উত্তরা
দীপক সেনগুপ্ত
সাহিত্য ও সাহিত্য রচয়িতা অর্থাৎ সৃষ্টি ও স্রষ্টা উভয়কেই পাঠকবর্গের দরবারে পৌঁছে দিতে সাময়িকপত্রের কোনো বিকল্প নেই। মুদ্রিত গ্রন্থের হয়ত তো একটা পৃথক কৌলিন্য আছে, কিন্তু সেই গ্রন্থটি একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে একজন লেখকের লেখা। বিভিন্ন বিষয়ের ডালি সাজিয়ে নবীন ও প্রবীণ লেখকদের নানান স্বাদের বৈচিত্রপূর্ণ রচনা সম্ভারে সমৃদ্ধ এবং সুশোভন চিত্রমালায় অলঙ্কৃত ও সজ্জিত হয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা যখন পাঠকের হাতে এসে পৌঁছোয় তখন সব শ্রেণীর পাঠকের কাছেই তা আদৃত হয়, সমাদর লাভ করে। বড় গল্প বা উপন্যাসের ক্ষেত্রেও ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের কোনো বাধা নেই। এ ধরণের পত্রিকার আর একটি উপযোগিতা হ’ল পাঠকদের সুস্থ রুচি গড়ে তুলে তাদের জ্ঞান ও তথ্যের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ ও প্রসারিত করা এবং নতুন লেখকগোষ্ঠিকে উৎসাহিত করে তাদের প্রতিষ্ঠিত হ’তে সাহায্য করা। পরবর্তী কালের কত নামি দামি লেখক যে সাময়িকপত্রের মাধ্যমে তাদের যাত্রা শুরু করেছেন তার ঠিকানা নেই। সহজলভ্যতার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। রাস্তার পাশের ছোটখাটো পুস্তক বিক্রেতার কাছেও এসব পত্রিকার দেখা মেলে, এজন্য নির্দিষ্ট প্রকাশকের বিপণির খোঁজ করতে হয় না।
বাংলা মাসিকপত্র অধিকাংশই প্রকাশিত হত কলকাতা বা তৎসন্নিহিত স্থান থেকে। দূরত্বের জন্য বহির্বঙ্গের পাঠক বা লেখকদের অসুবিধা হত। প্রতি মাসিকপত্রেরই একটা ঘনিষ্ঠ আড্ডা বা লেখকদের মিলনক্ষেত্র ছিল। লেখক ও অনুরাগীরা মাঝে মাঝে এখানে সমবেত হয়ে পরস্পরের সান্নিধ্য উপভোগ করতেন এবং সাহিত্য ও প্রাসঙ্গিক বিষয়ের আলোচনার মাধ্যমে সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস সার্থক হয়ে উঠত। উত্তর ভারতের লক্ষ্ণৌ, কাশী, কানপুর প্রভৃতি স্থানে সাহিত্যপ্রেমী কৃতবিদ্য ব্যক্তির অভাব ছিল না। এদের অন্যতম ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন। তিনি বিলেত থেকে ব্যারিষ্টার হয়ে ফিরে এসেছিলেন। দেশে এসে তিনি তার জ্যেষ্ঠ মাতুল স্যার কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্তের কন্যা হেমকুসুমকে বিয়ে করতে মনস্থ করেন। দেশের আইনে এ ধরণের বিয়ের অনুমোদন না থাকায় ১৯০০ খৃষ্টাব্দে দ্বিতীয় বারের জন্য তিনি বিলেত যাত্রা করেন এবং ১৯০১-এর জানুয়ারি মাসে তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু ফিরে এসে তিনি আত্মীয় স্বজন ও জ্ঞাতিবর্গের বিরূপ সমালোচনা ও তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বিপর্যস্ত হয়ে লক্ষ্ণৌ গিয়ে বসবাস শুরু করেন ও ব্যারিষ্টার হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন। এত করেও কিন্তু তার পারিবারিক জীবন সুখের হয় নি। যন্ত্রণা ও হতাশা থেকে মুক্তি পেতে তিনি সঙ্গীত ও সাহিত্য চর্চায় মন দেন। বঙ্গদেশের বাইরে বিশিষ্ট সাহিত্যানুরাগীদের নিয়ে তিনি একটি সংস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। একাজে যারা তার মুখ্য সহায় হন সাংবাদিক, সাহিত্যসেবী ও অক্লান্তকর্মী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, তদীয় ভ্রাতা ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী দিলীপকুমার রায়, জনপ্রিয় লেখক কাশীবাসী কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, লক্ষ্ণৌ চারুকলা বিভাগের অধ্যক্ষ ললিতমোহন সেন ও কানপুরের সুরেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখ গণ্যমান্য ব্যক্তি। সংস্থাটির নামকরণ হয় ‘উত্তর ভারতীয় বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন’। অবশেষে ১৯২৩-এর ৩রা ও ৪ঠা মার্চ কাশীর ‘সেন্ট্রাল হিন্দু কলেজে’র সভাগৃহে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে প্রায় দু’শ প্রতিনিধিকে নিয়ে সংস্থার প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
সংস্থার দ্বিতীয় অধিবেশন হয়েছিল সাংবাদিক প্রবর রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে ঐ বছরেই ২৬শে ও ২৭শে ডিসেম্বর এলাহাবাদে। তৃতীয় অধিবেশন হয়েছিল লক্ষ্ণৌ শহরে। ‘ভারতী’ সম্পাদক সরলা দেবী চৌধুরানী ছিলেন সভানেত্রী। ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ২৮শে ও ২৯শে চৈত্র (এপ্রিল ১৯২৫) তারিখে অনুষ্ঠিত এই অধিবেশনটি বিভিন্ন কারণেই ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমতঃ সংস্থাটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন’। দ্বিতীয়তঃ এই অধিবেশনেই ‘উত্তরা’ পত্রিকা আবির্ভাবের ইঙ্গিত মেলে। সম্মেলনের আহ্বায়ক অতুলপ্রসাদ সেন বহু বিদ্দজনের উপস্থিতিতে তার স্বাগত ভাষণে বলেন –
পূর্বে উল্লেখিত ব্যক্তিরা ছাড়াও অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমী কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও সমাজতত্ব বিষয়ের অধ্যাপক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শান্তিনিকেতনের কলাবিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও লক্ষ্ণৌ সরকারি শিল্প মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ অসিতকুমার হালদার প্রমুখ। এই অধিবেশনেই স্থির হয় ‘প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের’ মুখপত্র হিসাবে প্রকাশিত হবে মাসিক পত্রিকা ‘উত্তরা’। অতুলপ্রসাদের দীর্ঘদিন ধরে লালিত পরিকল্পনাটি এভাবেই রূপ পরিগ্রহ করে। ‘উত্তরা’ নামটি অতুলপ্রসাদেরই দেওয়া। পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক হলেন অতুলপ্রসাদ সেন ও রাধাকমল মুখোপাধ্যায়। সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী সহ-সম্পাদক হয়ে কাজের সহায়তা করবেন বলে ঠিক হয়। এই কর্মদক্ষ মানুষটির নাম অতুলপ্রসাদ আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন। তার নির্বাচন যে সঠিক ছিল সেটা পরবর্তী কালেই প্রমাণিত হয়েছে। বহু ঝড় ঝাপ্টা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও হাল ধরে দীর্ঘ ৪১ বছর সাফল্যের সঙ্গে ‘উত্তরা’র ধ্বজা উড্ডীয়মান রেখেছিলেন এই নিষ্ঠিত মানুষটি।
সরলা দেবীর সভাপতিত্বেই একটি ‘পত্রিকা সমিতি’ গঠিত হল। মূল অধিবেশন চলাকালেই এক রাত্রে লক্ষ্ণৌ-এর ‘চার্চ মিশন হাই স্কুলে’ পত্রিকা সমতির সভা হয়। অরুণা চট্টোপাধায়ের লেখায় – “পত্রিকা সমিতি গঠিত হলো। এই সমিতির এগার জনের মধ্যে প্রথম পাঁচজন হলেন অতুলপ্রসাদ সেন, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রলাল দে ও সুরেশ চক্রবর্তী। এছাড়া উত্তরপ্রদেশের অন্যান্য শহর থেকে খ্যাতিসম্পন্ন আরও ছয়জনকে পরিচালক সমিতিতে রাখা হলো। পত্রিকা প্রকাশের কাজকে ত্বরান্বিত করার জন্য পরিচালক সমিতিকে ভার দেওয়া হলো এক হাজার টাকা, পাঁচশ গ্রাহক ও কয়েকজন নিয়মিত প্রবাসী লেখক সংগ্রহ করতে। সভায় এই দায়িত্ব দানের প্রেক্ষিতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেল। এমন কি সভার সাধারণ শ্রোতারা ও স্বল্পাগতা মহিলারাও পত্রিকা প্রকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনায় উৎসাহিত হয়ে অর্থ দান করার প্রতিশ্রুতি দেন।”
পত্রিকার কোষাধ্যক্ষ হলেন রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়। উপদেষ্টা সমিতিতে নির্বাচিত হন – সরলা দেবী চৌধুরানী, রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যসেবী সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, কাশী সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ স্বনামধন্য গোপীনাথ কবিরাজ এবং এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত বিশিষ্ট বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা।
‘উত্তরা’র প্রকাশ তো একরকম নিশ্চিত হল। এবার একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখা যাক কাশীর বাঙালি সাহিত্যপ্রেমীরা ‘উত্তরা’র আগে অন্য কোনো পত্রিকা প্রকাশের জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন কি না।
কাশীতে বসবাসকারী বাঙালিদের উদ্যোগে প্রথম সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১৩২৭ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে, নাম ছিল ‘প্রবাসজ্যোতি’। কবি ও নাট্যকার মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিরিশ অধ্যাপক হয়ে ফিরে আসার আগে বহুদিন কাশীতে বাস করেছেন। তারই উৎসাহে ও আর্থিক সহায়তায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসজ্যোতি’। সম্পাদক ছিলেন কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সহ-সম্পাদক সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। মাসিক পত্রিকাটি মাত্র এক বছর স্থায়ী হয়েছিল। কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রথম সংখ্যাতেই ‘বাড়ীর কর্ত্তা’ নামে একটি উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলেন, যে কারণেই হোক দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে সেটা আর প্রকাশিত হয় নি।
১৩২৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে প্রকাশিত হয় ‘অলকা’। প্রকাশনায় ছিল পারিপাট্য ও সুরুচির ছাপ। গোপীনাথ কবিরাজ, মহেন্দ্রচন্দ্র রায়, প্রমুখ পন্ডিত ও বিদগ্ধ ব্যক্তিরা উচ্চমানের প্রবন্ধ রচনা করে পত্রিকার উৎকর্ষ বৃদ্ধি করেছিলেন। বহু গল্প লিখেছেন কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। পত্রিকা সম্পাদক ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য এবং এখানেও সহ-সম্পাদক সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। আর্থিক অনটনে ক্লিষ্ট ছিল ‘অলকা’।
কাশীর পন্ডিত মহলে চিন্তাশীল ব্যক্তির অভাব ছিল না। বৃন্দাবন ভট্টাচার্য্য ও কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার অধ্যাপক হরিহর শাস্ত্রীর যুগ্ম-সম্পাদনায় ১৩২৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গ সাহিত্য’ নামক একটি পত্রিকা। গভীর ভাবসমৃদ্ধ দার্শনিক প্রবন্ধ ও ধর্ম্মতত্ত্ব ছাড়া আর কোনো ধরণের রচনা প্রকাশে উৎসাহিত ছিলেন না সম্পাদকেরা। গল্প, উপন্যাস ও অন্যান্য লঘু বিষয়ের অভাবে পত্রিকাটি সাধারণ পাঠকবর্গের কাছে সমাদর লাভ করে নি। দু’বছর মাত্র চলেছিল পত্রিকাটি।
সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী নিজের নাম সুরেশ চক্রবর্তী লিখতেই পছন্দ করতেন। তিনি ছিলেন দক্ষ সংগঠক ও পরিশ্রমী। ‘অলকা’ পত্রিকার সঙ্গে তিনি গভীর ভাবে যুক্ত ছিলেন। সম্ভবতঃ তার সঙ্গে পত্রিকা সম্পাদক ও পরিচালকবর্গের কিছু মতান্তর হয়েছিল। তিনি নিজের একক প্রচেষ্টায় একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে উদ্যত হন। পত্রিকাটি ছিল পাক্ষিক ও নাম ছিল ‘প্রবাসী বাঙালী’, প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩০ বঙ্গাব্দে। প্রবাসী বাঙালিরা সে সময়ে সংগঠিত হয়ে একটি সংস্থা গড়ে তার মাধ্যমে একটি পূর্ণাঙ্গ পত্রিকা প্রকাশে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এর বিবরণ আগেই দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই সুরেশ চক্রবর্তীর মত সম্পাদনার কাজে অভিজ্ঞ ও পরিশ্রমী ব্যক্তিকে তারা কাছে টেনে নিয়েছিলেন। একাজে ব্যস্ত থাকায় ‘প্রবাসী বাঙালী’ পত্রিকার দিকে তিনি তেমন নজর দিতে পারেন নি। দু’বছর চলার পর বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি।
এই হ’ল কাশী থেকে প্রকাশিত কিছু পত্রিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।
‘উত্তরার’ আগমন বার্তা তো উচ্চারিত হলো, কিন্তু মূল প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়াল অর্থ। অধিবেশনে উৎসাহিত ও আবেগ তাড়িত হয়ে যারা অর্থের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অর্থ সংগ্রহের সময় তারা আর এগিয়ে এলেন না। প্রথম থেকেই পত্রিকাটি আর্থিক অনটনের সম্মুখীন হয়েছিল। সুরেশচন্দ্রের সাংগঠনিক ক্ষমতা ও উৎসাহই ছিল একমাত্র পাথেয়। তিনি কাজে নেমে পড়লেন। পত্রিকার প্রচ্ছদটি আঁকাতে হবে। লক্ষ্ণৌ সরকারি শিল্প মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্র অসিতকুমার হালদার ছিলেন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। সুরেশচন্দ্রকে নিয়ে অতুলপ্রসাদ নিজে গেলেন তার কাছে। প্রছদ পত্রের ব্যবস্থা করার পর এবার রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ প্রার্থনা। তার কবিতা দিয়েই ‘উত্তরা’র যাত্রা শুরু করতে হবে।
প্রথমবার বিলেত থেকে ফিরে আসার পরে ১৮৯০ সালে সরলা দেবী চৌধুরানীর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একুশ বাইশ বছরের যুবক অতুলপ্রসাদের প্রথম সাক্ষাৎকার। অতুলপ্রসাদের কথায় –“প্রথম দর্শনেই প্রেম। ইতিপূর্বে তাঁকে ছবিতে দেখিয়াছিলাম এবং তাঁর কবিতার অনুরাগী ছিলাম, নয়নের সম্মুখে যখন তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর স্নিগ্ধ কান্তি দেখিলাম, মুগ্ধ হইয়া গেলাম।” তারপর দীর্ঘদিন ধরে মেলামেশা ও আলোচনার ফলে তাদের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের লেখা ও আশীর্বাদ প্রার্থনা ক’রে ব্যক্তিগত ভাবে কবিকে চিঠি লেখেন অতুলপ্রসাদ। রবীন্দ্রনাথের কবিতা এসে পৌঁছোয়। ঠিক হয়েছিল ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১লা আষাঢ় পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হবে, কিন্তু যথেষ্ট প্রস্তুতি না থাকায় তারিখ পিছিয়ে দিতে হল।
এই আয়োজন যখন চলছে তখন অতুলপ্রাসাদের মা হেমন্তশশী অসুস্থ, মরণাপন্ন। স্ত্রী হেমকুসুমের সঙ্গেও চলছে মনোমালিন্য, হয়েছে সম্পর্কের অবনতি। কিন্তু অতুলপ্রসাদ অসীম ধৈর্য সহকারে কাজ করে চেলেছেন, পত্রিকা প্রকাশে্র সঙ্কল্পে তিনি অবিচল। আর্থিক সঙ্কট কাটাতে টাকা পাঠিয়েছেন তিনি। একটি চিঠিতে তিনি সুরেশচন্দ্রকে লিখেছেন – “আমার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা বুঝিতেই পার। তোমায় আপাততঃ খরচের জন্য ৫০ টাকার cheque পাঠাইতেছি। আমার বোধ হয় কলেজ বন্ধ হইবার পূর্ব্বে তোমার একবার লক্ষ্ণৌ আসা দরকার। রাধাকমলবাবু এবং রাধাকুমুদবাবুর সঙ্গে দেখা করিয়া এবং পরামর্শ করিয়া কাজে অগ্রসর হওয়া আবশ্যক।”
অবশেষে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে মঙ্গলবার শুভ মহালয়ার দিনে রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ নিয়ে ‘উত্তরা’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদে লেখা হত –‘প্রবাসী –বঙ্গ-সাহিত্য সম্মিলনের মুখপত্রঃ উত্তরা’। পরে যখন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদক হন, তখন এটির পরিবর্তে মুদ্রিত হত –‘বাঙ্গালার বাহিরে বাঙ্গালী প্রতিষ্ঠিত একমাত্র সচিত্র মাসিক পত্রিকা’।
‘উত্তরা’ দেখে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য ‘উত্তরা উত্তমা হইয়াছে’। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ-বাণী নিয়ে রচিত কবিতার কয়েক পংক্তি –
প্রথম সংখ্যায় রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের মুখবন্ধ ‘উত্তরা’র পরে প্রবন্ধ ছিল – ‘মনোবিজ্ঞান’ (ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়), ‘গৌড়ীয় যোগশাস্ত্র’ (গোপীনাথ কবিরাজ), ‘আপেক্ষিত তত্ত্ব অনুসারে জড় ও বিদ্যুতের সম্পর্ক’ (সত্যেন্দ্রনাথ রায়), ‘যুক্ত প্রদেশের প্রাচীন শিক্ষা’ (রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়), ‘এক ও বহু’ (ফণীভূষণ অধিকারী), ‘গুরু তেগবাহাদুরের জীবনী ও বাণী’ (অবিনাশচন্দ্র মজুমদার), ‘বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশন’ (সরলা দেবী চৌধুরানী)। গানের সঙ্গে অতুলপ্রসাদের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। প্রথম সংখ্যাতেই অতুলপ্রসাদের কথা ও সুরে গান প্রকাশিত হয়েছে, স্বরলিপি করেছেন সাহানা দেবী।
প্রথম সংখ্যাতেই বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছে – “এই প্রকাশের পশ্চাতে আপনাদের যে সাহায্য ও শুভ ইচ্ছা রহিয়াছে কেবল তাহাই প্রবাসী বাঙ্গালীর এই অনুষ্ঠানটিকে উদ্দেশ্য পথে অগ্রসর করিয়ে দিতে সমর্থ।” প্রথম সংখ্যায় যে সব লেখা প্রকাশিত হয়েছে তা থেকে স্পষ্ট যে ‘উত্তরা’য় চিন্তামূলক ভাবসমৃদ্ধ প্রবন্ধকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে গল্প, উপন্যাসও অনেক প্রকাশিত হয়েছে। ‘উত্তরা’র ছিল অবারিত দ্বার মুক্ত পরিসর। সব শ্রেণীর লেখকেরাই তাদের রচনা পাঠাতে পারতেন।
অন্যান্য অনেক পত্রিকার মতই ‘উত্তরা’তেও কতকগুলি ‘বিভাগ’ ছিল। কিছু নির্দ্দিষ্ট ধরণের এবং বিষয়ের লেখাই এখানে প্রকাশিত হত। ‘প্রবাসী বাঙ্গালী’ বিভাগে থাকত প্রবাসে অবস্থিত বাঙালীদের নানা খবর - তাদের অনুষ্ঠান, সভা-সমিতি, উল্লেখযোগ্য অবদান ইত্যাদি। সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে থাকত কৃতী বাঙালীদের জীবনীও। ‘সপ্তধারা’ নামক বিভাগটিতে থাকত হিন্দি, উর্দু, পাঞ্জাবী, তামিল প্রভৃতি অবাঙালী লেখকদের বিখ্যাত রচনার অনুবাদ। ‘আহরণী’তে থাকত দেশ বিদেশের বিভিন্ন খ্যাতনামা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত নানা উল্লেখযোগ্য সংবাদ ও রচনার সারাংশ। দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্দেশের শিল্প সংস্কৃতি ও সাহিত্য ভাবনার সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে এটি ছিল একটি সার্থক প্রয়াস। ‘উত্তরা’র আর একটি উল্লেখযোগ্য বিভাগ ছিল ‘সংকলন’। সম্পাদকের বিচারে কোনো লেখা গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে সেটা পুনর্মুদ্রিত হত এই বিভাগে। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের অনেক লেখা এখানে স্থান পেয়েছে। ‘পুস্তক পরিচয়’ বিভাগটিতে (মাঝে মাঝে নাম দেওয়া হয়েছে ‘সাহিত্য প্রসঙ্গ ও পুস্তক পরিচয়’) বিভিন্ন গ্রন্থের পরিচয় ও সমালোচনা প্রকাশ করা হয়েছে। ‘বিবিধ’ নামে এক বিভাগে থাকত বৈচিত্রপূর্ণ সংবাদের অংশ। তবে এসব বিভাগই নিয়মিত ভাবে সব সংখ্যাতে কখনই প্রকাশিত হয় নি। বিচ্ছিন্ন ভাবে চোখে পড়ে মাত্র। সঙ্গীত বিষয়ে অতুলপ্রসাদের বিশেষ উৎসাহ থাকায় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে অতুলপ্রসাদ, দিলীপকুমার রায়, দেবেন্দ্রনাথ সেন, সাহানা দেবী প্রমুখ সঙ্গীতজ্ঞের বহু গান এবং সংশ্লিষ্ট স্বরলিপি।
অসিতকুমার হালদার ছিলেন চিত্রকলায় বিশেষ প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি। শৈশব কাল থেকেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শান্তিনিকেতনের চিত্রকলা চর্চার সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯২৫ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত লক্ষ্ণৌ সরকারি শিল্প মহাবিদ্যালয়ের স্থায়ী অধ্যক্ষ পদে আসীন ছিলেন তিনি। অসিতকুমারের উদ্যোগে তার নিজের অঙ্কিত চিত্র ছাড়াও বহু প্রথম সারির শিল্পীদের আঁকা ছবিও মুদ্রিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সারদাচরণ উকিল, প্রমোদকুমার চট্টপাধ্যায়, হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার প্রমুখ। বিদেশী চিত্রকলা থেকেও চিত্র আহৃত হয়েছে। ‘উত্তরা’য় প্রকাশিত ছবি ছিল অতি উচ্চমানের।
‘কল্লোল’ পত্রিকার আবির্ভাব ঘটেছিল সাহিত্য রচনার প্রচলিত ধ্যান ধারণা ভেঙে দিয়ে একটা দিক পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে। বহু শক্তিমান লেখকেরা যেন এই বাঁধ ভাঙার জন্যই অপেক্ষায় ছিলেন। ‘কল্লোল’ ছিল ‘উত্তরা’র অগ্রজ, মাত্র আড়াই বছর বয়সের তফাৎ। ‘কল্লোলে’র বিদ্রোহী মনোভাব, বিষয় ভাবনা ও সাহিত্য সৃষ্টির নতুন প্রয়াস পাঠক ও লেখক উভয় শ্রেণীর একটা বৃহৎ অংশের মধ্যে যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিল। এই ঢেউ বহির্বঙ্গে ‘উত্তরা’কেও স্পর্শ করেছিল। ‘কল্লোল’, ‘কালি কলম’ পত্রিকার সঙ্গে ‘উত্তরা’র ছিল নিয়মিত যোগাযোগ। ‘কল্লোলে’র জন্মলগ্ন থেকে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় এটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ‘উত্তরা’ প্রকাশের খবর পেয়ে উচ্ছ্বসিত পবিত্র সহ-সম্পাদক সুরেশচন্দ্রকে চিঠি লেখেন। চিঠিটি ছিল –
এ থেকেই স্পষ্ট যে ‘উত্তরা’য় গল্প, কবিতা, উপন্যাস, গান প্রভৃতি সব বিষয়েই লেখা বেরিয়েছে, কিন্তু প্রবন্ধের মান ছিল খুবই উচ্চ এবং বহু পন্ডিত ও শিক্ষিত ব্যক্তিরা তাদের মূল্যবান রচনা দিয়ে প্রবন্ধের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছেন।
‘কল্লোলে’র বহু লেখক যেমন- বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শৈলজারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ‘উত্তরা’তেও লিখেছেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাদের রচনায় সাধারণ মানুষের জীবনচর্যা, যৌনতা প্রভৃতি বিষয় স্থান পেয়েছে। ‘উত্তরা’র সাহিত্যাঙ্গনের ছিল উদার বিস্তার। বিভিন্ন চিন্তাধারার রচনা স্থান পেয়েছে এখানে। সাহিত্য-ধর্ম বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ছিল একটু ‘রক্ষণশীল’ মনোভাব। ‘উত্তরা’র সঙ্গে তার ছিল নিবিড় সম্পর্ক। তা সত্বেও বুদ্ধদেব বসুর ‘কিছুই প্রেমের মত নয়’ কবিতাটি অনায়াসে স্থান পেয়েছে পত্রিকায় (ভাদ্র ১৩৩৯)। কবিতাটির কিছু অংশ -
‘উত্তরা’ বাংলার বাইরের বাঙালী সাহিত্যপ্রেমীদের দ্বারা পরিচালিত হলেও বঙ্গের লেখকদের সঙ্গেও ছিল নিবিড় যোগাযোগ।
‘উত্তরা’য় কবিতা ছাপা হয়েছে বহু সংখ্যায়। কবিদের মধ্যে ছিলেন – কাজী নজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত, নরেন্দ্র দেব, মোহিতলাল মজুমদার, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, রাধারানী দেবী, কালিদাস রায়, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, বিষ্ণু দে, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রভৃতি। ‘দুইখানি আধুনিক কবিতার বই’ নামক একটি সমালোচনা মূলক প্রবন্ধ লিখেছেন বুদ্ধদেব বসু। পরবর্তী কালে এদের প্রায় সকলেই প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসাবে সাহিত্য ক্ষেত্রে আদৃত হয়েছেন। অল্পখ্যাত কবিদের কবিতাও অনেক ছাপা হয়েছে, তবে পত্রিকার সব সংখ্যা দেখার সুযোগ না হওয়ায় জীবনানন্দ দাশের কবিতা ছাপা পেয়েছে কি না বলা গেল না।
চিন্তাধর্মী অজস্র মূল্যবান প্রবন্ধে আকীর্ণ হয়ে রয়েছে ‘উত্তরা’র পৃষ্ঠা। বিভিন্ন বিষয়ের লেখকদের মধ্যে ছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গোপীনাথ কবিরাজ, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, জগদীশচন্দ্র গুপ্ত, প্রমথ চৌধুরী, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, বনফুল, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, আবদুল ওদুদ, পরিমল গোস্বামী, প্রবোধচন্দ্র সেন, নারায়ণ চৌধুরী, অসিতকুমার হালদার, কিরণধন চট্টোপাধ্যায়, প্রবোধকুমার সান্যাল, বিনয়কুমার সরকার, মানিক ভট্টাচার্য্য, রাধাকমল মুখোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। মহিলাদের মধ্যে ছিলেন আশাপূর্ণা দেবী, রাধারানী দেবী, আশালতা দেবী, নিরুপমা দেবী প্রমুখ।
প্রমোদকুমার চট্টপাধ্যায়ের বিখ্যাত ভ্রমন উপাখ্যান ও সাধুসঙ্গের কাহিনী ‘তন্ত্রাভিলাষীর সাধুসঙ্গ’ লেখকের নিজের আঁকা চিত্র সহকারে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘উত্তরা’য়।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘উত্তরা’র অন্যতম প্রেরণাদাতা ও অবলম্বন। তিনি নিজে ত লিখেইছেন, তাকে নিয়েও বহু লেখকের অজস্র লেখা প্রকাশিত হয়েছে ‘উত্তরা’য়। কয়েকটি নমুনা – ‘রবীন্দ্র শিল্প প্রসঙ্গ’ (পরিমল গোস্বামী), ‘শ্রীঅরবিন্দ ও রবীন্দ্রনাথ’ (ভূপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য), ‘রবীন্দ্র প্রতিভায় সঙ্গীতের ভূমিকা’ (সুধীন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত), ‘রবীন্দ্ররচনায় মানবতার স্থান’ (শিশিরকুমার মৈত্র), ‘রাবীন্দ্রিক ছন্দ’ (প্রবোধকুমার সেন), ‘রবীন্দ্রনাথের রেকর্ড’ (সন্তোষকুমার দে), ‘সৌন্দর্যসাধক রবীন্দ্রনাথ’ (নরেন্দ্র দেব), ‘মিস্টিসিজম ও রবীন্দ্রনাথ’ (মিহিরকুমার মুখোপাধ্যায়), ‘রবীন্দ্রনাথের কাব্যে ও সংগীতে চিত্রাভাস’ (অসিতকুমার হালদার), ‘রবীন্দ্রনাথের গান’ (কাজী আবদুল ওদুদ) ইত্যাদি। একটি উল্লেখযোগ্য রচনা অতুলপ্রসাদ সেন রচিত ‘আমার কয়েকটি রবীন্দ্র স্মৃতি’ (‘উত্তরা’, ষষ্ঠ বর্ষ, মাঘ ১৩৩৮)। এটি ছিল দিল্লীর ‘রবীন্দ্র-জয়ন্তী’ উৎসবে সভাপতির অভিভাষণ।
‘উত্তরা’র কার্য্যালয় প্রথম কয়েক বছর ছিল লক্ষ্ণৌতে, পরে তা কাশীতে স্থানান্তরিত হয়। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ইন্ডিয়ান প্রেসের কাশী শাখার মুদ্রণালয় থেকে। পরে ছাপা হয় কলকাতার মডার্ন আর্ট প্রেসে। কিন্তু কলকাতা থেকে কাশী যাতায়াত অসুবিধাজনক বলে সুরেশচন্দ্রের চেষ্টায় অবশেষে ‘উত্তরা’র নিজের ছাপাখানা হয়।
পত্রিকার অর্থকষ্ট এক সময়ে খুবই প্রকট হয়েছিল। এজন্য অতুলপ্রসাদও খুব বিব্রত হয়ে পড়েন। একটি চিঠিতে তিনি সুরেশচন্দ্রকে লিখেছেন – “উত্তরার জন্য আমাকে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে, যদি জানতাম আমার ওপরেই সব দায়িত্ব ফেলবে তাহলে একাজে হস্তক্ষেপ করতাম না। যাহা হউক, আমি আর একখানা ৫০০ টাকার চেক Indian Press -এর নামে দিচ্ছি। ………।”
এই পরিস্থিতিতে সুরেশচন্দ্র অর্থনৈতিক সব দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নেন।
‘উত্তরা’য় বেশ কিছু বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অবনীন্দ্রনাথের প্রয়াণে বেরিয়েছিল কেদারনাথ স্মৃতিসংখ্যা ও অবনীন্দ্র সংখ্যা। ২৬শে আগষ্ট ১৯৩৪ সালে (১৩৪১ বঙ্গাব্দ) অতুলপ্রসাদের মৃত্যু হলে ১৩৪১ বঙ্গাব্দের আশ্বিন সংখ্যাটি অতুল সংখ্যা হিসাবে প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যাতেই রবীন্দ্রনাথের ‘অতুলপ্রসাদ সেন’ শীর্ষক কবিতাটি কবির হস্তাক্ষরের প্রতিলিপি করে মুদ্রিত হয়েছিল। কবিতাটির কিয়দংশ –
অতুলপ্রসাদ অবীন্দ্রনাথের কত প্রিয় ও অন্তরঙ্গ ছিলেন কবিতাটির প্রতি ছত্রে সেটি পরিস্ফুট।
অবশেষে সত্যিই রবীন্দ্রনাথ ইহলোক ত্যাগ করেন ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ। ‘উত্তরা’র সম্পাদকীয়তে লেখা হয় – “তিনি আর আমাদের মধ্যে নেই, একথা আমরা ভাবতেই পারি না। তিনি অমর। তিনি বেঁচে আছেন আমাদের সকলের অন্তরে। তিনি বেঁচে থাকবেন – তাঁর সৃষ্ট কাব্যলোকে। প্রতিটি ঋতুর আবর্তনে যখন প্রকৃতি আপনার লীলা-চাঞ্চল্যে অধীর হয়ে উঠবে – আমরা রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতার মধ্যে তাঁর আবির্ভাব নতুন নতুন করে অনুভব করবো।”
১৩৪৮-এর আশ্বিন সংখ্যাটি রবীন্দ্রসংখ্যা রূপে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৬২ সালে রবীন্দ্র-জন্ম-শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বেরিয়েছিল একটি বিশেষ রবীন্দ্রসংখ্যা।
পত্রিকার প্রকাশ প্রথম দিকে ছিল কিছুটা অনিয়মিত। কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিতও হয় নি, কয়েকটি যুগ্ম-সংখ্যাও বেরিয়েছিল। সপ্তম বর্ষ থেকে (আষাঢ় ১৩৩৯) অতুলপ্রসাদ সম্পাদনার ভার অর্পন করেন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীকে। সাধারণতঃ প্রতিমাসের প্রথম সপ্তাহে প্রকাশিত হত পত্রিকা। রয়্যাল সাইজের পত্রিকাটি তিন রঙের প্রচ্ছদে চিত্রিত হত। প্রথমে মূল্য ছিল বার্ষিক সডাক তিন টাকা চার আনা এবং প্রতি সংখ্যা চার আনা , পরে বৃদ্ধি পেয়ে হয় বার্ষিক সডাক চার টাকা এবং আলাদা ভাবে প্রতি সংখ্যা সাঁইত্রিশ পয়সা।
‘উত্তরা’ বাংলার বাইরে থেকে প্রকাশিত হওয়ায় বহু পুস্তকাগারেই এটির সন্ধান মেলে না। জাতীয় গ্রন্থাগার ছাড়া রয়েছে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে। অতুলপ্রসাদ বা ‘উত্তরা’ সম্বন্ধে লেখাও প্রকাশিত হয়েছে তুলনামূলক ভাবে কম। এ বিষয়ে দু’টি মূল্যবান প্রবন্ধের উল্লেখ করা যায়। প্রথমটি প্রকাশিত হয়েছিল অধুনাপুপ্ত ‘যুগান্তর’ পত্রিকার রবিবারের সাময়িকি বিভাগে ৭ই শ্রাবণ ১৩৬২ বঙ্গাব্দে। প্রবন্ধটির নাম ‘কাশীর সাহিত্য-জীবন ও উত্তরা’, লেখক রবীন্দ্র সেনগুপ্ত। কিছু সংশোধন সহ প্রবন্ধটি পুনর্মুদ্রিত হয়েছিল ‘উত্তরা’র ত্রিংশ বর্ষের প্রথম সংখ্যায় আষাঢ় ১৩৬২-তে। শ্রাবণের প্রবন্ধ আষাঢ়ে পুনর্মুদ্রিত হওয়ার রহস্য নিহিত রয়েছে পত্রিকার বিলম্বিত প্রকাশে। দ্বিতীয় রচনাটির লেখিকা অরুণা চট্টোপাধ্যায়। ‘উত্তরা অতুলপ্রসাদ সেন ও সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী’ নামে প্রবন্ধটি ১৩৯৭ বঙ্গাব্দের ‘দেশ’ পত্রিকার সাহিত্য সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের জয়পুর অধিবেশনে ‘প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন’ নামটি পরিবর্তিত হয়ে সংস্থার নাম হয়েছিল ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’।
‘উত্তরা’র অনেক সংখ্যাই দেখার সুযোগ না হওয়ায় এখানে পত্রিকাটির প্রাথমিক ভাবে কিছু তথ্য দেওয়া হল। দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে পথ-চলা একটা পত্রিকার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় দিতে হ’লে পত্রিকার অধিকাংশ সংখ্যাই হাতে পাওয়া দরকার। পত্রিকার শেষ সংখ্যা বেরিয়েছিল ১৯৬৬ সালে।
একজনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখ না করলে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তিনি হলেন সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী। অক্লান্ত পরিশ্রমী এবং পত্রিকা সম্পাদনায় অভিজ্ঞ এই ব্যক্তিটি সমস্ত প্রতিকূলতা সত্বেও ৪১ বছর ধরে যে ভাবে পত্রিকার হাল ধরেছিলেন কোনো প্রশংসাই তার জন্য যথেষ্ট নয়। ‘উত্তরা’র উত্তরণে সার্থক কান্ডারী তিনি। বাংলা ও বাংলার বাইরের নবীন ও প্রবীন লেখকদের বিভিন্ন বিষয়ের নানা স্বাদের রচনা যত্ন সহকারে ‘উত্তরা’র প্রশস্ত সাহিত্যাঙ্গনে স্থান করে দিয়ে ‘উত্তরা’কে একটি প্রথম শ্রেণীর সাহিত্য পত্রিকার মর্যাদা দিয়েছেন তিনি। ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে’র মুখপত্র ‘উত্তরা’ ও তার প্রাণপুরুষ সুরেশ চক্রবর্তীর নাম বাংলা সাময়িক পত্রের ইতিহাসে চির অম্লান থাকবে।
সংযুক্ত প্রতিলিপি –
চিত্র – ১ : ১৩৪০ আশ্বিন সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা।
চিত্র – ২ : ‘উত্তরা’য় প্রকাশিত ফটো - হাফিজের কবরের পাশে রবীন্দ্রনাথ।
চিত্র – ৩ : ১৩৩৯ কার্ত্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হেমেন্ মজুমদারের আঁকা ছবি।
লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.