প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ইতিহাসের কথা

অগাস্ট ৩০, ২০১৫

 

পালেদের কথা

হিমাদ্রী শেখর দত্ত


বাংলার পাল বংশীয় মানব–মানবীরা যাহারা ‘অবসর’ মারফত আমার এই লেখাটি পড়িবার কষ্ট স্বীকার  করিবেন তাহাদের নিকট, সর্বাগ্রে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আধুনিক এক পাল মহাশয়ের (এক সময় যাকে খুব ভালোবেসেছিলাম ‘দাদার কীর্তির’ পর পর) উপদ্রব ও আচার আচরণ দেখিয়া নিজ মনে এতোটাই দুঃখিত  হইয়াছি যে, পাল রাজবংশীয়দের হারানো ইতিহাসের পাতাগুলি আবার খুলিয়া দেখিবার ও আজিকার   গণদেবতাগণকে জানাইবার ইচ্ছা জাগরূক হয়। সেই মতো একদা বাংলার উন্নতির কর্ণধার ও প্রতিপালক মহান পাল বংশের ঠিকুজি-কুষ্ঠি লইয়া নাড়া চাড়া করা শুরু করি। অধুনা পাল মহাশয় যদি কোনওভাবে ওই বংশের শেষ সাঁঝবাতি হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তাহার বংশের প্রবাদপ্রতিম পূর্ব পুরুষদিগের এক্ষণে লজ্জা ও আফশোসের শেষ নাই। সম্পাদক মহাশয়ের নিকট বিনীত অনুরোধ যদি সম্ভব হয়, লেখাটিকে ট্যুইট করিয়া বর্তমান পালবংশীয়ের কাছে টালিগঞ্জ পাড়ায় পাঠাইয়া দিবেন। যদি কিছু লজ্জিত হইবার ও নিজেকে পরিবর্তন করিবার মানবিক ইচ্ছা তাহার মধ্যে জাগ্রত হয়! যদিও সে আশা নবীন সেন মহাশয়ের ‘আশা’ নামক কবিতার ছত্র অনুযায়ীই চলিবে সন্দেহ নাই!

যাহা হউক, এবার লেখার মধ্যে আসি। রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পরে (সাল ৬২৫), বাংলায় এক ধরনের অরাজকতার সৃষ্টি হয়। তখন কোন একজন রাজা বা গোষ্ঠী নেতার হাতে সমগ্র বাঙ্গালার ক্ষমতা ছিল না। তাই শাসন নামক সজ্জাটি বাংলার ভৌগোলিক শরীরটিকে শত্রু হাত হইতে যেমন অরক্ষিত রাখিয়াছিল, তেমনই দূরদর্শিতা ও অনুশাসনের অভাবে গোষ্ঠীগত কোন উন্নতি সাধনই করিতে পারে নাই। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা এই  সমস্ত কিছুই প্রজা সকলের কাছে অলভ্য ছিল। তীব্র তিব্বতি বহিরাক্রমণ এই সময় বাংলার উপরে আছড়ে পড়ে। ছোট ছোট গোষ্ঠীতে বিভাজিত হইয়া সকলেই নিজ নিজ গোষ্ঠীপতির পতাকাতলে আশ্রয় লয়। এই   ভাবে, অনাচার ও অত্যাচারের চরম সীমায় পৌঁছাইয়া যায় বাংলা। কিছু ধনী ও শিক্ষিত পরিবারের চারি পাশে  হয়তো গোটা একটি জনপদ বা গ্রাম, আশ্রয় হেতু ভিড় করিয়া থাকিলেও থাকিতে পারে, কিন্তু  সমগ্র বাংলা – বিহার–উড়িষ্যা এক নিদারুণ অশান্তি ও কষ্টের সহিত কালাতিপাত করিতেছিল। ৬২৫ সালের পরে ৭৫০ সাল পর্যন্ত (প্রায় ১২৫ বছর) এই এলাকাটি স্থানীয় শক্তিমান কিছু সমাজপতি (আজিকার গুণ্ডা সম্প্রদায়) এবং  বহিরাগত তিব্বতি সম্প্রদায়, সেই প্রকার কিছু মানুষের হাতে ছিল। সকলেই নিজ নিজ মত ও শক্তি অনুযায়ী এলাকা দখলের সুবিধা লইয়া ছিলেন। জনসংখ্যার অপ্রতুলতা, অর্দ্ধশিক্ষা, কিন্তু ব্যবহারিক জীবন যাপনের  কোনও অসুবিধা না থাকিবার কারণে (যেমন খাদ্যাদি, পণ্য, শস্য, গরু, মোষ, ফল ইত্যাদির অঢেল উৎপাদন)  বাঁচিয়া থাকিবার কোনও যুদ্ধ তাহাদের করিতে হয় নাই। কিন্তু অগ্রগতিরও কোন নিদর্শন পাওয়া যায় না।  ঐতিহাসিকেরা এই সময়কে বলেন ‘মাৎস্য ন্যায়’ রাজনীতির বাংলা। অর্থাৎ, বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে ভক্ষণ করিয়া থাকে, তাহার নিজের খেয়াল খুশী মতো, বাঙ্গালাতেও  ঠিক তেমনই সামাজিক কাঠামোর মধ্যে জনপদ   গুলি দিনাতিপাত করিতেছিল।  বাংলায় শশাঙ্কের সমসাময়িক অন্য রাজারা হইলেন হর্ষবর্ধন (উত্তর ভারতবর্ষ) আর ভাস্কর বর্মণ (কামরূপ)। শশাঙ্কের রাজধানীর নাম ছিল ‘কর্ণসুবর্ণ’ যা আধুনিক মুর্শিদাবাদ। শশাঙ্ক ছিলেন সমগ্র গৌড়ের রাজা, যাহার রাজ্য সীমা বাংলা ছাড়িয়ে দক্ষিণ পূর্বে উড়িষ্যা ও পূর্বে কামরূপের  সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজা শশাঙ্কের সময়ই বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রচলন হয়, যদিও বলা হয় এই ক্যালেন্ডার বানাইয়া ছিলেন সম্রাট আকবরের এক গনৎকার সভাসদ। সে অন্য কথা।     

৭৫০ সালে প্রথম পাল রাজা ছিলেন রাজা গোপাল যিনি প্রায় ২০ বছর (মতান্তরে ২৭ বছর) শাসন করিয়াছিলেন। এটা ছিল মধ্যযুগীয় বাংলার প্রথম শাসকের শাসন কালের শুরু। রাজা গোপাল ৮০-বৎসর বয়সে মারা যান তাঁর ছেলে ধর্মপালের হাতে সমস্ত রাজ্যপাট সমর্পণ করিয়া। সেই সময়ে সমগ্র বাংলা তাঁহার রাজ্য ছিল, যা তাঁহার ছেলে পরে আরও বর্ধিত করে। পাল শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘যারা পালন করেন।’ এই পালেরা ইহার পরে প্রায় ৪৫০ বৎসর বাংলার রাজা হিসেবে ছিলেন (২১ জন রাজা হইয়াছেন বংশানুক্রমে, যদিও তাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ও শক্তিশালী রাজা ছিলেন মাত্র তিন জনই)। সে কথায় ক্রমে আসিতেছি। পালবংশের আমলের কবি সন্ধ্যাকর নন্দী বিরচিত ‘রামচরিতম্‌’ কাব্যে বলা হইয়াছে পালেদের আদি নিবাস উত্তর বাংলার বরেন্দ্র নামক এলাকা যাহাকে ওনারা ওদের পিতৃভূমি (জনকাভু) বলিয়া মনে করিতেন। গোপাল ছিলেন এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী যুদ্ধ-সৈনিক ভাপ্যতার সন্তান  (খালিমপুর তাম্র পত্রের লেখনী)। গোপালের পিতা ভাপ্যতা ছিলেন মহান যোদ্ধা (যাহাকে ডাকা হতো খণ্ডিত’রতি অর্থাৎ সমস্ত  শত্রু নাশক; তাম্র পত্রের উদ্ধৃতি) আর ঠাকুর দাদা ছিলেন দয়িতবিষ্ণু (যিনি বিখ্যাত ছিলেন সর্ব্ব-বিদ্যাভদাতা নামে, অর্থাৎ যিনি সমস্ত প্রকার জ্ঞানে পারদর্শী, তাম্রপত্রের উদ্ধৃতি)। খালিমপুর জায়গাটি অধুনা বাংলাদেশের অন্তর্গত মাগুরা সদর, খুলনা ডিভিশনের ও ঝিনাইদহ জেলার মধ্যে পড়ে। খালিমপুর তাম্রপত্র রাজা গোপালকে সূর্য বংশীয় বলিয়াও দাবী করে, যদিও ঐতিহাসিকদের ধারনা ও বিশ্বাস যে পরবর্তী কালে তাঁহার সাধারণ বংশ পরম্পরাকে গৌরবান্বিত করা ছাড়া সূর্য বংশীয় হইবার কোন ঐতিহাসিক লিপি বা প্রমাণ পত্র নাই।  মধ্যযুগীয় লেখক আবুল ফজল পালেদের ‘কায়স্থ’ বলিয়াছেন তাঁহাদের আচার, ব্যাবহার, বিবাহ ও সামাজিক নিয়ম কানুন দেখিবার পরে। কোন কোন ঐতিহাসিক পালেদের সমুদ্র বংশীয় বা শূদ্রও বলিয়াছেন। কিন্তু ইতিহাস এ কথা অবশ্যই স্বীকার করে যে  সাধারণ অবস্থার মধ্যে থাকিয়াও, সেই সময়ে সকলের ব্যক্তিগত মনোনয়নে (তাঁর অসাধারণ যুদ্ধ নীতি আর সুশাসন করিবার সহজাত ক্ষমতা) রাজা গোপাল যে রাজ ঘরানার সৃষ্টি করিয়াছিলেন তাহা সমগ্র বাংলা ও তাহার জনপদবাসীর জন্য আগামী ৪৫০ বৎসর সফলতার ধ্বজাই উড়াইয়াছে। ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে আসিয়া সেনেদের নিকট পালেদের শেষ পরাজয় ঘটে ও পাল বংশের অস্ত ঘটিয়া যায়।   

রাজা গোপাল (৭৫০-৭৭৭ খ্রীষ্টাব্দ)

রাজা গোপাল ঠিক কি ধর্মাবলম্বী ছিলেন সঠিক তথ্যের অভাবে জানা যায় না, যদিও তিনি বৌদ্ধ ধর্মে আস্থা রাখিতেন বলিয়া জানা যায়। পরবর্তী সকল রাজাই নিজেকে বৌদ্ধ বলিয়াছেন, তাহারা সকলেই মহায়না বুদ্ধের পন্থা অনুসরণকারী ছিলেন। ঐতিহাসিক লামা তারানাথ (৮০০ বছর পরে ইতিহাস লেখেন) বলিয়াছেন, রাজা  গোপাল একদম গোঁড়া বুদ্ধপন্থী ছিলেন। তিনি ওদন্তপুরীতে (উদ্দান্তাপুর) এক বিশাল বৌদ্ধ বিহার (মনাস্টারি) বানাইয়াছিলেন, যাহা বর্তমান বিহারে, যাহা সেই সময়কার সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিহার হিসেবে পরিগণিত হইয়াছিল।  তাঁহার পরে, তাঁহার সুপুত্র আরও বড় বৌদ্ধ-বিহার বানান যা আজ হেরিটেজ স্থান বলিয়া ঘোষিত হইয়াছে।  

সুদীর্ঘ সাড়ে চারশো বছরে দু দুবার এই রাজত্ব ও বংশ খারাপ সময়ের মুখোমুখি হয়, কিন্তু আবার নিজের মর্যাদায় ফিরিয়া আসে। রাজা গোপালের পরে তাঁর পুত্র ধর্মপাল ও তাঁর পুত্র দেবপাল দুইজনে মিলিয়া ৮০ বৎসর রাজত্ব করিয়াছেন। এই সময়কে পালেদের স্বর্ণযুগ বলা হয় যাহা প্রকারান্তরে বাঙ্গালারও স্বর্ণযুগ। দক্ষিণে রাষ্ট্রকূট রাজাদের সাথে পালেদের মিত্রতা হেতু ধর্মপাল তাঁহার রাজ্যে সীমানা একদা হর্ষবর্ধনের রাজত্ব  ও রাজধানী কনৌজ পর্যন্ত বিস্তৃত করিয়া লন। সেখানে নিজের লোক চক্রযুধকে কনৌজের সিংহাসনে  বসাইয়া তিনি গৌড়ে ফিরিয়া আসেন। উত্তরের রাজাদের (গুর্জর প্রতিহার) থেকে দু দুবার আক্রান্ত হইয়াও  ধর্মপাল তাঁহার জীবন ও রাজত্ব দুটোই বাঁচাইয়া নেন রাষ্ট্রকূট রাজা ধ্রুব আর তৃতীয় গোবিন্দর সহায়তায়। দ্বিতীয় যুদ্ধের পরে তৃতীয় গোবিন্দ যখন দাক্ষিণাত্যে ফিরিয়া যান তখন সমগ্র উত্তর ভারতের ওপর বাংলার  পালেদের বিজয় পতাকা উড়িতে থাকে। ইহার পরে, তাঁহার পুত্র দেবপাল, পাল রাজ্যের সীমানা প্রাগজ্যোতিষপুর (অধুনা আসাম, গৌহাটি) পর্যন্ত বাড়াইয়া নেন। রাজ্যের সীমানা বাড়ায় রাজকরের যেমন বৃদ্ধি  হয় ঠিক তেমনই নানা শৈলী ও শিল্প বাংলার নিজস্বতার সাথে মিলিত হইতে থাকে।   


সৌজন্যেঃ উইকিপেডিয়া

সোমপুর মহাবিহার, অধুনা পাহাড়পুর, নওগাঁও জেলা, বাংলাদেশে অবস্থিত, (উপরের ছবিটি দেখুন) তখনকার মিলিত বাংলার সব থেকে বিরাট বৌদ্ধবিহারের স্থাপনা করেন রাজা ধর্মপাল তাঁহার রাজত্বকালের সময়। ১৯৮৫ সালে এই মহাবিহারটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত করা হয়েছে।  উপরের ছবি হইতে ওই বৌদ্ধ বিহারের  আকার ও তাঁর বিশালত্বের কিছুটা আন্দাজ করা যাইতে পারে। এই সোমাপুরা বিহার ২১ একর জমির ওপরে  বিস্তৃত ছিল (প্রায় ৮৫,০০০ বর্গমিটার)। যাহার মধ্যে ১৭৭ টি প্রকোষ্ঠ, অগুনিত স্তূপ, মন্দির ও আনুষঙ্গিক গৃহাদি ছিল। এ ছাড়া আরও নানা বৌদ্ধ বিহার পালেদের হাতে তৈরি হয়, যেমন বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী (গোপালের দ্বারা) এবং জগদ্দল-যেগুলি সবই ওই সময়কার স্থাপত্যের উন্নত শৈলীর সুচারু নিদর্শন ছিল। বখতিয়ার খিলজী যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন এই সকল বিরাট স্থাপত্যকে কিলা বা দুর্গ  বলিয়া  ভুল  করেন এবং সমস্ত বিহারগুলিকে কদর্য আক্রমণে ধূলিসাৎ করেন। পৃথিবীর অত্যাশ্চর্য কয়েকটি বৌদ্ধ-বিহার এই ভাবে কালের মাটিতে মিলাইয়া যায়। এই সব বৌদ্ধবিহারগুলি কেবল শাস্ত্রালোচনা, শিক্ষা, পুঁথি-রচনা ও ঈশ্বর সাধনারই স্থান ছিল না, এগুলি শিল্পের (যে কোন শিল্প যেমন, স্থাপত্য, অংকন, চিত্রাদি প্রকরণ) এক মেল-বন্ধন ছিল, যা পালেদের সময় এক সার্বিক উচ্চতা লাভ করিয়াছিল, এবং তাহাদের পরে সেনেদের  সময়ও তা বজায় ছিল। দেশজ শিল্পীরা তাহাদের শিল্পের মধ্যে নেপাল, বার্মা, শ্রীলঙ্কা, জাভা ইত্যাদি দেশের নিজস্বতাটুকুকে আয়ত্ত করিয়াছিলেন আর এই ভাবেই নানা দেশের কলাকৃতি ভারতের মধ্যে ও ভারত থেকে  বাহিরে আসা যাওয়া করিয়াছিল। আজ যাহাকে আমরা সাংস্কৃতিক লেনদেন বলিয়া থাকি।              

রাষ্ট্রকূটের সহায়তা দু দুবার পাইবার পরে, রাজা ধর্মপাল রাষ্ট্রকূট দুহিতা ও রাজকন্যা রন্নাদেবীকে বিবাহ করেন আর দুই মহা শক্তির মধ্যে সখ্যতার বন্ধন আত্মীয়তার বাঁধনে অটুট হইয়া যায়। ধর্মপাল জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যে উত্তর-মধ্য ভারতে তাঁহার ক্ষমতা ও অধিকার বজায় রাখতে পারিয়াছিলেন তাহা এই মিলিত শক্তির দান হিসেবে। পূর্বে বাংলা থেকে উত্তর-মধ্য ভারতের কনৌজ পর্যন্ত আর দক্ষিণে রাষ্ট্রকূট রাজাদের সীমানা পর্যন্ত সে পাল রাজাদের মুদ্রা জনগণের কাছে গ্রহণীয় ছিল। এই মুদ্রা সোনা ও রৌপ্যের সাথে তামা মিশ্রণ করিয়া প্রস্তুত করা হইয়াছিল। 

 
সৌজন্যেঃ ইন্টারনেট - ভারতীয় মুদ্রার ইতিহাস

             ওপরে মুদ্রাটির ফোটোগ্রাফ দেখানো হইয়াছে, বর্তমান মালিকের অনুমতি সাপেক্ষে। এই মুদ্রাটি গলায় লকেট-রূপে ব্যবহৃত হইত কেননা মুদ্রার শীর্ষদেশে ছিদ্র দৃশ্যমান, যাহার ভিতর দিয়ে সোনা বা রুপোর  চেইন/সুতো পরাইয়া লওয়া হোতো, যাহাতে মুদ্রাটিকে বক্ষের নিকট ঝুলাইয়া রাখা যায়। মুদ্রার (বামদিকে) দেখা যাইতেছে, রাজা ঘোড়ার  পৃষ্ঠে, দক্ষিণ হাতে বর্শা লইয়া, সিংহ বা শূকর জাতীয় কোন প্রাণী শিকার করিতেছেন যেটি তাঁহাকে বামপার্শ্ব হইতে আক্রমণ করিয়াছে। মুদ্রার (ডানধারে) ব্রাহ্মীলিপিতে কিছু লিপি লিখিত রইয়াছে... শ্রী/মান ধা/রমা পা/ লাহ, আবার ঘোড়ার সম্মুখ পায়ের কাছে লিখিত দুটি লাইন, কাই/লা, পেছনের পায়ের কাছে লিখিত ভো। মুদ্রার উল্টোদিকে মহালক্ষ্মী দেবী পদ্মাসনে বসা মূর্তি, যাহার দুই হাতে পদ্ম, তাঁহার দুধারে পবিত্র পাত্রদ্বয় (পূর্ণ ঘট), আর উপরে লিখিত বাম দিকে শ্রী।                 

একজন শক্তিশালী রাজার প্রজাপালক এবং শাসক হিসেবে যা যা গুণ একজন রাজার মধ্যে থাকা  উচিত তাহা পুরো মাত্রায় রাজা ধর্মপালের মধ্যে প্রাপ্ত ছিল। তিনি তাঁহার পিতার নিকট হইতে প্রাপ্ত যুদ্ধবিদ্যায় কুশলতো  ছিলেনই, তাঁহার সহিত কূটবুদ্ধি রাজনীতিজ্ঞও ছিলেন। তিনি গুর্জর প্রতিহারদের নিকট দু-দুবার যুদ্ধে পরাজিত হইয়াছেন ঠিকই (সম্পদ ও লোকক্ষয়), কিন্তু শত্রুর শত্রু যে মিত্র, তাহা চিনিয়া লইতে ভুল বা দেরী করেন নি, আর রাষ্ট্রকূটদের সাথে নিজের জীবন ও সাম্রাজ্যের সুরক্ষা সুনিশ্চিতকরণের জন্যে তাদের সাথে আত্মীয়তার সূত্রেও বাংলাকে বাঁধিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহার এই রাজনৈতিক দূরদর্শিতাই তাঁহাকে অন্য পাল রাজাদের হইতে আলাদা প্রতীত করিয়া থাকে।    


পাল রাজাদের প্রথম তিন পুরুষের সময়ে তাদের রাজ্যের সীমারেখা (গোপাল- ধর্মপাল- দেবপাল)
সৌজন্যেঃ উইকিপেডিয়া

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা না বলিলে, পালেদের কথা সম্পূর্ণ হইবে না। সেই সময়কার সর্ব বৃহৎ  বিশ্ববিদ্যালয় এই নালন্দা, যাহার খ্যাতি ও ঋদ্ধতা সারা দেশ জোড়া ছিল, আর তা হইয়াছিল পাল রাজাদের সাহায্যেই। ওই সময়ের বিখ্যাত বৌদ্ধ শ্রমণ ও পণ্ডিত যেমন অতীশ দীপঙ্কর, টিলোপা, শীলভদ্র, সুগতশ্রী, মুক্তিমিত্র, পদ্মনাভ, জ্ঞানশ্রীমিত্র এঁনারা সকলেই স্বনামধন্য শিক্ষক ও পণ্ডিত ছিলেন। এঁনাদের মধ্যে অনেকেই জীবনের একটা সময় নালন্দায় শিক্ষকতা করিয়াছেন। নালন্দায় পড়িতে পাওয়া বা পড়িতে যাওয়া তখনকার যে কোনও ছাত্রের নিকট গর্বের বস্তু ছিল।


নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের ধ্বংসাবশেষ

আজ সে পাল ও নাই আর সে গৌড়ও নাই। গৌড়ের বাঙালিদের এখন চলতি বাংলায় গুড় বাঙালি ডাকিয়া থাকে কেহ কেহ। যে রাজত্ব এক সময় দুই বাংলা মিলাইয়া ছিল আজ আলাদা আলাদা পতাকার নীচে, আলাদা রাষ্ট্র।  নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য আছে, জল লইয়া, সীমানা লইয়া, ফোর্স লইয়া, আর বা কিছু কিছু গোপনীয় আঁতাত লইয়া। কিন্তু সাধারণ প্রজা যাহারা আজ ছড়াইয়া আছে দুই ভূখণ্ডে, যাহাদের আদি পুরুষেরা সকলেই এক রাজার আশ্রয়ে ছিলেন, জাত–পাত নির্বিশেষে, তাহাদের অতৃপ্ত আত্মারা এখনও কদাচ খুঁজিয়া ফেরে সেই  রাজ্যকে, সেই রাজত্বকে, যেখানে রাজা ঈশ্বরের সমকক্ষ ছিলেন। কখনও নওগাঁও-এ আবার কখনও বিহারের নালন্দায়। ইতিহাস তাহার কাজ নীরবে করিয়া চলিয়াছে, সকলের অগোচরে। সৃষ্টির যে সাক্ষ্য ছিল তা ধ্বংসের ধূলিতে যেমন প্রমাণিত হয়েছে, নতুন সৃষ্টির অদৃষ্ট আভাষ আগামী দিনের জন্য কি রচনা করিতেছে তা দেখিয়া খুশী হইবার কোন কারণ দেখিতেছি না। বাংলার পালেদের পালে আজ গণদেবতার স্বীকৃতির হাওয়া নাই- কিন্তু   রাজনীতির হাওয়া আর রং দুটোই আছে। তাঁর জন্যে যে কোন মূল্য জনতাকে চুকাইতে হইতেছে প্রতিদিন, হইবেও। পুরুষ বা নারী কোন ভেদাভেদ নাই। শারীরিক বা আত্মিক যে কোন মৃত্যুই যেন আজ অতি সাধারণ  এক ঘটনা। আর একজন  ‘গোপাল’ খুঁজিয়া লইবার সময় উপনীত, হাতে অধিক অবসর নাই। যে তথাকথিত  রাজ বংশের নয়, কিন্তু রাজ মনোভাবাপন্ন, তাহাকে পাইতেই হইবে। ৪৫০ বছর ধরিয়া যাহারা জাতি হিসেবে  উচ্চ কোটির ছিলেন (মধ্য যুগীয় রাজ ঘরানায়), আজ তাহার প্রায় ৮০০ বছর পরে, সে জাতির এই অবনতি  ঠেকাইতে কোথায় আছেন গোপাল-ধর্মপালের বংশজরা ! বর্তমান সেই উত্তর জানাইবে কি আমাদের? টলিগঞ্জের পাল মহাশয় কিছু বলিবেন ? বাংলার মানুষ আশায় আশায় থাকিবেন।                 

তথ্যসূত্র
(১) The History and Culture of the Pālas of Bengal and Bihar, Cir. 750 A.D.-cir. 1200 A.D. Author:
Jhunu Bagchi. Abhinav Publications (1993).
(২) Dynastic History Of Magadha. Author- George E. Somers.
ছবি: History of India, Wikipedia, ও ইন্টারনেটের বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগৃহীত

         


লেখক পরিচিতি - প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ভূতত্ত্বে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। চাকরির কল্যাণে প্রায় সারা ভারত ঘুরেছেন। নানা স্থানের মানুষের জীবনযাপন ও ভাষা দেখার শেখার সু্যোগ পেয়েছেন - আর তা কুড়িয়েছেনও দু'হাত ভরে। নানা ধরনের গল্প- বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, ভ্রমণকাহিনি, প্রবন্ধ ছাড়াও ইতিহাস-নির্ভর লেখা লেখেন। ২০১৪-তে প্রথম বই “স্ব” ও ২০১৫-তে দ্বিতীয় বই “এক ছক্কা তিন পুট” এর প্রকাশ কলকাতা বইমেলায়। বই দুটি সুধী পাঠকের সমাদর লাভ করতে সমর্থ হয়েছে।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।