পণ্ড খেলার স্কোরকার্ড
আবেশ কুমার দাস
You don’t need to play every ball but every ball needs your judgement.
টেস্ট অভিষেকের আগেই টেস্ট ইতিহাসে ঠাঁই হয়ে গেল জ্যাকম্যান সাহেবের। সৌজন্যে এক বাতিল টেস্টম্যাচের স্কোরকার্ড। ইংল্যান্ডের ৪৯০তম টেস্ট ক্যাপটি যদি আর না-ও হাতে পাওয়া হত পাঁচ ফুট নয় ইঞ্চির ডানহাতি এই ফাস্ট-মিডিয়াম পেসারের তবুও তাঁর নামটি থেকে যেত টেস্ট ইতিহাসের পাদটীকায়।
রবিন জ্যাকম্যান |
রবিন জ্যাকম্যান। জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৩ অগাস্ট, ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সিমলায়। বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডের ক্যান্টারবেরিতে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে আত্মপ্রকাশ ১৯৬৬ মরসুমে সারে কাউন্টির হয়ে। ১৯৮০-৮১ থেকে ১৯৮২ মরসুমের ভেতর ৪টি টেস্টের ৬ ইনিংসে ব্যাট করে ৪২ রান (সর্বোচ্চ ১৭, গড় ৭.০০) এবং ৭ ইনিংসে ১০৭০টি ডেলিভারিতে ৪৪৫ রানের বিনিময়ে ১৪টি উইকেট (সেরা বোলিং ১১০ রানে ৪ উইকেট, গড় ৩১.৭৮, ইকনমি রেট ২.৪৯) সংগ্রহ করেছিলেন এই ইংরেজ পেসার। টেস্ট ক্রিকেটের আসরে সাদামাটাই বলা যায় এই পরিসংখ্যানকে। হয়তো ভুলেই যাওয়া যেত তাঁকে একদিন। কিন্তু ঘটনাচক্রের অত্যদ্ভুত যোগাযোগই স্মরণীয় করে রাখল তাঁকে।
সাতের দশকে তৎকালীন বিশ্ব ক্রিকেটের আঙিনা থেকে নির্বাসিত বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকার রোডেসিয়া এবং ওয়েস্টার্ন প্রভিন্স দলে খেলোয়াড় ও কোচের উভয় ভূমিকাতেই দেখা গিয়েছিল জ্যাকম্যান সাহেবকে। ১৯৮০-৮১ মরসুমে পাঁচ টেস্টের সিরিজ খেলতে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে উড়ে যাওয়া ইয়ান বোথামের নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ড দলে ঠাঁই হয়েছিল এই ডানহাতি পেসারের। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাসনকে কেন্দ্র করে সমকালীন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট রাজনীতির দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থান ছিল যথাক্রমে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত ও পাকিস্তানের। তা উক্ত সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটির (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৯৭এ) অকুস্থল নির্ধারিত হয়েছিল গায়নার জর্জটাউনে। দক্ষিণ আফ্রিকা-সংসর্গের কারণ দেখিয়ে জ্যাকম্যান সাহেবের ভিসা প্রত্যাহার করে নিল গায়নিজ সরকার। অন্যদিকে রাজনৈতিক চাপের সামনে নতিস্বীকারে অস্বীকৃত ইংল্যান্ড ক্রিকেট প্রশাসনও দল নামাল না মাঠে। পরিণামে বাতিল হয়ে গেল জর্জটাউন টেস্ট। ব্রিজটাউনে সিরিজের তৃতীয় টেস্টেই (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৯০০) অভিষেক ঘটল পঁয়তিরিশ উত্তীর্ণ রবিন জ্যাকম্যানের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংসে গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স ও ক্লাইভ লয়েড এবং দ্বিতীয় ইনিংসে কলিন ক্রফট ও এভারটন ম্যাটিসের উইকেটগুলিও দখল করলেন এই নবাগত ইংরেজই। কিন্তু উক্ত কৃতির পূর্বাহ্নেই সেই না-হওয়া টেস্টম্যাচের দৌলতে তাঁর নাম জায়গা করে নিয়েছে টেস্ট ইতিহাসের পাতায়। বাতিল সেই টেস্টের স্কোরকার্ডে চোখ রাখলে ফুটনোটে পাওয়া যাবে—‘‘Match cancelled due to the Guyanese government revoking the visa of RD Jackman due to him having played and coached in South Africa during the previous 11 years’’। স্বয়ং কোনও ক্রিকেটারের নাম আজ পর্যন্ত আর কখনও জড়ায়নি বাতিল কোনও টেস্টম্যাচের সঙ্গে।
সরকারি বর্ণবিদ্বেষী নীতির সৌজন্যে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মূলস্রোত থেকে দীর্ঘ একুশ বছর নির্বাসিত হয়ে থাকতে হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এবং উক্ত নির্বাসন অধ্যায়ের সূত্রেই পরবর্তীকালে সে দেশের কালো মানুষদের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার নামটিও সম্পৃক্ত হয়ে যায় টেস্ট ইতিহাসের পাতায়। নয়ের দশকে প্রোটিয়া টেস্ট দলের অফিসিয়াল ব্লেজার গায়ে চড়িয়ে ক্রিকেটের ময়দানে হাজির থাকতেও দেখা গিয়েছিল এই রাষ্ট্রনেতাকে। কিন্তু কতজন মনে রেখেছেন ১৯৮৪-৮৫ মরসুমের একটি বাতিল পাকিস্তান-ভারত টেস্টের স্কোরকার্ডের সঙ্গে জড়িয়ে আছে খোদ ভারতবর্ষের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নাম? ওয়াঘার ওপারে দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে উক্ত টেস্ট সিরিজের তৃতীয় তথা অন্তিম খেলাটির (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৯৯৬এ) নির্ঘণ্ট স্থির ছিল ৪-৯ নভেম্বর করাচিতে। কিন্তু ৩১ অক্টোবর শ্রীমতী গান্ধির আকস্মিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় সিরিজ অসমাপ্ত রেখেই দেশে ফিরে এসেছিল সুনীল গাভাস্কারের ভারত। একটিও বল না-হওয়া সেই টেস্টের স্কোরকার্ডের ফুটনোটে লেখা আছে—‘‘ Match (and the remainder of the tour) cancelled following Indira Gandhi’s assassination on 31 October’’। প্রসঙ্গত উক্ত ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪ তারিখেই শিয়ালকোটে মোহিন্দর অমরনাথের অধিনায়কত্বে একটি সীমিত ওভারের খেলায় ভারত মুখোমুখি হয়েছিল জাহির আব্বাসের পাকিস্তানের। নিজের দেহরক্ষীর গুলিতে ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর নিহত হওয়ার দুঃসংবাদটি জিন্না স্টেডিয়ামে পৌঁছতেই মাঝপথে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল সেই একদিনের খেলাটিও।
রাজনৈতিক কারণে উপমহাদেশের মাটিতে কোনও টেস্টম্যাচের বাতিল হওয়ার দৃষ্টান্ত খুঁজলে আরও পাওয়া যাবে। এবং প্রসঙ্গত, জ্যাকম্যান-সংসর্গের সুবাদে না-হওয়া সেই জর্জটাউন টেস্টকে বাদ দিলে রাজনৈতিক কারণে আজ অবধি বানচাল হওয়া বাদবাকি প্রত্যেকটি টেস্টেরই পটভূমি ছিল এই উপমহাদেশ। অথবা আরও সরাসরি বললে ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিমের দুই প্রতিবেশী যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তান। এখানেই শেষ নয়, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে একই সিরিজের পরপর দু’টি টেস্ট বাতিল হওয়ার দৃষ্টান্তও রচিত হয়েছিল এই উপমহাদেশেই। তিন টেস্টের সিরিজ খেলতে ১৯৮৭ মরসুমের প্রারম্ভে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল জেফ ক্রো-র নিউজিল্যান্ড। মীমাংসাহীন প্রথম টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১০৭৪) শেষ দিন ২১ এপ্রিল তারিখে এবং ঘটনাচক্রে উক্ত ম্যাচের অকুস্থল কলম্বোতেই এক বাসডিপোয় তামিল টাইগারদের ঘটানো এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে মৃত্যু ঘটে শতাধিক মানুষের। ২৩ এপ্রিলের ‘The Times’–এর রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে,
শেষ পর্যন্ত সিরিজ অসম্পূর্ণ রেখে দেশেই ফিরে যায় কিউয়িরা। ক্যান্ডি ও কলম্বোতে সিরিজের যথাক্রমে দ্বিতীয় (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১০৭৪এ) ও তৃতীয় টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১০৭৪বি) বানচাল হয়ে যায় পরপর। ১৯৯২ মরসুমের পূর্বাহ্নে আর কোনও টেস্ট সিরিজই আয়োজিত হয়নি দ্বীপরাষ্ট্রের মাটিতে। কিন্তু অশান্তির ইতি ঘটল না এখানেই। ১৯৯৪ মরসুমে তিন টেস্টের সিরিজ খেলতে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল সেলিম মালিকের পাকিস্তান। ১৮-২৩ অগাস্ট সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টটি (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১২৬৫এ) অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব গ্রাউন্ডে। মনে রাখা দরকার, সময়টা শ্রীলঙ্কায় এক বড়সড় রাজনৈতিক পালাবদলের মুহূর্ত। ১৬ অগাস্ট লোকসভা নির্বাচনের পরপরই দেশ জুড়ে নির্বাচনোত্তর কার্ফু বলবৎ করতে হয়েছিল বড়মাপের হিংসাত্মক অস্থিরতার আশঙ্কায়। এবং খুব সহজবোধ্য কারণেই একটিও বল আর গড়ায়নি সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের ময়দানে। মাত্রই সাত বছর সাড়ে তিন মাসের ব্যবধানে এভাবে দু’-দু’টি টেস্ট বাতিল হয়ে যায় উক্ত ময়দান থেকে। যদিও ক্যান্ডিতে সিরিজের তৃতীয় তথা শেষ টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১২৬৭) অনুষ্ঠিত হয়েছিল নির্বিঘ্নেই।
২০০২ মরসুম। পটভূমি পাকিস্তান। অকুস্থল আবার সেই করাচি। দুই টেস্টের সিরিজ খেলতে স্টিফেন ফ্লেমিং-এর নিউজিল্যান্ড গিয়েছিল সে দেশে। নির্ধারিত দ্বিতীয় টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৬০১এ) প্রথম দিন ৮ মে সকালে খেলা শুরুর মাত্রই ঘণ্টাদুয়েক আগে শহরের রাস্তায় এবং ঘটনাচক্রে কিউয়ি টিম হোটেলের সামনেই ঘটে গেল ভয়াবহ এক গাড়িবোমা বিস্ফোরণ। লক্ষ্য ছিল কর্মসূত্রে পাকিস্তানে বসবাসরত পশ্চিমি জনগোষ্ঠী। বর্বরোচিত ঘটনাটিতে প্রাণ হারালেন অন্তত চোদ্দজন মানুষ। যাঁদের মধ্যে ছিলেন এগারোজন ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার যাঁরা পাকিস্তানি নৌবহরের জন্যেই একটি সাবমেরিনের নির্মাণে লিপ্ত ছিলেন। ওই দিনের ‘The Age’-এর পাতা থেকে জানা যাচ্ছে,
সহজেই অনুমান করা যায় কী হয়েছিল এই ঘটনার অভিঘাত। শুধু পাকিস্তানের মাটি থেকে সিরিজ অসমাপ্ত রেখে দেশে ফিরেই যায়নি নিউজিল্যান্ড—ঘরোয়া টেস্ট কেন্দ্র হিসেবেও এরপর ধীরে ধীরে পাকিস্তানকে বেছে নিতে হয় শারজা, দুবাই বা আবু ধাবির মতো সংযুক্ত আরব আমিরশাহির শহরগুলিকে। অশিক্ষিত জাতীয়তাবাদ, জঙ্গি মৌলবাদ ও উগ্র ধর্মান্ধতাকে মূলধন করে দেশশাসনের পরিণাম যে সুখকর হতে পারে না বাইশ গজেও—অধুনা পাকিস্তান তার অতি উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। এবং প্রসঙ্গত, সামাজিক অস্থিরতা যে কোন তলানিতে ঠেলে নিয়ে যেতে পারে দেশীয় ক্রিকেটকে রবার্ট মুগাবের অপশাসিত জিম্বাবোয়েই (বিশেষত ২০০৫—২০১১ পর্বের) তার সার্থকতম নমুনা।
আজ অবধি যাবতীয় পণ্ড টেস্টের পরিসংখ্যান ঘাঁটতে বসলে দেখা যাবে ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, ডুনেডিনের ক্যারিসব্রুক, জর্জটাউনের বোর্দা, করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়াম ও কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব গ্রাউন্ডে বানচাল হয়েছে দু’টি করে খেলা। অন্যদিকে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড, ফয়সালাবাদের ইকবাল স্টেডিয়াম ও ক্যান্ডির অ্যাসগিরিয়া স্টেডিয়ামে ভেস্তে গিয়েছে একটি করে ম্যাচ। জ্যাকম্যান-সংসর্গের সুবাদে ১৯৮০-৮১ মরসুমের সেই বাতিল টেস্ট ব্যতিরেকেও মন্দ আবহাওয়ার দরুণ ১৯৮৯-৯০ মরসুমে জর্জটাউনে পরিত্যক্ত হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজেরই আরও এক দ্বিতীয় টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১১৪০এ)। উইজডেন আর্কাইভের ভাষায়,
প্রসঙ্গত, এখানে পাঁচবারের হিসেব (বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে প্রথমবার) করা হয়েছে মন্দ আবহাওয়ার দরুণ না-হওয়া খেলার পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে। এই সূত্রেই লক্ষণীয় ‘অ্যাবানডন’ শব্দটির ব্যবহার। ক্রিকেটের পরিভাষায় সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণে না-হওয়া টেস্টের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় ‘ক্যানসেল’ শব্দটি। এবং প্রাকৃতিক কারণে বানচাল টেস্টের বেলায় প্রযুক্ত হয় ‘অ্যাবানডন’ শব্দটি। সেই সুবাদে জর্জটাউনে আজ অবধি পণ্ড টেস্টদ্বয়ের প্রথমটি ‘ক্যানসেলড’ বা বাতিল, কিন্তু দ্বিতীয়টি ‘অ্যাবানডন’ বা পরিত্যক্ত। কিন্তু করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়াম বা কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব গ্রাউন্ডের না-হওয়া উভয় টেস্টই বাতিল। আবার ডুনেডিনের ক্যারিসব্রুক বা ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের বানচাল উভয় টেস্টই পরিত্যক্ত।
পরিত্যক্ত টেস্টের অকুস্থলের তালিকায় উপমহাদেশের একমাত্র নাম ফয়সালাবাদের ইকবাল স্টেডিয়ামের। ১৯৯৮-৯৯ মরসুমে পাকিস্তান-জিম্বাবোয়ে সিরিজের তৃতীয় টেস্টটি (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৪৩৪এ) এখানে পরিত্যক্ত হতেই নির্মিত হয়েছিল এক অন্যতর ইতিহাসও। পেশোয়ারে সিরিজের প্রথম টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৪৩০) নিল জনসনের জীবনের একমাত্র টেস্ট সেঞ্চুরি এবং হিথ স্ট্রিক-হেনরি ওলোঙ্গা-পমি মাঙ্গোয়াদের দাপটে ভর করে পাকিস্তানকে সাত উইকেটে হারিয়ে দিয়েছিল জিম্বাবোয়ে। লাহোরে দ্বিতীয় টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৪৩২) গাভিন রেনি, গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, অ্যাডাম হাকলদের বাঁচিয়ে দিয়েছিল আবহাওয়ার দাক্ষিণ্য। ফয়সালাবাদ টেস্ট ঘন কুয়াশার দৌলতে বানচাল হতেই তাই বিদেশের মাটিতে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয় নিশ্চিত হয়ে যায় অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেলের জিম্বাবোয়ের। টেস্টের চতুর্থ দিন ২০ ডিসেম্বর সকালে সরকারি ভাবে পরিত্যক্ত ঘোষিত হয় উক্ত টেস্ট। ঘটনাচক্রে একই দিনে ভারী বর্ষণের দাপটে ডুনেডিনে পরিত্যক্ত ঘোষিত হয় নিউজিল্যান্ড-ভারত তিন টেস্টের সিরিজের প্রথম টেস্টটিও (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৪৩৪বি)। ফয়সালাবাদ টেস্টের একদিন পরে শুরু হওয়ার কথা ছিল ডুনেডিন টেস্টের। প্রসঙ্গত উক্ত নিউজিল্যান্ড-ভারত টেস্টের জনৈক আম্পায়ারের ভূমিকায় ছিলেন কিউয়ি স্টিভ ডান। যিনি ঘটনাচক্রে ১৯৮৮-৮৯ মরসুমে ডুনেডিনেই একই কারণে ভেস্তে যাওয়া নিউজিল্যান্ড-পাকিস্তান টেস্টেরও (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১১১৩এ) জনৈক আম্পায়ার ছিলেন।
চলতি ২০১৭ মরসুমে সদ্য অনুষ্ঠিত উইন্ডসর পার্ক টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২২৬১) মহম্মদ আব্বাস-ইয়াসির শাহদের দৌলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১০১ রানে হারিয়ে দিয়েছে পাকিস্তান। অর্থাৎ বর্তমান নিবন্ধের রচনাকাল অবধি সময়ে সর্বমোট ২২৬১টি টেস্ট খেলা হয়েছে ক্রিকেটের ইতিহাসে। এবং একশো চল্লিশ বছরের কিছু বেশি এই সময়সীমায় পরিত্যক্ত ও বাতিল নির্বিশেষে পণ্ড হয়েছে সর্বসাকুল্যে ১৩টি টেস্ট। ২২৬১-এর তুলনায় নিতান্তই নগণ্য এই ১৩ সংখ্যাটি। কিন্তু ক্রিকেট-ব্যাকরণের নিয়মেই যেভাবে ছেড়ে দেওয়া ডেলিভারির চরিত্রকেও সমানভাবে বিবেচনা করে যেতে হয় ব্যাটসম্যানকে, না-হওয়া এই টেস্টগুলির কোনও কোনওটির প্রেক্ষাপটও অনুরূপ অনেক সংঘটিত টেস্টের তুলনায় অনেকাংশে বেশিমাত্রায় সম্পৃক্ত হয়ে আছে বৃহত্তর সমাজ সংস্কৃতির অন্তরঙ্গে।
পরিসংখ্যান ঘাঁটতে বসলে নজরে পড়বে ১৯৮০-৮১ মরসুমের সেই জর্জটাউন টেস্টই ইতিহাসের প্রথম বাতিল টেস্ট। এবং প্রাকৃতিক কারণে প্রথম কোনও টেস্ট পরিত্যক্ত হয় ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ড ময়দানে সেই সুদূর ১৮৯০ মরসুমে। সাল-তারিখের হিসেব দেখেই সম্ভবত আঁচ করে নেওয়া যাবে দুই প্রতিপক্ষের নাম (যদিও ১৮৮৮-৮৯ মরসুমে টেস্ট-কৌলীন্য অর্জন করে ফেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকাও)। ডব্লু জি গ্রেস ও বিলি মুরডকের অধিনায়কত্বে যথাক্রমে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে অষ্টম অ্যাসেজের (অ্যাসেজ নামটি চালু হয় ১৮৮২-৮৩ মরসুম থেকে, তার আগে পাঁচটি টেস্ট সিরিজে এই দুই দেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল উক্ত ঐতিহ্যবাহী শীর্ষকটি ব্যতিরেকেই) সেই তৃতীয় টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৩৪এ) প্রস্তাবিত সময়সীমা ছিল ২৫-২৭ অগাস্ট।
আটচল্লিশ বর্ষা পর ইতিহাসের দ্বিতীয় পরিত্যক্ত টেস্টটির (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২৬৪এ) অকুস্থলও ছিল সেই ম্যাঞ্চেস্টার। ৮-১২ জুলাইয়ের সময়সীমায় নির্ধারিত এই টেস্টটি ছিল ১৯৩৮ মরসুমের পাঁচ টেস্টের অ্যাসেজের তৃতীয় ম্যাচ। আর্কাইভ ঘাঁটলে না-হওয়া এই ম্যাঞ্চেস্টার টেস্টের অকুস্থলের একটি ছবি পাওয়া যায়। ওয়ালি হ্যামন্ডের ইংল্যান্ডের সঙ্গে ডন ব্র্যাডম্যানের অস্ট্রেলিয়ার ধ্রুপদী দ্বৈরথ প্রত্যক্ষ করতে বর্ষণস্নাত ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের জনবিরল গ্যালারিতে আপাদমস্তক বর্ষাতিতে ঢেকেও আকাশের অঝোর জলধারার ধরে আসার আশায় অপেক্ষারত দুই ইংরেজ দর্শকের ছবি। প্রসঙ্গত একই বছর নভেম্বরে মুক্তিপ্রাপ্ত বিশ্ববিশ্রুত ব্রিটিশ চলচ্চিত্রকার স্যার অ্যালফ্রেড হিচককের ‘দ্য লেডি ভ্যানিসেস’ ছবিতেও ধরা দেয় ভেসে যাওয়া উক্ত টেস্টের প্রসঙ্গ। প্রতিকূল আবহাওয়ায় ইউরোপের কোনও এক প্রত্যন্ত জনপদে (ইংল্যান্ডের বাইরে) প্রায় অন্তরিন একদল হোটেল বোর্ডারের চালচিত্র থেকে সূত্রপাত যে ছবির ঘটনাপ্রবাহের। অমন পরিস্থিতিতেও ছবির বিশেষ দুই চরিত্রের কথোপকথনে উঠে আসে হ্যামন্ড-গ্রিমেট প্রসঙ্গ। রেডিও সংযোগ ও দৈনিক সংবাদপত্রের অপ্রতুলতার দরুণ টেস্টের খবরাখবর পৌঁছয় না যাদের কাছে। পরবর্তীতে রেলপথে লন্ডনে ফিরে তড়িঘড়ি ম্যাঞ্চেস্টারের ট্রেন ধরতে গিয়ে যারা আবিষ্কার করে অতিবর্ষণে খেলা ভেস্তে যাওয়ার সংবাদ। ছবির মূল কাহিনির সমান্তরালে কমিক রিলিফের ঢঙে এভাবে চলতে থাকে ক্রিকেটের আনাগোনা।
১৯৩৮ সালের ওল্ড স্ট্যাফোর্ড গ্যালারি |
বিভিন্ন সূত্র থেকে চলতি দশকের গোড়াতেও জেনেছি বেকার স্ট্রিটের শার্লক হোমস মিউজিয়ামে এখনও (অন্তত ওই সময় অবধিও) পাইপমুখো বিশ্ববরেণ্য গোয়েন্দাসাহেবের নামে সপ্তায় সপ্তায় আসে চিঠি। নতুন নতুন রহস্যের মীমাংসায় তাঁকে সংশ্লিষ্ট হওয়ার আর্জি জানিয়ে। যেভাবে সেদিন মোহাবিষ্ট হয়েছিলাম সেই প্রায় রূপকথায়—সুপ্রাচীন ওল্ড ট্র্যাফোর্ড গ্যালারির সেই আট দশকের পুরনো স্থিরচিত্রটি এবং সমকালীন ‘দ্য লেডি ভ্যানিসেস’ চলচ্চিত্রে উক্ত দুই চরিত্রের উপস্থাপনা একইভাবে আমায় স্বপ্নাবিষ্ট করে সাতসাগর পাড়ের সেই সুসভ্য জাতির অদ্ভুত রোমান্টিসিজমের বিশুদ্ধতায়। ভাবতে ভাল লাগে, পরবর্তীকালে হলিউড তথা আপামর বিশ্ব-চলচ্চিত্রকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখা স্যার অ্যালফ্রেড হিচককের জীবনের প্রথম পর্বের একটি ছবির কাহিনিতে একদিন উঠে এসেছিল সমকালীন একটি পরিত্যক্ত টেস্টের বাস্তবতা। ভাবতে ভাল লাগে, আপামর বিশ্বের রহস্যরসিক পাঠককূলকে আজও সমানে মোহাচ্ছন্ন করে রাখা শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েল নিজে একজন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটার ছিলেন।
ক্রিকেট ইতিহাসের তৃতীয় পরিত্যক্ত টেস্টটির (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৬৭৫এ) সঙ্গেও জড়িয়ে আছে অ্যাসেজেরই নাম। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে আজ অবধি পণ্ড হওয়া এই একমাত্র টেস্টটি ছিল ১৯৭০-৭১ মরসুমের সাত টেস্টের (প্রকৃতপক্ষে ছয়) অ্যাসেজের তৃতীয় টেস্ট। তবে এই টেস্টটিকে বাতিল টেস্টের তালিকায় (বা আদৌ টেস্টম্যাচের পরিসংখ্যানে) অন্তর্ভুক্ত করা নিয়ে কিছু দ্বিমত আছে। কারণ অতিবৃষ্টির দরুণ ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭০-৫ জানুয়ারি, ১৯৭১ তারিখের মধ্যে নির্ধারিত প্রকৃত প্রস্তাবে ছয় টেস্টের অ্যাসেজের এই তৃতীয় টেস্টটি বানচাল হয়ে গেলেও দু’ দেশের বোর্ডের সিদ্ধান্তে ২১-২৬ জানুয়ারি, ১৯৭১ তারিখের মধ্যে নতুন সূচিতে উক্ত মেলবোর্নেই বিল লরির অস্ট্রেলিয়া ও রে ইলিংওয়ার্থের ইংল্যান্ড মুখোমুখি হয় নতুন ভাবে ধার্য অন্যতর একটি টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৬৭৭)। পরিণামে আখেরে সেই ছ’টি টেস্টই খেলা হয় সিরিজে। উক্ত ছয় টেস্টের সঙ্গে এই পরিত্যক্ত টেস্টটিকে পরিসংখ্যানের অন্তর্ভুক্ত করায় মতান্তরে সেই অ্যাসেজ দাঁড়ায় সাত টেস্টের। আবার যেহেতু এক পক্ষকালের সামান্য বেশি ব্যবধানে সেই মেলবোর্নেই নতুন ভাবে একটি পরিবর্ত টেস্টের আয়োজন করা হল, সুতরাং ৩১ ডিসেম্বর-৫ জানুয়ারি সময়সীমায় প্রস্তাবিত টেস্টকে আলাদা করে পরিসংখ্যানের অন্তর্ভুক্ত হয়তো না করলেও চলত। তবে এই টেস্টে মাঠে একটিও বল না গড়ালেও দু’ দেশের প্রথম একাদশ ঘোষিত হয়ে গিয়েছিল। এমনকি টসে জিতে ফিল্ডিং-এর সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিলেন ইলিংওয়ার্থ।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পরিত্যক্ত এই মেলবোর্ন টেস্টই কিন্তু প্রকারান্তরে জন্ম দিয়েছিল সেদিন সীমিত ওভারের ক্রিকেটের। ১৯৭১ সালের প্রথম শনিবার, বছরের সবে দ্বিতীয় দিন সরকারি ভাবে শনির দশাপ্রাপ্তি ঘটেছিল এই টেস্টের বরাতে। তার বদলে ম্যাচের নির্ধারিত অন্তিম দিন ৫ জানুয়ারি একটি চল্লিশ ওভারের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করা হয় অ্যাসেজের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে। চলতি অ্যাসেজের পরম্পরা মেনেই উক্ত সীমিত ওভারের খেলাটির প্রতিটি ওভারেও হয়েছিল আটটি করে ডেলিভারি। সেই অর্থে সাম্প্রতিক পঞ্চাশ ওভারের খেলাগুলির তুলনায় দীর্ঘায়িত হয়েছিল ম্যাচটি। ০-২ ফলাফলে সেবারের অ্যাসেজে পরাজিত হতে হলেও পরবর্তীকালে প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের সম্মান পাওয়া এই খেলাটিতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীকে পাঁচ উইকেটে পর্যুদস্ত করেছিল অস্ট্রেলিয়া।
লেখক পরিচিতি: জন্ম নৈহাটিতে। মোবাইল কম্যুনিকেশন ও নেটওয়ার্ক টেকনোলজির স্নাতকোত্তর। তবে পছন্দের বিষয় সাহিত্য। মূলত ছোটগল্পকার। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চার— তিনটি ছোটগল্প ও একটি নিবন্ধ-সংকলন। ভালবাসেন সিনেমা ও ক্রিকেট। সাহিত্য, সিনেমা ও ক্রিকেট— এই তিনটি বিষয়েই রচনা করেছেন বেশ কিছু নিবন্ধ।।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.