নারীত্বের সন্ধানে খেলার জগত
শমীতা দাশ দাশগুপ্ত
১৯৬০ এবং ১৯৬৪ সালের অলিম্পিক খেলায় দুই মহিলা খেলোয়াড়, তামারা ও ইরিনা নাতানোভনা প্রেস, সারা পৃথিবীতে আলোড়ন ফেলে দিলেন। সেই সময়ের অবিভক্ত সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের নাগরিক এই দুই বোন শট পাট ও ডিসকাস ছোঁড়া, হার্ডল দৌড়, এবং পেন্টাথেলন প্রতিযোগিতায় বেশ কিছু স্বর্ণ ও রৌপ্য পদক জিতে নিলেন, নতুন বিশ্ব রেকর্ড প্রতিষ্ঠা করলেন। বস্তুত, ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৬ সালের মধ্যে তামারা ও ইরিনা প্রেসের নামে ছাব্বিশটি বিশ্ব রেকর্ড আছে। বিভিন্ন খেলায় এই দু’বোনের দক্ষতা ও শারীরিক শক্তি অন্যান্য মহিলা খেলোয়াড়দের থেকে এতই ভিন্ন ছিল যে অনেকে বলতে আরম্ভ করল এঁরা আসলে পুরুষ, অথবা হিজড়া। সাংবাদিকেরা তাঁদের ব্যঙ্গাত্মক নামকরণ করল ‘প্রেস ভ্রাতৃদ্বয়’ (Press Brothers)।
মহিলা খেলোয়াড়দের লিঙ্গ নিয়ে মুখরোচক আলোচনা নতুন নয়, তবে খেলার মাঠে তামারা ও ইরিনা প্রেসের আবির্ভাবের পরে এই বিতর্ক জোরদার হয়ে উঠল। এর আগে, ১৯৩২ সালের অলিম্পিক প্রতিযোগী পোল্যান্ডের স্টানিস্লাভা ‘স্টাসিয়া’ ওয়ালাসিউইৎস ছেলে না মেয়ে তাই নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা হয়েছে। মহিলাদের ১০০ মিটার দৌড়ে স্টাসিয়া প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।
![]() অলিম্পিকের প্রতীক – পাঁচ মহাদেশ |
১০০ মিটার ছাড়াও আরও পাঁচটি বিভিন্ন পাল্লার দৌড় এবং লং জাম্প প্রতিযোগিতায় তিনি স্বর্ণপদক পান। খেলার মাঠে তাঁর দাপট দেখে তাঁর লিঙ্গ কী তাই নিয়ে সেই সময়ে প্রচুর কানাঘুষো আরম্ভ হয়েছিল। অলিম্পিক প্রতিযোগিতার শেষে ইয়োরোপ ছেড়ে স্টাসিয়া আমেরিকায় ফিরে গেলে সেই চর্চা কিছুটা স্তিমিত হল ঠিকই, কিন্তু একেবারে থামল না। অলিম্পিক গেমসে পোল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করলেও স্টাসিয়া ছিলেন আমেরিকার নাগরিক। তিন মাসের শিশু স্টাসিয়াকে নিয়ে তাঁর মা-বাবা পোল্যান্ড থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ড শহরে অভিবাস নিয়েছিলেন। আমেরিকায় অলিম্পিক দলের বাছাইয়ে বাদ পড়াতে স্টাসিয়া পোল্যান্ডের প্রতিনিধি হয়ে অলিম্পিক খেলায় যোগ দিয়েছিলেন। খেলার দুনিয়ায় তাঁর লিঙ্গ নিয়ে গুজবের প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ না করে, স্টেলা ওয়ালশ নাম নিয়ে স্টাসিয়া ক্লিভল্যান্ড শহরে বাকি জীবন কাটান। ১৯৮০ সালে সেখানেই তিনি খুন হন। শবব্যবচ্ছেদে স্টাসিয়ার শরীর নিয়ে চিকিৎসকেরা সংকটে পড়ল। দেখা গেল তাঁর শরীরে জরায়ু নেই; খুব ক্ষুদ্র কিন্তু অকেজো পুরুষ লিঙ্গ রয়েছে; এবং ক্রোমোজোমও পুরুষ ও নারীর থেকে পৃথক। অর্থাৎ শরীর এবং বংশানুর দিক থেকে স্টানিস্লাভাকে পুরোপুরি পুরুষ বা নারীবিচার করা যায় না। ক্লিভল্যান্ড শহরের প্রশাসন কিন্তু রায় দিল, স্টাসিয়া সারা জীবন নিজেকে নারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন; আবেগ ও আইনের চোখে তিনি নারী। অতএব এ নিয়ে আর কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না। মৃত্যুতে স্টাসিয়া সব গুজব শান্ত করে দিলেন।
১৯৩০ সালে শট পাট ও জ্যাভেলিন ছোঁড়ায় মেরি ইডিথ লুইজ ওয়েস্টনকে মহিলাদের মধ্যে ব্রিটেন-শ্রেষ্ঠ গণ্য করা হত। তিরিশের দশকেই তিনি হঠাৎ মার্ক ওয়েস্টন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে নিজের প্রিয় বান্ধবীকে বিয়ে করলেন। প্রশ্ন উঠল প্রতিযোগিতার সময় মেরি কি মেয়ে ছিলেন, না ছেলে? এ নিয়ে তর্ক চলেছিল বহুদিন।
শুধু এঁরা নন, আরও অনেক প্রথম শ্রেণীর মহিলা খেলোয়াড়ের লিঙ্গ কী তাই নিয়ে খেলার জগতে বহুবার গুঞ্জন উঠেছে। ১৯৬০য়ের দশকে অনেক মহিলা প্রতিযোগী অনুযোগ করলেন তাঁদের অন্যায় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে কারণ বহু মহিলা খেলোয়াড়ই আসলে পুরুষ। ফলে ১৯৬৬ সালে ঠিক করা হল মহিলা খেলোয়াড়দের যোনি পরীক্ষা করে অলিম্পিক ও বিশ্ব প্রতিযোগিতায় যোগদানের ছাড়পত্র দেওয়া হবে। কিন্তু দু’বছরের মধ্যেই প্রথাটি মহিলাদের প্রতি অসম্মানজনক বলে বর্জিত হল। তার বদলে ১৯৬৮ সালে অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ নিয়ম করল সব মহিলা খেলোয়াড়দের জিন (gene) বা বংশানু পরীক্ষা করে তাঁদের নারীত্ব সুনিশ্চিত করা হবে। মহিলা খেলোয়াড়দের জন্যে এই পরীক্ষা হবে বাধ্যতামূলক।
এই নিয়মের প্রথম বলি হলেন পোল্যান্ডের দৌড়বীর ইভা ক্লোবুকাওস্কা। ১৯৬৪ সালে স্বর্ণপদক জিতলেও ১৯৬৮ সালের অলিম্পিক খেলায় যোগ দেওয়ার অনুমতি তিনি পেলেন না। দেখা গেল তাঁর বংশানুর সঙ্গে পুরুষ বা মহিলা, কারোরই মিল নেই। কিন্তু বাইরে থেকে তাঁর শরীর মহিলাদের মত; সমাজ এবং আইন তাঁকে মহিলা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবুও, অলিম্পিক কর্মকর্তারা তাঁকে মহিলা বলে গ্রহণ করল না।
যতবারই কোন মহিলা খেলোয়াড়ের লিঙ্গ সম্পর্কে সন্দেহ জেগেছে, বা শারীরিক পরীক্ষায় অনিশ্চয়তা থেকেছে, দেখা গেছে সেই খেলোয়াড়ের তাতে কোন হাত নেই। কেউ স্বেচ্ছায় কর্তৃপক্ষকে ঠকাতে চেষ্টা করেনি। অবশ্য এ ব্যাপারে দু’একটি ব্যতিক্রম রয়েছে। ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক গেমসে জার্মানির ডোরা রাৎজেন হাই জাম্প প্রতিযোগিতায় চতুর্থ পদ পেলেন। দৈহিক পরীক্ষায় কর্মকর্তারা আবিষ্কার করলেন ডোরা আসলে নারী নন, একজন পুরোদস্তুর পুরুষ – নাম হেরমান। জার্মান সরকার অবশ্য তা স্বীকার করল না।
![]() ১৯৩৬ এর অলিম্পিকের প্রতীক |
পরে, ১৯৫৭ সালে এক স্বাক্ষাৎকারে ডোরা রাৎজেন বললেন খেলায় পদক লাভের লোভে নাৎসি সরকার তাঁকে নারী সেজে জীবন কাটাতে বাধ্য করেছিল। প্রতিযোগিতার তিন বছর আগে থেকে তিনি নারী হিসেবে পরিচিত হন। সেই সময়ে তাঁর জীবন ‘নরককুণ্ডে’ পরিণত হয়েছিল।
১৯৬৮ সালের পরে বাধ্যতামূলক জেনেটিক পরীক্ষার বিরুদ্ধে খেলোয়াড় মহলে এত জোর প্রতিবাদ উঠল যে ১৯৯৯ সালে তা বাতিল করা হল। স্থির হল, কোন খেলোয়াড় সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের যদি বিশেষ সন্দেহ জাগে, তাহলে শুধু তাকেই ব্যক্তিগতভাবে আলাদা করে পরীক্ষা করা হবে।
কিন্তু বহির্লিঙ্গ দেখে বা হরমোন পরীক্ষা করে কি নারী-পুরুষ নির্ণয় করা চলে? অবশ্যই না। তাহলে খেলার জগতের এই সমস্যার পূর্ণ সমাধান কী করে করা যায়? ২০১১ সালে অলিম্পিক প্রশাসন স্থির করল মহিলা খেলোয়াড়দের শরীরে নির্ধারিত মাত্রার কম টেস্টস্টেরোন (Testosterone) হরমোন থাকতে হবে, তবেই তাঁরা মহিলা বিভাগের প্রতিযোগিতায় যোগ দিতে পারবেন। সাধারণত পুরুষের শরীরে এই হরমোনের মাত্রা হয় এক লিটার রক্তে ৭ থেকে ৩০ ন্যানোমোলস, আর মহিলাদের শরীরে তিন ন্যানোমোলসের সামান্য কমবেশি। ফলে যে মহিলা খেলোয়াড়ের শরীরে বেশি টেস্টস্টেরোন রয়েছে, তিনি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। অথবা, স্ত্রী-হরমোন নিয়ে তাঁকে বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন থাকতে হবে। এই নিয়মের ফলে যে ব্যক্তিরা লিঙ্গ-পরিবর্তিত (Transgender), তাঁরাও মহিলা হিসেবে খেলায় যোগ দেবার সুযোগ পাবেন। ২০১২ থেকে এই পরীক্ষা বাধ্যতামূলক ভাবে চালু হল।
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ক্রীড়াজগতে কে পুরুষ কে নারী বিতর্কের সমাপ্তি হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকার (মোকগাড়ি) ক্যাস্টর সেমেনিয়া, ভারতের দ্যুতি চাঁদ, পিঙ্কি প্রামাণিক, শান্তি সৌন্দরাজন, ব্রাজিলের এদিনাঞ্চি ফার্নান্দেজ দা সিলভা, এবং আরও অনেক খেলোয়াড় দ্ব্যর্থব্যঞ্জক যোনি (ambiguous genitalia) অথবা অতিরিক্ত টেস্টস্টেরোন হরমোনের ধারক বলে চিহ্নিত হয়েছেন। এই প্রতিযোগীদের সম্পর্কে ক্রীড়াজগতের আধিকারিকেরা এখনও কোন সঙ্গত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি। এ ব্যাপারে দ্যুতি চাঁদের রুজু মামলার উত্তরে ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশনস’ (IAAF) টেস্টস্টেরোন হরমোনের মাত্রা কতটা হলে মহিলা গণ্য করা হবে, সেই নিয়ম ২০১৩ সালে বাতিল করেছে। কিন্তু তাতেও নারীর সঠিক সংজ্ঞা কী হওয়া উচিত তা নিয়ে বাদানুবাদের পরিসমাপ্তি ঘটেনি।
![]() নারী – পুরুষ ? – শুধুই মানুষ? |
কিন্তু এই ধন্দ কেন? সাধারণত সব শিশুই তো ছেলে বা মেয়ে হয়ে জন্মায়, তাই নয় কি? বৈজ্ঞানিকেরা অবশ্য বলেন এই ধারণা ভুল। তাঁদের মতে দু’টি নয়, অন্তত সাতটি লিঙ্গভাগ থাকা উচিত। ভারতে তিনটি লিঙ্গের আইনি স্বীকৃতি থাকলেও পশ্চিমে এবং পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে দুটি লিঙ্গই শেষ কথা। সন্তান জন্মালে প্রায় সব দেশেই ধাত্রী/ডাক্তারকে শিশু মেয়ে না ছেলে নির্ধারণ করতে হয়; যদি সন্দেহ থাকে, তাহলে যে কোন একটা লিঙ্গ বেছে নিতে মা-বাবাকে বাধ্য করা হয়। অর্থাৎ এই দুটি লিঙ্গ ছাড়া উপায়ন্তর নেই। যদিও মনে হয় নারী-পুরুষ, এই দুটি লিঙ্গই প্রকৃতির বাঁধাধরা নিয়ম, আসলে মানুষকে দ্বৈত বিভাগে ভাগ করতে প্রাকৃতিক বাস্তবকে অনেকাংশে উপেক্ষা করা হয়েছে। সমস্যার গভীরতা বোঝা যায় যখন লক্ষ্য করি পৃথিবীর কোন ভাষাতেই দু’টির বেশি লিঙ্গ ইতিবাচক ভাবে উল্লেখ করার সুযোগ নেই। কিন্তু নারী – পুরুষ, লিঙ্গ-পরিসরের এই দুই প্রান্তবর্তী বিন্দুর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের লিঙ্গ। এই ভিন্নতাকে একযোগে উভলিঙ্গতা (intersexed) বলা হয়। অন্তত ৪% শিশু উভলিঙ্গ হয়ে জন্মায়। দক্ষিণ আফ্রিকার বান্টু সমাজে উভলিঙ্গতার হার এর চেয়েও বেশি।
আমাদের সমাজে হিজড়া (hermaphrodite) আইন স্বীকৃত তৃতীয় লিঙ্গ। কিন্তু হিজড়া গোষ্ঠীর মধ্যে বহু ধরণের উভলিঙ্গ মানুষ রয়েছেন। তাঁদের সকলকে অভিন্ন ভেবে আমরা বিভ্রম সৃষ্টি করছি। উভলিঙ্গের মধ্যে ক্রোমোজোম এবং যোনি সংক্রান্ত পার্থক্য রয়েছে। ক্রোমোজোমের মধ্যেও বৈজ্ঞানিকেরা প্রায় সত্তর রকমের প্রভেদ আবিষ্কার করতে পেরেছেন। বহির্যোনির বিভিন্নতাও অনেক ধরণের হয়। হরমোন সংক্রান্ত তারতম্যও প্রচুর। ফলে প্রশ্ন থেকে যায় লিঙ্গ কী? নারী ও পুরুষের সংজ্ঞা কী?
এ ব্যাপারে ইংরেজিতে দুটি শব্দের ব্যাপক স্বীকৃতি রয়েছে – জেন্ডার ও সেক্স। জেন্ডার (gender) বলতে বোঝায় সমাজ-অনুমোদিত আচরণ যা প্রতি দেশের সংস্কৃতি নারী ও পুরুষ জনোচিত বলে মেনে নিয়েছে। বস্তুত জেন্ডার নির্ধারণ করে সমাজ আর সংস্কৃতি। আর লিঙ্গ (sex) বলতে বোঝায় জৈবিক বিশেষত্ব, যা নিয়ে শিশু জন্মায়। অর্থাৎ লিঙ্গ জন্মগত; আর শিশু বড় হতে হতে সমাজে পুরুষ বা নারী হবার যে শিক্ষা দেওয়া হয়, তা গড়ে তোলে জেন্ডার। এতদিন মেনে নেওয়া হত লিঙ্গ ও জেন্ডার মাত্র দু’ধরণের – পুরুষ ও নারী – এবং লিঙ্গ ও জেন্ডারের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি স্ত্রী-যোনি নিয়ে জন্মেছে তার আচরণ স্বাভাবিকভাবেই হবে নারীসুলভ আর পুরুষ-লিঙ্গ নিয়ে জন্মালে তার আচরণ হবে পুরুষালী। ব্যাপারটা স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু তাই কি? সমকামী ব্যক্তিরা সব সমাজেই চিরাচরিত চুলচেরা জেন্ডার বিভাগের বাইরে রয়ে যায়। লিঙ্গ পরিবর্তনকারী (Transgender) ব্যক্তিদের আত্মপরিচিতি ও লিঙ্গের মধ্যে সামঞ্জস্য থাকে না। আর শিশু যদি উভলিঙ্গ হয়, তাহলে?
এখন ভাবতে হয় উভলিঙ্গ কি নতুন কোন ব্যাপার, যা আগে কখনও দেখা যায়নি? নইলে সমাজে এর স্বীকৃতি নেই কেন? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখি বিভিন্ন সমাজে উভলিঙ্গ শিশু চিরকালই জন্মেছে আর নানান সমাজে উভলিঙ্গদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও নানান রকমের। কোন সমাজে তারা ‘জাদু জানে’ বলে বিশেষ সম্মান পায়, আর কোথাও তাদের বীভৎস ব্যতিক্রম ভেবে ঘৃণা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ নিউ গিনি, সাইবেরিয়া, এবং আমেরিকার আদিবাসী নাভাহো সমাজের উল্লেখ করা যেতে পারে। এই সব সমাজের বিশ্বাস ছিল উভলিঙ্গ ব্যক্তিরা অপরিমেয় আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী। আবার আফ্রিকার সেরের সম্প্রদায়ে উভলিঙ্গ শিশু জন্মালে তৎক্ষণাৎ তাকে মেরে ফেলা হত। ভারতে হিজড়া গোষ্ঠীর আইনি স্বীকৃতি থাকলেও তাদের সামাজিক অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক – মূল সমাজ থেকে তারা বহিষ্কৃত।
খেয়াল করলে বোঝা যায় ক্রীড়াজগতে লিঙ্গ সম্পর্কিত বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে নারী। পুরুষদের খেলায় লিঙ্গ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই তা নয়, কিন্তু সে ব্যাপারে কেউ খুব একটা বিচলিত নয়। আমেরিকার টেনিস খেলোয়াড় রিচার্ড র্যাসকিন্ড (পরে রেনে রিচার্ডস), ভলিবল খেলোয়াড় ক্লোয়ি অ্যান্ডারসন (আগের নাম জানাতে চান না), বক্সার ফ্যালন ফক্স (পরে একই নাম), ১৯৭৬ সালে অলিম্পিক ডেকাথেলন চ্যাম্পিয়ন (উইলিয়াম) ব্রুস জেনার (পরে কেটলিন মেরি জেনার), সামোয়ার সকার খেলোয়াড় জনি সেউলা (পরে জয়া সেউলা), ডেনমার্কের গলফ খেলোয়াড় মিয়ান ব্যাগার (পরে একই নাম), এঁরা সকলেই লিঙ্গ পরিবর্তিত – ছেলে থেকে মেয়ে হয়েছেন। প্রতিযোগিতার সময় এঁদের আচরণ বা শরীরে হরমোনের মাত্রা নিয়ে কারোর তেমন মাথাব্যথা হয়নি। তাঁরা পুরুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে অন্যায় অসুবিধেয় পড়ছেন কিনা সে নিয়ে কোন আলোচনা কোথাও হয়েছে বলে শুনিনি।
খেলার মহলে নারীত্বের সংজ্ঞা নিয়ে বাগবিতণ্ডা কিন্তু এখনও চলছে। কখনও পেশীবহুলতা, কখনও খেলায় বিশেষ দক্ষতা, কখনও শরীরে লোমের আধিক্যের ওপর ভিত্তি করে কিছু মহিলা খেলোয়াড়কে পুরুষ বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। অর্থাৎ নারীত্বের প্রচলিত সংজ্ঞার মধ্যে এঁরা পড়ছেন না। অথচ সন্দেহভাজনদের সকলেই নিজেদের মহিলা বলে চিহ্নিত করেন,পরিবারে মেয়ে হিসেবে বড় হয়েছেন, এবং সমাজে মহিলা হিসেবে স্বীকৃত। জেন্ডার পরিচিতির দিক থেকে তাঁরা অবশ্যই নারী। গোলমাল বাধছে এঁদের শরীর নিয়ে।
আন্তর্জাতিক খেলার আধিকারিকদের মতে উভলিঙ্গ প্রতিযোগীদের “মহিলা” বিভাগের খেলায় যোগ দেবার অনুমতি দিলে “সত্যিকারের” মহিলা খেলোয়াড়েরা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়বেন। উভলিঙ্গ ব্যক্তিরা তাঁদের “পুরুষোচিত” ক্ষমতার জোরে প্রতিযোগিতায় অতিরিক্ত সুবিধে পাবেন। সেই কারণেই এঁদের খেলা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে, এমনকি জেতার পরে পদক কেড়ে নেওয়াও হয়েছে। বহিষ্কারের এই যুক্তি খাটে যদি উভলিঙ্গ বা অধিক টেস্টস্টেরোন সম্বলিত মহিলারা ক্রমান্বয়ে প্রতিযোগিতায় জেতেন। একমাত্র তাহলেই বোঝা যাবে মহিলা বিভাগের খেলায় উভলিঙ্গ খেলোয়াড়েরা বাড়তি অ্যাডভান্টেজ পাচ্ছেন। বাস্তবে তার কিন্তু কোন প্রমাণ নেই। উভলিঙ্গ খেলোয়াড়রা আর পাঁচজনের মতই - কেউ ভাল, কেউ নয়। শরীরে টেস্টস্টেরনের আধিক্য প্রতিযোগিতায় কোন বিশেষ সুবিধে তাঁদের এনে দেয়নি। তাঁরা যে সব সময়ে শুধু জিততে পারেন না তা নয়, অনেক সময়ে খেলায় কোয়ালিফাইও করেন না। ইদানীং হরমোনের মাত্রা ইত্যাদি পরীক্ষা করা হচ্ছে শুধু জয়ীদের বেলায়। যে প্রতিযোগীরা প্রথম দশজনের মধ্যে নেই, তাঁদের এই অগ্নিপরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। তাছাড়া প্রথম দশজনকেও বাধ্যতামূলক ভাবে পরীক্ষা করা হয় না। পরীক্ষার আয়োজন করা হয় যখন কোন একজন বিচারক বা কর্মকর্তা প্রতিযোগীর শরীর দেখে “ঠিক মহিলা নয়” বলে সন্দেহ প্রকাশ করে। কিন্তু এখানেও ভ্রমের সম্ভাবনা রয়ে যায়। একজন বিচারকের যাকে পুরুষালী মনে হচ্ছে, অনেকের তাকে পুরুষালী নাও মনে হতে পারে।
খেলার জগতে এই নারী-পুরুষ সমস্যার চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন নারীবাদী সমালোচকেরা। তাঁদের মতে মেয়েদের শরীর কেমন হওয়া উচিত তা পুরুষশাসিত সমাজ স্থির করে রেখেছে। সেই সংজ্ঞার ব্যতিক্রম হলেই ধরে নেওয়া হয় উল্লিখিত ব্যক্তি নারী নয়, অতএব সে পুরুষ। পুরুষতান্ত্রিক সংজ্ঞা অনুসারে মেয়েদের দৈহিক গঠনে শক্ত পেশীর উপস্থিতি বাঞ্ছনীয় নয়। পেশী হল পৌরুষের প্রতীক। সেই কারণেই বহুদিন অবধি মেয়েদের খেলা বা ব্যায়াম করা নিষিদ্ধ ছিল। ব্যায়াম না করে মহিলাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি কিছু হয়নি। সেই সঙ্গে ধরে নেওয়া হত প্রতিযোগিতার মত সাংঘাতিক শারীরিক ও মানসিক পরিশ্রম মেয়েরা সহ্য করতে পারবে না। নারীবাদীদের মতে সংসার চালাতে বিভিন্ন শ্রেণীর মহিলাদের যে পরিমাণ খাটতে হয় ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বাঁচতে তাঁদের যে কঠিন মানসিক শ্রমস্বীকার করতে হয়, তার তুলনায় সামান্য খেলায় তাদের ক্ষতি হবে ভাবা হাস্যকর। আসলে মেয়েদের খেলতে না দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল অন্য - পুরুষের কল্পনানুযায়ী নারী-শরীর গঠন করা ও তা বজায় রাখা।
তবে পুরুষশাসিত সমাজের কল্পনার পরিসর এটুকুতেই আবদ্ধ নয়। খেলার মাঠে ছেলেদের পোশাকের সঙ্গে মেয়েদের জামাকাপড়ের তুলনা করলে ব্যাপারটা বেশ বোঝা যায়। আসলে মহিলাদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা পুরুষ দর্শকদের কিছুটা যৌন উত্তেজনা যোগায়। বীচ ভলিবল, টেনিস, তথা অন্য বহু প্রতিযোগিতায় মহিলাদের পোশাক দেখলে এই যুক্তি অস্বীকার করা যায় না। বহু নারী প্রতিযোগীর অনুরোধ সত্ত্বেও টেনিস কর্তৃপক্ষ মেয়েদের শর্টস পরে খেলার অনুমতি এখনও দেয়নি। এখনও মহিলা খেলোয়াড়দের সেজেগুজে ক্রীড়াঙ্গনে নামতে হয়। এমন পুরুষপ্রধান পরিবেশে ব্যতিক্রমী নারী-শরীর পেশীবহুল অথবা ঘোর কৃষ্ণবর্ণ - পুরুষ দর্শকের মনোরঞ্জন করতে পারবে বলে আশা করা যায় না। বরং তা “নারীসুলভ” নয় বলে খারিজ করা হয়। টেনিস তারকা সিরিনা উইলিয়ামস বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। পেশীবহুল এবং কৃষ্ণবর্ণ শরীরের জন্যে প্রথম দিকে তাঁকে প্রচণ্ড অন্তরায়ের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। খেলার স্পনসার জুটছিল না এবং টেনিস কর্তৃপক্ষের ধারণা ছিল তাঁর খেলা দেখতে দর্শক টিকিট কিনবে না।
উভলিঙ্গ খেলোয়াড়দের অস্তিত্ব আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানুষকে পরিচ্ছন্নভাবে পুরুষ-নারী, এই দুই বিভাগে ভাগ করা যায় না - সে খেলার জগতেই হোক বা জীবনের অন্যান্য আঙিনায়ই হোক। নিজেদের অজ্ঞতা এবং মনোবৃত্তির জন্যে উভয়লিঙ্গ খেলোয়াড়দের প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে রেখে নিঃসন্দেহে তাদের প্রতি আমরা গভীর অন্যায় ও অবিচার করছি। নারীত্বের সংজ্ঞা নিয়ে এই সমস্যা তাঁদের নয়, খেলায় বৈষম্য সৃষ্টিকারী কর্তাদের। সমস্যার সঠিক সমাধানের কেন্দ্রে রয়েছে নারীত্বের সংজ্ঞা পরিবর্তন। প্রশ্ন থেকে যায় নারীকে আমাদের সমাজ, ক্রীড়া কর্তৃপক্ষ, কী ভাবে বিচার করবে – তার দেহ দিয়ে, না আত্মপরিচয় দিয়ে ?
লেখক পরিচিতি: লেখক একজন শিক্ষক, গবেষক ও সমাজকর্মী। তিন দশকের অধিককাল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশিয় সমাজে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা ও তাঁদের ক্ষমতায়নের প্রচেষ্টায় নিযুক্ত। উত্তর আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশীয়় পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী সংস্থা মানবী-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অবসর-এর জন্মলগ্ন থেকে উপদেষ্টা মণ্ডলীতে যুক্ত।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.