পুরনো বলের হস্তশিল্প
আবেশ কুমার দাস
“Fancy being done by a bloody Chinaman”
কটূক্তির লক্ষ্যমুখ হওয়াও সময় সময় স্মরণীয় করে দেয় মানুষকে। যেমন ঘটেছিল এলিস আচং-এর বরাতে। নয়তো আর কী কারণ থাকে উইকেট পিছু সাতচল্লিশ রানের গড় রাখা বোলারকে মনে রাখার! অবশ্য স্বনামে কতখানি স্মরণীয় হয়ে আছেন অধুনা আচং, বলা মুশকিল। অনেক নিখাদ ক্রিকেট রসিকের কপালেই ভাঁজ ফেলে দেবে আজ এই নাম। কিন্তু বিরল একটি বোলিং শিল্পধারার অনুষঙ্গের সঙ্গেও কোনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকাই বা কম কী একজন ক্রিকেটারের জীবনে?
ক্যারিবিয়ান টেস্ট ইতিহাসের আদিপর্বের প্রতিনিধি আচং-এর পরিচিতি ছিল বাঁ-হাতি রিস্ট-স্পিনের দরুণ। ঘরের মাঠ কুইন্স পার্ক ওভালেই ২২তম ক্যারিবিয়ান টেস্ট ক্যাপ হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল এই ত্রিনিদাদির। অনারেবল ফ্রেডি ক্যালথর্পের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৯২৯-৩০ ঘরোয়া সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ১৮৯)। আবার জীবনের শেষ টেস্টটিও (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২৩৯) খেলেছিলেন পোর্ট অফ স্পেনের উক্ত ময়দানেই বব ওয়াটের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৯৩৪-৩৫ ঘরোয়া সিরিজে। নাতিদীর্ঘ ক্রিকেট জীবনে খেলা ৬ টেস্টের ১১ ইনিংসে ব্যাট হাতে ১ বার অপরাজিত থেকে ৮.১০ গড়ে করা ৮১ রানের (সর্বোচ্চ ২২) পাশাপাশি আচং তালুবন্দি করেছিলেন ৬টি ক্যাচ ও ৮ ইনিংসে ৯১৮টি ডেলিভারিতে ৪৭.২৫ গড়ে ও ২.৪৭ ইকনমি রেটে ৩৭৮ রানের বিনিময়ে সংগ্রহ করেছিলেন ৮টি উইকেট (সেরা বোলিং ৬৪ রানে ২ উইকেট)।
এলিস আচং |
সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটের আসরে নিছক মধ্যবিত্ত এই মানুষটির নামই কিন্তু সম্পর্কিত হয়ে আছে বাইশ গজের এক বিরল শিল্পকলার সঙ্গে। সৌজন্যে ডগলাস জার্ডিনের ইংল্যান্ড বনাম জর্জ গ্র্যান্টের ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে অনুষ্ঠিত ১৯৩৩ মরসুমের এক ম্যানচেস্টার টেস্ট (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২২৮)। ক্যালেন্ডারে তারিখটি ছিল ২৫ জুলাই, মঙ্গলবার। স্কোরকার্ডে চোখ রাখলে দেখা যায় প্রথম ইনিংসে হেডলি-কনস্টানটাইনদের তোলা ৩৭৫-এর জবাবে ঠিক দলগত ৩৭৪ রানের মাথায় পরপর সপ্তম (ওয়াল্টার রবিন্স), অষ্টম (ডগলাস জার্ডিন) ও নবম (এডওয়ার্ড ক্লার্ক) উইকেট হারিয়ে অতিথিদের ১ রান পেছনে থেমে যেতে হয়েছিল ইংরেজদের (ব্যাট করতে পারেননি আহত জর্জ ম্যাকাউলে)। প্রসঙ্গত, দলগত ২৩৪ রানের মাথায় আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমে অধিনায়ক জার্ডিনের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে ১৪০ রান জুড়েছিলেন রবিন্স। ঠিক যখন আশা করা যাচ্ছে এই জুটির কল্যাণে প্রথম ইনিংসে লিড নিয়ে নেবে ইংরেজরা তখনই একটি অদ্ভুত ডেলিভারি বেরিয়ে এল বাঁ-হাতি আচং-এর কবজি থেকে। বাঁ-হাতি রিস্ট-স্পিনারের স্বাভাবিক টার্নের আন্দাজেই স্টেপ আউট করে বেরিয়ে আসা ডানহাতি রবিন্সকে হতচকিত করে দিয়ে পিচ থেকে ঠিকরে ওঠা বলটি বাঁক নিল উল্টোদিকে। দস্তানায় বল নিয়ে ইভান ব্যারো যখন নড়িয়ে দিচ্ছেন তেকাঠি লক্ষণরেখার ধারেকাছেও তখন নেই রবিন্স। ঠকে গিয়ে তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় যা বেরিয়ে এল এরপর সাহেবের মুখ ফসকে অশ্বেতাঙ্গর কানে তা বাজতেই পারে বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের মতো—চিনে ব্যাটাচ্ছেলের ভোজবাজি।
খেয়াল রাখতে হবে দু’টি বিষয়। প্রথমত, ত্রিনিদাদবাসী আচং আদতে ছিলেন চিনা বংশোদ্ভূত। এবং দ্বিতীয়ত, খুব ভদ্র বিশেষণে ব্যবহৃত হয় না ইংরেজি ‘ব্লাডি’ শব্দটি। এভাবে ঠকে উইকেট দিতে হলে অবশ্য বিরক্ত হবেন পৃথিবীর যে কোনও ব্যাটসম্যানই। তবে সম্ভবত রবিন্স আরও চটেছিলেন এক চিনেম্যানের বলে ঠকে গিয়ে। প্রসঙ্গত, আচং-ই ছিলেন টেস্ট ইতিহাসে প্রথম চিনা রক্তের প্রতিনিধি। ১৯২৯-৩০ তো দূর অস্ত, আজকের দিনেও বিশ্ব ক্রিকেটে কোনও শক্তি হিসেবেই গণ্য হয় না পৃথিবীর জনবহুলতম দেশটি। বিশ্ব ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থার বিচারে অ্যাসোসিয়েট পর্যায়েরও তলায় নেহাত অকিঞ্চিৎকর অ্যাফিলিয়েট গোত্রে তার স্থান (সেই অনুমোদনও মিলেছে সবে ২০০৪ সালে)। সম্ভবত, কনস্টানটাইন বা মার্টিনডেলের মতো কোনও খাস ক্যারিবিয়ান ভূমিপুত্রের বলে নিজের উইকেটটি খোয়াতে হলে এত বিরক্ত হতেন না রবিন্স সাহেব। উইকেটে জমে গিয়েও নিজের ভুলে কোনও দুধুভাতু বোলারের শিকার হতে হলে এমন একটু-আধটু মুখখারাপ হয়তো একদিন পাড়ার মাঠে করে ফেলেছি আমরাও।
তবু, পার্থক্য তো কিছু থেকেই যায় গুপীর মাঠে আর সম্ভ্রান্ত ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে (যদিও অন্যতর প্রেক্ষিতে তালতলার মাঠের কভার ড্রাইভকে লর্ডসের কভার ড্রাইভের থেকে সংজ্ঞায় স্বতন্ত্র করতে চাননি গোপাল বসু)। ক্রিকেট ঐতিহাসিক অভিষেক মুখার্জির কলাম থেকে জানা যায় সেই মুহূর্তে মাঠে উপস্থিত লিয়ারি কনস্টানটাইন চেপেও ধরেছিলেন ওয়াল্টার রবিন্সকে,
অর্থাৎ এই হল বাঁ-হাতি রিস্ট-স্পিনারের গুগলি তথা বিরল চায়নাম্যান ডেলিভারির নামকরণের নেপথ্য ইতিবৃত্ত। এতটাই বিরল এই জাতের বোলারদের অস্তিত্ব যে ডগলাস জার্ডিনের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৯৩২ মরসুমে (২৫-২৮ জুন) লর্ডসে নিজেদের প্রথম টেস্টটি (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২১৯) খেলতে নামার মুহূর্ত থেকে কাঁটায় কাঁটায় ঠিক চুরাশি বছর ন’ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে টেস্ট দুনিয়ার ষষ্ঠ সদস্য দেশটিকে এই প্রজাতির প্রথম কোনও টেস্ট পর্যায়ের বোলার পেতে। ২০১৬-১৭ মরসুমের শেষ লগ্নে (২৫-২৮ মার্চ) ধর্মশালায় বর্ডার-গাভাসকার ট্রফির নির্ণায়ক শেষ টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ২২৫৮) স্টিভ স্মিথের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ২৮৮তম ইন্ডিয়া টেস্ট ক্যাপ হিসেবে অভিষেক ঘটে প্রথম ভারতীয় চায়নাম্যান বোলার কুলদীপ যাদবের। প্রসঙ্গত, কুলদীপকে পেতে পেতে কর্নেল সি কে নাইডু থেকে অজিঙ্ক রাহানে অবধি সর্বমোট ৩৩ জন টেস্ট অধিনায়ককে পাওয়া হয়ে গিয়েছে আসমুদ্রহিমাচল এই সুবিশাল দেশটির! এবং ধর্মশালায় নামতে হয়েছে দেশীয় ক্রিকেট ইতিহাসের ৫১২তম টেস্ট ম্যাচটিতে অংশ নিতে!
কিন্তু দুনিয়ায় কেন এত বিরল চায়নাম্যানদের সংখ্যা? কিছুটা জবাব মিলেমিশে প্রকৃতি ও মানবসভ্যতার অন্তরঙ্গে প্রচ্ছন্ন থাকলেও সম্পূর্ণ সদুত্তর পেতে হলে ডুব দিতেই হবে পুরনো বলের হস্তশিল্পের সামগ্রিক ব্যাকরণে। পালিশ চটে ক্রমে যখন গতি হারায় প্রথম সকালের লাল চেরি, গতির বাহাদুরদের পরিবর্তে ফিল্ডিংরত অধিনায়ককে নির্ভর করতেই হয় তখন ভোজবাজির ওস্তাদদের উপর। সচরাচর পুরনো বলের দুই জাতের জাদুকরের দেখা মেলে পৃথিবীতে। একদল আস্থা রাখেন আঙুলের কারিকুরিতে। পক্ষান্তরে অন্যদল নির্ভর করেন কবজির মোচড়ে। আঙুলের জাদুকরের ডান ও বামহাতের অস্ত্র যথাক্রমে প্রথাগত অফস্পিন ও লেফট-আর্ম অর্থোডক্স। অনুরূপে কবজির ওস্তাদের অস্ত্রেরা হল যথাক্রমে প্রথাগত লেগস্পিন ও লেফট-আর্ম আনঅর্থোডক্স। প্রসঙ্গত, এই চার জাতের ডেলিভারির মধ্যে প্রথম ও চতুর্থের গতিপথ অফ থেকে লেগ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয়র গতিপথ লেগ থেকে অফে। এই অবধি প্রভেদগুলি নিছক প্রাথমিক পর্যায়ের এবং ডেলিভারির মুহূর্তে বোলারের হাতের দিকে খেয়াল রাখলে এই পর্যায় অবধি পড়ে নিতে তেমন অসুবিধে হওয়ার কথা নয় ব্যাটসম্যানের। আর তাহলে তো মীমাংসাই হয়ে গেল রহস্যের যাবতীয় জটের!
চায়নাম্যানের ঘূর্ণি |
জটিলতার সূত্রপাত ঘটছে আসলে এরপর থেকে। আঙুলের কৌশল ও কবজির মোচড়ের একত্র প্রয়োগে জন্ম দুসরার। বিগত শতকের শেষপর্বে পাকিস্তানি অফস্পিনার সাকলিন মুস্তাক উদ্ভাবন ঘটান এই ডেলিভারিটির। প্রথাগত অফব্রেকের প্রায় অবিকল গ্রিপে বোলারের হাত থেকে নির্গত এই ডেলিভারির গতিপথ লেগ থেকে অফের দিকে (অর্থাৎ অফস্পিনের ঠিক বিপরীত)। ধ্রুপদী অফস্পিনে বুড়ো আঙুলের সঙ্গে থাকে তর্জনী ও মধ্যমার কারিকুরি। দুসরায় বল ছাড়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে অনামিকার ব্যবহার পালিশ চটা লাল চেরিকে ঠেলে দেয় উল্টোদিকে। স্বভাবতই আবিষ্কারের পর বেশ কিছুকাল আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাকিস্তানেরই একচেটিয়া ছিল অস্ত্রটির প্রয়োগ। সেই আমলে সাকলিনের স্পেল চলাকালে ব্যাটসম্যানের মতিগতি বুঝে উইকেটরক্ষক মঈন খান উর্দুতে বোলারকে ডাক দিতেন সেই ‘দুসরা’ (অন্য) বলটি ছাড়তে। ডেলিভারির নেপথ্য ব্যাকরণ তখনও অজানা থাকায় অগ্রিম সতর্কতা গ্রহণের কোনও উপায়ই থাকত না ব্যাটসম্যানের। এভাবেই এই ডেলিভারির নামকরণের নেপথ্য প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছেন মঈন খান।
দুসরার জটিল ভ্রমণপথ |
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আজ দুসরা অনেক অফস্পিনারের তূণেরই গুরুত্বপূর্ণ বাণ। প্রসঙ্গত, দুসরায় কবজির মোচড়ের আরোপিত অনুষঙ্গটির কারণে অনিবার্য হয়ে ওঠে কনুইয়ের ভূমিকা। এবং কনুই ভাঙার অনুমোদিত পরিমাপের নিয়মটির সৌজন্যেই সময় সময় এই ডেলিভারি বোলারকে টেনে নিয়ে যেতে পারে আইসিসির পর্যবেক্ষণে। কনুই ভাঙতে না হওয়ায় ধ্রুপদী অফস্পিনারের বেলায় কিন্তু এক ওভারস্টেপিং ব্যতিরেকে ডেলিভারি অবৈধ হওয়ার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। শ্রীলঙ্কার মুথাইয়া মুরলীধরন, ভারতের হরভজন সিং, দক্ষিণ আফ্রিকার জোহান বোথা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের শেন শিলিংফোর্ডরা দুসরার প্রয়োজনে নিজেদের বোলিং অ্যাকশনে কনুইয়ের অনুষঙ্গটি সংশ্লিষ্ট করতে গিয়েই বিপদ ডেকে এনেছিলেন। অফস্পিনার ধাঁধা লাগায় দুসরায় তো লেগস্পিনার গুগলিতে। বিংশ শতকের প্রথম দশকের ইংরেজ অলরাউন্ডার বার্নার্ড বোসঅ্যাঙ্কোয়েট (৭ টেস্টের ১৪ ইনিংসে ৩ বার অপরাজিত থেকে ১৩.৩৬ গড়ে সংগৃহীত রান ১৪৭, সর্বোচ্চ ২৭, ক্যাচ ৯টি এবং ১১ ইনিংসে ৯৭০টি ডেলিভারিতে ৬০৪ রানের বিনিময়ে সংগ্রহ ২৫টি উইকেট, সেরা বোলিং ১০৭ রানে ৮ উইকেট, গড় ২৪.১৬, ইকনমি রেট ৩.৭৩, ইনিংসে পাঁচ বা ততোধিক উইকেট ২ বার) এই ডেলিভারির জনক।
বার্নার্ড বোসঅ্যাঙ্কোয়েট |
সেই হিসেবে বিংশ শতকের প্রথম ও শেষ দশক বিশ্ব ক্রিকেটকে দিয়ে গিয়েছে পুরনো বলের দু’টি ব্রহ্মশির। প্রথাগত লেগব্রেকের পরিচিত অ্যাকশন থেকেই ছাড়া হয় গুগলি। কিন্তু ডেলিভারির পূর্বক্ষণে কবজির কৌশলের সামান্য হেরফেরে বা আঙুলের কারিকুরিতে বলের গতিপথকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় অফ থেকে লেগে (অর্থাৎ প্রথাগত লেগব্রেকের বিপরীতে)। কেন ঘাতক এই ডেলিভারি? লেগব্রেকের প্রত্যাশায় ডানহাতি ব্যাটসম্যান ব্যাট নিয়ে যাবেন বলের লাইনের বাইরে। চকিতে উল্টোদিকে ঢুকে আসা বলের সামনে থাকবে না কোনও রক্ষণ। পরিণতি হতে পারে তিনরকম। তেকাঠির সামনে বিপজ্জনক ভাবে পায়ের ঠিকানা পেয়ে যেতে পারে পালিশ চটা লাল চেরি। ব্যাট প্যাডের ফাঁক গলে ফেলে দিতে পারে বেলও। অথবা ছুঁয়ে নিতে পারে অপ্রস্তুত ব্যাটের কানা। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ফলাফল খুব স্পষ্ট। বাকি দুই ক্ষেত্রে যথাক্রমে আম্পায়ার ও উইকেটরক্ষকই (বা স্লিপের ফিল্ডার) যা বাড়াতে পারেন বন্ধুত্বের হাত।
সুভাষ গুপ্তে |
অর্থোডক্স ভিনু মানকড় ও অফস্পিনার গোলাম আহমেদের সঙ্গে পাঁচের দশকে ভারতের প্রথম স্পিন-ত্রয়ী গঠন করা লেগস্পিনার সুভাষ গুপ্তে শৈল্পিক স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন আপন গুগলিকে। টাইগার পাতৌদির বিখ্যাত সেই স্পিন-চতুষ্টয়ের অন্যতম সদস্য ভগবৎ চন্দ্রশেখরও ছিলেন গুগলির ওস্তাদ। তবে চন্দ্রশেখরের হস্তশিল্পের বেলায় শাপে বর হয়েছিল তাঁর শৈশবের পোলিও। বেঁকে যাওয়া ডানহাতে ব্যাট ভাল ধরতে না পারলেও কবজি থেকে প্রায় মিডিয়াম পেসের গতিতে (দীর্ঘ রান-আপ ছিল চন্দ্রশেখরের) নির্গত ডেলিভারিগুলির কোনটি যে কোনদিকে বাঁক নেবে সময় সময় বুঝতেন না তিনি নিজেও। পোলিও আক্রান্ত ডানহাত যে এই লেগস্পিনারের ব্যাটিং ও বোলিং-এ কী প্রভাব রেখে গিয়েছিল মালুম হয় তাঁর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই। ৫৮ টেস্টের ৮০ ইনিংসে ৩৯ বার অপরাজিত থেকে (এবং ২৩টি গোল্লা সহযোগে) ৪.০৭ গড়ে ব্যাটে তাঁর সংগ্রহ যেখানে সর্বসাকুল্যে ১৬৭ (সর্বোচ্চ ২২, ক্যাচ ২৫টি) ৯৭ ইনিংসে ১৫৯৬৩টি ডেলিভারিতে ২৯.৭৪ গড় ও ২.৭০ ইকনমি রেটে ৭১৯৯ রানের বিনিময়ে পক্ষান্তরে তাঁর ঝুলিতেই জমা পড়েছিল ২৪২টি উইকেট (সেরা বোলিং ৭৯ রানে ৮ উইকেট, ইনিংসে পাঁচ বা ততোধিক উইকেট ১৬ বার, ম্যাচে দশ বা ততোধিক উইকেট ২ বার)। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ভারতের সর্বোচ্চ উইকেট সংগ্রাহক এবং দেশের ৩০তম টেস্ট অধিনায়ক অনিল কুম্বলের হাতেও ছিল মারণ গুগলি।
ভগবত চন্দ্রশেখর |
ডানহাতি জাদুকরের গুগলির ধাঁচেই কবজির ন্যাটা ওস্তাদের মার চায়নাম্যান। পুরনো বলের এই বিশেষ হস্তশিল্পটির বিরলতার কিছুটা প্রেক্ষিত প্রচ্ছন্ন রয়েছে সমাজ ও প্রকৃতিতেও। দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে তো বটেই, খেয়াল করলে দেখা যাবে, শৈশবে যৎপরোনাস্তি নিরুৎসাহ করা হয় বাঁহাতে খাওয়া বা লেখার মতো শিশুর সহজাত প্রবণতাগুলিকেও। এমনকি পাশ্চাত্যেও করমর্দনের প্রথাটির সঙ্গে একেবারে স্বতঃসিদ্ধের মতো সম্পৃক্ত হয়ে আছে ডানহাতের ব্যবহার। প্রাকৃতিক ভাবেই ন্যাটারা সংখ্যালঘু দুনিয়ায়। উপরন্তু সামাজিক প্রবণতার এই বাড়তি দক্ষিণপন্থার সৌজন্যে বাঁহাতের ব্যবহার আরও কমই চোখে পড়ে আমাদের আশপাশে। ক্রিকেটও এই বৃহত্তর চালচিত্র থেকে ব্যতিক্রমী নয় বলেই অফস্পিনার বা লেগস্পিনারের তুলনায় ন্যাটা স্পিনারের পরিষেবা বরাবর কমই পেয়ে এসেছে বাইশ গজ।
উপরন্তু মনে রাখতে হবে, চায়নাম্যান ডেলিভারিটি আখেরে ন্যাটা হাতের কবজির ভোজবাজি। এই পর্যায়ে উপনীত হয়ে সম্পৃক্ত হচ্ছে সংখ্যালঘুত্বের আরও একটি পরত। শারীরবৃত্তীয় কারণেই কবজির কারসাজির তুলনায় অনেক অনেকাংশে সহজতর আঙুলের আনুষ্ঠানিকতা। ডানহাতি স্পিনারদের মধ্যেও ঠিক এই কারণেই বেশি দেখা মেলে অফস্পিনারদের। বা নিয়মিত বোলারদের সাময়িক বিরতি দেওয়ার প্রয়োজনে পুরনো বলে দু’-চার ওভার হাত ঘোরাতে এসে সচরাচর আঙুলের কেরামতিই দেখিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন ব্যাটসম্যানরাও। সেই তিনের দশক থেকে ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে চোখ রাখলে তাই পরপর ফিরোজ পলিয়া, রুস্তমজি জামসেদজি, কেকি তারাপোরে, ভিনু মানকড়, হীরালাল গায়কোয়াড়, বাপু নাদকার্নি, সেলিম দুরানি, বিষেণ সিং বেদী, কারসন ঘাউড়ি (নতুন বলে করতেন মিডিয়াম পেসও), দিলীপ দোশি, রবি শাস্ত্রী, রঘুরাম ভাট, মনিন্দর সিং, বেঙ্কটপতি রাজু, সুনীল জোশি, মুরলী কার্তিক, প্রজ্ঞান ওঝা বা হালের রবীন্দ্র জাডেজার মতো ন্যাটাদের ক্রমাগত অর্থোডক্সেই মনোযোগী দেখি। আংশিক সময়ের জন্য রান আপে এসেও একদিকে বিজয় মঞ্জরেকর, এম এল জয়সীমা, সুনীল গাভাসকার (নতুন বলে হালকা গতির পেসে ইনিংসের সূচনাও করেছেন জীবনের প্রথম পর্বে), চেতন চৌহান, রাহুল দ্রাবিড়, ভি ভি এস লক্ষণ, হৃষীকেশ কানিতকর বা মুরলী বিজয়রা আস্থা রেখেছেন অফস্পিনে। পক্ষান্তরে মুস্তাক আলি, অজিত ওয়াড়েকর, অশোক গন্ধোত্র, অজয় শর্মা, উরকেরি রামন, হেমাং বাদানি বা যুবরাজ সিং-রা নির্ভর করেছেন অর্থোডক্সের উপর। বাঁ-হাতি স্পিনের আনঅর্থোডক্সরা সেই সূত্রে বিরল পৃথিবীর যে কোনও দেশেই।
ধ্রুপদী আনঅর্থোডক্সের সঞ্চারপথ যেখানে অফ থেকে লেগের দিকে চায়নাম্যানের অভিমুখ সেখানে লেগ থেকে অফে। ডানহাতি বা ন্যাটা, আঙুলের ওস্তাদ বা কবজির ভেলকিবাজ, পুরনো বলের সব শিল্পীরই অবশ্যই সামর্থ্য নেই উল্টোদিকে বল ঘোরানোর। অফ বা লেগস্পিনার মাত্রেই যেমন পারদর্শী নন দুসরা বা গুগলির, আনঅর্থোডক্স মাত্রেও তেমনই ওস্তাদ নন চায়নাম্যানের। অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে সংখ্যালঘুত্বের এতগুলি স্তর অতিক্রম করে উত্থান ‘চৈনিক’ হস্তশিল্পীর।
চার্লস ল্যুয়িলিন |
এলিস আচং-এর চৈনিক কুলজিই এই বিরল ডেলিভারির নামকরণের উৎসমুখ হলেও আখেরে চায়নাম্যানের জনক নন আচং। ইতিহাসের ইঙ্গিত অনুযায়ী সম্মানটি প্রাপ্য ঊনবিংশ শতকের শেষপর্বের অশ্বেতাঙ্গ প্রোটিয়া অলরাউন্ডার চার্লস ল্যুয়িলিনের। ইংরেজ পিতার ঔরসজাত এই মিশ্ররক্তের ক্রিকেটারকে অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার (এবং ঘোরতর বর্ণবিদ্বেষী দক্ষিণ আফ্রিকার) প্রথম অশ্বেতাঙ্গ টেস্ট ক্রিকেটারের পরিচয়েও মনে রাখবে ইতিহাস। ১৮৯৫-৯৬ মরসুমে জোহানেসবার্গের অধুনালুপ্ত ওল্ড ওয়ান্ডারার্স ময়দানে অনুষ্ঠিত প্রথম টেস্টে (টেস্ট ক্রমাঙ্ক: ৪৮) লর্ড হকের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৩৩তম প্রোটিয়া টেস্ট ক্যাপ হিসেবে অভিষেক ঘটেছিল ল্যুয়িলিনের। ষোলো বছরের টেস্ট জীবনে ১৫ টেস্টের ২৮ ইনিংসে ১ বার অপরাজিত থেকে ২০.১৪ গড়ে ৪টি অর্ধশত সহকারে ৫৪৪ রান (সর্বোচ্চ ৯০) সংগ্রহ করার পাশাপাশি ল্যুয়িলিন তালুবন্দি করেছিলেন ৭টি ক্যাচ ও ২১ ইনিংসে ২২৯২ ডেলিভারিতে ১৪২১ রানের বিনিময়ে (গড় ২৯.৬০, ইকনমি রেট ৩.৭১) দখল করেছিলেন ৪৮টি উইকেট (সেরা বোলিং ৯২ রানে ৬ উইকেট, ইনিংসে পাঁচ বা ততোধিক শিকার ৪ বার, ম্যাচে দশ বা ততোধিক শিকার ১ বার)। লক্ষণীয়, আচং ছিলেন টেস্ট ক্রিকেটের অঙ্গনে প্রথম চিনা রক্তের প্রতিনিধি। এবং দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম অশ্বেতাঙ্গ টেস্ট ক্রিকেটারের পরিচয়ে ল্যুয়িলিনকে মনে রাখবে ইতিহাস। এই অদ্বিতীয় ডেলিভারির আবিষ্কার ও পরিচিতির সঙ্গে যে এভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকল বাইশ গজের এমন বিরল দু’টি অনুষঙ্গ, পালিশ চটা বলের বিরলতম হস্তশিল্পটির প্রতি ক্রিকেট দেবতার করা এর থেকে বড় পোয়েটিক জাস্টিস আর কী হতে পারত!
লেখক পরিচিতি: জন্ম নৈহাটিতে। মোবাইল কম্যুনিকেশন ও নেটওয়ার্ক টেকনোলজির স্নাতকোত্তর। তবে পছন্দের বিষয় সাহিত্য। মূলত ছোটগল্পকার। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা চার— তিনটি ছোটগল্প ও একটি নিবন্ধ-সংকলন। ভালবাসেন সিনেমা ও ক্রিকেট। সাহিত্য, সিনেমা ও ক্রিকেট— এই তিনটি বিষয়েই রচনা করেছেন বেশ কিছু নিবন্ধ।।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.