বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা
বিশেষ গোয়েন্দা সংখ্যা - জানুয়ারি, ১৫, ২০১৭
ইংরেজি ডিটেকটিভ সাহিত্যে নারী গোয়েন্দা
শমীতা দাশ দাশগুপ্ত
গোয়েন্দা, তায় আবার সাহিত্য; শুধু তাই নয় – নারী! অনেকেই অনিশ্চয়তায়
মাথা নাড়বেন। এ যেন সোনার পাথর বাটি! এই সোনার পাথর বাটি নিয়েই
আজকের আলোচনা। গোয়েন্দা বা অপরাধ সংক্রান্ত রচনা “সাহিত্য” আখ্যা
পেতে পারে কি না, সে নিয়ে বহু দিন ধরে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক হয়েছে।
ও ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার উদ্দেশ্য ইংরেজি ভাষায় লেখা
গল্প-উপন্যাসে মহিলা গোয়েন্দার জন্ম, বিকাশ, ও বিবর্তন সম্বন্ধে
একটু আলোচনা করা। তবে ব্যাপারটা সহজ নয়। ইংরেজি সাহিত্যে মহিলা
গোয়েন্দা গল্প ও উপন্যাসে বেশ অনেক দিন আগে আত্মপ্রকাশ করলেও,
তাদের সত্যিকারের উপস্থিতি এখনও কৈশোরকাল পেরোয়নি। এত স্বল্প পরিসরের
জীবনী কতই বা সারগর্ভ আর বিস্তারিত হতে পারে!
ইংরেজি সাহিত্যে গোয়েন্দা কাহিনি শুধুমাত্র লেখকের কল্পনার হাত
ধরে এগোয়নি। ১৮২৯ সালে লন্ডনে মেট্রোপলিটান পুলিশ বাহিনী প্রতিষ্ঠার
সঙ্গে গোয়েন্দা গল্পের উত্থানের ঘনিষ্ট সংযোগ রয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর
শেষের দিকে লন্ডন সুরক্ষার ভার ছিল প্রায় ২,০০০ আনাড়ি রক্ষকের
হাতে। এরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন এলাকায়, বিভিন্ন আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষের
অধীনে কাজ করত। ১৭৯৯ সালে ফরাসি বিপ্লব শেষ হবার পর বহু বেকার
সৈনিক এসে ইংল্যান্ডে আস্তানা গাড়ল। বেহিসাবি হৈ-হুল্লোড় করা ছাড়া
তাদের আর কোন কাজকর্ম নেই। এছাড়া খাদ্যের দাম হঠাৎ বেড়ে সাধারণ
মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় চুরি ডাকাতি হয়ে দাঁড়াল নিত্তনৈমিত্তিক
ঘটনা। এই দুর্দশাগ্রস্ত সমাজের পটভূমিকায়, এক সুসংহত কেন্দ্রীয়
নেতৃত্বের আওতায়, ৩,২০০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শান্তিরক্ষক নিয়ে
গড়ে উঠল মেট্রোপলিটান পুলিশ ফোর্স। ফোর্সের প্রধান কার্যালয়ের
ঠিকানা হোয়াইটহল অঞ্চলের একটি রাস্তার মোড় - স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড।
১৮৪২ সালে এই দপ্তরেই গড়ে উঠল একটি আলাদা ‘গোয়েন্দা’ বিভাগ, ১৮৭৮
সালে যার নামকরণ হল ‘সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট’ (সি.আই.ডি.)।
সেই সি.আই.ডি. বিভাগের কর্মীদের অভিনব তদন্তের পদ্ধতি বহু লেখককে
অনুপ্রেরণা জোগাল এক নতুন ধরনের কাল্পনিক চরিত্র গঠনে। এই নতুন
নায়কের নাম হল ডিটেকটিভ বা গোয়েন্দা।
নারী গোয়েন্দার পায়ের ছাপ খুঁজতে…
গোয়েন্দা আদিমাতার সন্ধানে
ইংরেজিতে লেখা গোয়েন্দা কাহিনির জনক খুঁজতে গেলে দেখা যায় সে
আসনে বসে আছেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের লেখক এডগার অ্যালেন পো।
যদিও তাঁর লেখায় ‘ডিটেকটিভ’ শব্দটার উল্লেখ নেই, কিন্তু ‘আগুস্ত
ড্যুপাঁ’র মত একজন চিন্তাশীল অনুসন্ধানকারী সৃষ্টি করে তিনি শার্লক
হোমস আর পরবর্তী কালের বহু যুক্তিবাদী গোয়েন্দার জন্মের পথ সরল
করে দিয়েছেন। তবে এই সব অসীম বুদ্ধিমান গোয়েন্দারা সকলেই ছিলেন
পুরুষ। বস্তুত, গোটা পৃথিবীর গোয়েন্দা কাহিনির প্রাচীন ইতিহাস
ঘাঁটলে দেখা যায় ইংল্যান্ডের শার্লক হোমস থেকে চিনের ডি রেঞ্জি,
সবাই পুরুষ। এমনকী এঁদের সহকারীদের মধ্যেও কোন মহিলার ছায়া কোনদিন
দেখা যায় নি। সে যুগে মহিলারা হতেন অপরাধের শিকার, পুরুষের সমানাধিকারে
রহস্যভেদী নয়।
প্রথম মহিলা গোয়েন্দা কে, সে বিষয়ে গভীর মতদ্বৈধ আছে। ১৮৪১ সালে,
পো রচিত দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ বের হবার কয়েক
মাস আগে ক্যাথরিন ক্রো প্রকাশ করেন দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ
সুসান হপলি, অর সার্কামস্ট্যানশিয়াল এভিডেন্স | সেদিক থেকে
বিচার করলে ক্যাথরিন ক্রো-এরই প্রথম গোয়েন্দা কাহিনি রচনার সম্মান
পাওয়া উচিত। তবে তারও বেশ কিছু আগে, ১৭৯৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল
অ্যান র্যাডক্লিফের লেখা দ্য মিস্ট্রিস অফ উডলফো। মিস্ট্রিস-এর
নায়িকা, এমিলি সেন্ট অবার্ট, কেমন করে নানান ভীতিপ্রদ অবস্থার
মোকাবিলা করতে সফল হল, তাই নিয়েই গল্প। অনেকের মতে এমিলির কার্যকলাপে
নারী ডিটেকটিভের প্রাথমিক প্রতিলিপি পাওয়া যায়। আবার অনেকে মনে
করেন মধ্যযুগীয় পরিবেশে বীভৎস রস সৃষ্টি করে র্যাডক্লিফ ভবিষতের
‘গথিক’ ধারার গল্প-উপন্যাসের খসড়া সৃষ্টি করেছেন।
ক্যাথরিন ক্রো-এর নায়িকা সুসান হপলি বাড়ির পরিচারিকা আর অ্যান
র্যাডক্লিফের এমিলি সেন্ট অবার্ট এক পড়ন্ত পরিবারের মাতৃহারা
সন্তান। দুই নায়িকাই বহু ভয়ঙ্কর আর আধিভৌতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন
হয়ে শেষ অবধি নিজেদের সাহসিকতায় সব সমস্যার সমাধান করেছে, প্রেমিককে
কাছে পেয়েছে। সেই জন্যই ক্রো এবং র্যাডক্লিফের উপন্যাস গোয়েন্দা
কাহিনি না রোমাঞ্চকর প্রেমের উপাখ্যান, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
অনেক সমালোচকের মতে, গোয়েন্দা গল্পের যা অপরিহার্য স্বাক্ষর -
নিবদ্ধ অনুসন্ধান - তার কোন ইঙ্গিত এই বই দুটিতে নেই। গল্পের নায়িকারা
কোন যুক্তিমাধ্যমে সমাধানে পৌঁছয়নি, তাই উপন্যাস দুটিকে ‘ডিটেকটিভ’
কাহিনি বলা চলবে না। অর্থাৎ গোয়েন্দা গল্পের জন্মদাতা পদ থেকে
এডগার অ্যালেন পো-কে সরানো যাবে না।
দ্য মার্ডার্স ইন দ্য রু মর্গ গল্পে এডগার অ্যালেন পো-এর
নায়ক, “আগুস্ত ড্যুপাঁ”, পর্যবেক্ষণ আর যুক্তিভিত্তিক তদন্ত ধারা
প্রতিষ্ঠা করার প্রায় দু’দশক পরে, ১৮৬৪ সালে ইংলন্ডে, মহিলা গোয়েন্দা-চরিত্র
নিয়ে প্রকাশিত হল দুটি বই – দ্য ফিমেল ডিটেকটিভ (লেখকঃ
অ্যান্ড্রু ফরেস্টার জুনিয়ার) আর রেভেলেশন্স অফ এ লেডি ডিটেকটিভ
(লেখকঃ ডব্ল্যু.এস.হেওয়ার্ড)। রগরগে প্রচ্ছদ আর হলুদ কাগজে মোড়া
সস্তায় ছাপা বই দুটি অল্প দামে বিক্রি হত রেলস্টেশনের বইয়ের ঠেলাগাড়িতে,
ভ্রমণকারীরা চটজলদি পড়বে বলে। বাঙলার বটতলায় ছাপা বইয়ের সামিল।
এর প্রায় কুড়ি বছর পরে, ২২১বি বেকার স্ট্রীটে শার্লক হোমস আত্মপ্রকাশ
করলেন।
দ্য ফিমেল ডিটেকটিভ আর রেভেলেশন্স অফ এ লেডি ডিটেকটিভ,
বই দুটির নায়িকা নারী হলেও লেখক পুরুষ। সেই সময়ের রীতি অনুযায়ী
দুটি বই-ই কাল্পনিক ‘কেস’ কাহিনির সমষ্টি। দ্য ফিমেল ডিটেকটিভের
নায়িকা, মিসেস গ্ল্যাডেন, সবসময় উৎসাহে ফুটছে, সব কিছু খুঁটিয়ে
পর্যবেক্ষণ করে, আর তথ্য বিশ্লেষণে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া প্রয়োগ
করে। তার জুতোর ছাপ নিরীক্ষণ ও বিচার করে দোষী সনাক্ত করা শার্লক
হোমসের অনুসন্ধান পদ্ধতিরই পূর্বাভাস। ড্যুপাঁ এবং হোমসের মত গ্ল্যাডেনও
পুলিশ বাহিনীকে অকর্মণ্য ভাবে।
অন্যদিকে রেভেলেশন্স অফ এ লেডি ডিটেকটিভের বিধবা নায়িকা,
বছর চল্লিশের মিসেস প্যাশেল, লন্ডন পুলিশের চীফ, কর্ণেল ওয়ার্ণারের
অধীনে কাজ করে। তার দশটা কেসের সফল সমাধান-সমষ্টি নিয়েই এই বই।
কেসগুলির মধ্যে খুন, রাহাজানি, ডাকাতি, অপহরণ, পরকীয়া, জালিয়াতি,
সবই রয়েছে। প্যাশেল জামার পকেটে কোল্ট রিভলভার নিয়ে ঘোরে এবং তা
ব্যবহার করতেও দ্বিধা করে না। সে সন্দেহভাজনকে অনুসরণ করে, লুকিয়ে
অন্যের বাড়িতে ঢুকে খানাতল্লাস চালায়। সেদিক থেকে প্যাশেল আমেরিকার
পোড় খাওয়া (হার্ড বয়েল্ড) মহিলা ডিটেকটিভ ধারার পূর্বসূরী। এই
হার্ড বয়েল্ড ধারার কথা পরে তুলব।
সমসাময়িক সমাজের মহিলাদের থেকে গ্ল্যাডেন এবং প্যাশেল দুজনেই
ভিন্ন। এরা স্বাধীনচেতা, পারিপার্শ্বিক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, নির্ভীক।
দুজনেই ছদ্মবেশ ধারণে পোক্ত। প্যাশেল মনে করে নারী বলে ডিটেকটিভ
কাজে পুরুষের থেকে তার সুবিধে বেশি। ‘সামান্য’ মহিলা বলে কেউ তাকে
সন্দেহ করে না; ফলে সে যত্রতত্র অবাধে ঘোরাফেরা করার ছাড়পত্র পায়,
সহজে অনুসন্ধান করতে পারে। দুঃখের বিষয় লেখার প্রসাদগুণের অভাবে
বই দুটি কালজয়ী হতে পারেনি।
এর পর, ‘ওল্ড স্লুথ’ ছদ্মনামে হার্লান পি. হ্যালসি পাঠকের সঙ্গে
তেইশ বছরের সুন্দরী নিউ ইয়র্কবাসিনী মহিলা গোয়েন্দা কেট গোলেটের
পরিচয় করিয়ে দিলেন দ্য লেডি ডিটেকটিভ (১৮৮০) উপন্যাসে।
বাস্তব অভিজ্ঞতায় কিঞ্চিৎ খাটো হলেও সাহস, ধৈর্য, বুদ্ধি, কোন
দিক থেকেই এই সদ্য-যুবতীর কোন খামতি নেই। এমন কি নিজেকে রক্ষা
করতেও সে পূর্ণসক্ষম। কেট গোলেট নিজের কাজে ব্যবহারের জন্যে নানান
রকমের অস্ত্র উদ্ভাবন করে। পরে এরই পূর্ণ রূপ আমরা দেখতে পাই জেমস
বণ্ডের কীর্তিকলাপে। নিজেকে রক্ষা করা তো কোন ছার, কেট গোলেট নিজের
শক্তিতে পুরুষদেরও বিপদমুক্ত করে।
১৮৯৫ সালে ক্যাড মেটি নামে আরেকজন নারী গোয়েন্দাকে হ্যালসি লোকসমক্ষে
আনলেন। বইয়ের নাম ক্যাড মেটিঃ দ্য ফিমেল ডিটেকটিভ স্ট্র্যাটেজিস্ট;
অর, ডুডি ডান এগেন ইন দ্য ফিল্ড। ক্যাড মেটি শৌর্যময়ী - সে
প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করতে পারে; চালাক; এবং ছদ্মবেশে নিজেকে লুকোতে
তুখোড়। ডুডি ডান তার পুরুষ সহযোগী; বিপদের হাত থেকে ক্যাডকে রক্ষা
করতে সে সদা প্রস্তুত। আবার ক্যাডও সময় সময়ে অলক্ষে থেকে ডুডিকে
বিপদের হাত থেকে বাঁচায়। ১৯০৪ সালে, মাদামোজেল লুসি, দ্য ফ্রেঞ্চ
লেডি ডিটেকটিভ উপন্যাসে হ্যালসি তাঁর আর একজন গোয়েন্দা মানসকন্যাকে
জন্ম দিলেন - লুসি। পুরুষ সহকারী জেরি ম্যাকের সঙ্গে লুসি বিভিন্ন
অপরাধের সমাধান করে বেড়ায় – তাই নিয়েই গল্পসমষ্টি।
সেই সময়ের মহিলা গোয়েন্দারা আত্মরক্ষায় সক্ষম হলেও সরাসরি শারীরিক
সংঘর্ষে খুব কমই যেত। বুদ্ধি এবং সহজাত প্রবৃত্তিই ছিল তাদের প্রধান
হাতিয়ার। কিন্তু ১৮৮৯ সালে দ্য অ্যাক্ট্রেস ডিটেকটিভ; অর দ্য
ইনভিজিবল হ্যান্ডঃ দ্য রোম্যান্স অফ অ্যান ইমপ্লাকেবল মিশন
উপন্যাসে অ্যালবার্ট ডব্ল্যু. একন তাঁর নায়িকা হিল্ডা সিরিনকে
একেবারে অন্য ছাঁচে গড়লেন। পঁচিশ বছরের হিল্ডা বক্সিং-এ ওস্তাদ,
বন্দুক ব্যবহারে পারদর্শী, অবলীলায় ছুরি চালায়। যে সব অপরাধীকে
নিউ ইয়র্ক পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে না, হিল্ডা তাদের কব্জা করে।
১৯৭০ দশকের জনপ্রিয় টিভি শো, ‘চার্লিস এঞ্জেলস’-এর গল্পরূপ যেন
হিল্ডার অনুকরণেই গড়া।
একনের পরবর্তী সৃষ্টি, দ্য ফিমেল-বার্বার ডিটেকটিভ; অর জো
ফিনিক্স ইন সিল্ভার সিটি (১৮৯৫) উপন্যাসে এমনি আরেকজন নারী
গোয়েন্দার উপস্থিতি রয়েছে। মিন্যো লরেন্স নিউ ইয়র্ক পুলিশের সদস্য,
কিন্তু তদন্তের খাতিরে নিউ মেক্সিকোর বেয়ারোপোলিসে (কাল্পনিক শহর)
গিয়ে বার্বার বা নাপিতের ব্যবসা খুলে বসেছে। মিন্যো শক্তপোক্ত, বুদ্ধিমতী, সাহসী,
দৃঢ়চেতা, এবং ঘুঁষোঘুঁষিতে পটু। সে মানসিক ও শারীরিকভাবে যে কোন
পুরুষের মোকাবিলা করতে পেছপা হয় না।
নব্যনারীর সন্ধানে
প্রথম যুগের ইংরেজি সাহিত্যে মহিলা গোয়ন্দাদের জন্ম দিয়েছিলেন
পুরুষ লেখকরা। এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি বললেই চলে। ফলে সমসাময়িক
পুরুষ গোয়েন্দাদের মতো মহিলা গোয়েন্দারাও ছিল ন্যায়িক যুক্তিবিজ্ঞানের
ওপর নির্ভরশীল। তাদের অনুসন্ধানের ঢঙ ছিল পুরুষালী। তবে বেশির
ভাগ মহিলা গোয়েন্দার কাজের পরিসর ছিল ক্ষুদ্র। প্রেমিক, স্বামী,
বিবাহ, সন্তান,আর পরিবারের মধ্যেই আবদ্ধ থাকত তাদের অপেশাদারী
তদন্তের জগত। ব্যতিক্রমী নারী হিসেবে এরা পাঠক সমাজে কৌতূহল জাগাত,
কিছুটা যৌন সুড়সুড়িও যোগাত, কিন্তু ক্ষমতার জোরে শ্রদ্ধাভাজন হতে
পারত না। মহিলা গোয়েন্দারা সকলেই ছিল অপেশাদার। দু-এক জন পুলিশে
কাজ করলেও সেই চাকরি হত অস্থায়ী। এই মহিলাদের পুলিশি কর্মজগতে
নিয়ে আসা হত কোন পুরুষ গোয়েন্দাকে সাহায্য করতে, পুরুষ গোয়েন্দার
প্রয়োজনে। কাজ শেষ বা রহস্য ভেদ হলেই এরা আবার পটভূমিতে মিলিয়ে
যেত।
এই সময়ে এল এক উল্লেখযোগ্য সামাজিক পরিবর্তন। সংসারের গণ্ডিতে
মেয়েদের আটকে না রাখার দাবিতে ১৮৯০ দশকে আরম্ভ হল প্রাথমিক পর্যায়ের
নারী মুক্তি আন্দোলন। আন্দোলনের লক্ষ্য মহিলারা নিজের ক্ষমতায়
অধিষ্ঠিত হবেন, উপার্জন করে স্বাধীন হবেন! এই সামাজিক আন্দোলনের
ছায়া পড়ল গোয়ন্দা সাহিত্যের পাতায়। গল্পের মহিলা গোয়েন্দারা এবারে
পেশাদারী জগতে প্রবেশ করতে আরম্ভ করল। উইল্কি কলিন্সের দ্য
ডায়রি অফ অ্যান রডওয়ে (১৮৫৬) উপন্যাসের দর্জি নায়িকা, অ্যান
রডওয়ে, সমস্ত প্রামাণ্য তথ্য সংগ্রহ করে, সাজিয়ে, একাই একটা হত্যারহস্যের
জট খুলে ফেলল। পারিশ্রমিক না পেলেও অ্যানের কাজের ধরনধারণে অবশ্যই
পেশাদারী গন্ধ রয়েছে।
১৯০০ সালে এম. ম্যাকডনেল বডকিন লিখলেন ডোরা মার্ল, দ্য লেডি
ডিটেকটিভ। বইয়ের প্রধান চরিত্র, ডোরা, উচ্চশিক্ষিত এবং কেম্ব্রিজ
বিস্ববিদ্যালয়ের এক ডনের কন্যা। সে বন্দুক চালাতে জানে, ছদ্মবেশ
ধারণ করতে পারে, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশক্তির অধিকারিণী এবং রহস্য
সমাধানে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগে বিশ্বাসী। এক নারীবিদ্বেষী
অপরাধী ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করে ডোরা তার বিচক্ষণতার পরিচয় দিল।
প্রায় সমসাময়িক গোয়েন্দা, লাভডে ব্রুক (দ্য এক্সপিরিয়েন্সেস
অফ লাভডে ব্রুক, লেডি ডিটেকটিভ, সি.এল. পর্কিস, ১৮৯৪), স্বাধীনচেতা,
উচ্চশিক্ষিতা। সে যুগের মহিলাদের জন্য উপযুক্ত পেশা, শিশু পরিচর্যা,
সে “বোরিং” মনে করে প্রত্যাখ্যান করে এবং গোয়েন্দার চাকরি নেয়।
শার্লক হোমসের মতো লাভডে ছদ্মবেশ ধারণ করে দোষীকে ফাঁদে ফেলে;
হোমসের মতোই পর্যবেক্ষণ শক্তি প্রয়োগ করে তথ্য জোগাড় করে; আর হোমসের
মতোই হাতে তদন্তের ভার না থাকলে মানসিক বিষাদে ভোগে। লাভডে নিজের
বুদ্ধিমত্তায় দোষী এবং পুলিশ, দুজনকেই নাকানিচোবানি খাওয়ায়।
শার্লক হোমসের ছায়ায় আরও কিছু মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র সে যুগে
গড়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে ম্যাডেলিন ম্যাক (মিস ম্যাডেলিন ম্যাক,
ডিটেকটিভ, হিউ সি. উইয়ার, ১৯১৪) আর ওলগা নেয়ার্সব্রুক (ওলগা
নেয়ার্সব্রুক, ডিটেকটিভ, হেজেল ক্যাম্পবেল, ১৯৩৩) বিখ্যাত।
হোমসের বন্ধু-সহকারী ওয়াটসনের মত ওলগারও সহকারী রয়েছে; তারই এক
বোন, মলি কিংসলি।
নতুন যুগের সন্ধানে
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম মহিলা গোয়েন্দা নায়িকা নিয়ে গল্প
লেখেন হ্যারি রকউড (ক্ল্যারিস ডাইক, দ্য ফিমেল ডিটেকটিভ,
১৮৮৩)। ক্ল্যারিস এক পুলিশ ডিটেকটিভের স্ত্রী। সে তার স্বামীকে
বিভিন্ন কেস অনুসন্ধানে সাহায্য করে। প্রথম মহিলা লেখকের হাতে
নারী গোয়েন্দার জন্মও হয়েছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। অ্যানা ক্যাথরিন
গ্রীনের সৃষ্টি, মিস এমিলিয়া বাটারওয়ার্থ, তার সুতীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী
শক্তি নিয়ে পাঠক সমাজে এসে আবির্ভুত হয় দ্য অ্যাফেয়ার নেক্সট
ডোর (১৮৯৭) উপন্যাসে। মিস বাটারওয়ার্থের জন্যেই গোয়েন্দা
সাহিত্যে অবিবাহিতা প্রৌঢ়া মহিলা ডিটেকটিভ ধারার প্রবর্তন ঘটেছে।
পরে এই ধারাটির পূর্ণ প্রকাশ হয় অ্যাগাথা ক্রিস্টির লেখা মিস মার্পল
এবং প্যাট্রিশিয়া ওয়েন্টওয়ার্থের সৃষ্টি মিস মড সিল্ভার চরিত্রে।
এই প্রৌঢ়া গোয়েন্দারা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা আর অপরিসীম কৌতূহল নিয়ে
দৈনিন্দিন জীবন কাটায় ঠিকই, কিন্তু তাদের চরিত্রের সফল বিকাশ ঘটে
সমস্যার তদন্তে আর রহস্যের সমাধানে।
আমেরিকায় মহিলা গোয়েন্দা কাহিনিধারার ঐতিহ্য গঠনে বিখ্যাত লেখক
রেক্স স্টাউটের অবদান অস্বীকার করা যায় না। তাঁর দ্য হ্যান্ড
ইন গ্লাভ (১৯৩৭) উপন্যাসে থিওডোলিনা ‘ডল’ বনার একজন মহিলা
গোয়েন্দা; কিন্তু সে স্বাধীন নয়, এক পুরুষ গোয়েন্দার সহকারী। ‘ডল’-এর
ক্ষমতা স্টাউট এত সীমিত করে দেখিয়েছেন যে তাকে খুব একটা কর্মক্ষম
মনে হয় না। তবু স্টাউটের মত একজন সফল এবং সক্ষম লেখক নারী-গোয়েন্দাকে
স্বীকৃতি দিয়ে এই ধারাকে প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে দিয়েছেন।
সত্যি বলতে কী, বিংশ শতাব্দীর সম্পূর্ণ উপন্যাসে পূর্ণাঙ্গ ও স্বাধীন
মহিলা ডিটেকটিভ চরিত্র প্রথম দেখা যায় মার্গারেট স্কট এবং উইল
আওর্সলার-এর (গেল গ্যালাগার ছদ্মনামে লেখা)আই ফাউন্ড হিম ডেড
(১৯৪৭) উপন্যাসে। উপন্যাসে গোয়েন্দা-নায়িকার নামও ‘গেল গ্যালাগার’।
পি ডি জেমস
|
বিংশ শতকের প্রথমে কিছু কিছু লেখিকা নারী -গোয়েন্দাকে কেন্দ্র
করে গল্প-উপন্যাস লিখলেও মহিলা গোয়েন্দাদের স্বর্ণযুগ আরম্ভ হয়
সত্তরের দশকে। বৃটিশ সাহিত্যে পি.ডি. জেমস তাঁর উপন্যাস, অ্যান
আনস্যুটেবল জব ফর এ উওম্যান-এ পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন
গোয়েন্দা-নায়িকা কর্ডেলিয়া গ্রে’র (১৯৭২)। উপন্যাসের নাম যথার্থই
দ্ব্যর্থবোধক। কর্ডেলিয়া গ্রে-কে নিয়ে জেমস আরও একটি উপন্যাস লিখেছেন।
সেই সময়েই আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে মার্শা ম্যুলার জন্ম দিলেন গোয়েন্দা
শ্যারন ম্যাকোনকে এডউইন অফ দ্য আইরন শুজ (১৯৭৭) উপন্যাসে।
আধুনিক গোয়েন্দা কাহিনির জগতে ম্যাকোনই প্রথম ‘পোড় খাওয়া’ (হার্ড
বয়েল্ড) নারী- ডিটেকটিভ চরিত্র।
‘পোড়-খাওয়া’ [মহিলা] গোয়েন্দার
সন্ধানে
পোড় খাওয়া বা ‘হার্ড বয়েল্ড’ গোয়েন্দা কাহিনির জন্ম আমেরিকা
যুক্তরাষ্ট্রে। বৃটিশ গোয়েন্দা কাহিনির ক্লাসিকাল ধারার থেকে ‘হার্ড
বয়েল্ড’-এর শৈলী এবং উদ্দেশ্য যথেষ্ট পৃথক। কোজি মিস্ট্রি নামে
খ্যাত ক্লাসিকাল ধারার লক্ষ্য দুটিঃ (১) দোষী সনাক্ত করা; এবং
(২) কোন পদ্ধতিতে দোষীকে ধরা যায় তা বিশদ করা । এই ধারায় অনুসন্ধান
মূলত যুক্তিভিত্তিক বিশ্লেষণের ওপর নির্ভরশীল। বৃটিশ ক্লাসিকাল
ধারার ডিটেকটিভের বৈশিষ্ট্য সে অসাধারণ বুদ্ধিমান এবং অপেশাদার;
সাধারণভাবে গল্পের প্রেক্ষাপট হয় উচ্চবিত্ত সমাজ। এতে দুয়েকটা
খুন থাকলেও রক্তপাত আর উগ্র হিংস্রতার স্থান নেই বললেই চলে। হার্ড
বয়েল্ড ধারা এর বিপরীত। এই ধারার কতগুলি বৈশিষ্ট্য রয়েছেঃ (ক)
গোয়েন্দা নিম্নবিত্ত খেটে খাওয়া মানুষ, পেশাদারী, অবিবাহিত এবং
একা থাকে; (খ) তার জীবনে নারী সমাগম ঘটে বটে, কিন্তু বেশিরভাগ প্রেম
বা বন্ধুত্বই অস্থায়ী; (গ) গল্পে শারীরিক সংঘর্ষ, হিংস্রতা,মারদাঙ্গা
প্রচুর, যা গোয়েন্দা-নায়ককেও মাঝে মধ্যে কাবু করে ফেলে; (ঘ) গল্প
ঘটনাবহুল ও গতি ক্ষিপ্র, এবং (ঙ) রহস্যের সমাধানে দোষীর শাস্তি
হওয়ার চেয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠা অনেক বেশি জরুরি ও তাৎপর্যময়।
রেমন্ড চ্যান্ডলার
|
হার্ড বয়েল্ড ধারায় গোয়েন্দার প্রাঞ্জল চরিত্রচিত্রণ খুবই প্রয়োজনীয়।
সাধারণত এই গোয়েন্দা হয় জীবনের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া, কিন্তু ন্যায়পরায়ণ;
কঠিন, কিন্তু দুঃখীর প্রতি দয়াবান; রূঢ়, কিন্তু স্নেহশীল। মনে
রাখতে হবে গল্পের প্রধান লক্ষ্য ধন্ধে আলোকপাত বা দোষীর শাস্তি
নয়, ন্যায়বিচার। এই ন্যায়বিচারে সমাজের ভূমিকা নেই; এ গোয়েন্দার
ব্যক্তিগত বিবেকের ব্যাপার, তার ব্যক্তিগত মাপকাঠিতে বাঁধা। হার্ড
বয়েল্ড ধারার সূত্রপাত ক্যারল জন ডেইলি-র হাতে হলেও একে জনপ্রিয়তার
তুঙ্গে তুলেছেন ড্যাশিয়েল হ্যামেট, রেমন্ড চ্যান্ডলার, রস ম্যাকডনাল্ড,
রবার্ট পার্কার, প্রমুখ আরও অনেকে।
চিরাচরিত হার্ড বয়েল্ড ধারায় নারীর স্থান একটু অদ্ভুত। মহিলারা
আগ্রাসের শিকার হয়; কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে ফন্দিফিকির করে; চুপিচুপি
খুন, চুরি, রাহাজানিও করে; আর অবশ্যই নায়ক-গোয়েন্দাকে সৎপথ থেকে
সরে যেতে প্রলুব্ধ করে। এই ধারার বেশির ভাগ উপন্যাসেই ডিটেকটিভের
ক্রোধের তাক নারী এবং উচ্চবিত্ত সমাজ। এহেন পরিস্থিতিতে পোড় খাওয়া
মহিলা মুখ্য অনুসন্ধানকারী আমরা খুঁজে পাব কি?
না, মহিলা গোয়েন্দারা হার্ড বয়েল্ড ধারায় পেছিয়ে থাকে নি। আগেই
বলেছি, ১৯৭৭ সালে প্রথম পোড়-খাওয়া নারী গোয়েন্দার জন্ম দিয়েছিলেন
আমেরিকার মার্শা ম্যুলার (এডউইন অফ দ্য আইরন শুজস)। শ্যারন
ম্যাকোনের পর আরও তিনজন মহিলা ডিটেকটিভ এই ধারায় উল্লেখযোগ্য স্থান
অধিকার করেছে – কার্লটা কার্লাইল (লেখকঃ লিন্ডা বার্নস), কিন্সি
মিলহোন (লেখকঃ সু গ্র্যাফটন), আর ভি.আই. ওয়ারশ্যস্কি (লেখকঃ স্যারা
পরেটস্কি)। বার্নস, গ্র্যাফটন, আর পরেটস্কির মানসকন্যাদের সম্বন্ধে
একটু বিস্তারিত বর্ণনা দিলে পোড়-খাওয়া গোয়েন্দা চরিত্রে আর একটু
আলোকপাত করা যাবে।
কার্লটা কার্লাইল লম্বায় ছ’ফুট এক ইঞ্চি, লাল চুল, বস্টনবাসী
পেশাদার গোয়েন্দা। তার প্রথম প্রকাশ ঘটে এ ট্রাবল অফ ফুলস
(১৯৮৭) উপন্যাসে। পুলিশের চাকরি থেকে ছাঁটাই হয়ে কার্লটা মাঝেমধ্যে
ট্যাক্সি চালায়; একা থাকে। তার শারীরিক শক্তি অন্যদের মনে ঈর্ষা
জাগায়, আর তার জিঘাংসাপ্রীতি সাধারণের ভয়ের কারণ হয়। ১৯৮৭ থেকে
২০০৮ সালের মধ্যে লিন্ডা বার্নস কার্লটাকে নিয়ে এক ডজন উপন্যাস
লিখেছেন।
স্যারা পরেটস্কির নায়িকা ভি.আই. (ভিক্টোরিয়া ইফিজেনিয়া) ওয়ারশ্যস্কি
পাঠকের সামনে এসে দাঁড়ায় ইন্ডেমনিটি ওনলি (১৯৮২) উপন্যাসে।
ওয়ারশ্যস্কির দৈহিক বর্ণনা আমরা কোথাও পাই না, কিন্তু জানতে পারি
সে শিকাগো শহরে বড় হয়েছে – সেখানকারই বাসিন্দা। তার মা-বাবা নেই;
স্কুলে পড়াশোনায় ভাল ছিল না, কিন্তু পরে আইন পাশ করেছে। ওয়ারশ্যস্কি
স্কুল এং কলেজ বাস্কেটবল টিমে খেলেছে। সে বিয়ে করেছিল কিন্তু বিচ্ছেদ
হয়ে গেছে; বেশ কয়েকজন প্রেমিক রয়েছে কিন্তু আসল বন্ধুত্ব মায়ের
বয়সী এক ইহুদী ডাক্তারের সঙ্গে। ওয়ারশ্যস্কি ছোটবেলা থেকে ছেলেদের
সঙ্গে রাস্তায় মারামারি করে বড় হয়েছে; হিংসাত্মক কাজকর্মে ভয় পায়
না। এ পর্যন্ত আঠারোটি ওয়ারশ্যস্কি উপন্যাসের শেষটি প্রকাশিত হয়েছে
২০১৫ সালে।
স্যু গ্র্যাফটন.......ফটো - মার্ক কগিনস
|
সু গ্র্যাফটনের বিখ্যাত বর্ণমালা (অ্যালফাবেট) রহস্য সিরিজের
গোয়েন্দা-নায়িকা কিন্সি মিলহোন-এর যাত্রা শুরু হয় এ ইজ ফর
অ্যালিবাই (১৯৮২) উপন্যাসে। সেই থেকে গ্রাফটন বি ইজ
ফর বার্গলার, সি ইজ ফর কর্পস, ইত্যাদি পেরিয়ে ২০১৫ সালে লিখেছেন
এক্স। লম্বায় কিন্সি পাঁচ ফুট ছ’ইঞ্চি, ওজনে ১১৮ পাউন্ড।
ছেলেবেলায় মা-বাবা দুজনকে হারিয়ে সে বড় হয়েছে মাসির বাড়িতে। কলেজ
পাশ করার আগেই কিন্সি ক্যালিফোর্নিয়ার কাল্পনিক শহর, সান্টা টেরেসার
পুলিশ বিভাগে যোগ দেয়, আর তার দু-বছর পরে পেশাদার গোয়েন্দা হিসেবে
কাজ আরম্ভ করে। তার সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু ও পাতানো আত্মীয় আশি বছরের
বাড়িওয়ালা। কিন্সির দুটি বিয়েই অসফল এবং তার কয়েকজন প্রেমিক রয়েছে
যারা তার জীবনে আসে যায়।
অবশ্যই এই তিনজন পোড় খাওয়া মহিলা ডিটেকটিভের চরিত্রে খুবই মিল।
এরা সকলে পেশাদার অনুসন্ধানকারী; পুলিশে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকলেও
সে সব ছেড়ে নিজের এজেন্সি খুলে বসেছে। সত্যিকারের আত্মীয় স্বজন
বলতে কেউ নেই; সংসারে একা – পুরুষ প্রেমিকেরা অস্থায়ী। তিনজনেই
কট্টর ব্যক্তি-স্বাধীনতায় বিশ্বাসী - স্বনির্ভর । নিজেদের রূপ
সম্পর্কে এদের সচেতনতা নেই; লিঙ্গ এদের জীবনে বিশেষ কোন অর্থ বয়ে
আনে না। এদের মারামারি করতে দ্বিধা নেই – অনেক সময়ে মার খায়, আবার
মার দেয়ও। এরা অপহৃত হয়, বন্দী হয়; কিন্তু আশ্চর্য, বাস্তবে মেয়েদের
যে ধরণের হিংসার মুখোমুখি সবসময়েই হতে হয়, তা এদের জীবনে ঘটে না।
অর্থাৎ এরা কখনও ধর্ষিত হয় না, বা এদের ধর্ষণের হুমকিও সহ্য করতে
হয় না। পুরুষ পোড়-খাওয়া গোয়েন্দাদের সঙ্গে বহু মিল থাকলেও এরা
‘নারী নরকের দ্বার’ ভাবনামুক্ত। বরং তিনজনেই নারীবাদী – অন্য মেয়েদের
সমস্যা সমাধান করতে দ্বিধা করে না।
এই তিনজন ছাড়াও নিজেদের প্রতিভা দিয়ে মহিলা হার্ড বয়েল্ড ধারা
পুষ্ট করেছেন আরও অনেক লেখিকা। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন
ক্যারল লিয়া বেঞ্জামিন (গোয়েন্দাঃ রেচেল আলেকজান্ডার); লিজা কোডি
(গোয়েন্দাঃ অ্যানা লি এবং ইভা ওয়াইলি); এলিজাবেথ কোজিন (গোয়েন্দাঃ
জেন মোসেস); জ্যানেট ড্যসন (গোয়েন্দাঃ জেরি হাওয়ার্ড); ও ভ্যাল
ম্যাকডরমিড (গোয়েন্দাঃ কেট ব্র্যানিগান)। হার্ড বয়েল্ড ডিটেকটিভ
ধারা জনপ্রিয় হলেও জন্মস্থানের বাইরে খুব একটা ছড়িয়ে পড়েনি।
কিশোরী গোয়েন্দার সন্ধানে
উনবিংশ শতকের শেষে লুইসা মে অ্যালকট চার বোনকে নিয়ে তাঁর কালজয়ী
উপন্যাস লিটল উইমেন (১৮৬৮) প্রকাশ করেন। এরপরই মার্ক
টোয়েন দুটি কিশোরের অভিযান নিয়ে লেখেন টম স্যয়ার (১৮৭৬)
আর দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অফ হাকলবেরি ফিন (১৮৮৫)। তখন থেকেই
আমেরিকার সমাজে কিশোর কিশোরীদের জন্যে রোমাঞ্চকর কাহিনির চাহিদা
বেড়ে ওঠে। সে চাহিদা অ্যানা ক্যাথরিন গ্রীন কিছুটা পূর্ণ করেন
দ্য গোল্ডেন স্লিপার অ্যান্ড আদার প্রবলেমস ফর ভায়োলেট স্ট্রেঞ্জ
(১৯১৫) উপন্যাসে। গ্রীনের নায়িকা ভায়োলেট কিশোরী; একটি উচ্চবিত্ত
পরিবারের মাতৃহীন কন্যা। নিজের বাবার অজান্তে সে গোয়েন্দাগিরি
করে উপার্জন করে, অন্যের সমস্যার সমাধান করে। সে নিজের বুদ্ধিমত্তা
আর চিন্তাশক্তি সম্পর্কে সচেতন এবং নিঃসংশয়।
তারপর ১৯১৬ সালে, এল. ফ্র্যাঙ্ক বম সৃষ্টি করলেন আর একটি অল্পবয়সী
ডিটিকটিভের চরিত্র – মেরি লুইজ। বম ছাড়াও বহু লেখক ঐ একই নামের
ছাতার তলায় লুকিয়ে মেরি লুইজকে পুষ্ট করেছেন। বইগুলি নীল কাপড়ে
বাঁধাই হত বলে সিরিজটি “দ্য ব্লুবার্ড বুকস” নামে জনপ্রিয়তা পায়।
কিন্তু এতেই আমেরিকার কিশোরী-জগত সন্তুষ্ট হল না। তাদের দাবীর
জবাবে ১৯৩০ সালে কিশোরী ডিটেকটিভ ন্যান্সি ড্রু-কে নিয়ে আরম্ভ
হল একটি যুগান্তকারী সিরিজ – ন্যান্সি ড্রু মিস্ট্রিজ। ১৯৩০ থেকে
২০১৩ সাল পর্যন্ত সিরিজটি একটানা প্রকাশিত
হয়েছে। ন্যান্সি ড্রু চরিত্রটি প্রকাশক এডওয়ার্ড স্ট্র্যাটেমায়ারের
মস্তিস্কপ্রসূত; কিন্তু ন্যান্সির পূর্ণাঙ্গ রূপ গড়ে তোলে এডওয়ার্ডের
কন্যা, সম্পাদক হ্যারিয়েট স্ট্র্যাটেমায়ার অ্যাডামস। এই সিরিজের
প্রথম তিরিশটি বই লিখেছেন মিল্ড্রেড ওয়ার্ট বেনসন; পরে ক্যারলিন
কীন ছদ্মনাম গ্রহণ করে বহু লেখক ন্যান্সি ড্রু-এর অ্যাডভেঞ্চার
লিখে হাত পাকিয়েছেন। বইগুলির তথ্যে অনেক ভুল থাকলেও মূল ইতিবাচক
বার্তা – মেয়েদের ক্ষমতায়ন – কিশোরী ন্যান্সি সমাজে পৌঁছে দিতে
পেরেছে। তবে সেদিনের লেখা বইগুলিতে বর্ণবিদ্বেষের ইঙ্গিত ইদানিংকালে
পাঠক সহ্য করবে না মনে করে বইগুলি সংশোধন করে নতুন করে প্রকাশ
করা হয়েছে।
ভিন্নগোত্রের নারী গোয়েন্দার সন্ধানে
এই অবধি যে মহিলা গোয়েন্দাদের বর্ণনা দেওয়া হল তারা সকলেই শ্বেতাঙ্গ,
ক্রিশ্চান, বিসমকামী (হেটেরোসেক্সুয়াল), এবং ইংল্যান্ড বা আমেরিকার
অধিবাসী। বিংশ শতকের মাঝামাঝি অবধি এই ছিল জনপ্রিয় ও প্রচলিত রীতি।
সত্তর ও আশির দশকে সমাজে মানব অধিকারের দাবী ও আন্দোলন গড়ে ওঠার
সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের পাতাতেও তার প্রতিফলন ঘটল। এগিয়ে এল সমকামী;
কৃষ্ণাঙ্গ; ইহুদী; আমেরিকার আদিবাসী (ইন্ডিয়ান); আফ্রিকা, লাতিন
আমেরিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার অধিবাসী; এবং প্রতিবন্ধী গোয়েন্দারা।
সমকামী গোয়েন্দা
প্রথম সমকামী পুরুষ গোয়েন্দার আবির্ভাব হয় ১৯৫৩ সালে, ইংল্যান্ডের
রডনি গার্ল্যান্ড-এর দ্য হার্ট ইন এক্সাইল উপন্যাসে।
পঞ্চাশের দশকে সমকামীদের প্রতি বৃহত্তর সমাজের অন্যায়ের প্রেক্ষাপটে
উপন্যাসটি লেখা। নায়ক টোনি পেজ মনস্তত্ববিদ; সে তার প্রাক্তন প্রেমিকের
আপাত-আত্মহত্যার তদন্ত করতে নেমেছে। কিন্তু তাকে সতর্ক থাকে হয়
যাতে নিজের যৌনজীবন লোকসমক্ষে প্রকাশিত না হয়ে পড়ে। সেইসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে
উপন্যাসটি এক অতি সাহসী প্রচেষ্টা। রডনি গার্ল্যান্ড লেখকের ছদ্মনাম।
এই একটি ছাড়া লেখক আর কোন বই লিখেছেন কিনা তাও আমরা জানতে পারি
না। গার্ল্যান্ডের আগেও সমকামী চরিত্র নিয়ে গোয়েন্দা কাহিনি লেখা
হয়েছে, কিন্তু তা ছিল মূলতঃ বিদ্রুপাত্মক, হাসিঠাট্টার পালা। তার
একটিকেও প্রথম সমকামী গোয়েন্দা গল্পের সম্মান দেওয়া উচিত নয়।
মহিলা সমকামী গোয়েন্দার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় হল আরও কুড়ি বছর পরে,
এম.এফ. বীলের কলমে। এঞ্জেল ডান্স (১৯৭৭) উপন্যাসের গোয়েন্দা-নায়িকা,
ক্যাট গেরেরা, শুধু সমকামী নয় – সে লাতিনা। ক্যাট গেরেরা রাগী,
জটিল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য, নারী ও সমকামীদের প্রতি বৃহত্তর
সমাজের অত্যাচারের প্রতিবাদে সোচ্চার। উপন্যাসটি তখন জনপ্রিয়তা
পায়নি; বীলও সমকামী গোয়েন্দা নিয়ে আর উপন্যাস লেখেননি।
মহিলা সমকামী গোয়ন্দা ধারার লেখা জনপ্রিয় হতে আরম্ভ করে আশির
দশকে – ক্যাথরিন ফরেস্টের লেখনীতে ভর করে। ফরেস্টের সমকামী নায়িকা,
কেট ডেলাফিল্ড, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারি থেকে অবসরপ্রাপ্ত,
লস এঞ্জেলেস পুলিশ বিভাগের ডিটেকটিভ। অ্যামেচার সিটি (১৯৮৪)
উপন্যাসে সে তার শ্যেনচক্ষু আর অভিজ্ঞতা নিয়ে উপস্থিত হল পাঠকসমাজে।
সেই থেকে ২০১৩ পর্যন্ত কেট ডেলাফিল্ডকে নিয়ে ন’টি জনপ্রিয় উপন্যাস
লিখেছেন ক্যাথরিন ফরেস্ট।
ক্যাথরিন ফরেস্ট ছাড়াও উপন্যাসে সমকামী মহিলা গোয়েন্দা নায়িকা
উপস্থাপন করেছেন আরও অনেকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অ্যান সীল
(গোয়েন্দাঃ জো জাকুৎসো); ব্রেন্ডা ওয়েদার্স (গোয়েন্দাঃ লিবি);
ক্লেয়ার ম্যাকন্যাব (গোয়েন্দাঃ কাইলি কেন্ডাল); জেন ডেলুচিয়ো (গোয়েন্দাঃ
ডি ডেলভ্যাল); জুলিয়া লিবার (গোয়েন্দাঃ লয় লম্বার্ড); লিন্ডি ক্যামেরন
(গোয়েন্দাঃ কিট ওম্যালি), ইত্যাদি। আমাদের দুর্ভাগ্য, সমকামী নারী
গোয়েন্দাদের পাঠক এখনো তেমন আপন করে নিতে পারে নি।
কৃষ্ণাঙ্গ গোয়েন্দা
কৃষ্ণাঙ্গ গোয়েন্দা নিয়ে প্রথম উপন্যাস হিসেবে গণ্য হয় জন বল-এর
ইন দ্য হীট অফ দ্য নাইট (১৯৬৫)। গোয়েন্দা ভার্জিল টিবস
ক্যালিফোর্নিয়ার পুলিশ বিভাগে কাজ করে। কাজের খাতিরে সাউথ ক্যারোলাইনায়
এসে সে একটি হত্যার তদন্তে জড়িয়ে পড়ল। উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ষাটের
দশকে আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকারের আন্দোলন। ভার্জিল টিবসকে
নিয়ে আরও কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন জন বল কিন্তু কোনটিই ইন দ্য
হীট অফ দ্য নাইট-এর মত সাফল্য পায়নি।
কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ গোয়েন্দা যদি বা মেলে, কৃষ্ণাঙ্গ নারী গোয়েন্দার
দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে তারা একেবারে নেই তা নয়। তবে কৃষ্ণাঙ্গ
নারী গোয়েন্দা নিয়ে লেখা প্রথম উপন্যাস পাঠকের মন থেকে এখন প্রায়
মুছেই গেছে। কালার্ড অ্যামেরিকান ম্যাগাজিনের সম্পাদক, পলিন হপকিন্স,
১৯০১-০২ সালে কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা গোয়েন্দা নিয়ে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস
লেখেন। হেগার্স ডটার নামে এই উপন্যাসে নায়িকা ভিনাস এক
কৃষ্ণাঙ্গ পরিচারিকা। সে এক কৃষ্ণাঙ্গ গোয়েন্দার সঙ্গে সমান তালে
কাজ করে একটি অপরাধ রহস্যের সমাধান করে।
এর পর ১৯৭৫ সালে দ্য ডার্ক এঞ্জেল উপন্যাসে গোয়েন্দা
এঞ্জেলা হার্পের জন্ম দেন লেখক জেমস ডি. লরেন্স। এঞ্জেলা প্রাক্তন
পুলিশ অফিসার। চড়া দামের কলগার্ল আর ফ্যাশন মডেলের কাজ ছেড়ে সে
পেশাদার গোয়েন্দার বৃত্তি নিয়েছে। এঞ্জেলা হার্পকে নিয়ে লরেন্স
চারটি উপন্যাস লিখেছেন। দুঃখের বিষয়, লেখায় প্রচ্ছন্ন নারী ও বর্ণবিদ্বেষের
দোষে ‘এঞ্জেল’ সিরিজ এখন প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
বরং অনেক বেশি আশাব্যাঞ্জক গোয়েন্দা নায়িকা পেনি ওয়ানাওয়েক-কে
নিয়ে লেখা উপন্যাস সিরিজ। ছ’ফুট লম্বা পেনি রাষ্ট্রসংঘের এক রাষ্ট্রদূতের
কন্যা। তাকে নিয়ে সুসান মুডি গোয়েন্দা গল্পের সিরিজ আরম্ভ করেন
১৯৮৪ সালে (প্রথম বই পেনি ব্ল্যাক)। সেই থেকে ১৯৯১ সাল
পর্যন্ত সাতটি ‘পেনি’ উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
এরপর বেশ কিছু কৃষ্ণাঙ্গ লেখিকা তাঁদের নিজেদের প্রতিলিপি অনুসারে
গোয়েন্দা উপন্যাসে নারী ডিটেকটিভ চরিত্র সৃষ্টি করেছেন। এঁদের
মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বার্বারা নীলি (গোয়েন্দাঃ ব্ল্যাঞ্চ হোয়াইট);
নোরা ডিলোখ (গোয়েন্দাঃ গ্রেস ‘ক্যান্ডি’ কাভিংটন); এলেনর টেলার
ব্ল্যান্ড (গোয়েন্দাঃ মার্টি ম্যাকালিস্টার); এবং পলা এল. উডস
(গোয়েন্দাঃ শার্লট জাস্টিস)। কৃষ্ণাঙ্গ লেখিকাদের কলমে কৃষ্ণাঙ্গ
মহিলা গোয়ান্দার চরিত্রচিত্রণ হয়ে উঠেছে বিশ্বাসযোগ্য আর সংখ্যালঘু
সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রার ছবি প্রকৃত।
ইদানীংকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা গোয়েন্দা, প্রেশাস
রামৎসওয়ে, প্রাণ পায় আলেকজান্ডার ম্যাকল স্মিথের কলমে, নব্বইয়ে
দশকে। আফ্রিকার বৎসওয়ানার রাজধানী গাবারোনে স্বামী-পরিত্যক্ত প্রেশাস
তার উত্তরাধিকার দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে দ্য নাম্বার ওয়ান লেডিজ
ডিটেকটিভ এজেন্সি (১৯৯৮)। নিজের সহজাত বুদ্ধি দিয়ে রামৎসওয়ে
পাড়া-প্রতিবেশীর সমস্যা আর রহস্যের সমাধান করে। ১৯৯৮ থেকে ২০১৬
অবধি এই সিরিজে সতেরোটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
অন্যান্য সংখ্যালঘু সমাজের নারী
গোয়েন্দা
ইহুদি গোয়েন্দা : ইহুদি সমাজের ইতিহাস, বিশেষত্ব,
প্রথা, ধর্মীয় নিয়ামাবলি ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে অপরাধের তদন্ত সাজানো
হয়েছে এই ধারার বইগুলিতে। তবে ইহুদি পুরুষ গোয়েন্দার উপস্থিতি
চোখে পড়লেও মহিলা গোয়েন্দা খুবই বিরল। সবচেয়ে জনপ্রিয় ইহুদি মহিলা
গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেছেন ফে কেলারম্যান। ১৯৮৬ সালে রিচুয়াল
বাথ উপন্যাসে কেলারম্যান সৃষ্টি করলেন ধর্মভীরু, গোঁড়া ইহুদি
গোয়েন্দা চরিত্র রিনা ল্যাজেরাস। রিনার স্বামী, পিটার ডেকার, লস
এঞ্জেলস পুলিশের ডিটেকটিভ। সে নিজের স্ত্রী রিনার সাহায্যে বহু
কেস সমাধান করে। এ পর্যন্ত একুশটি ল্যাজারাস/ডেকার জুটির উপন্যাস
প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া ইহুদি মহিলা গোয়েন্দাকে কেন্দ্র করে উপন্যাস লিখেছেন আইলিন
ব্যারন (গোয়েন্দাঃ লিলি স্যাম্পসন); শ্যারন কান (গোয়েন্দাঃ রুবি);
লরা লেভিন (গোয়েন্দাঃ জেইন অস্টিন); রজ সিগাল (গোয়েন্দাঃ এমিলি);
আইলেট ওয়াল্ডমান (গোয়েন্দাঃ জুলিয়েট অ্যাপেলবম), ও আরও অনেকে।
আমেরিকার আদিবাসী গোয়েন্দা। আমেরিকার আদিবাসী
সমাজের পরিস্থিতি, বিশ্বাস, ধর্ম, ইত্যাদি নিয়ে গোয়েন্দা কাহিনি
লিখেছেন বেশ কিছু লেখক। এঁদের মধ্যে টোনি হিলারম্যান সবচেয়ে সফল
ও তাঁর বই আদিবাসী নাভাহো সমাজ সংক্রান্ত সঠিক তথ্যে সমৃদ্ধ। হিলারম্যানের
উপন্যাসে ট্রাইবাল পুলিশ অফিসার জো লিপহর্ণ এবং জিম চী’র বিভিন্ন
রহস্য সমাধানের বিবৃতি রয়েছে। তবে অন্যান্য সংখ্যালঘু সাহিত্যের
মত এখানেও মহিলা গোয়ন্দার আনাগোনা খুবই সীমিত। এই খরার মধ্যেই
জায়াগা করে নিয়েছেন চেরোকি সমাজ নিয়ে লিখে জীন হেগার (গোয়েন্দাঃ
মলি বেয়ার’প); নাভাহো সমাজের সমস্যা নিয়ে লিখে এমি ও ডেভিড থরলো
(গোয়েন্দাঃ এলা ক্লা); অ্যালিউট এস্কিমো সমাজের অবস্থানে লিখে
ডেনা স্টাবেনাও (গোয়েন্দাঃ কেট শুগাক); এবং আনিশানাবে সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে
লিখে জে.এফ. ট্রেনার (গোয়েন্দাঃ অ্যাঞ্জেলা বিওয়াবান)।
প্রতিবন্ধী গোয়েন্দা। গোয়েন্দা সাহিত্যে প্রতিবন্ধী
নায়ক রহস্যের সমাধান করছে, তার কিছু উদাহরণ রয়েছে। দৃষ্টিহীন (লেখকঃ
ব্রুস আলেকজান্ডার), একটি পা হারিয়ে (লেখকঃ ভিকার্স বেল) ও একটি
হাত হারিয়ে পঙ্গু (লেখকঃ মাইকেল কলিন্স), ইত্যাদি শারীরিক সমস্যা
সত্ত্বেও বেশ কিছু পুরুষ গোয়েন্দা তদন্ত চালিয়ে গেছে। প্রতিবন্ধী
মহিলা গোয়েন্দারা সামনে এসেছে কম। প্রতিবন্ধী মহিলা গোয়েন্দা নিয়ে
লিখেছেন জেন এ. অ্যাডামস (গোয়েন্দাঃ নেওমি ব্লেক, প্রাক্তন পুলিশ
অফিসার, পেশাদারী গোয়েন্দা, দৃষ্টিহীন); বৃজিট অবের (গোয়েন্দাঃ
এলিস আন্ড্রিওলি, সিনেমা হলের মালিক, গাড়ি-বোমায় আহত হয়ে মূক,
দৃষ্টিহীন, এবং চলৎশক্তিহীন); এলিজাবেথ কজিন (গোয়েন্দাঃ জেনারা
মোসেস, ক্যান্সারে ভুগে একটা ফুসফুস খুইয়েছে); ডেভিড হান্ট (গোয়েন্দাঃ
কে ফ্যারো, কালারব্লাইন্ড, চোখে কোন রঙ দেখতে পায় না); [ছদ্মনামে]
হিয়ালিয়া জ্যাকসন (গোয়েন্দাঃ অ্যানাবেল হার্ডি ম্যারাটোস, মূক
ও বধির); ক্লেয়ার মাটুরো (গোয়েন্দাঃ লিলি ক্লিয়ারি, মানসিক রোগ
‘অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডারে’ ভোগে); টমাস ম্যাকল (গোয়েন্দাঃ
নোরা ক্যালাম, শিকাগোর পুলিশ ডিটেকটিভ, একটি পা নেই), ইত্যাদি।
দক্ষিণ এশিয় গোয়েন্দা। বহু দক্ষিণ এশিয় লেখক
ইংরেজিতে লিখলেও দেশী গোয়েন্দার সংখ্যা খুব বেশি নয়। ইদানিং গুটিকয়েক
লেখিকা উপন্যাস লিখতে মহিলা গোয়েন্দা বেছে নিয়েছেন। অনেক খোঁজ
করে পাওয়া গেল মাত্র তিনজনকে - স্বাতী কৌশল (গোয়েন্দাঃ পুলিশ অফিসার
নিকি মারওয়া); মধুমিতা ভট্টাচার্য্য (গোয়েন্দাঃ রিমা রায়); এবং
কল্পনা স্বামীনাথন (গোয়েন্দাঃ লাল্লি)।
এই বিষয়ে উল্লেখ করা যায় সুজাতা ম্যাসির লেখা রে শিমুরা গোয়েন্দা
সিরিজ। সুজাতা ম্যাসির গোয়েন্দা, রে শিমুরা জাপানী মহিলা এবং ইংরেজি
শিক্ষিকা। সে ঘটনাক্রমে রহস্যের সমাধানে জড়িয়ে পড়ে। রে শিমুরাকে
নিয়ে প্রথম উপন্যাস দ্য স্যালারিম্যানস ওয়াইফ প্রকাশিত
হয় ১৯৯৭ সালে। সেই থেকে ২০০৮ অবধি দশটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
তদন্তে বৈজ্ঞানিক নারীর সন্ধানে
আজকের দিনে মানুষের চরিত্র পাল্টেছে, সমাজ পাল্টেছে, সমসাময়িক
তদন্ত বিজ্ঞান পাল্টেছে; ফলে উপন্যাসে গোয়েন্দার কাজের ধারা আর
গল্পের বিষয়ও গেছে বদলে। সাম্প্রতিক ফোরেন্সিক বিজ্ঞানের ভিত্তিতে
লেখিকা প্যাট্রিশিয়া কর্ণওয়েল জন্ম দিয়েছেন তাঁর মানসকন্যা, ময়নাতদন্তকারী
ডাক্তার কেট স্কার্পেটা-কে। কর্ণওয়েলের লেখায় আধুনিক জৈববিজ্ঞান
এবং বিষ বিজ্ঞান (টক্সিকলজি) কেন্দ্রিয় স্থান অধিকার করে রয়েছে।
স্কার্পেটা নতুন ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা
করে অপরাধী সনাক্ত করে। ১৯৯০ সালে কেট স্কার্পেটাকে নিয়ে প্রথম
উপন্যাস, পোস্টমর্টেম, ছাপা হয়। ২০১৫ সাল পর্যন্ত কর্ণওয়েল
তেইশটি স্কার্পেটা উপন্যাস লিখেছেন।
ফরেনসিক ছাড়াও আজকের সমাজে এসেছে ইনফর্মেশন টেকনলজি। একবিংশ শতাব্দিতে
কম্পুটার ছাড়া কথা নেই। তাই কম্পুটার বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে
এসেছে স্টীগ লার্সনের নায়িকা, হ্যাকার লিসবেথ স্যালান্ডার। স্যুইডিশ
ভাষায় লেখা মাত্র তিনটি উপন্যাস প্রকাশ করে লার্সন গোয়েন্দা কাহিনির
গতি পাল্টে দিয়েছেন। শুধু কম্পুটার নয়, নারী বিদ্বেষের প্রতিবাদ
তাঁর লেখায় এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ২০০৫ সালে গার্ল উইথ
এ ড্র্যাগন ট্যাটু প্রকাশিত হয়। মাত্র তিনটি উপন্যাস উপহার
দিয়ে লার্সনের মৃত্যু গোয়েন্দা কাহিনির জগতে এক অপরিমেয় ক্ষতি।
সমাজে মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য বিভিন্ন আইন জোরদার হবার সঙ্গে
সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে মহিলা আইনজ্ঞ / উকিল নিয়ে লেখা গোয়েন্দা
উপন্যাস। জন গ্রিশমের দ্য ক্লায়েন্ট (১৯৯৩), উপন্যাসটি
সিনেমায় পরিবেশিত হয়ে জনপ্রিয় হয়েছে; ফলে বইটির নারী উকিল / গোয়েন্দা,
রেজিনা ‘রেজি’ লাভ-কে অনেকেই জানেন। কিন্তু ক’জন পাঠক আইনজীবি
মহিলা গোয়েন্দাকে নিয়ে লেখা অন্যান্য বই পড়েছেন? এই বিভাগে উল্লখযোগ্য
লেখিকা হলেন জেনিফার উইনার (ইন হার শুজ, ২০০২); সোফি
কিন্সেলা (দ্য আনডোমেস্টিকেটেড গডেস, ২০০৬); ডেবি ম্যাকম্বার
(বিট্যুইন ফ্রেন্ডস, ২০০৩); ট্যামি হোগ (অ্যাশেস
টু অ্যাশেস, ২০০৯); এবং লিসা স্কটোলাইন (থিংক টোয়াইস,
২০১০)।
সমাধানের সন্ধানে
গোয়েন্দা কাহিনিতে আজকের সমাজের নানান পরিবর্তন, উত্থান পতনের
প্রতিফলন পড়তে বাধ্য। সামাজিক পটভূমি ছাড়া গোয়েন্দা গল্প লেখা
অসম্ভব। অপরাধের উদ্দেশ্য, তাৎপর্য, গোয়েন্দার চরিত্র, সমাজের
প্রেক্ষাপটে বর্ণনা করলে তবেই তা বিশ্বাসযোগ্য হয়। শ’দুয়েক বছর
ধরে নারী গোয়েন্দা সাহিত্যের মঞ্চে ইতিউতি উঁকিঝুঁকি মেরে ইদানীং
শুধু সবেগে নয়, সদলবলে প্রবেশ করেছে। এ আবির্ভাব নিঃসন্দেহে স্বাগত।
শুধু ইংরেজিতে লেখা গোয়েন্দা কাহিনির ধারা এবং ইতিহাসের সামান্য
অংশ এই লেখায় তুলে ধরেছি। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষা-সাহিত্যে কোথায়,
কেমনতর মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র রয়েছে তা গবেষণার ক্ষমতা আমার নেই।
আশা করছি আরও অনেকে সে বিষয়ে লিখতে এগিয়ে আসবেন।
লেখক পরিচিতি - লেখক একজন শিক্ষক, গবেষক ও
সমাজকর্মী। তিন দশকের অধিককাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয়
সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা ও তাঁদের ক্ষমতায়নের
প্রচেষ্টায় নিযুক্ত। উত্তর আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশিয় পারিবারিক
নির্যাতন বিরোধী সংস্থা মানবী-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অবসর-এর জন্মলগ্ন
থেকে উপদেষ্টা মণ্ডলীতে যুক্ত।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।