প্রথম পাতা

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বিবিধ প্রসঙ্গ

এপ্রিল ১৫, ২০১৬

 

উডিপী’র রাজা - ভারতের প্রথম ক্যাটারার

হিমাদ্রী শেখর দত্ত


 

  অধুনা ভারতবর্ষের সব থেকে বড় রান্নাঘর কোথায় ? জনপদ অনুযায়ী যদি রান্নাঘরের সংখ্যার কথা যদি ধরা হয় তাহলে সবচেয়ে বেশী রান্নাঘর থাকার কথা সবচেয়ে জন বহুল রাজ্য ইউ পি মানে  উত্তরপ্রদেশে (Uttar Pradesh: 199,281,477(16.49%), জনগণনা ২০১১ সাল, মুল ভারতের ১৬.৫% প্রতিশত মানুষ উত্তর প্রদেশে বসবাস করে। গড়ে ৪-জনের একটি পরিবার ধরা হলে, সেখানে দৈনিক ৫০০ লক্ষ উনোনে রোজ আগুন জ্বলে।

কিন্তু একক রান্নাঘর হিসেবে পুরীর মন্দিরে লর্ড জগন্নাথদেবের রান্নাঘরই সবচেয়ে বড়। তার সাথে কেবল তুলনা  চলতে পারে অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরের লঙ্গরের রান্নাঘরের। স্বর্ণ মন্দিরের হরমন্দির সাহিব পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ নিঃশুল্ক রান্নাঘর চালায়। যেখান থেকে প্রতি দিন এক লক্ষ মানুষ খাবার গ্রহণ করে। খাবারের মেনু হল চ্যাপ্টা রুটি আর ডাল। পুরীর রান্নাঘর জগৎপতি স্বয়ং নারায়ণের রান্নাঘর, যা আয়তনের দিক দিয়ে এই পৃথিবীর সব থেকে বড় রান্নাঘর।  শোনা যায়  দেবী লক্ষ্মী এই রান্নাঘরে স্বয়ং জগন্নাথের জন্যে নানা রকম পদ রান্না করতেন।  কিন্তু রথ যাত্রার সময় যখন জগন্নাথ গুণ্ডিচা মন্দিরে তার মাসীর বাড়িতে অবস্থান করতেন, তখন দেবী লক্ষ্মীর রান্না থেকে মন চলে যেত, আর তার ফলে সমস্ত রান্না বিস্বাদ তৈরি হত। এখানে প্রতিদিন ৫০০০ লোকের রান্না আজও হয়, যা পূজার পরে প্রসাদ রূপে বিতরণ হয়। কিন্তু উৎসব অনুষ্ঠানের সময় এই কিচেনে এক লক্ষ থেকে দশ লক্ষ মানুষের রান্না কোন পূর্ব পরিকল্পিত বন্দোবস্ত ছাড়াই হয়ে থাকে। তাই এই রান্নাঘরকে পৃথিবীর সর্ব  বৃহৎ হোটেল বলে বলা হয়, যেখানে মানুষের জাত ধর্ম কুল কোন কিছুই দেখা হয় না।

এই দুটি রান্নাঘরের আয়োজন ও তার থেকে উদ্ভূত খাদ্যের পরিমাপ সম্বন্ধে কোন গভীর তত্ত্বমূলক আলোচনার  জন্য এই নিবন্ধ নয়। কেবল একটা তুলনা মূলক দৃষ্টান্তের সমীকরণ দেখাবার জন্য এই মুখবন্ধের প্রয়োজন ছিল। এবার আসি আসল কথায়।

যদিও ঠিক ঠিক তারিখ নির্ধারণের কাজ এখনও চলছে, তবুও মোটামুটি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ৩১০২ বি সি তে ঘটেছিল বলে সাধারণ ভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে। তার মানে আজ থেকে ৩১০২+২০১৬ = ৫১১৮ বছর আগে, মোটামুটি ১০০ বছরের +/- ধরলে, প্রায় ৫০০০ বছর আগে। এই যুদ্ধের শেষ দ্বারাই মোটামুটি দ্বাপর থেকে কলিযুগে এই পৃথিবী আর আমরা প্রবেশ করেছি। যদিও এ নিয়ে নিরন্তর তারিখ গণনা  আর গ্রহ নক্ষত্রের প্লেনেটারি অবস্থানের মেল বন্ধন ঘটানোর কাজ আজও চলছে। এই যুদ্ধে সমগ্র ভারতবর্ষ  (তখনকার আর্য্যাবর্ত) ও তার রাজারা হয় পাণ্ডব পক্ষে বা কৌরব পক্ষে যোগ দান করেন ও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। কোন রাজ্যের বা দেশের রাজা বা মহানায়ক এর থেকে বিরত থাকেন নি। কেবল দুটি রাজ্য ছাড়া। প্রথম দ্বারকা, যে কোন পক্ষের হয়েই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় নি, আর দুই হল উডিপীর রাজা। এই উদিপীর (মতান্তরে    উডিপী) রাজার কাহিনী বলার জন্যেই অমৃতসর আর পুরীর রান্নাঘরের কথা মুখবন্ধে এসেছিল।    

উডিপী কৃষ্ণ মন্দির

যখন দু পক্ষের (পাণ্ডব ও কৌরব) দূতেরা তাদের দলে যোগদান করানোর অনুরোধ নিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজার কাছে যাচ্ছিলেন, তখন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আসেন ওই একই উদ্দেশ্য নিয়ে অধুনা কর্ণাটকের কাছে উডিপী রাজ্যে। উডিপীর রাজা শ্রীকৃষ্ণকে অনুরোধ করেন, যে তিনি কোন দলেই যোগ দিতে চান না, কারণ এই রক্ত ক্ষয়ে তার নিজের ও তার দেশবাসীর কোণ কল্যাণ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি কৃষ্ণকে বলেন, এত বড় যুদ্ধে যারা যুদ্ধ করবেন, তাদের পান আহারের বন্দোবস্ত তিনি করতে চান, কিন্তু যুদ্ধ নয়। তার অংশ গ্রহণ এই ভাবেই হবে। এত সৈনিক, রাজা, লস্কর, মহাযোদ্ধা, সকলকেই তো আহার  গ্রহণ করতেই হবে, উনি সেই ব্যবস্থা করার জন্য উৎসুক। কৃষ্ণ তখন তাকে তাই করতে বলেন। শ্রীকৃষ্ণ উডীপির রাজাকে বলেন, ‘ভাল, কাউকে না কাউকে তো রান্না করতেই হবে, অতএব তুমি তাই কর, আর সকলকে ভোজন দিয়ে তৃপ্ত কর’। ঊদিপির রাজা ভারতবর্ষের প্রথম সার্বজনিক ক্যাটারার। 

কিন্তু কত জনের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে তাকে ? এই প্রশ্নের উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ তাকে যুদ্ধে ভাগ নেবে এমন জন সংখ্যার একটা হিসেব দেন। সেটা এই রকম।

এই যুদ্ধে ১৮  অক্ষৌহিণী সৈন্য যুদ্ধ করার জন্য প্রাথমিক ভাবে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেমেছিল। এক  অক্ষৌহিণী সৈন্য বলতেঃ ২১,৮৭০ টি রথ, ২১,৮৭০টি হস্তী, ৬৫,৬১০টি ঘোড়া, ১,০৯,৩৫০জন পদাতিক সৈন্য বোঝায়। এখন একটি রথে মিনিমাম ২ জন, একটি হাতী তে ২ জন, একজন করে ঘোড়াতে, আর ১০৯৩৫০ জন পদাতিক যোগ করলে কি দাঁড়ায় ? 
রথঃ ২ গুণিতক ২১,৮৭০  = ৪৩,৭৪০জন  
হাতীঃ ২ গুণিতক ২১,৮৭০= ৪৩,৭৪০ জন
ঘোড়াঃ ১ গুণিতক ৬৫,৬১০= ৬৫,৬১০ জন
পদাতিকঃ                 ১,০৯,৩৫০ জন  
-----------------------------------------
সর্ব মোটঃ             ২,৬২,৪৪০ জন প্রতি  অক্ষৌহিণীতে          
তাহলে ১৮  অক্ষৌহিণী = ২,৬২,৪৪০ গুণিতক ১৮ = ৪৭,২৩,৯২০ জন  

 মানে সাতচল্লিশ লক্ষ তেইশ হাজার ন'শো কুড়ি জন। এরা কেবল যোদ্ধা। এর সাথে থাকবে ধোপা, নাপিত, কামার, ছুতোর, অশ্বশালা–হাতীশালা চালাবার লোকজন, অস্ত্র বানানো ও রিপেয়ারিং শপ-এর লোকজন, ব্রাক্ষ্মণ, পুরোহিত, তুরী ভেরী বাদক, ঘোষক, গবাদি পশুশালা ও তার পালক, অগণিত দাস দাসী এবং রাজমহিষীগণ সকলে। সব মেলালে এই সংখ্যা ৫০ লক্ষের ওপর হয়ে যায়। ভাবা যায়, এই ভারতবর্ষে আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে ৫০- লক্ষ মানুষ এই একই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে অধুনা হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রে জড়ো হয়েছিলেন।  এই সংখ্যাটি আজকের ভারতের নিয়মিত সৈন্য সংখ্যার থেকেও বেশী।

আমরা সকলেই আজ জানি যে এই যুদ্ধ ১৮ দিন চলেছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর দিনে এই ১৮ দিনের সংখ্যাটি কারোরই জানা ছিল না। উডিপীর রাজারতো ছিলই না। হয়তো ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন,  কিন্তু তিনি কোথাও এর প্রকাশ করেন নি। নিয়তির হাতে যেমন ভাবে চলেছে, যুদ্ধ সে ভাবেই ধীরে ধীরে তার অন্তিম দিনের প্রতি গড়িয়েছে। এই মহাযুদ্ধে রোজ হাজার হাজার যোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছে- উভয় পক্ষেই। ঊডিপির  রাজাকে বলা হয়েছিল, একদম পরিমাণ মতো ভোজন বানাতে, যাতে কেউ অভুক্ত না থাকে, আবার এক দানা খাদ্য সামগ্রী ফেলাও না যায়। যদি উনি রোজ ৫ লক্ষ লোকের রান্নাই করে যেতেন, তাহলে তা অবশ্যই উদ্বৃত্ত হতো এবং নষ্ট হতো। সমগ্র ভূখণ্ডে যখন যুদ্ধ চলছে তখন স্বাভাবিক ভাবেই আহার্য্য প্রাচুর্যের মধ্যে হলেও তাকে  বাঁচানোর চেষ্টাই করা উচিত। কিন্তু রাজা উডিপীর পক্ষে কি করে জানা সম্ভব আজ কতজন সৈনিক, যোদ্ধা, মহা যোদ্ধা স্বর্গারোহণ করেছেন ধর্ম যুদ্ধে, আর আগামী কাল কত জনের খাবার বানাতে হবে ? এই রহস্য যুদ্ধের শেষে জানা যায়, যদিও একদিনের জন্যেও উডিপীর আয়োজনে কোন রকম ত্রুটি হয় নি। সকলেই অবাক হয়েছিল, কি করে ঊডিপির রাজা একদম ঠিক ঠাক পরিমাণের রান্না করছেন ! যুদ্ধ শেষে রাত্রি প্রহরে যদি  হিসেব করা হয়ও, সেই সংখ্যা ঊডিপিতে জানাতে জানাতে সকাল অবশ্যই হয়ে যাবে। কিন্তু ততক্ষণে তো নতুন করে আবার যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।  

এই প্রশ্নের উত্তরে উডিপীর রাজা বলেন, আমি প্রতি রাত্রে শ্রীকৃষ্ণের জন্য ভোগের ব্যবস্থা করি, যুদ্ধ শেষে। কৃষ্ণ ভেজানো বাদাম খেতে ভালোবাসেন। আমি ওই ভোগের থালার সাথে খোসা ছাড়িয়ে কিছু ভেজানো বাদামও রেখে দিতাম ওর সামনে। শ্রীকৃষ্ণ কথা বলতে বলতে খেয়ে যেতেন। যেদিন যেকটা বাদাম উনি গ্রহণ করতেন, পরের দিন ঠিক সেই পরিমাণ সংখ্যক সেনা মারা যাবে, কেবল ১০০০ দিয়ে বাদাম সংখ্যাকে গুণ করে নিতে হবে। আমি ঠিক ততজনকে বাদ দিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতাম। যদি শ্রীকৃষ্ণ ১০টি বাদাম খেতেন, তার মানে আগামী কাল ১০০০০ জন মারা যাবেন। ভগবান প্রথম দিন থেকেই জানেন কি কি হবে আর কবে হবে। আর তা সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু তাঁর চারপাশে যারা একটু আলাদা কৃপার পাত্র ছিল, যাদের জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত ছিল, তারা ঈশ্বরের লীলা দেখে বুঝতে পারতেন, কি হতে চলেছে। তার মধ্যে ঊডিপির রাজাও ছিলেন।
আজ উডিপি সমগ্র ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ  কুক বা রন্ধন কার্য্যে পারদর্শী  ক্যাটারার সাপ্লায়ার।       

শেষ কথাঃ   ৫০০০ বছর পূর্বে যখন হয়তো শস্য, ফলমূল, জল, মদ, মাংস কোন কিছুর অপ্রতুলতা ছিলনা তখন খাবারের যোগাড় করা কঠিন কাজ ছিল না, যদিও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই পরিমাণ খাদ্যের সরবরাহ করা কোন মুখের কথা নয়। এরপর গড়ে চার লক্ষ থেকে এক লক্ষ লোকের সব রকম খাবার বানানোর জন্য উপযুক্ত বর্তনাদি ও রাঁধুনে। তার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তার পরে ছিল, সেই সমস্ত তৈয়ারি করা খাদ্য সামগ্রী সুদূর কর্ণাটক থেকে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে পৌঁছানো। সরল ছিল না কোন রাস্তা ঘাট, দূরত্ব ছিল কয়েক দিন ব্যাপী, তবুও সেই ঊডিপির রাজা কি ভাবে এই মহৎ কার্য্য সমাধা করেছিল আমার চিন্তায় তা আসে না। তবে কি তিনি কুরুক্ষেত্রের কাছেই কোথাও তার সেই ঐতিহাসিক রান্নাঘরটির স্থাপনা করেছিলেন? যদি কেউ কোন নতুন কথা শোনাতে পারেন তাহলে ঋদ্ধ হই।  

মূল কথাঃ   এই গল্পে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবস্থাটা একবার ভাবুন। শুরু থেকে শেষ সব কিছু তাঁর জানা থাকা সত্ত্বেও তাকে পুরো খেলাটা খেলার মত করেই (পড়ুন কর্মের মতো করেই) করে যেতে হয়েছে। এটাই সবথেকে বড় শিক্ষা। আমি যদি আজ জানতে পারি ভবিষ্যতে আমার কি কি হবে, তাহলে আমি এখনই সব কিছু বন্ধ করে দিয়ে সেই সব হবার জন্য বসে যাব। আজকের দিনের কোন কাজে আমার আর মন থাকবে না। কৃষ্ণ আগামী কাল কি হবে জানার পরেও আজকের কোন কর্মে হেলা করেন নি। এই শিক্ষাই তিনি আমাদের দিতে চেয়েছেন।  

ঋণ স্বীকার ও মূল সূত্রঃ
১) http://www.hindufaqs.com/fascinating-stories-mahabharata-ep-v-story-king-udupi/
২) দাদাগিরিঃ জি বাংলায় সৌরভ গাঙুলি’র অনুষ্ঠান 

 


লেখক পরিচিতি - প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ভূতত্ত্বে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। চাকরির কল্যাণে প্রায় সারা ভারত ঘুরেছেন। নানা স্থানের মানুষের জীবনযাপন ও ভাষা দেখার শেখার সু্যোগ পেয়েছেন - আর তা কুড়িয়েছেনও দু'হাত ভরে। নানা ধরনের গল্প- বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ ছাড়াও ইতিহাস-নির্ভর লেখা লেখেন। ২০১৪-তে প্রথম বই “স্ব” ও ২০১৫-তে দ্বিতীয় বই “এক ছক্কা তিন পুট” এর প্রকাশ কলকাতা বইমেলায়। বই দুটি সুধী পাঠকের সমাদর লাভ করতে সমর্থ হয়েছে।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।