কল্লোল
দীপক সেনগুপ্ত
গোকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাশ, মনীন্দ্রলাল বসু ও সুনীতি দেবী - এই চার বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছিল একটি প্রতিষ্ঠান, নাম ফোর আর্টস ক্লাব| ক্লাবের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জুন| প্রত্যেকের একটি করে গল্প নিয়ে 'ঝড়ের দোলা' নামে একটি গল্পের বইও বেরিয়েছিল| একটি মাসিক পত্রিকা বের করার ইচ্ছা ফলপ্র¬¬¬সূ হবার আগেই উঠে গেল ক্লাব| 'ঝড়ের দোলা'র সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ঝড়ের মত উদ্দাম এবং যৌবনের উচ্ছ্বাস ও স্বপ্ন নিয়ে সঙ্কল্প ছিল অটুট ; প্রচলিত ধারার বাইরে বেরিয়ে নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা|
এই ভাষাতেই গোকুলের কথা শুনিয়েছেন 'কল্লোল'-এর সঙ্গে ঘণিষ্ঠভাবে যুক্ত অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত| এটা ১৩২৯ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংক্রান্তির ঘটনা|
উৎসাহ ছিল যথেষ্ট কিন্তু অভাব ছিল অর্থের| তবু 'কল্লোল' বেরিয়েছে| সাড়ে তিন টাকা দিয়ে একটা ছোট প্রেস থেকে হ্যাণ্ডবিল ছাপানোর আগেই 'কল্লোল' ছাপা শুরু হয়েছে| দীনেশরঞ্জন লিখেছেন - "ইহার পূর্ব্বেই কিছু কিছু কপি প্রেসে ছাপিতে দেওয়া হয়| বিধাতার সাহায্যে ১৩৩০-এর ১লা বৈশাখ কল্লোল ছাপিয়া বাহির হইল|" পত্রিকার আর্থিক দৈন্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অফিস ঘরও ছিল তথৈবচ| ১০/২ পটুয়াটোলা লেনে ছিল দীনেশরঞ্জনের মেজদাদা বিভুরঞ্জনের দু'কামরার বাড়ী, সেখানেই আট ফুট বাই দশ ফুট ছোট একটা ঘরে 'কল্লোল'-এর অফিস| ১৩৩১-এর ভাদ্র মাসে অফিস অবশ্য স্থানান্তরিত হয়েছিল ২৭নং কর্নওয়ালিস স্ট্রীটে কিন্তু বছর দেড়েক পরেই আবার পুরাণো ঠিকানায় ফিরে এসেছে| আমহার্স্ট স্ট্রীট ও বিবেকানন্দ রোডের সংযোগ স্থলের কাছে দীনেশরঞ্জন তার এক বন্ধুর প্রেসে ‘কল্লোল’ ছাপাবার ব্যবস্থা করেন| ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি সেখানে লোহা-লক্কড়ের দোকান হয়েছে। এর পর পত্রিকা ছাপা হয়েছে ১১১/৪ মানিকতলা ষ্ট্রিটের কোহিনূর প্রেসে, ৩৩-এ মদন মিত্র লেনের বাণী প্রেসে, ২-এ অক্রুর দত্ত লেনের রহস্য লহরী প্রেসে, ২৯-এ রামকান্ত মিস্ত্রী লেনের ক্যালকাটা প্রিন্টিং ওয়ার্কসে। এরকম বিভিন্ন ছাপাখানায় ‘কল্লোল’ ছাপা হয়েছে। একই ভাবে পত্রিকার প্রচ্ছদেরও পরিবর্তন হয়েছে বেশ কয়েকবার, তবে প্রতিটিতেই ফুটে উঠেছে “তরুণ সমুদ্র-হৃদয়ের সংঘাত, উচ্ছ্বাস, আগ্রাসন আর সীমাহীন কল্পনাভিসার|"
যে দুজনের মূল উৎসাহ ও উদ্যোগে 'কল্লোল'-এর প্রকাশ সেই গোকুলচন্দ্র নাগ ও দীনেশরঞ্জন দাশ সম্বন্ধে একটু জেনে নেওয়া যাক| সম্পাদক হিসাবে ছাপা হত দীনেশরঞ্জনের নাম, গোকুলচন্দ্র ছিলেন সহকারী সম্পাদক| কিন্তু গোকুলচন্দ্রই ছিলেন "আসল কর্ণধার"| অর্থক্লীষ্ট পত্রিকাকে বাঁচাতে বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রণ কার্যের তদারক সবই গোকুল একা সামলেছেন, লোক রাখার সামর্থ কোথায়? গোকুল ছিলেন শিল্পী| কৃতী ফটোগ্রাফারও ছিলেন তিনি| আর্ট স্কুল থেকে বেরিয়ে, প্রত্নতত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজে নিযুক্ত হয়ে পুনেতে চলে যান| বছর খানেক বাদে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন| বম্বের সলিসিটর শুকথঙ্কর ও তার স্ত্রী মালিনী গোকুলকে খুবই স্নেহ করতেন ; তাদের যত্নে তিনি সেরে উঠলেও চাকরি করার অবস্থা ছিল না| কলকাতায় ফিরে এসেও স্বস্তি নেই, বিধবা দিদি ও তার চার ছেলেমেয়ের ভার গোকুলের উপর পড়ে| দাদা কালিদাস নাগ উচ্চশিক্ষার্থে ইওরোপে| কিছুদিন বাদে দাদা ফিরে এলে প্রাণে বল এলো গোকুলের, দাদাকে খুবই ভালবাসত সে| কিন্তু বেশীদিন নয়, শিবপুরের বাড়ীতে আবার অসুস্থ হয়ে পড়ল গোকুল| সেই অবস্থাতেই চলে সাহিত্য রচনা| ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন যক্ষায় আক্রান্ত হয়েছেন গোকুল| 'কল্লোল'-এর বন্ধুরা প্রায়ই আসতেন শিবপুরের বাড়ীতে ; গভীর সহমর্মিতায় আপ্লুত করে রোজ আসতেন সাহিত্যিক পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়| ডাক্তারের পরামর্শে ঠিক হল গোকুলকে দার্জিলিঙে নিয়ে যাওয়া হবে, সঙ্গে দাদা কালিদাস নাগ; "আর কে! আছে সে ঐ একজন অশরণের বন্ধু, অগতির গতি, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়|" কাশীর ইণ্ডিয়ান প্রেসে তখন গোকুলের লেখা বই 'পথিক' ছাপা হচ্ছে| ডাকে প্রুফ পাঠানো হলে পবিত্র সেটা গোকুলকে পড়ে শোনাতেন এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন করে দেওয়া হত| 'পথিক' পরে ধারাবাহিকভাবে 'কল্লোল'-এ প্রকাশিত হয়েছিল| ১৩৩২-এর ভাদ্র মাসের শেষে গোকুলের অসুখ বেড়ে যায়; খবর পেয়েই বন্ধু দীনেশরঞ্জন ছুটলেন দার্জিলিঙে| বাকিটা পড়া যাক অচিন্ত্যকুমারের 'কল্লোল যুগ' থেকে –
দীনেশরঞ্জনের আর্থিক অবস্থাও ছিল শোচনীয়| জীবিকার তাগিদে নানা পেশা ও কর্মজীবন তাকে বেছে নিতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে| স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউয়ে শিক্ষাও ছিল অসম্পূর্ণ তিনিও ছিলেন শিল্পী ও কল্লোল পাবলিশিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা| মেট্রোপলিটন কলেজের অধ্যক্ষ সারদারঞ্জন রায়ের ছিল স্পোর্ট্স গুডসের দোকান, সেখানে কিছুদিন সেলসম্যানের কাজ করেছেন দীনেশরঞ্জন; ছেড়ে দিয়ে ওষুধের দোকানে চাকরি করেছেন| সেটাও ছেড়ে বই-এর কার্টুন আঁকা, প্রচ্ছদ তৈরীর কাজ করেছেন| ‘শনিবারের চিঠি’র প্রথম প্রচ্ছদটি দীনেশরঞ্জনেরই আঁকা| এক সময়ে অর্থের প্রয়োজনে অভিনয়ের দিকেও ঝুঁকেছিলেন তিনি|
দীনেশরঞ্জন ও গোকুলচন্দ্র ছিলেন অভিন্নহৃদয় বন্ধু| দুজনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই ‘কল্লোল’ সচল ছিল| গোকুলের অকাল মৃত্যুর পর ভগ্ন হৃদয় দীনেশরঞ্জন একাই পত্রিকা চালিয়েছেন| তবে ‘কল্লোল’ দীর্ঘজীবী হয় নি| ১৩৩০-এর বৈশাখে প্রকাশিত হয়ে শেষ সংখ্যা বেরোয় ১৩৩৬-এর পৌষে - মোট ৮১ টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়| প্রথম সংখ্যাতেই বিজ্ঞাপন বেড়িয়েছিল - 'কল্লোল' 'বংলার মাসিক গল্প-সাহিত্য'| কিন্তু কবিতা ছাপা হবে না? তা ছাড়া পত্রিকাকে সব ধরণের পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে বিষয়ের বৈচিত্র থাকতেই হবে। পাঠকসংখ্যা কম হলে অর্থাগমও হ্রাস পাবে। খেয়াল হতেই ১৩৩১-এর ভাদ্র সংখ্যার পরেই বিজ্ঞপ্তিটি পরিত্যক্ত হয়েছে| 'কল্লোল'-এ কবিতা বেরিয়েছে অজস্র, লিখেওছেন অনেকে| পত্রিকার জীবদ্দশায় প্রকাশিত মোট ৮১ টি সংখ্যার একমাত্র ১৩৩৪-এর কার্তিক সংখ্যা ছাড়া ৮০ টিতেই প্রকাশিত হয়েছে কবিতা| নামী লেখকদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ১২ টি, জীবনানন্দ ১২ টি, বুদ্ধদেব বসু ১৪ টি , অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ১৫ টি, প্রেমেন্দ্র মিত্র ৯ টি এবং নজরুল ২৯ টি কবিতা রচনা করেছেন 'কল্লোল'-এর জন্য| এ ছাড়া ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার; যতীন্দ্রমোহন বাগচী; বিজয়চন্দ্র মজুমদার; যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত; নরেন্দ্র দেব; সুনির্মল বসু; হুমায়ুন কবীর; হেমচন্দ্র বাগচী; কবি জসিমুদ্দীন; হেমেন্দ্রকুমার রায়; বনফুল; নলিনীকান্ত সরকার; সুরেশচন্দ্র ঘটক; সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়; প্রণব রায; বন্দে আলি মিয়া| মহিলাদের মধ্যে ছিলেন প্রিয়ম্বদা দেবী; সুনীতি দেবী; কুসুমকুমারী দেবী; বিভাবতী দেবী; মৈত্রেয়ী দেবী; রাধারাণী দত্ত; জ্যোৎস্নাময়ী দেবী; চামেলীপ্রভা দেবী; নীলিমা রায়; বিমলা দেবী; সুশীলাসুন্দরী দেবী; শৈলবালা সেন প্রভৃতি| প্রথম সংখ্যার প্রথম রচনাটিই দীনেশরঞ্জন দাশ রচিত 'কল্লোল' নামক কবিতা| কবিতাটির প্রথম চারটি পংক্তি হল -
নতুন স্বপ্নের উদ্দীপনা ও দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ|
রবীন্দ্রোত্তর কালের শ্রেষ্ঠ কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতিষ্ঠার পিছনে 'কল্লোল-এর ভূমিকা অনস্বীকার্য| জীবনানন্দ দাশগুপ্ত তখনও দাশ হন নি ; একদিন 'কল্লোলে' একটা কবিতা পাঠালেন, নাম ‘নীলিমা’| 'কল্লোল'-এর সঙ্গে অচিন্ত্যকুমার ছিলেন নিবিড় ভাবে সম্পৃক্ত| 'নীলিমা' কবিতাটি তার চোখে পড়ে আর সেই সঙ্গে চোখে পড়ে লেখকের ঠিকানা - বেচু চ্যাটার্জ্জি স্ট্রীট| অচিন্ত্যকুমার লিখেছেন –
‘নীলিমা’ কবিতাটি ছাপা হয়েছিল ১৩৩২-এর ফাল্গুন সংখ্যায়| 'কল্লোলে' প্রকাশিত জীবনানন্দের ১২ টি কবিতার মধ্যে শেষ কবিতা 'পাখিরা’, বেরোয় ১৩৩৬-এর বৈশাখে| মাঝে বেরিয়েছে 'মোর আঁখিজল’ (আষাঢ় ১৩৩৩); ‘কোহিনূর’ (কার্তিক ১৩৩৩); ‘শ্মশান' (পৌষ ১৩৩৩); ‘দক্ষিণা' (চৈত্র ১৩৩৩); ‘সিন্ধু' (জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৪); ‘আদিম’ (ফাল্গুন ১৩৩৪) এবং আরও কযেকটি কবিতা| জীবনানন্দ ১৩৩৪-এর পৌষ থেকেই তার পদবী দাশগুপ্ত থেকে শুধু দাশ-এ রূপান্তরিত করেন| জীবনানন্দ ছাড়াও কবি যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত ও মোহিতলাল মজুমদারকেও নবীন পাঠক সমাজে পরিচিত করতে সাহায্য করেছে ‘কল্লোল’| গদ্য ও পদ্য রচনায় সমান পারদর্শী বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন 'শাপভ্রষ্ট' (কার্তিক ১৩৩৩); 'বন্দীর বন্দনা' (ফাল্গুন ১৩৩৩) ইত্যাদি কবিতা| প্রেমেন্দ্র মিত্রের ৯ টি কবিতার মধ্যে রয়েছে 'সেথা তুমি পূর্ণ ছিলে' (ফাল্গুন ১৩৩১); 'জীবন শিয়রে বসি স্বপ্ন দেয় দোল' (চৈত্র ১৩৩১); 'উদ্বেলিত যৌবনের সিন্ধুতীরে' (বৈশাখ ১৩৩২); 'বেনামী বন্দর' (ভাদ্র ১৩৩৩) ইত্যাদি| 'কল্লোল যুগের' অচিন্ত্যকুমার 'কল্লোল'-এ লিখেছেন বেশ কয়েকটি কবিতা, যেমন 'অনাগত কবি’; 'চাষা’; 'সূর্য’; 'ঝটিকা’; 'সব পুড়ে ছাই' ইত্যাদি| সঙ্গে রয়েছে বিতর্কিত কবিতা 'গাব আজ আনন্দের গান’, বেরিয়েছিল আষাঢ় ১৩৩৩ সংখ্যায়| তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতাও ছাপা হয়েছে| তবে তারাশঙ্কর 'কল্লোল'-এ লিখেছেন, প্রশংসিতও হয়েছেন কিন্তু একটু দূরে দূরেই থেকেছেন ; 'কল্লোল'-এর অন্তরঙ্গ হয়ে উঠতে পারেন নি তিনি| বিষ্ণু দে ও অজিত চক্রবর্তী তুলনামূলক ভাবে কমই লিখেছেন|
'কল্লোল' সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গী কি ছিল? 'কল্লোল'-ই বা রবীন্দ্রনাথকে কতটা এবং কি ভাবে গ্রহণ করেছিল? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে নজরুলের কবিতা এবং একটি প্রাসঙ্গিক বিষয় আলোচনা করা যাক| নজরুলের কবিতায় অনেক সময়েই বিদ্রোহী মনের দৃপ্ত প্রকাশ ঘটেছে| তার কবিতাই 'কল্লোল'-এ প্রকাশিত হযেছে সর্বাধিক, ঊনত্রিশটি| তার 'সৃষ্টি সুখের উল্লাসে' একটি বিখ্যাত কবিতা, সকলেই পড়েছেন -
নজরুল তখন কারারুদ্ধ| কারাকক্ষের অন্তরালেই রচিত এই কবিতা 'কল্লোল'-এ প্রকাশের জন্য লাল কালিতে লিখে পাঠান নজরুল| "কবিতাটির জন্য পাঁচটাকা দেওয়া হযেছিল| জেলে সেই টাকা পবিত্র (পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়) পৌঁছে দিয়েছিল নজরুলকে|" নজরুলের একটি কবিতা 'সর্ব্বনাশের ঘণ্টা' 'কল্লোল'-এ ছাপা হয়েছিল ১৩৩১-এর কার্তিক সংখ্যায়| কবিতাটির অসামান্যতা তেমন নেই, কিন্তু এটি সাময়িক পত্র গবেষকরা অনেক সময়েই উল্লেখ করেছেন; কারণ এর পিছনে রয়েছে একটি কৌতূকপ্রদ ঘটনা| 'মানসী' পত্রিকার ১৩২১ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় মোহিতলাল মজুমদার 'আমি' নামাঙ্কিত একটি কবিতা রচনা করেছিলেন| এর পর ১৩২৮-এর পৌষ সংখ্যার 'বিজলী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নজরুলের সাড়া জাগান কবিতা 'বিদ্রোহী'| এটি ছিল -
'বিদ্রোহী' কবিতার সঙ্গে 'আমি' কবিতাটির ভাবগত মিল থাকায় মোহিতলাল ক্ষুব্ধ হন এবং তার সেই ক্ষোভের কথা নজরুল জানতে পারেন| এর পর 'শনিবারের চিঠি'-র ৪ঠা অক্টোবর ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে পূজা সংখ্যায় 'বিদ্রোহী' কবিতাটির একটি প্যারোডি প্রকাশিত হয়| কবিতাটির কয়েকটি পংক্তি ছিল -
কবিতাটিতে কোন লেখকের নাম ছিল না এবং এখানেই হল বিপত্তি| নজরুল ধরে নিলেন কামস্কাট্কীয় অসম ছন্দের এই প্যারোডিটি মোহিতলালের রচনা| আসলে এটি লিখেছিলেন সজনীকান্ত দাস| মোহিতলালের লেখা ধরে নিয়ে তীব্র অভিমানে ব্যঙ্গ রচনার মাধ্যমে উত্তর না দিয়ে নজরুল শ্রদ্ধা ও সমর্থন জানিয়ে মোহিতলালের উদ্দেশ্যে লেখেন 'সর্ব্বনাশের ঘন্টা'| কবিতাটি ছিল -
অনেকে আবার ভেবে নিয়েছিলেন কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে লেখা| হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ এ ব্যাপারে কি করে প্রাসঙ্গিক হলেন তার কারণ বোঝা শক্ত| তবে সাহিত্য ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সর্বব্যাপী প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করে সাহিত্য রচনা করার সচেতন প্রয়াস ‘কল্লোলে’র লেখকদের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল। যাই হোক 'সর্ব্বনাশের ঘন্টা' প্রকাশিত হয় ১৩৩১-এর কার্ত্তিক সংখ্যায়| পত্রিকার অগ্রহায়ণ সংখ্যাতেই 'মনলোক' বিভাগে এ নিয়ে লেখা হয়েছে –
আসল ব্যাপারটি পরে জানা গিয়েছিল, এবং এ নিয়ে মোহিতলালের সঙ্গে নজরুলের সাময়িক দূরত্ব তৈরী হয়েছিল|
জসিমুদ্দীন ছিলেন পল্লীবাংলার কবি| তার কবিতায় গ্রামের জীবন ও প্রকৃতির ছাপ স্পষ্ট| তার লেখা 'কবর' ও 'রাখালী' কবিতা 'কল্লোলে'-ই প্রথম প্রকাশিত হয়| অচিন্ত্যকুমার তার 'কল্লোল যুগ'-এ জানিয়েছেন –
"এমনি একটি কবিতা গেঁয়ো মাঠের সজল শীতল বাতাসে উড়ে আসে 'কল্লোলে'|”
কবিতাটির নাম 'কবর'| বাংলা কবিতার দিগদর্শন| কল্লোলের পৃষ্ঠা থেকে সেই কবিতা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা-পরীক্ষার বাংলা পাঠ-সংগ্রহে উদ্ধৃত হল!" কিন্তু এই সঙ্গে অচিন্ত্যকুমার জানিয়েছেন অস্বস্তিকর একটি খবর - "কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভ্রম বাঁচাতে গিয়ে অনভিজাত 'কল্লোলের' নামটা বেমালুম চেপে গেলেন|"
এ ত গেল কবিতার কথা| এখন কোন কোন রচনা নিয়ে ‘কল্লোলে’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল দেখা যাক - 'কল্লোল'(কবিতা)-দীনেশরঞ্জন দাশ; ‘বীণা’(গল্প)-সুনীতি দেবী; ‘মা’ (গল্প)-শৈলজানন্দ মূখোপাধ্যায়; ‘কল্লোল’(কথিকা)-বিজয়চন্দ্র মজুমদার; ‘রিক্তা’(গল্প)-কেতকী দেবী; ‘সংগ্রহ’(সুভাষিত সংগ্রহ); ‘পুঁটেরাম’(গল্প)-নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত; ‘পথিক’(উপন্যাস)-গোকুলচন্দ্র নাগ; ‘ফুলের আকাশ’(গল্প)-দীনেশরঞ্জন দাশ; ‘ভাঙ্গাবাড়ী’(গল্প)-অমলেন্দু সেনগুপ্ত; ‘বিড়ালের স্বর্গ’(অনুবাদ গল্প, মূলঃ Emile Zola)- পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়; ‘বসন্তবিলাপ’(কবিতা)-দীপঙ্কর (কালিদাস নাগ)। সংগ্রহ পর্য্যায়ে ছিল বিভিন্ন সাহিত্যিকের রচনা থেকে উদ্ধৃতি|
'কল্লোল'-এর জীবদ্দশায় উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১১ টি ও গল্প ১৬৬ টি| গল্প লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু ; অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ; জলধর সেন ; শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ; প্রেমেন্দ্র মিত্র ; প্রবোধ কুমার সান্যাল ; গোকুলচন্দ্র নাগ ; দীনেশরঞ্জন দাশ ; পরিমল গোস্বামী ; বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় ; প্রমথনাথ বিশী ; সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায ; পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় ; নরেন্দ্র দেব ; সরোজ রায়চৌধুরী ; শান্তা দেবী ; শৈলবালা ঘোষজায়া ; পঞ্চানন ঘোষাল ; সুরমা দেবী ; রাধারাণী দত্ত ; সীতা দেবী ; অহল্যা গুপ্ত ; নীলিমা বসু ; নিরুপমা দেবী ; সুনীতি দেবী ; প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ; মুরলীধর বসু ; যুবনাশ্ব ; প্রমথ চৌধুরী ; জগদীশ গুপ্ত ; হেমেন্দ্রলাল রায় ; নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত ; বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ; কপিলপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য ; সত্যেন্দ্র দাস ; সুবোধ রায় ; সুকুমার ভাদুরী প্রমুখ| এরা প্রায় কেউই সাহিত্য জগতে অপরিচিত নন। অনেকে তখনই কম বেশি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, অনেকে ‘কল্লোলে’র হাত ধরেই প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছেন।
সুসম্পাদিত পত্রিকাতে সাধারণতঃ কতকগুলি ‘ফিচার’ বা বিভাগ থাকে। নির্দিষ্ট ধরণের কিছু লেখাই এই সব বিভাগে প্রকাশিত হয়। ‘কল্লোলে’রও এরকম কিছু বিভাগ ছিল। ‘সংগ্রহ’ বিভাগে থাকত কোনো গল্প বা উপন্যাস থেকে নির্বাচিত সংক্ষিপ্ত কিছু সুভাষিতাবলী। ‘আলোচনা’ বিভাগটি ছিল পুস্তক পরিচয় বা কিছু সাহিত্য ভাবনা নিয়ে তৈরি। এর পরিবর্তে কোন কোন সংখ্যায় ‘পুস্তক পরিচয়’ও প্রকাশিত হয়েছে। দেশ বিদেশের নানা সংবাদ নিয়ে প্রকাশিত হ’ত ‘সমাচার’, মাঝে মাঝে কিছু মন্তব্য সহ। অপর একটি ফিচার ‘পরিচয় লিপি’। এটির উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে পত্রিকায় বলা হয়েছে – “কল্লোলে গত এক বৎসর ধরিয়া পরিচয় লিপি লেখা হইতেছে। এই পরিচয় লিপির উদ্দেশ্য, লেখক বা লেখিকাদের রচনার ভিতর যে একটি বিশেষ ভাব থাকে তাহা পাঠক-পাঠিকাদের নিকট উপস্থিত করা। কল্লোলের প্রতি সংখ্যার সমস্ত রচনাগুলির বিচিত্রিতা হইতে একটি সহজ সুর সংগ্রহ করিয়া তাহাও পরিচয় লিপির আকারে প্রকাশ করা হইয়া থাকে। ইহার দ্বারা অনেক লেখকের লেখাকে সাধারণের নিকট বিশেষভাবে পরিচিত করিয়া দিবার সুযোগ পাওয়া যায়।” ‘ছবি’ ফিচারটি ছিল শিল্পীদের শিল্প কর্মের বিষয় নিয়ে আলোচনা। গোকুলচন্দ্রের পর দীনেশরঞ্জন যখন সম্পাদক হন, তখন তিনি অনেকগুলি বিষয়কে একত্রিত করে ‘ডাকঘর’ নামক একটি বিভাগের প্রবর্তন করেন। এতে পুস্তক পরিচয়, দেশ বিদেশের কথা, সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হ’ত। এই বিভাগটির গুরুত্ব ছিল এই কারণে যে, এটি পর্যালোচনা করলে সমকালীন অনেক জ্ঞাতব্য তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায় এবং পত্রিকার সম্বন্ধেও সামগ্রিকভাবে একটি ধারণা গড়ে ওঠে। পরে এটি উঠে গিয়ে ‘প্রবাহ’ এর স্থলাভিষিক্ত হয়। ‘কাহিনী’ নামে একটি বিভাগ শুরু হয়েছিল ১৩৩০-এর মাঘ সংখ্যা থেকে। এখানে থাকতো দেশ বিদেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। লেখক ছিলেন মুখ্যতঃ নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। বহু বিদেশী সাহিত্যিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে ‘কল্লোল’ দাবী করতে পারে। তবে উল্লিখিত ফিচারগুলির কোনটিই সব ক’টি সংখ্যায় ছিল না। এগুলি এসেছে এবং গিয়েছে, মাঝে মাঝে নতুন নতুন বিভাগের আবির্ভাব হয়েছে। ছাপাখানা পরিবর্তন করার মতই এই বিভাগগুলিরও পরিবর্তন ঘটেছে। সব মিলিয়ে যেন একটা অস্থিরতার ইঙ্গিত, স্থিতিশীলতার অভাব, বিদ্রোহের ছায়া।
বহু মাসিক পত্রিকা বা প্রকাশনা সংস্থার অফিসে গড়ে ওঠে আড্ডা| এই আড্ডাকে কেন্দ্র করেই নবীন ও প্রবীন লেখকেরা পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হন| সাহিত্য প্রসঙ্গ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয় এই জমায়েতে| স্থান সংকোচ ও আর্থিক দুরবস্থা সত্বেও 'কল্লোল'-এর আড্ডায় ছিল অন্তরঙ্গতা ও প্রাণের গভীরতা| এটি সুন্দর ফুটে উঠেছে অচিন্ত্যকুমারের লেখনীতে| সম্পাদক দীনেশরঞ্জনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎকার সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন –
ঠিক এমনই এক বর্ণনা রয়েছে প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'নানা রঙে বোনা' গ্রন্থে| প্রেমেন্দ্র লিখেছেন
অন্যান্য অনেক মাসিক পত্রিকা থেকে 'কল্লোল'-এর একটি বিশিষ্টতা রযেছে| এই পত্রিকাটি সাহিত্য জগতে যে রকম আলোড়ান তুলেছিল, এতে প্রকাশিত রচনা নিয়ে যে বিরূপ সমালোচনা বা সরব সমর্থনের ঢেউ উঠেছিল, অন্যান্য পত্রিকার ক্ষেত্রে তা দেখা যায় নি| এর কারণও ছিল| রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ও সাহিত্য ক্ষেত্রে তার ধারার অনুকরণীয়তা তখন সর্বব্যাপী| অনেকে এই গণ্ডী থেকে বেরিয়ে এসে নিজস্ব ভাব ও চিন্তা নিজের ভাষায় নিজের মত করে প্রকাশ করতে উন্মুখ; কিন্তু করতে গিয়েই সামনে যেন পথ রোধ করে রবীন্দ্রনাথ| রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ প্রতিভা, সাহিত্য জগতে তার অবদান ও রচনার উৎকর্ষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করেও মনে হয়েছে তার রচনা যেন বড় বেশী নৈতিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ| সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, উদ্ভুত যন্ত্রণা, অনুভূতি ও আবেগের ভাষা ও প্রকাশ অনেক বেশী স্থূল ও নগ্ন| এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সত্য ও বাস্তবকে অস্বীকার করারই নামান্তর| এটাই ছিল সমসাময়িক কিছু সাহিত্য রচনায় উৎসুক ও আগ্রহী যুবকের দৃষ্টিভঙ্গী| মানুষের জীবন যন্ত্রণা, প্রেম, প্রীতি ও ভালবাসা তো নির্দ্দিষ্ট কোন অনুশাসনের লক্ষণরেখা সব সময়ে মেনে চলে না| এ জাতীয় ঘটনা ত অজস্র ঘটে চলেছে| তা হলে সাহিত্যে তার প্রকাশ থাকবে না কেন? সে সমযে সীমাহীন দারিদ্র ও কর্মাভাব মানুষের জীবন ও জীবিকার ক্ষেত্রে চরম নৈরাশ্য ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে| সমকালীন লেখকদের সাহিত্য রচনায় এ সব বিষয় ছায়া ফেলবে এটাই স্বাভাবিক| অনেকেই এই অব্যবস্থার জন্য দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী কালের দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট ও দিশাহীন সমাজ ব্যবস্থাকেই দায়ী করেছেন| এই অভাব ও বঞ্চনার পীড়নে ক্লীষ্ট তরুণ যুবকদের একটি অংশ শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে বাস্তবের রুঢ়তাকে অস্বীকার করতে চান নি| এই বাঁধন ছেঁড়ার জয়গানই 'কল্লোল'-এর লেখকরা গাইতে চেয়েছিল|
আর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হ’ল রূশ বিপ্লব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরেই এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব মানুষের চেতনার জগতে উল্লেখযোগ্য আলোড়ন তুলেছিল যার ঢেউ এসে পৌঁছেছিল এই বাংলার কূলেও। সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের একটা হাতিয়ার হিসাবে অনেকেই এটা বেছে নিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে বিপিনচন্দ্র পাল তার বক্তৃতায় তুলে ধরলেন বলশেভিক আন্দোলনের তাৎপর্য। পরের বছরে অক্টোবর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি। চরম অর্থনৈতিক অব্যবস্থা ও সামাজিক অস্থিরতার পরিমন্ডলে একটা দিশা খুঁজে পেতে অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও এর অনুবর্তী হলেন। এদের অনেকেই ছিলেন তরুণ ও কর্মহীন যুবক। নতুন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে, অনেক মেধাবী যুবক শিক্ষা শেষ করে বেরিয়েছে, কিন্তু কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই। চরম হতাশা বিদ্রোহাত্মক মনোভাবকে জাগিয়ে তুলেছে। পত্রিকাটির বহু রচনার মধ্যে তাই দারিদ্রের বিবরণ, শোষণ, সাধারণ মানুষের আখ্যান ও হৃদয়াবেগের কথা স্বতস্ফূর্তভাবেই স্থান পেয়েছে| এই উন্মাদনার প্রকাশ এতটাই তীব্র হয়ে পড়েছিল যে এই সময়কে একটি সন্ধিক্ষণ বা যুগের সঙ্গে তুলনা করেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত| এটাই 'কল্লোল যুগ' বা কল্লোলের কাল| কিন্তু গোপাল হালদার সেটা মানেন নি, তার দৃষ্টিভঙ্গীতে এটা যুগ নয় "হুজুগ"| এই হুজুগ বা পরিবর্তনের বার্তা নিয়েই 'কল্লোল'-এর আত্মপ্রকাশ| এটা লক্ষণীয় যে বহু নাম করা লেখক, যাদের অনেকেই পরবর্তী কালে সাহিত্য ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তারাও এই ধারাকে সমর্থন জানিয়ে লেখা প্রকাশ করেছেন|
'কল্লোল' জোয়ারের মত এসেছে| প্রকাশিত লেখার মধ্য রয়েছে দারিদ্রের বিবরণ, জীবন সংগ্রামের আখ্যান, যৌনতার প্রকাশ, প্রেম ও ভালবাসা জনিত আবেগের উচ্ছ্বাস| সে কালের বিচারে হয ত কোন কোন লেখা শালীনতার সীমা অতিক্রম করেছে| এটা মেনে নিতে রবীন্দ্রনাথ কুণ্ঠিত, দ্বিধাগ্রস্ত| ১৩৩৩-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যার 'কল্লোল'-এ বেরিয়েছে বুদ্ধদেব বসুর গল্প 'রজনী হল উতলা' (জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩)| এতেই চারিদিকে আলোড়ন পড়ে যায়| অচিন্ত্যকুমারের লেখায় –
কি ছিল বুদ্ধদেব বসুর রচনাটিতে ? গল্পটিতে লেখক আই. এ. পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় বাবার এক ব্যারিস্টার বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠেছেন। গৃহস্বামীর সাতটি মেয়ে। “এই মেয়ের দল আমাকে নিয়ে যেন ছিনিমিনি খেলতে লাগলো।” কয়েকটি পংক্তির উদ্ধৃতিই সমালোচকদের উষ্মা প্রকাশের কারণ ব্যাখ্যা করতে যথেষ্ট হবে –
কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর গল্পেই শেষ হল না| আষাঢ় সংখ্যায় বেরোল অচিন্ত্যকুমারের কবিতা 'গাব আজ আনন্দের গান'| কবিতাটি ছিল -
আনন্দের গান অনেকেরই নিরানন্দের কারণ হযেছিল| পরের মাসেই প্রকাশিত হল যুবনাশ্বর 'পটলডাঙার পাঁচালি'| [ প্রসঙ্গতঃ, যুবনাশ্বর প্রকৃত নাম মণীশ ঘটক। অধুনা প্রয়াতা সমাজসেবী ও লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর পিতৃদেব ]। “ স্থান পটলডাঙার ভিখিরী পাড়া, প্যাচপেচে পাঁকের মধ্যে হোগলার কুড়েঘর| আর কথাবার্তা যেমনটি হতে হয়, একান্ত অশাস্ত্রীয়|" 'কল্লোল'-এর রচনায় এই নীচুতলার কাহিনী, সঙ্গে অবশ্যই যৌনতার সংমিশ্রণ তখন অন্যান্য কিছু পত্রিকাকেও যেন প্রভাবিত করেছে| অনেকে যেন এই মুক্ত হাওয়ার জন্য আকুল ছিল, বেরোতে চাইছিল ছকে বাঁধা গণ্ডী থেকে| 'কালি কলম' পত্রিকায় বেরিয়েছে নজরুলের 'মাধবী প্রলাপ', 'অনামিকা' কবিতা; মূল সুর একই| ফাল্গুন সংখ্যার 'কল্লোল'-এ বেরোল বুদ্ধদেব বসুর কবিতা 'বন্দীর বন্দনা' -
তবে শুধু বুদ্ধদেব, অচিন্ত্যকুমার, নজরুলই নয়; যোগ দিয়েছেন মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর মত কবিরাও| শরৎচন্দ্র তার লেখাতে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ, কামনা-বাসনা দ্বন্দ-বিচ্ছেদের কথা নির্মোক ভঙ্গীতে তুলে ধরেছেন , শুদ্ধতা বা আভিজাত্যের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যান নি| সম্ভবতঃ এই জন্যই 'কল্লোল'-এর লেখকদের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়| সমাজের এই "কুরুচিপূর্ণ" দিকটি উন্মোচনের জন্য অনেকেই শরৎচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন| এ বিষযে শরৎচন্দ্রের দৃষ্টিভঙ্গী ছিল খুব পরিস্কার| 'কল্লোল' প্রকাশিত হওয়ার বহু আগে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মে তার লিখিত উপন্যাস 'চরিত্রহীন' প্রসঙ্গে একটি চিঠিতে প্রমথনাথ ভট্টাচার্য্যকে তিনি লিখেছেন –
‘কল্লোলে’র প্রিয় হওয়া সত্বেও শরৎচন্দ্র কিন্তু কখনো ‘কল্লোলে’ লেখেন নি। তিনি ছিলেন ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার বাঁধা লেখক। হয় তো ‘কল্লোলে’র আর্থিক অসামর্থ্যও এক্ষেত্রে কিছুটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
‘কল্লোল’ প্রকাশিত হবার অনেক আগেই রবীন্দ্রনাথ প্রকাশ করেছেন ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘নষ্টনীড়’ (১৩০৮) প্রভৃতি রচনা যা নিঃসন্দেহে আধুনিক উপন্যাস বা গল্পের প্রথপ্রদর্শক হিসাবে কাজ করেছিল। তবু উপনিষদের ভাবধারায় গড়ে ওঠা রবীন্দ্রনাথের রচনায় সাধারণভাবে যে শুচিতা ও আধ্যাত্মিক চেতনার প্রকাশ ঘটেছে, সেটা তার মানসিকতার মধ্যেই ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিল। এর বাইরে বেরিয়ে এসে দৈনন্দিন জীবনের স্থূল বিষয়ের অসংযত বর্ণনাকে তিনি সাহিত্যে স্থান দিতে চান নি। কিন্তু রবীন্দ্র প্রতিভার অমোঘ প্রভাবকে অস্বীকার করাও তো সহজ নয়। ‘কল্লোলে’র নবীন বিদ্রোহী লেখকেরা তাই সরাসরি রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত হতে চেয়েছেন। এই ভাবনার মুক্ত প্রকাশ দেখা যায় অচিন্ত্যকুমারে ‘আবিষ্কার’ কবিতায় (১৩৩৬ কার্তিক) -
সাহিত্য ক্ষেত্রে 'কল্লোল'-এর 'বিচ্যুতি' দেখে প্রবীনরা ভ্রুকুটি করেছেন, নবীনরা অনেকেই স্বাগত জানিযেছেন আর মধ্যবয়সীরা রয়েছেন দ্বিধাগ্রস্ত| সজনীকান্ত কিন্তু 'কল্লোল'-এর 'বেয়াদপি' মেনে নেন নি; একাই এগিয়ে এসেছেন প্রতিবাদ করতে| সজনীকান্ত অবশ্য প্রকাশের সময় থেকেই 'কল্লোল'-এর মধ্যে নতুন কিছু দেখেন নি -"বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার মত এমন কিছু নহে, আর পাঁচটা পত্রিকা যেমন হয় সেই রকমই, পাঁচমিশেলি ব্যাপার, থোড় বড়ি খাড়া-খাড়া বড়ি থোড়|" ‘কল্লোলে’ প্রকাশিত লেখা নিয়ে সজনীকান্ত সরাসরি রবীন্দ্রনাথের কাছে নালিশ জানালেন চিঠিতে| দীর্ঘ সে চিঠি; অংশবিশেষ দেখে নেওয়া যাক -
রবীন্দ্রনাথ হয় ত সাময়িকভাবে খানিকটা এড়িয়ে যেতে চাইছিলেন| তিনি লিখলেন -
‘কল্লোলে’ প্রকাশিত রচনার ধারাকে সমর্থন না করলেও ‘শনিবারের’ চিঠি’র আক্রমনাত্মক সমালোচনাকেও রবীন্দ্রনাথ ভাল চোখে দেখেন নি। এ প্রসঙ্গে এক সময়ে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার চিঠিপত্র বিনিময়ও হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন – “আমার নিজের বিশ্বাস শনিবারের চিঠির শাসনের দ্বারাই অপরপক্ষে সাহিত্যের বিকৃতি উত্তেজনা পাচ্ছে।”
সম্ভবতঃ রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্ত হবার অন্যতম উপায় হিসাবে এবং বহু সংখ্যক রচনার মূল সুর যৌনতার সমর্থনে 'কল্লোল'-এর লেখকেরা অনেকেই বিদেশী সাহিত্যের দিকে ঝুঁকেছিলেন| আন্তর্জাতিক স্তরে লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলা ছিল উদ্দেশ্য| খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিদেশী রচনার বহু অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অন্তত ৫০টি অনূদিত গল্প-উপন্যাস বেরিয়েছে 'কল্লোল'-এর পাতায়| এ ছাড়া বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে রচিত গল্প তো ছিলই। রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার না করে তাকে শ্রদ্ধা জানিয়েই এ কাজ তারা করেছিলেন| ১৩৩৪ সালের 'কল্লোল'-এর রচনা-সূচীতে পাওয়া যাবে যে সব বিদেশী লেখকদের তারা হলেন - ফেরদৌসী (ইরানের কবি) ; এইচ.জি.ওয়েলস (ইংরেজ সাহিত্যিক) ; রোঁমা রোলাঁ (নোবেলজয়ী ফরাসী সাহিত্যিক) ; গ্যাব্রিয়েল দ্য আনুনৎসিয়ো (ইতালীর কবি ও সাহিত্যিক) ; সেলমা ল্যাগারলফ (প্রথম মহিলা নোবেলজয়ী সুইডেনের লেখিকা) ; টমাস হার্ডি (ইংরেজ সাহিত্যিক) ; ন্যুট হ্যামসুন (নোবেলজয়ী নরওয়ের লেখক)| ১৩৩০-এর ফাল্গুন সংখ্যায় লেখা হয়েছে "এই পথে গিয়েছেন গ্যেটে, শীলার, হেইন, ওয়াগনার, রুশো, বিটোভেন, সাঁটুব্রিয়াঁ| এই পাওয়া আর না পাওয়ার মাঝে, এই অনন্ত বুভুক্ষার মধ্যে, এই রূপের সম্ভোগে, এই রূপাতীতের প্রশ্নে, এই সীমা ও অসীমের মাঝে বর্ত্তমান ইউরোপীয় সাহিত্যের জন্ম হয়|" এটা ঠিকই 'কল্লোল'-এর লেখকেরা বিদেশী সাহিত্য ও লেখকদের দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছেন| বুদ্ধদেব বসু বলেছেন -"ফ্রয়েড্ পড়ে অবধি আমার মনে হয়েছিল যে পৃথিবীতে এমন কোন জিনিস নেই - থাকতে পারে না - যা আমি না বুঝতে পারি|" রম্যাঁ রলাঁর ‘জাঁ ক্রিসতফ’ অনুবাদ উপন্যাসটি যে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে তার বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছে ১৩৩১ মাঘ সংখ্যায়। পরের মাস ফাল্গুন সংখ্যা থেকে এটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হতে থাকে, অনুবাদক কালিদাস নাগ ও গোকুলচন্দ্র নাগ। মাঝে একমাস বাদ দিয়ে ১৩৩২ পৌষ সংখ্যার পরেই মৃত্যু হয় অনুজ গোকুলচন্দ্রের ; কালিদাস নাগের সঙ্গে যোগ দান করেন তার স্ত্রী রামানন্দ-কন্যা শান্তা দেবী। ১৩৩৩-এর ভাদ্র সংখ্যায় শেষ হয় অনুবাদ-উপন্যাসটি।
এত সব বিতর্কের মাঝে রবীন্দ্রনাথের চুপ করে থাকা সম্ভব হয় নি| অনেকেই তার মতামত জানতে উদগ্রীব ছিলেন| ১৩৩৪-এর শ্রাবণ সংখ্যা 'বিচিত্রা'য় তিনি লেখেন 'সাহিত্য-ধর্ম্ম' নামক প্রবন্ধ| তার বক্তব্যের মূল কিছু কথা এখানে তুলে ধরা যেতে পারে| রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন
উদ্ধৃতিটি কিছুটা দীর্ঘ হলেও এটি প্রয়োজন এই জন্য যে, ‘কল্লোল’-এর লেখকদের ‘বাস্তবতা’ ও ‘সত্যে’র দোহাই দিয়ে সাহিত্যে কিছু বিষযের স্থান দেওয়া বা উল্লেখ করা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গী ও মতামত এ থেকে খুব সুস্পষ্টভাবে উদ্ধার করা যাবে|
১৩৩৪-এর অগ্রহায়ণ মাসের 'বিচিত্রা'য় বেরোয় রবীন্দ্রনাথের আর একটি প্রবন্ধ ‘সাহিত্যে নবত্ব’| ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিত হয় নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তর ‘সাহিত্য ধর্ম্মের সীমানা'| 'কল্লোল' বের করে অমলেন্দু বসুর 'অতি আধুনিক কথা সাহিত্য' ও বুদ্ধদেব বসুর 'অতি আধুনিক বাংলা সাহিত্য'| ভবানী ভট্টাচার্য্যের 'কথা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ' বের হয় 'কল্লোল'-এর ১৩৩৪ শ্রাবণ সংখ্যায়| প্রবন্ধটিতে লেখক সংক্ষেপে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি উপন্যাস নিয়ে আলোচনা করেছেন| আমাদের বর্তমান আলোচনার ক্ষেত্রে এই প্রবন্ধের প্রাসঙ্গিকতা হিসাবে একটি উদ্ধৃতিই যথেষ্ট –
বলা বাহুল্য ভবানী ভট্টাচার্য্যের এই বিশ্লেষণের উত্তরও রবীন্দ্রনাথের 'সাহিত্য-ধর্ম্ম' থেকে নেওয়া উল্লিখিত উদ্ধৃতির মধ্যেই বিধৃত আছে|
'কল্লোল'-এ প্রকাশিত হয় অচিন্ত্যকুমারের 'বেদে' নামক উপন্যাস| এই উপন্যাসটিও অশ্লীলতার ঝড় তুলেছিল| এ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ অচিন্ত্যকুমারকে একটি চিঠি লেখেন যেটি 'কল্লোল' ১৩৩৬-এর বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে| তিনি লিখেছেন –
নরওয়ের সাহিত্যিক ন্যুট হ্যামসুনের দ্বারা 'কল্লোল'-এর অনেক লেখক প্রভাবিত হয়েছেন, এ রকম কথা অনেকের মনে হয়েছে| বিশেষ করে অচিন্ত্যকুমার যে প্রভাবিত হয়েছেন এটা রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে| এ সম্বন্ধেও রবীন্দ্রনাথ তার মতামত ব্যক্ত করেছেন| অচিন্ত্যকুমারকে তিনি লিখেছেন –
অবশ্য ‘কল্লোলে’র সব রচনাতেই যে যৌনতার ছোঁয়া বা অশ্লীলতার আঁচ লেগেছিল তা নয়। তবে মননধর্মী বা গভীর ভাবসমৃদ্ধ লেখা পত্রিকায় তেমন স্থান পায় নি, পত্রিকার উদ্দেশ্যও ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সময়ের তরুণ লেখকদের চিন্তাধারা বা মানসিকতার সঙ্গেও এ ধরণের লেখা সঙ্গতিপূর্ণ ছিলনা।
‘কল্লোলে’র বিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসে অচিন্ত্যকুমার অবশ্য পরে লিখেছেন 'পরমপুরুষ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ'; এই গ্রন্থটির জন্যই তার সমধিক খ্যাতি| ‘বেদে’র কামনা আবিল আবর্ত থেকে কামনাহীন শুচিশুভ্র নির্মলতায় উত্তরণ|
এ তো গেল সাহিত্যে শালীনতার বিষয়; 'কল্লোল'কে কেন্দ্র করেই যে বিতর্কের উদ্ভব| কিন্তু 'কল্লোল' সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণ বিরূপ মনোভাব কখনও পোষণ করেন নি| শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় 'কল্লোল'-এর একজন বিশিষ্ট লেখক হিসাবে স্বীকৃত| তার লেখা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ 'প্রবাসী' ১৩৩৪-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় লিখেছেন –
অতএব রবীন্দ্রনাথ 'কল্লোল' বর্জন করেছিলেন কথাটা ঠিক নয়| 'কল্লোল'-এর একদল লেখক রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করে নিজেদের মত লিখতে চেয়েছিলেন - সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়| কিন্তু এই পত্রিকাটি কবিকে কখনও অশ্রদ্ধা বা অবজ্ঞা করে নি| নজরুলের কবিতার একটি প্যারোডি সম্বন্ধে নজরুলেরই লেখা 'সর্ব্বনাশের ঘণ্টা' কবিগুরুর উদ্দেশ্যে লেখা বলে কারো কারো যে ভুল ধারণা হয়েছিল, সে ভ্রান্তি নিরশন করে 'কল্লোল' কর্ত্তৃপক্ষ যে লেখা প্রকাশ করেছিল, যেটা আগেই উল্লেখিত হয়েছে, তা থেকেও বোঝা যায় 'কল্লোল' ছিল রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে রীতিমত শ্রদ্ধাশীল| চীনের রাজধানী পিকিং-এ রবীন্দ্রনাথ আমন্ত্রিত হন বক্তৃতা করার জন্য| একই আমন্ত্রণে তার আগে ইংল্যাণ্ড থেকে বার্টার্ড রাসেল ঘুরে এসেছেন| ১৯২৪ খ্রীষ্টাব্দের ২১শে মার্চ কবি 'ইথিওপিয়া' জাহাজে যাত্রা করেন| ১৩৩১-এর বৈশাখে 'কল্লোল'এ প্রকাশিত হয়েছে কবির 'শেষ অর্ঘ্য'; উল্লেখ করা হয়েছে –
কবির পিকিং যাত্রা সম্বন্ধে এই শুভেচ্ছা জানিয়েছে 'কল্লোল'|
১৩৩১-এর চৈত্র সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরসহ ‘অন্ধকার’ কবিতাটি মুদ্রিত হয়| পরের বছর বৈশাখ সংখ্যায় 'মুক্তি' কবিতাটি এবং আশ্বিনে 'ওগো শেফালি' গানটি বেরিয়েছে| ১৩৩৩-এর বৈশাখে প্রকাশিত হয়েছে কবিগুরুর 'উদ্বোধন' কবিতা; মন্তব্য করা হয়েছে -"রবীন্দ্রনাথের এই পুরাতন কবিতাটি কল্লোলের নববর্ষের যাত্রার উদ্বোধনরূপে প্রকাশ করা হল|" জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছবি দিযে, ছবির নীচে লেখা হয়েছে 'শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর| ৬৫তম জন্মতিথি, ২৫শে বৈশাখ, ১৩৩৩|’ 'কল্লোল'-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গোকুলচন্দ্র নাগ তার উপন্যাস 'পথিক'এ 'চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে' রবীন্দ্রসঙ্গীতটি ব্যবহার করেছেন| ১৩৩১-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় বিশ্বভারতী কর্ত্তৃপক্ষের কাছে 'কল্লোল' অনুরোধ জানিয়েছে কবিগুরুর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ নিয়ে একটি স্বল্পমূল্যের 'সুলভ সংস্করণ’ প্রকাশ করতে, যাতে সর্বসাধারণ তার রচনা পাঠ করে তৃপ্ত হতে পারেন| এ সব নিশ্চয়ই রবীন্দ্রবিদ্বেষের নমুনা নয়| 'কল্লোল' ও রবীন্দ্রনাথের তথাকথিত বিদ্বেষের প্রচলিত ও প্রচারিত তথ্যের উৎস হয় ত এই যে, অন্য বেশ কিছু পত্রিকা যেমন মূলতঃ ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা হয়ে উঠেছিল, 'কল্লোল’ তার স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বাধীন চিন্তাধারা পোষণ করে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে; কিন্তু এই প্রচেষ্টা করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথকে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করে নয়, বরং কিছুটা সম্ভ্রম জানিয়ে, সঙ্গে নিয়েই| ১৩৩৪-এর পৌষ সংখ্যায় বলা হয়েছে –
‘কল্লোলে’র লেখকগোষ্ঠী রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানিয়েই রবীন্দ্র প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে এযাবৎ পরিত্যক্ত বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে স্বাধীন ভাবে সাহিত্য সৃষ্টিতে মন দিয়েছিলেন। তবে রবীন্দ্রনাথের খুব ঘনিষ্ঠ হয়েও রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত হতে তো প্রমথ চৌধুরীও চেয়েছেন; অবশ্য তার রচনার বিষয়বস্তু ‘কল্লোলে’র ধারা থেকে স্বতন্ত্র। একটি বিষয় লক্ষণীয়। যুদ্ধোত্তর কালের আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা, রাশিয়ার বলশেভিক আন্দোলন ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েও ‘কল্লোলে’র লেখকগোষ্ঠী কিন্তু কখনও রাজনীতিকে তাদের রচনায় স্থান দেয় নি। তাদের সৃষ্টিক্ষম লেখনী মূলত সাহিত্য রচনাতেই নিবদ্ধ থেকেছে। অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল নবীন প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন লেখকেরা প্রায় সকলেই অর্থাভাবে কষ্ট পেয়েছেন। অন্ত্যজ মানুষের জীবন যন্ত্রণা, দারিদ্র, ও বস্তি জীবনের নানা অভিঘাত তাই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই স্থান পেয়েছে এদের রচনায়।
প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন ‘কল্লোলে’র অন্যতম প্রাণপুরুষ। অচিন্ত্যকুমারের মাধ্যমে গোকুলচন্দ্রের সঙ্গে তার পরিচয়। পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষে ১৩৩১ শ্রাবণ সংখ্যায় তার প্রথম গল্প ‘সংক্রান্তি’ প্রকাশিত হয়। এর পর তিনি অবারিতভাবে লিখে গিয়েছেন গল্প, উপন্যাস ও কবিতা। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একবার সাহিত্য-সভায় ‘কল্লোলে’র ডাক পড়েছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সাক্ষাৎকার। প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখনীতে ধরা রয়েছে তার কিছু বিবরণ, ব্যক্তিগত অনুভব ও অভিজ্ঞতা। ‘কল্লোলে’র সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না হলেও, এখানে তার কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে ‘কল্লোল’কে ঘিরে কলরোল তো কিছু কম হয় নি। তাই বিবরণ একেবারে তাৎপর্যহীন নয়। প্রেমেন্দ্র লিখেছেন -
‘কল্লোলে’র কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্র-প্রসঙ্গ হয় ত অনেকটা জায়গা জুড়ে রইল। এটা অস্বাভাবিক মনে হয় না। কারণ, রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্যাকাশে দীপ্তিমান সূর্য। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান, শিল্প সব ক্ষেত্রেই তার গতি অপ্রতিহত, প্রভাব অনতিক্রম্য। অতএব সাহিত্যের এক সন্ধিক্ষণে তরুণ প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথকে কিভাবে কততা গ্রহণ করেছে, কি চোখে দেখেছে এবং রবীন্দ্রনাথই বা নতুন লেখক বা তাদের লেখা সম্বন্ধে কি মনোভাব পোষণ করেছেন এ প্রসঙ্গের অবতারণা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ।
‘কল্লোলে’র প্রতি সংখ্যার দাম ছিল চার আনা, পরে হয় পাঁচ আনা; বার্ষিক সডাক মূল্য সাড়ে তিন টাকা। পত্রিকার সাইজ প্রথমে ছিল ডিমাই। কিন্তু ছোট সাইজের জন্য বিজ্ঞাপন জুটতো কম কারণ, বিজ্ঞাপনের ব্লক প্রস্তুত হত ডাবল ক্রাউন সাইজের, অন্যান্য পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই। ছোট সাইজের জন্য প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা ‘প্রবাসী’ বা ‘ভারতবর্ষে’র মত আভিজাত্য বজায় থাকেনা মনে করে অনেক পাঠকের এটা মনঃপুত ছিল না। এসবের জন্য চতুর্থ বর্ষ থেকে ‘কল্লোল’ ডাবল ক্রাউন সাইজে পরিবর্তিত হয়।
গোকুলচন্দ্রের মৃত্যুর পূর্বে দীনেশরঞ্জন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ‘কল্লোল’ তিনি চালিয়ে যাবেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তিনি। ‘কল্লোল’ তো শুধু গোকুলচন্দ্রের প্রাণের ধন নয়, নবীন প্রবীণ বহু কবি ও সাহিত্যিকের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক আশ্রয়স্থল। কিন্তু সপ্তম বর্ষে দীনেশরঞ্জন পত্রিকার মৃত্যু ঘোষনা করেন। সিদ্ধান্তটি হয় ত হঠাৎই নিয়েছিলেন তিনি; কারণ শেষ সংখ্যায় (১৩৩৬ পৌষ) প্রকাশিত প্রবোধকুমার সান্যালের বড় গল্প ‘কাজললতা’র ভূমিকায় সম্পাদক লিখেছেন গল্পটি চৈত্র সংখ্যা পর্যন্ত চলবে, কিন্তু সেই মাসেই পত্রিকা বন্ধের সিদ্ধান্ত। দীনেশরঞ্জন লিখেছেন –
স্বাভাবিক কারণেই তিনি নিজেও অত্যন্ত ব্যাথিত হয়েছিলেন এবং তার আশা ছিল তিনি পত্রিকাটি আবার প্রকাশ করতে পারবেন, কিন্তু তার সে ইচ্ছা পূর্ণ হয় নি। সম্ভবত সব চেয়ে বেদনাহত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু। কিছুতেই তিনি সম্পাদকের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন নি। তার কথায় –
সবশেষে একটা সাধারণ প্রসঙ্গের অবতারনা করে 'কল্লোল' প্রসঙ্গে ইতি টানা যাক| সেটি হল 'কল্লোল'-এর দুষ্প্রাপ্যতা, প্রকাশ কালেই এটি দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে| মজার কথা হ’ল, পত্রিকাগোষ্ঠিই ‘কল্লোলে’ বিজ্ঞাপন দিয়েছিল পুরানো সংখ্যা সংগ্রহ করতে। হয় ত অর্থাভাবে কম সংখ্যক বই ছাপা হোত| জাতীয় গ্রন্থাগার ছাড়া কিছু লাইব্রেরীতে পত্রিকাটি লভ্য, আর রয়েছে কিছু মনস্ক ও যত্নশীল পাঠকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে| প্রত্নতাত্বিক সংগ্রহ কপি করে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় তো যায় না, কিন্তু পুস্তকের বেলা ত সে নিয়ম খাটে না, বিশেষ করে আজকের উন্নত প্রযুক্তির যুগে| অনায়াসেই পত্রিকাটি ওয়েবসাইটের মাধমে আগ্রহী পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়| যাই হোক, পত্রিকাটি একটি যুগের নির্দেশ করুক বা নাই করুক, এক সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করা আধুনিক সাহিত্যের উদগাতা বিদ্রোহী ‘কল্লোল’ সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে|
চিত্র – ১ : ১৩৩৬ কার্ত্তিক সংখ্যার প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা।
চিত্র – ২ : ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকার আশ্বিন ১৩৩৪ সংখ্যায় ‘কল্লোলে’র বিজ্ঞাপন।
চিত্র – ৩ : প্রথম সংখ্যার প্রথম রচনার আংশিক প্রতিলিপি।
ঋণ স্বীকার –
(১) ‘কল্লোল যুগ’-অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ;
(২) ‘কল্লোলের কাল’-জীবেন্দ্র সিংহরায়
(৩) অন্যান্য পত্রিকা।
লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.