
পিতার মতই দস্যুতা করতে ভালোবাসে। দস্যু বনহুর যাকে বাপু বলে সম্বোধন
করতো, সেই কালু খাঁ একজন প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন ডাকাত সরদার।
দস্যু বনহুর সিরিজে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের মধ্যে ‘আশা’
নামের চরিত্রটিকে ধারণা করা হয় রহস্যময়ী। এছাড়া ‘দস্যু রানী’ নামের
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র রয়েছে, যিনি আহাদ নামের একজন নাম
করা ডিটেকটিভের স্ত্রী। এই সিরিজের বইগুলোর নাম দস্যু বনহুর, দস্যু
বনহুরের নতুন রূপ, সৈনিক বেশে দস্যু বনহুর, নাথুরামের কবলে, মনিরা,
দুর্ধর্ষ দস্যু বনহুর, ছায়ামূর্তি, মনিরা ও দস্যু বনহুর, সাগরতলে
দস্যু বনহুর, সর্বহারা মনিরা, ঝিল শহরে দস্যু বনহুর, ঝিন্দের রানী,
দস্যু দুহিতা, বন্দিনী, মায়াচক্র, চিত্রনায়ক দস্যু বনহুর, কান্দাইয়ের
পথে দস্যু বনহুর, বন্দী বনহুর, দস্যু বনহুরের মৃত্যুদণ্ড, অন্ধ
মনিরা, প্রেতাত্মা, মৃত্যুর কবলে নূরী, বনহুরের অন্তর্ধান, আফ্রিকার
জঙ্গলে দস্যু বনহুর, বাংলাদেশে দস্যু বনহুর, বন্ধনহীন দস্যু বনহুর,
দিল্লীর বুকে দস্যু বনহুর, রাত্রি ভয়ঙ্কর, প্রতিধ্বনি, নাবিক দস্যু
বনহুর, ফৌজিন্দিয়া দ্বীপ, আস্তানায় দস্যু বনহুর ইত্যাদি। এগুলো
সালমা বুক ডিপো থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন
সংস্করণ হয়েছে কয়েকটি প্রকাশনা থেকে।
রোমেনা আফাজের অন্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে কাগজের নৌকা, মোমের আলো,
মায়ার সংসার, মধুমিতা ইত্যাদি। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি স্বাধীনতা
পদক লাভ করেন।
ফরিদুর রেজা সাগর ঢাকায় ২২ শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ সালে জন্মগ্রহন
করেন। পিতা ফজলুল হক, মাতা রাবেয়া খাতুন। ২০০৫ সালে শিশু সাহিত্যে
অবদানের জন্য বাংলা একাডেমি ও ২০১৫ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তিনি
লেখক ও চলচ্চিত্র প্রযোজক। একই সঙ্গে বেসরকারি টিভি চ্যানেল আই
এবং ইমপ্রেস টেলি ফিল্ম-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
তার শিশুতোষ এ্যাডভেঞ্চার এবং গোয়েন্দা ঘরানার গ্রন্থ ছোটকাকু
সিরিজ। ঢাকার অনন্যা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই গ্রন্থগুলো বেশ
জনপ্রিয়। এগুলো বিভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে। কয়েকটির নাম হচ্ছে
ছোটকাকুর বড় বিপদ, মাগুরা গুঁড়া গুঁড়া, যশোরে সরোবরে, কুয়াকাটায়
কাটাকাটি, কক্সবাজারের কাকাতুয়া, একলাফে টেকনাফে ইত্যাদি।
বাংলাদেশের আর যারা কিশোরদের উপযোগী গোয়েন্দা কাহিনি বা সেরকম
এ্যাডভেঞ্চার-থ্রিলার লিখেছেন বা লিখছেন তাদের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ,
মুহম্মদ জাফর ইকবালও আছেন। হুমায়ূন আহমেদ-এর গোয়েন্দা কাহিনি সূর্যের
দিন। এছাড়া হিমু এবং মিসির আলী সিরিজের মধ্যেও গোয়েন্দা উপকরণ
রয়েছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল ২৩ ডিসেম্বর ১৯৫২ সালে সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা ফয়জুর রহমান আহমদ, মাতা আয়েশা আখতার খাতুন। বর্তমানে সিলেটের
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। শিক্ষাবিদ
এবং তারুণ্যের প্রতীক হিসেবে তিনি সকলের আদর্শ হয়ে উঠেছেন। তাঁর
দীপু নাম্বার টু হচ্ছে গোয়েন্দাধর্মী গ্রন্থ। এছাড়া বৈজ্ঞানিক
কল্পকাহিনি, এ্যাভেঞ্চারধর্মী বহু গ্রন্থ রয়েছে মুহম্মদ জাফর ইকবালের।
শাহরিয়ার কবির একজন খ্যাতনামা লেখক, সাংবাদিক, ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র
নির্মাতা। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর তিনি ফেনীতে জন্মগ্রহণ
করেন। লেখক হিসাবে তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি একজন শিশুসাহিত্যিক।
১৯৯২ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষ শক্তির
বিরূদ্ধে কাজ করে চলেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পূর্ণ করে শাহরিয়ার
কবির ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সাংবাদিক হিসেবে যোগদান করেন
এবং ১৯৯২ সাল পর্যন্ত নির্বাহী সম্পাদক পদে থাকেন। তিনি একাত্তরের
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাথেও যুক্ত আছেন। তার উল্লেখযোগ্য
গ্রন্থগুলো হচ্ছে, নুলিয়াছড়ির সোনার পাহাড় (১৯৭৬), আবুদের অ্যাডভেঞ্চার,
নিকোলাস রোজারিওর ছেলেরা, হানাবাড়ির রহস্য, পাথারিয়ার খনি রহস্য,
মহা বিপদ সংকেত, নিশির ডাক, বার্চবনে ঝড়, রাজপ্রাসাদে ষড়যন্ত্র,
রত্নেশ্বরীর কালো ছায়া, লুসাই পাহাড়ের শয়তান, ব্যাভারিয়ার রহস্যময়
দূর্গ, মরু শয়তান, অপহরণ, ভয়ঙ্করের মুখোমুখি ইত্যাদি।
সাম্প্রতিককালে যারা লিখছেন তাদের মধ্যে মোস্তাক আহমেদ জনপ্রিয়
লেখক। জন্ম ফরিদপুরে ৩০ শে ডিসেম্বর ১৯৭৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
পড়াশুনা করছেন। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিতে আগ্রহী হলেও গোয়েন্দা কাহিনিতে
পারদর্শী। উল্লেখযোগ্য বই রোবটিজম, ক্লিকি ভাইরাস, অতৃপ্ত আত্মা
ইত্যাদি। নীল মৃত্যু একটি গোয়েন্দা কাহিনি। শিশিলিন সিরিজে নালন্দা
থেকে প্রকাশিত তাঁর কিশোর গোয়েন্দা গ্রন্থগুলো জনপ্রিয়। এখান থেকে
তাঁর ৩৬টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তিনি ঢাকা সিটির উত্তরা
জোনের পুলিশের ডিসি পদে কর্মরত।
তৌফির হাসান উর রাকিব লিখেছন, ঈশ্বরী (২০১৪) ও অপদেবী (২০১৬)।
এগুলিও সব সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। ফুয়াদ আল ফিদাহ, মারুফ
হোসেন, সায়েম সোলায়মানও এই ঘরানার লেখক। আহমেদ মাওলা লিখেছেন কাটামুণ্ডের
রহস্য। বেসরকারি টিভি চ্যানেল আই-তে কর্মরত কবি ও লেখক আমীরুল
ইসলাম ‘আমাদের গোয়েন্দাগিরি’ নামে শিশুদের জন্য গোয়েন্দা কাহিনি
লিখেছেন।
চলচ্চিত্র পরিচালক বাদল রহমান বিখ্যাত জার্মান লেখক Emil Erich
Kastner Gi Emil and the Detective অবলম্বনে তৈরি করেছেন জনপ্রিয়
চলচ্চিত্র ‘এমিলির গোয়েন্দা বাহিনী।’
লেখক পরিচিতি - সত্যজিৎ রায় মজুমদার : জন্ম ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৫৯, বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার মালীডাঙ্গা গ্রামে। খুলনার দৌলতপুর ব্রজলাল সরকারি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) এবং স্নাতকোত্তর (১৯৮৬) ডিগ্রি লাভ। মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা ১১। সাংবাদিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু। কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্ব পালনের পর ২০০৬ সাল থেকে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শিক্ষা ও প্রকাশনা বিভাগের ব্যবস্থাপক পদে কর্মরত। আগ্রহের ক্ষেত্র বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।