সমাজ ও সংস্কৃতি
জুন ১৫, ২০১৬
“যে ভাষা মরমে পশি আকুল করে তোলে প্রাণ”…
সুদীপ্তা চট্টোপাধ্যায়
“সকল সুরে বেজেছে তার আগমনী
সে যে আসে,আসে, আসে ... ”
তিন বছর আগের কথা, পুজো আসছে যদিও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে ধূলো ময়লা নেই বললেই চলে তবুও মায়ের শেখানো অভ্যেসে ঝাড়পোঁছ চলছে। বইয়ের র্যাক ঝাড়তে ঝাড়তে চোখে পড়ল রবীন্দ্রনাথের কবিতা সংকলন “শিশু”। ছেলেদের পড়ে শোনাবো বলে দেশ থেকে বেশ কিছু ছোটোদের বই এনে রেখেছিলাম, মনে হল দুইভাই কে “পূজার সাজ” কবিতাটা পড়ে শোনাই ;
পড়তে শুরু করতেই প্রত্যেকটি লাইনেই হোঁচট ; কারন ছেলেরা প্রায় প্রত্যেকটি কথারই মানে জানতে চাইছে, আচ্ছা! এভাবে কি কবিতা পড়ার আনন্দ পাওয়া যায় নাকি এভাবে কবিতার শোনার রস গ্রহণ করা যায় !
এতদিন এই ভেবে খুশী ছিলাম যে আমার ছেলেরা বাংলা বলে। আজ অনেক প্রশ্ন মাথায় এলো। বাংলা সাহিত্যের এই সম্ভারের কতটুকুই আর ইংরেজিতে আনুবাদ হয়েছে! ওরা যদি নিজেরা পড়তে না শেখে তবে তো এরা বাংলা সাহিত্যের এই সব মণিমুক্তো থেকে বঞ্চিত হবে।
নাগরিকত্বের নিরিখে বা মাতৃভূমির পরিচয়ে আমরা যা-ই হই না কেন জাতিসত্ত্বার নিরিখে কিন্তু আমাদের প্রাথমিক পরিচয় আমরা বাঙালি। এই অদ্ভুত দেশের “বিবিধের মাঝে মিলন” মেলায় আর সব জাতির মতো আমরাও কিন্তু আমাদের বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্য নিয়েই মূল স্রোতের অংশীদার হয়েছি। আর প্রত্যেকটি গোষ্ঠীর নিজের নিজের ভাষা সংস্কৃতির আদানপ্রদানেই বহুজাগতিক সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভব হচ্ছে। অবশ্য এই বহুজাগতিক নতুন সংস্কৃতি আমাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যকে সমৃদ্ধ করছে কিনা এটাও বিতর্কের বিষয়। যাই হোক, একটি জাতির সত্বার মূল তাদের নিজস্ব ভাষা এবং সংস্কৃতি। সংস্কৃতির ভিতর দিয়েই একটি জাতিকে চেনা যায় বোঝা যায়।
আজ আমাদের বাংলা ভাষা, বিশ্বের দরবারে সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষার মাপকাঠিতে পঞ্চম স্থান অধীকার করেছে। এই ভাষার কারনেই আজ ইউনাইটেড নেশান্স ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমাদের কাছে এর থেকে বেশী গর্বের বিষয় আর কী হতে পারে?
বিদ্যাসাগর আর রবীন্দ্রনাথের হাতে আমাদের শৈশবের ভিত তৈরী হয়েছে। কৈশোরে জড়িয়ে আছে শরত, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকান্ত। আজও সুকুমার শিশুদের মনে সেভাবেই ঢেউ তোলেন সুকুমার রায়। তাই বঙ্কিম মধুসূদন যে ভাষাকে পূর্ণতা দিয়েছেন সে ভাষা শিক্ষা আর তার চর্চা যে কতটা জরুরী এবং কতোটা প্রয়োজনীয় সে কথাটা বোঝা নিশ্চই এতোটা কঠিন নয়।
হতে পারে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম জন্মগত ভাবে বাঙালি না, মাতৃভূমির মর্যাদায় তাদের মাতৃভাষা হয়ত বাংলা না কিন্তু জাতিসত্ত্বায় তারা কিন্তু বাঙালি। বাংলা তাদের মায়ের মুখের ভাষা, এই সংস্কৃতির ছায়াতেই তারা বেড়ে উঠছে, এই তাদের প্রকৃত পরিচয় ...
‘ধান ভাঙতে শিবের গীত’ গাওয়া হয়ে গেল। আসলে আমার এই সব এলোমেলো ভাবনা চিন্তায় আসল কথার খেই হারিয়ে গেলেও বুঝলাম এর উত্তর একটাই যে করেই হোক ছেলেদের বাংলা শেখাতে হবে, শুরু হল তোড়জোড়, দেশ থেকে এল বর্ণ পরিচয় ,সহজ পাঠ। শনিবার এলেই ‘ অ এ আজগর আসছে তেড়ে’ র অত্যাচারে ছেলেরা দিশেহারা , উইকেন্ডের দিন গুলোয় বাড়ীতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তৈরি হতে লাগল। প্রথম প্রথম নতুন কিছু একটা শেখার উৎসাহ থাকলেও কিছুদিন পর ছাত্র এবং শিক্ষিকা দু তরফেই উৎসাহে ভাঁটা পড়তে শুরু করল। যথারীতি স্লেট পেন্সিল ঢুকে পরল জীপ লক ব্যাগে।
এ ব্যাপারে আমাদের সব মায়েদের গল্পই বোধহয় একই রকম।
কিছুদিন পর একটি কালী মন্দিরে গেছি হঠাৎ ছোট ছেলে ফিসফিস করে বলল “মম সি ! ওই কিডস রা আমাদের মত টক করছে !” (কয়েক বছর আগে ওর বাংলা ঐরকমই ছিল) তেমন পাত্তা দিইনি বাঙ্গালী কালী মন্দিরে বাঙালি তো থাকবেই। কিন্তু একটু পরে কানে এল গানের সুর। সেই শুনে ভয়ে ভয়ে উঁকি মারলাম ছোট্টো ঘরটায় দেখি বিভিন্ন বয়েসের কিছু বাচ্চা মন দিয়ে গান করছে। হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন একজন ভদ্রলোক। ঘরের দেওয়ালে বোর্ডে বড় বড় করে লেখা আছে অ ,আ ক, খ। অন্য বোর্ডের কোনটায় মানব দেহের ছবি তাতে বাংলায় প্রত্যেকটি অঙ্গের নাম, কোনটায় ফুলের ছবি বা ফলের ছবি। একদিকের বোর্ডে নানা রকম হাতের কাজ আর বাংলায় লেখা বেশ কিছু নাম বোঝাই যাচ্ছে ছোটোদের হাতের লেখা।
“এরপর সৃষ্টি হল ইতিহাস” বললে হয়ত বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে কিন্তু আমার কাছে এই আবিস্কার ইতিহাস সৃষ্টির থেকে কম কিছু ছিল না। জানতে পারলাম প্রায় ২৭ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা করে চলেছে। নিউ জার্সির বুকে পরবর্তী প্রজন্মকে বাংলা ভাষা শিখতে সাহায্য করছে।
তিন বছর হল এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হয়েছি। অবাক হয়ে যাই আজও একি উৎসাহে ছেলেরা অপেক্ষা করে রবিবারের , কবে রবিবার আসবে আর কখন তারা বাংলা স্কুলে যাবে। মিডল স্কুলের পড়া শোনা, এক্স্ট্রা ক্যারিকুলার এক্টিভিটি সামলেও এই যে বাংলা স্কুলে যাওয়ার এত উৎসাহ আমার মনে হয় তার কারন একটাই, এই প্রতিষ্ঠানের শেখানোর ধরন।
ওদের স্কুলে মাসি মেসোরাই বাংলা পড়ান,গান শেখান ওদের প্রিয় মামা। এখানে কোন টিচার নেই, মা, মাসি, মামা, মেসোরাই টিচার। এখানে আমাদের ছোটবেলার মত রাগী রাগী গানের দিদিমনির কানমলা নেই, নাচের তাল ভুল করে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকাও নেই। জোর করে ধরে কঠিন কঠিন শব্দ শেখানো বা লেখানোও হয় না, নেই জোর করে চাপানো হোম ওয়ার্কের টেনশন। বাঁধাধরা ক্যারিকুলাম নেই এমন কি পরীক্ষার ভয়ও নেই।
বাচ্চারা নিজেদের মজার গল্প, বেড়ানোর গল্প কিংবা নিজের প্রিয় সময় কাটানোর গল্প শেয়ার করে। মেসোর কাছে পড়ার বইএর সাথে সাথে ফেলুদার গল্পও শোনে আর মাসির কাছে লিখতে শিখে। একটু আধটু ভুল হলে বাচ্চারা মামা মাসিদের নির্বিকার বলে দিতে পারে “ মাসি ক্লাস শেষ হলে তোমার বাড়ী গিয়ে শিখে নেব”।
এই স্কুলের একটাই কঠিন রুল স্কুলে বাংলায় কথা বলতে হবে, ভুল করেও ইংরেজি বলা যাবে না। এই রুলের জন্যই তৈরি হয় বাংলায় কথা বলার অভ্যেস। কথা বলার সময় আটকে গেলে মাসিরা সাহায্য করেন আর এভাবেই ওদের বাংলা শব্দের ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হয়।
নিজের অভিজ্ঞতায় দেখছি, এই গল্প শুনতে শুনতে ,একসাথে দুষ্টুমি করতে করতেই কখন যে নিজের ভাষায় লিখছে নিজের নাম,পড়ে ফেলছে ছোট ছোট শব্দ বুঝতেও পারছেনা। খেলতে খেলতে গল্প আড্ডার মাঝেই ওরা পড়তে লিখতে শিখে যাচ্ছে। অথচ এই আমিই একদিন একার চেষ্টায় পুরনো পদ্ধতিতে ওদের শেখাতে পারিনি বর্ণমালা।
অতি উৎসাহ নিয়ে এখানে পালন করা হয় রবীন্দ্র, নজরুল জয়ন্তী, নববর্ষ কিংবা বিজয়া দশমী। অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির সাথে কবিতা বা গানের বাণী মুখস্থ করতে করতেই পড়া হয়ে যায় এঁদের লেখা, শেখা হয় কবিতা, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, একুশের গান।
দশমীর খাওয়া দাওয়া মানে নাড়ু, নিমকি কিংবা পিঠের স্বাদের সাথে সাথে জানা হয়ে যায় বাংলার খাওয়া দাওয়া। বিভিন্ন ঋতুর গান শেখার সাথে সাথে পরিচয় হয় বাংলার প্রকৃতির। সরস্বতী পুজোয় উপোস করে অঞ্জলি দেওয়া আর বাংলা দাদুর মন্ত্র পাঠের সাথে সাথে পরিচয় হয় নিজেদের সংস্কৃতির। গরমের ছুটিতে চলে নাটকের মহরা। পুজোয় অনুষ্ঠিত হয় সেই নাটক। নাটকের পার্ট মুখস্থ করা আর নাটকের গল্পের চরিত্রদের বুঝতে গিয়ে শেখা হয় বাংলার মানুষের কালচার। এমন কি ক্রিসমাসের ছুটীতে যখন স্যান্টা আসে গিফট নিয়ে তখন ঠিক এভাবেই শিখে যায় এ দেশেরও কালচার।
তাই যখন দেশে গিয়ে আমার ছোটো ছেলে খুব অবাক হয়ে তার কাজিনকে জিজ্ঞেস করেছিল “তোমরা কেন আমার সাথে ইংরেজিতে কথা বলছ?” তখন মনে হয়েছিল আমার ভলেন্টিয়ারি আজ সার্থক। হয়ত এরা বাংলা ভাষায় বিশারদ হবে না, কিন্তু নিজের ভাষা নিজের সংস্কৃতিকে এরা ভুলে যাবে না। আর বাঙালি হিসেবে এই আমাদের সবথেকে বড় পাওয়া।
এই কয়েক বছরে কত রকম অভিজ্ঞতা হল এই স্কুলে একটা মজার কথা না বলে থাকতে পারছি না ...
স্কুলে প্রশ্ন উত্তরের পালা চলছে প্রশ্ন ছিল- মায়ের বোনকে কী বলে? বড় দিদি র ঊত্তর “মাসি” এর পরের প্রশ্ন – বাবার বোনকে কী বলে? পাঁচ বছরের ছোটো ভাই হাত তুললো ... উত্তর এলো “বাসি”। মায়ের বোন মাসি হলে বাবার বোন বাসি হতেই পারে ! দ্বিতীয় প্রশ্ন বলতো হোয়াইট এর বাংলা কি? কেউ উত্তর দিল সাদা। তার পরের প্রশ্ন ব্ল্যাক এর বাংলা কী? আবার সেই হাত ঊপরে। কী উত্তর পাওয়া যেতে পারে ভেবে কৌতূহল হল, তাই আবার তাকে সুযোগ দেওয়া হল উত্তর এলো “কাদা”। এবারো ভুল ধরার উপায় নেই হোয়াইট সাদা হলে ব্ল্যাক তো কাদা হবেই। সেই ছেলে কিন্তু এখন পরিষ্কার বাংলা পড়তে লিখতে পারে।
আজ আমেরিকার বুকে ছড়িয়ে আছে অনেক বাংলা স্কুল। নিউ জার্সির বুকেই অন্তত ৪/৫ টি বাংলা স্কুল চলছে। প্রবাসে বসবাসকারী বাঙালিরা যদি এভাবেই দেশ ধর্ম নির্বিশেষে মনের সংকীর্ণতা দূর করে বাংলা সাহিত্য,বাংলা ভাষা চর্চায় এবং নিজেদের ঐতিহ্য প্রসারে এগিয়ে আসে তবেই প্রকৃত বাঙ্গালী হিসেবে আমরা গর্বিত হতে পারব। আমাদের ছেলে মেয়েদের অনুপ্রেরণা যুগিয়ে আত্মসন্ধানী মননে প্রগতি আনতে পারব।
লেখক পরিচিতি: এম এসসি ও বি এড করে কিছুদিন শিক্ষকতা করেছিলেন। এখন ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সময় পেলে কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি লেখেন - বিভিন্ন ম্যাগাজিনে সেগুলো প্রকাশিত হয়েছে। নিজের একটি ব্লগও আছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।