প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

আলোচনা

অগাস্ট ১৫, ২০১৫

পরিশ্রমের বিকল্প ২১১৫-তেও আবিষ্কৃত হবে না

রোহণ কুদ্দুস

আমার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার একটি গ্রামে। নাম হাল্যান। কথিত আছে, হলদিঘাটের যুদ্ধের পর রাণা প্রতাপের দুই দেহরক্ষী এই অঞ্চলে এসে আস্তানা গাড়েন। তখনও তাঁরা বাংলায় কথাবার্তা বলাটা রপ্ত করতে পারেননি। তাই কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলতেন – “রাণা হারলেন।” সেই হারলেন থেকেই নাকি তাঁদের প্রতিষ্ঠিত গ্রামের নাম হয়ে দাঁড়ায় হাল্যেন বা হাল্যান। কাহিনির ঐতিহাসিক সত্যতা বা যৌক্তিকতার প্রশ্নে যাচ্ছি না। কিন্তু যে গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করেন তাঁদের গ্রামের নাম হেরে যাওয়া থেকে এসেছে, সে গ্রামটা কেমন হতে পারে? পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মুসলমান-অধ্যুষিত গ্রামের মতোই। কেউ ব্যবসা করেন, ছোটোখাটো মুদি দোকান চালান, বাসে-ট্রেনে ফেরি করেন, কিছু মানুষ চাষবাস করে থাকেন আর বেশ কিছু মানুষ ভিক্ষা করে পেট চালান। সামান্য কিছু মানুষ চাকরি করলেও, কলেজের গণ্ডি পেরনো মানুষের সংখ্যা এখনও নেহাতই কম।
আমি যখন ছোটো ছিলাম, তখন আশেপাশে ভালো স্কুল সে অর্থে ছিল না। তাই আমরা গ্রাম ছেড়ে চলে আসি বাগনানে, আমায় ভর্তি করা হয় বাগনান সেন্ট টমাস স্কুলে। ক্লাসে ভালোই ফল করতাম। ধারাবাহিকভাবে প্রথম স্থানে থাকার জন্যেই হোক বা আর পাঁচজন বাবা-মায়ের মতোই অপত্যের প্রতি উচ্চাশাতেই হোক, বাপি-মা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল ক্লাস ফাইভে আমায় ভালো কোনও স্কুলে ভর্তি করতে। সেই সূত্রেই আল আমীন মিশনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমাদের। হাওড়া-হুগলীর সীমান্তে খলতপুর গ্রামে এই আবাসিক স্কুল। আমাদের আর্থিক অবস্থা তখন মোটেও ভালো ছিল না। ব্যবসায় একের পর এক ক্ষতির পর বাপি দেনার দায়ে সর্বস্বান্ত। কিন্তু আমার পড়াশোনার জন্যে তাঁকে সেভাবে দুশ্চিন্তা করতে হয়নি। আল আমীন মিশনের সাধারণ সম্পাদক এম নুরুল ইসলাম আমাদের স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, অর্থটা কোনও অন্তরায় নয় এই স্কুলে পড়তে গেলে। মিশনের স্টাইপেন্ডে অনেকটাই মকুব হয়ে যেত মাসিক বেতন।

শুধু তো আমি নই। গত তিন দশকে হাজার হাজার মুসলমান ছাত্র-ছাত্রী এই মিশন থেকে বিনা ব্যয়ে, অর্ধ ব্যয়ে বা স্টাইপেন্ড নিয়ে পড়াশোনা করেছে, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দারিদ্রের গহ্বর থেকে আলোর দিকে টেনে তুলে এনেছে নিজের পরিবারকে। আজ আল আমীন মিশনের শাখা সারা রাজ্যের জেলায় জেলায়। কিন্তু কোথা থেকে আসে এই বিপুল কর্মযজ্ঞকে টিকিয়ে রাখার খরচ? উত্তর – যাকাত। নিজের আয়ের আড়াই শতাংশ দরিদ্রদের দান করা মুসলমানদের জন্যে নামাজ পড়া বা হজে যাওয়ার মতোই অবশ্যকর্তব্য। সারা দেশের ধনী মুসলমান ব্যবসায়ীদের থেকে তাঁদের এই যাকাতের অর্থ জোগাড় করে বেড়ায় আল আমীন মিশন। যাকাতের অর্থও যে সমাজ গড়ার কাজে এভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটা মুসলমান সমাজকে আল আমীন মিশনই প্রথম দেখিয়েছে। তাই প্রায় হাজার দশেক ছাত্র-ছাত্রীকে প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়াও আল আমীন মিশনের বড় সাফল্য অন্য জায়গায়। সারা পশ্চিমবঙ্গে এই স্কুলকে মডেল করে গড়ে উঠেছে আরও প্রায় এক কুড়ি প্রতিষ্ঠান। এমনকি আমাদের গ্রামেও মাওলানা আজাদ এ্যাকাডেমি নামে এরকম একটা আবাসিক স্কুল গড়ে উঠেছে। গত এক দশকে এই এ্যাকাডেমি পশ্চিমবাংলার মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাপ্রসারের কতটা ফলপ্রসূ ভূমিকা নিয়েছে, সে পরিসংখ্যান এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটা হল, এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমাদের গ্রামে একটা পরিবর্তনের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে। সারা পশ্চিমবাংলা থেকে ছাত্ররা আসছে আমাদের গ্রামে পড়তে – এই একটা তথ্যই আমাদের গ্রামের মানুষকে সচেতন করে তুলেছে শিক্ষার ভূমিকা সম্পর্কে। নিজেদের ভাগ্যকে, সরকারকে বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের দোষারোপ না করে শিক্ষার্জনের মাধ্যমেই কেবল এ রাজ্যের পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের দুর্গতির অবসান ঘটতে পারে। হ্যাঁ, শিক্ষার মাধ্যমে দারিদ্রের মোকাবিলাও করা যায় – এই সারসত্যটা অনুধাবন করতে পেরেছেন এলাকার মানুষ। হেরে যাওয়া থেকে আলোর দিকে মুখ ফেরাচ্ছেন আমাদের গ্রামের লোকজন।

অনেকেই প্রশ্ন করেন – আল আমীন মিশন কি একটা মাদ্রাসা? সেখানে শুধু মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরাই পড়াশোনা করার সুযোগ পায় কেন?

প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলি, আল আমীন মিশন বা এরকম আরও যে প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের আর বাকি স্কুলগুলোতে সে পাঠক্রম অনুসরণ করা হয়, সেই একই পাঠক্রমে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনা করে।

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে আল আমীন মিশনের সাধারণ সম্পাদক এম নুরুল ইসলামের বক্তব্য তুলে ধরি। তিনি বলেন,

“আমাদের দেশ একটা পরিবার। একটা পরিবারের এক ভাই বেশ অবস্থাসম্পন্ন আর অন্য ভাই হতদরিদ্র হলে সেই পরিবারে অশান্তি নেমে আসতে বাধ্য। তেমনই আমাদের দেশেরও একটা অন্যতম প্রধান জনগোষ্ঠী যদি শিক্ষার আলো না পায়, যদি সারা জীবন দারিদ্রের সাথে লড়াই করতে থাকে, তাহলে আমাদের দেশের সার্বিক উন্নতি কখনও সম্ভব নয়।”

একই কথা প্রযোজ্য আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রেও। পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজটাকে টেনে তুলতে হলে সংরক্ষণ দরকার বুনিয়াদী স্তরে। আল আমীন মিশন সেই কাজটাই করতে চেয়েছে। আল আমীন মিশনের দরজা সবার জন্যে উন্মুক্ত হয়ে গেলে মুর্শিদাবাদ, মালদা বা দিনাজপুরের মত জেলাগুলো থেকে যে সব নিম্নবিত্ত ছেলেমেয়েগুলো আজ ইঞ্জিনীয়ারিং বা মেডিকাল কলেজে পড়ছে; হয়তো তারা কোনওদিনও স্কুলের গন্ডিও পেরোতে পারত না।

আল আমীন মিশনের কথা এতটা দীর্ঘ পরিসরে বললাম একটাই কারণে। এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা গত তিন বছরে সারা রাজ্যের এম বি বি এস আসনের প্রায় দশ শতাংশ অধিকার করে ফেলেছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে, শুধুমাত্র পরিশ্রমের জোরেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মেধার থেকেও খুব বেশি প্রয়োজন পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ের। আমি নিজে যখন মিশনে পড়তাম, তখন একটা চালু কথা বলতাম আমরা – “আল আমীন মিশন কখনও ঘুমোয় না।” এর অর্থ হল, চব্বিশ ঘণ্টার যে কোনও সময় যদি মিশনের সব ঘরগুলো খুঁজে দেখা হয়, তাহলে দেখা যাবে কেউ না কেউ পড়ছেই। আমাদের সাধারণ সম্পাদক, যাঁকে আমরা স্যার বলেই ডাকি, সেই স্যার তো বলতেনই – “যে মানুষটা একদিন সকালে উঠে দেখল সে বিখ্যাত হয়ে গেছে, সে কিন্তু এতদিন ঘুমোচ্ছিল না।” তাই আমরা চেষ্টা করতাম, খুব কম সময় ঘুমিয়ে দিনের বেশিরভাগ সময়টাই পড়াশোনার কাজে লাগাতে। আমি নিশ্চিত সেই ট্র্যাডিশন এখনও বজায় আছে। নাহলে ৫৫ শতাংশের বেশি ছাত্র-ছাত্রী উচ্চমাধ্যমিকে ৮০ শতাংশের ওপর মার্কস পায় কী করে? প্রতিবছর জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় এই চোখ ধাঁধানো সাফল্য আসে কী করে?

আর এই হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন স্যার। লাখ-লাখ টাকার দেনা মাথায় নিয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিবছর কয়েকশো সংসারে হাসি ফুটিয়ে চলেছেন যিনি, তাঁকে কেন যে এখনও এ দেশের অন্যতম শিক্ষাবিদ হিসাবে চিহ্নিত করা হল না সেটাই আশ্চর্যের। অবশ্য স্বীকৃতি যে একেবারেই আসেনি তেমনটা নয়, এ বছরই আল আমীন মিশন সংখ্যালঘুদের মধ্যে শিক্ষার বিকাশে অবদানের জন্যে বঙ্গভূষণ সম্মান পেয়েছে। একটাই প্রার্থনা, পুরস্কারের ঔজ্জ্বল্যে আমাদের স্যার, মিশনের শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীর ঘামের দাগটা যেন কখনও ঢাকা না পড়ে যায়।

স্যার প্রায়ই বলতেন, “বিজ্ঞান অনেক কিছুই আবিষ্কার করেছে এবং করবে। কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প কোনওদিনই আবিষ্কৃত হবে না।” মাঝে মাঝেই এই নিয়ে আমরা তর্ক করতাম, বিপক্ষে যুক্তি সাজাতাম, কিন্তু কথাটা যে কতটা সত্যি তা টের পেয়েছিলাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হওয়ার পর।

জয়েন্ট এন্ট্রান্সে আমার র‍্যাঙ্ক হয়েছিল ৫৪০। কাউন্সেলিং-এ দেখা গেল যাদবপুর বা শিবপুরে ইলেক্ট্রিকাল বা মেকানিকাল এগুলো পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু আমার বরাবরই ইচ্ছা ছিল ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে পড়ব। তাই পাড়ি জমালাম ভিন রাজ্যে। কেরালার কালিকটে ভর্তি হলাম। আর ই সি-গুলো সে বছরই এন আই টি-তে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছিল। এন আই টি কালিকট ছিল তার মধ্যেই একটা। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর অথৈ সাগরে পড়লাম। সব রাজ্যের ছাত্র সবকিছুই জানে দেখা গেল। কিন্তু আমরা পশ্চিমবঙ্গের ছাত্ররাই শুধু পিছিয়ে। আমরা না জানি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, না জানি ম্যাট্রিক্স। অন্যান্য রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীরা এইসব তাদের প্লাস টু লেভেলেই শিখেছে। তাই স্বভাবতই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থেকেই দৌড় শুরু হল। আর কী করে জানি না, আস্তে আস্তে পিছিয়েই যেতে থাকলাম। প্রথম বছরের দুটো সেমেস্টারে মোটামুটি উতরে গেলাম। পরের বছরে ব্যাপারটা আরও কঠিন হয়ে গেল। থার্ড সেমেস্টারে টেনেটুনে সব বিষয়ে পাস করলেও ফোর্থ সেমেস্টারে গিয়ে দুটো বিষয়ে ফেল করলাম। তাও ইলেক্টনিক্স-এর খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটো বিষয়ে – ইলেক্ট্রনিক্স সার্কিট আর ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক্স-এ।

আমি আল আমীন মিশনের ছাত্র, একডাকে সবাই সেখানে আমায় চেনে ভালো ছাত্র হিসাবে, সেই আমি ফেল করেছি? কালিকটে আসার আগে আমাকে গ্রামের মানুষজন ধুমধাম করে বড় অনুষ্ঠানের আয়োজনে অনেক উপহার দিয়ে আমায় সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন। মনে হল, আমার বাপি-মা, পরিবার-পরিজন, গ্রামের মানুষ সবার মাথা হেঁট করে দিয়েছি আমি। দুটো বছর কলেজে কাটানোর পর মনে হল, আমি আমার বাবার কষ্টোপার্জিত উপার্জন নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই করিনি।

থার্ড ইয়ারের ক্লাস শুরু হল। দেখলাম, ক্লাসের মধ্যেই কেউ কেউ আমার দিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। খারাপ লাগল। একদিন আমাদের ব্যাচের এ্যাকাডেমিক এ্যাডভাইজার নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন। খুব সত্যি বলতে কী, ভেবেছিলাম হয়তো আমায় বলবেন – “মন দিয়ে পড়ো। পরিশ্রম করলে কী না হয়? দরকার হলে আমি তোমায় সাহায্য করব ইত্যাদি ইত্যাদি।” কিন্তু সেসব দিকে না গিয়ে আমার এ্যাকাডেমিক এ্যাডভাইজার শান্তস্বরে আমায় বোঝালেন – “তুমি চাইলে এখনও বাড়ি ফিরে যেতে পারো। সবার জন্যে সবকিছু নয়। আমি পঁচিশ বছর এখানে পড়াচ্ছি। বহু ছাত্র দেখেছি এই চাপ নিতে পারে না। তুমি চাইলে এখনও গ্র্যাজুয়েশান বা ডিপ্লোমা করে ঠিকঠাক চাকরি জোগাড় করে নিতে পারবে।” খুব সত্যি বলতে কী, জীবনে এতবড় মোটিভেশান আমি পাইনি। ফেল করায় আমার ইগোতে লেগেছিল ঠিকই। সহপাঠীরা আমার পেছনে আমায় নিয়ে আলোচনা করছে বুঝতে পেরে বেশ কষ্টও পেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ আমার মুখের ওপর আমায় বলল ‘ছেড়ে দাও’, আমার অহং-এ এতবড় আঁচড় আর কেউ কখনও দিতে পারেননি।

জেদ চেপে গেল। ক্লাসে মন দিয়ে পড়া শুনতে লাগলাম। না বুঝতে পারলে একাধিকবার জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলাম। প্রথম সারির ছাত্রদের থেকে নোটস ধার নিতে লাগলাম। লাইব্রেরি গিয়ে রেফারেন্স বই পড়তে শুরু করলাম। মোট কথা, ‘ভালো কিছু হবে না’ ধরে নিয়ে গত দু বছর যা করিনি, এবার তার সবকিছুই করতে শুরু করলাম। ফল পেলাম হাতেনাতে। ফিফথ সেমেস্টারে আমি শেষে চারটে সেমেস্টারের থেকে বেশি জিপিএ পেলাম। কিন্তু তার পরের সেমেস্টার ছিল আমার জীবনের সবথেকে কঠিন সময়। ফোর্থ সেমেস্টারের ফেল করা দুটো সাবজেক্টে পাস করতে হবে। কিন্তু সেটাই সব নয়। সেই দুটো সাবজেক্টে ৮০ শতাংশ এ্যাটেন্ডেন্সও থাকতে হবে, নাহলে ফাইনাল পরীক্ষায় বসতে পাব না। অর্থাৎ জুনিয়ারদের সঙ্গে ক্লাসে বসতে হবে, এটাই শুধু বিড়ম্বনার ব্যাপার নয়। কলেজের প্রতিদিনের স্লট মিলিয়ে এমন সব সাবজেক্ট নিতে হবে, যাতে মোট আটটা বিষয়ের ক্লাস করতে পারি এবং প্রত্যেকটাতেই অন্তত ৮০ শতাংশ এ্যাটেন্ডেন্স রাখতে পারি।

আমাদের ইলেক্টিভ সাবজেক্ট নেওয়ার বিকল্পও ছিল অন্য ডিপার্টমেন্ট থেকে। তাই হিউম্যানিটিজ থেকে নিয়েছিলাম ইকনমিক্স। এতে করে স্লটের হিসাব মেলানো গেলেও সারাদিন ক্লাস করতে হত। অন্য সহপাঠীরা অফ-পিরিয়ড পেত একটা-দুটো করে। কিন্তু আমার সে উপায় ছিল না। সেমেস্টারের মাঝে দুটো করে ইন্টারনাল টেস্ট থাকত। তখনও আমায় কোনও কোনও দিনে চারটে করে টেস্ট দিতে হয়েছে। এক কথায়, সারাদিন পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনও কাজ ছিল না আমার। সিক্সথ সেমেস্টারের রেজাল্ট বের হতে দেখা গেল, সবকটা বিষয়েই ভালোভাবে পাস করেছি। এবারের জিপিএ আগের সেমেস্টারের থেকেও বেশি।

এরপর এলো জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণ – ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ। থার্ড ইয়ারের শেষেই নামী কোম্পানি আসে চাকরির অফার নিয়ে। বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন রকম কাট-অফ। যদিও শেষ দুটো সেমেস্টারে আমি অনেকের থেকেই ভালো করেছিলাম, তবুও প্রথম চারটে সেমেস্টারের কারণে আমার সিজিপিএ ডন ব্র্যাডম্যান টাইপ একটা জায়গায় ছিল – ৫.৯৯৬, যেটা দেখেই কোনও কোম্পানিই পরীক্ষায় বসতে দিত না।

সপ্তা দুয়েক কেটে গেছে। কলেজের অনেকেই ভালো ভালো চাকরি পেয়ে গেছে। এক সকালে এলো ইনফোসিস। এই প্রথম একটা কোম্পানি যাদের কাট-অফ ছিল আমার নাগালের মধ্যেই। এরপর হয়তো আর কোনও কোম্পানির ক্ষেত্রে এই সুযোগ পাওয়া যাবে না। টেস্টে বসার সুযোগ পেলাম। কিন্তু হলে গিয়ে দেখি অধিকাংশ এইট সিজিপিএ পাওয়া ছেলেমেয়ের ভিড়। কিন্তু আমি এতদিনে এটুকু বুঝে গিয়েছিলাম, নিজের সেরাটা দিতে পারলে আমায় কেন, যে কোনও মানুষকেই আটকানো শক্ত। তাই মরিয়া চেষ্টা চালালাম। মাথা ঠাণ্ডা রেখে একের পর এক উত্তর দিয়ে গেলাম। দিনটা আমারই ছিল নিশ্চিত। কয়েক ঘণ্টা পরে দেখলাম তালিকার একেবারে প্রথম দিকেই আমার নাম। এবার ইন্টারভিউ। কী করে যেন সেটাও ঠিকঠাক হয়ে গেল সব। চাকরিটা শেষ পর্যন্ত পেয়েই গেলাম আমি।

হাতে একটা চাকরির অফার থাকায় কলেজের শেষ বছরটা হয়ে গেল দারুণ আনন্দের। ততদিন বেশি মার্কস পাওয়ার অভ্যাসটা ফিরে এসেছে। তাই দারুণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই পড়াশোনা করতে লাগলাম। ফাইনাল ইয়ার প্রোজেক্টে বিষয় বেছে নিলাম বেশ কঠিন। মোবাইল কমিউনিকেশানে ডেটা লস কমিয়ে যাতে যোগাযোগ আরও উন্নত করা যায়, তেমন নতুন একটা এ্যালগরিদমের খোঁজ। প্রোজেক্ট গাইড বারণ করেছিলেন, বিষয়টা শক্ত, মাস্টার্স-এও কেউ এমন প্রোজেক্ট নেওয়ার আগে দুবার ভাবে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম – “যদি দিনরাত খাটি তাহলে হবে?” উনি বলেছিলেন, “তোমায় বিশ্বাস রাখতে হবে তুমি পারবে, তাহলে হবে।” তারপর একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন – “আমি বিশ্বাস করি না, তুমি পারবে।”

কিন্তু পেরেছিলাম। কারণ আমি জানতাম, লেগে থাকলে হবে। সারাজীবন তাই তো দেখেছি চোখের সামনে। বাপিকে আকণ্ঠ ঋণে ডুবে গিয়েও লড়াই করে একটু একটু করে উঠে আসতে দেখেছি। হাজারটা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে স্যারকে দেখেছি মিশনকে নিয়ে এগিয়ে যেতে। সৌরভ গাঙ্গুলিকে ভারতীয় টিমে ফিরে আসতে দেখেছি। রকি বালবোয়াকে রিং-এর মধ্যে পড়ে গিয়েও তারপর উঠে প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করতে দেখেছি। অতএব আমি জানতাম, আমিও পারব।

ফাইনাল রেজাল্ট বের হওয়ার পর দেখা গেল একটা সম্মানজনক জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে আমার সিজিপিএ। না ফার্স্ট ক্লাস আমি পাইনি, তবে ইনফোসিসের পর এ্যাক্সেঞ্চার থেকেও চাকরির অফার পেয়েছি। মোট কথা, সব ভালোই হয়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। দেখা করতে গেলাম আমার প্রোজেক্ট গাইডের সঙ্গে। তিনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন – “আমি কখনও বিশ্বাসই করিনি তুমি এই প্রোজেক্ট শেষ করতে পারবে।” আমি জানি, ওঁর কাছে গত চার বছরে আমিই প্রথম প্রোজেক্ট করেছি। তাই লড়াইটা দুজনেরই ছিল। চোখের জলে বিদায় জানালেন আমাকে। ডিপার্টমেন্টের সমস্ত প্রোফেসার, লেকচারারদের ঘরে ঘুরে ঘুরে দেখা করে এলাম। ভাবিনি এমন হবে দিনটা। চারদিকে আনন্দ, খুশি। একেবারে শেষে গেলাম আমাদের এ্যাকাডেমিক এ্যাডভাইজারের ঘরে। কলেজ ছাড়ার শেষ দিনে যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি, তাতে ওঁর ভূমিকা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। হাসিমুখে বিদায় দিলেন।

তারপর গত ন বছর ধরে আমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। কলেজে যেখানে শেষ করেছিলাম, এখানে ঠিক সেখান থেকেই শুরু করেছি। এখন আমি একজন প্রোজেক্ট ম্যানেজার। অফিসের কাজ সামলেও নিজের লেখালেখির পাশাপাশি একটা প্রকাশনা সংস্থারও আমি কর্ণধার। অনেকেই আমায় জিজ্ঞাসা করেন, “চাকরির পরেও প্রকাশনার দায়িত্ব সামলাও কী করে?” আমি উত্তর দিই, অফিস ছাড়া আমি এটাই করি। অফিসে বারো ঘণ্টা আর সৃষ্টিসুখে বারো ঘণ্টা। তাহলে ঘুমোই কখন? কেন পরের দিন? শিবরাম-মাফিক মজা ছেড়ে যোগ করি, আমি কোনও পার্টিতে যাই না, আইপিএল-এর ম্যাচ দেখতে মাঠে যাই না, উইকএন্ডে বন্ধুদের বাড়ি খেতে যাই না। মোট কথা অফিসে যাওয়া ছাড়া ব্যাঙ্গালোরের ছোট্ট ফ্ল্যাট থেকে বেরোই না কোথাও। ইন্টারনেটেই মুদির বাজারটাও সেরে ফেলি, বাড়ি ডেলিভারি দিয়ে যায়। আর সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমি মনে দিয়ে কাজ করে যাই। এমনিতে মধ্যমেধার মানুষ আমি, তাই পরিশ্রমটাই সম্বল। আর কে না জানে – “যে মানুষটা একদিন সকালে উঠে দেখল সে বিখ্যাত হয়ে গেছে, সে কিন্তু এতদিন ঘুমোচ্ছিল না।”

'কর্মক্ষেত্র' পত্রিকাতে পূর্ব-প্রকাশিত


লেখক পরিচিতিঃ রোহণ কুদ্দুস একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার।  পেশাগত কাজের বাইরে কবিতা এবং গদ্য লেখেন। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ। সৃষ্টিসুখ নামের একটা প্রকশনা সংস্থা এবং সৃষ্টি নামের একটি অনলাইন ম্যাগাজিন চালান।

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.

 


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।