অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


খেলা‘ঘর’ বাঁধতে লেগেছি

অবসর বিশেষ সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১, ২০১৭

 

শরীর, বিজ্ঞান, মন - খেলে তিনজন

ড. সৌমেন্দ্র সাহা

পার্ক স্ট্রিট ষ্টেশন ছাড়তে যাওয়া মেট্রোয় উঠতে ঊসেইন বোল্ট স্টাইলে স্প্রিন্ট টেনে ঋদ্ধিমান-ডাইভ দিয়ে কামরায় ঢুকেই, পড়বি তো পড় এক্কেবারে কল্যাণদার সামনে। আপনারা কল্যাণদাকে চেনেন না, তাই। কল্যাণদা অর্থাৎ কল্যাণময় গাঙ্গুলি, যাঁকে ওঁর পাড়ায় আড়ালে-আবডালে প্রফেসর জি কে অর্থাৎ জেনারাল নলেজের অবিসংবাদিত এনসাইক্লোপেডিয়া ভাবা হয়। উনি রাশিয়া ও আলাস্কার মাঝে ঠিক কোন জায়গায় ভূমিকম্প হয়েছে এবং কেন তা হয়েছে; মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের হারিয়ে যাওয়া বিমান ঠিক কোন জায়গায় পাওয়া যেতে পারতো, অথবা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ইকনমিক পলিসিতে ঠিক কোন জায়গায় ভুল আছে, কিম্বা জাস্টিন বিবারের কোন ধরণের গানে নজর দেওয়া উচিৎ.....ইত্যাদি ইত্যাদি সম্পর্কে নাতিদীর্ঘ, অর্থাৎ আরামসে ঘন্টা চারেক দাঁড়িয়ে এবং দাঁড় করিয়ে সুচিন্তিত মতামত দিয়ে থাকেন। আপনাদের প্রয়োজন থাকলে জানাবেন।

যাই হোক, এ হেন কল্যাণদার মুখোমুখি হয়ে ...আত্মারাম প্রায় খাঁচাছাড়া অবস্হায়, নির্ভীক ভাব সাজিয়ে আমার এই মাঝবয়েসী ছেলেমানুষীর একটা জুৎসই অজুহাত প্রায় পেশ করতে যাচ্ছি, অমনি বাঁজখাই গলায় অভিভাবকসুলভ হুঙ্কার…”তোমার কি এই বয়সে এইসব করা উচিৎ!” আমিও বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী। কল্যাণদাকে এক থিয়োরেটিক্যাল আউটসাইড ডজ দিয়ে ধাঁ করে বললাম, “ক্রীড়াবিজ্ঞানের মতে ঠিক করেছি”। অ্যায়সা একখানা ডজ খেয়ে কল্যাণদা কি ক্লীন বোল্ড? না। খানিক খাবি খেয়েই ঝপ করে বমালসমেত দাগী চোর ধরার ষ্টাইলে আমায় জাপ্টে ধরে বল্লেন “পেয়ে গেছি”!!! যাচ্চলে। কি পেলেন? “মিতালি ওভাবে আউট হলো কেন? আচ্ছা বলো তো ক্রিকেটের সাথে গলায় আটকানোর কি সম্পর্ক?” বুঝলাম এই জায়গায় কল্যাণদা এক্কেবারে কাঁচা। আমার সিক্সথ সেন্স বললো বাঁচার সম্ভাবনা উজ্জ্বল! আর ছাড়ি? বললাম, ওটা অন্য ধরণের চোকিং। কল্যাণদা ছাড়ার পাত্র নন। বললাম, শ্যামবাজারে নেমে বলছি। কল্যাণদা যাবেন দমদম, বেমালুম রাজি হয়ে গেলেন!

অতঃপর শ্যামবাজারের গোলবাড়ির চত্বরে দাঁড়িয়ে, ক্রীড়াবিজ্ঞান চর্চা। ওনার প্রথম প্রশ্নের জবাব দেওয়া নিয়ে শুরু করলাম। মিতালি আউট হওয়ার জন্য অনেক বিশেষজ্ঞই চোকিং কে দায়ী করলেও, উনি নিজে ওনার স্পাইক আটকে যাওয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন। যদি তা-ই হয়েও থাকে, তবুও ওনার রানিং দেখেই বোঝা যায়, যে ওনার দু-পায়ের মাংসপেশী ডাবল পূল অর্থাৎ ঊরুর দু'পাশের পেশী একইসাথে সঙ্কুচিত হয়ে গিয়েছিল। আমাদের পেশী সাধারণতঃ শুধুমাত্র সঙ্কুচিত হয়। একদিকের পেশী সঙ্কুচিত হলে, তার অপর দিকের পেশী প্রসারিত হলে অঙ্গ-সঞ্চালন সম্ভব হয়। কোনো আকস্মিক পরিস্হিতিতে আচম্বিতে দু'দিকের পেশী একইসাথে সঙ্কুচিত হয়ে পড়লে, তাকেই ডাবল পূল বলা যায়, এবং সেই অবস্হায় শরীর প্রায় “ন যযৌ ন তস্থৌ” হয়ে ওঠে। সেই ডাবল পূল অবস্হাকেই ক্রীড়াজগতের পরিভাষায় চোকিং বলে। মিতালির নিজের কথায়, “আমরা শেষ পর্যন্ত ফাইনালের চাপটা নিতে পারিনি।”

এতক্ষণে কল্যাণদা বলে উঠলেন, বড়ো জটিল বিষয়, একটু ছবি এঁকে বোঝাও তো। বোঝো ঠেলা! অগত্যা তাই করলাম। এতে আপনাদেরও হয়তো কিছুটা সুবিধা হতে পারে।

সঠিক ভাবে দৌড়োনোর জন্য

সঠিক ভাবে দৌড়োনোর জন্য আমাদের পায়ের অ্যাগণিস্ট এবং অ্যান্টাগণিস্ট পেশীর সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন। যে কোনো শারীরিক কাজের ক্ষেত্রেই পেশীর সঙ্কোচন ও প্রসারণ প্রয়োজন, এবং একই পেশী অ্যাগণিস্ট (সঙ্কোচনের সময়) এবং অ্যান্টাগণিস্ট (প্রসারণের সময়) দুই ভূমিকাই পালন করে। সঠিক ভাবে দৌড়োনোর জন্য অ্যাগণিস্ট এবং অ্যান্টাগণিস্ট পেশীর ভূমিকা কিরকম হয় তা উপরের ছবিতে বোঝা যাবে।

কল্যাণদা আংশিক বুঝলেন, তবে তাতে তাঁর জ্ঞানের ক্ষুধা মিটলো না। বললাম পুরো বিষয়টা বুঝতে চাইলে আরো সময় প্রয়োজন, এবং ক্রীড়া বিজ্ঞান বিষয়টা জানতে হবে। যথা, ক্রীড়া বিজ্ঞান বা স্পোর্টস সাইন্স বিষয়টা কি এবং তার মধ্যে কি কি বিষয় অন্তর্গত, সে সম্পর্কে কিছুটা স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন।

ক্রীড়াবিজ্ঞান

খেলোয়াড়দের দক্ষতার মূল্যায়নের প্রয়োজনে ক্রমে ক্রমে ক্রীড়া বিজ্ঞানের মধ্যে অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সেগুলো হল, ১) শারীর নৃবিদ্যা বা (কিনঅ্যাথ্রপোমেট্রি), ২) ক্রীড়া বায়োমেকানিকস্, ৩) ক্রীড়া শারীরতত্ত্ববিদ্যা, ৪) ক্রীড়া মনোবিজ্ঞান, ৫) ক্রীড়া পুষ্টিতত্ত্ববিদ্যা, ৬) পেশীতন্তুর সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা, ৭) স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট, ৮) স্পোর্টস মেডিসিন ও ৯) স্পোর্টস ফিজিওথেরাপি।

এই বিষয়গুলোর প্রতিটি নিয়ে আলোচনা করা এই পরিসরে এই মুহুর্তে আলোচনা করা একেবারেই সম্ভব নয়। তবে সবচেয়ে আগে শরীরের আয়তন, কাঠামো ও পরিমাপ সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। শরীরের আয়তন ও পরিমাপ এবং খেলাধূলায় তার ফলাফল নিয়ে আলোচনায় আশা যাক। যেই না বলা, অমনি কল্যাণদা বলে উঠলেন আমাদের দেশের খেলোয়াড়দের যা চেহারা? কি খেলবে? আরো বল্লেন, তাও তো এখন কিছু জিমন্যাসিয়াম হয়েছে, আর তাতে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে রোজ যায়। ওদের মতো বড়ো চেহারা হবে, তবে না! বেশ বিজ্ঞের মতো বলে আমার দিকে তাকালেন। বললাম, এই জন্যেই আপনাদের ক্রীড়া বিজ্ঞান বিষয়টা জানা দরকার।

কিনঅ্যানথ্রোপোমেট্রি বা শারীর নৃবিদ্যা

কিনঅ্যানথ্রোপোমেট্রি

কিনঅ্যানথ্রোপোমেট্রি, অর্থাৎ শারীর নৃ-বিদ্যা খেলোয়াড় এবং সাধারণ মানুষের শরীরের তিনটি পরস্পরের থেকে পৃথক ও চরম পরিমাপের প্রস্তাব করে (হিথ ও কার্টার, ১৯৬৭), যা শরীরের সর্বোত্তম সোম্যাটোটাইপ বা শ্রেণী-বিন্যাস পদ্ধতি হিসাবে পরিচিত। হিথ-কার্টার অ্যান্টোফোমেট্রিক সোম্যাটোটাইপ পরিমাপ শরীরের দৈর্ঘ্য, শরীরের ভর বা ওজন, ত্বকের নীচের চর্বির পরিমাণ, হাড়ের পরিমাপ এবং শরীরের অঙ্গের পরিধির উপরে নির্ভর করে পরিমাপ করা হয়।

১। এন্ডোমর্ফি অর্থাৎ, চর্বিসম্পন্ন গোলাকার শরীর, শরীরের ত্বক-নিম্নস্থ চর্বির ভাগের শতকরা হিসাবের সাথে উচ্চতা সম্পর্কিত আনুপাতিক হিসাবের দ্বারা পরিমাপ করা হয়।
২। মেশোমর্ফির অর্থ হলো সুঠাম পেশীসম্পন্ন দেহ-সৌষ্ঠব। বড়ো বড়ো হাড়ের গঠন সম্পন্ন, এঁদের শরীরের কাঠামো বড়ো মাপের হয়।
৩। এক্টোমর্ফি অর্থাৎ হল পাতলা, সংকীর্ণ কাঁধ, ছোট হাড়-সম্পন্ন অপেক্ষাকৃত শীর্ণ চেহারার শারীরিক পরিমাপ।

এই পর্য্যন্ত শুনে কল্যাণদা বলতে যাচ্ছিলেন, অর্থাৎ ভালো খেলোয়াড় মেশোমর্ফ হবে। না, ঠিক তা নয়। বিভিন্ন খেলা অনুযায়ী ভালো খেলোয়াড়দের গঠন, এন্ডো-এক্টো-মেশোমর্ফ বা এন্ডো-মেশো-এক্টোমর্ফ, এমনকি এক্টো-মেশো-এন্ডোমর্ফও হতে পারে।

এবার কথা হলো, শরীরের আকার-আয়তন বা ভরের সাথে খেলায় সাফল্যের সম্পর্ক কতটা? ধরে নেওয়া যাক, দূরপাল্লার দৌড়ে সাফল্যের কথা ভাবা হচ্ছে।

মানব শরীরের আয়তন অনুযায়ী খেলাধূলায় দক্ষতা

দূরপাল্লার দৌড়ে সাফল্য শরীরের ভর সম্পর্কিত ভিও-২ ম্যাক্স বা সর্বোচ্চ অক্সিজেন ব্যবহারের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। শরীরের আয়তন বৃদ্ধির সাথে সর্বোচ্চ অক্সিজেন ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা আয়তন বৃদ্ধির বর্গফল অনুযায়ী বেড়ে যায়। অথচ সর্বোচ্চ অক্সিজেন ব্যবহারের ক্ষমতা সেই হারে বাড়ে না।

বড়ো আয়তনের শরীর নিয়ে অল্প অক্সিজেন ব্যবহারে বেশী ক্রিয়াশীল থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই বড়ো আয়তনের শরীর নিয়ে দূরপাল্লার দৌড়ে সাফল্য অসম্ভব হয়ে যায়। তুলনায় ছোটোখাটো শরীর দূরপাল্লার দৌড়ের জন্য ভালো। ধরে নিন স্কুটারের ইঞ্জিন নিয়ে ট্রাক চালানোর অসুবিধার কথা বলা হচ্ছে।

শুধু তাই নয়, বড়ো আয়তনের শরীর হওয়াটা পূল আপ বা চিন আপ করার জন্যেও অসুবিধাজনক। ছোট চেহারার খেলোয়াড়েরা বড়ো চেহারার খেলোয়াড়দের তুলনায় আরও অনেক ভালো পূল আপ করতে পারেন।

স্পোর্টস মেডিসিন এবং স্পোর্টস্ ফিজিওথেরাপী

সমস্ত খেলাধূলার মধ্যে বাস্কেটবল ও ভলিবলের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃতভাবে গোড়ালিতে আঘাতের সম্ভাবনা অধিক রয়েছে। সম্ভাব্য গোড়ালির আঘাত কমানোর জন্য বেশ কয়েকটি ব্যালেন্স বা ভারসাম্য-ক্ষমতা বর্ধনকারী ব্যায়াম রয়েছে এবং এছাড়া অন্যান্য স্নায়বিক-ক্ষমতা বর্ধনকারী ব্যায়ামের প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা রয়েছে। এইসব ব্যায়াম সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্নায়বিক শক্তিবৃদ্ধি হয়, যা গোড়ালিতে অসম্ভব চাপবৃদ্ধি প্রতিরোধ করে। একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, পুরুষ অ্যাথলেটদের তুলনায় মহিলা খেলোয়াড়দের গোড়ালির আঘাত প্রাপ্তির ঝুঁকি অনেক বেশী।

স্টার ব্যালেন্স (১) পরীক্ষা

ওয়াই ব্যালেন্স (২) পরীক্ষা

বোসুবল (৩)

ওবল বোর্ড (৪) পরীক্ষা

স্পোর্টস্ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ এবং স্পোর্টস্ ফিজিওথেরাপিষ্টেরা, স্টার-ব্যালেন্স (১) এবং ওয়াই-ব্যালেন্স (২) পরীক্ষার মাধ্যমে গোড়ালির স্থায়িত্ব, স্হিতিস্হাপকতা এবং শক্তির পরীক্ষা করেন। বোসুবল (৩) এবং ওবল বোর্ড (৪) ব্যবহার করে চিকিৎসক, বিশেষতঃ স্পোর্টস্ ফিজিওথেরাপিষ্টেরা গোড়ালির স্থায়িত্ব, স্হিতিস্হাপকতা এবং শক্তিও বৃদ্ধি করার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

ক্রীড়া শারীরতত্ত্ববিদ্যা বা স্পোর্টস এবং এক্সারসাইজ ফিজিওলজি

অনেকেরই ধারণা খেলাধূলায় সাফল্যের জন্য সবসময়ই নিজেকে নিঙড়ে দিতে হবে। তা একদমই ঠিক না। যথাযথ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। খুব ধীরে-ধীরে আক্ষরিক অর্থেই ওভারলোড ট্রেনিং দেওয়া হয়। এই ওভারলোড খুব সতর্ক হয়ে দেওয়া প্রয়োজন, নচেৎ অতিরিক্ত ট্রেনিং লোড একজন খেলোয়াড়ের অনেক ক্ষতি করতে পারে। নীচে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের দুষ্টচক্র সম্পর্কে বলা হয়েছে। আর তার নীচে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের কু-প্রভাব কাটানোর জন্য যে ধরণের থেরাপী বা চিকিৎসা আছে, তার নমুনা রাখা হলো।

অতিরিক্ত প্রশিক্ষণের দুষ্টচক্র

ক্রীড়া-শারীরতত্ত্ববিদ্যা

তার মানে আমাদের দেশের কোচ বা প্রশিক্ষকেরা এইসব কিস্যু জানে না? কল্যাণদার প্রশ্নে বললাম, আমাকে অযথা কোনো বিতর্কে জড়াবেন না। অনেকেই রীতিমতো ভালভাবেই প্রশিক্ষিত, এবং তাই অনেক খেলাতেই ভারতীয় খেলোয়াড়েরা চূড়ান্ত সাফল্য লাভ করছে। কথা ঘোরানোর জন্যে অন্য প্রসঙ্গের বিষয় নিয়ে আলোচনায় এলাম। খেলোয়াড়দের সঠিক অঙ্গ-সঞ্চালনের এবং সঠিক বল বা ফোর্স প্রয়োগের জন্য, তাঁদের বায়োমেক্যানিক্যাল সক্ষমতা সম্বন্ধে জানা জরুরী। এখানে বল ছোঁড়ার মতো সাধারণ কাজ এবং শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে ফুটবল কিক করার মতো কাজে বায়োমেকানিক্সের ভূমিকার আলোচনা করা হলো।

বল ছোঁড়ার বায়োমেকানিক্স

বল ছোঁড়ার বায়োমেকানিক্স

বিরাট কোহলি (ও ধোনি)

ক্রীড়া মনোবিজ্ঞান

এইবারে আসি ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানের বিষয় নিয়ে আলোচনায়। কল্যাণদা বেশ উৎসাহিত। কথা কিন্তু শুরুই হয়েছিল চোকিং নিয়ে, যা মানসিক চাপের এক চূড়ান্ত অবস্হার কথা বলে। খেলোয়াড়েরা এই চাপের কারণ হিসাবে সাধারণতঃ প্রতিযোগিতায় ব্যর্থতার সম্ভাবনার কথাই বলেন। কল্যাণদা সায় দিয়ে বললেন, “তাই তো, তা ছাড়া আর কি?”

তা কিন্তু নয়। ব্যর্থতার সম্ভাবনা বা সেই সংক্রান্ত ভয় বা দুশ্চিন্তা কাটিয়ে ওঠার জন্য অনেক ধরণের আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক মনোঃচিকিৎসা আছে, এবং এই বিষয়ে শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানীরাই একজন খেলোয়াড়কে সহায়তা করতে পারেন। কল্যাণদার প্রশ্ন, “ঠিক কি কি ধরণের সমস্যা হতে পারে, আর সেগুলোর সমাধানই বা কি কি ভাবে হতে পারে?” খুব অল্প পরিসরে যা বলা যেতে পারে, তা হলো, মনোযোগের নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সমস্যা, অথবা খেলার ফলাফল সংক্রান্ত অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপণ। অর্থাৎ খেলার সময়, খেলা-সংক্রান্ত বিষয়ে মন না দিয়ে, খেলার ফলাফল কি হবে তাই নিয়ে চিন্তামগ্ন থাকতে গিয়ে খেলায় মনোযোগ হারানো। এছাড়া, দৈনন্দিন প্র্যাকটিসের লক্ষ্য স্হির করা, নিজের খেলোয়াড় হিসাবে সাফল্য অর্জনের জন্যে লক্ষ্য স্হির করা ইত্যাদি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর পাশাপাশি, আবেগ ও উত্তেজনার নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি আত্মনিয়ন্ত্রণেরও অসীম প্রয়োজনীয়তা আছে। ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানীরা একজন খেলোয়াড়কে এইরকম ধরণের বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করতে পারেন। কতকগুলো আধুনিক পদ্ধতি যেমন বায়োফিডব্যাক পদ্ধতি, পরিমিত কল্পনা ও অন্তর্দর্শনের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কিছু চিকিৎসা পদ্ধতির উল্লেখ করা যেতে পারে। কিন্তু এইসব সাধারণ সমস্যার থেকে ‘অ্যাচিমেভোফোবিয়া’ অথবা “সফলতার বা সাফল্যের ভয়” কিন্তু আলাদা বিষয়। আসুন এই প্রসঙ্গে একটু আলোকপাত করা যাক।

ক্রীড়া-মনোবিজ্ঞান

অ্যাচিমেভোফোবিয়া বা সফলতার ভয়

যাঁরা আতঙ্কের সম্মুখীন হয়েছেন তাঁরা কখনো অদ্ভূতভাবে সফলতার বা সাফল্যের উত্তেজনার সাথে আতঙ্কের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্হিতি একইরকম শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন হিসাবে অনুভব করতে পারেন। তাঁরা উত্তেজনাবর্দ্ধক পরিস্থিতির সম্মুখীন না হওয়ার জন্য, নিরবচ্ছিন্ন উত্তেজনাবিহীন অবস্হায় থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন এবং উত্তেজক পরিস্থিতি এড়িয়ে চলেন। এর ফলে ক্রমান্বয়ে এঁরা নিরবচ্ছিন্ন উত্তেজনাবিহীন অবস্হায় থাকতে থাকতে এঁদের নিজেদের সাফল্য সম্পর্কে প্রায় ফোবিক বা অমূলকভাবে ভীত হয়ে উঠতে পারেন। সাফল্যের ভয় যদিও ফোবিয়া বা অমূলক ভয়। অনেক অদ্ভুত মনে হতে পারে; কিন্তু এটি আসলে একটি খুব বাস্তব সামাজিক ফোবিয়া। আমাদের মধ্যে অনেকেই এমন আছেন যাঁরা বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত হয়েছেন যে সাফল্যের রাস্তাটি ঝুঁকিপূর্ণ, তাই তা এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। এঁদের মনে কতকগুলো ভ্রান্ত ধারণা ঢুকে যায়, যেমন "বেশী প্রত্যাশা করা ভালো নয়, অল্পেই সবসময় সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ"। এই ধরণের বিশ্বাস একবার প্রোথিত হয়ে গেলে, তা হতাশার সৃষ্টি করতে পারে। এই হতাশার মধ্যে অভ্যস্ত হয়ে এঁরা বরং বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে এঁদের দ্বারা এর বেশী কিছু হতোই না, এবং বেশী লোভ করা কখনোই উচিৎ নয়। এই ভয় খেলোয়াড়দের স্বপ্ন দেখার এবং তাঁর লক্ষ্য অর্জনে বাধা দেয়। এই বিশ্বাস প্রকৃত অর্থে আমাদের মধ্যমান অর্জনকারী করে রাখে, এবং কখনোই নিজেদের সম্পূর্ণ ক্ষমতার ধারে-কাছে সাফল্যের মান পৌঁছোতে দেয় না। এই অবস্হা কাটিয়ে উঠতে কিন্তু ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানী বা মনস্তত্ত্ববিদদের থেকে ধারাবাহিকভাবে পূঙ্থানুপূঙ্খ বিশ্লেষণাত্মক সহায়তার প্রয়োজন। আবার বলছি, ক্রীড়া মনোবিজ্ঞানী বা মনস্তত্ত্ববিদ, যে কোনো মনোবিদ বা মনোবিজ্ঞানী নন।

সবসময় মনে রাখা প্রয়োজন, খেলায় জয় এবং পরাজয়, দুটোই হতেই পারে। দুই অবস্হাতেই স্বাভাবিক থাকতে পারা একান্তই প্রয়োজন। জয় এবং পরাজয় দুটোকেই একই ভঙ্গিতে দেখতে শেখার প্রয়োজন।

কিছু আধুনিক মূল্যায়ণ পদ্ধতি –

এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে, অনেক বিষয়ে আরো উন্নতমানের এবং আরো পূঙ্থানুপূঙ্খ বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে। ব্রেন-ম্যাপিং, নিউরো-ইমেজিং, পেট-স্ক্যানিং ইত্যাদি পদ্ধতির মাধ্যমে মানব-মস্তিষ্কের অনেক অজানা তথ্য পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। নীচে ফাংশানাল এম-আর-আইয়ের মাধ্যমে কগনিটিভ নিউরোসাইন্সের বিশ্লেষণের নমূনা দেওয়া হলো।

কগনিটিভ নিউরোসাইন্স

কগনিটিভ নিউরোসাইন্স

কগনিটিভ নিউরোসাইন্সের বিশ্লেষণ হয়তো অপেক্ষাকৃতভাবে খরচ-সাপেক্ষ। কিন্তু ব্রেন-ম্যাপিং, নিউরো-ইমেজিং, পেট-স্ক্যানিং ইত্যাদি না করেও আরো সহজ-লভ্য পদ্ধতির মাধ্যমে খেলোয়াড়দের আবেগ সংক্রান্ত অনেক তথ্য সম্পৃক্তভাবে পাওয়া সম্ভব। পরবর্তী অংশে এই পদ্ধতি সম্বন্ধে কিছু তথ্য দেওয়া হলো।

স্কিন কনডাক্টেন্স পদ্ধতি

১। একজন খেলোয়াড় প্রতিযোগিতামূলক জটিল বা কঠিন সংকটের পরিস্থিতিতে সমস্যার সম্মুখীন হলে, তাঁর স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকলাপের পরিবর্তন হয়, এবং তার ফলে স্নায়বিক সূচকগুলির পরিবর্তনের উপর ভিত্তি করে ‘এক্রীন’ নামক স্বেদ বা ঘর্মগ্রন্হির নিঃসরণের ফলে ত্বকের তড়িৎ পরিবাহিতার তারতম্য ঘটে। এই তারতম্যের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মানসিক, বিশেষতঃ আবেগগত পরিবর্তন সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক তথ্য পাওয়া যায়।
২। লেটেন্সি - কোনো উত্তেজক পরিস্হিতিতে উদ্দীপনার শুরু থেকে তার প্রতি প্রতিক্রিয়ার মধ্যে যে সময়ের ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়।
৩। রাইজ টাইম - একটি প্রতিক্রিয়া সূচনা করার পরে, উত্তেজনার শিখর পর্যন্ত পৌঁছাতে যে সময় লাগে, তাকে রাইজ টাইম বলা হয়। এই প্রতিক্রিয়ার শুরু থেকে শিখর পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য অন্তর্বর্তী সময় ১ থেকে ৩ সেকেন্ডের মধ্যে হতে পারে।

স্কিন কনডাক্টেন্স পদ্ধতি (১)

৪। অ্যাম্প্লিচ্যুড - উদ্দীপনার ফলে উত্তেজনা যে প্রতিক্রিয়ার সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছোয়, সেই চূড়ান্ত মাত্রাকে অ্যাম্প্লিচ্যুড বলা হয়।
৫। রিকভারী টাইম - উত্তেজনা সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানোর পর চূড়ান্ত শিখর থেকে ধীরে ধীরে উত্তেজনার প্রশমন শুরু হয়। ধীরে ধীরে উত্তেজনা হ্রাস পেতে থাকে এবং একসময়ের পরে উত্তেজনার প্রশমন আর লক্ষ্য করা যায় না। উত্তেজনার বৃদ্ধির ফলে ত্বকের কর্ণিয়ামে অধিক মাত্রায় স্বেদ-গ্রন্হির নিঃসরণে কর্ণিয়াম আরো ত্বড়িৎ পরিবাহী হয়ে ওঠে। এই কর্ণিয়াম যতক্ষণ অবধি শুষ্ক না হয়, ততক্ষণ ত্বড়িৎ পরিবাহিতা হ্রাস পায় না, এবং তার ফলে উত্তেজনার প্রশমন সম্পূর্ণ হয় না। ফলে, উত্তেজনার প্রশমন সম্পূর্ণ হতে যে সময় লাগে, তাকেই রিকভারী টাইম বলা হয়।

স্কিন কনডাক্টেন্স পদ্ধতি (২)

এখন প্রশ্ন হলো, এই সব যন্ত্রপাতি ছাড়া কি খেলোয়াড়দের মানসিক অবস্হা সম্বন্ধে অন্য কোনো উপায়ে জানা সম্ভব নয়?

সম্ভব।

অনেক ধরণের পর্যবেক্ষণমূলক প্রশ্নের মাধ্যমে অনেক সময় খেলোয়াড়দের আবেগ ও মানসিক অবস্হান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা যায়, তবে সেইসব পদ্ধতির সাফল্য প্রশ্নাতীত নয়। তাই, এখানে মনে রাখা জরুরী যে, খেলোয়াড়দের মানসিক অবস্হার পূঙ্থানুপূঙ্খ বিশ্লেষণ না করে কখনোই তাঁদের সম্পর্কে কোনো ধারণা করা উচিৎ নয়। আর, শুধুমাত্র একজন বিশেষজ্ঞ ক্রীড়া-মনোবিজ্ঞানীই কিন্তু এই বিষয়ে একজন খেলোয়াড়কে সহায়তা করতে পারেন।

মোটামুটি ঘন্টা-চারেক সময় নিয়ে এই ক্রীড়াবিজ্ঞান এবং ক্রীড়া-মনোবিজ্ঞান বিষয়ে কল্যাণদাকে জ্ঞান দিয়ে আরেকটু হলেই আমি নিজেও আরেক কল্যাণদা হয়ে পড়ছিলাম। আপনাদের কথা মনে পড়তেই সামলে নিলাম। এজন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। কল্যাণদাকে ছেড়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচার আগে কথা দিয়েছি, পরে আবার কোনোদিন অন্য কোথাও, অন্য কোনো পরিসরে এই বিষয়গুলোর যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে আরো বিশদ আলোচনা করবো। তখন আবার আপনাদের সাথে যোগাযোগ হবে। আর হ্যাঁ, আপনাদের কোনো বিষয়ে কল্যাণদার কোনো সুচিন্তিত মতামত জানার প্রয়োজন থাকলে অবশ্যই আমাকে জানাবেন। ততোদিন পর্যন্ত ভালো থাকুন।


লেখক পরিচিতি: ভারত, বাংলাদেশ, কানাডা ও মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন জাতীয় দলের ক্রীড়া-মনোবিজ্ঞান ও ক্রীড়াবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ হিসেবে এবং কানাডা ও মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণায় অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রপত্রিকায় আশিটির বেশি প্রবন্ধের রচয়িতা। বাংলা মাধ্যমেও লেখালেখি করেন যথেষ্ট।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.