বাইশ গজের বন্ধু
আবেশ কুমার দাস
In any game, the game itself is the prize, no matter who wins, ultimately both lose the game.
মহাভারতের কিস্সা কি শুধুই কুরুক্ষেত্রে? তা তো নয় মোটেই। বাইশ গজেই কি চুকেবুকে গেল সব বোঝাপড়া? মনে তো হয় না। এই সেই ক্ষাত্রতেজের কুরুভূমি দশ ফুট বাই বাইশ গজ। রান উইকেটের শুকনো পাটিগণিতের নিঃসাড়ে লৌকিক জীবনের কত অলৌকিক কান্নাহাসিরা সেই কবে থেকে অন্তঃসলিলা হয়েছে যার আপাত নিষ্প্রাণ অস্তিত্বের গভীর পরতে পরতে। জীবনের কুসুমিত ভোরে সোনালি সম্ভাবনার পথে এখানেই পাঁচিল হয়ে দাঁড়ায় হীন মাৎসর্য। আবার অজান্তেই কবে যেন এই বন্ধুর জগতেই তৈরি হয়ে ওঠে সম্পর্কের এমনই গভীর রসায়ন—একসঙ্গে বিয়ার পাবে যাওয়ার সেই ধূসর সন্ধ্যাগুলিতেও একদিন টের পাওয়া যায়নি যার আঁচ। চিরতরে চলে যাওয়ার দিন এই কারণেই কি তবে এই ক্ষাত্রভূমিকে সশ্রদ্ধ প্রণাম করেছিলেন শচীন তেন্ডুলকর?
আবারও সেই সিডনি শহর। আবারও এক সফররত ভারতীয় টেস্ট দলের অনুশীলনের নেট। জাতীয় দলের নেতৃত্বের ব্যাটনটি মহম্মদ আজহারউদ্দিনের কবজা থেকে ইতিমধ্যে সৌরভ গাঙ্গুলীর হাতে। ১৯৯১-৯২ সফরের সেই প্রবল সম্ভাবনাময় রুমমেটও ততদিনে ‘আধুনিক সময়ের ডন’। কে ভেবেছিল বেসরকারি ভাবে হলেও সেই ‘ডন’-এর তরফেই আসবে এমন এক অভাবিত আমন্ত্রণ! বারো বছর আগের সেই অভিষেক টেস্টের বঞ্চনাময় দ্বিতীয় ইনিংসের কোটা প্রতীকী অর্থে হলেও কিছুটা পুরিয়ে নেওয়ার। আসলে আর সব্বাই ভুলে গেলেও শচীন তেন্ডুলকর যে কোনওদিনও ভুলতে পারেননি প্রথম অস্ট্রেলিয়া সফরের সেই পুরনো রুমমেট সুব্রত ব্যানার্জিকে।
সফরকারী ভারতীয় টেস্ট দলের সদস্য হিসেবে ১৯৯১-৯২ থেকে ১৯৯২-৯৩ মরসুমের মধ্যবর্তী সময়ে পর পর তিনটি বিদেশ সফরে যাওয়া (যার শেষ দু’টি দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের যথাক্রমে প্রথম জিম্বাবোয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফর) এই দীর্ঘকায় পেসারের জন্ম ১৯৬৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন বিহারের পাটনায়। এম আর এফ পেস ফাউন্ডেশনের একেবারে প্রারম্ভিক পর্বের ছাত্র সুব্রতর প্রথম জাতীয় নির্বাচকদের দূরবিনে আসা ১৯৮৯-৯০ মরসুমের একটি রঞ্জি ম্যাচে ৭৮ রানে ১২ উইকেট তুলে নিয়ে একাহাতে ত্রিপুরাকে ধ্বংস করার মাধ্যমে। ডানহাতে মিডিয়াম-ফাস্ট বলের পাশাপাশি ব্যাটের হাতটাও নেহাত মন্দ ছিল না। নিয়তির খেয়াল কিনা বলা শক্ত, যে কোনও ধরনের অস্ট্রেলীয় অনুষঙ্গের সঙ্গেই যেন বরাবর সুব্রতর এক ভিন্নতর রসায়ন। মাদ্রাজের (অধুনা চেন্নাই) পূর্বোল্লিখিত পেস ফাউন্ডেশনে পরিণতির দিনগুলিতে শিক্ষাগুরু হিসেবে বিশ্ববিশ্রুত ফাস্ট বোলার ডেনিস লিলিকে পাওয়া থেকেই বোধহয় যার সূচনা।
১৯৯১-৯২ মরসুম। হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে আসন্ন পাঁচ টেস্টের সিরিজের জন্য সফরকারী ভারতীয় দল নির্বাচন। অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ১৯৯২ বিশ্বকাপের ঠিক প্রাক্কালে উক্ত সফরটির উদ্দেশ্যই ছিল বিশ্বকাপের পূর্বাহ্নে মাসাধিক কাল ক্যাঙারুর দেশে কাটিয়ে অস্ট্রেলীয় পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নেওয়া (ঠিক যেভাবে ২০১৫ বিশ্বকাপের কয়েক মাস আগেই চার টেস্টের সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়ায় উড়ে উড়ে গিয়েছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত)। উক্ত আবহাওয়ায় তেইশ ছুঁই ছুঁই সুব্রতর উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই মহম্মদ আজহারউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন দলে রাখা হয়েছিল তাঁকে। প্রসঙ্গত উক্ত সফরেই প্রথমবারের জন্য জাতীয় দলে নির্বাচিত হয়েছিলেন আরও এক বঙ্গসন্তান। সৌরভ গাঙ্গুলী।
০-২ ফলাফলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় নতুন বছরের দ্বিতীয় দিন সকালে সিডনিতে শুরু হতে চলা তৃতীয় টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১১৮১) চূড়ান্ত এগারোয় ভারত কোনও বিশেষজ্ঞ স্পিনার রাখল না (রবি শাস্ত্রী ততদিনে স্রেফ ব্যাটিং অলরাউন্ডার)। চতুর্থ পেসারের ভূমিকায় ১৯৪তম ইন্ডিয়া টেস্ট ক্যাপ হিসেবে অভিষেক ঘটল সুব্রত ব্যানার্জির। হয়তো চার পেসারের কথা মাথায় রেখেই টসে জিতে ফিল্ডিং-এর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মহম্মদ আজহারউদ্দিন। প্রথম পরিবর্ত হিসেবে এসে জেফ মার্শের লেগস্ট্যাম্প নড়িয়ে দিলেন নবাগত সুব্রতই। এবং ১২৭ রানের মধ্যে এরপর পড়ে যাওয়া মার্ক টেলর ও মার্ক ওয়ার উইকেট দু’টিও জমা হল তাঁর ঝুলিতেই। অভিষেক টেস্টে এভাবে প্রায় তুরীয় ছন্দ যখন পেয়ে গিয়েছেন দীর্ঘদেহী বঙ্গসন্তান ঠিক তখনই আক্রমণ থেকে সরিয়ে নেওয়া হল তাঁকে। এবং প্রথম ইনিংসে ১৭০ রানে পিছিয়ে পড়ে ৬ জানুয়ারি সকালে আবার ব্যাট করতে নামা দ্বিতীয় অস্ট্রেলীয় ইনিংসে আর কখনও বল হাতে ফিরে এলেন না সেই প্রথম সকালের নায়ক।
এই সফরেই প্রথম টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক:১১৭৭) ব্রিসবেনে ১৯৩তম ইন্ডিয়া টেস্ট ক্যাপটি হাতে পেয়েছিলেন জাভাগল শ্রীনাথ। পাঁচটি টেস্টেই খেলানো হয়েছিল তাঁকে। অন্যদিকে সুব্রত বাদ পড়েন অ্যাডিলেডে পরবর্তী টেস্টেই। সিরিজ শেষে দেখা গেল ভারতীয়দের মধ্যে বোলিং গড়ে সবার উপরে নাম রয়েছে সুব্রতর (গড় ১৫.৬৬)। আর সবার তলায় শ্রীনাথের (গড় ৫৫.৩০)। পরিসংখ্যান অবশ্যই বলে দেয় না সবকিছু। কিন্তু সেই নিরিখে গভীরতর বিশ্লেষণে বসলেই আজ উঠে আসবে আরও কিছু প্রশ্ন। উক্ত সফরের আড়াই দশক পরে আজ পিছন ফিরে তাকালে দেখা যাবে টেস্টগুলি অনুষ্ঠিত হয়েছিল যথাক্রমে ব্রিসবেন, মেলবোর্ন, সিডনি, অ্যাডিলেড ও পার্থে। মনে রাখতে হবে, সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডই সমগ্র অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সেই একমাত্র ময়দান যার চরিত্র ভারতের পক্ষে কিছুটা হলেও অনুকূল। শেষ তিন-চারটে সেশনে কিছু কিছু ভেলকি দেখানোর সুযোগ থাকে স্পিনারদের। খোদ অস্ট্রেলিয়াই তাদের ৩৫০তম টেস্ট ক্যাপটি শ্যেন ওয়ার্নের হাতে তুলে দিয়েছিল এই টেস্টে। আর এখানেই কিনা ভারতের তরফ থেকে বেঙ্কটপতি রাজুকে সরিয়ে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হল এক তরুণ পেসারকে (এমনকি এই টেস্টের দ্বাদশ ব্যক্তিও ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী, রাজু নন)! আর্কাইভে রক্ষিত টেস্টের চতুর্থ ঘণ্টার ধারাবিবরণীতে পাচ্ছি,
The commentators believe that this may be the first time ever that India have picked four specialist fast bowlers in a test. They also suspect it might be the last... Waugh played a strange kind of shot, got a thick edge and Prabhakar, now in the gully, took an easy catch. Three wickets to Banerjee.
আবার ঠিক যখনই বিদেশের মাটিতে শোরগোল তুলে ফেলার উপক্রম ঘটাচ্ছেন সুব্রত, তখনই সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। অ্যাডিলেডে পরবর্তী টেস্টে তো বটেই, এমনকি পার্থের উইকেটেও চূড়ান্ত একাদশে ফিরছেন বেঙ্কটপতি রাজু! বারো জনের দলেও রাখা যাচ্ছে না সুব্রতকে! দ্বাদশ ব্যক্তি হিসেবে উঠে আসছে প্রবীণ আমরের নাম!
দুঃখের কথা, বাঙালি পেসারের জীবনে বঞ্চনার ইতিবৃত্ত এখানেই শেষ হল না। বরং শুরু হল। মহম্মদ আজহারউদ্দিন যে তাঁকে পছন্দ করেন না সেই সত্যটুকু ততদিনে স্রেফ ওপেন সিক্রেট। ১৯৯২-৯৩ মরসুমে ছিল ভারতের পর পর দু’টি বিদেশ সফর। অক্টোবরে সদ্য টেস্ট-কৌলীন্য পাওয়া জিম্বাবোয়ের সঙ্গে হারারেতে একমাত্র টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১১৯৭)। এবং তারপরেই দীর্ঘ একুশ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে ক্রিকেটের মূলস্রোতে ফিরে আসা দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে নভেম্বর থেকে জানুয়ারি অবধি বিস্তৃত ভারতের চার টেস্টের পূর্ণাঙ্গ সিরিজ। মনে রাখা দরকার, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী নীতির ঘোরতর বিরোধী ছিল ভারতবর্ষ (ক্রিকেটেই নয় শুধু—১৯৭৪ ডেভিস কাপ ফাইনালেও স্বেচ্ছায় না খেলে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ জলাঞ্জলি দিয়েছিল ভারত, যেহেতু অপর ফাইনালিস্টের নাম ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা)। ১৯৭১ পূর্ববর্তী অধ্যায়েও তাই গ্রেমি পোলকের দেশের সঙ্গে কোনও ক্রিকেটীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি পাতৌদি, ওয়াড়েকরদের। অর্থাৎ ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসেই সেই প্রথম আফ্রিকা সফর। দেওধর ট্রফির ফাইনালে ব্যাটে বলে ম্যাচ জেতানো পারফরম্যান্সের দৌলতে ষোলো জনের ভারতীয় দলের টিকিট জোগাড় করে ফেললেন সুব্রত।
আবার শুরু হল খেলার মাঠের বহুবন্দিত সেই কবজির মোচড়ের এক বহুনিন্দিত প্রয়োগ। পর্যাপ্ত সুযোগ না দিয়ে দিয়ে এক সম্ভাবনাময় তরুণকে ক্রমশ আত্মবিশ্বাসহীন হতাশাগ্রস্ত করে তোলার কুৎসিত খেলা। কোনও অর্থেই যাকে বলা চলে না জেন্টলমেনস গেম। ১৫ অক্টোবর জিম্বাবোয়েতে একটি ট্যুর ম্যাচে খেললেন সুব্রত। ২৯ অক্টোবর দক্ষিণ আফ্রিকায় নিকি ওপেনহাইমার একাদশের বিরুদ্ধে মোটামুটি ভালই বল করলেন। ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া কম্বাইনড বোলড একাদশের বিরুদ্ধে চারদিনের খেলায় দ্বিতীয় ইনিংসে ৫ উইকেট নিলেন ১৯ ওভারে মাত্র ২৯ রান খরচ করে। কিন্তু পর পর সেই দুই সফরের কোনও টেস্টের চূড়ান্ত একাদশেই আর শিকে ছিঁড়ল না। মজার কথা, সফর শেষে প্রথম শ্রেণির খেলাগুলির গড়ের বিচারে আবার ভারতীয় বোলারদের তালিকায় সবার উপরেই থেকে গেল তাঁর নাম (৬৩-২২-১৩১-৯, বোলিং গড় ১৪.৫৫)।
জীবনের অনেকানেক অপ্রাপ্তির নেপথ্যেই মানুষের ব্যক্তিগত দোষত্রুটির (যদি কিছু থাকেও) তুলনায় অনেকাংশে বৃহত্তর ভূমিকা রেখে যায় পরিস্থিতির বিরূপতা। সেই অঙ্গরাজ কর্ণের মহাকাব্যিক আমল থেকেই চলে আসছে এহেন দুর্ভাগ্যজনক ট্র্যাডিশন। নিয়তিতে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কূট তর্কে না ঢুকেও আপাতত এটুকুই বলতে পারি, অনেক পারিপার্শ্বিক অনুষঙ্গেরই ঘটন অঘটন রয়ে যায় মানুষের নাগালের বাইরে। দীর্ঘ ক্রিকেট জীবনের অধিকারী হয়েও টেস্ট খেলা হয়নি ক্লাইভ রাইসের। দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাসন পর্বও সমান্তরালে চলেছিল প্রায় অত বছরই। টেস্ট অভিষেকেই দেশকে নেতৃত্বদানের বিরল সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছিল জ্যাক হোমসকে। ১৯৩৯-৪০ মরসুমের সেই নির্ধারিত ইন্ডিয়া ট্যুর বিশ্বযুদ্ধের বাধ্যবাধকতায় বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিল ইংল্যান্ড (এবং আর কখনও টেস্ট খেলাও হয়নি হোমসের)। একমাত্র বাঙালি হিসেবে পাকিস্তানের টেস্ট ক্যাপ মাথায় চড়ানোর অতি বিরল সুযোগ হাতছাড়া হয়েছিল রকিবুল হাসানের। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাংলাদেশ (এবং ২৯ বছর লেগেছিল তারপর তাদের টেস্ট-কৌলীন্য লাভ করতে)।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরে পরবর্তী এক বছরে উপমহাদেশের মাটিতে পরের পর দশটি টেস্ট ছিল ভারতের। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে দেশের মাটিতে যথাক্রমে ইংল্যান্ডের সঙ্গে তিনটি ও জিম্বাবোয়ের সঙ্গে একটি টেস্ট। জুলাই-অগাস্টে শ্রীলঙ্কায় তিন টেস্টের সফর। এবং পরবর্তী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ভারতে শ্রীলঙ্কার তিন টেস্টের ফিরতি সফর। দক্ষিণ আফ্রিকায় যেভাবে পেস আক্রমণে সমৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিল দল, উপমহাদেশের মাটিতে স্বভাবতই নিরর্থক ছিল সেই স্কোয়াডকে ধরে রাখার। ষোলো জনের দল থেকে অবিলম্বে বাদ পড়েন চেতন শর্মা ও সুব্রত ব্যানার্জি (এছাড়াও বাদ পড়েছিলেন রবি শাস্ত্রী, সঞ্জয় মঞ্জরেকর ও অজয় জাডেজা)। এবং দেশের মাঠে চিরকালের বাঘ ভারতও টার্নিং পিচ বানিয়ে পরের পর ইংল্যান্ড ও জিম্বাবোয়েকে পেড়ে ফেলে। শুরু হয় তিন স্পিনার নিয়ে অধিনায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিনের বিজয়যাত্রা। জুলাই-অগাস্টে শ্রীলঙ্কাতেও ১-০ ফলাফলে সিরিজ জেতে ভারত (বিদেশের মাটিতে ভারতের ওই দশকের একমাত্র টেস্ট জয়)। নামে বিদেশ সফর হলেও শ্রীলঙ্কার পরিবেশও উপমহাদেশীয়ই। উপরন্তু সেই শ্রীলঙ্কা ছিল যথেষ্ট দুর্বল একটি টেস্ট দল। ১৯৯৩-৯৪ মরসুমে ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ফিরতি সিরিজে আবার ৩-০ ফলাফলে জয়। সব মিলিয়ে উক্ত দশটি টেস্টের আটটিতেই জিতেছিল ভারত (দু’টি অমীমাংসিত)। শুধু টিম ম্যানেজমেন্টই নয়, উইনিং কম্বিনেশন ভাঙতে চান না জাতীয় নির্বাচকরাও।
এছাড়াও অন্য কয়েকটি ঘটনা ঘটছিল ওই সময়টায়। কপিল দেব এসে দাঁড়িয়েছিলেন রিচার্ড হ্যাডলির তৎকালীন ৪৩১ টেস্ট উইকেটের বিশ্বরেকর্ডকে টপকে যাওয়ার মুখে। মনোজ প্রভাকরের মতো ব্যাটে বলে ইনিংসের সূচনা করা অলরাউন্ডার এবং কপিল দেবের মাপের মহিরুহের দৌলতে সমকালীন ভারতের দ্রুততম পেসার শ্রীনাথকেই তখন প্রায়শই বসে থাকতে হচ্ছে রিজার্ভ বেঞ্চে। ইংল্যান্ড ও জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে পরের পর দু’টি টেস্টে জোড়া দ্বিশতরান করে ক্রিকেটানুরাগী দেশবাসীকে মাতিয়ে দিয়েছেন নবাগত বিনোদ কাম্বলি। এমন ভরা বাজারে দলীপ ট্রফিতে পশ্চিমাঞ্চলের বিরুদ্ধে সুব্রত ব্যানার্জির ৬-৪৮ খতিয়ান বা মধ্যাঞ্চলের বিরুদ্ধে ৮১ রানের ইনিংসগুলি স্রেফ ধামাচাপা পড়ে যায়। ওদিকে পাতৌদির পদাঙ্ক অনুসরণ করে সেই মুহূর্তে দেশের মাটিতে আজহারউদ্দিনের অস্ত্র কুম্বলে-চৌহান-রাজু। হায়দ্রাবাদির বিজয়রথও ছুটছে এমনই ভীমবেগে যে বোম্বেকে রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন করেও এমনকি রবি শাস্ত্রীও (৮০ টেস্টের ১২১ ইনিংসে ১৪ বার অপরাজিত থেকে ৩৫.৭৯ গড়ে সংগৃহীত রান ৩৮৩০, সর্বোচ্চ ২০৬, শতরান ১১ ও অর্ধশত ১২ বার, ক্যাচ ৩৬টি, ১২৫ ইনিংসে ১৫৭৫১টি ডেলিভারিতে ৬১৮৫ রান খরচ করে ৪০.৯৬ গড়ে ও ২.৩৫ ইকনমি রেটে সংগৃহীত উইকেট ১৫১টি, সেরা বোলিং ৭৫ রানে ৫ উইকেট, ইনিংসে পাঁচ বা ততোধিক উইকেট ২ বার) দ্রুত প্রাক্তন হয়ে গেলেন। উপমহাদেশের বাইরে ভারতের পরবর্তী সফর ছিল ১৯৯৩-৯৪ মরসুমের নিউজিল্যান্ড। ততদিনে সুব্রত ব্যানার্জি স্রেফ বিস্মৃত এক নাম।
দেশের ক্রিকেটব্যবস্থা সংক্রান্ত আরও একটি বিষয়ও সেই মুহূর্তে হায়দ্রাবাদির হাত শক্ত করেছিল। ১৯৯৩ পরবর্তী কয়েক বছরে যাঁদের অন্তত শৈশবও কেটেছে তাঁরাই মনে করতে পারবেন ভারতবর্ষে ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনাটি চরমে উঠেছিল ঠিক ওই সময়। এবং অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ভারতের বাজারে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল সীমিত ওভারের ক্রিকেট। শারজা বা টরন্টোর মতো শহরে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান সীমিত ওভারের ক্রিকেট ম্যাচ মানেই ভরদুপুরে শুনশান হয়ে যেত শহরের রাস্তাঘাট। লক্ষণীয়ভাবে হাজিরা কমে যেত স্কুল-কলেজে। এই সীমিত ওভারের খেলার হাত ধরে ভারতীয় ক্রিকেটে যেমন এসেছিল রাশি রাশি অর্থ তেমনই দেশের মাটিতে ফি বছর অনুষ্ঠিত সেই ত্রিদেশীয় বা চতুর্দেশীয় সীমিত ওভারের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতাগুলিতে যেন তেন প্রকারেণ ভারতের সাফল্যও হয়ে উঠেছিল বাজারের পক্ষে এক অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ। পরিণামে মহম্মদ আজহারউদ্দিনের উক্ত টার্নার তথা তিন স্পিনারের ছকটির গুরুত্ব বেড়েই চলছিল দিনকে দিন। অর্থাৎ সামগ্রিক ভারতীয় ক্রিকেটব্যবস্থাতেই এই সময় হায়দ্রাবাদির ভূমিকা হয়ে উঠেছিল অপরিসীম। নিঃসন্দেহেই এই সময়ের পক্ষে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিলেন সুব্রত ব্যানার্জি। শরদিন্দুনাথ (শুঁটে) ব্যানার্জি (১টি টেস্টের ২ ইনিংসে ব্যাট করে সংগৃহীত রান ১৩, সর্বোচ্চ ৮, গড় ৬.৫০, ২ ইনিংসে ২৭৩টি ডেলিভারিতে ১২৭ রানের বিনিময়ে সংগৃহীত উইকেট ৫টি, সেরা বোলিং ৫৪ রানে ৪ উইকেট, গড় ২৫.৪০, ইকনমি রেট ২.৭৯) এবং সুধাংশু (মন্টু) ব্যানার্জি (১টি টেস্টের ১ ইনিংসে ব্যাট করে ০ রান, ২ ইনিংসে ৩০৬টি ডেলিভারিতে ১৮১ রানের বিনিময়ে সংগৃহীত উইকেট ৫টি, সেরা বোলিং ১২০ রানে ৪ উইকেট, গড় ৩৬.২০, ইকনমি রেট ৩.৫৪, ৩ টি ক্যাচ) অর্থাৎ দুই পূর্বতন ব্যানার্জি পেসারের চটিতে পা গলিয়েই যেন ‘ওয়ান টেস্ট ওয়ান্ডার’-এর তকমা নিয়ে দ্রুত জনারণ্যে মিশে গেলেন সুব্রত ব্যানার্জিও (১টি টেস্টের ১ ইনিংসে ব্যাট করে সংগৃহীত রান ৩, গড় ৩.০০, ১ ইনিংসে বল করে ১০৮টি ডেলিভারিতে ৪৭ রানের বিনিময়ে সংগৃহীত উইকেট ৩টি, গড় ১৫.৬৬, ইকনমি রেট ২.৬১)।
অসমর্থিত সূত্রে শুনেছি, কিছুটা মাথাগরম ধরনের মানুষ ছিলেন সুব্রত ব্যানার্জি। কোনওভাবে অধিনায়ককে চটিয়েছিলেন কিনা তা অবশ্য জানি না। তবে এক্ষেত্রে হয়তো বলা যায়, একা আজহারউদ্দিন কেন অনেক অধিনায়কেরই বিষনজরে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায় এমন ক্রিকেটারদের। আবার চিত্র-সাংবাদিক বা হোটেল বয়ের সঙ্গে স্বয়ং আজহারউদ্দিনের দুর্ব্যবহারও অনেকেই ভুলবেন না। এককালে খোদ সুনীল গাভাসকারকে অবধি তাঁর প্রতি ঈর্ষাকাতর বলে প্রকাশ্যে বিষোদ্গার করেছিলেন হায়দ্রাবাদি। পাশাপাশি ক্রিকেটার তথা মানুষ হিসেবে কেমন চরিত্রের অধিকারী ছিলেন সুব্রত ব্যানার্জি? অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯৭-৯৮ মরসুমের ঘরোয়া সিরিজ। দ্বিতীয় টেস্টটি (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৪০৯) খেলা হচ্ছে হায়দ্রাবাদির পয়মন্ত মাঠ কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে। ব্যাট হাতে পাঁচ নম্বরে নেমে অপরাজিত ১৬৩ রানের অসামান্য একটি ইনিংস খেললেন অধিনায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিন। তৃতীয় দিনের খেলার শেষে ছ’ বছরের পুরনো মান অভিমান ভুলে হায়দ্রাবাদিকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন সেই সুব্রত ব্যানার্জি (দ্বাপরের শেষপাদেও খুব সুলভ নয় এই ক্ষাত্র-সৌজন্য)। বিহার থেকে ততদিনে তিনি চলে এসেছেন কলকাতায়। বাংলার হয়ে খেলতে।
চিরকাল একরকম যায় না মানুষের। অধিনায়ক হিসেবে ১৪টি টেস্ট জিতে পাতৌদি এবং গাভাসকারকে টপকে যাওয়া হায়দ্রাবাদির জীবনেও এল দুর্দিন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপের পর হারালেন মুকুট। বাদ পড়লেন দল থেকেও (১৯৯৬ মরসুমের ইংল্যান্ড সফরের পরও কিছুদিনের জন্য হারিয়েছিলেন অধিনায়কত্ব, কিন্তু বাদ পড়তে হয়নি)। প্রতিভায় ক্ষমতায় কোনওকালেই তাঁর কয়েকশো মাইলের মধ্যেও না আসা দেবাং গান্ধির (৪টি টেস্টের ৭ ইনিংসে ১ বার অপরাজিত থেকে ৩৪.০০ গড়ে সংগৃহীত রান ২০৪, সর্বোচ্চ ৮৮, অর্ধশত ২ বার, ক্যাচ ৩টি) মতো ক্রিকেটারকেও তখন টেস্ট দলে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। আর কবজির মোচড়ের জন্য বিশ্বখ্যাত উইলো শিল্পী তিনি, মহম্মদ আজহারউদ্দিন, হায়দ্রাবাদের বাড়িতে (বা সঙ্গীতা বিজলানির সুবাদে বোম্বের ফ্ল্যাটে) বসে খেলা দেখছেন। খারাপ ফর্মই নয় শুধু, ততদিনে অনেক গুরুতর সন্দেহের তির তাঁর দিকে। এককালের অনুরাগীদের হৃদয় থেকেও হারিয়েছেন ভালবাসার আসন। পরিচিত সাংবাদিকদের দেখা পেলে বিলাপ করেন মিয়াঁ—‘আমি কী করেছি যাতে এই ব্যবহার পেতে হচ্ছে?’ সাংবাদিকদের মুখে প্রাক্তন অধিনায়কের এই খেদোক্তির কথা জানতে পেরে মন্তব্য করেছিলেন তৎকালীন এক সিনিয়র—‘আমি কী করেছি! তুমি কী করোনি? তোমার জন্য সুব্রত ব্যানার্জির কেরিয়ার নষ্ট হয়ে গেছে।’
যখন বাদ পড়েছিলেন খেলা হয়েছিল আটানব্বইটি টেস্ট। ১৯৯৯-০০ মরসুমে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ঘরোয়া সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে ব্যাঙ্গালোরে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৪৮৬) দলে ফিরে কেরিয়ারের ৯৯তম টেস্টটি খেললেন। ইনিংস পরাজয় বাঁচাতে না পারলেও দ্বিতীয় ইনিংসে আগাগোড়া ধ্বংসের মধ্যে দাঁড়িয়ে করলেন নিজের ২২তম টেস্ট সেঞ্চুরিটি। কিন্তু পশ্চিম দিগন্তে যে ইতিমধ্যে কালো মেঘ ঘনিয়ে এসেছে কে আর জানত! প্যান্ডোরার বাক্সের ডালা খুলে গেল হ্যান্সি ক্রোনিয়েরা দেশে ফিরতে না ফিরতেই। সামনে চলে এল বহু কলঙ্কিত সেই ম্যাচ ফিক্সিং অধ্যায়ের ভূত। আপাদমস্তক ভদ্রলোক হিসেবে সুপরিচিত ক্রোনিয়েকে দূরদর্শনের পর্দায় স্বীকারোক্তি দিতে বসে চোখের জল ফেলতে দেখল মূঢ় ক্রিকেট দুনিয়া। ভারতের মাটিতে সরকারি তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হলেন হায়দ্রাবাদি। দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে নির্বাসিত হয়ে গেলেন সব ধরনের ক্রিকেট থেকে আজীবনের মতো। মাত্র ১ টেস্টের কেরিয়ার নিয়ে সবার অলক্ষ্যে বাইশ গজকে বিদায় জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন সুব্রত ব্যানার্জি একদিন যাঁর দাক্ষিণ্যে—নিয়তির এমনই পরিহাস—মাত্র এক টেস্টের জন্যই দেশের হয়ে ১০০ টেস্ট খেলার বিরল সম্মান থেকে বরাবরের মতো বঞ্চিত হয়ে থাকতে হল এককালের বর্ণময় ক্রিকেট কেরিয়ারের অধিকারী সেই মহম্মদ আজহারউদ্দিনকেই (৯৯ টেস্টের ১৪৭ ইনিংসে ৯ বার অপরাজিত থেকে সংগৃহীত রান ৬২১৫, সর্বোচ্চ ১৯৯, গড় ৪৫.০৩, সেঞ্চুরি ২২ ও হাফসেঞ্চুরি ২১ বার, ৩টি ইনিংসে ১৩ বল করে ১৬ রান দিয়েছেন, ইকনমি রেট ৭.৩৮, ক্যাচ ১০৫টি)।
এত তোলপাড় যখন চলছে গোটা ক্রিকেট দুনিয়ায়, তখন কোথায় তিনি সুব্রত ব্যানার্জি? তাঁর খোঁজ পেতে হলে আবার পাড়ি দিতে হবে আমাদের সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়ায়। নিয়তি নির্ধারিত যে অদ্ভুত অস্ট্রেলীয় সংসর্গের প্রসঙ্গে বলেছিলাম আগেই—যেন তাকে স্বীকৃতি দিতেই জীবনসঙ্গিনী হিসেবে ততদিনে সুব্রত বেছে নিয়েছেন জনৈকা অস্ট্রেলিয়াবাসিনীকে। ডেনিস লিলির তত্ত্বাবধানে একদিন শুরু হয়েছিল যাঁর প্রবল সম্ভাবনাময় ক্রিকেট কেরিয়ার, ইতিমধ্যে তিনি সংসার পেতেছেন অভিষেক টেস্টের সেই সিডনি শহরেই। লেভেল থ্রি কোচিং-এর পাঠও সম্পূর্ণ করে নিয়েছেন দক্ষিণ গোলার্ধের এই সুন্দর দেশটিতে বসবাসের ফাঁকে।
২০০৩-০৪ মরসুম। সৌরভ গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে চার টেস্টের সফরে টিম ইন্ডিয়া উড়ে গেল অস্ট্রেলিয়ায়। স্টিভ ওয়ার বিদায়ী টেস্ট সিরিজ হিসেবে ক্রিকেট অনুরাগীদের মনে আজও অমলিন হয়ে রয়েছে এই সফরের অনেক স্মৃতি। দিস্তায় দিস্তায় নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছিল সিরিজের কভারিং-এ। খুব কম লোক জানতে পেরেছিল, খুব কম লোক মনে রেখেছে কালের হস্তাবলেপে বিলুপ্ত হতে বসা সাবেক ব্রিটিশদের সেই ‘নোবেলেস্ট অফ অল গেমস’-এর গভীর দ্যোতনাকে ক্ষণেকের জন্য হলেও আধুনিক সময়ে জীবনীময় করে তুলতে এই সফরেই শচীন তেন্ডুলকরের এক বিশেষ কৃতিকে। সেই এক যুগ আগের অস্ট্রেলিয়া সফরে যখন বঞ্চিত হচ্ছেন সুব্রত, পরবর্তী জিম্বাবোয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও যখন তাঁর উপর চলছে অবহেলা, তখন নেহাতই টিন এজের আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণ শচীন। কিছুই করতে পারেননি সেদিন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে নিজের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির ইনিংসে কিছু সময় উইকেটের অপর প্রান্তে সঙ্গ দেওয়া বন্ধু সুব্রতর জন্য। ২০০৩-০৪ সফরের শচীন অনেক অনেক পরিণত। অনেক অনেক প্রতিষ্ঠিত। সন্দেহাতীতভাবে গাভাসকার-উত্তর অধ্যায়ের ভারতীয় ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠতম ব্র্যান্ড। সফরের ফাঁকে চলে গেলেন তিনি পুরনো বন্ধুর সিডনির বাড়িতে। অনুরোধ করলেন তাঁকে দেশে ফিরে আসতে। পরবর্তী প্রজন্মের ভারতীয় পেসারদের ভার নিতে। টেনে নিয়ে গেলেন পুরনো বন্ধুকে নতুন টিম ইন্ডিয়ার নেটে। বারো বছর আগের সেই টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের প্রাপ্য কোটার অন্তত কিছুটা, প্রতীকী অর্থে হলেও, যেন মিটিয়ে দিলেন বঞ্চিত সেই বাঙালি পেসারকে—অজিত আগরকর, ইরফান পাঠানদের সঙ্গে গোটা একটা দিন নাগাড়ে টিম ইন্ডিয়ার নেটে বল করিয়ে।
সুযোগ্য উত্তরপুরুষের জন্য চিরদিনই অর্ঘ সাজিয়ে রেখে যান ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা অতীতপুরুষেরা। ভাবতে ভাল লাগে, অদেখা শচীন তেন্ডুলকরের জন্যই যেন একদিন সেই অমর পঙ্ক্তি সাজিয়ে গিয়েছিলেন নেভিল কার্ডাসের মতো অমর কিংবদন্তি—‘‘A true batsman should in most of his strokes tell the truth about himself.’’ আড়াই দশকের বিস্তৃত ক্রিকেট কেরিয়ারে দেশে বিদেশে অনেক অবিস্মরণীয় ইনিংসই খেলেছেন শচীন। রেকর্ড-বইয়ের পাতায় পাতায় স্বর্ণাক্ষরে উল্লিখিত আছে (থাকবে) সেই যাবতীয় ইনিংসের সমুদয় ঠিকুজি কুষ্ঠি। কিন্তু সেই যাবতীয় পরিসংখ্যানের ভিড়ে কখনও লেখা থাকবে না, কখনও লেখা হবে না বিস্মৃতপ্রায় এক বাঙালি পেসারের জন্য খেলা শচীনের এক অন্যতর ইনিংসের প্রসঙ্গ। সুদীর্ঘ কেরিয়ারে স্বদেশি বিদেশি নির্বিশেষে ৬০০ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের সংস্পর্শে আসা শচীনের জীবনে সেই হতভাগ্য পেসারের প্রতি ঘটে যাওয়া অবিচার যে কী গভীর রেখাপাত করেছিল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত প্রথম ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ মরসুমের প্রাক্কালের একটি ঘটনা। সিডনিতে সুব্রতকে বলা কথাগুলি যে কথার কথা ছিল না তার হাতে গরম প্রমাণ রেখেই ওই সময় রিলায়েন্স গোষ্ঠীর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্তরে কথা বলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বোলিং পরামর্শদাতা হিসেবে পুরনো বন্ধুকে দেশে ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করেন শচীন। পরবর্তীকালে ঝাড়খণ্ড রঞ্জি দলের পূর্ণ সময়ের কোচ হিসেবে সুব্রতর নিযুক্তির পূর্ব প্রেক্ষিত নিঃসন্দেহে নির্মিত হয়ে গিয়েছিল আই পি এলের উক্ত মরসুমেই।
কোচ হিসেবে জাতীয় স্তরে সুব্রত ব্যানার্জি আজ বেশ পরিচিত একটি নাম। উমেশ যাদব এবং বরুণ অ্যারনের উত্থানের নেপথ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাই ছিল এই প্রাক্তন বাঙালি পেসারের। আপন পুত্র অর্জুনকেও পুরনো বন্ধুর তত্ত্বাবধানেই পাঠিয়েছেন শচীন। যাঁর ব্যাট করা একমাত্র টেস্ট ইনিংসটিতে সঙ্গত করেছিলেন স্বয়ং ক্রিকেট দেবতার অবতার, তাঁকে একেবারে মুছে ফেলা কি কোনও মর মানুষের সাধ্যেই কুলোয়?
লেখক পরিচিতি: জন্ম নৈহাটিতে। মোবাইল কম্যুনিকেশন ও নেটওয়ার্ক টেকনোলজির স্নাতকোত্তর। তবে পছন্দের বিষয় সাহিত্য। মূলত ছোটগল্পকার। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চার— তিনটি ছোটগল্প ও একটি নিবন্ধ-সংকলন। ভালবাসেন সিনেমা ও ক্রিকেট। সাহিত্য, সিনেমা ও ক্রিকেট— এই তিনটি বিষয়েই রচনা করেছেন বেশ কিছু নিবন্ধ।।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.