বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা
বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা - জানুয়ারি, ১৫, ২০১৭
বাবলা গাছের ছায়া
শেখর মুখোপাধ্যায়
সরাইখানার করিডরে নিয়ন আলোর ঝলকানি। সামনে এক অপরিচিত ঘর। বন্ধ
দরজা। মুসাফিরখানার ন্যুব্জ বৃদ্ধ পারিচারকের হাতের চাবির ছোঁয়ায়
দোর খুলে যায়। মলাট উলটে যায় অচেনা বইয়ের। ঢুকে পড়েন অন্দরমহলে।
অন্ধকার অববাহিকার মাঝে খাত খুঁজে বাইরের আলো আধখোলা দরজার ফাঁক
দিয়ে ভিতরে বয়ে যায় নদীর মতো। এই দৃষ্টি আপনি সঙ্গে এনেছেন। বাতির
বন্দোবস্ত তবুও যে ছিল জরুরি তাই বোঝাতেই কি থমকে দাঁড়ান! আপনি
দেখছেন পায়াভাঙা টেবিল, আপনারই সঙ্গে আমি দেখছি তাতে একরাশ ধুলো।
কিছু তার আপনি সরাবেন, কিছু আমি, কিছু তবু সেই রয়ে যাবে আপনার
পাঞ্জার আবছা পরিচয় এঁকে। আমার পঞ্জরে বাজবে আপনার হৃৎস্পন্দন।
কখন যে আপনি আমায় ভর করেছেন, কখন আমার আঙুল লিখতে শুরু করেছে আপনার
গল্প! আপনাতে-আমাতে কখন মিলিয়ে গেছি আগামীর প্রত্নতাত্ত্বিক গুহায়।
গোয়েন্দা আপনি বুকে হাত দিয়ে দেখুন, অন্তরমহলে আমি আপনারই বিশ্বস্ত
লিপিকার। আমার কালি, আমার কলম, সবিস্ময় লিখি আমি আপনার ভাবনা।
কখনও মুখে হাসি ফোটে, কখনও কুঁচকে ওঠে কপাল, আমার, আপনারও। আপনি
দাঁড়িয়ে আছেন চৌকাঠে । পরিচারক ঘরের বাতি জ্বালে। হাসিমুখে হাত
চুলকোয়। বিশটি টাকা তার শীর্ণ হাতে ধরে দিয়ে কৌতূহলী আপনি অবশেষে
প্রবেশ করেন এক রাতের ভাড়ার কড়ারে হোটেলের ঘরে। পরিচারক ক্ষুধার্ত
শৃগালের চোখে আপনার দিকে চেয়ে ঠোঁট ফাঁক করে দাঁতে ঝলকায় দেখনহাসি।
পাজামার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে ঘুনসিতে বাঁধা গেঁজেয় চালান করে তার
টিপ্। ঘরটি ছোট। তার কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আপনি। টিমটিমে আলোয়
সামনে কায়ার মতো শুয়ে আপনার ছায়া। পরিচারক বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে
দেয়। ঘরে এখন আপনি আর আপনার ছায়া একা।
পায়াভাঙা টেবিল থেকে ফুট দুই দূরে পড়ে আছে আনুমানিক ছ’ইঞ্চি মাত্রাবিশিষ্ট
একটি কাঠের ঘনক। হোটেলের অতিথি সেটিকে পায়ে ঠেলে ঢুকিয়ে দেয় টেবিলের
ভাঙা পায়ের নীচে। হেলে পড়া টেবিল সোজা হয়ে দাঁড়ায়। লোকটি চেয়ারে
বসে ঝোলায় হাত ঢোকায়। বের করে একটি গোয়েন্দা গল্প সংকলন। মলাট
থেকে মলাট উলটে বইটি ছুঁড়ে ফেলে দেয় টেবিলে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গড়িয়ে
পড়ে বিছানায়। কলম থামিয়ে গোয়েন্দাকে জিজ্ঞেস করি, লোকটা কে? জবাব
আসে, সম্ভবত গোয়েন্দা গল্পের অনুরক্ত পাঠক, ট্রেনে আসতে আসতে পুরো
বইটা পড়ে শেষ করে ফেলেছে, এখন ভাবছে রাতটা কাটবে কীভাবে, কিংবা
...। কিংবা? কিংবা, লোকটা গোয়েন্দা গল্পের বিরক্ত লেখক, ওই বইটি
ওর গল্পের শেষতম সংকলন। লোকটা নতুন প্লট খুঁজে না পেয়ে বিবাগি
হয়েছে, নতুন একখানা হাতেগরম না নিয়ে দেশে ফেরা নেই। স্বাজাত্যবোধে
তেতে উঠে বলি, চলুন ওকে হেল্প করি। গোয়েন্দা হাসে। আমি মধুসূদন
দাদার মতো পাশেই দাঁড়িয়ে, চলুন।
ঘরে এখন পাঠক, লেখক, গোয়েন্দা ও তাদের সবেধন নীলমণি এক ছায়া।
একজন শয্যাগত, আর একজন পায়াভাঙা টেবিলের সামনে চেয়ারে উপবিষ্ট,
আরও একজন নিরাপত্তা রক্ষীর কেতায় দণ্ডায়মান দরজার পাশে। ছায়াটি
তিনজনকেই স্পর্শ করে বিস্তৃত ঘরের মেঝে থেকে দেওয়ালে।
চেয়ারে বসা মানুষটি বলেন, কেন, কী হইতে কী-ও তো হইয়া যায়। না
হয় তেমনই লিখুন একখানা।
উত্তেজনায় শয্যা ত্যাগ করেন শয্যাগত – হ্যাঁ, ওই লিখি আর এট টু
ব্রুট আপনিও দুয়ো দিন আমায়। দস্যু মোহন নস্টালজিয়ার কারণে আজও
পড়া হয়। আমার কলমে কলকাতার রাজপথে পাদচারণারত গোয়েন্দার পরমুহূর্তে
অকস্মাৎ বার্লিনের রাস্তায় উপস্থিতির উল্লেখ প্রত্যাশিত নয়।
চেয়ার ছেড়ে শূন্য বিছানায় গড়িয়ে অট্টহাস্য করেন তিনি – কেন, অপ্রত্যাশিতই
তো কাম্য, বিশেষত গোয়েন্দা গল্পে।
ফাঁকা চেয়ারের পিঠ ধরে ঝুঁকে ক্লান্ত হাসেন ইনি – কিন্তু তাই বলে
দু’হাতে পিস্তল বাগিয়ে অন্য হাতে টর্চ জ্বেলে জলের পাইপ বেয়ে দোতলায়
কি ওঠা যায়!
গম্ভীর স্বরে দরজার কাছে দাঁড়ানো মানুষটি বলে ওঠেন – যায়। কী না
করেছি আমি শতকের পর শতক! কিছু তার লোকে মনে রেখেছে, অনেক কিছুই
রাখেনি।
গোয়েন্দারা সব সময়েই একটু সবজান্তা টাইপ অহংকারী হয় দেখেছি। সমস্বরে
বলে ওঠেন লেখক ও পাঠক।
যথেষ্ট কারণ আছে তার। গোয়েন্দা লেখকের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করেন,
আপনি যে হোটেলের ওই পরিচারকের চোখ দেখেই লিখে ফেললেন শৃগালের মতো
চোখ আর, তার ঠোঁটের ফাঁকে দেখে ফেললেন দেখনহাসির ঝলকানি, সে কোন
কারণে?
লেখক মাথা চুলকোন। পাঠকের চোখেও ঘনিয়ে আসে প্রশ্ন। লেখক মাথা ছেড়ে
থুতনি চুলকে কবুল করেন, কলমে অনেকসময় অনেক কিছু তোড়ে এসে যায়।
তোড়ে না তাড়সে?
ওই একই ব্যাপার।
ও। এসে গেলেই আপনি সেটা লিখে ফেলবেন? এখন ওই শেয়ালের চোখ আর দেখনহাসির
ঝলকানি ব্যাপারটার বিহিত করবে কে? আপনার কলম কী বলে?
পাঠক সায় দেন। ঠিক, এই কাজ লেখক এবং তার কলমের দায়িত্বের মধ্যেই
পড়ে।
লেখক মাথা নাড়েন। না হে, কলম আর কথা বলছে না। তখন দুম করে লিখে
ফেলেছি, কাজটা ঠিক হয়নি, ওই বাক্যটা কেটে দিই বরং।
পাঠক হাঁ হাঁ করে ওঠেন। না, একদম না, ওটা পড়ে বেশ একটা ইয়ে হচ্ছে,
মানে একটা সম্ভাবনাভরা থমথমে ভাব। ওটা কাটা চলবে না। এখন প্রয়োজন
কেবল সযুক্তি ঘটনাপ্রবাহ। তাহলেই গল্প এগোবে। চেষ্টা করুন।
লেখক চাপে পড়ে যান। জুলজুলে চোখে চান গোয়েন্দার দিকে। গোয়েন্দা
তখন এগিয়ে আসেন নায়কোচিত ভঙ্গিতে ঘাড় দুলিয়ে। শ্রীযুক্ত লেখক,
আপনি কালি, কলম ও সময় বিস্তর ব্যয় করে এক গোয়েন্দা পুষেছেন, সেটা
যে অপব্যয় নয় সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব তাহলে আমার?
কোণঠাসা লেখক কাতর জবাব দেন, কাজে কাজেই, আর তো কাউকে দেখছি না
যে আমাকে সামান্য সাহায্য করতে পারে।
ঠিক হ্যায়। কাজটা আমি নিচ্ছি। কিন্তু দেখবেন, পরিশ্রমের পর পারিশ্রমিক
যেন বাদ না যায়।
তা আর বলতে! রয়্যালটির ফিফ্টি পারসেন্ট তোমাকে দিয়ে দেব, ভাই।
থাক। রয়্যালটি নিজের কাছেই রাখুন। আমার কাজ আমি করব। শুধু দেখবেন
আপনার কল্পনাপ্রবণ কলমে যেন শেষপর্যন্ত আমার নাম না ডোবে। কিন্তু,
এটা কী ব্যাপার, আপনি আমাকে হঠাৎ তুমি বলতে শুরু করলেন? সামান্য
রেসপেক্ট কি আমি আশা করতে পারি না! আর, লেখক হিসাবে আপনি জাস্ট
আমার ক্রনিকলার, বড়জোর সহকারী। গল্পে আই কল দ্য শট্স।
লেখক তোতলিয়ে বলেন, সে তো বটেই। তবে কি না, আমার গল্পে আবার গোয়েন্দা
ও তার কর্মকাণ্ডের লেখক পরস্পরকে তুই বলে।
ওটা অত্যন্ত অন্যায় করেছেন। শব্দে আমার শরীর নির্মাণ করার আগে
আমাকে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া উচিৎ ছিল আমার সহকারী আমাকে মধ্যম পুরুষের
একবচনে কতটা সম্ভ্রম অথবা অনাদরে সম্বোধন করতে পারে।
ভুল হয়ে গেছে, ভাই, ইঁ না, দাদা। কিন্তু, এ-ব্যাপারে যখন সিদ্ধান্ত
গৃহীত হয় তখনও তো আপনার জন্ম হয়নি।
গোয়েন্দা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। জন্ম ও মৃত্যু এই দুটো ব্যাপারে গোয়েন্দারও
কোনও হাত নেই।
এবং, বিয়েতে। যোগ করেন পাঠক।
গোয়েন্দা সঙ্গে সঙ্গে তেরিয়া মেজাজে চান। এক ব্যোমকেশ ছাড়া কাউকে
দেখেছেন বিয়ে করতে? গোয়েন্দারা বিয়ে করে না। ব্যোমকেশ অত্যন্ত
অন্যায় করেছিল, তদন্ত করতে গিয়ে তদন্তের একজন সাসপেক্টকে বিয়ে
করে বসল। হাইলি ইরেগুলার! টিউটরের যেমন ছাত্রীকে কখনও বিয়ে করতে
নেই, তেমনই গোয়েন্দার কখনও সাসপেক্টকে বিয়ে করতে নেই। বিয়ে করতেই
নেই। শার্লক হোম্সকে বিয়ে করতে দেখেছেন? এত যে সেই আইরিন অ্যাডলার
নামে মহিলার প্রেমে পড়েছিল, তবুও তাকে বিয়ে করেনি।
পাঠককে উৎসুক শোনায়। ব্যাপারটা তাহলে সত্যি? শার্লক হোম্স আইরিন
অ্যাডলারের প্রেমে পড়েছিলেন?
এ-ব্যাপারে আর দ্বিতীয় কথা না-বলার বিষয়ে আমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কার কাছে?
কার আবার! হোম্সের কাছে।
শার্লক হোম্সকে আপনি চিনতেন?
শুনুন, এর জবাবও দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, এর পর আপনি জানতে চাইবেন
উনি এখন কোথায় আছেন। সেটা বলে দিলে হোমসের জীবন বিপন্ন হতে পারে।
মরিয়ার্টির চ্যালাচামুণ্ডারা শুধু নয়, হলিউডি প্রযোজক, পরিচালকরা
পর্যন্ত ওকে স্বস্তিতে বাঁচতে দেবে না। তারপর বলিউড যে ওকে কী
ব্যাং-নাচ নাচাবে! ব্যোমকেশের হাল দেখে রীতিমতো ব্যোম্কে আছি।
সুশান্ত রাজপুতের অশান্ত নৃত্যের পর ব্যোমকেশের কাছে রহস্য তদন্তের
চেয়ে মাচায় পারফরমেন্সের প্রস্তাব শুনছি বেশি আসছে। আজকাল সত্যান্বেষীকে
হোয়াট্স-অ্যাপ করে জবাব পাই না। বেচারি কোথায় যে লুকিয়ে আছে।
কোথাও লুকিয়ে নেই। বলিউডে শুটিং করে সময় পাচ্ছেন না সম্ভবত, তাই
আপনার মেসেজের জবাবে পালটা হোয়াট্স-অ্যাপ করতে পারছেন না।
আই সি! খুব দুঃখের কথা।
কোনটা?
এই যে আপনারা নতুন কোনও গোয়েন্দা তৈরি করতে পারছেন না। পুরোনোকে
নিয়ে টানাটানি কেন? নাচিয়ে গোয়েন্দা চাই তো তেমন একটা নতুন বানিয়ে
ফেলুন টেস্ট টিউবে বা ইউ টিউবে। এই তো লেখক হাজির আছেন ঝোলা কাঁধে।
আমি নাচ জানি না।
দূর্ মশায়! আপনি জাস্ট লিখবেন আপনার গোয়েন্দা নাচে ভাল। তারপর
সে কী নাচে সে দেখে নেবে ড্যান্স ডিরেক্টর।
তা বটে!
শার্লক তো ভয়ে সিঁটিয়ে আছে।
কেন?
সাম্প্রতিকতম হলিউডি ছবিতে না কি তার হোমোসেক্সুয়াল ট্রেট দেখা
গেছে।
গেছে তো গেছে। হোমোসেক্সুয়ালিটি এখন স্বীকৃত যৌনাচার।
তাতে শার্লকেরও কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু, যে যা নয় তাকে তা-ই বলা
কি চলে?
নয় মানে! ড. ওয়াটসনের বিয়েতে ওঁর ঘোরতর আপত্তি ছিল। কেন?
আপত্তি কোথায় দেখলেন?
কেন, রবার্ট ডাউনি জুনিয়র আর জুড ল অভিনীত প্রথম সিনেমাটিতেই।
ওটা সিনেমা। গাই রিচি পরিচালক। ওই গল্পের লেখক আর্থার কোনান ডয়েল
নন। আর হোমোসেক্সুয়াল ট্রেট দেখা গেছে মার্ক গ্যাটিস পরিচালিত
ছবিতে যেখানে শার্লকের ভূমিকায় অত্যন্ত অবিশ্বস্ত অভিনয় করেছেন
বেনেডিক্ট কামবারব্যাচ।
আ রে, আপনি বুঝছেন না, এ হল গল্পের যুগোপযোগী সংস্করণ। ছবিগুলি
ভাল ব্যাবসা করেছে।
করেছে তো ওই শার্লকের নাম ভাঙিয়ে। কপিরাইট শেষ হওয়া কাজগুলোতে
বাটপার খাবলা মেরে বলে বিনির্মাণ! চোরের মায়ের বড় গলা, বলে, লেখক
মৃত! মৃত হলে তাকে নিয়ে আজ টানাটানি করতিস!
শুনুন, এসব লিটারারি কিংবা কালচারাল ক্রিটিক আপনি বুঝবেন না। গোয়েন্দারা
চলে যুক্তির চালে, সবেতেই গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ খোঁজে, সবেতেই প্যাটার্ন,
তারা ফরএভার মডার্ন। পোস্ট-মডার্ন থিওরি বোঝা ডিটেকটিভের কম্ম
নয়।
বটে! তাহলে উমবের্তো একোর ‘নেম অফ দ্য রোজ’এর গোয়েন্দা ব্রাদার
উইলিয়াম অফ বাস্কারভিলকে কী বলবেন? ওরহান পামুকের ‘মাই নেম ইজ
রেড’ উপন্যাসটি কি তাহলে যথেষ্ট উত্তর-আধুনিক নয়? যত্তসব! এই উত্তরোত্তর
আধুনিক যুগেও হোমস কীভাবে জলজ্যান্ত বেঁচেবর্তে আছে তার ব্যাখ্যা
আপনাদের পণ্ডিতেরা দিতে পারবেন? দেখব, আজ থেকে একশো বছর পরে ব্রাদার
উইলিয়াম কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন।
শার্লক হোম্স বেঁচে আছেন!
নেই? বইয়ের দোকানে গিয়ে দেখুন, পাবলিক লাইব্রেরিতে, পাঠকের ঘরে
– অগ্যুস্ত্ দ্যুপ্যাঁ, শার্লক হোম্স, এরকুল পোয়ারো, মায় বাঙালির
দেবেন্দ্রবিজয়, ব্যোমকেশ সবাই যে দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে তার প্রমাণ
বইয়ের তাকে একরাশ সাজিয়ে রাখা আছে।
ও! পাঠক হাসেন। লেখকও। আপনি মেটাফরিক্যালি বলছেন! গল্পের মধ্যে
ওঁরা বেঁচে আছেন।
গোয়েন্দা শক্ত মুখে তাকান দু’জনের দিকে। আপনারা এই মুহূর্তে কোথায়
আছেন বলে ভাবছেন?
কোথায়?
এক গোয়েন্দা গল্পের মধ্যে, যার শেষে কী হবে কেউ জানে না।
লেখক ফুকরে ওঠেন, হোটেলের লোকটার চোখ অমন শেয়ালের মতো দেখাচ্ছিল
কেন তার সমাধান তো এখনও হল না? উত্তেজিত পাঠকও জানতে চান, ওর দাঁতে
অমন হাসি ঝলকাল কেন?
সেটা আর দেখতে দিচ্ছেন কোথায়! হাবিজাবি কথা বলে আমার চিন্তার সূত্রগুলিকে
আপনারা বিঘ্নিত করছেন। এই জন্য পই পই করে বলি, আমাকে চিন্তামগ্ন
দেখলে কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে। সে কথা শুনলে তো। কপালগুণে জুটেওছে
একটা হাঁদাগঙ্গারাম লেখক!
লেখক নতমস্তক, অপরাধীর মতো নখে নখ খোঁটেন। পাঠকও জ্বলন্ত চোখে
চান তাঁর দিকে। পরের বইমেলায় বই আর একটাও বিকোবে না বুঝতে বাকি
থাকে না লেখকের। এক, ব্যাটা গোয়েন্দা যদি কোনওক্রমে হৃতসম্মান
পুনরুদ্ধার করে দিতে পারে। সেইজাতের একটা অনুরোধ করবেন বলে মুখ
খুলতে যেতেই গোয়েন্দা ঠোঁটে আঙুল তুলে শাসান – শ্ শ্ শ্! পরমুহূর্তে
নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে এক টানে দরজা খুলে ফেলেন। ঘরের মধ্যে দড়াম
করে আছড়ে পড়ে একটি দেহ। না, মৃত নয়। পরিচারক জীবিত। সে হাঁচড়পাঁচড়
করে উঠে মেঝেয় বসে জুলজুলিয়ে চায়। তাকে পেরিয়ে হোটেলের অতিথি ঘরের
বাইরে পা রাখেন। তৎক্ষণাৎ পাশের ঘরের দরজা দমাস্ করে বন্ধ হয়।
অতিথি ঘরে ফিরে এসে দরজা বন্ধ করে কড়া গলায় প্রশ্ন করেন, দরজার
বাইরে কান পেতে দাঁড়িয়েছিলে কেন? মতলব কী তোমার?
পরিচারক ককিয়ে ওঠে। কোনও মতলব নাই, আজ্ঞা। আপনাদের ঝগড়া শুনে ভাবছিলাম,
কী হল!
আমাদের মানে! ক’জনকে তুমি এই ঘরে দেখছ?
এখন কেবল আপনাকেই। কিন্তু আজ্ঞা, আমি মনে হল বাইরে থেকে ভিতরে
তর্কাতর্কির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। পরিচারক ঘরের মধ্যে ইতিউতি
উঁকি দেয়।
কী, আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখছ?
আজ্ঞা না।
কিন্তু, তুমি ঠিক শুনেছ। আমরা তর্কই করছিলাম। আমরা তিন জন।
আর দু’জন তাহলে কোথায় গেল?
ভেগেছে।
কখন ভাগল?
তুমি ঘরে পা রাখা মাত্র।
আশ্চর্য! কেন?
কারণ, তুমি গল্পের ভিতরের লোক, হয়তো একজন খুনি।
কী বলছেন, বাবু! আমি খুনি?
একশো শতাংশ। লেখক লিখে ফেলেছেন যে তোমার মুখটা শেয়ালের মতো ধূর্ত
এবং তোমার দেঁতো হাসিতে মিশে আছে নৃশংসতা। পাঠক সেটা পড়েও ফেলেছেন।
কাজে কাজেই ইতিমধ্যেই সাব্যস্ত যে, হয় তুমি খুনি কিংবা তার স্যাঙাত।
বললেই হল! কই, সেই লেখক আর পাঠক লোকদুটো গেল কোথায়?
বললাম যে, কেটে পড়েছে।
কেন?
লেখক গল্পটা লিখে ফেলতে আর পাঠক নতুন গল্পটা পড়বে বলে।
আপনিও ওদের সঙ্গে গেলেন না কেন?
কারণ, তোমারই মতো আমিও গল্পের ভিতরের লোক। তাছাড়া, এই খুনের সঙ্গে
যে তোমার কোনও যোগ নেই, আসল খুনি অন্য কেউ, সেটা প্রমাণ করে উপন্যাসের
শেষে চমক দেওয়ার কাজটা এখনও বাকি আছে।
কে খুন হল?
এখনও হয়নি। হবে।
কে?
কে আবার, লেখক।
বলেন কী! লেখক নিজেই খুন হয়ে যাবে?
উপায় নেই। ইদানীং সেটাই দস্তুর। একটা না ভেঙে অন্য একটা কিছু আজকাল
গড়া যায় না। একজন না মরলে অন্য একজন জন্মাতে পারে না। নতুন রাস্তা
তৈরি না করে পুরোনো রাস্তারই রং ফিরিয়ে তার নতুন নামকরণ করাই এখন
নিয়ম। কলকাতা রোজ বাড়ছে, তবু বিনয়-বাদল-দীনেশের নাম রাখতে ডালহাউসিকে
কবরস্থ করা প্রয়োজন, লর্ড ওয়েলিংটন শুড মেক ওয়ে ফর রাজা সুবোধ
মল্লিক, ল্যান্সডাউন ফর শরৎ বোস ...
তা হয়তো হবে। জনসংখ্যা বাড়ছে, অথচ পৃথিবী তো আর বাড়ছে না। এভারেস্টের
পথে ট্র্যাফিক জ্যাম দেখে ম্যালোরিও হয়তো আর সেখানে উঠতে চাইতেন
না। সৃজনের বিরল উপাদানগুলি ক্রমশ কমে আসছে। ভিড়ে ভরা হাটেবাজারে
চোরাগোপ্তা খুন-জখম তো বাড়বেই। কিন্তু, খুনটা করবে কে?
সন্দেহের তালিকায় অনেকেই আছে। কিন্তু, তদন্তের খাতিরে তদন্ত শেষ
না হওয়া পর্যন্ত আসল খুনির পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না।
অতঃপর
তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। পাঠক হিসাবে গোয়েন্দা গল্পের বিশেষজ্ঞ আমি
নই। পড়াশুনো অত্যন্ত সীমিত। লেখক হিসাবে সীমাবদ্ধতা আরও বেশি।
প্রকাশিত গোয়েন্দা উপন্যাসের সংখ্যা একটি, বড় গল্প একটি এবং ছোট
গল্প একটি। অথচ, বছর দেড়েক আগে এক বিখ্যাত লেখিকা কথায় কথায় আমায়
বললেন, আপনি তো থ্রিলার লেখেন! তখন অবশ্য ‘গজপতি নিবাস রহস্য’
দেশে ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে। তাই বলে আমি থ্রিলার লেখক হয়ে
গেলাম! গোয়েন্দা উপন্যাস লিখে কি আমার পরিচিতি বাড়ল? পুরোনো লেখক
কি মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই? এই প্রশ্নেরই উত্তর অনুসন্ধানের
বিবরণ পূর্বেই তাই দিয়ে রাখলুম।
চল্লিশ বছর বয়সে লিখতে শুরু করেছি। প্রথম প্রকাশিত লেখা একটি
ছোট গল্প, প্রোমোটারের লোক, দেশ পত্রিকার ৫ই সেপ্টেম্বর ২০০৫ সংখ্যায়
প্রকাশিত হয়। বোধহয় কমই লিখি। তবুও, গত দশ বছরে আমার উপন্যাস প্রকাশিত
হয়েছে দশটি, গল্প গোটা বিশেক, নন-ফিকশন গুটি তিন। এসবের ভিড়ে মাত্র
একটি গোয়েন্দা উপন্যাস লিখে ২০১৬ সালে হয়ে গেলুম থ্রিলার লেখক!
একেই বলে কামাল করা। এরপর প্রত্যাশিত আত্মস্বরে কেয়াবাত!
ভাববার বিষয়। থ্রিলার কাকে বলে এবং থ্রিল কী ও কয় প্রকার, এই
প্রশ্নের সর্বসম্মত জবাব পাওয়া বোধহয় সম্ভব নয়। তবুও, যেভাবে মোটা
দাগে কিছু সাহিত্যকে থ্রিলার দাগানো হয়ে থাকে, তেমনই মোটা বোধে
কিছু চিন্তার উৎস খোলার চেষ্টা করা যেতে পারে। থ্রিলারের পাঠকসংখ্যা
সম্ভবত আর সব জাতের গল্প বা উপন্যাসের তুলনায় বেশি। সাহিত্যতত্ত্বে
আমার বিন্দুমাত্র দখল নেই। যতদূর জানি, দেশজ সংস্কৃত সাহিত্যতাত্ত্বিক
রসবিভাজনে থ্রিলার বলা যাবে এমন কোনও রস আলাদা করে উপস্থাপন করা
হয়নি। কারুণ্য, বাৎসল্য ইত্যাদি কয়েকটি রস বাদ দিলে আর সবই নানাভাবে
থ্রিলিং। ইংরেজি তথা বিদেশি সাহিত্যে এককথায় থ্রিলারের কোনও সংজ্ঞা
আছে কি না জানি না। যতটুকু বুঝি, বিনোদনের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে
থ্রিল অন্যতম একটি। সব জাতের সাহিত্যেই এর উপস্থিতি কম-বেশি দেখা
যায়। পাঠক নানাভাবে থ্রিল্ড হতে পারেন, ভয়ে, কৌতূহলে, আনন্দে,
আশঙ্কায়। যে লেখায় আর সবকিছু ছাপিয়ে থ্রিলই থাকে প্রধান ভূমিকায়
তাকেই হয়তো বলে থ্রিলার।
যতদূর বুঝি, থ্রিলার গোত্রের সাহিত্যকে উচ্চাঙ্গের সাহিত্য মনে
করার চল নেই। পাঠক অথবা লেখক হিসাবে সাহিত্যের উচ্চ, মধ্য ও নিম্ন
আমি বুঝি না। একেবারেই জাজমেন্টাল নই। পাঠক হিসাবে শুধু বুঝি কোনটা
আমার পড়তে ভাল লাগে, কোনটা লাগে না। লেখক হিসাবেও সেটাই লিখি যখন
যেটা আমার লিখতে ইচ্ছে করে। গত বছর দশেকে এক ধরনের লেখা লিখেছি।
এখন একটু অন্যরকম লিখতে চেষ্টা করছি। নিজেকে ভাঙার মূল্য চোকাতে
হয়। আমাকেও হচ্ছে। ইতিমধ্যে, একটি গোয়েন্দা উপন্যাস লেখার ইচ্ছে
করেছিল, লিখেছিলাম। আবার ইচ্ছে করলে আবারও লিখব।
তথাকথিত মূলস্রোতের উপন্যাস, তথাকথিত মূলস্রোতের বাইরের উপন্যাস,
ডিটেকটিভ নভেল এবং সমাজবিজ্ঞান ঘেঁষা নন-ফিকশন এই চারটি ক্ষেত্রে
কলম চালানোর প্রয়াসের কারণে এই ক্ষেত্রগুলির বিষয়ে দু-চার কথা
হয়তো বলতে পারি। লেখা যে ধরনেরই হোক না কেন, তাতে মানুষের কথাই
বলা হয়, সমাজের চিত্রই ধরা থাকে। কে কীভাবে সেই কথা বলছেন, চিত্রটি
আঁকছেন তার তফাত থাকে। বিভিন্ন সম্পর্ক, তাদের ছড়ানো ডালপালা,
হাসি-কান্না, দুঃখ-আনন্দ, আশা-হতাশা, ইত্যাদি পরিবেশিত হয় লেখকের
কলমে। ভাষা, আঙ্গিক এবং দর্শনের প্রভেদে লেখার প্রকৃতিও বদলে যায়।
নিজের লেখার ক্ষেত্রে বলতে পারি, কখনও কখনও গল্পের শেষটা মনে তৈরি
থাকে, অনেকসময় আবার থাকেও না। সমাপ্তি ছকা থাক বা না থাক, লেখার
নিজের একধরণের মন, একটা গতি তৈরি হয়, যা ছকাকষা পরিণতিকে প্রায়শ
অন্তত আংশিক বদলে দেয়। তবুও, মুক্ত গদ্য বলে সম্ভবত কিছু হয় না।
কবিতাও কি তেমন মুক্ত হয়? লেখার শেষে সব লেখারই একটা ছক চোখে পড়ে।
ব্যাকরণ ভাঙাও দাঁড়িয়ে যায় এক ধরনের ব্যাকরণ। তার উপর এক-একজনের
এক-একরকম ভাষা, এক-একরকম শব্দের ভাণ্ডার, এক-একরকম শব্দের প্রয়োগ।
প্রকাশক, সম্পাদক ও সমালোচকেরা কীভাবে সাহিত্যের জঁর বিভাজন করেন
তা আমার অজানা, বুদ্ধিরও অগম্য। লেখক হিসাবে এগুলি আমার জানার
প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবুও, অনেক সম্পাদক ও প্রকাশকই এ-বিষয়ে
লেখকের মত জানতে চান। তখন ভেবেচিন্তে একটা জবাব তৈরি করতে হয়।
এ-বিষয়ে পাঠক বরং নিশ্চিন্ত। তাঁর পড়তে যা ভাল লাগবে তা-ই তিনি
পড়বেন। এই ভাল লাগা ব্যাপারটি ঘিরেও ঝড় তোলা যায়। ভাল লাগা বলতে
কী বোঝায়? মুচমুচে গদ্য? মিষ্টি প্রেমের গল্প? গায়ে কাঁটা দেওয়া
ভৌতিক কাহিনি? রুদ্ধশ্বাস মার্ডার মিস্ট্রি? ভাষার জটিল মারপ্যাঁচ?
অর্থের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অর্থ? আখ্যানের বহুস্তরী বিন্যাস? কী?
আমি বুঝি না এসবের মধ্যে ভাল ও মন্দের বিচার কীভাবে হতে পারে।
যেমন বুঝি না যে, সিরিয়াস সাহিত্য বলতে কী বোঝায়, পপুলার সাহিত্য
থেকে তাকে পৃথক করতেই হবে কেন। যা-ই লিখুন, লেখক লিখছেন পঠিত হবেন
বলে। বই বাজারেই বিকোবে। পাঠক এদিকেও আছেন, ওদিকেও। মাঝখানে সীমারেখাটা
ঠিক কার প্রয়োজন? পাঠ্যপুস্তক না হলেই কি সে অপাঠ্য?
সাধারণভাবে (বারে বারে ‘সাধারণভাবে’ শব্দবন্ধটা ব্যবহার করতে
হচ্ছে অর্থাৎ, ‘অসাধারণ’ বলেও কিছু থাকে। পাঠকের ওপরে লেখার অসাধারণত্ব
নির্ধারণের ভার ছেড়ে দিলে জ্বালা চুকে যেত। কিন্তু, তা ছাড়া হয়
না) থ্রিলারকে সিরিয়াস সাহিত্যপদবাচ্য ধরা হয় না। গোয়েন্দাকাহিনিকে
থ্রিলারের সাব-জঁর মনে করা হয়। সুতরাং, গোয়েন্দাকাহিনি সিরিয়াস
সাহিত্য নয়।
সিরিয়াস লিটারেচার ও পপুলার লিটারেচারের মধ্যে একটা প্রভেদ সম্ভবত
এইভাবে ভাবা যেতে পারে – যা সিরিয়াস তা কখনও পপুলার নয়, এবং/সুতরাং
যা পপুলার তা সিরিয়াস হতে পারে না। বাংলায় এই দৃষ্টিভঙ্গিটি খুব
সিরিয়াসভাবে পপুলার। এককালে শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর লেখা
নিয়ে যে কর্দমাক্ত কাজিয়া চলেছে দীর্ঘদিন, তাতে তাঁর জনপ্রিয়তার
হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেছে কি না জানি না। কিন্তু, আশা ছিল এর ফলে বাংলায়
সিরিয়াস সাহিত্য বাড়বে। কতটা বেড়েছে সেই চিত্র সামনে পড়ে আছে।
প্রসঙ্গত, সিরিয়াস সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি তার প্রায় সবই বিদেশি
এবং সেগুলি আমরা ইংরেজিতে পড়ি এবং সেগুলির লেখকেরা প্রায় সকলেই
জনপ্রিয়। অনুচ্ছেদের শুরুতেই তাহলে ছিল লজিক্যাল ফ্যালাসি!
ঠিক আছে। কোনও ব্যাপার না। সিরিয়াস লিটারেচার ও পপুলার লিটারেচারের
মধ্যে একটা মোক্ষম প্রভেদ আছে। বটে! কী সেটা? না, সিরিয়াস লিটারেচার
পড়তে হয় মগজ দিয়ে আর পপুলার লিটারেচার পড়া হয় হৃদয় দিয়ে। ছুরি
দিয়ে ঠিক কোন ভাঁজ বরাবর চিরে দিলে মগজ ও হৃদয় আলাদা হয়ে যায় আমি
অন্তত জানি না। রোবটদের শুনেছি মগজ থাকে কিন্তু হৃদয় থাকে না।
সেক্ষেত্রে, সিরিয়াস লিটারেচারের সবচেয়ে ভাল লেখক ও পাঠক রোবটদের
মধ্যেই পাওয়া সম্ভব। আমি জানতাম, শিল্পের সৃজন ও সমঝের ক্ষেত্রে
হৃদয় বস্তুটা জরুরি। তা নয় দেখছি।
বেশ। গোয়েন্দাকাহিনিতে গোয়েন্দার কোন্ জিনিসটা সবচেয়ে বেশি জরুরি?
সত্যজিৎ বলে গেছেন, মগজাস্ত্র। গোয়েন্দাকাহিনির গোয়েন্দার সঙ্গে
লেখক এবং পাঠক দুজনেই মগজ ব্যবহার করে চলেন। লেখক লেখার সময়, পাঠক
পড়ার সময়। গোয়েন্দাকাহিনির আকর্ষণের একটি কারণ সম্ভবত এই মগজে-মগজে
হাত ধরাধরি। এতৎসত্ত্বেও, গোয়েন্দাগল্প সিরিয়াস লিটারেচার নয়।
তাতে গোয়েন্দার বিন্দুমাত্র অভিমান নেই। গোয়েন্দাগল্প জীবনে যিনি
একটাও লিখেছেন কিংবা লেখার চেষ্টা করেছেন, তিনি জানেন কাজটা কী
দাবি করে।
যে ধরণের লেখাই লিখুন না কেন, প্রতিটি লেখককেই কমবেশি গোয়েন্দাগিরি
করতে হয়। অন্য এক বা একাধিক মানুষের জীবন নিয়ে গল্প বা উপন্যাস
লিখতে যে যতই গবেষণা করুন, তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তিনি
নিজে যাপন করেননি। সুতরাং, শব্দবিস্তারের পথে বিস্তর ফাঁক দেখা
দেয়। চোখে দেখা, কানে শোনা, হৃদয়ের অনুভূতি আর মগজের প্রয়োগে সূত্রানুসন্ধান
করে ফাঁকগুলি ভরাট করতে হয়। ফাঁক থাকে বলেই সৃজনশীলতার অবকাশ থাকে।
এই ফাঁক ভরাট করার কাজে যাকে যত বেশি বিশ্বস্ত দেখায় তিনি তত বড়
গোয়েন্দা, হয়তো বড় লেখকও। ভ্রমণকাহিনিগুলির কথা ভাবা যেতে পারে।
হিমালয়ের কথা লিখেছেন জলধর সেন, প্রবোধকুমার সান্যাল, সুবোধ চক্রবর্তী,
উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শঙ্কু মহারাজ এবং আরও অনেকে। তবুও প্রতিটি
বৃত্তান্ত আলাদা, প্রতিটিতেই হিমালয় দেখা দেয় ভিন্ন রূপে। ‘মণিমহেশ’
পড়তে গিয়ে মনে হয় না এই সবই তো ‘হিমালয়’এ জানা হয়ে গেছে। অথচ,
ইস্কুলের ভুগোল বই থেকেই তো সকলের পরিচয় ঘটে হিমালয়ের সঙ্গে। নিজেও
হিমালয় দেখেছি কয়েক বার। তবুও, অন্যের লেখা বারবার পড়ি, বারবার
দেখি অন্যের চোখ দিয়ে, প্রতিবারই নতুন রহস্যের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন
অনুভবের আবিষ্কারে শিহরিত হই।
গোয়েন্দা কাহিনি যদি শুধু খুন, জখম, নিরুদ্দেশ, চুরি, ডাকাতি,
ব্ল্যাকমেল ইত্যাদি রহস্য ও সেগুলির সন্তোষজনক সমাধান বা হতাশাজনক
ব্যর্থতার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ হত তবে কেবল খবরের কাগজ পড়লেই চলত।
কখনও কখনও মানুষ খুন হয় জানা কথা। খুনির বিষয়ে মনস্তাত্ত্বিক অজস্র
গবেষণা আছে। খুন ও খুনি সম্পর্কে কৌতূহল মেটাতে সেগুলি পড়া উচিৎ।
সেগুলি পড়ুন বা না পড়ুন, পাঠক গোয়েন্দাগল্প পড়েন, লেখক বিশেষজ্ঞ
মনস্তত্ত্ববিদ নন জেনেও পড়েন। পাঠকদের কাছ থেকে পাওয়া পাঠপ্রতিক্রিয়ার
ভিত্তিতে গোয়েন্দা গল্পের পাঠকদের মধ্যে আমি অন্তত দুটি দল দেখতে
পাই। এক দল গল্পে ছড়ানো সূত্র ও তার ভিত্তিতে গোয়েন্দার সমাধানপদ্ধতির
দিকে কড়া নজর রাখেন, আর এক দল সূত্র ও সমাধানের খুঁটিনাটির দিকে
তত দৃষ্টি দেন না। দুই দলের কাছেই লেখাটি উপভোগ্য হওয়া জরুরি।
তথাকথিত বাস্তবের মাটি ছেড়ে কল্পনার ডানায় ভর করে উড়ান দেওয়ার
অবকাশ গোয়েন্দা গল্পে কম থাকে। কিন্তু, একেবারে থাকে না তাও নয়।
সামনের সবটা চোখে ধরা পড়ে না। দৃষ্টিভঙ্গির কিংবা দৃষ্টিকোণের
তফাতের কথা ছেড়েই দিলাম, দেখার জন্য প্রয়োজন হয় আলো। আলো না থাকলে
চোখের ভূমিকা শূন্য। আলো থাকলেই ছায়াও থাকে। ছায়ার পিছনে কী আছে
দেখতে বাড়তি উদ্যোগ নিতে হয়। আলোয় দাঁড়িয়ে অন্ধকারও ঘন মনে হয়।
আলোর ফোকাস বদলে অন্ধকারে তাক করলে আগের আলোকিত অংশে অন্ধকার নামে।
আলো আর অন্ধকারের অনির্ধারিত সীমানায় বাসা বাঁধে বহুরূপী কল্পনা।
তাই, এক ব্যক্তির নির্বাচিত শব্দে যে গোয়েন্দা গল্প লেখা হয় সেটাই
তদন্তে শেষ কথা নয়। গোয়েন্দা কাহিনির লেখকেরা গোয়েন্দা হিসাবে
সফল হন না, গোয়েন্দারাও সফল হন না গোয়েন্দা কাহিনি রচনায়। বাস্তবের
মোড়কে পেশ করা গোয়েন্দা গল্প আসলে বিশুদ্ধ কল্পনা। অশুদ্ধ বাস্তবও
বলতে পারেন। একেই বলে শিল্প। যেদিন মানুষ রোবট হবে, যদি কোনওদিন
হয়, সমস্ত শিল্পের সঙ্গে গোয়েন্দা কাহিনির ধারাও শেষ হবে। বাস্তবে
ভেজাল মেশানোই শিল্পীর কাজ। কিংবা, ভেজালে বাস্তব মেশানো। যেভাবে
দেখবেন, ভেজাল বাস্তব কিংবা বাস্তবিক ভেজাল। তবে, কল্পনা যেহেতু
বাস্তবজাত হয়েও বাস্তব নয়, আর পাঁচটা গল্পের মতো গোয়েন্দা গল্পও
তাই নির্ভেজাল অবাস্তব। শিল্পের প্রতি মানুষের ভালবাসা এবং পক্ষপাতিত্ব
যতটা তথাকথিত সিরিয়াস সাহিত্যে ধরা থাকে, তার চেয়ে বেশি না হলেও
ততটাই ধরে রাখে রহস্য গল্প। রহস্য গল্পের মধ্যে গোয়েন্দা গল্পের
জায়গা আলাদা। রহস্যে মানুষ অভিভূত হয়। খানিক ধাতস্থ হলে রহস্যভেদ
করতে চায়। অন্তত, বিশ্লেষণ করে বুঝতে চায় ঘটনার গতিপ্রকৃতি। নিজের
পরিপ্রেক্ষিতে চারপাশ অথবা, চারপাশের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে – বোঝাপড়ার
এই আদিম তবুও অনন্ত প্রবণতার স্পষ্ট উচ্চারণই হয়তো আর সব গল্প,
এমনকী অন্যান্য রহস্য গল্পের থেকেও আলাদা করে গোয়েন্দা গল্পকে।
“আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না।” গোয়েন্দা গল্পও বেঁচে থাকবে
যতদিন না সবাই সব কিছু জেনে যায়।
যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। কেউ জানে না কাল কী হবে। জানলে, বেঁচে
থাকার অন্তত বারো আনাই দাঁড়িয়ে যেত জোলো। রহস্যে মোড়া আগামীর আশা
ও আশঙ্কায় যা নিয়ত দোলে, তারই নাম জীবন। তারই এক রঙিন আংশিক প্রতিচ্ছবি
দুই মলাটে পেলে মানুষ রুদ্ধশ্বাস তাকে পড়ে ফেলতে চাইবে তাতে আশ্চর্য
কী! সুতরাং, গোয়েন্দা গল্প একজাতের রহস্য গল্প হওয়ার কারণে তাতে
রহস্যের জমাট নির্মাণ জরুরি, সেটা প্রাইমারি। রহস্যভেদে প্রয়োজনীয়
সূত্রগুলি সামনে ফেলেও আড়ালে রাখার কেরামতিও জরুরি, সেটাও প্রাইমারি।
এগুলির প্রয়োজন প্রথম প্রকাশেই পাঠককে চমকে দিতে বা, অভিভূত করতে।
তারপর একদিন পাঠক চমক কাটিয়ে উঠবেন, অভিভূতি অতীত হবে। অনেক গল্পই
মন থেকে হারিয়ে যাবে। অথচ, কিছু গল্প পাঠক ফিরে ফিরে পড়বেন। পড়া
গল্প, সবই তো জানা, রহস্যের টান তো আর নেই। তবুও পড়বেন। এইভাবে
বারে বারে যেগুলি পড়া হয়, শতাব্দীর স্রোতে হারিয়ে যায় না, সেইসব
গোয়েন্দা গল্পে রহস্যের পাশাপাশি থাকে আরও কিছু, সেগুলি সেকেন্ডারি।
এমনই সেকেন্ডারি যা ক্রমশ প্রাইমারিকে ছাপিয়ে লেখার নিশান হয়ে
দাঁড়ায়। খাওয়া, শোওয়া, ওঠা, বসা, ইস্কুল-কলেজে শিক্ষিত হওয়া, কর্মযোগ্যতা
অর্জন করা, উপার্জন করা, এই প্রাইমারি সবকিছুর পাশে গল্প লেখা
ও গল্প পড়া নিতান্তই অকেজো সেকেন্ডারি। গুহামানবও এই অকেজোর খোঁজে
এঁকে গিয়েছে গুহাচিত্র। অকেজোর এই খোঁজ সম্ভবত মনুষ্যত্বেরই একটি
মাত্রা। যে লেখক সেই মাত্রা ছুঁতে পারেন তাঁর লেখা থেকে যায়।
পড়া গোয়েন্দা গল্পগুলির কথা যখন ফিরে ভাবি, সেগুলিতে বর্ণিত রহস্য
এবং রহস্যভেদের পদ্ধতি আজ আর তত মনে পড়ে না। এডগার অ্যালান পো’র
গোয়েন্দা গল্পের কথা ভাবলে মনে আসে তাঁর গোয়েন্দা অগ্যুস্ত্ দ্যুপ্যাঁর
আপাত উৎকেন্দ্রিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং ঊনবিংশ শতকের ইউরোপ
বিশেষত, প্যারিসের ছবি। ফরাসি ভদ্রতা, শিল্পবোধ, ভেঙে পড়া সামন্ততন্ত্রের
রেশ। আর্থার কোনান ডয়েলের গোয়েন্দা গল্প মনে পড়লে দেখি পাশাপাশি
দাঁড়িয়ে শার্লক হোম্স আর ড. ওয়াটসন। ছবির মতো ভাসে ঊনবিংশ শতকের
শেষার্ধের ইউরোপ বিশেষত, ইংল্যান্ডের ছবি। লন্ডনের অলিগলি, লিভারপুলের
বন্দর, ইংল্যান্ডের শহরতলি, গ্রাম; আর্ল, ব্যারনদের জমিদারির ধ্বংসাবশেষ,
ব্রিটিশ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ, ঔপনিবেশিক ঐশ্বর্যের আঁচে প্রতিভাত
নতুন বড়লোক, ভারত-ফেরত লর্ডদের কেতা, আমেরিকার সঙ্গে পাঞ্জার লড়াইয়ের
শুরু। আগাথা ক্রিস্টি ভাবলে মনে পড়ে এরকুল পোয়ারো এবং মিস মার্পল
আর বিংশ শতকের দুটি অর্ধে বদলে যাওয়া ইউরোপীয় দস্তুর, মোটরগাড়ি,
ক্রোম প্লেটিং, ফ্ল্যাট সংস্কৃতি আর ভ্রমণের প্যাকেজ ট্যুরের সূত্রপাত।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প মনে পড়লে বিংশ শতকের প্রথমার্ধের
কলকাতার রাজপথে দেখি আপাদমস্তক ভদ্রলোক বাঙালি সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ
বক্সীকে। তৎকালীন বাঙালি সমাজ, সম্পর্ক এবং বাঙালিয়ানার টুকরো
ছবি ফুটে ওঠে গল্পগুলিতে। এঁদের পাশে ফেলুদার উল্লেখ করতে কিঞ্চিৎ
দ্বিধাবোধ করছি। ফেলুদার গল্পে কলকাতা আছে, কাঠমান্ডু, বারাণসী,
বোম্বাই আছে। কিন্তু, এই সব শহর তথা ভারতের ৭০-৮০ দশকের সমাজচিত্র
বড় একটা নেই। ফেলুদার গল্পে বারংবার মগজাস্ত্রের উল্লেখ থাকলেও,
তার প্রয়োগের নিদর্শন হাতে গোনা কয়েকটি গল্প ছাড়া আর কোথাও আমার
চোখে অন্তত পড়েনি। এর কারণ হয়তো এই যে, সত্যজিৎ মূলত কিশোরদের
জন্য এই গল্প ও উপন্যাসগুলি লিখেছিলেন। চলচ্চিত্র পরিচালনা ও সম্পাদনার
ব্যস্ততার মাঝে দ্রুত লেখা গল্প ও উপন্যাসগুলিতে তাই সিনেমাটিক
গতি আছে, সামাজিক গভীরতা নেই। ফেলুদার গল্পগুলি থ্রিলার হলেও,
গোয়েন্দা গল্পের সারিতে তাদের বেশিরভাগকেই আমি খুঁজে পাই না। এইসবের
মাঝখানে বাঙালি আরও অনেক লেখক গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন। তাঁদের অনেকেই
নিজের সময়ে তুমুল জনপ্রিয় ছিলেন যেমন, পাঁচকড়ি দে, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়,
দীনেন্দ্রকুমার রায় প্রমুখ। শ্রদ্ধেয় সুকুমার সেন একগুচ্ছ গল্প
লিখেছিলেন মহাকবি কালিদাসকে গোয়েন্দার ভূমিকায় রেখে। গল্পগুলি
জনপ্রিয় হয়নি। পণ্ডিত গবেষকের উপস্থাপিত প্রাচীন ভারতের ছবি হয়তো
মনে ধরেনি পাঠকের। অথচ, মুখে মুখে চলে আসা বীরবল, গোপাল ভাঁড় ও
মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্পগুলি আজও জনপ্রিয়। এই গল্পগুলির মধ্যে
অনেকগুলিই গোয়েন্দা গল্পের ছাঁদে বর্ণিত। গল্পগুলিতে বাদশাহী দরবার,
শাহী শাসন, সামন্ত রাজা, সাধারণ প্রজা, ব্রাহ্মণ পুরোহিত, মুসলমান
কাজি, মোটের উপর বিগত সময়ের সমাজ ব্যবস্থার ছবি পাওয়া যায়। আড্ডার
ফেরে মোল্লা নাসিরুদ্দিনের বঙ্গীভবন এতটাই ঘনীভূত যে, তাঁকে ইরান,
আরব বা তুরস্কের মানুষ বলে আর মনে হয় না। বরং, মনে হয় যেন চুটুক
দাড়ি, মাথায় টুপি, লুঙ্গিপরা মানুষটিকে ছেলেবেলায় ঠাকুর্দার সঙ্গে
হুঁকো হাতে আড্ডা দিতে দেখেছি।
গল্প ও উপন্যাসের পাঠক কমে গেছে বলে নিয়মিত খেদোক্তি শুনি। এর
কারণও আলোচিত হয়। মানুষের হাতে আজ সময় কম। গিন্নিরা যারা নিয়মিত
দ্বিপ্রহরে গল্পের বই বুকে বিছানা আশ্রয় করতেন তাঁরা আজকাল কর্তার
সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দশটা-পাঁচটা আপিসে ফাইল কাবার করেন। সন্ধেয়
বাড়ি ফিরেই টিভি খুলে বসেন। টিভিটা বইয়ের বড় প্রতিযোগী। বাচ্চারাও
বই ফেলে কার্টুন দেখে। - সবই হয়তো ঠিক। কিন্তু, আজকালকার লেখকেরাও
কি তেমন লেখা লেখেন?
লেখা আর পড়ার জগতে গণতন্ত্রের নাম স্বেচ্ছাচারিতা। পাঠক যথেচ্ছ
পড়বেন। লেখক যথেচ্ছ লিখবেন। বিশেষ করে লেখকদের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতার
অভাব চোখে পড়ে। মূলত দুটি দল দেখতে পাই। একদল বছরে অন্তত চার-পাঁচ
খানা উপন্যাস এবং কমপক্ষে পাঁচ-দশটি গল্প লেখেন। নিঃসন্দেহে তাঁরা
উচ্চমানের লেখক, নইলে এত লেখার ডাক পেতেন না। কিন্তু, প্রতিটি
ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে যা লিখিত হয় তার বেশিটাই চর্বিতচর্বণ। বেশিরভাগই
টিকে থাকার তাগিদে লিখে চলেন। কলম যতদিন চলছে ততদিন টিকবেন। কলম
যেদিন থামবে সেদিন পিছনে তাকিয়ে একরাশ অন্ধকার ছাড়া কিছু চোখে
পড়বে না। পাঠক এঁদের লেখা নিচ্ছেন, পত্র-পত্রিকার পাতায়। একশো
টাকায় পাঁচটি উপন্যাস, সঙ্গে একাধিক গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ। টাইম
পাস। বছর খানেক পরে ঝালমুড়ির ঠোঙা। পাঠক ঘটিগরম গিলছেন কারণ, বর্তমানে
এর চেয়ে ভাল কিছু মিলছে না। এই পাঠকদের আম-পাঠক বলে অভিহিত করার
চল আছে। দ্বিতীয় দল স্বঘোষিত সিরিয়াস লেখা লেখেন। এঁরা শিল্প ও
পাণ্ডিত্য সমার্থক বোঝেন। এঁদের খাস (আমের বিপরীত) পাঠকগোষ্ঠী
আছে। দুই দলই পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিগড়ে বাঁধা (যদিও দ্বিতীয় দলটি
থেকে থেকেই সমাজবাদী চাদরে গা ঢাকেন। পাণ্ডিত্য আর বামপন্থা কেন
যেন শপিং ম্যলেও সমার্থক)। এক দল মাস প্রোডাকশনের পশরা নিয়ে, আর
এক দল এক্সক্লুসিভিটির ব্যানার উড়িয়ে। প্রথম বাজারটি তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক,
দ্বিতীয়টি একচেটিয়া কারবার না হলেও ওলিগোপলিস্টিক, বিভিন্ন গোষ্ঠীর
বিবিধ ঘোঁটে ভরা। আত্মজীবনী ও ভ্রমণসাহিত্যের বইগুলি বাজারে বরাবরই
ভাল বিকোয়। অর্থাৎ, এগুলি জনপ্রিয়। তাহলে কি এগুলির সাহিত্যমূল্য
নেই? ভেবে দেখা দরকার যে, বাংলা বাজারে সিরিয়াস বিশ্বসাহিত্য এত
বিকোয়, এত তার পাঠক, এত সমঝদার, তবু সিরিয়াস সাহিত্যিকের কেন এত
অভাব? সোজা কথাটা সোজা করে বলাই ভাল – বাংলায় যারা তথাকথিত সিরিয়াস
সাহিত্যের তরফদারি করেন তাঁরা কেউ সেই সিরিয়াস সাহিত্য রচনা করেন
না।
সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠককে আম-পাঠক বলে উল্লেখ করায় কী আনন্দ আছে, তাতে
কী উদ্দেশ্য সাধিত হয় আমি বুঝি না। একটা কথা বুঝি, সাহিত্য তার
সিরিয়াসনেস বা খাস-পাঠকের ভরসায় বাঁচে না। তথাকথিত আম-পাঠকই সাহিত্যকে
এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। এই বিষয়ে রাশিবৈজ্ঞানিক গবেষণার সময় আমার
নেই, ইচ্ছেও নেই। তবু মনে হয় বাজারে তথাকথিত সিরিয়াস সাহিত্যের
বেচাকেনার সঙ্গে তথাকথিত আম-পাঠকের খরিদ্দারির একটা ধনাত্মক সম্পর্ক
থাকা সম্ভব। অর্থাৎ, আম আর খাস ততটা আলাদা বা মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ
নয় যতটা প্রচার করা হয়। কিন্তু, এই প্রচারের ফল আত্মঘাতী হতে পারে।
সম্ভবত, হচ্ছেও। সিরিয়াসনেসের প্রচণ্ড প্রতাপে সত্যিই যদি আম-পাঠক
ক্রমশ আরও বেশি বইবাজারবিমুখ হয়ে ওঠেন তবে বইওলাকে শুধুমাত্র উৎপাদনের
ব্যয়টুকু তুলতেই বই বেচতে যেতে হবে সরকারি গ্রন্থাগারে। তারপর
গ্রন্থাগারে পাঠকের পায়ের ধুলো না পড়লে, মনে মনে বই লিখে মনেই
রেখে দিতে হবে।
লেখকের স্বেচ্ছাচারী হওয়া দরকার। যা লিখতে ইচ্ছে করে তা-ই তিনি
লিখবেন। কিছু লেখা পাঠকের পছন্দ হল না বলে অভিমানের কিছু নেই।
কিছু যদি পাঠকের পছন্দ হয় তবে লেখক ধন্য। পাঠকের পছন্দের উপর নির্ভর
করে যেমন লেখা চলে না, তেমনই পাঠকের পছন্দকে গাল পাড়াও চলে না।
এই গণতন্ত্রে লেখকের স্বেচ্ছাচারিতার পাশাপাশি পাঠকের স্বেচ্ছাচারিতাও
স্বীকৃত। ভারসাম্য তাতেই কোথাও একটা থাকে।
স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, আমাদের শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়,
প্রত্যেকেই থেকে থেকে নিজের গোয়েন্দার প্রতি নিজেই বিরক্ত হয়ে
উঠেছেন, গোয়েন্দা গল্পের কলমটি হাত থেকে নামিয়ে রাখতে চেয়েছেন
বারে বারে। পেরে ওঠেননি। শার্লক হোম্সকে পুনর্জীবিত করতে বাধ্য
হয়েছেন কোনান ডয়েল। আমরা পেয়েছি ‘দ্য রিটার্ন অফ শার্লক হোম্স’
-এর অনবদ্য গল্পগুলি। বিরক্ত আগাথা ক্রিস্টি তাঁর গোয়েন্দা এরকুল
পোয়ারোকে প্রায়ই উল্লেখ করেছেন অসহ্য অহংকারী বেঁটে বুড়ো বলে।
পাঠক তবু এই গোয়েন্দাকে ভালবেসেছে। শরদিন্দুও প্রায় দেড় দশক ব্যোমকেশ
রচনা বন্ধ রেখেও আবার ফিরিয়ে এনেছিলেন তাকে। এই গোয়েন্দারা আজও
বেঁচে আছেন পাঠকের ভালবাসায়। কেন? আগেই জানিয়ে রেখেছি যে, মাত্রই
কয়েকটি গোয়েন্দা গল্প বেরিয়েছে আমার কলমে। যদি আরও কিছু কখনও লিখি
তবুও এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না।
জবাব সম্ভবত খুঁজতে যাওয়া যেতে পারে তরুণতর প্রজন্মের কাছে। সম্প্রতি
আমি যতজন তরুণের সঙ্গে কথা বলেছি, রবার্ট ডাউনি জুনিয়র বা বেনেডিক্ট
কামবারব্যাচ অভিনীত শার্লক হোম্স তাদের কারওরই প্রায় ভাল লাগেনি।
ভাল লেগেছে আমার মতো বুড়োদের (আমি বাদে)। তাঁরা বলছেন, আহা, এটা
একটা অন্য ইন্টারপ্রিটেশন, একটা অন্যভাবে কোনান ডয়েল পড়ার প্রয়াস।
আমার মনে হয়, এটা জোয়ান ও বৃদ্ধের জেনারেশন গ্যাপের টেক্স্ট ও
কনটেক্স্ট। রবার্ট ডাউনি বা, বিশেষত বেনেডিক্ট কামবারব্যাচ বৃদ্ধস্য
তরুণী ভার্যা পর্যায়ে পড়ে যান তাহলে। আবার সেই গে টেক্স্টের অবতারণা।
মাঝে মাঝে ভাবি, বন্ধুত্ব ব্যাপারটা কি এই একবিংশ শতাব্দী ভুলতে
বসেছে! সবাই অস্কার ওয়াইল্ড! ছেলেদের মেস মানেই কি তাহলে মেসি
হোমোসেক্সুয়ালিটি? মেয়েদের মেস মানেই গুয়ি লেসবিয়ানিজম! হেটারোসেক্সুয়াল
চোখে হোমোসেক্সুয়ালিটি দেখার এই প্রবণতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে
হোমোসেক্সুয়ালিটি। সমকামিতা যে এক স্বাভাবিক যৌন প্রবণতা হতে পারে
সেই ধারণা গুলিয়ে যায় একে বিষমকামিতার মাঝে এক বৈচিত্র্য বলে পেশ
করলে।
হোমোসেক্সুয়ালিটি ইজ নট আ সাইডকিক অফ হেটারোসেক্সুয়ালিটি। হেটারোসেক্সুয়াল
স্বরে আমি এটুকুই বলতে পারি। নইলে, গোয়েন্দা গল্পের সাসপেক্টের
মতো হোমোসেক্সুয়ালিটিও রহস্যময় অপরাধপ্রবণতা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু,
বাজার বলে একটা ব্যাপার আছে, হোমোদের নয়, হেটারোদের, বুড়ো হেটারোদের।
জনপ্রিয় থ্রিলার ও গোয়েন্দা গল্পগুলি নিয়ে সিনেমা হয়েছে। একই চরিত্রে
অনেকেই অভিনয় করেছেন। আমি যখন কলেজে পড়ি, জেমস বন্ডের চরিত্রে
অভিনয় করতেন রজার মুর, খানিকটা আমাদের অমিতাভ বচ্চনের স্টাইলে।
খারাপ লাগত না। কিন্তু, পরে বন্ডের চরিত্রে আমার পছন্দ হয় শন্
কোনরিকে যিনি রজার মুরের আগে বন্ডগিরি করে গেছেন (বয়সে রজার মুরের
চেয়ে বছর কয়েকের ছোট হয়েও)। ক্লিন্ট ইস্টউডের ডার্টি হ্যারি দেখেছি
– ডু ইউ ফিল লাকি! বেশ থ্রিলিং। তারপর নব্বইয়ের দশকে যখন সদ্য
স্নাতকোত্তর পর্যায় পেরিয়ে গবেষণার জগতে এসেছি তখন দেখলাম ‘আনফরগিভন’।
মানুষের সম্পর্ক যে সব গল্পের মেরুদণ্ড, ‘পেল রাইডার’ পর্যায় পেরিয়ে
ক্লিন্ট এক ধাক্কায় বুঝিয়ে দিলেন। এত বড় এক হিরোরও প্রয়োজন ছিল
জিরো থেকে শুরু করার। আমাকে ফেসবুকে জেরেমি ব্রেট ফ্যান ক্লাবে
যোগ করেছে আমারই এক ছাত্র। অনেকেই শার্লক বনেছেন। জেরেমি ব্রেটকে
মনে ধরেছে আজকের তরুণ প্রজন্মের। এরা ক্যালকুলাস, ম্যাট্রিক্স
অ্যালজেব্রা, ফাজি লজিক ও র্যাশনাল এক্সপেক্টেশনে ওস্তাদ। পাশাপাশি
কোনান ডয়েল পড়েছে। ফরওয়ার্ড ডিলিং তত্ত্ব পড়ে যেমন, তেমনই ‘সিলভার
ব্লেজ’ পড়ে উত্তেজিত ফোন করেছে আমাকে, ইউ টিউবে গ্রানাডা টিভির
ছবিগুলি ডাউনলোড করে দেখেছে রাত জেগে। আমিও চলচ্চিত্রে শার্লক
হোম্স বলতে বুঝি জেরেমি ব্রেট, আর কাউকে নয়। এরকুল পোয়ারো! অনেকেই
করেছেন। ছবিতে পোয়ারো বলতে আমি বুঝি ডেভিড সুশে। ফেলুদা-প্রেমিক
(পুরুষ হলে আপনি যে হোমো এতে তার প্রমাণ হয় না) ভেবে দেখুন, সবচেয়ে
সেরিব্রাল বাঙালি অ্যাকটর সবচেয়ে নামি বাঙালি পরিচালকের ছবিতে
বারাণসীর মুন্সির ঘাটে খুল্লমখুল্লা টার্গেট শ্যুটিংয়ে দক্ষতা
দেখিয়ে ঠাঁই ঠাঁই গুলি চালিয়ে মগনলাল মেঘরাজকে অজ্ঞান করে ফেললেন।
কী, না জটায়ুর অপমানের বদলা নিতে। পুলিশের আধিকারিক ব্যাপার দেখে
একগাল হাসলেন। বিংশ শতকের শেষার্ধের মানবাধিকারের কর্মীরা টুঁ
শব্দটি করলেন না। এটা গোয়েন্দা গল্প? মগজাস্ত্রকে সেকেন্ডারি করে
প্রাইমারি দাঁড়িয়ে গেল আগ্নেয়াস্ত্র! ফেলুদার চরিত্রে সৌমিত্র
অত্যন্ত বিশ্বস্ত অভিনয় করেছেন। সম্ভবত, খুব সেরিব্রালরাই এভাবে
গল্পের গরু গাছে তুলতে পারেন। বাকি থাকেন ব্যোমকেশ। তাঁর দুর্ভাগ্য,
মনে রাখার মতো অভিনয় তাঁর চরিত্রে কেউ করে যাননি। সত্যজিতের চিড়িয়াখানায়
উত্তমবাবু মহানায়কের চাদর গা থেকে খুলে রাখতে পারেননি। আর বাকিরা?
একমাত্র অবাঙালি রজিত কাপুর ছাড়া আর কাউকেই ব্যোমকেশের আশপাশে
দেখি না। কিন্তু, শরদিন্দুবাবু, এরপরও আপনার ব্যোমকেশের বহু পুনর্জন্ম
হবে, তাদের হুলিয়া দেখে চমকে যাবেন না। আপনি আফটার অল মৃত। ইউ
ক্যান্ট হ্যাভ এনি সে।
মনে পড়ছে আলেকজান্ডার ম্যাককল স্মিথের ‘দ্য নাম্বার ওয়ান লেডিজ
ডিটেকটিভ এজেন্সি’এর কর্ণধার তথা এজেন্সিটির একমাত্র গোয়েন্দা
ম্মা প্রেসাস রামোত্স্বেকে। ‘টি টাইম ফর দ্য ট্র্যাডিশনালি বিল্ট’
নামে গোয়েন্দা উপন্যাসে ম্মা রামোত্স্বের ভাবনা, “উই আর বর্ন
টু বি সোসিয়েবল অ্যান্ড সিট টুগেদার উইথ আদার্স ইন দ্য শেড অফ
অ্যান অ্যাকেসিয়া ট্রি অ্যান্ড টক অ্যাবাউট থিংস দ্যাট হ্যাপেন্ড
দ্য ডে বিফোর।” গল্পে আমি আজও এই আলাপচারিতা, এই কথকতায় বিশ্বাস
করি। গোয়েন্দা গল্পে তো বটেই। এমন কোনও লেখক আছেন এই দুনিয়ায় যিনি
নিজের লেখা বাবলা গাছের ছায়ায় বসা আসরে পঠিত ও আলোচিত হচ্ছে দেখে
খুশি হন না? যদি বলি, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘ক্রনিকল
অফ আ ডেথ ফোরটোল্ড’ একটি গোয়েন্দা গল্প, চমকে যাবেন না নিশ্চয়।
যদি বলি, ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচ্যুড’ও থ্রিলারের ধাঁচে
লেখা, দয়া করে রাগ করবেন না। থ্রিলারের অবিসংবাদী সংজ্ঞা আজও নেই।
লোকায়ত জ্ঞান বরং আছে বাবলা গাছ ও নদীর সম্পর্কের বিষয়ে। সেদিনও
সূর্য পূর্বদিকে উঠেছিল, অস্তে গিয়েছিল পশ্চিমেই, এরই মাঝখানে
মধ্যাহ্নে এক গাড়িচালক আমায় বলেছিলেন, বাবলা গাছ দেখলেই বুঝবেন
নদী আছে সামনে, বাবলা আছে অথচ নদী নেই কাছেপিঠে এ হতেই পারে না।
এই অভিজ্ঞা বহুবার মিলিয়ে দেখতে দেখতে অভিজ্ঞান বনে গেছে। বাবলা
গাছের সারি দেখলেই সামনে স্রোতস্বিনী আশা করি, কখনও নিরাশ হইনি।
লেখক পরিচিতি - লব্ধ প্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক। ওঁর গোয়েন্দা কাহিনী "গজপতি নিবাস রহস্য" সম্প্রতি ধারাবাহিক ভাবে "দেশ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে । "অন্য কোনোখানে" দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত ওঁর আরেকটি ধারাবাহিক কাহিনী। এছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে বৈবস্বত, জিয়ন নদী, অনিকেত ইত্যাদি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।