অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


খেলা‘ঘর’ বাঁধতে লেগেছি

অবসর বিশেষ সংখ্যা সেপ্টেম্বর ১, ২০১৭

 

গোল্ড কাপ আর গোলাপি দেওয়াল

সৌরভ মুখোপাধ্যায়

চুরাশি সাল, তখনও আমাদের বাড়িতে বিজলি আসেনি। পাড়ায় একটিমাত্র ঘরে টিভি, আমাদের বাড়ির চার বাড়ি পরে। শনিবার সন্ধেয় বাংলা বই, সকাল থেকে ফিসফাস শোনা যেত পুকুরঘাটে, মোড়ের মাথায়, চায়ের দোকানে। আজ শাপমোচন, আজ বাঘা যতীন। বিকেলে খেলা সেরে, রাস্তার ধারে ধনীগৃহের সদরঘরের সামনে চটির পাহাড় দেখতে দেখতে নিজের কেরোসিন-কুপি-জ্বলা ঘরে ফিরে ভূগোল মুখস্থ করত সতৃষ্ণ এগারো বছরের বালক। রোববার মোহনবাগানের খেলা আছে বিকেলে, সরাসরি টেলিকাস্ট। বন্ধুরা ডাকে। উঁহু, পরের বাড়ি টিভি দেখতে যাওয়ার আইন নাই। রেডিও আছে বাড়িতে, দাদুর পাশে বসে রিলে শোনো। টিভিতে তো খেলার রেজাল্ট আলাদা হবে না কিছু! কঠিন সংবিধান।

আচমকাই একদিন, এ কী অলৌকিক! বাবা বলে বসলেন, “নেহরু গোল্ড কাপের খেলা দেখবি নাকি? তিলকজেঠুর বাড়িতে নতুন টিভি নিয়েছে, তোকে নিয়ে যাই চল।”

টিভিতে খেলা? বিদেশের টিম, ইন্ডিয়া টিম? বাবা নিজে নিয়ে যাবেন? কথাটা কানের ভিতর দিয়ে মরমে প’শে প্রাণ আকুল করে দিল।

#

তিলকজেঠু পিতৃবন্ধু। সম্পন্ন ব্যবসায়ী, দিলখোলা গ্রামীণ প্রৌঢ়। আমায় ভালবাসেন বড়, ‘বাবা’ ছাড়া মুখে কথা নেই। বসার ঘরের দরজা থেকে লম্বা দুটো হাত বাড়িয়ে “এসেছিস বাপ!” বলে সে কী খাতির, ঘরভর্তি লোকের সামনে আমার জন্যে প্লেটভর্তি সন্দেশ। “তোমরা বাপু নজর দিয়ো না, আমার বাবা আজ পেত্থম খেলা দেখতে এয়েছে গো, এটা ওর জন্যে ইস্পেশাল।” বাবা কী একটা মৃদু আপত্তি তুলতে যাচ্ছিলেন, এক ধমকে চুপ। সব থেকে ভাল জায়গাটি আমার জন্যে গুছিয়ে দিয়ে গৃহকর্তা নিজে সেঁটে গেলেন দেয়ালের কোণে। জীবনের প্রথম লাইভ ম্যাচ দেখা, আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট, তার ওপর এমন ভি আই পি ট্রিটমেন্ট--- হমিন্‌অস্ত হমিন্‌অস্ত ছাড়া আর কীই বা মনে হওয়ার ছিল!

সত্যি বলি, সেই এগারো বছর বয়সের স্মৃতি খুব বেশি কিছু যে খুঁটিনাটি সঞ্চয় রাখতে পেরেছে এমন দাবি করে লাভ নেই। মোট ক’টা ম্যাচ দেখেছিলাম, কী কী স্কোর হয়েছিল--- চেপে ধরলে নির্ভুল বলতে পারব না। স্মৃতিচারণ করতে বসে আসলে আমরা ক্রমাগত বিস্মৃতির কাছেই তো নতজানু হতে থাকি। দরকারি তথ্যের চেয়ে অপ্রয়োজনীয় টুকরোটাকরা কী করে যে বেশি জায়গা জুড়ে নেয়, জমকালো ঘটনাবলীকে ফ্যাকাশে করে দিয়ে নিতান্ত এলেবেলের দল যে কী করে ফুটে থাকে ডাউন মেমরি লেনের দুধারে--- সে এক রহস্য।

তেত্রিশ বছর আগের ম্যাচ-ওয়াড়ি স্ট্যাটিস্টিকস-রাশি আজ হুবহু মনে নেই। শুধু আবহটুকু এক্কেবারে ডিজিটাল ছবির মতো ঝকঝকে! সেই গোলাপি দেওয়ালের বসার ঘর, উত্তরের দেয়াল-ঘেঁষা প্যানোরামা টিভি, স্ক্রিনের সামনে একটা বাড়তি নীল কাচ, একদিকে স্পিকার--- সেই স্পিকারের ভেতর থেকে ভেসে আসছে থিম টিউন। এখনও মরচে পড়েনি সুরটাতে, গুনগুনিয়ে গেয়ে দিতে পারি : নি-পা-পা-নি, গা-রে-মা-সা... সকার-সকার! প্রতিটা দলের নাম ইকো-সহকারে আসছে, পর্দায় কোলাজ, সঙ্গে ঐ সুর। ছ’বার রিপিট। আর্জেন্টিনা, চায়না, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, রুমানিয়া, ইন্ডিয়া।

ছটি টিমের স্কোরকার্ড

দূরদর্শনের খেলা-সম্প্রচারের পরিকাঠামো তখনও শৈশবাবস্থা ছাড়িয়ে ওঠেনি। গোলের রিপ্লেগুলো দেখাত বিলকুল নভিশের মতন। একটা ঝাপসা পর্দার মতো সরে যেত বাঁ-পাশ থেকে, তার মধ্যে অতি স্লো-মোশনে, প্রায় শট-টু-শট কেটে কেটে প্লেয়ারের মুভমেন্ট, বলের গতিপথ--- যেন অনন্তকাল লাগছে একটা গোল দেখাতে! এখনকার খোকারা দেখলে হেসে গড়াবে। কিন্তু ঐ আদ্যিকালের টেকনোলজিই ক্লাস-সেভেনের গাঁইয়া চোখে অভূতপূর্ব বিস্ময় এঁকে দিত। ঘোর নিয়ে বাড়ি ফেরা, তার পর সারা সন্ধে ঐ থিম টিউন গুনগুন। অঙ্ক ভুল। ইতিহাস-খাতার পিছন-পাতায় আঁকা চলছে চিন-পেনাল্টিবক্সে পোল্যান্ড-স্ট্রাইকারের হানা। আর কর্মশিক্ষা-ক্লাসের জন্যে মাটির তৈরি নেহরু কাপ। দুটি তালুর মুদ্রায় একটি বলের মতো গ্লোব ধরা। সোনালি রং কোথায় পাওয়া যাবে, সেই নিয়ে মাথা ফাটাফাটি। খেলার কথা যত না মনে আছে, খেলার অভিঘাতের ডিটেইলস মনে আছে তার ঢের বেশি।

তাই বলে খেলার কথা কিচ্ছু মনে নেই নাকি? ধুস, তা আবার হয়?

বিলার্ডো – ১৯৮৬র বিশ্বকাপ

মনে আছে হাঙ্গেরিয়ান লাজলো কিসের আশ্চর্য স্কিল। মনে আছে তাঁরই সতীর্থ গোলরক্ষক লাজলো কাকাসের অ্যাক্রোব্যাটিক পেনাল্টি-বাঁচানোর দৃশ্য। আর্জেন্টিনার তারকা সোনালি-চুল গারেকা ছিলেন টুর্নামেন্টের অন্যতম আকর্ষণ--- সবাই বলছিল ছিয়াশির বিশ্বকাপ মাতাবে সে-ছেলেই। তার পাশে খেলছিল কালো-চুলের এক ছোকরা, নাম বুরুচাগা। তবে খেলোয়াড়রা নয়--- শেষ অবধি সব আলোচনার কেন্দ্রে চলে এলেন আর্জেন্টাইন কোচ বিলার্ডো। সাইডলাইনের ধারে অমন অদ্ভুত আচরণ, লাল কার্ড অবধি দেখে ফেললেন!

নেহেরু কাপে প্রশান্ত ব্যানার্জী

চ্যাম্পিয়ন পোল্যাণ্ড টিমকে তো রীতিমত মনে গাঁথা আছে।

সুদর্শন স্মোলারেখ, সপ্রতিভ ছটফটে বুনসল। দীর্ঘদেহী রোমান ওজিস্কির সেই উড়ন্ত হেডের জয়সূচক গোল। চিন সেদিন হাড্ডাহাড্ডি লড়েছিল, তিলকজেঠুর বসার ঘরে চিনের সাপোর্টারও ছিল অনেক। এশিয়ার টিম বলে কথা! আর হ্যাঁ, আমাদের রোগা-দুবলা ছেলেরাও কিন্তু মিলোভানের কোচিংএ খারাপ খেলেনি বাপু।

ভোলার নয়, আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে ভারতের মরিয়া প্রতিরোধ। সাব্বির-বিশ্বজিৎ-প্রশান্ত-মনোরঞ্জন-কৃষ্ণেন্দুর জেদি লড়াই, অতনু ভট্টাচার্যের অভাবনীয় গোলকিপিং! আর শেষ মুহূর্তে হেরে যাওয়ার সেই বিষাদ।

শেষদিন, ফাইনালের পর, বাড়ি ফিরে আসার সময় তিলকজেঠু আবার জড়িয়ে ধরেছিলেন। “আবার দু’বছর পর এই খেলা ফের হবে বাপ। আমি থাকি না থাকি, এখেনে এসেই খেলা দেখো ধন, কেমন?”

সেদিন বাড়ি ফেরার পথেই বাবার মুখে শুনলাম। তিলকজেঠুর ক্যানসার। আয়ু আর মাস কয়েক।

#

তিলকজেঠুর বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, ফ্ল্যাট উঠবে। শুনে কেমন একটা ছটফটানি হচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছি।

গোলাপি দেয়ালের সেই বসার ঘরের একটি দেয়াল মাত্র ভাঙতে বাকি। সেই উত্তরের দেয়াল। টিভি থাকত যার গায়ে। তিলকজেঠু বলেছিলেন, ঐ ঘরে আবার খেলা দেখতে যেতে, পরের নেহরু কাপ। আমি ঘাড় নেড়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে আমাদের ঘরে টিভি এসে গেল, জেঠুও আর নেই। তেত্রিশ বছর কেটে গেছে, কথা রাখা হয়নি আমার।

গোলাপি দেওয়াল কাল ভাঙা হবে। আমার প্রথম গোলাপি সুখের স্মৃতি। আমি শেষবারের মতো তার চুন-সুরকির গন্ধ নিই। বুনসল-বুরুচাগা-কাকাসের ঘামগন্ধ আর তিলকজেঠুর জর্দার গন্ধ একাকার হয়ে আছে যার সঙ্গে।


লেখক পরিচিতি: লেখকের বেড়ে ওঠা প্রত্যন্ত গ্রামে, বৃত্তি - শিক্ষকতা, প্রেম - সাহিত্য চলচ্চিত্র সঙ্গীত ক্রীড়া ও আলস্য। ত্রিশোর্ধ্ব বয়সে শুরু করে, গত দেড় দশক ধরে নিয়মিত বাংলার অগ্রণী পত্রপত্রিকাসমূহে পাঠক-সমাদৃত কথাসাহিত্য লিখে আসছেন।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.