অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


খেলার দুনিয়া

জুলাই ১৫, ২০১৭

 

ছাই দিয়ে যায় চেনা

আবেশ কুমার দাস

In Affectionate Remembrance
of
ENGLISH CRICKET,
which died at the Oval
on
29 August 1882,
Deeply lamented by a large circle of sorrowing
friends and acquaintances
R.I.P.
N.B.—The body will be cremated and the
ashes taken to Australia.

চিতাভস্মের চুলচেরা উত্তরাধিকার নিয়ে যে মাথা ঘামাতে পারে খোদ খ্রিস্টানরাও, কে ভেবেছিল? এক-আধ বছরও নেহাত নয়, টানা একশো চৌত্রিশ বছর ধরে ক্রিকেট দেবতার আদালতে চলছে ‘মামলা’! মাঝেমধ্যে ধুমধাম করে বসে শুনানির আসর। কেনিংটন ওভালের সেই টেস্টে দুই ইনিংস মিলিয়ে ৯০ রানে যদি ১৪ উইকেট না তুলতেন স্পফোর্থ সাহেব! অথবা ‘The Sporting Times’-এর পাতায় ব্যঙ্গচ্ছলে অবিচুয়ারিটি না লিখতেন ব্রুকস সাহেব! কতজন মনে রেখেছেন আজ এই দু’টি নাম? অথচ মামলার অন্তর্বর্তী রায় নিয়ে ক্রিকেট দুনিয়ার উৎসাহের অভাব নেই আজও।

ফ্রেডরিক স্পফোর্থ

অস্ট্রেলীয় টেস্ট ইতিহাসের একেবারে আদিপর্বের ফাস্ট বোলার ফ্রেডরিক স্পফোর্থ ব্যাট ও বল দুটোই করতেন ডানহাতে। ১৮৭৬-৭৭ থেকে ১৮৮৬-৮৭ মরসুমের ভেতর ১৮ টেস্টের ২৯ ইনিংসে ৬ বার অপরাজিত থেকে ৯.৪৩ গড়ে ২১৭ রান (সর্বোচ্চ ৫০, অর্ধশতক ১টি), ১১টি ক্যাচ এবং ৩০ ইনিংসে ৪১৮৫ ডেলিভারিতে ১৭৩১ রানের বিনিময়ে ১৮.৪১ গড়ে, ২.৪৮ ইকনমি রেটে ৯৪ উইকেট (সেরা বোলিং ৪৪ রানে ৭ উইকেট, ইনিংসে পাঁচ বা ততোধিক উইকেট ৭ বার, ম্যাচে দশ বা ততোধিক উইকেট ৪ বার) দখল করেছিলেন ১৪তম অস্ট্রেলীয় টেস্ট ক্যাপের মালিক স্পফোর্থ। ১৮৮২ মরসুমে ইংল্যান্ড সফরের একমাত্র টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৯) লন্ডনের কেনিংটন ওভালের সবুজ উইকেটে শুরুতে ৮০ ওভারে (৪ বলের ওভার) মাত্র ৬৩ রানে মুড়িয়ে যেতে হলেও স্পফোর্থের আগুনে পেসেই (৭-৪৬) প্রথম ইনিংসে ইংরেজদেরও ১০১ রানে আটকে রাখতে পেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। ২৯ অগাস্ট টেস্টের দ্বিতীয় দিন সকালে আবার ব্যাট করতে নেমে ওপেনার হিউ ম্যাসির ৫৫ ও অধিনায়ক বিলি মুরডকের ২৯-এর সৌজন্যে ১২২ অবধি পৌঁছয় ক্যাঙারুর দেশ। এবং চতুর্থ ইনিংসে ৮৫ রানের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ব্যাট করতে নামা ইংরেজদের ভবলীলা এরপর জীবনের সেরা বোলিং খতিয়ানের সুবাদে মাত্র ৭৭-এই সাঙ্গ করে দেন আবারও সেই স্পফোর্থ।

খোদ লন্ডনের মাটিতে একটি কলোনি দলের কাছে বাইশ গজের এই লজ্জাজনক পরাজয় স্বভাবতই ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল ভিক্টোরীয় ইংরেজদের। নামি সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় দেশীয় ক্রিকেটকে ব্যঙ্গ করে নাগাড়ে ছাপা হয়ে চলছিল কার্টুন, ছড়া, টীকাটিপ্পনী। ৯ সেপ্টেম্বর, শনিবারের সাপ্তাহিক ‘Punch’–এ ছাপা হওয়া একটি কবিতার পঙ্‌ক্তিগুলি ছিল,

Well done, Cornstalks! Whipt us
Fair and square,
Was it luck that tript us?
Was it scare?
Kangaroo Land’s ‘Demon’, or our own
Want of ‘devil’, coolness, nerve, backbone?

টেস্টের ফয়সালার ঠিক চারদিনের মাথায় ২ সেপ্টেম্বরের ‘The Sporting Times’-এর পাতায় ‘মৃত’ ইংলিশ ক্রিকেটের স্মরণে সেই অবিচুয়ারিটি লিখলেন প্রয়াত ব্রিটিশ সাংবাদিক তথা ঔপন্যাসিক শার্লি ব্রুকসের পুত্র রেজিনাল্ড ব্রুকস। মনে রাখা প্রয়োজন, cremation শব্দের আভিধানিক অর্থ শবদাহ। ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রচলন ছিল না প্রথাটির। কট্টর খ্রিস্টীয় সমাজে আজও ঘৃণিতই মনে করা হয় পেগান আচারগুলিকে। শবদাহ করে চিতাভস্ম একেবারে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়ার প্রসঙ্গটি নিঃসন্দেহেই তাই ব্যঙ্গের মাত্রায় এক অতিরিক্ত পরত যোগ করে। কিন্তু ক্ষুব্ধ জনতা থেকে সাংবাদিককুলের কেউই সেই মুহূর্তে খেয়াল করল না ব্রুকসের অবিচুয়ারিটির সূত্রে অচিরেই কী ঐতিহ্যশালী একটি নাম সংশ্লিষ্ট হতে চলেছে দু’ দেশের পারস্পরিক টেস্ট সিরিজের সঙ্গে।

সেই ভস্মাধার

আলোচ্য প্রসঙ্গে আপাতত বিরতি নিয়ে এই অবসরে বরং চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক বাইশ গজের সবুজ প্রেক্ষাপটে ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া যাবতীয় অ্যাংলো-অস্ট্রেলীয় দ্বৈরথের পরিণতিতে। ১৮৭৬-৭৭ মরসুমে মেলবোর্নের ঐতিহাসিক ক্রিকেট ময়দানে যথাক্রমে ১৫-১৯ মার্চ ও ৩১ মার্চ-৪ এপ্রিলব্যাপী চলা দু’টি টাইমলেস ম্যাচে জেমস লিলিহোয়াইট জুনিয়রের ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল ডেভ গ্রেগরির অস্ট্রেলিয়া। প্রথম খেলায় (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১) চার্লস ব্যানারম্যানের অপরাজিত ১৬৫ রানের সূত্রে ৪৫ রানে অস্ট্রেলিয়া এবং দ্বিতীয় খেলায় (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২) জর্জ উলেটের ব্যাটে-বলে পারফরম্যান্সের সুবাদে (২-১৫ ও ১-৩৩ এবং ৫২ ও ৬৩) ৪ উইকেটে ইংল্যান্ড পরাস্ত করে প্রতিপক্ষকে।

১৮৭৮-৭৯ মরসুমে লর্ড হ্যারিসের ইংল্যান্ড সেই মেলবোর্নেই ২-৪ জানুয়ারিব্যাপী চলা একটি টাইমলেস ম্যাচে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৩) আবারও মুখোমুখি হয় ডেভ গ্রেগরির অস্ট্রেলিয়ার। অ্যালেক ব্যানারম্যানের ৭৩ এবং মূলত স্পফোর্থের সৌজন্যে (৬-৪৮ ও ৭-৬২; ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসে রেভারেন্ড রয়েল, ফ্রান্সিস ম্যাককিনোন ও টমাস এমেটকে পরপর প্যাভিলিয়নে ফেরত পাঠিয়ে টেস্ট ইতিহাসের সর্বপ্রথম হ্যাটট্রিকের কৃতিত্ব অর্জন) ১০ উইকেটে প্রতিপক্ষকে বিধ্বস্ত করে অস্ট্রেলিয়া।
পরবর্তী আয়োজন লন্ডনের কেনিংটন ওভালে। ইংল্যান্ডের মাটিতে সেই প্রথম টেস্ট ক্রিকেটের অনুষ্ঠান। ১৮৮০ মরসুমের ৬-৮ সেপ্টেম্বরব্যাপী চলা সেই তিনদিনের খেলায় (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৪) লর্ড হ্যারিসের ইংল্যান্ডের মুখোমুখি হয়েছিল বিলি মুরডকের অস্ট্রেলিয়া। ২২, ২৩ ও ২৪তম ইংলিশ টেস্ট ক্যাপ হিসেবে এডওয়ার্ড, জর্জ ও উইলিয়াম গ্রেসভ্রাতৃত্রয়ের একত্রে অভিষেকের সৌজন্যে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে এই টেস্ট। এবং সহোদর এডওয়ার্ডের সঙ্গে ওপেন করতে নেমে প্রথম ইনিংসে উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেসের ১৫২ উক্ত টেস্টে ৫ উইকেটে ইংল্যান্ডের জয়লাভের নেপথ্যে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ডব্লু জি গ্রেসের সেঞ্চুরিটিও ছিল টেস্ট ইতিহাসে প্রথম কোনও ইংরেজের করা শতরান।

১৮৮১-৮২ মরসুম। চার টেস্টের সিরিজ খেলতে অ্যালফ্রেড শ’র ইংল্যান্ড গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। সফরের মাঝে খুচখাচ কিছু খেলা ছিল প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডের মাটিতেও। প্রতিটি টেস্টই ছিল আখেরে টাইমলেস। কিন্তু দু’ দলের সম্মতিক্রমে মীমাংসাহীন ভাবে শেষ করতে হয়েছিল সিরিজের যথাক্রমে প্রথম (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৫) ও চতুর্থ টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮)। ৩১ ডিসেম্বর ও ১০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া উক্ত উভয় টেস্টই ঘটনাচক্রে অনুষ্ঠিত হয়েছিল মেলবোর্নে। আড়াই মাসেরও কম সময়ের ব্যবধানে সংঘটিত উক্ত উভয় টেস্টের উপসংহারপর্বই দেখিয়ে দেয় কত অপেশাদার ছিল সেকালের ক্রিকেটের চরিত্র। যেখানে এলেবেলে ট্যুর ম্যাচের খাতিরেও মীমাংসার আগে থামিয়ে দিতে হয় কোনও টেস্টম্যাচের ঘটনাপ্রবাহকে। ৪ জানুয়ারি সকালের জাহাজে ইংরেজদের ভেসে পড়ার কথা ছিল নিউজিল্যান্ডের উদ্দেশ্যে। কিন্তু আগের দিন পর্যন্ত সিরিজের প্রথম টেস্টের ফয়সালা না মেলায় বন্দর কর্তৃপক্ষ বিকেল পৌঁনে চারটে অবধি পিছিয়ে দিয়েছিল জাহাজ ছাড়ার সময়। কিন্তু চতুর্থ ইনিংসে ৫৫ ওভারের (৪ বলের ওভার) শেষেও পরিস্থিতি মীমাংসার অনুকূল না থাকায় এরপর দু’ দলের সম্মতিক্রমে থামিয়ে দেওয়া হয় খেলা। মীমাংসাহীন ভাবে শেষ হয় ক্রিকেট ইতিহাসের সেই প্রথম কোনও টেস্টম্যাচ। অন্যদিকে হয়তো ফয়সালা হতেও পারত সিরিজের শেষ টেস্টের যদি না গোটা ১৪ মার্চের খেলাই ভেস্তে যেত বৃষ্টিতে। ঘটনাচক্রে সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই মেলবোর্ন ছাড়ার কথা ছিল ইংরেজদের—পরদিন থেকে ভিক্টোরিয়ায় শুরু হতে চলা একটি দু’ দিনের খেলায় অংশ নিতে। এই টেস্টের উল্লেখযোগ্য ঘটনা প্রথম ইনিংসে জর্জ উলেটের ১৪৯ যা কিনা অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে প্রথম কোনও ইংরেজের টেস্ট শতরান। সিরিজের দ্বিতীয় (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৬) ও তৃতীয় টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৭) অকুস্থল সেই প্রথমবারের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল সিডনিতে। যথাক্রমে ৫ ও ৬ উইকেটে টেস্ট দু’টি জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। তাদের তরফে এই টেস্টদ্বয়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল যথাক্রমে জর্জ পামারের ১১ উইকেট (৭-৬৮ ও ৪-৯৭) এবং পার্সি ম্যাকডোনেলের ১৪৭ রান।

ফিরে আসি আমাদের পূর্বতন আলোচনায়। ১৮৭৬-৭৭ থেকে ১৮৮১-৮২ সময়কালের ভেতর সংঘটিত আটটি টেস্টের পরিসংখ্যান বলে দেয় মোটামুটি শেয়ানে শেয়ানেই চলছিল কোলাকুলি। এবং উক্ত আটটির মধ্যে সাতটি টেস্টেরই অকুস্থল ছিল অস্ট্রেলিয়া। মনে রাখা দরকার, সমসাময়িক ইংলিশ ক্রিকেট পরিসরে খেলোয়াড়দের মধ্যে একটি সুস্পষ্ট সামাজিক বিভাজন ছিল অ্যামেচার এবং প্রফেশনালে। মজার বিষয় হল, প্রথম সারির ক্রিকেটারদের অধিকাংশই ছিলেন অপেশাদার গোত্রের। এবং যেহেতু ক্রিকেট পেশার জায়গা ছিল না এঁদের, দীর্ঘ বিদেশ সফরে পাওয়া যেত না অনেককেই। জেমস লিলিহোয়াইট জুনিয়রের বাহিনীর প্রত্যেকটি সদস্যই ছিলেন পেশাদার ক্রিকেটার। ডব্লু জি গ্রেসের মাপের ব্যক্তিত্বকে ১৮৮০-র সেপ্টেম্বরের আগে আমরা পাচ্ছিই না টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনায়। অ্যালফ্রেড শ’র সৈন্যদলে আবার চোখে পড়ছে ডাক্তারবাবুর অনুপস্থিতি। অর্থাৎ সমকালে দেশের মাটিতেই সুযোগ ঘটত পূর্ণশক্তির ইংরেজ একাদশকে মাঠে নামানোর। এই পরিস্থিতির সাপেক্ষে বিবেচনা করলেই খোদ কেনিংটন ওভালে ১৮৮২-র উক্ত পরাজয়ের ক্ষতটির গভীরতার আঁচ মেলে। প্রসঙ্গত, অ্যালবার্ট হর্নবির দলের সদস্য হিসেবে সেই টেস্টে যথারীতি মাঠে নেমেছিলেন দাড়িওয়ালা গ্রেস। ‘The Sporting Times’-এর পাতায় দেশীয় ক্রিকেটকে ‘মৃত’ বলায় মনে হয় না সারা দেশে খুব বেশি মানুষ সেদিন ব্রুকসের সাংবাদিকসুলভ বাড়াবাড়ি খুঁজে পেয়েছিলেন।

ইভো ব্লাই

এসে পড়ল ১৮৮২-৮৩ মরসুম। রানির দেশে বেজে উঠল রণডঙ্কা। আসন্ন অস্ট্রেলিয়া সফরের জন্য ইংরেজ দলপতি নির্বাচিত হলেন লন্ডনের অভিজাত পরিবারের সন্তান অনারেবল ইভো ব্লাই। তিন টেস্টের ফলাফলের ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়ার কথা ছিল রাবারের পরবর্তী মালিকানা। এমন পরিস্থিতিতে ক্রিকেট দুনিয়ার যে কোনও অধিনায়কের কণ্ঠেই শোনা যাবে রাবার পুনরুদ্ধারের আত্মবিশ্বাসী ঘোষণা। বাড়তির মধ্যে এক্ষেত্রে ব্রুকসের অবিচুয়ারির আক্ষরিক ভাষার সূত্র ধরে মরিয়া ব্লাই একেবারে শপথ নিলেন অস্ট্রেলিয়ার মাটি থেকে ‘চিতাভস্ম’ (Ashes) দেশে ফিরিয়ে আনার।

সিরিজের শুরুটা কিন্তু মোটেও মনোমতো হল না ইংরেজদের। অস্ট্রেলিয়ার মাটি যে শক্ত ঘাঁটি মেলবোর্নের প্রথম টেস্টেই (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১০) টের পেয়ে গেলেন ব্লাই। ৩৮তম ইংলিশ টেস্ট ক্যাপটিও এখানেই হাতে পেলেন ইংরেজ অধিনায়ক। ৩০ ডিসেম্বর সকালে টস জিতে ব্যাট করতে নামল অস্ট্রেলিয়া। অধিনায়ক বিলি মুরডক (৪৮), পার্সি ম্যাকডোনেল (৪৩) এবং জর্জ বোনরের (৮৫) সৌজন্যে ২৯১ তুলেও ফেলল ক্যাঙারুরা। জবাবে নববর্ষের দিন জর্জ পামারের (৭-৬৫) সামনে প্রায় দাঁড়াতেই পারল না ইংরেজরা। ডিক বার্লোকে সঙ্গে নিয়ে ওপেন করতে নামা ব্লাই-এর বেল পড়ে গেল খাতা খোলার আগেই। ১৭৭ রানে প্রথম ইনিংসে মুড়িয়ে গিয়ে সেই আমলের নিয়মে ফলো অন করে দ্বিতীয় দফায় ইংরেজরা তুলেছিল ১৬৯। ওপেনার হিউ ম্যাসির উইকেটটি মাত্র খুইয়ে জয়ের জন্য দরকারি রানটুকু পরের দিন তুলে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।

শপথ রক্ষার্থে ১৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হতে চলা পরবর্তী মেলবোর্ন টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১১) জিততেই হত ব্লাইকে। বাকি টেস্টে আর বিশেষ কিছু করতে না পারলেও সৌভাগ্যক্রমে এবার টস জিতলেন ইংরেজ অধিনায়ক। চার্লস লেসলি (৫৪), ওয়াল্টার রিড (৭৫) এবং নয় নম্বরে ব্যাট করতে নামা অফস্পিনার উইলি বেটসের (৫৫) দাপটে ইংরেজরা প্রথমেই তুলে ফেলল ২৯৪। জবাবে ব্যাট করতে নেমে উক্ত বেটসের (৭-২৮) সামনে খোদ নিজেদের দেশের মাটিতে এরপর মাত্র ১১৪ রানে ভেঙে পড়ে ক্যাঙারুরা। টেস্ট ইতিহাসের প্রথম ইংরেজ বোলার হিসেবে হ্যাটট্রিকও করেন বেটস—পার্সি ম্যাকডোনেল, জর্জ গিফেন ও জর্জ বোনরকে পরপর ফেরত পাঠিয়ে। ১৮০ রানে পিছিয়ে থেকে আবার ব্যাট করতে নেমেও উক্ত বেটসের (৭-৭৪) সৌজন্যেই ১৫৩-র বেশি আর এগোতে পারেনি অস্ট্রেলিয়া। পরিণামে ইতিহাসে সেই প্রথম কোনও টেস্টের ফয়সালা হল ইনিংসের ব্যবধানে।

রাবারের মালিকানার নির্ণায়ক পরবর্তী টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১২) অকুস্থল ছিল সিডনি। ২৬ জানুয়ারির সকালে এই টেস্টেও টসে জিতলেন ব্লাই। এবং প্রথমে ব্যাট করে ওয়াল্টার রিড (৬৬) ও উইকেটরক্ষক এডমন্ড টাইলকোটের (৬৬) সৌজন্যে ইংরেজরা তুলল ২৪৭। জবাবে ওপেনার অ্যালেক ব্যানারম্যানের ৯৪ সত্ত্বেও ২১৮-র বেশি এগোতে পারল না অস্ট্রেলীয়রা। ২৯ রানের লিড নিয়ে আবার ব্যাট করতে নেমে স্পফোর্থের (৭-৪৪) সামনে দ্বিতীয় দফায় মাত্রই ১২৩ রানে মুড়িয়ে গেল ইংল্যান্ড। দুই অঙ্কে পৌঁছতে পারলেন মাত্র চারজন ইংরেজ ব্যাটসম্যান—চার্লস স্টাড (২৫), ডিক বার্লো (২৪), ওয়াল্টার রিড (২১) ও স্বয়ং  ইভো ব্লাই (অপরাজিত ১৭)। কিন্তু এবার অস্ট্রেলীয় স্পফোর্থের জবাব হিসেবে জ্বলে উঠলেন বাঁহাতি মিডিয়াম পেসার ডিক বার্লো (৭-৪০)। ব্ল্যাকহ্যাম (২৬) এবং ম্যাসি (১১) বাদে দুই অঙ্কে পৌঁছতে পারলেন না আর কোনও অস্ট্রেলীয়। ৩০ জানুয়ারি মাত্র ৮৩ রানে ধসে পড়ল ক্যাঙারুদের ইনিংস।

ফ্লোরেন্স রোজ মরফি

নির্ধারিত হয়ে গেল রাবারের ভবিষ্যৎ মালিকানা। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া থেকে যে ‘চিতাভস্ম’ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছিলেন ব্লাই, কী হল তার? একেবারে আক্ষরিক অর্থেই রক্ষা পেল সেই প্রতিশ্রুতিও। বীররসের নেপথ্যে সে এক প্রেমরসের অন্যতর কাহিনি। অনেকটা শেষ হয়েও সাঙ্গ না হওয়া আদর্শ ছোটগল্পের মতোই অনুপম। সিডনির তৃতীয় টেস্টের পর একদল অস্ট্রেলীয় যুবতী সফররত ইংরেজ অধিনায়ককে উপহার দিয়েছিল একটি রৌপ্য ভস্মাধার। যার অভ্যন্তরে সংরক্ষিত ছিল ‘the ashes of Australian cricket’—আদপে একটি ক্রিকেট বেলের ভস্মাবশেষ। এবং ঠিক পরের বছর সানবারির সেন্ট মেরিজ চার্চে উক্ত যুবতীদলের অধিনায়িকা ফ্লোরেন্স রোজ মরফির সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন অনারেবল ইভো ব্লাই। এবং ১৯২৭-এর ১০ এপ্রিল ডার্নলের অষ্টম আর্ল, জাস্টিস অফ দ্য পিস, ডেপুটি লেফটেন্যান্ট ইভো ফ্রান্সিস ওয়াল্টার ব্লাই-এর মৃত্যুর পর লেডি ফ্লোরেন্সের তরফ থেকে উক্ত ১৮৮২-৮৩ ‘অ্যাসেজ’ জয়ের স্মারক ভস্মাধারটি দান করা হয়েছিল লর্ডস মিউজিয়ামে। যদিও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মনে হয় লর্ডস মিউজিয়ামের আজকের দ্রষ্টব্যটি প্রকৃত প্রস্তাবে আদি ভস্মাধারটির প্রতিরূপ। কেননা ১৯২৭ সালে লোকচক্ষুর সামনে আসা ভস্মাধারটি টেরাকোটার। যাহোক, আলোচ্য সিরিজ এবং পরবর্তীতে আর যাবতীয় অ্যাংলো-অস্ট্রেলীয় টেস্ট সিরিজের (কয়েকটি বিশেষ ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে) নামের সঙ্গে ‘দ্য অ্যাসেজ’ শব্দবন্ধটির সম্পৃক্ত হয়ে যাওয়ার নেপথ্য কাহিনি রচিত হয়েছিল এই সফরেই। ‘ঐতিহ্যময় চিতাভস্ম’-র উত্তরাধিকারকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সেই থেকে নিয়ম করে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়ে আসছে বিশুদ্ধ ক্রিকেট ঐতিহ্যের ধারক দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী জাতি।

টেস্ট ক্রিকেটার হিসেবে যথেষ্টই অনুজ্জ্বল ব্লাই সাহেবের খতিয়ান। ৪ টেস্টের ৭ ইনিংসে ১ বার অপরাজিত থেকে ১০.৩৩ গড়ে তাঁর সংগ্রহ সর্বসাকুল্যে ৬২ রান (সর্বোচ্চ ১৯), ক্যাচ ৭টি। উক্ত অস্ট্রেলিয়া সফরেই টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনায় তাঁর প্রবেশ ও প্রস্থান। স্বাস্থ্যের কারণে এরপর আর এগোতে পারেনি তাঁর প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট জীবনও। জেমস লিলিহোয়াইট জুনিয়র থেকে আজকের জো রুট অবধি ইংরেজদের নেতৃত্ব দেওয়া ৮০ টেস্ট অধিনায়কের ভিড়ে স্রেফ হারিয়েই যাওয়ার কথা ছিল ক্রিকেটার হিসেবে নিপাট মধ্যবিত্ত এই মানুষটির। সেই হিসেবে বিস্মৃতপ্রায়ও কি বলা যায় না ১৯০০-র ৩১ অক্টোবর বড়দা লর্ড ক্লিফটনের মৃত্যুতে উত্তরাধিকার সূত্রে ডার্নলের অষ্টম আর্লের খেতাবটি অর্জন করা অনারেবল ইভো ব্লাইকে? ক্রিকেট ইতিহাসের চর্চা করা মুষ্ঠিমেয় কিছু মানুষের বাইরে আর কতজন আজ মনে রেখেছেন তাঁর নামটি? ক্রিকেটের অন্তর্লীন চরিত্রও তো বদলে গিয়েছে কতই না সেই ব্লাই-মুরডক-স্পফোর্থ সাহেবদের সময় থেকে। সেদিনের ‘অপেশাদার’ স্পোর্টসম্যানশিপের জায়গা নিয়েছে আজকের ‘পেশাদার’ গেমম্যানশিপ।

মজা এখানেই, যতকাল অনাগত পৃথিবীতে অনুষ্ঠিত হয়ে চলবে বিশ্ব ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাটি ততকালই এই আভিজাত্যময় খেলাটির মহীয়ান ইতিহাসে প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে ব্লাই সাহেবের নামটি। ‘ছাই’ সরিয়ে সরিয়ে যতদিন ক্রিকেট রোমান্টিক অনুসন্ধান করতে থাকবে সত্যের উৎসমুখের, ততদিনই ব্রুকস সাহেবের ব্যঙ্গ, ব্লাই সাহেবের শপথ, একটি ভস্মভূত ক্রিকেট বেল এবং সর্বোপরি সেই রূপকথার পরিচয়-প্রণয়-পরিণয় পর্বের সার্বিক সংসর্গে তাকে ফিরে ফিরে যেতে হবে অন্তরালের কোনও এক অদৃশ্য ক্রিকেট দেবতার রচিত সেই দৃশ্যমান চিত্রনাট্যটির কাছে।


লেখক পরিচিতি: জন্ম নৈহাটিতে। মোবাইল কম্যুনিকেশন ও নেটওয়ার্ক টেকনোলজির স্নাতকোত্তর। তবে পছন্দের বিষয় সাহিত্য। মূলত ছোটগল্পকার। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চার— তিনটি ছোটগল্প ও একটি নিবন্ধ-সংকলন। ভালবাসেন সিনেমা ও ক্রিকেট। সাহিত্য, সিনেমা ও ক্রিকেট— এই তিনটি বিষয়েই রচনা করেছেন বেশ কিছু নিবন্ধ।।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.