মাসিক বসুমতী
দীপক সেনগুপ্ত
পত্র-পত্রিকার ইতিহাসে ‘বসুমতী’ একটি অতি পরিচিত ও ইতিহ্যপূর্ণ নাম| 'বসুমতী'র অবশ্য বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন সময়ে| প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বসুমতী’র সাপ্তহিক সংস্করণ - প্রথম প্রকাশ ১৩০৩ বঙ্গাব্দের ১০ই ভাদ্র, মঙ্গলবার (১৫শে অগাষ্ট, ১৮৯৬)| সম্পাদকের নাম কোথাও মুদ্রিত ছিল না| তবে সমসাময়িক একটি লেখা থেকে জানা যায় –“প্রথমে শ্রী ব্যোমকেশ মুস্তফী, পরে গত পৌষ হইতে শ্রী কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদক হইয়াছেন।” এরপর ‘বসুমতী’র দৈনিক সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩২১ বঙ্গাব্দের ২১শে শ্রাবণ (৬ই অগাষ্ট, ১৯১৪)| তারিখটি স্মরণীয় এই কারণে যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার দু’দিন পরেই বের হয় দৈনিক পত্রিকাটি| ‘বসুমতী’ বার্ষিক হিসাবেও বেরিয়েছিল ১৩৩২ ও ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের পূজোর সময়; সম্পাদক ছিলেন সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ| ১৩৩৪-এর সংখ্যাটি বের হয় সতীশচন্দ্রের সম্পাদনায়| বার্ষিক সংখ্যা আরও বেরিয়েছিল কি না জানা নেই|
বর্তমান আলোচনা 'মাসিক বসুমতী' পত্রিকা নিয়ে| পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩২৯-এর বৈশাখ মাসে হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের সম্পাদনায়| 'প্রবাসী'র প্রকাশকাল ১৩০৮-এর বৈশাখ, 'ভারতবর্ষে'র ১৩২০-র আষাঢ় ; দু'টি পত্রিকাই শুধু দীর্ঘস্থায়ী নয়, অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল| এতৎ সত্বেও আর একটি পত্রিকার প্রয়োজন কেন হয়েছিল ? 'মাসিক বসুমতী' প্রকাশের পর তা পাঠক সমাজের কাছে আদৃত হয়েছিল কি না এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক| এর উত্তরে আপাতত এটুকু বলা যায় যে, এই পত্রিকাটি প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে পাঠককূলকে তৃপ্ত করেছে, এটির চাহিদাও ছিল যথেষ্ট| অনেকে হয় ত পত্রিকাটির 'কৌলীন্য', 'সাহিত্যমূল্য' বা 'আভিজাত্য' নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন| সেটা নিয়ে নানা মত থাকতেই পারে তবে 'মাসিক বসুমতী'র জনপ্রিয়তা ছিল প্রশ্নাতীত| পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে প্রথম সংখ্যার 'সূচনা'য় বলা হয়েছে -
উদ্দেশ্য খুবই পরিস্কার| তবে পত্রিকাটির জনপ্রিয়তার একটি কারণ অবশ্যই বিভিন্ন শ্রেণীর ও রুচির পাঠকদের উপযোগী বিষয়বস্তু ও উপাদান পরিবেশন| এ বিষয়টি স্পষ্ট করে ব্যক্ত করেছেন নিউইয়র্ক, ম্যানহাটন, ইউ.এস.এ থেকে 'বসুমতী'র একদা আগ্রহী পাঠক অর্ভিন ঘোষ তার ‘আমার যৌবন ও মাসিক বসুমতী’ নামক একটি মনোজ্ঞ স্মৃতিচারণে - "কিন্তু মাসিক বসুমতী ছিল এক 'পোর্টম্যান্টো' পত্রিকা, সেখানে ঝাল মশলা থেকে আরম্ভ করে নলেন গুড়ের সন্দেশ সবই পাওয়া যেত| অর্থাৎ বিভিন্ন স্বাদ ও রসের আকর ছিল সেই পত্রিকা| প্রত্যেক মাসে ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে তিনশ পাতার অধিক সেই পত্রিকা যখন বেরোত, তখন আমরা খোঁজ করতাম আমাদের প্রিয় লেখক-লেখিকাদের কোন লেখা বেরিয়েছে কিনা, গোগ্রাসে গলাদ্ধকরন করতাম সেই লেখাগুলি| অবশ্য অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও নীলকণ্ঠ ছিল সবারই প্রিয়, তাই কেউ নিরাশ হয়ে ফিরত না| তখন ঠিক সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার মতো মাসিক বসুমতীকেও উপেক্ষা করার উপায় ছিল না| সাহিত্য জগতে সে বিরাজ করত স্বমহিমায় ও স্বমর্যাদায়|"
ইংরেজ অধীকৃত ভারতবর্ষ তখন পরাধীনতার গ্লানিতে নিমজ্জিত| দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় একদল সাহিত্যসেবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিক তখন যথেষ্ট যত্নবান ও সচেষ্ট| সম্পাদক হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ নিজে ছিলেন একজন সাহিত্যসেবী ও সাংবাদিক| স্বাভাবিকভাবেই সেজন্য 'মাসিক বসুমতী'তে সাহিত্যের বিভিন্ন বিভাগের রচনার সঙ্গে দেশ গঠনের কর্মসূচী ও বিশ্লেষণ ঠাঁই পেয়েছে|
'বসুমতী'র স্বত্বাধিকারী সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ছিলেন রামকৃষ্ণ ভক্ত| প্রথম সংখ্যার শুরুতেই তাই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের একখানি ত্রিবর্ণ রঞ্জিত ছবি দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল| প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত রচনার সুচীপত্র ছিল এইরকম -
সম্পাদক রচিত 'পত্র সূচনা' ; কালিদাস রচিত কবিতা 'প্রথম বর্ষণ' ; রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সম্বন্ধে একটি রচনা 'শ্রীরামকৃষ্ণ' লিখেছেন দেবেন্দ্রকুমার বসু ; কবিতা 'কে ডাকে?' রচয়িতা গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ; হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত একটি দীর্ঘ কবিতা নাম 'তুষানল' ; নগেন্দ্রনাথ সেন কবিভূষণের দু'টি কবিতা 'বুরহানপুরে' ও 'আওরঙ্গাবাদে' ; লণ্ডনের একটি উৎসবের বর্ণনা (সচিত্র) 'লণ্ডনে জয়োৎসব' ( লেখকের নাম নেই ) ; স্বর্ণকুমারী দেবীর ধারাবাহিক রচনা 'মিলন-রাত্রি' ; ধারাবাহিক ধর্ম্ম সম্বন্ধীয় রচনা 'মুক্তি ও ভক্তি' লিখেছেন প্রমথনাথ তর্কভূষণ ; নামহীন লেখকের কবিতা 'বৈশাখ' ; এরপর ছিল 'নারী মন্দির' বিভাগে 'নারীত্ব' শিরোনামে প্রাচ্যের আদর্শ অনুসারে নারীর কর্তব্য সম্বন্ধে রচিত প্রবন্ধ, লিখেছেন সত্যেন্দ্রকুমার বসু ; ভবানীচরণ লাহা অঙ্কিত 'দিনের বেসাতি' নামে একটি নারীচিত্র ; 'বঙ্গনারীর কাজ' লিখেছেন মনোরমা ঘোষ ; এর পর রয়েছে 'সমান অধিকার' নামাঙ্কিত একটি চিত্র, শিল্পী 'কল্লোল' খ্যাত দীনেশরঞ্জন দাশ ; প্রতিভা দেবীর সম্বন্ধে একটি লেখা অজ্ঞাতনামা লেখকের ; বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের লেখা 'বাঙ্গালীর প্রতি নববর্ষের সম্ভাষণ' ; দীনেশরঞ্জন দাশ অঙ্কিত একটি ব্যঙ্গচিত্র 'সবুরে মেওয়া ফলে' ; ক্ষিরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'গুহামধ্যে' ; পূর্ণচন্দ্র দে'র কবিতা 'উদ্ভট সাগর' ; নামহীন লেখকের ঐতিহাসিক সৌধ অবলম্বনে সচিত্র রচনা 'স্মৃতিসৌধ' ; কুমুদরঞ্জন মল্লিকের কবিতা 'গর্দ্দানমারী' ; সম্পাদক রচিত ধারাবাহিক উপন্যাস 'যেদিদা' ; একটি কবিতা 'ওমরের পথে' ; কৃষি ও বাণিজ্যের সংবাদ নিয়ে লিখেছেন শচীন্দ্রনাথ মল্লিক ; অমৃতলাল বসুর রম্যরচনা 'চরকা' ; 'আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্রের গ্রামে চরকার কেন্দ্র' শিরোনামে একটি ফটো ; 'য়ুরোপের বর্ত্তমান সমস্যা' নামে দীর্ঘ রচনা লিখেছেন বিপিনবিহারী গুপ্ত ; 'দারিদ্র্য' নামে কবিতা লিখেছেন কালিদাস রায় ; সরোজনাথ ঘোষের গল্প 'ভিক্ষা' ; এর পরে পরিবেশিত হয়েছে 'বঙ্গীয়-সাহিত্য-সম্মেলন-মেদিনীপুর' শিরোনামে ত্রয়োদশ অধিবেশনের সাহিত্য-শাখার সভাপতির অভিভাষণ - ধারাবাহিকভাবে পরিবেশন করেছেন ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ; প্রসন্নময়ী দেবীর কবিতা 'উপহার' ; সত্যচরণ লাহার পানকৌড়ি পাখিকে নিয়ে রচনা 'পানকৌড়ি', সঙ্গে রয়েছে ভবানীচরন লাহা অঙ্কিত 'পানকৌড়ির প্রেমালাপ' নামে একটি চিত্র ; রয়েছে কাজি নজরুল ইসলাম রচিত একটি কবিতা 'তূর্য্য-নিনাদ'| এর পর স্থান পেয়েছে সচিত্র 'চয়ন' বিভাগে দেশ বিদেশের বিভিন্ন বিভাগের খবরাখবর ; প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ধারাবাহিক গল্প 'অদৃষ্ট-পরীক্ষা' ; একটি ব্যঙ্গচিত্র 'ভারত সরকারের বাজেট' ; সচিত্র সম্পাদকীয় বিভাগে রয়েছে ভারতের আয়-ব্যয়ের হিসাব ও দেশী-বিদেশী বহু নাম করা ব্যক্তিত্বের পরিচয় ; স্বামী ব্রহ্মানন্দকে নিযে লিখেছেন সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যয় স্বয়ং; সবশেষে রযেছে 'মাসপঞ্জী' বিভাগে বৈশাখ মাসের বিশেষ বিশেষ ঘটনা|
১৩৬ পৃষ্ঠা ব্যাপী বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে সমসাময়িক নাম করা লেখকদের রচনা সমৃদ্ধ হয়ে প্রকাশিত হয়েছে 'মাসিক বসুমতী'র প্রথম সংখ্যাটি| বলা বাহুল্য অতি সহজেই এটি পাঠক সমাজের সমাদর লাভ করে| প্রথম সংখ্যা থেকেই যে পত্রিকাটি সমাদৃত হয়েছিল তার প্রমাণ এই যে সংখ্যাটির প্রথম মুদ্রণের ৫ হাজার কপি এক সপ্তাহের মধ্যে নিঃশেষিত হয়ে গিযেছিল এবং চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে দ্বিতীয় সংখ্যার ১০ হাজারের সঙ্গে প্রথম সংখ্যাটির আরও ৫ হাজার কপি ছাপা হয়েছিল| হেমেন্দ্রপ্রসাদের কৃতিত্ব হল নামকরা বহু লেখককে তিনি তার পত্রিকার জন্য লিখতে রাজী করিয়েছিলেন| প্রথম সংখ্যার লেখক-সূচী থেকেই এই প্রচেষ্টার প্রমাণ মেলে| 'চয়ন' নামক আকর্ষণীয় বিভাগটিতে সমসাময়িক রাজনীতির আলোচনা, দেশ-বিদেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কাহিনী থাকত| নানা কাজে ব্যবহৃত নব আবিষ্কৃত যন্ত্রের সচিত্র পরিচয়ও থাকত এই বিভাগটিতে|
হেমেন্দ্রপ্রসাদ কিন্তু বেশীদিন সম্পাদক হিসাবে কাজ করেন নি| অত্যধিক কাজের চাপে তিনি ১৩৩০-এর অগ্রহায়ণ মাসের পরে দায়িত্ব থেকে অব্যহতি নেন| এর পর সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় স্বয়ং| রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ সতীশচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গী হেমেন্দ্রপ্রসাদের থেকে অন্যরকম ছিল| তিনি ছিলেন গোঁড়া হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী| পত্রিকার নাম কিছুটা পরিবর্তন করে তিনি 'সচিত্র মাসিক বসুমতী' রাখেন| প্রচ্ছদেরও পরিবর্তন ঘটে| আগে ছিল একটি বিশ্বগোলকের ছবি, সেটা পরিবর্তিত হয়ে হ’ল একটি শিশুকে স্তন্য দানরত মাতৃমূর্তি, এঁকেছেন শিল্পী হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার| তবে সামগ্রিকভাবে পত্রিকার মানের অবনতি হয়েছিল বলে মনে হয় নি| ১৩৩১-এর কার্ত্তিক মাস পর্যন্ত সতীশচন্দ্র একাই সম্পাদনার কাজ দেখাশোনা করেছেন; অগ্রহায়ণ থেকে তার সঙ্গে যুক্ত হন সত্যেন্দ্রকুমার বসু| পত্রিকার শুরুতেই যে স্তন্যদানরত মাতৃমূর্তি ছিল, তার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে|
সতীশচন্দ্র ও সত্যেন্দ্রকুমারের সম্পাদনাকালে রবীন্দ্রনাথের লেখা 'মাসিক বসুমতী'তে প্রকাশিত হতে শুরু হয়| ১৩৩৪-এ প্রকাশিত হয় নাটক 'নটীর পূজা', 'শেষরক্ষা' ও 'ঋতুরঙ্গ'| কয়েকটি গানও ছাপা হয়েছিল| রবীন্দ্রনাথের 'বিলাতের স্মৃতি' ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৫-এর বৈশাখ থেকে ১৩৩৬-এর শ্রাবণ পর্যন্ত| তবে গোঁড়া হিন্দুধর্মের সমর্থক সতীশচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের উদার দৃষ্টিভঙ্গীর সমন্বয় দীর্ঘস্থায়ী হয় নি| হিন্দু ধর্মের কিছু কিছু আচরণ ও অনুশীলন রবীন্দ্রনাথের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় নি| গান্ধীজীর নীতিকেও তিনি সম্পূর্ণ মেনে নিতে পারেন নি| এ সব নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে 'বসুমতী'র দূরত্ব তৈরী হয়| সমালোচনামূলক বেশ কিছু প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের মত ও দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতিবাদ জানিয়ে| যেমন, 'বিশ্বকবির অনধিকার চর্চ্চা'য় (ফাল্গুন, ১৩৩৯) যতীন্দ্রমোহন সিংহ রবীন্দ্রনাথের ধর্ম্মমতের সমালোচনা করে লিখেছেন - "সকলেই জানেন, স্মরণাতীত কাল হইতে হিন্দুশাস্ত্রে ঈশ্বরপ্রাপ্তির দুইটি প্রশস্ত মার্গ প্রচলিত রহিয়াছে, তাহার একটির নাম জ্ঞানমার্গ, অপরটির নাম ভক্তিমার্গ| যাহাকে কর্ম্মযোগ বলে তাহা এই দুইটি মার্গের সহায়| জ্ঞানমার্গের সাধক প্রধানতঃ বিষয়বৈরাগ্য অবলম্বন করিয়া নিজের আত্মার মধ্যে পরমাত্মার সন্ধান করেন, আর ভক্তিমার্গের সাধক ভগবানকে 'রসো বৈ সঃ' জানিয়া সেই রস-স্বরূপে আপন চিত্তবৃত্তি নিমজ্জিত করেন| কিন্তু আমাদের এই আধুনিক ঋষি ইহার কোন মার্গই পছন্দ করেন না| .... আবার এখন বলিতেছেন "কি জানি আমার প্রকৃতির কাছে এই ভক্তির মাতামাতি, এই হৃদয়াবেগের আবর্ত্তিত নিরর্থকতা একান্ত অরুচিকর|" .... “এখানে ব্রাহ্মবন্ধুগণকে বলি, আপনারা শুনিয়া রাখুন, আপনাদের ব্রাহ্মসমাজের চূড়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করিতেছেন যে, যাহারা উপাসনা মন্দিরে খোল-করতাল-সহযোগে ব্রহ্মসঙ্গীত গাইতে গাইতে ভক্তির উচ্ছ্বাসে মাতামাতি করেন - কেহ বা প্রেমাশ্রু ধারায় ধরাতল অভিষিক্ত করেন, 'বিধাতা তাদের হারালেন' - অর্থাৎ তাঁহাদের ব্রহ্ম-প্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা নাই| রবীন্দ্রনাথের বর্ত্তমান খেয়াল অনুসারে, মানুষের সেবাই ঈশ্বরের প্রসন্নতা লাভের একমাত্র পন্থা| কিন্তু বর্ত্তমান যুগে এই সেবা-ধর্ম্মের প্রবর্ত্তক কে? আমরা জানি স্বামী বিবেকানন্দ| রবীন্দ্রনাথ কি তবে এই শেষ বয়সে স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য হইলেন ?" ... ইত্যাদি| এ ধরণের আরও অনেক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যেমন - 'রবীন্দ্র বিদূষণ' (কার্ত্তিক, ১৩৩৯); 'গোড়ার কথা ও শেষের কবিতা' (অগ্রহায়ণ, ১৩৩৯); 'বিশ্ববিদ্যালয ও বিশ্বকবি' (ভাদ্র, ১৩৩৯); 'বিশ্বকবির কারুণ্যোচ্ছ্বাস' (অগ্রহায়ণ, ১৩৪২) ইত্যাদি|
১৩৪০-এর চৈত্র মাস পর্যন্ত সহকারী সম্পাদকের কাজ চালিয়ে সত্যেন্দ্রকুমার বসু বিদায় গ্রহণ করেন| ১৩৪১ বঙ্গাব্দ থেকে সতীশচন্দ্র একাই সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৩৫০-এর চৈত্র অবধি তিনি সফলতার সঙ্গে এই কাজ চালিয়ে গেছেন| ১৩৪১-এর বৈশাখ থেকে পত্রিকার সূচীপত্রের বিন্যাসে কিছু পরিবর্তন লক্ষিত হয়| সূচীপত্রটিকে বিষয় অনুসারে সাজানো হয়েছে; যেমন 'ধর্ম্ম প্রবন্ধ', 'সাহিত্য সন্দর্ভ', 'শিক্ষা নিবন্ধ', 'ঐতিহাসিক প্রবন্ধ', 'রাজনৈতিক প্রসঙ্গ', 'চয়ন', 'স্বরলিপি', 'নাট-চিত্র', 'অশ্রু-অর্ঘ্য', 'শিকার কাহিনী', 'কবিতা', 'সাময়িক প্রসঙ্গ', 'বৈদেশিক প্রসঙ্গ' - এই কয়টি বিভাগে বিন্যস্ত ছিল ১৩৪১-এ প্রকাশিত রচনার বিষয়ানুক্রমিক সূচী| এতে নির্দিষ্ট বিষয় থেকে কাঙ্ক্ষিত রচনাটি নির্বাচন করতে পাঠকদের অনেক সুবিধা হত| এই বিভাগুলি এবং প্রকাশিত রচনা থেকে বিষয়বস্তুর ব্যপ্তি কিছুটা অনুমান করা যায়| সমস্ত রচনাগুলি যথাযথ সাজিয়ে পত্রিকাটি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশ করতে সম্পাদককে কি অসাধারণ পরিশ্রম করতে হত তা সহজেই অনুমেয়|
সতীশচন্দ্র ছিলেন একজন গোড়া হিন্দু ও রামকৃষ্ণ ভক্ত| স্বাভাবিক ভাবেই শাস্ত্র ও ধর্ম সম্বন্ধীয় বহু নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে 'মাসিক বসুমতী'তে| সতীশচন্দ্রের মৃত্যু হয় ১৩৫১-এর ১৩ই বৈশাখ| তার মৃত্যুর পর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সাহিত্যিক অধ্যাপক যামিনীমোহন কর| সহযোগী হিসাবে পেয়েছিলেন সতীশচন্দ্রের জামাতা প্রাণতোষ ঘটককে| এই সময়ে পত্রিকার একটি দিক পরিবর্তন ঘটে| নতুন যুগের লেখকদের লেখা অনেক বেশী সংখ্যায় ছাপা হতে থাকে|
কবিতা লিখেছেন জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সজনীকান্ত দাস, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে এবং আরও অনেকে| উপন্যাস বেরিয়েছে গজেন্দ্রকুমার মিত্রের 'রাত্রির তপস্যা' ; সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের 'স্রোত বহে যায়' ; প্রতিভা বসুর 'সেতুবন্ধ' ; বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের 'স্বর্গাদপি গরিয়সী' ; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ঝড় ও ঝরাপাতা' ; পঞ্চানন ঘোষালের 'রক্তনদীর ধারা' ; মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নগরবাসী', 'মাটি' ; রঞ্জনের (নিরঞ্জন মজুমদার) 'শীতে উপেক্ষিতা' ও 'অন্তরা' ; বিক্রমাদিত্যের (অশোক গুপ্ত) 'দেশে দেশে' ; আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের 'পঞ্চতপা' ও 'নার্স মিত্র' ; সতীনাথ ভাদুড়ীর 'মীনাকুমারী' প্রভৃতি| যাযাবরের (বিনয় মুখোপাধ্যায়) বিখ্যাত উপন্যাস 'দৃষ্টিপাত' প্রকাশিত হতে থাকে ১৩৫২-এর শ্রাবণ সংখ্যা থেকে| গল্প লিখেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, অন্নদাশঙ্কর রায়, নরেন্দ্র মিত্র, হেমেন্দ্রকুমার রায়, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ| প্রবন্ধ লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সৈয়দ মুজতবা আলী, মেঘনাদ সাহা ও অন্যান্য বহু বিশিষ্ট লেখক| সুভাষচন্দ্র বসুর কিছু মূল্যবান লেখা স্থান পেয়েছে ১৩৫২-এর শ্রাবণ সংখ্যায়|
কিছু কিছু অনুবাদও বেরিয়েছে, যেমন 'দি গুড আর্থ'-এর অনুবাদ করেছেন শিশিরকুমার সেনগুপ্ত ও জয়ন্ত কুমার ভাদুড়ী; লু রচিত 'কুঙ ই-চি' অনুবাদ করেছেন পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়; এডগার এলেন পো-র 'একটি অদ্ভুত ঘটনা' -অনুবাদক অজিত কুমার গঙ্গোপাধ্যায়; নিখিল সেন অনূদিত জেমস জয়েসের লেখা অবলম্বনে 'প্রথম প্রেম'; উইলিয়ম ফকনারের 'সন্ধ্যাসূর্য্য'-অনুবাদক মৃণালকান্তি মুখোপাধ্যায়|
যামিনীমোহনের সম্পাদনাকালে কিছু নতুন বিভাগের সূচনা হয়েছে, যেমন 'রঙ্গপট', 'অঙ্গন ও প্রাঙ্গণ', 'পত্রগুচ্ছ' ইত্যাদি| যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ‘মাসিক বসুমতী’-র এক সময়ে দূরত্ব তৈরী হয়েছিল; যামিনীমোহন কর ও প্রাণতোষ ঘটকের সম্পাদনার শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথের রচনা আবার পত্রিকায় স্থান পেয়েছে| ১৩৫৪-এর বৈশাখে ছাপা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার তলে’, রবীন্দ্রনাথের প্রদত্ত ভাষণের অমিয় চক্রবর্ত্তী কর্ত্তৃক শ্রুতিলিখিত অপ্রকাশিত রচনা ‘মানব সাধনা’| বৈশাখ সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছে ক্ষিতিমোহন সেনের প্রবন্ধ ‘মানবতা-ধর্ম্ম ও রবীন্দ্রনাথ’| জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় বেরিয়েছে প্যারীমোহন সেনগুপ্তের প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথ মহাকবি কি না’, আষাঢ় সংখ্যায় ‘অঙ্গন ও প্রাঙ্গণ’ বিভাগে প্রকাশিত হয়েছে কিরণশশী দে’র রচনা ‘রবীন্দ্রনাথের গান’; শ্রাবণ সংখ্যায় লেখা হয়েছে নৃপেন্দ্রগোপাল মিত্রের রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবিতা ‘রবীন্দ্রনাথ’|
১৩৫৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যা থেকে প্রাণতোষ ঘটক একাই সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন| এই সময়ে কয়েকটি নাম করা ধারাবাহিক রচনা 'মাসিক বসুমতী'তে প্রকাশিত হয়| এর মধ্যে রয়েছে অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের 'পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ' ও 'পরমাপ্রকৃতি শ্রীশ্রীসারদামণি', 'অখণ্ড অমিয় শ্রীগৌরাঙ্গ' ; মনোজ বসুর 'চীন দেখে এলাম' ও 'সোবিয়েতের দেশে দেশে' ; সজনীকান্ত দাসের 'আত্মস্মৃতি' ; রাহুল সাংকৃত্যায়নের 'ভলগা থেকে গঙ্গা' (অনুবাদ) ; পরিমল গোস্বামীর 'স্মৃতিচিত্র' ; সম্পাদক প্রাণতোষ ঘটকের 'আকাশ পাতাল'|
১৩৬০-এর ভাদ্র সংখ্যা থেকে চালু হয় একটি অধ্যায় 'চারজন'| এর মাধ্যমে একটি প্রচেষ্টা ছিল চারজন কৃতী বাঙালীর সঙ্গে পাঠকবর্গের পরিচয় ঘটানো, যাদের সম্বন্ধে অনেকেরই হয় ত জানা নেই| আর একটি বিভাগ 'ছোটদের আসর' ছোট ছেলেমেযেদের কাছে খুবই প্রিয় ও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল| এতে লিখতেন যাদুকর পি.সি.সরকার, হেমেন্দ্রকুমার রায়, ইন্দিরা দেবী, শৈল চক্রবর্ত্তী, হরিনারায়ন চট্টোপাধ্যায়, মণীন্দ্র দত্ত, যামিনীমোহন কর প্রমুখ|
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেশ কিছু প্রবন্ধ এই সময়ে প্রকাশিত হয়েছে; যেমন জয়দেব রায়ের 'রবীন্দ্রনাথ ও পাশ্চাত্ত্য সঙ্গীত' (চৈত্র, ১৩৫৭) ; তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রনাথ ও সাহিত্যের বাস্তবতা' (ভাদ্র, ১৩৬০) ; সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের 'রবীন্দ্রনাথ ও অসমীয়া সাহিত্য' (চৈত্র, ১৩৬৭) ; শশীভূষণ দাশগুপ্তের 'টলস্টয়, গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ' (আষাঢ়, শ্রাবণ, ১৩৬৮) ; ডঃ নরেশচন্দ্র ঘোষের 'রবীন্দ্রনাথের স্বদেশচিন্তা' (কার্ত্তিক, ১৩৬৮) ; চিত্তরঞ্জন দেবের ''য়েট্স ও রবীন্দ্রনাথ' (মাঘ, ১৩৭২) প্রভৃতি|
'মাসিক বসুমতী'র কয়েকটি বিভাগের উল্লেখ করতেই হয়| একটির উল্লেখ আগেই করা হয়েছে, সেটি হল 'অঙ্গন ও প্রাঙ্গণ'| এখানে শুধু মহিলা লেখকেরাই বিভিন্ন বিষয়ে তাদের লেখা প্রকাশ করতেন| লেখিকাদের মধ্যে রয়েছেন - আশা দেবী, বেলারাণী দেবী, অমিয়া দেবী, ক্ষণপ্রভা ভাদুরী, সুলতা সেনগুপ্তা, কিরণশশী দে, রুচিরা বসু, আশাপূর্ণা দেবী, শান্তি দেবী, বিভাবতী বসু প্রমুখ| অবশ্য এরা পরবর্তী কালে সবাই যে সাহিত্যক্ষেত্রে খুব প্রাসঙ্গিক ছিলেন এমন নয়| অন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ হল 'আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি' ও 'সাময়িক প্রসঙ্গ'| 'সাময়িক প্রসঙ্গে' সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ পরিবেশিত হত| বিখ্যাত ব্যক্তিদের পরলোক গমনের খবরও সংযোজিত হত মাঝে মাঝে, সঙ্গে থাকত সংক্ষিপ্ত পরিচিতি| শোক সংবাদ পরিবেশনের জন্য 'অশ্রু-অর্ঘ্য' নামে একটি বিভাগ তৈরী হয়েছিল পরে| 'আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি'তে থাকত সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা| অনেক মাসিক পত্রিকা তখন রাজনৈতিক-প্রসঙ্গ এড়িয়ে চলত, সম্ভবত সাহিত্য-পত্রিকার বিশুদ্ধতা বজায় রাখার জন্য| হয় ত এ কারণেই 'মাসিক বসুমতী' বিশুদ্ধ সাহিত্য-পত্র হিসাবে অনেকের কাছে মর্য্যদা লাভ করে নি| হতে পারে, তবে কোন পাঠক যদি সাহিত্যের বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ের রসাস্বাদন করতে বা বিশ্ব পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী হতেন তবে 'মাসিক বসুমতী' ছিল অবশ্য পঠনীয় ও সংগ্রহযোগ্য| দৃষ্টান্ত স্বরূপ ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ ও ‘আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি’ - এই দুটি বিভাগে আলোচিত কিছু বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে| 'সাময়িক প্রসঙ্গে' আলোচিত কিছু বিষয় হল 'ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা' ; 'কলিকাতার মেয়র নির্ব্বাচন' ; ‘বোম্বাই ডকে বিস্ফোরণ’ ; ‘মংপুতে রবীন্দ্র স্মৃতিপূজা’ ; 'ফরিদপুর অনাথ আশ্রম' ; 'বাঙ্গালী-ছাত্রদের জন্য বৃত্তি' ; 'কাঁথি কলেজে সরকারী সাহায্য' ইত্যাদি| 'আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি'তে প্রকাশিত কিছু বিষয় হল 'আমেরিকা কোন পথে?' ; 'ইন্দোচীনের স্বাধীনতা সংগ্রাম' ; 'চীনের আর্থিক দুর্গতি' ; 'কোরিয়ার ভবিষ্যৎ' ; 'হিটলার কোথায়?' ; 'অর্থনীতিক দাসত্ব' ; 'পদানত ও অধিকৃত জার্মানী' ; 'কংগ্রেস ও গান্ধীজী' ইত্যাদি| সূচীপত্রে বিষয়-বিভাগের মাঝে মাঝেই পরিবর্তন ঘটত| 'আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি'র পরিবর্তে 'রাজনীতি প্রসঙ্গ' পরিবেশিত হয়েছে কোন কোন সময়ে| তবে প্রকাশনা কালের শেষের দিকে সূচীপত্র সম্বলিত পৃষ্ঠার মধ্যে বিজ্ঞাপনের উপস্থিতি পীড়াদায়ক|
'বসুমতী সাহিত্য মন্দির'-এর প্রতিষ্ঠাতা উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় রামকৃষ্ণ ভক্তদের অন্যতম| ‘কথামৃত’তেও উপেন্দ্রনাথের নাম উল্লেখিত হয়েছে| তার পুত্র সতীশচন্দ্রও ছিলেন রামকৃষ্ণ ভক্ত| সঙ্গত ভাবেই ঠাকুর রামকৃষ্ণ বিষয়ক বহু রচনা পত্রিকাতে স্থান পেয়েছে| প্রাণতোষ ঘটকের সম্পাদনাকালে যেমন 'বসুমতী'র উল্লেখযোগ্য মানোন্নয়ন ঘটে, পত্রিকার জনপ্রিয়তা অধোগতি শুরু হয় কিন্তু তার সময় থেকেই| ১৩৭০ বঙ্গাব্দের কাছাকাছি সময়ে পত্রিকার উৎকর্ষও নিম্নমুখী হয়েছিল| এক সময়ে জনপ্রিয় লেখকেরা তাদের রচনা-সম্ভার দিয়ে যে পত্রিকাটি অলঙ্কৃত করেছিলেন - ছাপা হয়েছিল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'আজকাল পরশুর গল্প' ; শৈলজানন্দের 'কয়লাকুঠি' ; যাযাবরের 'দৃষ্টিপাত' ; অচিন্ত্যকুমারের ‘পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ' ; শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'চুয়াচন্দন', 'রক্তসন্ধ্যা', 'সীমান্ত হীরা' এবং অন্যান্য বহু খ্যাতিমান লেখকদের সাড়া জাগানো গল্প ও উপন্যাস - কালের গতিতে সেই পত্রিকাটিই ক্রমশঃ স্তিমিত হয়ে পড়ে| জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে 'মাসিক বসুমতী'তে সন্নিবেশিত হয়েছে 'মাসিক রাশিফল', 'সচিত্র বোম্বাই সমাচার' প্রভৃতি বিভাগ, এমন কি যৌন বিজ্ঞান বিভাগটিও| ১৩৭৭-এর শ্রাবণ মাসে সম্পাদক প্রাণতোষ ঘটকের মৃত্যু ঘটে| পরবর্তী সম্পাদক হন বিজনকুমার সেন, কিন্তু পত্রিকার প্রচার সংখ্যা আর ঊর্দ্ধমুখী করা যায় নি|
সতীশচন্দ্রের একক সম্পাদনা কালে 'মাসিক বসুমতী' পত্রিকার নাম পরিবর্তিত হয়ে হয়েছিল 'সচিত্র মাসিক বসুমতী'| তবে এই নাম বরাবর পত্রিকায় ছাপা হয় নি, কিন্তু বিপুল সংখ্যক ছবি স্থান পেয়েছে প্রতি সংখ্যায়| চিত্রসূচীও বিষয়ানুক্রমিক সাজানো হয়েছে, কিন্তু প্রতি সংখ্যাতেই একই রকম বিভাগে বিভক্ত হয় নি| 'মাসিক বসুমতী' প্রকাশিত হত বর্ষ সংখ্যা অনুসারে প্রতি বর্ষে দুটি খণ্ড হিসাবে| বৈশাখ থেকে আশ্বিন প্রথম খণ্ড এবং কার্ত্তিক থেকে চৈত্র দ্বিতীয় খণ্ড| একটি বর্ষের প্রথম খণ্ডে প্রকাশিত চিত্রের বিভাগগুলি ছিল এই রকম - 'সুরঞ্জিত চিত্র' (১৮) ; 'দেবদেবীর চিত্র' (৪) ; 'দেশনায়কগণের চিত্র' (২৯) ; 'বিশিষ্টগণের চিত্র' (২৭) ; 'ভারতীয় নারীচিত্র' (২) ; 'বিভিন্ন দেশের নর-নারী' (১০৪) ; 'কাহিনীর চিত্র' (৭) ; 'ঐতিহাসিক চিত্র (১০) ; 'অভিনয়-চিত্র' (৮) ; 'বৃক্ষলতা চিত্র' (৯) ; প্রাণী-চিত্র' (৭) ; 'ব্যঙ্গচিত্র' (১) ; 'সাময়িক চিত্র' (১৯) ; 'বৈজ্ঞানিক চিত্র' (৭৫) ; ‘দৃশ্য চিত্র’ (যেমন রামকৃষ্ণ মন্দির, কাটমুণ্ডু সহর ইত্যাদি) (১৪৬)| অর্থাৎ ছ'টি সংখ্যায় প্রকাশিত চিত্র সংখ্যা ৪৬৬, তবে অধিকাংশই ফটোগ্রাফ| ছবি এঁকেছেন মিঃ টমাস, পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী, কমলাকান্ত ঠাকুর, ইন্দুভূষণ সেন, হেমেন্দ্রকুমার মজুমদার, অতুল বসু, দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোপাল ঘোষ, ঠাকুর সিং প্রমুখ চিত্রশিল্পী| মিঃ টমাস ও ঠাকুর সিং-এর অঙ্কিত কিছু চিত্র নিয়ে শালীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে, যথারীতি 'শনিবারের চিঠি' প্রকাশ করেছে ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য|
'বসুমতী' প্রসঙ্গের ইতি টানার আগে ‘১৬৬নং বহুবাজার ষ্ট্রীট’-এ (বর্তমান বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী স্ট্রিট) অবস্থিত 'বসুমতী সাহিত্য মন্দির'-এর ইতিহাস একটু জেনে নেওয়া যাক| সংস্থাটি অতি প্রাচীন এবং দীর্ঘকাল ধরে বহু দুস্প্রাপ্য এবং উৎকৃষ্ট গ্রন্থ ছেপে সুলভ মূল্যে সাহিত্য পিপাসুদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে এই প্রকাশন সংস্থাটি| এই ভবনটির ইতিহাস জানতে ঔৎসুক্য থাকাটা স্বাভাবিক| এ সম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নীচে দেওয়া হল| উল্লেখিত তথ্য সংগৃহীত হয়েছে সুনীল ঘোষ রচিত 'বসুমতী ভবনের আদিকথা' নিবন্ধ থেকে; রচনাটি ১৯৫২ খ্রীষ্টাব্দের ২রা ডিসেম্বর ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল|
প্রাণতোষ ঘটকের মৃত্যুর পর অস্থায়ী সম্পাদক বিজনকুমার সেন অনেক চেষ্টা করেও 'মাসিক বসুমতী'র প্রকাশনা চালিয়ে যেতে পারেন নি| পত্রিকাটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়| নানা বৈচিত্রের, বিভিন্ন ধরণের ও স্বাদের লেখা প্রকাশ করার জন্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় 'মাসিক বসুমতী'কে একটি 'অদ্ভুত সমন্বয় পত্রিকা' নামে চিহ্ণিত করেছেন; মনে হয় মূল্যায়নটি পত্রিকাটির চরিত্র বিশ্লেষণে যথার্থ| ধর্ম ও রাজনীতি, উদার ও রক্ষণশীল ইত্যাদি নানা বিপরীতধর্মী লেখা প্রকাশিত হয়েছে 'মাসিক বসুমতী'তে, যা সচরাচর দেখা যায় না| দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে বহু লেখকের সমাবেশ ঘটিয়ে নানা বিষয়ের রচনা প্রকাশের মাধ্যমে বিভিন্ন রুচি ও মতাবলম্বী পাঠকদের মনোরঞ্জন করে 'মাসিক বসুমতী' সাময়িক পত্রের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে থাকবে|
প্রায় চল্লিশ বছর বন্ধ থাকার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আনুকূল্যে ও আর্থিক সহায়তায় 'মাসিক বসুমতী' পত্রিকাটি ১৪১৮ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস (ফেব্রুয়ারি, ২০১২) থেকে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে| একটি পূজা বার্ষিকীও বেরিয়েছে| বর্তমান সময়ে বৃহত্তর শ্রেণীর পাঠকদের রুচি, দৃষ্টিভঙ্গী ও মানসিকতার এতটাই পরিবর্তন হয়েছে যে কোনো সামায়িক পত্রের পক্ষে সাহিত্যমূল্য বজায় রেখে ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করা সম্ভব কি না বলা শক্ত। যাই হোক, ‘মাসিক বসুমতী’র পাতায় পাতায় সমাজ-জীবন ও ইতিহাসের বহু মূল্যবান তথ্য বিধৃত রয়েছে। সেই সময়ের কথা জানতে হলে অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে বৃহৎ কলেবরের ‘মাসিক বসুমতী’র কথাও গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
সংযুক্ত প্রতিলিপি –
লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.