বিলেতে চ্যাম্পিয়নদের খেতাব রক্ষার সম্ভাবনা: কিছু তথ্য,কিছু যুক্তি
অনীশ মুখোপাধ্যায়
(১)
এজবাস্টন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের নাম শুনলে প্রথমেই আমার যে ম্যাচের কথা মনে আসে তা হলো নিরানব্বই বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমিফাইনাল। তারপরে ওই টুর্নামেন্টেই ভারত বনাম ইংল্যান্ড ম্যাচ। ছিয়ানব্বইতে শচীনের ১২২-এর ইনিংসটাকেই বা ভুলি কেমন করে? দেখিনি কিন্ত খবরের কাগজে পড়েছিলাম নব্বইয়ের দশকের প্রথমদিকে ব্রায়ান লারার ৫০১-এর রিপোর্ট। প্রবীণ মানুষজন হয়ত ১৯৭৫-এর প্রথম বিশ্বকাপে গ্লেন টার্নারের সেই অবিস্মরণীয় ১৭১ রানের কথা মনে করবেন যেটা তার আট বছর বাদে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিলদেব ভেঙ্গে দিয়েছিলেন টানব্রিজ ওয়েলসে। কিন্ত আজ অত দূরে ফেরার বাসনা নেই। বরং যদি বছর চারেক পিছিয়ে যাই তবে মনে আসবে এই মাঠেই বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচে ধোনির দলের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়। আর কী আশ্চর্য! আগামী চৌঠা জুন ভারতের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির প্রথম খেলা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই এজবাস্টনেই। অর্থাৎ সেবার যেখানে জয় দিয়ে শেষ হয়েছিলো এবার সেখান থেকেই শুরু। নেতার নামটি ছাড়া টিমটাতেও খুব বড় কোন বদল হয়নি।
(২)
সাবেক এজবাস্টন ছিলো সিমারদের স্বর্গ। সারা সকাল সিম ও সুইং-এর কঠিন প্রশ্নপত্রের সামনে ব্যাটসম্যানের পরীক্ষা চলতো। মে-জুনের এই সময়ে সিমাররা এখানে এতটাই সাহায্য পেতেন যে স্পিনারদের সেভাবে দরকারই হত না। ব্যতিক্রম নিরানব্বই-এর বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। নব্বইয়ের দশকে ৫০ ওভারের ম্যাচে ২২০-২৩০ তুলেও এখানে ম্যাচ জেতা যেত। ভারত যেমন। নিরানব্বইয়ের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে ২৩২ রান তুলে হারিয়েছিলো। অস্ট্রেলিয়া যে সেবারে শ্বাসরোধকারী সেমিফাইনাল অবিশ্বাস্যভাবে টাই করেও জিতে যায় সেখানেও স্টিভ ওয়ার হাতে ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ছিলো মোটে ২১৩ রান। কিন্ত সেসব এখন সোনালী অতীত। আজ,এই ধুম-ধাড়াক্কা কুড়ি-বিশের যুগে ২০ ওভারেই ১৮০-২০০ রান ওদেশেও ওঠে। অধুনা এজবাস্টনের পিচও বদলেছে। ওয়্যারউইকশায়ার কাউন্টির খেলা দেখলে সেটা আরো ভালো বোঝা যায়।
এবারে যে তিনটে মাঠে খেলাগুলি হবে সেগুলি হলো এজবাস্টন(বার্মিংহাম),কার্ডিফ(সোফিয়া গার্ডেন্স)আর দ্য ওভাল(লন্ডন)।
গত দশ বছরে(১লা জানুয়ারী ২০০৭-৩১শে ডিসেম্বর ২০১৬)এই তিন মাঠে যে একদিনের খেলাগুলি হয়েছে তাতে দুটো দলের গড় রানের একটা হিসেব করে দেখা গেলো। এই সময়কালে কম আলো ও বৃষ্টির জন্য ওভার কমেছে এবং সেহেতু খেলাও শেষ হয়নি- এমন কিছু ম্যাচ বাদ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে প্রথম দুটি মাঠে দশটি ম্যাচ এবং ওভালে খেলা হওয়া উনিশটি ম্যাচ-এর ইনিংস পিছু গড় রানকে নিচের সারণিতে দেওয়া হল। এখানে যে দল খেলাগুলিতে আগে ব্যাট করেছে তাদের ব্যাটিং টিম-১ ও যারা পরে ব্যাটিং করেছে তাদের ব্যাটিং টিম-২ বলা হয়েছে।
মাঠের নাম |
ব্যাটিং টিম-১ গড় রান |
ব্যাটিং টিম-২ গড় রান |
এজবাস্টন |
২৮২ |
২২০ |
কার্ডিফ |
২৫৮ |
২২০ |
ওভাল |
২৫৭ |
২৩১ |
সারণি-১ [ তথ্যসূত্র:ইসপিএন ক্রিকইনফো ]
(৩)
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতের গ্রুপটা কিন্ত বেশ কঠিন। প্রথম খেলাই পাকিস্তানের বিপক্ষে। নিরপেক্ষ দেশে ভারত আজ অবধি পাকিস্তানের কাছে ২০০৪ ছাড়া আইসিসি টুর্নামেন্টে হারেনি। মজার ব্যাপার হলো সেটাও চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিরই ম্যাচ ছিলো আর খেলাও হয়েছিলো এজবাস্টনেই। যদিও সেই পাকিস্তান আর এই পাকিস্তান এক নয়। কিন্ত তাতে করে কিছু আসে-যায় না। ভারতের কাছে পাকিস্তান ম্যাচ বরাবরই মানসিকভাবে কড়া চ্যালেঞ্জের। এছাড়া আছে শ্রীলংকা আর দক্ষিণ আফ্রিকা। দুটিই ভালো টিম। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা। কিন্ত ভারতের এই গ্রুপে এক নম্বর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা কতটা?সেটা জানার জন্য চোখ রাখতে হবে এবারে যারা দলে আছেন তাদের ইংল্যান্ডে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটা তার ওপরে। আর তার জন্য একদিনের খেলায় বিলেতের মাঠে এ যাবৎ বিরাটের এই দলটায় যারা আছেন তারা কে কেমন খেলেছেন- সেই তথ্যটি একবার দেখে নিতে হবে।
আসুন,প্রথমে চোখ রাখি সারণি-২(ক)এ।
সামগ্রিক কেরিয়ার পারফরম্যান্স | শুধু ইংল্যান্ডের মাঠে পারফরম্যান্স | গড় রানের পার্থক্য(১১) =(৯)-(৪) | স্ট্রাইক রেটের পার্থক্য (১২)=(১০)-(৫) | |||||||||
নাম | ম্যাচ(১) | ইনিংস(২) | রান(৩) | গড়(৪) | স্ট্রাইক রেট(৫) | ম্যাচ(৬) | ইনিংস(৭) | রান(৮) | গড়(৯) | স্ট্রাইক রেট(১০) | ||
রোহিত | ১৫৩ | ১৪৭ | ৫১৩১ | ৪১.৩৭ | ৮৪.৪৩ | ৭ | ৭ | ২২৯ | ৩৮.১৬ | ৭১.৩৩ | -৩.২১ | -১৩.১ |
ধাওয়ান | ৭৬ | ৭৫ | ৩০৯০ | ৪২.৯১ | ৮৯.৯৫ | ৯ | ৯ | ৫১৮ | ৭৪ | ৯৮.১ | ৩১.০৯ | ৮.১৫ |
কোহলি | ১৭৯ | ১৭১ | ৭৭৫৫ | ৫৩.১১ | ৯০.৭৬ | ১০ | ১০ | ২৯১ | ৩২.৩৩ | ৮৫.৫৮ | -২০.৭৮ | -৫.১৮ |
রাহানে | ৭৩ | ৭১ | ২২৩৭ | ৩২.৪২ | ৭৮.৮৫ | ৯ | ৯ | ৩৫০ | ৩৮.৮৮ | ৮৭.৫ | ৬.৪৬ | ৮.৬৫ |
ধোনি | ২৮৬ | ২৪৯ | ৯২৭৫ | ৫০.৯৬ | ৮৮.৯৮ | ২১ | ১৬ | ৫১৯ | ৩৭.০৭ | ৮৫.৬৪ | -১৩.৮৯ | -৩.৩৪ |
যুবরাজ | ২৯৬ | ২৭১ | ৮৫৩৯ | ৩৬.৮ | ৮৭.৬৪ | ১৯ | ১৯ | ৫৮৩ | ৩৪.২৯ | ৮৫.৪৮ | -২.৫১ | -২.১৬ |
অশ্বিন | ১০৫ | ৬০ | ৬৭৪ | ১৬.৪ | ৮৭.১ | ১৪ | ৮ | ৭৪ | ১৪.৮ | ১৩২.১ | -১.৬৩ | ৪৪.৯৫ |
জাদেজা | ১২৯ | ৯০ | ১৮৮৮ | ৩২ | ৮৫.৫৪ | ১২ | ৮ | ২৬৬ | ৮৮.৬৬ | ১১৪.৬৫ | ৫৬.৬৬ | ২৯.১১ |
সারণি-২(ক) [ তথ্যসূত্র: ইসপিএন ক্রিকইনফো]
এখানে শিখর ধাওয়ান এবং রবি জাদেজার কথায় পরে আসছি। তার আগে অন্য দিকে তাকাই। ওপরের সারণিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শেষ দুটি কলাম যেখান থেকে খুব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে গড় রান এবং স্ট্রাইক রেটের বিচারে ইংল্যান্ডের মাঠে একমাত্র অজিংক রাহানের পারফরমেন্স সার্বিক কেরিয়ারের চেয়ে বেশ ভালো। আর সবথেকে খারাপ অবস্থা বিরাট কোহলির। তারপরে আছেন এমএস ধোনি। এবার ধাওয়ান ও জাদেজার কথায় আসা যাক। ধাওয়ান চার বছর আগের টুর্নামেন্টে ফর্মের চূড়োয় ছিলেন। কিন্ত তারপরের বছরেই ইংল্যান্ড সফরে একটি মাত্র খেলায় ৯৭ রান করা ছাড়া কিছুই করতে পারেন নি। গড় রানের পার্থক্য(৩১.০৯)এত বেশী দেখাবার কারণ ২০১৩-এর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সাফল্য আর ওই ৯৭ নট আউট এর ইনিংস। জাদেজার ব্যাপারও খানিকটা সেরকম। যে লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান আট ইনিংসের মধ্যে পাঁচবারই নট আউট থেকেছে তার গড় বড় রান না করেও বেশীই হবে। দু’জনেরই স্ট্রাইক রেট ভালো। যতক্ষণ খেলবেন বল নষ্ট করবেন না। তাহলে অসুবিধা কোথায়?
অসুবিধা হলো সংখ্যাতত্ত্ব পুরো গল্প শোনাতে পারে না। আজকের ধাওয়ান গত বছর জানুয়ারী মাসের পর থেকে ফর্ম হারানো এবং চোটের কারণে দলেই ছিলেন না। ফিরলেন এ-বছরে সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। গোটাদুয়েক ম্যাচ খেলেছেন এবং ডাহা ফেল করেছেন। অন্যদিকে ২০১৫ সালের নভেম্বর মাস থেকে ধরলে ধাওয়ান এ পর্যন্ত ৮ টেস্টে ৩০৬ রান করেছেন। শতরান নেই,একটিই অর্ধশতরান এবং গড় ২৫.৫০। এরপরেও ধাওয়ান ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বোর্ডিং পাস কেন পাবেন এই প্রশ্ন ওঠা খুব স্বাভাবিক। যেমন স্বাভাবিক এহেন সাম্প্রতিক অতীতের ব্যাগেজ নিয়ে হিথরোতে নামার পরে তার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান হওয়া।
রোহিত শর্মা সম্পর্কে বলা হয় যেদিন ছুটবেন সেদিন শতাব্দী বা দুরন্ত নয়, গতিমান এক্সপ্রেসকেও নাকি হারিয়ে দেবেন। কিন্ত বছরে এমন পুণ্য লগন কবার আসে?ধাওয়ানের মতন রোহিতও চোট সারিয়ে দলে ফিরেছেন এবং ঐ অবধিই। আইপিএল-এর পাটা পিচে পরপর তিনবার এমনভাবে এলবিডবলু হয়েছেন যাতে মনে হতে পারে যে রোহিত সিমেন্ট গোলা বালতিতে পা চুবিয়ে ব্যাট করতে নেমেছেন। অবশ্য আইপিএলে রান পেলে ইংল্যান্ডেও পাবেন-এমন ভাবার কারণ নেই।
বিরাট কোহলির দুঃস্বপ্নের ইংল্যান্ড সিরিজ(২০১৪)আবারো ওদেশে গেলে মনে আসবেই। বিরাট নিজে প্রায় দু বছর বাদে ফর্ম হারিয়েছেন। ঠান্ডা আবহাওয়ায়,মেঘলা আকাশে,বল যদি আধ হাত করে সুইং করে-বিরাট কতটা স্বস্তিতে থাকবেন এটা দেখা আন্তর্জাতিক স্তরে এখনো বাকি আছে। কারণ ইংল্যান্ডে এমনটা তো রোজের ছবি। বেলা বাড়ে,রোদ ওঠে,পিচের ড্যাম্প ভাব কাটে,ব্যাটিং সহজতর হয়ে ওঠে। কিন্ত তার আগে?ওয়ান-ডাউন যে ব্যাট হাতে নামবে তাকে তো এর মধ্যে দিয়ে যেতে হতে পারে।
বরং রাহানে এই টুর্নামেন্টে বিপদকালে ত্রাতা হয়ে ওঠার কাজটা করতে পারেন। ২০১৪-এর ইংল্যান্ড সিরিজে তাঁকেই সবথেকে বেশী স্বচ্ছন্দ দেখিয়েছিলো। গোটা হোম সিজনে(২০১৬-২০১৭)রাহানের ব্যাটে রানের খরা গেছে। কিন্ত অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ধরমশালা টেস্টে,(যা কিনা চরিত্রে কতকটা বিলেতি আবহাওয়ার মতন)মনে হয়েছে ব্যাটে টাচটা ফিরছে।
এর বাইরে মিডল অর্ডারে বাকি দুই ব্যক্তি হলেন যুবরাজ সিং এবং এমএস ধোনি। দু’জনেই যদি নিজ যোগ্যতায় খেলে দেন বড় রান উঠবে। কিন্ত দুজনেই যদি ব্যর্থ হন,অবাক হবো না। একটা সঙ্গত প্রশ্ন এখানে আসা উচিৎ। যুবরাজ খেলবেন কি? কেদার যাদব আজ অবধি ইংল্যান্ডে খেলেননি। কিন্ত বেশ কাজের ব্যাটসম্যান,পার্ট-টাইম স্পিনার। যুবরাজ বছর ছয়েক বাদে একটা দেড়শো রানের ইনিংস হয়তো এ বছরের গোড়ায় খেলেছেন। তবুও এখনকার যুবরাজ টিমে থাকা মানে একটা অনিশ্চয়তা সঙ্গে নিয়ে নামা। বড় কিছু করে দিলেন মানে আপনি সিকিম রাজ্য লটারি জিতলেন। অন্যথায়—বিরাটের জন্য চিন্তা থাকছে।
যদি ইংল্যান্ডের মাঠে এই দলের ব্যাটসম্যানদের যার যেমন গড় রান(ধাওয়ান ও জাদেজা বাদে। তাদের ক্ষেত্রে কেরিয়ার গড়কেই নেওয়া হল। কারণটা ইতিমধ্যে বলা আছে। ) সেটুকুও সবাই করে দেন তবে ২৬৫-২৭০ ওঠা উচিৎ। কাজেই সারণি-১ থেকে মনে হতেই পারে যে ২৬৫-২৭৫ রান খারাপ হবে না। কিন্ত সেখানে যেটা বলা নেই সেটা হল কিছু ছোট আর কিছু বড় সংখ্যার গড় করলে মাঝামাঝি একটি সংখ্যা যেহেতু গড় মান দেখায়, তাই সেখানে ঐ ছোট বা বড় মানগুলির প্রভাব আলাদা করে গড় সংখ্যায় বোঝা যায় না।
দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। গত বছরেই যেমন ওভালে শেষ দুটি একদিনের ম্যাচের একটিতে দুই ইনিংসে রান উঠলো যথাক্রমে ৩৯৮ ও ৩৬৫ এবং পরেরটিতে যথাক্রমে ৩০৫ ও ৩০৯। এবার এ থেকে কী বোঝা যাচ্ছে? বোঝা যাচ্ছে যে ওভালের মাঠে ২৬০ একটা নিরাপদ স্কোর? বোধহয় না। তাছাড়া ক্রিকেট তো আর নিছক সংখ্যাতত্ত্বের বিশ্লেষণ নয় বা কম্পিউটারে খেলা হয় না। মাঠে নেমে যিনি বা যারা ওইদিন ঐ মূহুর্তে খেলবেন, সেইদিন তাদের যা পারফরমেন্স হবে সেটাই চূড়ান্ত। কার গড় কত বা কার স্ট্রাইক রেট কী-সেটা একটা স্তরের পরে খুব একটা বিবেচ্য নয়। তবু সেটা আলাদাভাবে দেখানোর একটাই অর্থ আর সেটা হল এবারেও ব্যাটসম্যানরা আগের কয়েকবারের ফর্মের পুনরাবৃত্তি করে দেখাতে পারেন-এটা খেয়াল রাখা। বিদেশে যেহেতু আমাদের ব্যর্থতার এক লম্বা ইতিহাস আছেই।
এ ব্যাপারে মনে রাখতে হবে যে পিচগুলোকে একদিনের ম্যাচের দাবি মেনে আরো পাটা করে দেওয়ার চক্রান্ত এখন বিশ্বের সর্বত্র প্রচলিত। তায় চার ও ছয় বেশী হওয়ার জন্য বড় মাঠের বাউন্ডারি লাইনকে এগিয়ে দেওয়ার গল্প আছে।
ওভালের কথাই ধরা যাক। এ মাঠে একসময় দৌড়ে চার রান নেওয়া যেতো। আজ ভাবাই যায় না। কাজেই এক হিসেবে ইংল্যান্ডে খেলা হলেও আগে ব্যাট করে কত রান করলে চলবে এটা বোঝা কঠিন। ঠিক তেমনি কত বড় রান তাড়া করা যাবে-এটা আগাম অনুমান করা শক্ত। আর সেটা কে করবেন? কোহলির এই টিম রান তাড়া করায় নাকি ওস্তাদ। কিন্ত তার বেশীরভাগ ম্যাচেই কোহলি নিজে খেলে দিয়েছেন। এখানে যদি তাঁর গত আড়াই মাসের ফর্ম চলে তবে ফলাফল নিয়ে বেশী আশাবাদী না হওয়াই ভালো। সেটা আরো এইজন্য যে দুই ওপেনার কে নিয়ে ভরসার বিশেষ কারণ দেখা যাচ্ছে না(ইতিপূর্বে বিস্তারিত বিবৃত)।
(৪)
এবার আসা যাক বোলিং-এর কথায়।
সারণি-২(ক)এর মতন এখানেও বোলারদের সামগ্রিক পারফরম্যান্স এবং ইংল্যান্ডের মাঠের পারফরম্যান্সকে দেখানো হয়েছে। সেখানে উমেশ যাদব এবং যুবরাজ সিং ছাড়া(হার্দিক ও বুমরাহ-এর এটাই প্রথম ইংল্যান্ড সফর)বাকিদের অতীত পারফরম্যান্স কেরিয়ারের সামগ্রিক অবস্থানের নিরিখে ভালোই বলা যাচ্ছে। কিন্ত কথা হলো কোন কোন বোলার খেলবেন?
নাম | ম্যাচ | ইনিংস | ওভার | মেডেন | রান | উইকেট | সেরা বোলিং | গড় | ইকোনমি | স্ট্রাইক রেট | |
সামি | সামগ্রিক | ৪৭ | ৪৬ | ৩৯০.৫ | ২৬ | ২১৬৬ | ৮৭ | ৩৫/৪ | ২৪.৯ | ৫.৫৪ | ২৬.৯ |
ইংল্যান্ডে | ৪ | ৪ | ৩২.৩ | ১ | ১৫২ | ৮ | ২৮/৩ | ১৯ | ৪.৬৭ | ২৪.৩ | |
ভুবনেশ্বর | সামগ্রিক | ৫৯ | ৫৯ | ৪৮৭.৫ | ৪৫ | ২৪১৭ | ৬১ | ৮/৪ | ৩৯.৬ | ৪.৯৫ | ৪৭.৯ |
ইংল্যান্ডে | ৯ | ৯ | ৬৬ | ৭ | ২৭১ | ১১ | ১৪/২ | ২৪.৬ | ৪.১ | ৩৬ | |
উমেশ | সামগ্রিক | ৬৩ | ৬২ | ৪৯২.৫ | ২০ | ২৯৬৫ | ৮৮ | ৩১/৪ | ৩৩.৭ | ৬.০১ | ৩৩.৬ |
ইংল্যান্ডে | ৬ | ৬ | ৪১৪ | ২ | ২৪৪ | ৫ | ৭৫/১ | ৪৮.৮ | ৫.৮৫ | ৫০ | |
অশ্বিন | সামগ্রিক | ১০৫ | ১০৪ | ৯৫৫.৩ | ৩৪ | ৪৬৯৫ | ১৪৫ | ২৫/৪ | ৩২.৪ | ৪.৯১ | ৩৯.৫ |
ইংল্যান্ডে | ১৪ | ১৩ | ১০৮.১ | ৬ | ৫০৬ | ২১ | ৩৯/৩ | ২৪.১ | ৪.৬৭ | ৩০.৯ | |
জাদেজা | সামগ্রিক | ১২৯ | ১২৫ | ১০৭২ | ৪৪ | ৫২৩৭ | ১৫১ | ৩৬/৫ | ৩৪.৭ | ৪.৮৮ | ৪২.৬ |
ইংল্যান্ডে | ১২ | ১২ | ১০০ | ৫ | ৪৮০ | ২৩ | ৩৬/৫ | ২০.৯ | ৪.৮ | ২৬ | |
যুবরাজ | সামগ্রিক | ২৯৬ | ১৬০ | ৮৩৬.২ | ১৮ | ৪২৬৯ | ১১১ | ৩১/৫ | ৩৮.৪৫ | ৫.১০ | ৪৫.২ |
ইংল্যান্ডে | ১৯ | ১০ | ৫৪.২ | ০০ | ৩২২ | ৮ | ৩৯/৩ | ৪০.২৫ | ৫.৯২ | ৪০.৭ | |
বুমরাহ | সামগ্রিক | ১১ | ১১ | ৯৭.৩ | ৫ | ৪৭৭ | ২২ | ২২/৪ | ২১.৭ | ৪.৮৯ | ২৬.৫ |
হার্দিক | সামগ্রিক | ৭ | ৭ | ৫১ | ১ | ২৯৬ | ৯ | ৩১/৩ | ৩২.৯ | ৫.৮ | ৩৪ |
সারণি-২(খ) [তথ্যসূত্রঃইসপিএন ক্রিকইনফো]
ইংল্যান্ডের মাঠে সামি ও ভুবনেশ্বর কুমার খেলবেন। যদি তিন পেসার খেলেন তবে আরেকজন কে হবেন?উমেশ যাদব গত কয়েক মাস দারুণ ভালো বল করে যাচ্ছেন। বলের গতি ১৪০+কিমি। কিন্ত উমেশ বড্ড রান খরুচে। ওর ইকোনমি এমনকি ইংল্যান্ডের মাঠেও খুব বেশী। তাহলে কি যসপ্রীত বুমরাহ?বুমরাহ-এর বয়স কম,হাতে খুব ভালো ইয়র্কার আছে,ডেথ ওভারে অনেক বেশী কার্যকরী,বলে জোরও যথেষ্ট আছে। আরেকটা বিকল্প হতে পারে দুজনেই খেলবেন,ভুবি(ভুবনেশ্বর) বাদ। কিন্ত তাতে সমস্যাও আছে।
ভুবনেশ্বরের বলে জোর কম,কিন্ত তিনি ইংল্যান্ডের মাঠে সবথেকে বেশী কার্যকরী। তার কারণ সুইং। লেট আউট সুইং-এ বারেবারে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করে দেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ভুবির। কিন্ত ওর বোলিং ভীষণ রকম আবহাওয়া ও পিচ নির্ভর। যেখানে আবহাওয়া শুকনো,গরম,খটখটে রোদ,পিচে ঘাস নেই,মাঠে হাওয়া নেই-ভুবি সেখানে পাড়ার বোলার। ওর আরেকটা বড় দুর্বলতা হলো স্লগ ওভারে মার খেলে লাইন-লেংন্থ কোথাও হারিয়ে যায়। এমন অনেক খেলা দেখা গেছে যেখানে হয়ত ওর প্রথম স্পেল ৭-১-১৬-২। এটাই ইনিংস শেষে হয়ে যেতে পারে ১০-১-৫৬-২। কারণ যে অর্থে বুমরাহ স্লগের বোলার সেই অর্থেই ভুবি প্রথম কুড়ি থেকে তিরিশ ওভারের বোলার। চতুর অধিনায়ক হলে এর মধ্যে ভুবির কোটা শেষ করিয়ে দিতে হবে। না হলে...
কাজেই কোহলির কাছে এটা বিরাট সমস্যা যে ভুবি খেলবেন কী খেলবেন না। এর বাইরে আছে হার্দিক পাণ্ডিয়া। হার্দিক যদি খেলেন তবে যুবরাজের খেলার প্রশ্ন ওঠে না। কারণ হার্দিক লোয়ার অর্ডারে ব্যাট চালাবেন-ধরা হয়ে থাকে। এর সঙ্গে রাখুন ওর ফিল্ডিং যা এই সময় যুবরাজের কাছে প্রায় অতীত। আর যদি দুজনেই খেলেন তবে ধরে নিতে হবে যে হার্দিক হচ্ছেন তিন নম্বর সিমার। এটা যদি খেটে যায় এক অর্থে ভালো। কিন্ত না খাটলে বিকল্প কমে যাবে। মহম্মদ সামি আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ বোলার। সামিও চোট সারিয়ে ফিরছেন। সামি পুরো ফিট হয়ে নিজের আনন্দে বল করতে পারা মানে বাকিদের ঘাড় থেকে চাপ কমে গেলো। কিন্ত এই ব্যাপারটা সেভাবে এখনো পরীক্ষিতই নয়। এর বাইরে থাকছেন স্পিনাররা। অশ্বিন ও জাদেজা। দুজনেই খেলবেন ধরে নেওয়া যায়। এবং এদের কুড়ি ওভারে অনেক কিছু ঠিক হবে। অশ্বিন আইপিএল খেলেননি চোটের জন্যই। আর টানা বল করে বিশ্রামের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। সেই বিশ্রাম গত মাস দেড়েকে পেয়েছেন। আরো কিছুদিন পাবেন। সুস্থ অশ্বিন ওভালের শুকনো পিচে বিপক্ষকে ব্যস্ত রাখতে পারলে কোহলির খুব সুবিধা হয়। জাদেজাকে নিয়ে অনেক কথা শুনি। জাদেজার খেলায় প্রচুর ভুলভ্রান্তি যে কেউ খুঁজে পাবেন। কিন্ত এই মুহুর্তে ওর থেকে ভালো বিকল্প কেউ নেই। আরো একটা ব্যাপার হলো জাদেজা ইংল্যান্ডে বল হাতেও যথেষ্টই সফল(সারণি-২(খ))। সংগে রাখুন ওর ফিল্ডিং। কাজেই জাদেজা একজন মাঝারি মাপের অলরাউন্ডার হলেও এই দলে খুব প্রয়োজনীয় খেলোয়াড়।
(৫)
ভারতের তিন বিপক্ষ নিয়ে এবার আলোচনায় ঢুকি।
পাকিস্তান এই মুহূর্তে এক ভাঙাগড়ার পর্যায় দিয়ে যাচ্ছে। দলে অনেক নতুন মুখ দেখা যায়।
শোয়েব মালিক ছাড়া আর প্রায় কেউই খুব পুরোনো খেলোয়াড় নয়। ব্যাটসম্যান হিসেবে সরফরাজ আমেদ আর আমেদ শাহজাদ পূর্ব পরিচিত। এর বাইরে আছেন মহম্মদ হাফিজ,উমর আকমল আর আজহার আলি। এরা কেউই ভয়ঙ্কর ব্যাটসম্যান নন,কিন্ত অতীতে ভারতকে অনেকবার ভুগিয়েছেন সরফরাজ আর মহম্মদ হাফিজ। এজবাস্টনে আবারো ভোগাবেন না-এমন গ্যারান্টি কেউ দেবে না। খুব আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি এদের বোলিং শক্তি দেখে। একজন বাদে বোধহয় সবাই বাঁহাতি। জুনেইদ খান,ওয়াহাব রিয়াজ আর মহম্মদ আমের তো আছেনই। এরা যে কেউ যে কোনদিন একটা স্পেল-এ খেলা শেষ করে দিতে পারেন। এরা ছাড়া ইমাদ ওয়াসিম আছেন। স্লো,অর্থোডক্স। আর অন্যদিকে পাবেন ডানহাতি ফাস্ট বোলার হাসান আলিকে। একটা দলে যদি এতজন বাঁহাতি বোলার খেলেন তবে উল্টোদিকের ডানহাতি ব্যাটসম্যানের পক্ষে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া মুশকিল হতে পারে। আমার মনে আছে ওয়াহাব রিয়াজের ২০১৫ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইন্যালে শেন ওয়াটসনকে নাকানিচোবানি খাওয়ানো স্পেলটার কথা। শর্ট পিচ বল করে করে ওয়াহাব ওয়াটসনকে প্রায় পাগল করে ছেড়েছিলেন সেবার সিডনিতে। ইউটিউবে গেলে দেখবেন এই স্পেলের একটা ভিডিও আছে যেটা প্রায় সাড়ে সাত লাখ হিট পেয়েছে। পাকিস্তান অবশ্য ম্যাচটায় হারে। কিন্ত হেরেও হিরো হয়ে যান ওয়াহাব।
মহম্মদ আমেরকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। নিজদোষে কুখ্যাত(লর্ডস-২০১০)এবং নিজগুণে বিখ্যাত হওয়ার ফলে সুপরিচিত। আর জুনেইদ ভারতের পাটা পিচেই ২০১২-তে এসে বেশ ভালো বল করে গিয়েছেন। কাজেই পাকিস্তান খুব সহজ প্রতিপক্ষ হবে না।
এঞ্জেলো ম্যাথেইউজের নেতৃত্বে এই শ্রীলঙ্কাও বেশ প্রস্তুত হয়ে আসবে। মাহেলা-সাঙ্গাকারা নেই। কিন্ত এরা আবার নিজেদের গুছিয়ে নিচ্ছে। বেশ কয়েক বছর ধরে খেলে যাচ্ছেন এমন খেলোয়াড় প্রায় সাত-আটজন। উপুল থরংগা,দীনেশ চাণ্ডিমল,চামারা কাপুগেদারা,থিসারা পেরেরা,কুশল পেরেরা,সুরংগা লাকমল,লাসিথ মালিঙ্গা,নুয়ান কুলশেখরারা ব্যাটে ও বলে যথেষ্ট ওজনদার নাম। সঙ্গে ম্যাথেউজ নিজে আছেন। আর যারা আছেন তারা অপেক্ষাকৃত তরুণ খেলোয়াড়। তবু তার মধ্যে আসেলা গুণরত্নেকে মাথায় রাখতে হবে। তবে শ্রীলঙ্কার একটা সমস্যা আগেও দেখা গেছে। দেশের বাইরে খেলতে গিয়ে অন্য জায়গায় দল হিসেবে এরা যতটা সফল ইংল্যান্ডে সব সময় ততটা নয়। মুরলিধরন,মাহেলা,সাঙ্গাকে ভর করে কয়েকবার হয়ত ভালো ফল করে দেখিয়েছে। কিন্ত সাফল্যের থেকে তাদের ব্যর্থতাই বেশী। তাই প্রতিপক্ষ হিসেবে শ্রীলংকা আসবে সবার শেষে। কার্ডিফে যেহেতু এদের সঙ্গে খেলা হবে কাজেই সেটাও হয়ত ভারতের পক্ষে যেতে পারে। কার্ডিফে ভারত এযাবৎ ভালো খেলে এসেছে। কার্ডিফ তুলনায় নতুন মাঠ। সামান্য ছোটও। পিচ নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কারণ নেই। সোফিয়া গার্ডেন্সের পিচ ও আবহাওয়া ব্যাটসম্যানদের ওপরে মোটামুটি প্রসন্নই থাকে।
সবশেষে দক্ষিণ আফ্রিকা। খুব সম্ভবতঃএবারের সবথেকে বিপদজনক দল। অধিনায়কের নাম যেখানে এবি ডিভিলিয়ার্স সে দলকে আলাদা সম্ভ্রমের চোখে দেখতেই হয়। সঙ্গে ব্যাট হাতে থাকছেন হাসিম আমলা,কুইন্টন ডি কক,জা-পল ডুমিনি,ফ্যাফ ডু-প্লেসি,ডেভিড মিলার আর ফারহান বেহারদিন। এরা যে কেউ যে কোনদিন যে কোন টার্গেট খাড়াও করতে পারেন,তাড়াও করতে পারেন। বেহারদিন নতুন এসেছেন। বাকিরা অত্যন্ত পরিচিত এবং ব্যাট হাতে সৃষ্টি ও ধ্বংস দুই-ই অনায়াসে করে দেখিয়ে দেবেন।
আর বোলিং?ডেল স্টেইন নেই। কিন্ত তাতে কে আর সুখনিদ্রায় যাবেন? নতুন তারকা হলেন কাগিসো রাবাদা। রাবাদা গত এক-দেড় বছরে বোধহয় বিশ্বে অন্যতম সফল পেস বোলার। সঙ্গে রাখুন মর্নি মর্কেল,ওয়েন পার্নেল আর ক্রিস মরিসকে। মর্কেল সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মাথায় আসছে না কোন গুণের কথা আগে বলবো। গতি?আছে। সুইং?আছে। আচমকা থুতনির কাছে বল বাউন্স করিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা?আছে। ডেথে ইয়র্কার?তাও আছে। লাইন-লেংথ নিয়ে বলে লাভ নেই। নিজের দিনে মর্কেলকে খেলা দ্রাবিড়-শচীন-লক্ষণের কাছেও দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছিলো। বরং পার্নেল সেদিক দিয়ে ব্যাটসম্যানের কাছে সহজ বিকল্প। ওয়েন পার্নেল আজকের বোলার নন। বলে সাংঘাতিক না হলেও ভালই জোর। কিন্ত পার্নেলকে মারা যায়। কারণ পার্নেল প্রচুর ওভারপিচ ডেলিভারি করে ফেলেন। ইয়র্কার জায়গায় না থাকলে আরো সুবিধা। সবথেকে বড় কথা পার্নেল মার খেলে মাথা গরম করে ফেলেন।
আর রইলেন ক্রিস মরিস। এই ভদ্রলোককে ভারতীয়রা আইপিএলে অনেকবার দেখেছেন। আপাত নিরীহ আচরণ। কিন্ত মর্কেলের মতই হঠাৎ হঠাৎ বাউন্সার ছাড়েন। ভালো পরিবেশে সুইং করাতে পারেন। মরিসকে হালকা ভাবে নিলে মুশকিল।
ওদের এক নম্বর স্পিনার হলেন ইমরান তাহির। তাহিরের সুবিধা হল লেগ স্পিন করতে গিয়ে মার খেলেও ফ্লাইট করাতে পিছপা হন না। খুব বিপদজনক বোলার নন। কিন্ত তাহিরকে কাউন্টার অ্যাটাক করতে গেলে ব্যাটসম্যানকে কিছু পরিমাণ ঝুঁকি নিতে হবে। তাহিরের স্পিন সঙ্গী ভারতীয় বংশোদ্ভূত কেশব মহারাজ। কেশব বাঁহাতি স্পিনার। অল্প কিছুদিন খেলছেন। তবে নিজের লাইন-লেংথে অটল থাকার সুঅভ্যাস এর মধ্যেই দেখা গেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার ফিল্ডিং নিয়ে বোধহয় নতুন করে কিছু না বলাই ভালো। কারণ তার উচ্চস্তর যে কতটা উচ্চ তা ক্রিকেটের খবর যারা রাখেন অবশ্যই জানেন। ভারত এদের মুখোমুখি হবে ওভালে। এখন অবশ্য বলা হয় দ্য কেআইএ ওভাল যা আসলে সারে কাউন্টির ঘরের মাঠ। ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট মাঠও বটে। বহুবছর ধরে সিরিজের শেষ টেস্ট খেলা হয় এই মাঠে। এবার এখানেই হবে টুর্নামেন্টের ফাইনাল। ওভাল বলতেই একগুচ্ছ স্মৃতি এবং একটি বিশেষ ছবি মনের আকাশে ভিড় করে আসে। স্মৃতির কথা আজ থাক। যে ছবির কথা মনে আসে সেটা হলো একটি গ্যাসহোল্ডার যা অনেকদিন ধরে ওভাল-ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে আছে। ওভালে বরাবর আদর্শ ব্যাটিং পিচ পাওয়া যায়। যেটা অনেকে ভুলে যান সেটা হলো ওভালে একদিনের ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধেও পিচের চরিত্র খুব বেশী বদলায় না। ফলে ৩০০-৩২০ রান টার্গেট থাকলে সেটা তুলে দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। বছর দশেক আগে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ভারত ৩১৬ রান তাড়া করে ম্যাচটা জিতে যায়।
এ ব্যাপারে যে তথ্য দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম তার কথায় ফিরে আসি। আগে ব্যাটিং বা পরে ব্যাটিং করে কোন মাঠে কেমন ফলাফল হয়েছে এটা ওই দশ বছরের খেলাগুলি থেকে যদি একবার বোঝার চেষ্টা করি তবে দেখা যাবে ওভালে ওই ১৯টি খেলায় আগে ব্যাট করে জেতা ম্যাচ ৯টি,পরে ব্যাট করে ১০টি। কার্ডিফে অনুপাত ৫:৫। কিন্ত এজবাস্টনে ৭:৩। অর্থাৎ প্রথমে ব্যাট করা দল জিতেছে ৭ বার। কাজেই টস যদি আদৌ কোথাও নির্ণায়ক ভূমিকা নেয় তবে চৌঠা জুন এজবাস্টনেই হয়ত নেবে। ঐতিহাসিকভাবে এই তিন মাঠের মধ্যে বা এমনিতেও ইংল্যান্ডের বাকি মাঠগুলির নিরিখে বিচার করলে লিডসকে(হেডিংলি) বাদ দিলে এজবাস্টনেই বোলাররা সবথেকে বেশী সাহায্য পেয়ে এসেছে। কিন্ত আগেই বলেছি যে এজবাস্টনের পিচের চরিত্র খানিকটা বদলেছে। কাজেই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে বোলাররা কতটা সাহায্য পাবে সেটা যতটা পিচের থেকে আবহাওয়ার ওপরে হয়ত বেশী নির্ভর করবে ।
(৬)
ভারত কেমন করবে-এই প্রশ্নটা এতকিছুর পরে আবারো ফিরে আসছে।
যে দলে প্রথম সারির তিনজন ব্যাটসম্যান ফর্মে নেই,দুজন জীবনের সেরা সময় পেছনে ফেলে এসেছেন আর কয়েকজনের এটাই প্রথম ইংল্যান্ড সফর- তাদের কাছে খেতাব রক্ষার আশা আর জুন মাসের গোড়ায় কলকাতায় বর্ষার প্রত্যাশা একই ব্যাপার। কিন্ত যদি প্রথমেই পাকিস্তানকে হারানো যায়,আর বিরাট এবং ধোনি যদি তাঁদের ক্ষমতার ষাট থেকে সত্তর ভাগও খেলে দেন,সঙ্গে রাহানে নিজের কাজটি করতে থাকেন আর ওদিকে দুই স্পিনার,সামি এবং আর একজন পেসার নিজেদের সুনাম খানিকটাও বজায় রাখতে পারেন তবে অনেক হিসেবই এদিক-ওদিক হয়ে যেতে পারে।
হর্ষ ভোগলে স্টারের কমেন্ট্রি বক্সে ফিরছেন কিনা সে নিয়ে আইসিসি মোটেও ভাবছে না। বরং এজবাস্টনে রবিবাসরীয় ক্রিকেট যুদ্ধের টিকিট কাউন্টারে হাউজফুল বোর্ড ঝুলবে কিনা সেটা অনেক বড় প্রশ্ন। স্টার ক্রিকেট শশাংক মনোহরকে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলো যে ভারত শেষ পর্যন্ত খেলবে কিনা আর এটাই আসল কথা। ভারত খেললে তারা ব্রডকাস্ট করবে নতুবা নয়। কারণ ক্রিকেট অর্থনীতিতে শেষ কথা তো সেই বাজারই বলবে। আর তাতে ভারসাম্য দাম ও চাহিদা কত হবে সেটা যে ভারতই অধুনা ঠিক করে থাকে এবং করবেও- এটা আইসিসির প্রেসিডেন্টের কাছে খুব স্পষ্ট। ভারত ফাইন্যাল খেলুক তাই তিনিও চাইবেন। স্টার তো চাইবেই । চ্যাম্পিয়নরাই যদি চ্যাম্পিয়নশিপ রক্ষার জন্য ১৮ই জুন ওভালে নামতে না পারে তবে তো টুর্নামেন্টটাই বেকার হয়ে যাবে। সেটা কোন পক্ষই চাইবে না।
গ্রীষ্মের ইংল্যান্ড,তায় সি.টি-২০১৭ –এর মঞ্চ। বালকদের থেকে পুরুষদের আলাদা করে চিনে নেওয়ার এর চেয়ে ভালো পটভূমি আর কী-ই বা হতে পারে?
দেখা হবে এজবাস্টনে ।
সবাই আসছেন তো?
লেখক পরিচিতি: পেশায় অর্থনীতির অধ্যাপক। ন'হাটা কলেজে কর্মরত। লেখালেখি নিয়ে চিন্তাভাবনার শুরু ২০১০-এ। প্রথম উপন্যাস 'জগতরত্ন রক্তনীল' আনন্দমেলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ২০১৪-২০১৫ সালে। ক্রিকেট নিয়ে লেখালেখিতে আগ্রহী। ফেসবুকে এ ব্যাপারে নিজস্ব পেজ 'বাইশ গজের ডাইরি'তে নিয়মিত লিখে থাকেন।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.