বিবিধ প্রসঙ্গ

মার্চ ১৫, ২০১৬
একক এবং একাকী : জীবনানন্দ
সোমেন দে
জীবনানান্দ দাস |
আনন্দ যার জীবনে বিরলতম অনুভব সেই কবিরই নাম জীবনানন্দ। বিষণ্ণতার সঙ্গে নিত্য সহবাস করতে করতে এই পিতৃদত্ত নামটির ভার হয়তো কখনো কখনো তাঁর কাছে খুব অবহ মনে হয়েছে। অথবা এই নামটিই হয়তো সাহায্য করেছে বেদনা-বিধুর বিপন্নতায় নির্বাসিত জীবনে সতত সৃষ্টিশীল থাকতে। তাঁকে নিয়ে অনেক রহস্যের মত আমরা সেই রহস্যও কোনোদিন সমাধান করতে পারবো না।
জীবনানন্দকে কেউ বলেছেন নির্জনতম কবি , কেউ বলেছেন নিশ্চেতনার কবি , কেউ বলেছেন অবচেতনার কবি। জীবনানন্দ এই সব মতগুলিকেই ‘ আংশিক ভাবে সত্য ‘ বলেছেন।
যখন তিনি কবিতা লিখতে আরম্ভ করেছেন রবীন্দ্রনাথ সূর্যের মত জ্বল জ্বল করছেন বাংলার সাহিত্যের আকাশে। বাংলা কবিতার যে আঙ্গিক, যে ভাব যে ভঙ্গীকে যে তিনি হিমালয়োচিত উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করেছেন তার সামনে দাঁড়িয়ে সে সময়ের যে কোনো কবির অসহায়বোধ অবশ্যম্ভাবী ছিল। আর কি কিছু লেখার বাকি আছে ? রবীন্দ্রনাথ কি আধুনিকতার শেষ ধাপে রেখে যাবেন কবিতাকে ? এ প্রশ্নগুলো যখন নবীন কবিদের জ্বালিয়ে বেড়াচ্ছে তখন কল্লোল , কালিকলম প্রভৃতি পত্রিকা চেষ্টা করছে রবি ঠাকুরের হাত ছাড়িয়ে একটা নতুন পথে হাঁটবার | একটি অনুচ্চারিত বিদ্রোহকে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছেন বুদ্ধদেব বোস , অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত , সুধীন্দ্রনাথ দত্ত বিষ্ণু দেরা। তবে এঁরা যতই বিদ্রোহের ভাব দেখান আসলে এঁদের অন্তরে রবীন্দ্রনাথ শালগ্রাম শিলার মত অনড়। ছন্দের বন্ধন ভেঙ্গে বেরোতে পারলেও আঙ্গিকে রবি ঠাকুর ফিরে ফিরে আসছেন। ঠিক এই সময় জীবনানন্দ এ সব আন্দোলনের কথা মুখে না বললেও কবিতার আঙ্গিক একেবারে ভেঙ্গে তছনছ করে দিতে চাইলেন। কিন্তু সে সময় কেউ তাকে বিশেষ পাত্তা দিলেন না। মুখচোরা অন্তর্মুখী নির্বিরোধী মানুষটি রবির আলোতে আলোকিত না হয়ে , রবীন্দ্রনাথ কে পাশ কাটিয়ে একা একাই চললেন অন্য একটা এবড়ো খেবড়ো অনালোকিত রাস্তায়।
সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা দলছুট মানুষদের সমাজ হয় তাচ্ছিল্য করে নয় ছাপ মেরে দেয় পাগল বলে। এ ক্ষেত্রেও তাই হল। প্রথম প্রকাশিত বই ‘ঝরা পালক’ থেকে দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ধুসর পাণ্ডুলিপি’ বেরোতে লেগেছিল ন বছর সময়। বোঝাই যায় তিনি পাঠকের কাছে সমাদৃত হন নি সেই সময়ে। তবু এই ন বছরে নিজেকে নিয়ে গেলেন আরো বেশি বিমূর্ততার দিকে। ডুব দিলেন নতুন অবচেতনায় জগতে।
‘কবিরে পাবেনা তার জীবন চরিতে’ এমন একটি সাবধান বাণী লিখে রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবাইকে কোনো কবির ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি অতি ঔৎসুক্য থেকে সংযত থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু আমাদের উৎসাহ তাতে বিন্দুমাত্র কমেনি। প্রিয় কবির জীবনযাপনের ব্যক্তিগত খুঁটি নাটি জানবার ইচ্ছেতে কোনো দিন ভাঁটা পড়েনি। বাঙালি শিলং এ বেড়াতে গিয়ে আজও খোঁজে লাবণ্যর সেই বাড়িটি। নীরা, যার মন খারাপ হলে কোলকাতায় ট্রাফিক জ্যাম হয়ে যায় , সে কোলকাতার কোন পাড়ায় বাস করতো এ নিয়ে তর্ক আজও চলে।
একটি কবিতার জন্য আর একটি ছোট্ট মফস্বল শহর বাঙালি কল্পনায় স্থায়ী আসন পেয়ে গেছে। শহরের নাম নাটোর। যেখানে বনলতা সেন থাকতেন। হাজার বছর পথ হাঁটার পর বাঙালি বোধহয় ভুলবেনা বনলতা সেন কে। অনেকে ভাবেন এই একটি কবিতা লিখলেই জীবনানন্দ বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকতেন।
কথা হচ্ছিল জীবন চরিত নিয়ে। মানুষ জীবনানন্দ কে যারা কাছ থেকে দেখেছেন তাদের খণ্ডিত স্মৃতি চারণ থেকে একটু বুঝে নেবার চেষ্টা করা যাক কবিকে।
বাবা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন একজন শিক্ষাব্রতী আর মা ছিলেন সেকালের একজন নামকরা কবি – কুসুমকুমারী দাশ। বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয় তাঁর প্রথম স্কুল। এখান থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন ব্রজমোহন কলেজে। সেখান থেকে প্রথম বিভাগে আই এ পাশ করে চলে আসেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাই সেকেন্ড ডিভিশনে। পরীক্ষার আগে তিনি ব্যাসিলাস ডিসেন্ট্রিতে খুব ভুগেছিলেন।
ইচ্ছে ছিল সে বছর পরীক্ষা ড্রপ দেওয়ার। কিন্তু মায়ের জোরাজুরিতে পরীক্ষা দিতে বাধ্য হন।
মায়ের কথা তিনি কিছুতেই ফেলতে পারতেন না। বাবার সঙ্গে একটা সম্ভ্রমের দূরত্ব বজায় রাখতেন। কিন্তু মায়ের সঙ্গে সব কথা হত। কোনো দিন মায়ের সঙ্গে কবিতা নিয়ে কোনো আলোচনা হত কিনা তা অবশ্য আমরা জানতে পারিনা। কুসুমকুমারীর কবিখ্যাতি কিন্তু সে সময় কিছু কম ছিল না। ‘প্রবাসী’ আর ‘মুকুল’ পত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু কবিতা ছাপা হয়েছিল। আর একটি কবিতার তো আমাদের কাছে প্রায় প্রবাদ প্রতিম হয়ে গেছে –
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?
মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন
মানুষ হইতে হবে এই তার পণ ---
জীবনানন্দ অবশ্য প্রথম থেকেই এই জাতীয় কবিতা থেকে অনেক দূরের যাত্রী। এম এ পাশ করে চাকরী পান সিটি কলেজে। সে কলেজে ব্রাহ্মদের রমরমা। ছাত্রদের সরস্বতী পুজো করা নিয়ে পরিচালন সমিতির একটি বিরোধ বাধে এবং তাতে ছাত্রদের সমর্থন করার অপরাধে জীবনানন্দের চাকরী যায়। তার পরে চাকরী করতে যেতে হয় তাঁর সাধের রূপসী বাংলা ছেড়ে দিল্লীতে রামযশ কলেজে । সুদূর দিল্লীতে হয়ত খুব একাকীত্ব বোধ করছিলেন।
তখনি হয়ত মাথায় উঁকি দিচ্ছিল সেই বিখ্যাত লাইন গুলি –
‘...সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রা দোষে
আমি একা হতেছি আলাদা
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা
আমার পথেই শুধু বাধা...।’
অনুভব করেছিলেন বাস্তব জীবনে একজন জীবন সঙ্গিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা। তেমন কেউ এলে কেটে যাবে একাকীত্ব। এমনটাই ভেবেছিলেন হয়ত।
সেই ভেবেই লাবণ্য গুপ্ত কে দেখতে এলেন জীবনানন্দ, লাবণ্যর জ্যাঠামশাইয়ের ঢাকার বাড়িতে। লাবণ্য তখন ঢাকার ইডেন কলেজে হোস্টেলে থেকে আই এ পড়েন। সে কালের নিরিখে যথেষ্ট প্রগতিশীল। সুন্দরী এবং সপ্রতিভ।
ব্রাহ্ম পরিবারের রীতিনীতি বেশ খোলা মেলা ছিল। জ্যাঠামশাই জীবনানন্দ কে পাত্রী কে একান্তে প্রশ্ন করার সুযোগ দিলেন। গত তিন প্রজন্মের বাংলা ভাষাভাষী কবিযশপ্রার্থীরা যে জীবনানন্দের কবিতায় খুঁজে পান রোমান্টিকতার আশ্রয় , তিনি মানুষটি কি আদতে রোমান্টিক ছিলেন ?
তাঁর জীবনে যে নারী প্রথম আসতে চলেছে তাকে তাঁর করা প্রশ্ন গুলি জেনে তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যেতে পারে। সেগুলি ছিল এ রকম -
আপনার নাম কি ?
আই এ তে আপনি কি কি সাবজেক্ট নিয়েছেন?
কোন সাবজেক্টটি আপনার বেশি পছন্দ ?
পাত্রী কোনো রকমে এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েই উঠে চলে যায় অন্দরমহলে।
প্রশ্নের উত্তর পেয়ে জীবনানন্দের কি ধারণা হয়েছিল তা আমরা জানতে পারি না। তবে এর পরেই জীবনানন্দ বিয়েতে মত দেন। ১৯৩০ সালের ২৬শে বৈশাখ , শুক্লা চতুর্দশী তিথিতে ঢাকা শহরে খুলনা জেলার সেনহাটি গ্রামের রোহিণীকুমার গুপ্তর কন্যা লাবণ্য গুপ্তর সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায় কবি জীবনানন্দের।
দেখতে এসে পাত্রীকে করা প্রশ্ন গুলি মধ্যে কোনো রোমান্টিকতার রেশ ছিল না এটা আমাদের মনে হতেই পারে। কিন্তু ফুলশয্যার রাতে ? আমাদের প্রিয় কবি কি কথা বলেছিলেন নবোঢ়া বধূকে ?
সে রাত্রে সংলাপ ছিল এই রকম
- আমি শুনেছি তুমি ভালো গান গাইতে পারো। আমায় একটা গান শোনাবে ?
- কোন গান ?
- জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে গানটা যদি জানো তবে সেটাই শোনাও
সে রাত্রে পর পর দু বার গানটি গাইতে হয়েছিল লাবণ্যকে। অনেক দিন পরে কবিপত্নী কবিকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ফুলশয্যার রাতে এই গানটি কেন শুনতে চেয়েছিলেন।
উত্তরে কবি বলেন –
এই লাইন দুটির মানে জানো ?
আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া
তোমার বীণা হতে এসেছে নামিয়া –
জীবনের শুভ আরম্ভ তে তো এই গানই গাওয়া উচিত , শোনা উচিত।
এ পর্যন্ত যা জানলাম তা জানতে পারলাম তার অনেকটাই কবি পত্নীর লেখা ‘মানুষ জীবনানন্দ’ থেকে। এ বই তে যা লিখেছেন, বোঝা যায় তিনি খুব সন্তর্পণে লিখেছেন। ইচ্ছে করেই লিখতে চান নি এমন কিছু যাতে মানুষ জীবনানন্দের বিচিত্র স্বভাবের থেকে সৃষ্টি হওয়া দাম্পত্য সম্পর্কের ফাঁকগুলো ধরা পড়ে। এ বইতে মানুষ জীবনানন্দ আর সম্বন্ধে যা যা জানতে পারি তা সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় –
খুব সাধারণ জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। মিলের ধুতি পরতেন। তাও একটু উঁচু করে পরতেন মানে ধুতি হাঁটুর নীচে বেশি দূর নামত না। এবং তাঁর জামা কাপড়ের ব্যাপারে কারো মন্তব্য গ্রাহ্য করতেন না। এমন কি পরা গেঞ্জি ময়লা হলেও ছাড়তে চাইতেন না। ডিম খেতে খুব ভালো বাসতেন। নিজের লেখার খাতা প্রাণপণে আগলে রাখতেন।
দুই সন্তান মঞ্জুশ্রী আর সমরানন্দকে খুব ভালোবাসতেন , যে কোনো গৃহী মানুষের মত। ছোট বেলায় মেয়ের একবার অসুখ করে তখন মেয়েকে কোলে নিয়ে সারারাত পায়চারী করতেন। মেয়েকে রান্না ঘরে যেতে বারণ করতেন , পাছে আগুনে পুড়ে যায়। আশা ছিল মেয়ে তার মত কবিতা লিখবে একদিন। ছেলের সঙ্গে বন্ধুর মত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। একটু নার্ভাস প্রকৃতির ছিলেন।
বিয়ের পর লাবণ্য বি এ পরীক্ষা দিয়েছিলেন কবিরই উৎসাহে। রেজাল্ট বেরোবার সময় তিনি এতটাই নার্ভাস ছিলেন রেজাল্টের খাম হাতে পেয়েও অনেকক্ষণ ধরে নিজে কিছুতেই খুলতে পারেন নি খাম। কারো কাছে কিছু নিতে কুণ্ঠিত বোধ করতেন। বিয়েতে শ্বশুর বাড়ি থেকে একটি আংটি পেয়ে বেশ বিড়ম্বিত বোধ করেছিলেন।
তবে তাঁকে দেখে যতটা শান্ত নিরীহ মনে হত আসলে তিনি তেমন ছিলেন না। লাবণ্যর কথায় ‘ছাই চাপা আগুন’। শান্ত ভাবে অল্প কথায় নিজের ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতেন কখনো কখনো।
লাবণ্য দাশের স্মৃতিচারণ পড়লে মনে হতে পারে তাদের দাম্পত্য জীবন বেশ মসৃণ ভাবেই কেটেছে। কিন্তু তেমনটা বোধহয় নয়। ভূমেন্দ্র গুহ এবং অশোক মিত্র মশাই যাঁরা দুজনেই কবির খুব কাছের মানুষ ছিলেন তাঁদের স্মৃতিচারণে আমরা একটা অন্য রকম ছবি পাই। ‘মাল্যবান’ উপন্যাসে , যেটি কবির ভাই অশোকানন্দ দাশের মতে কবির ছদ্ম বেশে আত্মজৈবনিক উপন্যাস , সেখানেও দাম্পত্য সম্পর্কের অশান্তির দিকটি উঠে এসেছে। সে কথায় পরে আসছি।
দিল্লির রামযশ কলেজে অধ্যাপনা করেছেন বিয়ের পরে বছর খানেক; ১৯৩৫ সালে বরিশালে চলে এসে যোগ দেন ব্রজমোহন কলেজে, ছিলেন ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৫১ থেকে '৫২ সাল পর্যন্ত পড়িয়েছেন খড়গপুর কলেজে, ১৯৫৩ সালে বরিষা কলেজে, পরের বছর হাওড়া গার্লস কলেজে তিনি অধ্যাপনা করেন। খড়গপুর কলেজে অধ্যাপনা করার সময় সপ্তাহান্তে কলকাতায় চলে আসতেন এবং প্রায়শই কলেজ কামাই করে আরো কয়েকদিন থেকে যেতেন। তাই এই চাকরীটি চলে যায়। পরে ডায়মন্ড হারবার কলেজে একটি চাকরির ব্যবস্থা করে দেন তাঁর শুভানুধ্যায়ীরা। সে চাকরীতে তিনি যোগদান করেন নি যাতায়াতের অসুবিধার অজুহাতে। ঘন ঘন চাকরি হারানোর ফলে জীবনের অনেকটা সময় প্রচণ্ড অর্থকষ্টেই কেটেছে। গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে ইন্সিওরেন্সের দালালি পর্যন্ত করতে হয়েছে। তবু তার মধ্যে কিন্তু লেখা চালিয়ে গেছেন পুরো দমে। ওই এক জায়গায় তিনি কখনো হাল ছাড়েন নি। বোধহয় আগামী পৃথিবীর কথা ভেবে। সেটাই আমাদের পরম সৌভাগ্য।
‘ ….পৃথিবীতে নেই কোন বিশুদ্ধ চাকুরি।
এ কেমন পরিবেশে রয়ে গেছি সবে ---
বাকপতি জন্ম নিয়েছিল যেই কালে,
অথবা সামান্য লোক হেঁটে যেতে চেয়েছিল স্বাভাবিকভাবে পথ দিয়ে,
কী করে তা হলে তারা এ রকম ফিচেল পাতালে
হৃদয়ের জন-পরিজন নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে ? ’
‘বিশুদ্ধ চাকুরি’ কোথাও নেই জেনেও সেই চাকুরির সন্ধানেই বরিশালের উদার আকাশ আর হিজল- কাঁঠাল-জামের আর্দ্র মাটি থেকে উৎপাটিত হয়ে আবার এই ইঁট-কাঠ-লোহার কোলকাতায় এসে পড়লেন কবি। তার ওপরে সে তখন এক উত্তাল সময় - ১৯৪৭ এ যখন দেশভাগের আগুনে দুই বাংলা অশান্ত। উদ্বাস্তু সমস্যায় কলকাতা জর্জরিত। সেই সময়েই বরিশাল থেকে কলকাতায় এলেন জীবনানন্দ জীবিকার সন্ধানে। কোনো নির্দিষ্ট আয়ের নিরাপত্তা ছাড়াই।
এই নূতন জীবনের শুরুটা মোটেই রমণীয় হলনা। একদিকে কবি হিসেবে তাঁর তেমন কোনো পরিচিতি তখনো গড়ে ওঠেনি, অথচ তাঁর সমসাময়িক কবিরা বুদ্ধদেব বসু , প্রেমেন্দ্র মিত্র , অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত , অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন দত্ত , বিষ্ণু দে এঁরা সবাই ব্যক্তিগত জীবনে এবং সাহিত্যিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এই দুঃখ তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে অনেক দিন। অশোক মিত্রের লেখায় জানতে পারি এ রকম সময়ে কবি তাঁকে একান্তে ডেকে নিয়ে জানতে চেয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসুর পঞ্চাশ হাজার টাকা ফিক্সড আছে কিনা। হয়ত এক ধরণের হীনমন্যতায় শিকার হয়ে পড়েছিলেন।
অন্য দিকে জীবনানন্দের ব্যক্তিগত জীবনও তেমন মসৃণ নয়। দাম্পত্য জীবনে একটু একটু করে ফাটল ধরছে। থাকেন কোলকাতার এক মেসে। প্রায় উপার্জনহীন এবং কবি হিসেবে তিনি তখনো কলকাতার সাহিত্য জগতে কোনো ছাপ ফেলতে ব্যর্থ। তাঁর কবিতা তখনো পত্র পত্রিকার অফিস থেকে ফেরত আসে।
কবিতা লিখে পয়সা পাওয়া যায় না। তাই শুধু অভাবের তাগিদেই গল্প উপন্যাস লেখার কথা ভেবেছেন, লিখেওছিলেন। পরামর্শ করেছিলেন বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী প্রতিভা বসুর সঙ্গে। দেশ পত্রিকার অফিসে গিয়ে সাগরময় ঘোষের কাছে গিয়ে অর্থের বিনিময়ে উপন্যাস লেখার প্রস্তাব দেন। সাগরময় ঘোষ উপন্যাস প্রকাশে রাজিও হন। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে সে উপন্যাস আর জমা দেন নি।
সেই সময় কোলকাতার কবিতার জগৎ আন্দোলিত হচ্ছে কল্লোল , কালি কলমের কবিদের দ্বারা। আধুনিকতার সংজ্ঞা খুঁজছেন এই গোষ্ঠীর সদস্যরা। সবাই রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করে যাবার বাসনায় যাচ্ছেন ইয়োরোপের কবিতায় আধুনিকতার অনুসন্ধানে । এই কবিদের গোষ্ঠী একটা আন্দোলনের মুখ হবার চেষ্টা করছে। স্বভাবলাজুক , মিতবাক , অবগুণ্ঠিত জীবনানন্দ এই গোষ্ঠীর একজন গৌণ সদস্য হয়েছেন মাত্র। কারো কাছে বিশেষ কল্কে পান নি।
তিনি এই কবিতার আন্দোলনকে মন থেকে মানেন নি। তাঁর একটা নিজস্ব সুস্পষ্ট মত ছিল। কখনো রবীন্দ্ররীতিকে অস্বীকার করার কথা বলেন নি। তিনি মনে করতেন নতুন ধারা আসতে পারে ভাষার নতুন ব্যবহারে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে একটি প্রবন্ধে তিনি দ্বিধাহীন ভাষায় বললেন –
‘অর্থহীন অসন্তোষে বা দুর্বল বিদ্রোহের অভিমানে আমি আমার পূর্ববর্তী বড় কবিকে ডিঙ্গিয়ে গেলাম অকাব্যের জঞ্জালের ভিতর – সাহিত্যের ইতিহাসে এ রকম আন্দোলনের কোন স্থান নেই।’
(রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিক বাংলা কবিতা, কবিতার কথা)
অথচ রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর নিজের কবিতার আঙ্গিক নিয়ে যে খুব উৎসাহ পেয়েছিলেন , তা নয়। উত্তর কালের সবচেয়ে প্রতিভাবান কবি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা পাই শুধু একটি দায়সারা মন্তব্য - "তোমার কবিতা চিত্ররূপময়, সেখানে তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।" এছাড়া আর কোনো মূল্যায়ন খুঁজে পাই না। রবীন্দ্রনাথের মতন আধুনিক এবং উদারচেতা মানুষের পক্ষে এই উদাসীনতা খুবই আশ্চর্য লাগে।
বুদ্ধদেব বসুও প্রথমে তাঁকে রবীন্দ্রনাথের মত তাঁকে প্রকৃতির কবি বলেই চালিয়ে দিয়েছিলেন –
"ছবি আঁকতে তার অসাধারণ নিপুণতা; তার ছবিগুলো শুধু দৃশ্যের নয়, বিশেষভাবে গন্ধের ও স্পর্শের।"
অনেক পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলেন জীবনানন্দ একজন ‘খাঁটি আধুনিক কবি’।
সুধীন দত্ত তাঁর পত্রিকার জন্যে জীবনানন্দের পাঠানো একটি কবিতা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তবে বিষ্ণু দে অবশ্য তাঁর ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটি নিজে হাতে সংগ্রহ করে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ছেপেছিলেন।
আর সজনী কান্ত দাস শনি বারের চিঠি তে তো আক্রমণের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন।
শত লাঞ্ছনার মধ্যে জীবনানন্দের একমাত্র সম্বল ছিল তাঁর আত্মবিশ্বাস। তাঁর ডায়রির পাতায় তিনি এক জায়গায় লিখছেন –
I ought to just do that for what I stand and in which I excel and delight and which is my true vocation.
রূপসী বাংলার একটি কবিতার একটি লাইন ‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর‘’ এ শুধু একটি কবিতার আবেগ তাড়িত উচ্চারণ নয়। এ তাঁর প্রত্যয়ী ঘোষণা। তাঁর যা কিছু আহরণ তা এই বাংলার আকাশ বাতাস নদী মাঠ থেকে।
এ কবিতার শেষ কটি পঙক্তিতে তাই নিসর্গ মুগ্ধতার থেকে আমাদের তিনি নিয়ে যান এক কালহীনতার দিকে , বাংলার নিজস্ব লোকপুরাণে, মনসামঙ্গলে।
‘বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে-
কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোৎস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়-
সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বত্থ বট দেখেছিল, হায়,
শ্যামার নরম গান শুনেছিলো- একদিন অমরায় গিয়ে
ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায়
বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিলো পায়’
অসহায় বেহুলাকে স্বামীকে বাঁচিয়ে দেবার শর্তে ইন্দ্রসভায় দেবতাদের মনোরঞ্জনের জন্য নাচতে হচ্ছে তীব্র যন্ত্রণা বুকে নিয়ে। সে যন্ত্রণার উপমা উঠে আসে সেই বাংলার প্রকৃতি থেকেই – ছিন্ন খঞ্জনার মত, এ যন্ত্রণার এর চেয়ে ভালো উপমা আর কি হতে পারে।
আবার তিনি শুধু বাংলার মানচিত্রে সীমাবদ্ধ ররে গেছলেন তা নয় , তাঁর ইতিহাস ভূগোল এবং সমাজচেতনা চলে গেছে মেসিডোনিয়া, নীলনদ তাইগ্রিস, মিশর লিবিয়া, হংকং ,সাংহাই এমন কি সুদূর মেরু প্রদেশে।
– ‘কোনো গ্লসিয়ার হিমস্তব্ধ কর্মোরান্ট পাল
বুঝিবে আমার কথা ; জীবনের বিদ্যুৎ কম্পাস
অবসানে'
এখানে ‘কর্মোরান্ট' বাঙালি পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ অচেনা শব্দ। এখনকার আগ্রহী পাঠক উইকি খুঁজে পেতে পারেন এই নামের পাখির কিছু বিবরণ। একধরনের সামুদ্রিক পাখি। মাছ খায়। বাসা বাঁধে সমুদ্রের উপকুলে। এ পাখি নাকি ডাইনোসরের সময়েও ছিল। অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছে হাজার হাজার বছর। তবে তার মধ্যে অনেক পাখি হয়ত গ্লসিয়ারে হিমস্তব্ধ হয়ে গেছে। শ্যামা দোয়েল ফিঙ্গে পানকৌড়ি হাঁড়িচাচা পাখি যাঁর প্রিয় সেই কবি ঠিক কোন সংকেত দেবার জন্যে এ রকম অচেনা পাখির উপমা দিলেন তার সন্ধান আমরা করতে থাকবো।
অভিযোগ অনেক উঠেছে । সাধারণ পাঠকের কাছ থেকে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ, বামপন্থীদের কাছ থেকে বুর্জোয়া পন্থার অভিযোগ, ছান্দসিকের কাছ থেকে ভুল ছন্দে কবিতা লেখার অভিযোগ, নীতিবাগীশের কাছ থেকে অশ্লীলতার অভিযোগ। কিন্তু জীবনানন্দ কখনো নিজের পথ পরিবর্তনের কথা ভাবেন নি। নিজের ডিকশন বদলান নি। তাঁর কথা ছিল –
‘মহাবিশ্বলোকের ইশারার থেকে উৎসারিত সময় চেতনা আমার কাব্যে একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো ; কবিতা লেখবার পথে কিছুদূর গিয়েই আমি বুঝেছি , গ্রহণ করেছি। এর থেকে বিচ্যুতির কোনো মানে নেই আমার কাছে।’ (কবিতার কথা )
আসলে সংকেত ছড়িয়ে আছে তাঁর সমস্ত কাব্য জগত জুড়ে। জীবনানন্দের চেতনা অবচেতনা অধিচেতনার জগতের সংকেত আমাদের জন্যে রেখে গেছেন। কিছু তার কিছু আবিষ্কৃত কিছু এখনো অনাবিষ্কৃত। তবু আবিষ্কারের আগ্রহ বেঁচে থাকবে , যতদিন বাংলা কবিতা লেখা হবে।
এমেরিকান কবি Archibald MacLeish একটি বিখ্যাত উক্তি এখানে স্মরণীয় - A poem should not mean but be’ । জীবনানন্দের কবিতা তাই। ভালো করে কিছু বোঝাবার আগেই তা কবিতা হয়ে ওঠে।
‘মাটি-পৃথিবীর টানে মানবজন্মের ঘরে কখন এসেছি,
না এলেই ভালো হত অনুভব করে;
এসে যে গভীরতর লাভ হল সে সব বুঝেছি
শিশির শরীর ছুঁয়ে সমুজ্জ্বল ভোরে;
দেখেছি যা হল হবে মানুষের যা হবার নয়–
শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়।'
কবিতা থেকে আবার মানুষ জীবনানন্দে ফিরে যাই। ‘না এলেই ভালো হত’ এবং ‘এসে যে গভীরতর লাভ হল’ এই দোলাচলের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছে তাঁর নানা বর্ণের সৃষ্টি , আশা এবং আশাহীনতার। ব্যক্তিগত জীবন তাঁর লেখাকে ঠিক কতখানি প্রভাবিত করেছে তা বলা মুস্কিল। কবিতায় যে ব্যক্তিগত যন্ত্রণার বলতে পারেন নি তা কি বলতে চেয়েছেন উপন্যাসে ? তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় উনিশ বছর পরে। তিনি নিজে তাঁর উপন্যাস প্রকাশে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন অনিচ্ছুক। প্রধানত তাঁর ভাই অশোকানন্দ দাশের আগ্রহেই এই প্রথম উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের মূল বিষয় একটি স্ত্রী শাসিত সংসারে দাম্পত্য জীবনের অসঙ্গতি। তাঁর মৃত্যুর পর আমরা জানতে পারি অসংখ্য কবিতার সঙ্গে তিনি নিভৃতে বসে চোদ্দটি উপন্যাস ও ১০৮টি ছোট গল্পও লিখেছিলেন। মাল্যবান ছাড়া অন্য উপন্যাসেও কবির জীবন-যন্ত্রণা খণ্ডিত অংশ উঠে এসে নানা চরিত্রের মধ্যে দিয়ে।
‘কারুবসনা আমাকে নষ্ট করে দিয়েছে। সব সময় শিল্প সৃষ্টি করবার আগ্রহ তৃষ্ণা .... কারুকর্মীর এই জন্মগত অভিশাপ আমার সমস্ত সামাজিক সফলতা নষ্ট করে দিয়েছে’
কারুবাসনা উপন্যাসের নায়কের এই কথা জীবনানন্দের স্বগতোক্তির মতন লাগে।
এই পৃথিবীর রণ রক্ত সফলতা
সত্য; তবু শেষ সত্য নয়।
যাপিত জীবনে রণ রক্ত সফলতা কোনো দিন আঁকড়ে ধরে থাকতে চাননি। তবু শেষ সত্যের অনুসন্ধান ছাড়েন নি। মৃত্যুর কথা এসেছে ঘুরে ঘুরেই।
তাঁর স্ত্রীর কথায় -
"...মৃত্যুর পরপার সম্বন্ধে ওর একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। মাঝে মাঝেই ওই কথা বলতেন। বলতেন, মৃত্যুর পরে অনেক প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হয়। আর খালি বলতেন আচ্ছা বলতো আমি মারা গেলে তুমি কী করবে? "
কবিতাতেও থেকে থেকে এ রকম এক প্রগাঢ় নিদ্রার কথা বলতেন –
‘যে ঘুম ভাঙ্গে নাকো কোনোদিন ঘুমাতে ঘুমাতে
সবচেয়ে সুখ আর শান্তি আছে তাতে।'
তাই তাঁর অন্তর্ধানও তাঁর কবিতার মতনই রহস্যে ঘেরা। কলকাতার ইতিহাসে ট্রাম চাপা পড়ে আজ পর্যন্ত অন্য কারো মৃত্যু ঘটেনি। তাই সন্দেহ জাগে কবি কি এতটাই আত্মবিস্মৃত হয়ে চলা ফেরা করতেন! নাকি তাঁর মৃত্যু আসলে স্বেচ্ছামৃত্যু ছিল। তাঁর দুই কাছের মানুষ সঞ্জয় ভট্টাচার্য এবং ভূমেন্দ্র্র গুহ দুজনেই সে রকম সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সেই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার বিবরণ আমরা পাই তাঁর আর এক বন্ধু সুবোধ রায়ের লেখা থেকে -
"জলখাবার" "জুয়েল হাউজের" সামনে দিয়ে রাস্তা অতিক্রম করছিলেন জীবনানন্দ দাশ। শুধু অন্যমনস্ক নয়, কী এক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন কবি। চলন্ত ডাউন বালিগঞ্জ ট্রাম স্পটিং স্টেশন থেকে তখনো প্রায় পঁচিশ-ত্রিশ হাত দূরে। অবিরাম ঘণ্টা বাজানো ছাড়াও বারংবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করছিল ট্রাম ড্রাইভার। যা অনিবার্য তাই ঘটলো। গাড়ি থামল তখন, প্রচণ্ড এক ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গেই কবির দেহ যখন ক্যাচারের ভিতর ঢুকে গেছে। ক্যাচারের কঠিন কবল থেকে অতি কষ্টে টেনে হিঁচড়ে বার করলেন সবাই কবির রক্তাপ্লুত, অচেতন দেহ। কেটে, ছিঁড়ে থেঁতলে গেছে এখানে সেখানে।।....... চুরমার হয়ে গেছে বুকের পাঁজরা, ডান দিকের কটা আর উরুর হাড়।"
( জীবনানন্দ স্মৃতি। সুবোধ রায়)
এই অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালের জেনারেল ওয়ার্ডে। যেখানে তার আশে পাশে পুলিশ কেসের রোগীরা শুয়ে আছেন আর আবহ সঙ্গীতের মত শোনা যাচ্ছে খইনি টেপা দারোয়ানের গান।
‘সুখ আর শান্তি’ নয় অপরিসীম যন্ত্রণার মধ্যে কাটিয়েছেন ১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবর থেকে ২২শে অক্টোবর দিনটি পর্যন্ত। তার পর অনন্ত শান্তিকল্যাণ।
হাসপাতালে জীবনের শেষ কয়েকদিন তাঁর স্ত্রী তাঁকে দেখতে আসেন নি। তিনি নাকি ব্যস্ত ছিলেন টালিগঞ্জে সিনেমার কাজে। যখন তাঁর শবদাহ দাহ করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে রাখা আছে , তখন কলকাতা কেন্দ্রিক অনেক কবি সাহিত্যিকরা এসে শ্রদ্ধা জানিয়ে যাচ্ছেন , সেই সময় লাবণ্য দেবী জীবনানন্দের বন্ধু ভূমেন্দ্র্র গুহর কাছে জানতে চেয়েছেন –
‘অচিন্ত্য-বাবু এসেছেন , বুদ্ধ-বাবু এসেছেন , সজনী-কান্ত এসেছেন , তাহলে তোমাদের দাদা নিশ্চয় বড় মাপের সাহিত্যিক ছিলেন ; বাংলা সাহিত্যের জন্য তিনি অনেক কিছু রেখে গেলেন হয়তো , আমার জন্যে কি রেখে গেলেন বলো তো ? ’
প্রশ্নটি লাবণ্য দেবীর দিক দিয়ে খুব অসঙ্গত ছিল , এমন কথা বোধহয় বলা যায় না ।
কবির শ্রাদ্ধ বাসরে রাখবার জন্যে একটি ছবি অনেক সন্ধান করেও আয়োজকরা যোগাড় করতে পারেন নি । এমন কি তাঁর স্ত্রী ও দিতে পারেন নি।
উত্তরকালের কবিদের জন্যে তিনি কতটা আলোর সন্ধান দিয়ে গেছেন তার পরিমাপ তাঁরাই করবেন। এ নিবন্ধ শেষ করা যাক এ কালের বিশিষ্ট কবি জয় গোস্বামীর একটি কবিতা দিয়ে –
‘একটি পাখী ডাকছে তার কাকলি মাধবীলতা যতটা বাগান...
আকাশে চক্কর মেরে মাথায় দু চারটি তারা ডুবে গেলে পর
এককোনে আড়ামোড়া ভেঙ্গে উঠে সর্বনিম্ন ডালের ওপর
হাফহাতা গেঞ্জীপরা কনুই লাগিয়ে সোজা দাঁড়ান মালকোঁচা টানটান
কে উনি ? কে উনি ? ব্যক্তি ? মহাশয় ? বাগানের মালী বা দেখাশোনার লোক ?
দুটি পাখি ডাকছে , তিনটি, কাকলি মাধবীলতা কতটা বাগান
পার হল ? দোর খোলো ,সারা মাথা তারা ডুবে সবাই যখন ঘুমচোখ
চারজন ,পাঁচজন ষষ্ট , সপ্তম , অষ্টম পাখি জড়ো হচ্ছে ভুলে যাচ্ছে
কাকলি বা গান
মাথায় চক্কর মেরে ভোর-অন্ধকার দেখছে , দূরে হাওড়া ব্রিজের মাথায়
কুয়াশা সরিয়ে দিয়ে আবার অনেকদিন পর
শ্রী দাশ , জীবনানন্দ , কী রকম সূর্যটাকে তুলে দিয়ে যান।'
তথ্যঋণ-
‘মানুষ জীবনানন্দ’ - লাবণ্য দাশ
‘আলেখ্য জীবনানন্দ’- ভূমেন্দ্র গুহ
অনুষ্টুপ (জীবনানন্দ বিশেষ সংখ্যা )
নিজের জীবনানন্দ – জয় গোস্বামী
আমার জীবনানন্দ আবিষ্কার ও অন্যান্য – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
জীবনানন্দ স্মৃতি। সুবোধ রায়
লেখক পরিচিতি - চাকুরী জীবন বেসরকারি এবং আধা সরকারি কর্পোরেট জগতের বিভিন্ন পদে। এখন অবসরপ্রাপ্ত। লেখেন নেহাতই মনের খিদে মেটাতে। লেখেন নানান বিষয় নিয়ে। তবে যাই লেখেন বিষয় নির্বাচনে কিছু অভিনবত্ব থাকে। গান , চলচ্চিত্র, ভ্রমণ, দিন বদলের ছবি, বাঙ্গালিয়ানা এ রকম আরও অনেক বিষয় এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ। তথ্যকে কৌতুকের মোড়কে এবং ভাবনা কে স্বচ্ছতার আবরণে পরিবেশন করতে চেষ্টা করেন। বিষয় যাই হোক ভাষা সব সময়েই ঝরঝরে, রসস্নিগ্ধ এবং মনোগ্রাহী।
বেশ কয়েকটি ওয়েব পত্রিকাতে লেখেন। দেশ বিদেশে অনেক গুণগ্রাহী পাঠক আছেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।