অথ কথা ছাই বিনা
আবেশ কুমার দাস
After this match, the last of the rubber originally scheduled, some Australian ladies burned a bail, sealed the ashes in an urn and presented it to the victorious captain of the English team. The urn, together with its embroidered velvet bag, is housed in the Memorial Gallery at Lord’s.
রাবার ছিনিয়ে নিল ব্লাই সাহেবের দলবল। খোদ সিডনির মাটিতেই তুলল ১৮৮২-র লন্ডন টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৯) পরাজয়ের মধুর প্রতিশোধ। ‘চিতাভস্ম’-ও ফিরে পাওয়া গেল সেই অস্ট্রেলীয় যুবতীদের দৌলতে। সর্বোপরি রাবারের সঙ্গে সঙ্গে উক্ত রমণীদলের অধিনায়িকার হৃদয়টিকেও জিতে নিয়ে জাহাজে উঠলেন তরুণ ইংরেজ অধিনায়ক। কোটের পকেটে ঠাঁই পেল সেই রুপোর ভস্মাধারটি। যার অভ্যন্তরে সুরক্ষিত ছিল একমুঠো ছাই। তখন কে আর জানত, জনশ্রুতির সেই ফিনিক্স পাখিটির মতোই অবিকল ছাই থেকে এরপর নবজন্ম ঘটবে টেস্ট দুনিয়ার প্রাচীনতম দ্বৈরথটির।
সালতামামির হিসেবে টেস্ট দিগন্তের তৃতীয় সদস্য দেশটির নাম ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। পোর্ট এলিজাবেথের ক্রুসেডার্স ময়দানে ১৮৮৮-৮৯ মরসুমে ইংরেজদের বিরুদ্ধে টেস্ট আবির্ভাব (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৩১) ঘটেছিল প্রোটিয়াদের। সেই নিরিখে ইংরেজ-অস্ট্রেলীয় মহারণের পরেই পৃথিবীর প্রাচীনতম টেস্ট দ্বৈরথটি হল প্রোটিয়া-ইংরেজ সংঘাত। অথচ অ্যাসেজের অনুসরণে কোনও একটি বিশেষ নামে চিহ্নিত হতে এই দ্বৈরথকে অপেক্ষা করতে হয়েছে শতাব্দীরও অধিক সময়কাল। ২০০৪-০৫ মরসুমে উক্ত টেস্ট সিরিজকে প্রথম চিহ্নিত করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকাজাত ইন্দো-পর্তুগিজ মিশ্ররক্তের উত্তরাধিকারী অশ্বেতাঙ্গ ইংরেজ টেস্ট ক্রিকেটার বেসিল ডি’ অলিভিয়েরার নামে। এবং দু’ দেশের প্রথম সাক্ষাতের অকুস্থল সেই ক্রুসেডার্স ময়দানেই (অধুনা সেন্ট জর্জেস পার্ক) অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম বেসিল ডি’ অলিভিয়েরা ট্রফির প্রারম্ভিক টেস্টটি (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৭২৮)। অ্যান্ড্রু স্ট্রসের ১২৬ ও অপরাজিত ৯৪ রানের দু’টি ইনিংসে ভর করে উক্ত টেস্টে প্রোটিয়াদের সাত উইকেটে পরাজিত করে ইংল্যান্ড।
বহুতর কারণে ক্রিকেটের সুদীর্ঘ ইতিহাসে স্পষ্ট একটি বিভাজনরেখার চেহারায় অস্তিত্বশীল রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কয়েকটি বছর। বিশ্বযুদ্ধ-উত্তরকালের ক্রিকেটকে মোটামুটি ভাবে আধুনিক ক্রিকেট হিসেবে মান্য করা হয়। সমাজ সংসারের কোনও পরিবর্তনই বহাল হয় না রাতারাতি। সাবেক ক্রিকেট থেকে আধুনিক ক্রিকেটের আবাহনও অবশ্যই ঘটেনি একদিনে। বিগত শতকের সাতের শেষার্ধে সূচনা হয়েছিল যে আন্দোলনের তার পরিপূর্ণ স্বরূপ উদ্ঘাটিত হচ্ছে হয়তো আজকের দিনে। বা কালেদিনে হয়তো টের পাওয়া যাবে আরও অনেকানেক পরিবর্তন। মোটের উপর কথাটা হল, দেশে দেশে কিছু আগে পরে সাবেক ক্রিকেটের অপেশাদার কাঠামোটি থেকে আস্তে ধীরে বেরিয়ে এসে পেশাদারিত্বের পথে হাঁটা শুরু হয়েছিল এই বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বেই।
বিপণন ও সেই সূত্রে কিছু অবধারিত চাকচিক্য অর্থাৎ গালভরা পরিভাষায় ‘ব্র্যান্ডিং’ আধুনিকতার একটি অন্যতম চরিত্রলক্ষণ। অনেকটাই উক্ত প্রকরণের তাগিদেই ক্রিকেটের এই আধুনিক পর্বে দ্বিপাক্ষিক টেস্ট সিরিজগুলিকে ক্রমশ বিশেষ বিশেষ নামে চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১৯৬০-৬১ মরসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়া দ্বিপাক্ষিক টেস্ট সিরিজটিকে প্রথম চিহ্নিত করা হয় দ্য ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফির তকমায়। ব্রিসবেনে অনুষ্ঠিত এই ট্রফির প্রারম্ভিক টেস্টটি (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৪৯৮) ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে প্রথম টাই-টেস্ট হিসেবে। প্রসঙ্গত, টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম লগ্নটি থেকে তিরাশি বছরেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয়েছিল কোনও খেলার এই বিরল পরিণতি পেতে।
অ্যাংলো-ক্যারিবীয় টেস্ট দ্বৈরথটি উইজডেন ট্রফির মর্যাদা পায় ১৯৬৩ মরসুমে। ম্যাঞ্চেস্টারে অনুষ্ঠিত প্রারম্ভিক টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৫৪৩) কনরাড হান্টের ১৮২ এবং ল্যান্স গিবসের বোলিং বিক্রমে (৫-৫৯ ও ৬-৯৮) দশ উইকেটে ইংরেজদের পরাজিত করেছিল ক্যারিবিয়ানরা।
টেস্ট ক্রিকেটের ময়দানে যুযুধান দুই ওশিয়ানীয় প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার দ্বিপাক্ষিক মহারণটি ট্রান্স-তাসমান ট্রফি হিসেবে চিহ্নিত হয় ১৯৮৫-৮৬ মরসুমে। ব্রিসবেনে আয়োজিত প্রারম্ভিক টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১০২৯) মার্টিন ক্রো-র ১৮৮, জন রিডের ১০৮ এবং মূলত রিচার্ড হ্যাডলির ‘ফেয়ারিটেল’ পারফরম্যান্সে (৫৪ এবং ৯-৫২ ও ৬-৭১) অস্ট্রেলিয়াকে ইনিংস ও ৪১ রানে পর্যুদস্ত করেছিল নিউজিল্যান্ড।
নতুন সহস্রাব্দ থেকে ক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ইন্দো-অস্ট্রেলীয় দ্বিপাক্ষিক টেস্ট সিরিজটি প্রথম বর্ডার-গাভাসকার ট্রফির তকমা পায় ১৯৯৬-৯৭ মরসুমে। দিল্লিতে আয়োজিত প্রারম্ভিক টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৩৩৫) নয়ন মোঙ্গিয়ার ১৫২ এবং অনিল কুম্বলের বোলিং পরাক্রমে (৪-৬৩ ও ৫-৬৭) অস্ট্রেলিয়াকে সাত উইকেটে পরাস্ত করেছিল ইন্ডিয়া।
১৯৯৯-০০ মরসুম থেকে অস্ট্রেলিয়া-জিম্বাবোয়ে টেস্ট সিরিজটি চিহ্নিত হয়ে আসছে সাউদার্ন ক্রস ট্রফি হিসেবে। হারারেতে আয়োজিত প্রারম্ভিক টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৪৬৩) অধিনায়ক স্টিভ ওয়ার অপরাজিত ১৫১ ও মার্ক ওয়ার ৯০-এ ভর করে দশ উইকেটে জিম্বাবোয়েকে পরাজিত করেছিল অস্ট্রেলিয়া।
সাদা পোশাকের ক্রিকেটের আঙিনায় ক্যারিবীয়-সিংহলি দ্বৈরথটি প্রথম সোবার্স-তিসেরা ট্রফি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ২০১৫-১৬ মরসুমে। গলে অনুষ্ঠিত প্রারম্ভিক টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২১৮১) দিমুথ করুণারত্নের ১৮৬, দীনেশ চান্দিমলের ১৫১ ও রঙ্গনা হেরাথের বোলিং বিক্রমে (৬-৮৬ ও ৪-৭৯) ভর করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ইনিংস ও ৬ রানে পর্যুদস্ত করে শ্রীলঙ্কা।
অতি সাম্প্রতিকে টেস্ট-কৌলীন্য অর্জন করেছে আফগানিস্তান এবং আয়ারল্যান্ড। যদিও চলতি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপ (যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এই দুই দেশ) শেষ হওয়ার আগে টেস্ট দুনিয়ায় আত্মপ্রকাশ ঘটবে না তাদের। বাছাই সাত-আটটি অ্যাসোসিয়েট দেশের মধ্যে বহুদিন ধরে চলে এই প্রতিযোগিতা। চারদিনের খেলাগুলিকে দেওয়া হয় প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ম্যাচের স্বীকৃতি। চলতি ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপের বিস্তৃতি আগামী ২০১৭-১৮ মরসুম অবধি। অর্থাৎ ২০১৮ মরসুমের আগে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটের আঙিনায় দেখা যাবে না আফগান বা আইরিশদের। অবশিষ্ট দশটি টেস্ট-কুলীন দেশ এতকাল নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এসেছে পঁয়তাল্লিশটি দ্বিপাক্ষিক টেস্ট সিরিজে। এই সিরিজগুলির প্রত্যেকটিকেই এখনও অবধি বিশেষ বিশেষ নামে চিহ্নিত করা হয়ে না গেলেও প্রক্রিয়াটি কিন্তু চালু আছে।
তবে অ্যাসেজের মতো অভিনব প্রেক্ষাপট—বলাই বাহুল্য—কোনওকালে উপস্থিত ছিল না দুনিয়ার আর কোনও দ্বিপাক্ষিক টেস্ট সিরিজেই। এও অনস্বীকার্য, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের সেই সাবেক রমরমার দিনগুলি আজ অনেকাংশেই অস্তমিত। কিন্তু অ্যান্ডি মারের উত্থানের পূর্বাহ্ন অবধি ইতিহাসের এক বিস্তীর্ণ প্রহরব্যাপী আর কোনও ব্রিটিশ পুরুষ উইম্বলডনের সেন্টার কোর্টের ঘাস ছিঁড়ে মুখে না তুলতে পারলেও যেমন তাতে বিন্দুমাত্র ঘাটতি হয়নি উক্ত অভিজাত গ্র্যান্ড স্ল্যামের মহিমার, গ্রেস-হ্যামন্ড-কাউড্রেদের দেশের আজকের ক্রিকেটীয় মানের অবনমনেও অনুরূপ কিছুমাত্র ক্ষুণ্ন হয়নি সাবেক অ্যাসেজের আবেদন।
মজার কথা হল, সাদা পোশাক-লাল বলের আঙিনায় ১৯৬৩ পরবর্তী যাবতীয় অ্যাংলো-ক্যারিবীয় দ্বৈরথই উইজডেন ট্রফির (বা ১৯৯৬-৯৭ পরবর্তী যাবতীয় ইন্দো-অস্ট্রেলীয় সংঘাতই বর্ডার-গাভাসকার ট্রফির) অন্তর্ভুক্ত হলেও ১৮৮২-৮৩ পরবর্তী প্রত্যেকটি অ্যাংলো-অস্ট্রেলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতাই অন্তর্ভুক্ত নয় অ্যাসেজের। ১৮৭৬-৭৭ থেকে ১৮৮২-র অন্তর্বর্তী সময়কালে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের প্রথম ন’টি টেস্টের প্রসঙ্গ অবশ্যই স্বতন্ত্র। কিন্তু লক্ষণীয়, সেই ১৮৮২-৮৩ সফরেই তিন টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১০, ১১ ও ১২) ফলাফলের নিরিখে রাবারের ভবিষ্যৎ মালিকানার ফয়সালা হয়ে গেলেও ১৭-২১ ফেব্রুয়ারির ভেতর ব্লাই সাহেবের দলবল সিডনিতে আরও একটি টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৩) মুখোমুখি হয়েছিল বিলি মুরডকের বাহিনীর। অ্যাসেজ-উত্তরকালের প্রথম ‘নন-অ্যাসেজ’ টেস্ট হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে সিডনির এই টেস্টটি।
বিশেষ কারণে ইতিহাস মনে রাখবে এই টেস্টকে। রাবারের মালিকানা পূর্বাহ্নেই নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায় দু’ দলের সম্মতিক্রমে পরীক্ষামূলক ভাবে এই টাইমলেস টেস্টের চারটি ইনিংসে ব্যবহৃত হয়েছিল চারটি আলাদা আলাদা পিচ। অর্থাৎ খেলার পরিণতির উপর থেকে টসের গুরুত্বকে প্রথমেই ছেঁটে ফেলা হয়েছিল অনেকটাই। পরপর তিনটি ইনিংসের ঘাত প্রতিঘাত পদার্থবিদ্যার নিয়মেই পিচে রেখে যায় বেশ কিছু ফাটল। মিনিট দশেক রোলার চালিয়েই তখন আর বাইশ গজকে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না অবিকল প্রথম সকালের চেহারায়। একেবারে মরা ব্যাটিং উইকেট ব্যতিরেকে আর যে কোনও পিচেই চতুর্থ ইনিংস তাই বরাবরই এক অন্য খেলা। বোলিং নিয়ন্ত্রণহীন বনেদি ক্রিকেটের সেই আদিপর্বে আঢাকা ফুটিফাটা পিচে শেষ ইনিংসের ব্যাটিং যে কী মধুময় ব্যাপার ছিল কল্পনা করে নিতে খুব কষ্ট হয় না। ইতিহাসের সেই আদিলগ্নে খেলা হওয়া টেস্টগুলির স্কোরকার্ডে চোখ রাখলে দেখা যাবে টসে জেতা দল একেবারে চোখকান বুজে ওপেনারদের প্যাড গ্লাভস পরিয়ে ক্রিজে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওভালে অনুষ্ঠিত ১৮৮০-র টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৪, পাশাপাশি ইংল্যান্ডের মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্ট) প্রথম ইনিংসে ডব্লু জি গ্রেসের ১৫২-য় ভর করে ৪২০ তুলে ফেলা এবং অস্ট্রেলিয়াকে ফলো অনে পাঠানো ইংল্যান্ডই যেমন চতুর্থ ইনিংসে প্রয়োজনীয় ৫৭ রান তুলতে সময় নিয়েছিল ৩৩.৩ ওভার (৪ বলের ওভার) ও খুইয়েছিল পাঁচ-পাঁচটি উইকেট। তৃতীয় ইনিংসে অধিনায়ক মুরডককে (অপারজিত ১৫৩) যদি আর কিছুক্ষণ সঙ্গ দিতে পারতেন পামার-আলেকজান্ডার-মুলেরা, অন্যরকম হতেই পারত টেস্টের পরিণতি। অ্যাসেজ-উত্তরকালের প্রথম ‘নন-অ্যাসেজ’ টেস্টে চারটি ইনিংসে চারটি পৃথক পৃথক পিচের বন্দোবস্ত নিঃসন্দেহেই তাই ক্রিকেট ইতিহাসের একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। চারদিনের মাথায় এই টাইমলেস টেস্টটি চার উইকেটে জিতে নিয়েছিল মুরডকের দল। কাজে লাগেনি ইংল্যান্ডের তরফে প্রথম ইনিংসে অ্যালান স্টিলের অপরাজিত ১৩৫ রানের ইনিংসটি। অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে উল্লেখযোগ্য কৃতি ছিল প্রথম ইনিংসে জর্জ বোনরের ৮৭, দ্বিতীয় ইনিংসে অ্যালেক ব্যানারম্যানের ৬৩ ও জ্যাক ব্ল্যাকহ্যামের অপরাজিত ৫৮।
১৯৭৬-৭৭ সেন্টিনারি টেস্টে ডেরেক র্যান্ডাল ও গ্রেগ চ্যাপেল |
সিডনির এই সংঘাতের চুরানব্বই বছরেরও বেশি পরে মেলবোর্নের ঐতিহ্যশালী ক্রিকেট ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই বিরল গোত্রের দ্বিতীয় টেস্টটি। একটি বিশেষ পরিচয়ে ক্রিকেটের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৭৬-৭৭ মরসুমের উক্ত টেস্ট। ১৮৭৬-৭৭ মরসুমে ডেভ গ্রেগরির অস্ট্রেলিয়া বনাম জেমস লিলিহোয়াইট জুনিয়রের ইংল্যান্ডের সেই প্রথম সাক্ষাৎকারের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১) শতবর্ষপূর্তিতে আয়োজন করা হয়েছিল এই ‘সেন্টিনারি টেস্ট’-এর (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮০০)। টনি গ্রেগ ও গ্রেগ চ্যাপেলের ধুরন্ধর ক্রিকেট মস্তিষ্কের সংঘাতে সমৃদ্ধ এই টেস্টের পরিণতিতে কিন্তু অবিকল পুনরাবৃত্ত হয় অস্ট্রেলিয়ার ৪৫ রানে জয়লাভের সেই শতাব্দীপ্রাচীন ব্যবধান (অস্ট্রেলিয়া ১৩৮ ও ৪১৯/৯ এবং ইংল্যান্ড ৯৫ ও ৪১৭)। ক্যাঙারুদের তরফে এই টেস্টের উল্লেখযোগ্য কীর্তি ছিল ডেনিস লিলির ১১ উইকেট (৬-২৬ ও ৫-১৩৯) এবং তৃতীয় ইনিংসে উইকেটরক্ষক রডনি মার্শের অপরাজিত ১১০। অন্যদিকে স্রেফ চতুর্থ ইনিংসে ম্যারাথন ৪৬৩ তাড়া করতে নামা ইংরেজদের তরফে করা ধ্রুপদী ১৭৪ রানের ইনিংসটির দৌলতেই ইতিহাসে স্মরণীয় থেকে যাবেন ডেরেক র্যান্ডাল (৪৭ টেস্টের ৭৯ ইনিংসে ৫ বার অপরাজিত থেকে ৭টি শতক ও ১২টি অর্ধশতক সহযোগে ৩৩.৩৭ গড়ে সংগৃহীত রান ২৪৭০, সর্বোচ্চ ১৭৪, ক্যাচ ৩১টি এবং ২ ইনিংসে ১৬টি ডেলিভারিতে ১.১২ ইকনমি রেটে খরচ করা রান ৩)।
সেন্টিনারি টেস্টে যখন মেতে আছে ক্রিকেট দুনিয়া তলে তলে অন্যতর এক মহাবিপ্লবের প্রস্তুতি এগিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। অস্ট্রেলীয় দূরদর্শনে দেশীয় ক্রিকেটের সম্প্রচারকে কেন্দ্র করে দানা পাকিয়ে ওঠা সেই ওয়ার্ল্ড সিরিজ অধ্যায়ের কথাই বলছি। বলাই বাহুল্য, প্যাকারের সেই বিদ্রোহী সিরিজের দৌলতে ক্রিকেটীয় ভাবে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির নাম ছিল অস্ট্রেলিয়া। খেয়াল করা যাক ওয়ার্ল্ড সিরিজ অধ্যায়ের ঠিক পূর্ববর্তী কয়েকটি মরসুমের ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া দ্বৈরথের পরিসংখ্যানে। নিজেদের দেশে ১৯৭৪-৭৫ অ্যাসেজে মাইক ডেনেসের বাহিনীকে ৪-১ ফলাফলে স্রেফ তুলোধোনা করেছে অস্ট্রেলিয়া। পরবর্তী ১৯৭৫ অ্যাসেজে ইংল্যান্ড থেকেও ১-০ ফলাফলে রাবার টিকিয়ে ফিরেছেন ইয়ান চ্যাপেল। ১৯৭৬-৭৭ মরসুমে মেলবোর্নের মাটিতে সেন্টিনারি টেস্ট জিতেছেন গ্রেগ চ্যাপেল। ১৯৭৭ অ্যাসেজে ইংল্যান্ডের মাটিতে রাবার খোয়াতে হলেও দু’টি টেস্ট ড্র রাখতে পেরেছে ক্যাঙারুরা। সেখানে ১৯৭৮-৭৯ অ্যাসেজে স্বনামধন্য ক্রিকেটারদের অধিকাংশকেই হারিয়ে খোদ নিজেদের ঘরের মাঠেই শোচনীয় ৫-১ ফলাফলে পর্যুদস্ত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া। গ্রেগ চ্যাপেলের অবর্তমানে অধিনায়কত্ব করছেন অনভিজ্ঞ গ্রাহাম ইয়ালোপ, কোনও ম্যাকেঞ্জি বা লিলির নামগন্ধও থাকছে না দলে—সে বড় দুঃসময় অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের।
আবার ১৯৭৯-র পর মিটমাট হয়ে গেল ক্রিকেট বোর্ডে-কেরি প্যাকারে। বিদ্রোহী সিরিজে নাম লেখানো ক্রিকেটারদের উপর থেকে উঠে গেল নিষেধাজ্ঞা। এবং প্যাকারের স্বার্থেই এরপর বোর্ড নিল এক অভিনব উদ্যোগ। ১৯৭৯-৮০ মরসুমে প্রায় একই সময় দক্ষিণ গোলার্ধের ক্রিকেট মহাদেশে উড়ে গেল মাইক ব্রিয়ারলির ইংল্যান্ড ও ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্রমান্বয়ে দুই তরফেরই মুখোমুখি হল গ্রেগ চ্যাপেলের বাহিনী। ক্রিকেটের ইতিহাসে কোনও একটি দেশের এভাবে জোড়া টেস্ট সিরিজে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা বিরলের মধ্যেও বিরল। আসলে তখন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে যত বেশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট, ততই বেশি চ্যানেল নাইনের সম্প্রচার ও সেই সূত্রে প্যাকারের মুনাফা। অতএব যথাক্রমে ১-৫ ডিসেম্বর ব্রিসবেনে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৬২), ২৯ ডিসেম্বর-১ জানুয়ারি মেলবোর্নে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৬৭) ও ২৬-৩০ জানুয়ারি অ্যাডিলেডে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৭০) মুখোমুখি হল অস্ট্রেলিয়া-ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এবং যথাক্রমে ১৪-১৯ ডিসেম্বর পার্থে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৬৪), ৪-৮ জানুয়ারি সিডনিতে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৬৮) ও ১-৬ ফেব্রুয়ারি মেলবোর্নে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৭২) মুখোমুখি হল অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড।
অস্ট্রেলীয়-ক্যারিবীয় টেস্টগুলি প্রথাগত ভাবেই দ্য ফ্রাঙ্ক ওরেল ট্রফির অন্তর্ভুক্ত হলেও অ্যাংলো-অস্ট্রেলীয় টেস্টগুলি পেল না অ্যাসেজ-টেস্টের শিরোপা। সূচি থেকে দেখা যায় ২ জানুয়ারি ক্যারিবিয়ানদের মহড়া নিয়ে উঠেই ৪ জানুয়ারি ইংরেজদের মুখোমুখি হতে হত অস্ট্রেলিয়াকে (ক্যারিবিয়ানরা যে খেলা শেষ করে দিয়েছিল চতুর্থ দিনই তা একেবারেই অন্য বিষয়)। আবার ৩০ জানুয়ারি লয়েডদের সঙ্গে বোঝাপড়া মিটিয়েই ১ ফেব্রুয়ারি হতে হত ব্রিয়ারলিদের মুখোমুখি। এবং এই উভয় ক্ষেত্রেই যথাক্রমে মেলবোর্ন থেকে সিডনি ও অ্যাডিলেড থেকে মেলবোর্ন উড়ে যাওয়ার ব্যাপারটুকুও ছিল। পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় জোড়া সিরিজ খেলতে হলেও এত টানাপোড়েনের মধ্যে স্পষ্টতই ‘চিতাভস্ম’-র মালিকানা বুঝে নেওয়ার বৃহত্তর প্রেক্ষিতটিকে সংশ্লিষ্ট রাখতে চায়নি অস্ট্রেলিয়া। সমকালীন পৃথিবীর সর্বোত্তম ক্রিকেট শক্তি ক্যারিবিয়ানদের কাছে রাবার খোয়ানোর ভয়ও অস্ট্রেলিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিতে অ্যাসেজ হারানোর আশঙ্কার তুলনায় স্পষ্টতই অনেক কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রায় শেষ প্রহরে ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিল লিন্ডসে হ্যাসেটের অস্ট্রেলিয়া। ওয়ালি হ্যামন্ডের ইংল্যান্ডের সঙ্গে সফরকারী অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেসের খেলা হয় পাঁচটি তিনদিনের ম্যাচ। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের বাজারে নিজেদের ক্রিকেটীয় শক্তি সম্পর্কে সন্দিহান অস্ট্রেলীয় বোর্ড অ্যাসেজ তো দূর অস্ত, সাধারণ টেস্টম্যাচের স্বীকৃতি দিতেও সম্মত হয়নি ১৯৪৫ মরসুমের উক্ত খেলাগুলিকে। ১৯৭৯-৮০ ‘নন-অ্যাসেজ’ ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া সাক্ষাৎকারেও পুনরাবৃত্ত হল একই মনোভঙ্গি। তবে যথাক্রমে ১৩৮ রানে, ৬ উইকেটে এবং ৮ উইকেটে এই সিরিজে কিন্তু ইংরেজদের চুনকাম করেই ছেড়েছিল পূর্ণশক্তি ফিরে পাওয়া অস্ট্রেলিয়া। পার্থের প্রথম টেস্টে অ্যালান বর্ডারের ১১৫ ও জেফ ডাইমকের ৯ উইকেট (৩-৫২ ও ৬-৩৪), সিডনির দ্বিতীয় টেস্টে গ্রেগ চ্যাপেলের অপরাজিত ৯৮ এবং মেলবোর্নের তৃতীয় টেস্টে গ্রেগ চ্যাপেলের ১১৪ ও ডেনিস লিলির ১১ উইকেট (৬-৬০ ও ৫-৭৮) অস্ট্রেলিয়ার তরফে সিরিজের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
১৯৮০ সেন্টিনারি টেস্টে ব্যাটিংরত মাইক গ্যাটিং |
ইংল্যান্ডের মাটিতে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত ১৮৮০-র টেস্টের প্রসঙ্গ আগেই এসেছে এই নিবন্ধে। মেলবোর্নের অনুসরণেই ১৯৮০ মরসুমে একটি সেন্টিনারি টেস্টের (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৮৮৫) আয়োজন করা হয় লর্ডসে। প্রসঙ্গত, অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম ও শতবার্ষিকী উভয় টেস্টই অনুষ্ঠিত হয়েছিল মেলবোর্নে। কিন্তু ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে উক্ত অকুস্থলদ্বয় ছিল যথাক্রমে কেনিংটন ওভাল ও লর্ডস। অ্যাসেজ-উত্তর ইতিহাসের এই প্রথম ‘নন-অ্যাসেজ’ দ্বৈরথ যেখানে অমীমাংসিত ভাবে খেলা শেষ করতে পেরেছিল ইংল্যান্ড। ৫ উইকেটে ৩৮৫ ও ৪ উইকেটে ১৮৯ রান তুলে দু’বারই ইনিংসের দান ছেড়ে দিয়েছিলেন গ্রেগ চ্যাপেল। প্রথম ইনিংসে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে শতরান করেন যথাক্রমে গ্রেম উড (১১২) ও কিম হিউজ (১১৭)। ইয়ান বোথামের দল প্রথম দফায় ২০৫ রানে মুড়িয়ে যায় ডেনিস লিলি (৪-৪৩) ও লেন প্যাসকোর (৫-৫৯) দাপটে। দ্বিতীয় দফায় অবশ্য জিওফ্রে বয়কটের অপরাজিত ১২৮ ও মাইক গ্যাটিং-এর অপরাজিত ৫১-র দৌলতে ৩ উইকেটে ২৪৪ অবধি পৌঁছতে পেরেছিল ইংরেজরা।
বাইসেন্টিনারি টেস্টের পূর্বাহ্নে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটাররা |
কৌলীন্যে কিছু খামতি ছিল না পরবর্তী তথা এযাবৎকালের সর্বশেষতম অ্যাংলো-অস্ট্রেলীয় ‘নন-অ্যাসেজ’ সাক্ষাৎকারটিরও। উপরন্তু বাইশ গজকে অতিক্রম করে উক্ত টেস্টের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এমনকি সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল অন্য এক বৃহত্তর সামাজিক অন্তরঙ্গেও। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ইউরোপীয় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার দ্বিশতবর্ষপূর্তিকে স্মরণে রেখে ১৯৮৭-৮৮ মরসুমে সিডনিতে বসেছিল ‘বাইসেন্টিনিয়াল টেস্ট’-এর (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১০৯০) আসর। প্রসঙ্গত, গোত্রে ‘নন-অ্যাসেজ’ হলেও আখেরে কিন্তু এই টেস্ট একেবারে পরিহার করে যেতে পারেনি ‘অ্যাসেজ’ অনুষঙ্গ। লর্ডস সংগ্রহশালার জন্য লেডি ফ্লোরেন্সের দান করা সেই স্মারক ভস্মাধারটিকে এই টেস্টের প্রাক্কালেই প্রথম নিয়ে যাওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ায়। বলা প্রয়োজন, ‘চিতাভস্ম’-র মালিকানার প্রশ্নে দড়ি টানাটানি চলতে থাকলেও ভস্মাধারটি কিন্তু প্রথাগত শিল্ড বা ট্রফির মতো ঘোরাফেরা করে না দু’ দেশের মধ্যে। ডার্নলের অষ্টম আর্ল, জাস্টিস অফ দ্য পিস, ডেপুটি লেফটেন্যান্ট ইভো ফ্রান্সিস ওয়াল্টার ব্লাই-এর মৃত্যুর পর থেকে দ্রষ্টব্যটির স্থায়ী ঠিকানা হয়ে আছে লর্ডসের স্মারক সংগ্রহশালা। এবং রীতিমতো রঞ্জনরশ্মির নীচে ফেলে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে টেরাকোটার ভাস্কর্যটিকে।
টেস্টের তৃতীয় দিন অবধি খেলায় প্রাধান্য ছিল মাইক গ্যাটিং-এর দলের। ইংল্যান্ডের প্রথম ইনিংসের ৪২৫ রানের জবাবে মাত্র ২১৪ রানে মুড়িয়ে গিয়ে ফলো অনে বাধ্য হয় অস্ট্রেলিয়া। ইংরেজদের হয়ে শতরান করেছিলেন ক্রিস ব্রড (১৩৯)। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় ব্যাট হাতে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ডেভিড বুন (অপরাজিত ১৮৪)। এই দফায় ১৩৫ ওভারেও দু’টির বেশি অস্ট্রেলীয় উইকেট তুলতে পারেননি এমবুরি-ক্যাপেলরা। শেষ অবধি বুনের সঙ্গে ৪৮ রানে অপরাজিত রয়ে যান অধিনায়ক অ্যালান বর্ডার। দ্বিশতবার্ষিকী টেস্টই আজ অবধি হওয়া সর্বশেষ অ্যাংলো-অস্ট্রেলীয় ‘নন-অ্যাসেজ’ দ্বৈরথ।
টেস্ট ক্রিকেটের আঙিনায় আজ অবধি ৩৪১ বার সাক্ষাৎ ঘটেছে দু’ দেশের (যথাক্রমে ১০৮ এবং ১৪০টি টেস্টে জিতেছে ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া, অমীমাংসিত থেকেছে ৯৩টি খেলা)। একেবারে আদিপর্বের ন’টি সাক্ষাৎকার ব্যতিরেকে অ্যাসেজ-উত্তরকালের এই সাতটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাই ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে ‘নন-অ্যাসেজ’ টেস্টের তকমায়। ১৮৮২-৮৩ থেকে ১৯৮৭-৮৮—একশো পাঁচ বছরের দীর্ঘ সময়সীমায় বিচ্ছিন্ন ভাবে অনুষ্ঠিত এই টেস্টসপ্তক গোত্রে ‘নন-অ্যাসেজ’ হয়েই কিন্তু আখেরে সাক্ষ্য রেখে যায় অ্যাসেজের গভীর মাহাত্ম্যের। দু’টি সেন্টিনারি ও বাইসেন্টিনিয়াল টেস্টকে অ্যাসেজের মর্যাদা না দেওয়া থেকেই সন্ধান মেলে ঐতিহ্যময় ‘চিতাভস্ম’-র উত্তরাধিকারকে ঘিরে দুই খ্রিস্টীয় দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির চরম স্পর্শকাতরতার বাস্তবতাটির। খুচখাচ দু’-এক টেস্টের ছুটকো দ্বৈরথের নিরিখে ‘চিতাভস্ম’-র মালিকানা হস্তান্তরে রাজি নয় কোনও পক্ষই। সম্পৃক্ত থাকলই না হয় এসব ক্ষেত্রে শতবার্ষিকী বা দ্বিশতবার্ষিকী উদ্যাপনার সম্ভ্রান্ত প্রেক্ষাপট। অ্যাসেজের কৌলীন্যও কিছু কম নয় দু’ দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতির গূঢ় অলিন্দে।
আজ মনে হয়, অ্যাসেজকে কেন্দ্র করে এমন গভীর স্পর্শকাতরতার ইন্ধনেই মরিয়া হয়ে সেদিন বডিলাইনের কুৎসিত পথে হাঁটতে পেরেছিলেন ডগলাস জার্ডিন। হাঁটতে পেরেছিল ‘নোবেলেস্ট অফ অল গেমস’-এর উদ্ভাবক সাগরপাড়ের সেই সনাতন ক্রিকেট সভ্যতা। ব্যাট-বলের ন্যূনতম অনুষঙ্গ যতকাল বয়ে বেড়াবে এই গ্রহ, ইতিহাসের পাতায় ততকালই কলঙ্কের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে হ্যারল্ড লারউডকেও। মানুষ মনে রাখবে অ্যাডিলেডের সেই তৃতীয় টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২২২, ‘ব্যাটল অফ অ্যাডিলেড’ নামে কুখ্যাত) মাথা নীচু করে লারউডকে বিল উডফুলের ডাক করা। একই ইনিংসে খুলিতে চোট পেয়ে সম্পূর্ণ অচেতন হয়ে অস্ট্রেলীয় উইকেটরক্ষক বার্ট ওল্ডফিল্ডের ময়দানত্যাগ। নিঃসন্দেহেই ১৯৩২-৩৩ অ্যাসেজ ক্রিকেটের সামগ্রিক ইতিহাসেই এক ঘৃণিত অধ্যায়। কিন্তু প্রকারান্তরে উক্ত ঘটনাচক্রই আবার প্রমাণ করে কতখানি স্পর্শকাতরতা ছিল দুই দেশের ক্রিকেট সংস্কৃতিতে সেদিনের অ্যাসেজকে কেন্দ্র করে। ‘ধর্ম’প্রতিষ্ঠার মোহে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে সংঘটিত করে চলা সেই একটির পর একটি অধর্মের আদলেই তাই যেন সেদিন সাধারণ ঔচিত্য অনৌচিত্যবোধের সংজ্ঞাও গুলিয়ে গিয়েছিল ভদ্রতার কারণে বিশ্ববন্দিত জাতিটির।
লেখক পরিচিতি: জন্ম নৈহাটিতে। মোবাইল কম্যুনিকেশন ও নেটওয়ার্ক টেকনোলজির স্নাতকোত্তর। তবে পছন্দের বিষয় সাহিত্য। মূলত ছোটগল্পকার। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চার— তিনটি ছোটগল্প ও একটি নিবন্ধ-সংকলন। ভালবাসেন সিনেমা ও ক্রিকেট। সাহিত্য, সিনেমা ও ক্রিকেট— এই তিনটি বিষয়েই রচনা করেছেন বেশ কিছু নিবন্ধ।।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.