অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


খেলা‘ঘর’ বাঁধতে লেগেছি

অবসর বিশেষ সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১, ২০১৭

 

রোলাঁ গ্যারোয় একটি রূপকথার রাত

দেবশ্রী ভট্টাচার্য

সেটা ছিল ১৯৯৯ সাল। সম্ভবত জুন মাসের প্রথম শনিবার। ক্লাস শেষে এক বন্ধুর জন্মদিন পালন করতে জড়ো হয়েছিলাম কলেজ সংলগ্ন এক রেস্তোরাঁয়। এক পেট বিরিয়ানি খেয়ে খানিক তাড়াহুড়ো করেই বাড়ি ফিরলাম।একটু পরেই যে শুরু হবে ফরাসী-ওপেনে মেয়েদের সিঙ্গলস ফাইনাল, স্টেফি গ্রাফের ফাইনাল, এখানে এটাই শেষ বার। গত ১০/১২ বছরে একুশটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব জেতা হয়ে গেছে, তারমধ্যে পাঁচবার শুধু এখানেই। তিন বছর আগেও তিন তিনটে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে শেষ করেছিলেন বছরটা। এরপর আর নামতে পারেননি কোর্টে। দীর্ঘদিনের হাঁটুর চোট তাঁকে নিয়ে ফেলেছিল অপারেশন টেবিলে। সেই শরীর-মনের ধাক্কা সামলাতেই কেটে গেল আরও এক বছর। খানিকটা হাল্কা ছলেই নেমেছিলেন এইবার, পাখির চোখ ছিল সামনের উইম্বলডন!

এদিকে এই দু' বছরে বদলে গেছে অনেক কিছুই। টানা সবচেয়ে বেশী দিন (১৮৬ সপ্তাহ) এক নম্বরে থাকা স্টেফি নেমে গেছেন তিন ধাপ! তাঁরই ফেলে আসা একছত্র সাম্রাজ্যে জাঁকিয়ে বসতে চাইছেন মার্টিনা হিংগিস আর ড্যাভেনপোর্টের মত নবাগতারা। ছুরির আঘাত সারিয়ে গত বছর সার্কিটে ফিরে এসেছেন কেরিয়ারের প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী মনিকা সেলেসও। কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে দ্বিতীয় বাছাই ড্যাভেনপোর্ট আর সেমিফাইনালে তৃতীয় বাছাই মনিকা সেলেসকে হারিয়ে স্টেফির সামনে এবার হিঙ্গিস! বছর আঠারোর এই ছিপছিপে তরুণীই তখন এক নম্বরে, টুর্নামেন্ট এর শীর্ষ বাছাই! এই দু' বছরেই তিনি জিতে নিয়েছেন চার/পাঁচ টা গ্র্যান্ড স্ল্যাম, একমাত্র অধরা থেকে গেছে এই ফরাসী ওপেন চ্যাম্পিয়নশিপ খেতাব! এবার কি হবে স্বপ্ন পূরণ?

স্টেফি গ্রাফ

শুরু হল তিরিশ ছুঁইছুঁই কিংবদন্তির সাথে আঠারোর তারুণ্যের লড়াই! মানুষের ঢল নেমেছে এর সাক্ষী থাকতে। উপচে পড়ছে রোলা গ্যারো স্টেডিয়াম! দু’ বছর পর স্বমহিমায় ফিরে এসেছেন প্রিয় চ্যাম্পিয়ন..সেই চোখ জুড়োনো ফোরহ্যান্ডে আগের দুটো নকআউট ম্যাচে উড়ে গেছেন ড্যাভেনপোর্ট, সেলেসরা। দর্শকও সেদিন আর নিরপেক্ষ থাকতে পারছেন কই? স্টেফির এক একটা পয়েন্টে গর্জে উঠছে স্টেডিয়াম শত-সহস্র করতালিতে। প্রথম সেট থেকেই কেমন যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন হিঙ্গিস, র‍্যাকেট ছুড়েই ফেলেন একবার। তবে এই সেট জিতে নেন তিনি শেষ অব্ধি (৪-৬ গেমে)। দ্বিতীয় সেটে টানটান উত্তেজনা শুরু থেকেই। হিঙ্গিসের একটি শটে বল লাইনের বাইরে পড়েছে এই মত দেন মাঠ-আম্পায়ার। মানতে নারাজ হিঙ্গিস নিজেই চলে আসেন স্টেফির কোর্টের শেষ প্রান্তে। শেষে ম্যাচ-রেফারির হস্তক্ষেপে আবার শুরু হয় ম্যাচ। স্পিরিট অনেকটাই ধাক্কা খায় এমন আচরণে। "স্টেফি স্টেফি.." চীৎকারে মত্ত স্টেডিয়াম তখন শুধুই অপেক্ষার প্রহর গুনছে বিজয় মুহূর্তের। এ যে সর্বকালের সেরা এক চ্যাম্পিয়নের বিদায়লগ্ন! তবুও দ্বিতীয় সেটেও ম্যাচ পয়েন্ট পেয়ে যান হিঙ্গিসই। এবার শুরু হয় প্রকৃত চ্যাম্পিয়নের এক অবিস্মরণীয় ফিরে আসার লড়াই। হিঙ্গিসের ম্যাচ-পয়েন্ট সার্ভিস ব্রেক করে পর পর পাঁচ/ছয় টা পয়েন্ট আদায় করে সেই সেট জিতে তো নেনই স্টেফি (৭-৫ গেমে), অন্তিম সেটের লড়াইয়েও এগিয়ে যান অনেকটাই। এখান থেকে আর কোনরকমেই ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি হিঙ্গিস। এই সেটটা একরকম একতরফাই জিতে নেন স্টেফি গ্রাফ(৬-২ গেমে)। যদিও ম্যাচ শেষের দু-এক মিনিট আগেও স্টেডিয়ামের আওয়াজে মন:সংযোগ নষ্ট হচ্ছে বলে আবারো আম্পায়ারের কাছে অভিযোগ করে বসেন হিঙ্গিস। স্টেফি জবাব দেন এক অপ্রতিরোধ্য উইনারে। হাতে ২২-তম গ্র্যান্ড স্ল্যাম ট্রফি, চোখে জলের ধারা..মাইক হাতে কিছু বলার সময় গলা রুদ্ধ হয়ে আসে স্টেফির! কোনমতে ধন্যবাদ দিতে পারেন দর্শকদের এই আকুল সমর্থনের জন্য আর হিঙ্গিসকেও বলেন সামনে অনেক সুযোগ আছে এই কাপ জেতার, এত ভেঙে না পড়তে। ভেজা চোখে গোটা স্টেডিয়াম তখন বিদায় জানাচ্ছে তাঁকে। তখন কে জানত সামনের উইম্বলডন তাঁর আর জেতা হবেনা। হিঙ্গিসেরও আর কোনদিন পাওয়া হবেনা এ কাপ। সে বছর অস্ট্রেলিয়া-ওপেনেই এক নতুন যুগের সূচনা হবে ভবিষ্যৎ চ্যাম্পিয়ন সেরেনা উইলিয়ামস এর আবির্ভাবে।

স্টেফি গ্রাফের হাসি-কান্না মাখা সেই মায়াবী সন্ধ্যেটা আজ এই আঠারো বছর পরও কেমন চোখের সামনে ভাসে।প্রিয় ম্যাচ নিয়ে লিখতে বসে মনে এল এই ম্যাচটার কথাই..


লেখক পরিচিতি: বাড়ি হালিসহর, পেশা কলেজে অধ্যাপনা। নেশা – যে কোনো আউটডোর গেম, পারি না পারি, খেলতে সাধ যায়! স্বপ্ন – পরের জন্মে ক্রিকেট খেলা।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.