অন্য স্লেজিং অথবা ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা
আবেশ কুমার দাস
For still, the more he works, the more Do his weak ankles swell.
কালো মানুষদের সমানাধিকারের প্রশ্নে গৃহযুদ্ধ বেধে গিয়েছিল আমেরিকায়। কুলশীলমানহীন একলব্যকে প্রিয় শিষ্যের পথ থেকে সরিয়ে দেওয়ার মনোবাঞ্ছায় ভয়াবহ গুরুদক্ষিণা চেয়ে নিয়েছিলেন কুরুগুরু দ্রোণাচার্য। সাক্ষী থাকবে মানবজাতির ইতিহাস থেকে দেশ-বিদেশের পুরাণ-মহাকাব্যেরা। তথাকথিত ইতরদের ছলে-বলে-কৌশলে বরাবর বঞ্চিতই রাখতে চেয়েছে ‘সভ্যতা’। বাইশ গজে উক্ত ‘সভ্যতা’র বহিঃপ্রকাশেরই কি নাম স্লেজিং? মহারণের প্রাক্কালে মহারথী কর্ণের সারথী হয়ে যুধিষ্ঠিরের কাছে স্বীকৃত শপথ পালনে মদ্ররাজ শল্যও কি অনুসরণ করেননি সেই স্লেজিং-এর পন্থাই?
সভ্যতার প্রশ্নেই গাল বাড়িয়ে সেদিন অর্জুন রণতুঙ্গার কাছে চড় খেতে হয়েছিল প্রবল পরাক্রমী অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট সংস্কৃতিকে। ফিরে দেখা যাক বিশ শতকের নয়ের দশকের সেই ঘটনাবহুল দ্বিতীয়ার্ধ। মাত্র দেড় দশক আগে টেস্ট-কৌলীন্য লাভ করা সিংহলিদের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্রমোত্থান কি ঈর্ষান্বিত করে তুলছিল মার্ক টেলরের দেশের সমসাময়িক ক্রিকেট সমাজ তথা সংশ্লিষ্ট মিডিয়ার বৃহদংশকে! যার অনিবার্য পরিণাম ১৯৯৫-৯৬ মরসুমে শ্রীলঙ্কার অস্ট্রেলিয়া সফরে ঘটে যাওয়া সেই যাবতীয় ঘটনাবলী! দুর্ভাগ্যজনকভাবে যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ে এমনকি বাইশ গজে কর্তব্যরত অস্ট্রেলীয় আম্পায়ার ডারেল হেয়ারের নামটিও! নইলে কেন মেলবোর্নে অনুষ্ঠিত সেই কুখ্যাত বক্সিং ডে টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৩১৯) প্রথম দিন মধ্যাহ্নভোজনের বিরতির পর মাত্র তিন ওভারের ভেতর সাত সাতবার ‘নো’ ডাকা হবে অফস্পিনার মুথাইয়া মুরলীধরনকে!
এতদিন পর আর্কাইভ ঘাঁটতে বসে হাতে পাচ্ছি উক্ত টেস্ট প্রসঙ্গে ‘The Daily News’-এর একটি মূল্যবান রিপোর্টিং। প্রথম দিনের বর্ণনায় চোখ রাখলে দেখা যাচ্ছে,
টেস্ট সিরিজের সূচনা থেকেই চলছিল সিংহলিদের চাপে রাখার নানাবিধ আয়োজন। পার্থে প্রথম টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৩১৭) বল-বিকৃতির অভিযোগে একদফা হয়রান করা হয়েছিল অতিথিদের। সেই প্রসঙ্গেও পর্যাপ্ত আলোকপাত করে উক্ত রিপোর্ট,
The umpires, Parker and Hyatt and match referee Dowling were howling when finding the Lankans guilty with no chance to forward their defence arguments... Obviously the ICC must be on a sticky wicket what with no evidence to prove the Lankans guilty. What is essential in any conviction is EVIDENCE. And this is nowhere to be seen or found since the ball in question had not been preserved as evidence.
Instead by continuing to play with that ball the umpires have in their eagerness to lynch the Lankans, obliterated whatever evidence.
অনুমান করা যায়, শ্রীলঙ্কা-অস্ট্রেলিয়া দ্বিপাক্ষিক ক্রিকেট সম্পর্ককে কোথায় নামিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এই যাবতীয় ঘটনাবলীর অভিঘাত। স্বাভাবিক নিয়মেই চাপানউতোর শুরু হয়েছিল দুই তরফেই।
কিন্তু সমস্ত শালীনতার বেড়া ভেঙে অস্ট্রেলীয় মিডিয়ার তরফে একসময় শুরু হল সিংহলিদের একটি ‘অসভ্য’ জাতি হিসেবে আখ্যায়িতকরণের অপপ্রয়াস। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল সে দেশের ক্রিকেট অধিনায়ক অর্জুন রণতুঙ্গার। বাইশ গজে স্লেজিং-এর নামে প্রতিপক্ষকে বাবা-মা তুলে গালিগালাজ করতে, স্ত্রী-বান্ধবীদের নামে কুৎসিত ইঙ্গিত করতে, এমনকি অপ্রিয় সিদ্ধান্তে মাঠের আম্পায়ারকেও চোখ রাঙাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা অস্ট্রেলীয়দের নাম না করে এক প্রকাশ্য সাংবাদিক সম্মেলনে দেশীয় সংবাদমাধ্যমের সামনে এরপর যা বলেছিলেন রণতুঙ্গা তার মর্মার্থ—সিংহলি সভ্যতা কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন, ইংল্যান্ডের দুর্বৃত্তদের দ্বীপান্তরের শাস্তি দিয়ে পাঠানো হত না শ্রীলঙ্কায়। ইতিহাসের উত্থাপনা ঘটিয়ে যাবতীয় কদর্য আক্রমণের মুখের উপর শালীন ভাষায় এমন শাণিত জবাব একজন শিক্ষিত অনুভূতিসম্পন্ন ভদ্রলোকের পক্ষেই দেওয়া সম্ভব ছিল।
মনে পড়ে ২০০৭-০৮ মরসুম। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে বর্ডার-গাভাসকার ট্রফির দ্বিতীয় টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৮৫৭)। পঞ্চম দিনের খেলার শেষে সিডনির সেই বিখ্যাত সাংবাদিক সম্মেলন। একটি প্রশ্নের জবাবে চতুর্থ ইনিংসে সদ্য ১১১ বলে অপরাজিত ৪৫ রানের এক মরণপণ ইনিংস খেলে ওঠা ভারত অধিনায়ক অনিল কুম্বলের প্রতিক্রিয়া স্রেফ কিংবদন্তি হয়ে আছে—‘‘Here only one team has played in the spirit of the game’’। সদ্যবিগত ২০১৬-১৭ মরসুমে ভারতের মাটিতে অনুষ্ঠিত বর্ডার-গাভাসকার ট্রফির টেস্টগুলিতে তাই যখন আবার তপ্ত হয়ে ওঠে বাইশ গজের আবহ, যখন আগ্রাসনে এঁটে উঠতে না পেরে ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে প্রকারান্তরে ‘অশিক্ষিত’ বলেন স্বয়ং ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার জনৈক কর্মকর্তা—বুঝতে অসুবিধে হয় না—সমানে চলছে সেই অশালীন পরম্পরা।
সংঘর্ষের উত্তেজনা অবশ্যই স্পর্শ করে বাইশ গজকে। আবেগহীন একদল যন্ত্রমানবের ঢঙে অবশ্যই সংলিপ্ত হওয়া চলে না ব্যাট বলের লড়াইতে। রণমত্ততার বিশেষ মুহূর্তে খুচখাচ বাদানুবাদও হয়তো একেবারে অস্বাভাবিক নয়। আর ইলিয়াড থেকে মহাভারত সাক্ষী—যেখানেই ক্ষাত্র অনুষঙ্গ, চলতি নিয়মনীতির অল্পবিস্তর বিচ্যুতিও সেখানে প্রায় স্বতঃসিদ্ধই। কিন্তু এও তো উপলব্ধি করতে হবে—কেন একদিন এই খেলাকে ‘নোবেলেস্ট অফ অল গেমস’ মনে হয়েছিল দিগ্বিজয়ী ব্রিটিশদের। কেন বেছে বেছে এই খেলাকেই চিহ্নিত করা হয়েছিল ‘ভদ্রলোকের খেলা’র অভিধায়। আসলে সাবেক ক্রিকেটের অন্তরঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে বনেদি যুক্তরাজ্যের এমনই কিছু কিছু গভীর অনুষঙ্গ—যাকে অগ্রাহ্য করলে বৃহত্তর ক্রিকেটের অন্তরাত্মাকেই আর আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। রুক্ষ হাওয়ায় উলটে পালটে যাওয়া একশো চল্লিশ বছরের টেস্ট ইতিহাসের অনেকগুলো পাতা পিছিয়ে গেলে যেমন আজ মনে পড়তে বাধ্য ফ্রাঙ্ক টাইসনের মতো এক আদ্যন্ত বর্ণময় ক্রিকেট চরিত্রকে। সেই বিশুদ্ধ ব্রিটিশ সংস্কৃতিতে সম্পৃক্ত তাঁর একেবারে অন্যধারার স্লেজিং-এর (যদি অবশ্য আদৌ তাকে স্লেজিং বলা যায়) অভিনবত্বকে।
ফ্রেড ট্রুম্যানের সমসাময়িক টাইসন ফাস্ট বল করতেন ডান হাতে। বাইশ গজে ঘটানো সামান্য দু’-একটি কীর্তি থেকেই আঁচ করে নেওয়া যায় যাঁর গোত্রকে। ১৯৫৩ মরসুমের অ্যাসেজ খেলতে যেবার ইংল্যান্ডে গিয়ে নামল লিন্ডসে হ্যাসেটের অস্ট্রেলিয়া তখন সেভাবে কেউ চেনেই না বছর তেইশের টাইসনকে। ৪-৬ জুলাই নর্দাম্পটনশায়ারের সঙ্গে একটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ ছিল সফরকারী অস্ট্রেলীয়দের। তা দিনের প্রথম ওভারের চতুর্থ বলেই টাইসনের ইয়র্কারে একেবারে আক্ষরিক অর্থেই স্ট্যাম্প উড়ে গেল অতিথি ব্যাটসম্যান গ্রেম হোলের। এবং উইকেট থেকে সীমানার দড়ির ঠিক মাঝামাঝি দূরত্বে দস্তানা হাতে সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকা কিথ অ্যান্ড্রুর মাথার উপর দিয়ে স্ট্যাম্পটি ছিটকে গিয়ে পড়ল খানিক পেছনে। পরের বছরই ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে অনুষ্ঠিত অন্য একটি খেলায় আবার টাইসনের হাত থেকে নির্গত একটি ডেলিভারি বাইশ গজে প্রথম ছোবলটি মেরেই আছড়ে গিয়ে পড়ল পেছনের সাইটস্ক্রিনে। আজকের দিনে নিছক রূপকথাই মনে হবে এসব ঘটনাকে।
খুব সম্ভবত এই গোত্রের সিংহহৃদয় বোলারদের দাক্ষিণ্যে হয়ে চলা বাই রানের বন্যায় বাঁধ দিতেই সাবেক ক্রিকেটে চিন্তা করা হয়েছিল লং স্টপ এলাকাটির বিষয়ে (বোলার এবং উইকেটকিপারের সংযোজক কাল্পনিক অক্ষরেখা উইকেটকিপারের পেছনে যে বিন্দুতে সীমানাকে স্পর্শ করে)। আজকের দিনে লং স্টপে একজন ফিল্ডসম্যানকে রাখা নিছক বাহুল্য বই কিছু নয়। তবে প্রসঙ্গত বলে রাখি, টেস্ট ক্রিকেটে ওই অঞ্চলে একজন ফিল্ডসম্যানকে চাক্ষুষ করার বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল আমার—যদিও একেবারে অন্য কারণে। বিগত ২০১৬-১৭ মরসুমে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ভারতের হোম সিরিজের পঞ্চম টেস্টকে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২২৪১) অনেকেই মনে রাখবেন করুণ নায়ারের অপরাজিত ৩০৩-এর সৌজন্যে। চেন্নাইয়ের চিপক ময়দানের কোণে কোণে শট খেলা নায়ারের সেই অতিমানবিক ইনিংসে অতিষ্ঠ ইংরেজ অধিনায়ক অ্যালিস্টার কুক চতুর্থ দিনের (১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬) কিছু সময় একজন ফিল্ডসম্যানকে রেখেছিলেন লং স্টপে। বেশ মনে আছে আমার, যখন সদ্য একজনকে আনা হল ওই এলাকায়, ভারতের হয়ে টেস্ট খেলা টিভি চ্যানেলের কমেন্টেটররাও প্রথমে মনে করতে পারছিলেন না ‘লং স্টপ’ নামটি।
ফিরে আসি টাইসন প্রসঙ্গে। ১৯৩৮-৩৯ মরসুমের সেই সুবিখ্যাত ডারবান টাইমলেস টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২৭১) চতুর্থ ইনিংসে দ্বিশতরান করা বিল এড্রিকের সুখ্যাতি ছিল ফাস্ট বোলারদের হুক করায়। ১৯৫৪ মরসুমে ক্রিকেটের মক্কা লর্ডসে অনুষ্ঠিত একটি ঘরোয়া খেলাইয় এহেন এড্রিককেই হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন টাইসন। বলের গতিতে সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত এড্রিক সময় আন্দাজের ভুলে টাইসনের ছোবল খেলেন নিজের গালে এবং সুরক্ষাবর্ম হিসেবে হেলমেটের ব্যবহার সেই পাঁচের দশকে স্রেফ কষ্টকল্পনা। পরিণামে চলতি মরসুমেই ওভালে অনুষ্ঠিত ইংল্যান্ড-পাকিস্তান সিরিজের চতুর্থ টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৩৯০) ৩৭৭তম ইংরেজ টেস্ট ক্যাপটি হাতে এসে গেল চব্বিশ পেরনো ফ্রাঙ্ক টাইসনের।
১৯৫৪-৫৫ মরসুম। টাইসনের জীবনের সোনালি অধ্যায়। ইংল্যান্ডের হয়ে পরপর অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড সফর। সফরকারী দল থেকে বাদ পড়তে হল খোদ ফ্রেড ট্রুম্যানকে। সংবাদমাধ্যম তরুণ ইংরেজ পেসারের নতুন নামকরণ করল ‘টাইফুন টাইসন’। সিডনিতে দ্বিতীয় টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৩৯২) টাইফুনের পারফরম্যান্স (৪-৪৫ ও ৬-৮৫) সিরিজে সমতায় ফেরায় ইংরেজদের। প্রসঙ্গত চতুর্থ ইনিংসে বল করতে যাওয়ার আগে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং-এর সময় রে লিন্ডওয়ালের বলে মাথায় ভয়াবহ আঘাত পেয়েছিলেন টাইসন। ‘In the Eye of the Typhoon: The Inside Story of the MCC Tour of Australia and New Zealand 1954/55’ গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত করা যাক স্বয়ং টাইফুনকেই,
মেলবোর্নে তৃতীয় টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৩৯৩) চতুর্থ ইনিংসে আবার মাত্র ২৪০ রান তাড়া করতে নামা রিচি বেনো-নিল হার্ভের অস্ট্রেলিয়াকে শেষদিনে একেবারে গুঁড়িয়ে দিলেন জীবনের সেরা বোলিং খতিয়ানে (৭-২৭)। পঞ্চম দিন সকালে পঞ্চাশ হাজার অস্ট্রেলীয় দর্শকের চোখের সামনে রিচমন্ড এন্ড থেকে তাঁর ৬.৩ ওভারের সেই স্পেলকে (৬-১৬) ব্যাখ্যা করা হয়েছিল ‘the fastest and most frightening sustained spell of fast bowling seen in Australia’ হিসেবে। শেষ অবধি ৩-১ ফলাফলে উক্ত অ্যাসেজ জিতে নেয় ইংরেজরা। নেপথ্যে অনেকখানি ভূমিকাই রয়ে গিয়েছিল আট বলের সেই অ্যাসেজের পাঁচটি টেস্ট থেকে ২৮ উইকেট দখল করা সাড়ে চব্বিশের ইংরেজ ফাস্ট বোলারের। কিউয়িদের দেশের উল্লেখযোগ্য ঘটনা সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৪০২) অকল্যান্ডে দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ২৬ রানে মুড়িয়ে গিয়ে টেস্ট ইতিহাসে নিউজিল্যান্ডের এক ইনিংসে সর্বনিম্ন স্কোরে অল আউট হওয়ার নজির স্থাপন। গর্ডন লেগাট ও ম্যাট পুরকে সকাল সকাল ফেরত পাঠিয়ে প্রলয়ের সূচনা ঘটিয়েছিলেন আবার সেই টাইফুনই। মাত্র ৪৬ রানের লিড নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ফিল্ডিং করতে নেমে ইংল্যান্ড উক্ত টেস্ট জিতে নিয়েছিল ইনিংস ও ২০ রানে (নিউজিল্যান্ড ২০০ ও ২৬, ইংল্যান্ড ২৪৬)। ডন ব্র্যাডম্যান নিজের দেখা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফাস্ট বোলার মনে করেছেন ফ্রাঙ্ক টাইসনকে। ১৯৫৪-৫৫ মরসুমের সেই অ্যাসেজে টাইসনকে খেলা প্রাজ্ঞ ক্রিকেটব্যক্তিত্ব রিচি বেনোও নিঃসংশয়ে সুর মিলিয়েছেন ব্র্যাডম্যানের পর্যবেক্ষণে। টাইসনের বোলিং-এ উইকেটের চল্লিশ গজ পেছনে স্লিপে দাঁড়িয়ে থাকা সতীর্থ টম গ্রেভনির মতে, Frank Tyson, at his peak, was possibly the fastest bowler of all time... Roaring off a long run, he generated tremendous pace that unnerved and unhinged even the greatest batsmen.
আজকের প্রযুক্তি ছিল না সেই পাঁচের দশকে। উল্লিখিত সেই নিউজিল্যান্ড সফরে এক কনকনে শীতের সকালে ওয়েলিংটনের অ্যারোনটিক্যাল কলেজে ক্রিকেট বলের গায়ে ধাতব পাত জুড়ে শাব্দিক প্রকৌশলে বোলারদের ডেলিভারির গতিবেগ পরিমাপের ব্যবস্থা হয়েছিল। কোনও রান-আপ ছাড়া এবং গায়ে তিনদফা সোয়েটার চড়িয়ে টাইফুনের গতিবেগ দাঁড়িয়েছিল ঘণ্টায় ৮৯ মাইল। নিঃসন্দেহে দীর্ঘ রান-আপের টাইসন অনেক বেশি গতির বোলার ছিলেন। তাঁর খরচ করা রানের এক বৃহদংশই এসেছিল আদপে ব্যাটের কানায় লেগে। সুইং বা সিম বোলারদের প্রসঙ্গ স্বতন্ত্র্য। কিন্তু শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও কোথাও পৌঁছে ফাস্ট বোলিং-ও যেন মহৎ কবিতার মতোই এক আত্মধ্বংসী শিল্পকলা। কেবল এই দুইয়ের বাহ্যিক প্রকাশই যা দু’রকম। স্বয়ং ফাস্ট বোলারের শরীর তথা শারীরবৃত্তীয়তার উপরেই তাই একদিন প্রতিশোধ তোলে ক্রিকেটের এই অনন্যসাধারণ কলাটি। দীর্ঘ রান-আপ ও অমানুষিক গতির টাইসনের ক্ষেত্রেও ব্যত্যয় ঘটেনি যে নিয়মের। ১৯৫৬-র পর উপর্যুপরি জবাব দিতে লাগল শরীর। পরে ধরা পড়েছিল, খেলার সময় ব্যবহার করা জুতোও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল টাইফুনের সঙ্গে। ডেলিভারির পদক্ষেপের মুহূর্তে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল গোড়ালি। পরিণামে মাত্র তিরিশেই দাঁড়ি পড়ল সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইংরেজ ফাস্ট বোলারের কেরিয়ারে (১৭ টেস্টের ২৪ ইনিংসে ৩ বার অপরাজিত থেকে ১০.৯৫ গড়ে সংগৃহীত রান ২৩০, সর্বোচ্চ অপরাজিত ৩৭, ৪টি ক্যাচ এবং ২৯ ইনিংসে ৩৪৫২টি ডেলিভারিতে ১৪১১ রান খরচা করে ১৮.৫৬ গড় ও ২.৪৫ ইকনমি রেটে সংগৃহীত উইকেট ৭৬, সেরা বোলিং ২৭ রানে ৭ উইকেট, ইনিংসে পাঁচ বা ততোধিক উইকেট ৪ বার, ম্যাচে দশ বা ততোধিক উইকেট ১ বার)। প্রসঙ্গত, টাইসনের কম গড়ে টেস্টে অন্তত ২০ উইকেট আজ অবধি দখল করতে পারেননি আর কোনও বোলার।
এই অবধি গল্পটা হল নিখাদ ব্যাট-বলের। এহেন বিশ্বত্রাস ইংরেজের চরিত্রে কিন্তু ছিল এক অন্যতর মাত্রা। বলে রাখা দরকার, ফ্রাঙ্ক টাইসন ছিলেন ডারহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় উড়ে গিয়ে প্রাথমিক পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন স্কুল শিক্ষকতা। ক্রিকেট সফরেও সঙ্গে থাকত জর্জ বার্নার্ড শ, ভার্জিনিয়া উলফ বা জিওফ্রে চসারের বই। যেন সেই ঋদ্ধ সাহিত্যমনস্কতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই বাইশ গজে কোনওদিনও প্রথাগত স্লেজিং-এর কদর্যতায় সংশ্লিষ্ট করেননি নিজেকে। পরিবর্তে সন্ত্রস্ত ব্যাটসম্যানের সামনে আওড়ে আসতেন কখনও ওয়ার্ডসওয়ার্থ, আবার কখনও দু’-এক পঙ্ক্তি শেক্সপিয়ার। সন্দেহাতীতভাবে বাইশ গজে ব্যাটসম্যানকে স্লেজ করা হয় তার মনঃসংযোগকে ব্যাহত করতেই। কে না জানে, ব্যাটসম্যানের কাছে ক্রিকেট নিছকই এক বলের খেলা। ফাস্ট বোলারের মাথার উপর দিয়ে দুরন্ত ছক্কা হাঁকানোর পরের বলেই ব্যাট সরানোর সেকেন্ডের গাফিলতিতে নড়ে যেতে পারে অফস্ট্যাম্প। ব্যাটের কানা ছুঁয়ে উড়ে যাওয়া বল জমে যেতে পারে ফ্লাই স্লিপের মুঠোয়। মহান কবির দু’-এক ছত্র পঙ্ক্তির রসিক উপস্থাপনাতেও যে নড়িয়ে দেওয়া যায় প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের মনোযোগের ভরকেন্দ্রটুকু—বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক ফ্রাঙ্ক টাইসন। সংস্কৃত ভাষায় ‘স্নাতক’ শব্দের অর্থ যাঁর স্নান সম্পূর্ণ হয়েছে। সাহিত্যের স্নান, সাহিত্যের সিদ্ধি বাস্তবিকই পরিপূর্ণ হয়েছিল এই ইংরেজ ফাস্ট বোলারের। বিশুদ্ধ জীবনশিল্পী জীবনের যে কোনও অনুষঙ্গকেই পরিণত করে তুলতে পারেন তাঁর শিল্পের বিষয়বস্তুতে। অথবা জীবনের যে কোনও অনুষঙ্গেই অবলীলায় সংশ্লিষ্ট করতে পারেন স্বীয় শিল্পের সারমর্মকে। ফ্রাঙ্ক টাইসনও, সেই ঢঙেই অবিকল, বাইশ গজে সফল দৌত্য ঘটাতে পেরেছিলেন আপন ঋদ্ধ সাহিত্যরুচির। একটু আগেই তাই বলছিলাম যে কথা—কোথাও উপনীত হয়ে ফাস্ট বোলিং-ও যেন এক মহৎ কবিতা—স্বয়ং ফ্রাঙ্ক টাইসনই নিজের বর্ণময় ক্রিকেট জীবনের দৌত্যে এই আপাত বিপরীত মেরুর দুই শিল্পকলাকে নিয়ে এসেছিলেন একই বিন্দুতে। টাইসনের জন্ম ১৯৩০ সালের ৬ জুন, ল্যাঙ্কাশায়ারে। সময়ই আদপে গড়ে নেয় আপন বরপুত্রকে। ফিরে দেখা যাক বিংশ শতকের সেই তিনের দশকের ব্রিটিশ ক্রিকেট সংস্কৃতির অন্তরঙ্গকে। ইতিহাসের পাতা উলটে স্মরণ করা যাক ১৯৩৬ সালের ৩ জুলাই। মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একটি ম্যাচের তৃতীয় তথা অন্তিম দিনের খেলা চলছিল লর্ডসে। আচমকাই কেমব্রিজের প্রতিনিধিত্ব করা সমসাময়িক ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটার জাহাঙ্গির খানের বলে আঘাত পেয়ে মৃত্যু ঘটে একটি চড়ুইপাখির। উইজডেনের ক্রিকেটারস অ্যালমানাকে জাহাঙ্গির খান সংক্রান্ত বর্ণনায় পাওয়া যাবে,
বাইশ গজের এক আচমকা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো হতভাগ্য একটি চড়ুইপাখির মৃতদেহকেও উপযুক্ত সম্মান দিয়ে কালের হস্তাবলেপ থেকে সংরক্ষিত রাখার চেষ্টা করে যে সুসভ্য জাতি, খুব সম্ভবত নতুন করে কিছু বলার দরকার পড়ে না তাদের বনেদি ক্রিকেট সংস্কৃতির ঋদ্ধ অন্তঃসার বিষয়ে। সবুজ গালিচার বুকে একদিন আপাদমস্তক সাদা পোশাকে সেই সমৃদ্ধ সংস্কৃতিরই প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন ফ্রাঙ্ক টাইসন। প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের মনোযোগের হানি ঘটানোর মতো দুষ্কার্যেও যে তিনি প্রকৃত জীবনশিল্পীর ঢঙেই অবলম্বন খুঁজে নেবেন আপন পূর্বপুরুষদের মহৎ শিল্পকর্মের অন্তঃকরণেই তাতে আর আশ্চর্য কী!
লেখক পরিচিতি: জন্ম নৈহাটিতে। মোবাইল কম্যুনিকেশন ও নেটওয়ার্ক টেকনোলজির স্নাতকোত্তর। তবে পছন্দের বিষয় সাহিত্য। মূলত ছোটগল্পকার। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চার— তিনটি ছোটগল্প ও একটি নিবন্ধ-সংকলন। ভালবাসেন সিনেমা ও ক্রিকেট। সাহিত্য, সিনেমা ও ক্রিকেট— এই তিনটি বিষয়েই রচনা করেছেন বেশ কিছু নিবন্ধ।।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.