‘ছোটোর দাবি’– সম্ভাবনার টেবিল টেনিস
গোরাচাঁদ চৌধুরী
২০১৭এর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। দিল্লীর থ্যাগরাজ স্টেডিয়ামে চলছে আইটিটিএফ ওয়ার্ল্ড ট্যুর-ইন্ডিয়ান ওপেন টেবল টেনিস টুর্নামেন্ট। ভারতে এই প্রথম ওয়ার্ল্ড ট্যুরের মতো দামী প্রতিযোগিতা। অংশগ্রহণ করছেন টিটি জগতের প্রথম সারির প্যাডলারেরা; আছেন স্যামসনভ, ওসীমা, ওভচারভের মতো প্রথম কুড়িতে থাকা খেলোয়াড়, এছাড়াও এসেছেন চিন, জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশের নামজাদা পুরুষ ও মহিলা প্যাডলারেরা। ঈর্ষণীয় তাঁদের সকলেরই ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং। রয়েছেন ভারতীয় টিটির আইকন শরথ কমল; সৌম্যজিৎ ঘোষ, জি সথ্যেন, মৌমা দাস, মধুরিকা পাটকরও আছেন। অসাধারণ সব খেলা, লোম খাড়া করে দেওয়া র্যালি, চোখধাঁধানো টপস্পিন, উপর্যুপরি অবিশ্বাস্য ডিফেন্স, বিদ্যুৎ গতির উইনারের সম্মিলিত প্রদর্শনীতে নয়নসার্থক সে টুর্নামেন্ট। যেমন প্রতিযোগীদের র্যাকেটের ঝলসানি, তার সংগে পাল্লা দিয়ে জাঁকজমকের আয়োজনের ঝলকানি। মনের ভিতরে আশাবাদ উঁকি মেরে বলতে চাইছিল যে ভারতে টিটি’র সাবালকত্ব পাওয়ার সময়টা আর বেশি দূর নয়। কিন্তু এটা ভারত, যেখানে এখনো খেলা বলতে আমজনতা ক্রিকেটটাকেই বোঝেন, ফলে বেশিরভাগ সময়েই স্টেডিয়াম ইকো করছে। বোঝা গেল এখনো ছোট খেলার তকমাটা সে অর্থে রয়েই গেছে।তবে একই সঙ্গে এটাও প্রযোজ্য যে, সেভাবে দেখতে গেলে তুলনামূলক ভাবে ভারতে টিটি’র ইতিহাস বেশ নবীন। বিশ্বের ক্রীড়া ইতিহাসেও বটে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা ভারতীয় ক্রীড়াজগতকে অনেকভাবে সমৃদ্ধ করেছে বলে জানা থাকলেও, টেবল টেনিস এর জায়গা ছিল ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলির সান্ধ্য-আড্ডা আর চা-বাগানের সাহেবদের অবসর বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। চা এবং ক্রিকেট বিস্তারে ভারতে সাহেবদের যে অবদান, অবশ্যই টিটি বা অন্যান্য ছোট খেলার জন্য আমরা তাঁদেরকে ততখানি সচেষ্ট দেখি নি। মোটামুটি খুব পিছনে না গিয়েও স্বচ্ছন্দে বলাই যায় যে ইন্দু পুরী, কমলেশ মেটা’র আগে আমাদের দেশে টেবল টেনিসের খবর কাগজে জায়গা পেত না। যদিও আজও অবস্থার যে খুব উন্নতি হয়েছে তা জোর গলায় বলা যাবে না। টেবল টেনিসের খবর শেষ পাতার নিচের দিকে ছোট্ট খোপের মধ্যে বড়জোর চার লাইন। এমনকি ইন্ডিয়ান-ওপেনের খবরও কলকাতার বড় কাগজগুলোতে সেভাবে স্থান পায়নি, যদিও ন্যাশনাল ডেইলিগুলো প্রত্যাশিতভাবেই এটাকে গুরুত্ব দিয়েই ছাপিয়েছে। আমাদের কাছে আরো গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ভারতীয়দের মধ্যে বাঙালিরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আমরা যদি টেবল টেনিসের হালফিলের ছবিটার দিকে একটু চোখ বোলাই, দেখব যে ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংএ প্রথম দশে কেবল জার্মানির দিমিট্রিজ ওভচারভ আর টিমো বল ছাড়া কোনও নন-এশিয়ান নেই, মেয়েদের প্রথম দশেও একজন মাত্র নন-এশিয়ান প্যাডলার। অথচ খেলাটা ১৯০১এ শুরুই করেছিলেন ইউরোপিয়ানরা। আর ১৯৫২তে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ খেলা হয়েছিল আমাদের দেশে তদানীন্তন বোম্বাইতে, এশিয়াতেই সেই প্রথমবার। আজ প্রশ্নাতীতভাবে চিন আর জাপান প্রভুত্ব করছে বিশ্ব টিটি’তে। পুরুষ বিভাগে প্রথম চারটে নামই চিনের, মেয়েদেরও তাই। এই যদি আন্তর্জাতিক ছবি হয়, মনে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক তবে আমরা এখন কোথায়? হ্যাঁ, আমরা আছি এবং শুনলে অবাক হবেন না, ভারতীয় টেবল টেনিসের এখন কিন্তু বেশ সুসময়। মোটামুটিভাবে গত প্রায় ৭০ বছর ধরে সেভাবে ভারতীয়রাও টিটি খেলছেন, কিন্তু এই প্রথম বিশ্ব-ক্রমতালিকাতে প্রথম ১০০তে একসঙ্গে চার চারজন ভারতীয়। অচিন্ত্য শরথ কমল (৪৪), হরমিত দেশাই (৮১), সৌম্যজিৎ ঘোষ (৮৪) আর মেয়েদের মধ্যে মণিকা বাত্রা (১০০) [জুন ২০১৭এর ক্রমানুযায়ী]। দেশভিত্তিক তালিকাতে ভারত ১৪তম স্থানে [জুন ২০১৭এর ক্রমানুযায়ী]। ক্রিকেটকে এই আলোচনায় না আনাই ভালো। তথাকথিত ছোটখেলার মধ্যে ব্যাডমিন্টন (তাও কি আর ছোট?) ব্যতীত আর কোনও আন্তর্জাতিক খেলার বিশ্ব-ক্রমপর্যায়ে ভারতের স্থান কিন্তু এই মুহুর্তে এত ওপরে নয়। এবার আরো ছোট করি যদি ছবিটাকে? বাংলার কী খবর? হকিতে পাঞ্জাব আর ফুটবলে বাংলা’র একাধিপত্যের ছবি ছিল ভারতীয় খেলার জগতের একরকম স্থায়ী চিত্র। সে ছবি ক্রম-বিলীয়মান হলেও, আজ কিন্তু বাংলার মান রেখে চলেছে তুলনায় অনেকটাই ছোট খেলা টেবল টেনিস। একেবারেই অতিশয়োক্তি নয় যে বাংলা বিগত ২০-২৫ বছর ধরে ভারতীয় টিটি’র বড়দাদাগিরি করে আসছে। বাংলার টিটি নিয়ে আমরা অবশ্যই আরো একটু বিশদ আলোচনা করব তবে তার আগে ভারতীয় টিটি’র অবস্থা নিয়ে দু-এক কথা ছোট করে বলা যাক। ১৯৮৮তে সিওল অলিম্পিকসে টেবল টেনিস প্রথমবার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকে প্রায় প্রতি অলিম্পিকসেই ভারত টিম পাঠিয়েছে এবং অন্যান্য অনেক খেলার মতোই বেশিরভাগ সময়েই প্রথম রাউন্ডেই দৌড় শেষ হয়ে গিয়েছে। অলিম্পিকসে এখনো পর্যন্ত সেরা পারফরম্যান্স শরথ কমলের থার্ড রাউন্ড খেলা । বরং কমনওয়েলথ গেমসে ভারতীয় টিটি’র সাফল্য অনেকটাই বেশি। কমলেশ মেটা থেকে চেতন বাবুর, শরথ কমল কমনওয়েলথে ব্যক্তিগত সোনা জিতেছেন। ডাবলসেও সোনা এসেছে বহুবার, রুপোও এসেছে। দলগতভাবেও ভারত সোনা এনেছে সেখান থেকে। এছাড়াও এশিয়ান গেমস, সাফ গেমস, কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়নশিপ, সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন গেমস থেকে ভারতীয়েরা শুধু আজ নয়, কমলেশ মেটা’র আমল থেকেই ঝুড়ি ঝুড়ি পদক আনছেন। টেবল টেনিসে গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্ট ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপেও আমাদের ছেলেমেয়েদের পারফরম্যান্স ফেলনা নয়। একদম সাম্প্রতিক, জুন ২০১৭ তে জার্মানিতে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপেও ভারতীয়েরা দারুণ লড়াই করলো। শরথ কমল দুর্দান্ত খেলেও শেষ ১৬য় ওঠার ম্যাচে পরাস্ত হলেন। মৌমা দাস-মণিকা বাত্রা জুটি ডাবলসে ইতিহাস তৈরী করে কোয়ার্টার ফাইনাল খেললেন। ক্রিকেটের যেমন কাউন্টিক্লাব বা ফুটবলের প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবে খেলে জাতে ওঠার একটা ব্যাপার থেকেই যায়, সেরকমই টিটি’র অভিজাত ক্লাব জার্মানির বরুসিয়া ডুসেলডর্ফে খেলছেন শরথ কমল, ওখসেনহসেন ক্লাবে প্র্যাকটিস করছেন সৌম্যজিৎ ঘোষ। পরিসংখ্যান এর কচকচিতে আর না গিয়ে শুধু এটাই বলার যে ছোট খেলা কিন্তু বড় পায়ে হাঁটতে শুরু করেছে।
ভারতীয় টেবল টেনিসের আইকন অচিন্ত্য শরথ কমল |
ফিরে আসি বাংলায়। টেবল টেনিসে বাংলা বরাবরই অগ্রণী রাজ্য। মনে রাখতে হবে এই বাংলাতেই সেই ১৯৭৫ সালেই আয়োজিত হয়েছিল টেবল টেনিসের ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ। সেই সুবাদেই আমরা পেয়েছিলাম মাত্র চার মাসের মধ্যে তৈরী করা ১২০০০ দর্শকাসনের নেতাজী ইনডোর স্টেডিয়াম। সেই টুর্নামেন্টের দুটো ঘটনার উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। এক, নেহাতই রাজনৈতিক কারণে সেবার সাউথ আফ্রিকা আর ইজরায়েলকে সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হয় নি। দুই, পুরুষদের সেমিফাইনাল চলার সময় ৭৫ মিনিট খেলা বন্ধ রাখতে হয়েছিল সদ্যনির্মিত ছাদের ফুটো দিয়ে বৃষ্টির জল টেবিলে পড়ার জন্য। ফেব্রুয়ারি মাসের অকালবর্ষণ আর নির্মাণগত ত্রুটি সেদিন উদ্যোক্তাদের যথেষ্ট লজ্জাই দিয়েছিল। তৎসত্ত্বেও একটা সময় ছিল যখন ভারতীয় টিটি টিমের অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ বাংলা বলে ভুল হতে পারত। ভারতীয় টেবল টেনিসের আঁতুড়ঘর বলা হত বাংলাকে (লোকে বলতো নারকেলডাঙা ও শিলিগুড়ি, এখন যেমন প্রধানত: নৈহাটি)। হ্যাঁ, কমলেশ মেটা বা ইন্দু পুরীর কথা মাথায় রেখেই বলছি। মেয়েদের টিটি’র কথাই আগে ধরা যাক। সাতবারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন (আটবারের ইন্দু পুরীর রেকর্ডটা কেবল ভাঙা বাকি) পৌলমী ঘটক আর তাঁর অবিচ্ছেদ্য জুড়ি ছ’বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন মৌমা দাসের গত প্রায় দু’দশকের একচ্ছত্র দাপট কি সহজে ভোলার? এমন কোনও প্রতিযোগিতা নেই যেখানে এঁরা দেশের প্রতিনিধিত্ব করেননি। সাফল্য পাননি কেবল অলিম্পিকে। মান্তু ঘোষ বা অনিন্দিতা চক্রবর্তীকেই বা ভুলি কি করে? আজো দেশের হয়ে খেলছেন মৌমা সঙ্গে আরো কয়েকজন বঙ্গতনয়া। নৈহাটির সুতীর্থা মুখার্জী খুব কিছু অঘটন না ঘটলে বা ঘটালে আগামী কয়েক বছর বিশ্বের দরবারে ভারতীয় চ্যালেঞ্জ। সঙ্গে কৃত্তিকা সিংহরায়। দ্রুত উঠে আসছেন ঐহিকা, মৌমিতা, আর প্রাপ্তি। জাতীয় স্তরে রীতিমতো সমীহ জাগানো পারফরম্যান্স করে এঁরা আকর্ষণ করেছেন সকলের দৃষ্টি। ছেলেদের দিকে নজর ফেরান। কমলেশ মেটা-উত্তর যুগ থেকে শরথ কমল যুগের মধ্যবর্তী বছরগুলো কিন্তু বাংলার ছেলেরাই শাসন করেছে ভারতীয় টিটি। অরূপ বসাক, অর্জুন দত্ত, গণেশ কুণ্ডু, শুভ্রজিত সাহা, সৌম্যদীপ রায়। হালফিলের বাঙালি তারকা সৌম্যজিৎ ঘোষ। প্রচণ্ড প্রতিভা আর দৃঢ়সঙ্কল্প নিয়ে জাতীয় দলের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে একদল বাঙালি তরুণ- রণিত ভঞ্জ, অর্জুন ঘোষ, অনির্বাণ নন্দী, জিৎ চন্দ্র, অভিমন্যু মিত্রেরা। এমনকি টেবল টেনিসের জাতীয়স্তরের কোচিংএও বাঙালি কোচেরা চিরকালই যথেষ্ট সম্মান পেয়ে আসছেন- জয়ন্ত পুশিলাল, তপন চন্দ্র, মিহির ঘোষ থেকে আজকের ইন্ডিয়ান টেবল টেনিস টিমের কোচ সৌম্যদীপ রায়। টেবল টেনিসে একমাত্র দ্রোণাচার্য পুরস্কারও এক বাঙালি কোচেরই-তিনি ভবানী মুখার্জী। তবুও এ লেখা তো কেবল ‘আমরা বাঙালি’ ধ্বজা উত্তোলনের জন্যই নয়। তাই একইসঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে যে এতদসত্বেও বাংলার টেবল টেনিস কিন্তু এখন কড়া চ্যালেঞ্জের সামনে। বিশেষ কয়েকটি রাজ্য দ্রুত উঠে এসেছে পাদপ্রদীপের আলোতে। অধুনা ভারতীয় টিটির আইকন শরথ কমল বা জি.সথ্যেন টিটি’তে তামিলনাড়ুকে একদম সামনে নিয়ে এসেছেন। দক্ষিণ থেকে কর্ণাটকও তৈরী করছে প্রতিভা। মহারাষ্ট্রে এত ভালো ভালো খেলোয়াড় উঠে আসছে যে ওঁরা বাধ্য হয়ে দুটো রাজ্যদল তৈরী করেছেন। দিল্লী, গুজরাট আর হরিয়ানা থেকেও বেশ ভালো কিছু তরুণ প্রতিভা আজ জাতী্য় স্তরে খুব পরিচিত নাম। সিনিয়র টিমের কথা ছেড়েই দিলাম। অর্চনা কামাথ, শ্রুতি অম্রুতে, সেলেনা সেলভাকুমার,মানব ঠক্কর, অভিষেক যাদব, পার্থ ভিরমান, পা্য়াস জৈনরা অতি প্রতিশ্রুতিবান হিসেবে সার্কিটে আজ বহুল প্রচারিত নাম। আর যতদূর জানি, ভারতীয় জাতীয় কোচ ম্যাসিমো কনস্ট্যানটিনির বাছাই-করা সেরা ৪০ ‘ভবিষ্যতের তারকা’য় অবাঙালি খেলোয়াড়েরাই সংখ্যাগুরু।
বাংলার সোনার দুই মেয়ে পৌলমী ঘটক ও মৌমা দাস। |
“ভারতীয় টেবল টেনিসের এই উত্থান আসলে এক মানসিকতার পরিবর্তনের ফসল”, বলছেন পৌলমী ঘটক। “আমি বা মৌমা যখন খেলেছি তখন কেউ এত সিরিয়াসলি নিত না টিটি’কে, মা বাবারা তো নয়ই। আমি তো খেলতে পেতাম শর্তসাপেক্ষে, অঙ্কগুলো টাইমলি শেষ করতে পারলে তবেই ক্লাবে যাওয়া, নয় তো না। আর আজ অনেক অভিভাবকই টিটি’কে তাঁদের বাচ্চাদের কেরিয়ার হিসেবে ভাবছেন”। বাস্তবিকই তাই। সৌম্যজিৎ ঘোষ মাত্র ১৫ বছর বয়স থেকেই সুইডেনের বিখ্যাত কোচ পিটার কার্লসেনের কাছে চলে গেছিলেন প্রশিক্ষণ নিতে। এখন ফোকাসটা অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এর পিছনের কারণগুলোও একেবারেই জোলো নয় বরং অনেক আকর্ষণীয়। মাঝারি স্তরেই ক্রিকেট বা ফুটবল খেলে প্রচুর টাকা বা চাকরি পাওয়া অনেকদিন থেকেই প্রচলিত। কিন্তু টিটি’কে কেরিয়ার করার নেহাত বাস্তবিক অসুবিধেগুলো এখন সহজেই অতিক্রম্য। ব্যাপারটা এমনিই দাঁড়িয়েছে যে কেবল ভালো চাকরি পাওয়ার হাতছানিতে অনেকে টেবল টেনিস খেলছে। আজ ভারতীয় টিটি’র সবচেয়ে বড় নিয়োগকারী পেট্রোলিয়াম কোম্পানিগুলি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্পনসরও বটে। দেশের প্রায় সব বিখ্যাত টেবল টেনিস খেলোয়াড় খেলেন পি.এস.পি.বি’এর (পেট্রোলিয়াম স্পোর্টস প্রোমোশন বোর্ড) হয়ে। এছাড়াও স্পোর্টস কোটায় রেল, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস, কাস্টমস, এয়ারপোর্ট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, এল.আই,সি’র মতো সরকারি ও আধা-সরকারি সংস্থাগুলি নিয়মিত ভাবে নিয়োগ করছেন। “তবে কেবলমাত্র একটা চাকরি-ই নয়.....এখন টেবল টেনিস খেলে যে সামাজিক সম্মান বা রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়া যায়, তা রীতিমতো ঈর্ষণীয়। টিটি খেলে অর্জুন পেয়েছেন অনেকেই, খেলরত্নের জন্যও বিবেচিত হচ্ছে বলে শুনতে পাচ্ছি.......এসব তো উঠতি খেলোয়াড়দের কাছে বিরাট অনুপ্রেরণা......আগেও হয়তো এগুলো ছিল, কিন্তু এখন আরো বেশি করে চোখে পড়ছে.....এতে নতুনেরা আর ওদের অভিভাবকরাও মোটিভেটেড হচ্ছেন”, বলছেন সৌরভ সেনগুপ্ত, যিনি নিজে টেবল টেনিসে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেছেন আর এখন সেই খেলার সুবাদেই ইন্ডিয়ান অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিভাগে কর্মরত। ‘খেলে কী হবে?’—বাঙালীর এই চিরন্তন প্রশ্নের জবাব টিটি’র টেবল থেকে আসতে শুরু হয়েছে। ঠিক এই জায়গাটাতেই প্রচণ্ড আশাবাদী পৌলমী ঘটক। “ওরিয়েন্টেশন চেঞ্জ হয়ে গিয়েছে.......প্রচণ্ডরকম পেশাদারিত্ব এসে গেছে আমাদের প্লেয়ারদের মধ্যে...... আজকের বাচ্চারা অনেকবেশি পরিণত অল্প বয়স থেকেই.....আমরা এত খবর রাখার সুযোগই পাইনি, আজ ইন্টারনেটের দৌলতে নিমেষে মা লঙ (বিশ্বের ১নং পুরুষ প্যাডলার) বা লিঙ্ ডিং-এর (বিশ্বের ১নং মহিলা প্যাডলার) খেলার ভিডিও ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে....এটা কি কম প্রাপ্তি? তা ছাড়াও টেবল টেনিসের লেটেস্ট ডেভেলপমেন্টের খবর, কোথায় কে কিরকম খেললো, কিভাবে জিতলো বা হারলো......কে কি স্টাইলে ফোরহ্যাণ্ড টপস্পিন বা ব্যাকহ্যাণ্ড ফ্লিক মারছে, আরো বেশি এফেক্টিভ ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ-এর ট্রেনিং ভিডিও চাইলেই হাতের মুঠোয় পেয়ে যাচ্ছে এরা....এটা খুবই উপকারে লাগছে। সুখের কথা হলো আজকের প্রজন্ম এগুলোকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে, নিজের উন্নতির জন্য ব্যবহার করছে....আর হাতেনাতে ফলও পাচ্ছে”। তাহলে শুধু কি প্রযুক্তির ব্যবহারেই উন্নতি? আর কিছু কি লাগে না? সম্প্রতি ভারতীয় টেবল টেনিস দলের ইটালিয়ান কোচ ম্যাসিমো কনস্ট্যানটিনি বলেছেন যে টেবিল টেনিসে আজকের দিনে আন্তর্জাতিক স্তরে সফল হতে গেলে তিনটি জিনিস প্রধান: স্কিল, চূড়ান্ত ফিজিক্যাল ফিটনেস আর মেন্টাল স্ট্রেংথ। ভারতীয়দের মধ্যে প্রথমটির অভাব না থাকলেও বাকি দুটির অভাব প্রকট। আর তার ফলেই আন্তর্জাতিক টেবিলে লড়াইটা কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু ঘাটতিটা কোথায় এবং কেন? ঠিক এখানেই অবশ্যম্ভাবী ভাবে চলে আসছে পরিকাঠামোর কথা, সরকারি উদ্যোগ বা সাহায্যের বিষয়টি এবং একইসঙ্গে বেসরকারি উদ্যোগের কথাও। ‘সরকারি সহযোগিতা নেই’-এর বহুল প্রচারিত অভিযোগ এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে সত্যের অপলাপ হবে। ভারত সরকারের ‘সাই’ এর প্রায় প্রত্যেক কেন্দ্রেই টেবল টেনিসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, পরিকাঠামোও নেই একথা বলা যাবে না। তবে সরকারি উদ্যোগের কথা উঠলে সর্বাগ্রে বলতেই হবে আজমেরে পিএসপিবি’র অ্যাকাডেমির কথা। পেট্রোলিয়াম বোর্ডের এই রেসিডেন্সিয়াল অ্যাকাডেমি বিগত বেশকিছু বছর ধরে ভারতের শ্রেষ্ঠ টিটি খেলোয়াড়দের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত। আধুনিক পরিকাঠামো, বিদেশী কোচ, বিজ্ঞানসম্মত ট্রেনিং সবকিছুর সমন্বয়ে এই মুহুর্তে সারাভারতের উঠতি প্রতিভাবান টেবল টেনিস খেলোয়াড়দের গন্তব্য আজমের। বর্তমানের প্রথমসারির প্রায় সব খেলোয়াড়ই হয় পিএসপিবি’র ফসল অথবা পিএসপিবি স্পনসর্ড। একদম সম্প্রতি কোল ইন্ডিয়ার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কলকাতা সাই’তে ‘কোল ইন্ডিয়া-সাই ন্যাশনাল টেবল টেনিস অ্যাকাডেমি’ তৈরী করার প্রক্রিয়া শুরু হলো। কোল ইন্ডিয়া আগামী তিন বছরে ৭ কোটি টাকার উপরে ব্যয় করবে এই অ্যাকাডেমির জন্য। আগস্ট ২০১৭ থেকেই প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ শুরু হবে। সর্বার্থেই একদম আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের একটি পরিকাঠামো যুক্ত অ্যাকাডেমিতে আগামীতে বিশ্বমানের খেলোয়াড় তৈরী করার উদ্দেশ্যেই এই প্রকল্পের সৃষ্টি বলে জানা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে এটা নিঃসন্দেহে সুখবর। তবে পৌলমীর মতে এটাই যথেষ্ট নয়। আজ প্রতিযোগিতা এতটাই কঠিন যে, আন্তর্জাতিক স্তরে ভালো ফল করতে গেলে বা বিশ্বের প্রথম পঞ্চাশে থাকতে গেলে বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়াটা একান্ত জরুরী। আর সেটার জন্য দরকার প্রচুর অর্থ। সৌম্যজিৎ ঘোষ আইটিটিএফ-এর আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছিলেন বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য। সেটাকে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরাই ভালো। এখানেই সরকারের দরাজ হস্তের প্রয়োজন বলে তিনি মনে করছেন। আর শুধু বিদেশ কেন? দেশেও এখন ভালোভাবে ট্রেনিং নিতে গেলে কোচের বেতন, ফিজিক্যাল আর মেন্টাল ফিটনেস বিশেষজ্ঞের খরচ, উন্নতমানের রাবার আর প্লাস্টিক বলের খরচ, বিভিন্ন জায়গায় খেলতে যাওয়ার খরচ সবমিলিয়ে বছরে বেশ কয়েক লাখের উপরে ধাক্কা। অতিসম্প্রতি সৌম্যদীপ রায় ও পৌলমী একটি অ্যাকাডেমি খুলেছেন কলকাতায়। সেইসূত্রেই তিনি জানাচ্ছেন যে, খরচটা অনেক মধ্যবিত্ত অভিভাবকের কাছেই হিমসিমকর। আর সেজন্যই তিনি চাইছেন যে কেবল সরকার নয়, প্রাইভেট স্পনসর বা কর্পোরেট স্পনসর এগিয়ে আসুক। রাজ্য সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। জি সথ্যেনের অলিম্পিক প্রস্তুতির জন্য তামিলনাড়ু সরকার চারবছরের জন্য তাঁকে এক কোটি টাকা আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন, হরমিত দেশাই-এর জন্যও আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন তাঁর রাজ্য গুজরাট। পৌলমী জানালেন, আমাদের রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রীও আশ্বাস দিয়েছেন যে, ২০১৭ যুব ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য যে অত্যাধুনিক পরিকাঠামোগুলি প্রস্তুত করা হচ্ছে তার কিছু পরিকাঠামো বিশ্বকাপের পর টেবিল টেনিসের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হবে। ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনাটা অবশ্যই বাড়াবাড়ি, কিন্তু একথা বলতেও অসুবিধা নেই যে ভারতীয় ক্রিকেটে বিসিসিআই-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আসলে শক্তিশালী একটি অ্যাসোসিয়েশন বা ক্রীড়াসংস্থা থাকাটা যেকোনো খেলা বিশেষ করে তুলনামূলক ছোট খেলাগুলোর জন্য অপরিহার্য। টেবল টেনিসের জাতীয় সংস্থা টিটিএফআই-এর বিশেষ চেষ্টা থাকলেও আরো কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করার দরকার এবং সুযোগ দুইই আছে। আমাদের রাজ্যে এখন টিটি’র তিনটি সংস্থা। এরফলে যে সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। সম্প্রতি রাজ্যসরকারও চাইছেন তিনটির বদলে একটিই মাত্র রাজ্যসংস্থা হোক, নিজেদের মধ্যের বিভেদ ও মনান্তর ভুলে সকলে মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজ্যের টিটি’র স্বার্থে কাজ করুন, রাজ্যসরকারও যথোচিত ও যথাসম্ভব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। পশ্চিমবঙ্গে কোনোদিনই প্রতিভার কোনও অভাব ছিল না এবং আজও নেই। তিনটি সংস্থা মিলে গিয়ে এক হয়ে কাজ করলে এ রাজ্যের টিটি যে দ্রুত অনেকটা এগিয়ে যাবে এ বিষয়ে প্রাক্তন খেলোয়াড়দের অনেকেই নিশ্চিত। অবশ্য উল্টোমতও পোষণ করছেন কেউ কেউ। বর্তমান পরিস্থিতিতে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের দুটি আলাদা আলাদা সংস্থা থেকে বেশি সংখ্যক খেলোয়াড় সুযোগ পাচ্ছেন জাতীয় প্রতিযোগিতাগুলিতে অংশগ্রহণ করার, কিন্তু সংস্থা একটি হয়ে গেলে সেই সংখ্যাটা কমে যাবে, বাংলার ছেলেমেয়েদের সুযোগ কমবে। তবে একটা বিষয়ে সকলেই একমত যে মানসিকতার পরিবর্তন আর যথাযথ পরিকাঠামোতে প্রশিক্ষণ-এই দু'য়ের সংযোগেই সাফল্য আসবে আর ইতিমধ্যেই আসা শুরু হয়ে গেছেও। আজকের বাবা-মায়েরা তাঁদের সন্তানদের ডাক্তার বা ইঞ্জিনীয়র বানানোর জন্য যা করেন, সফল টিটি খেলোয়াড় করার জন্যও অনেকেই সেটা করছেন এবং যথাযথভাবে করছেন খুব অল্প বয়স থেকেই। এই বাংলার বিভিন্ন টিটি কোচিং সেন্টারে গেলেই তা চোখে পড়বে। এই রকম প্রচেষ্টার প্রকৃষ্ট ফসলের উদাহরণ জাপানের বিস্ময় বালক তোমাকাজু হারিমোতো। এই মুহুর্তে হারিমোতো বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ নবীন প্রতিভা। মাত্র ১৩ বছরের এই অপরিসীম প্রতিভাবান বালকটি বিশ্ব ক্রমতালিকাতে এখন ১৮ এবং অচিরেই সে যে বিশ্বের একনম্বর হবে এনিয়ে সংশয়ের কোনও অবকাশ নেই। ইতিমধ্যেই তার শিকার অনেক বাঘা বাঘা খেলোয়াড়। দিল্লীর ইন্ডিয়ান ওপেনের সেমিফাইনালেও র্যাঙ্কিংএ অনেক এগিয়ে থাকা শরথ কমল বিস্মিত হয়ে দেখেছেন কিভাবে তাঁকে অবিশ্বাস্য ভাবে পরাজয় মেনে নিতে হলো হারিমোতোর কাছে। হারিমোতোর কোচ কে জানেন? অবাক হবেন না, ওর বাবা নিজেই।
জাপানের তোমাকাজু হারিমোতো। বিশ্ব টেবল টেনিসের বিস্ময় বালক। |
এই লেখা শুরু করেছিলাম দিল্লীর গল্প দিয়ে (যদিও তা গল্প নয়, সত্যি ঘটনাই)। এটা ঠিকই যে সেদিন গ্যালারিতে সাধারণ দর্শক ছিল অনেকটাই কম, তবে ছিল উঠতি খেলোয়াড়েরা, তাদের কোচ বা অভিভাবকের সঙ্গে। এটাই প্রভূত আশাব্যঞ্জক। যে উৎসাহ, উদ্দীপনা তাদের মধ্যে দেখেছি তা নিঃসন্দেহে সম্ভাবনাকে বহুমাত্রায় বাড়িয়ে তুলবে। এরসঙ্গে যোগ করবো সংগঠকের সক্রিয় ভূমিকাকে। পৌলমীরা যেটা চাইছেন প্রোমোশন আর প্রফেশনালিজম তার সবটা না হলেও অনেকটাই এসেছে ভারতীয় টেবল টেনিসে। একটা স্তর অবধি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা তো নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু এত বড়মাপের একটা আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতিযোগিতা সর্বার্থেই সফলভাবে আয়োজন করার পিছনে সিংহভাগে ছিলেন বিভিন্ন কর্পোরেট স্পনসরেরা। টেবল টেনিস সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো তো আগে থেকে ছিলই, ভারতে টিটি’তে এখন সবথেকে বড় বেসরকারি পৃষ্ঠপোষক ‘ইলেভেন স্পোর্টস’। টিটিএফআই-এর ওয়েবসাইটে যান, বাৎসরিক ক্যালেণ্ডার-এ ক্লিক করুন। দেখতে পাবেন সারা বছরের জাতীয় স্তরের ক্রীড়াসূচি আর সঙ্গে সঙ্গে আন্দাজ পেয়ে যাবেন বাকিটার। আমাদের দেশে টেবল টেনিসের প্রোমোশনের জন্য ২০১৫ সালে টিটিএফআই-এর সঙ্গে ১০ বছরের চুক্তি সই করেছেন এই সংস্থাটি। শোনা গেল ‘সেন্টার ফর এক্সেলেন্স অফ টেবল টেনিস’ তৈরী করতেও স্পোর্টস মিনিস্ট্রির সঙ্গেও কথা চলছে তাঁদের। ইন্ডিয়ান ওপেনের মূল স্পনসরও ছিল ‘ইলেভেন স্পোর্টস’। কারা এই ‘ইলেভেন স্পোর্টস’? জানতে ইচ্ছে করতেই পারে। আইএসএল-এর ‘চেন্নাইয়ান এফসি’র সহযোগী মালিক, ভিটা দানি ‘ইলেভেন স্পোর্টস’ এর চেয়ারম্যান। এটুকু তথ্য যথেষ্ট মনে না হলে আরো একটু জানাতে পারি। এশিয়ান পেন্টস-এর মালিকের গৃহকর্ত্রী জনান্তিকে শোনা গেল সম্পর্কে নীতা আম্বানির বোন। তাঁর সঙ্গে আছেন অন্যতম প্রধান মস্তিষ্ক, সংস্থার অধিকর্তা স্বয়ং কমলেশ মেটা। এই যুগলবন্দী ভারতীয় টিটি’র জন্য নতুন আশার আলো সঞ্চার করছেন; উৎসাহিত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম এটা জেনে যে ভালো খেললে আরো ভালো খেলার রসদের অভাব হবে না। তবে কেবল ‘ইলেভেন’ই নয়। টিটি’তে এখন ছোট ছোট স্পনসরও কিছু কম নয়। স্থানীয় স্তরের একটা উদাহরণ দিই। কয়েক বছর হলো বাংলাতে ডব্লুবিটিটিএ’র উদ্যোগে টেবল টেনিস লীগ শুরু হয়েছে-জুনিয়র আর সিনিয়র লীগ। অবশ্যই প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। দ্বিতীয় বছর থেকেই দেখা গেল প্রায় সবক’টি দলই রীতিমত বিভিন্ন ছোটবড় কোম্পানি থেকে স্পনসরশিপ পেয়েছে। তথাকথিত প্রচারের ধামাকা নেই, গ্ল্যামারের ঝলকানি নেই, তা সত্ত্বেও এ কম প্রাপ্তি নয়। তবে তুরুপের তাস কিন্তু পেশ করলেন আইটিটিএফ, সহযোগী সেই ‘ইলেভেন স্পোর্টস’। আইপিএল, আইএসএল, প্রো-কবাডি’র মতোই ২০১৭এর জুলাই থেকে শুরু হলো ‘ফার্স্ট এভার প্রফেশনাল ইন্ডিয়ান টেবল টেনিস লীগ’ যার পোশাকি নাম অবশ্য ‘আলটিমেট টেবল টেনিস’। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর আমির খান। তবে এখানে শহরভিত্তিক নয়, ক্লাবভিত্তিক ছ’টা দল, পুরুষ ও মহিলা মিলে দলপ্রতি আটজন করে খেলোয়াড়, যারমধ্যে চারজন বিদেশী আর চারজন দেশী। প্রথম লীগের বিদেশীদের প্রায় সকলেরই ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিং ৫০এর মধ্যে। সঙ্গে শ্রেষ্ঠ ভারতীয় প্যাডলারেরাই স্থান পেয়েছেন দলগুলোতে। চেন্নাই, দিল্লী আর মুম্বাই ভেনু। কলকাতা নেই, বোধহয় আন্তর্জাতিক মানের ইনডোর স্টেডিয়াম নেই বলেই। আর নেই কলকাতার বাংলা বা ইংরেজি খবরের কাগজ (তাতে অবশ্য লীগ বা খেলোয়াড় কারো কিছু এসে যায় বলে মনে হয় না)। বৈভব, জাঁকজমক, প্রচারের আলোর সাথে সাথে অনেক আশা আর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসছে এই প্রফেশনাল লীগ। বিশেষত নবীন খেলোয়াড়দের কাছে। এই লীগ সফল হলে ভারতীয় টেবল টেনিস একলাফে অনেকটা এগিয়ে যাবেই এনিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ২০১৭এর ফেব্রুয়ারি’র দিল্লী’র গ্যালারি আর জুলাইয়ের গ্যালারিতে যে অনেক পার্থক্য হবে তা এখনই বলে দেওয়া যাচ্ছে। স্টার টিভির পর্দা যদি সঠিক ছবি দেখায় তাহলে চেন্নাইয়ের ভরা গ্যালারি কিন্তু সে ইঙ্গিতই দিচ্ছে। পৌলমী প্রচণ্ড প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছিলেন যে, “আর মাত্র চার-পাঁচটা বছর দেখুন, ব্যাডমিন্টনের মতো টেবল টেনিসও আর ছোট খেলা থাকবে না আর সেই পরিবর্তিত বা উন্নীত স্ট্যাটাসের ভারতীয় টেবল টেনিসে আবার রাজত্ব করবে বাংলার ছেলেমেয়েরাই”। বড্ড বেশি আশা হয়ে যাচ্ছে কি? আজ্ঞে না। দামামা কিন্তু বাজা শুরু হয়েছে ২০১৭এর প্রারম্ভের ওয়ার্ল্ড ট্যুর দিয়ে, সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত প্রফেশনাল লীগ......আন্তর্জাতিক টেবল টেনিস সার্কিটে ভারতের গুরুত্ব ক্রমবর্ধমান। অন্তত: আইটিটিএফ-এর দৃষ্টিভঙ্গিতে সেই ছবিই ফুটে উঠছে। আর আপনার আমার জানার জন্য এবং পৌলমীকে সত্যি প্রমাণের জন্যই বোধহয় 'আলটিমেট টেবল টেনিস লীগ’-এর সূচনা সংস্করণের মোট ২৪ জন শ্রেষ্ঠ ভারতীয় প্যাডলারের মধ্যে ৯ জনই, হ্যাঁ মশাই, নিখাদ বঙ্গসন্তান। ছোট থেকে বড় হওয়ার বয়ঃসন্ধিতে, আশা আর সম্ভাবনার বাঁধনে আমরা না হয় বুক বাঁধি আরো একবার। ভারতীয় হিসেবে, বাঙালি হিসেবে তো বটেই।
বিশেষ ধন্যবাদ: পৌলমী ঘটক, সৌরভ সেনগুপ্ত।
তথ্যসূত্র:
http://www.ittf.com/rankings;
http://dr.ittf.com/ittf_ranking/ittf_team_ranking.html;
http://www.ittf.com/2017/06/12/franchises-announced-ultimate-table-tennis-league
Times of India;
Hindustan Times.
ছবি সৌজন্য: firstpost.com; getty images; butterflyonline.com
লেখক পরিচিতি: মফঃস্বলে কৈশোর কাটানোর পর এখন কলকাতায় থিতু। টেবল টেনিসের অনুরাগী ও বাধ্যতামূলক দর্শক। সরকারের কৃপাজীবী।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.