বঙ্গবাণী
দীপক সেনগুপ্ত
বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশ ও উৎকর্ষতা লাভের পেছনে সাময়িক পত্রিকার একটি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন, ধর্ম, রাজনীতি ও সমাজ জীবনের বিভিন্ন প্রাঙ্গনের নানা বৈচিত্রপূর্ণ বিষয়বস্তু নির্বাচিত রচনা প্রকাশের মাধ্যমে যেমন আগ্রহী পাঠকদের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে তেমনি লেখকেরাও উৎসাহিত হয়েছে তাদের রচনা সার্থকতা লাভ করায়। এই প্রক্রিয়ায় শিক্ষিত পাঠকবর্গ গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রচয়িতারাও পরিণত হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন। বাংলা সাহিত্যের বিশেষ প্রয়োজনে বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশ করেছেন। চার বছর পরেই তার মনে হয়েছে যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন সেটা সিদ্ধ হওয়ায় পত্রিকাটির আর কোন প্রয়োজন নেই। ‘বঙ্গদর্শন’ যে বাংলা ভাষার গতিপথকে সুনির্দিষ্ট করে তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে এবং এতদ্বারা যে ভাষা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল একথা বিদগ্ধ জনেরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন। অবহেলায় ফেলে রাখা লেখার স্তূপ থেকে অসমাপ্ত একটি রচনা খুঁজে বার করে তাগাদা দিয়ে না লেখালে শরৎচন্দ্রের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘পথের দাবী’র ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশ বিলম্বিত হত, হয়ত চিরদিন লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যেত। প্রবাসী সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় না ‘খোঁচালে’ রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসটির ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। এভাবেই সাময়িকপত্র উদ্যোগ নিয়ে প্রথিতযশা লেখকদের রচনা পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। অন্য দিকে লেখকদেরও পত্রিকাকে প্রয়োজন হয়েছে পাঠকদের কাছে পৌঁছোনর জন্য। ‘ভারতী’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হেমেন্দ্রকুমার রায়ের খেদোক্তি –“ভারতী আর বাঁচল না। এ দুঃখ আমার আজও যায় নি। কারণ প্রধানতঃ ভারতীকে অবলম্বন করেই সাহিত্য ক্ষেত্রে আমি হয়েছিলুম পরিচিত।”
বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে যে সাময়িক পত্রিকাগুলি জনপ্রিয় হয়েছিল তাদের মধ্যে রয়েছে ‘বঙ্গবাণী’ (১৯২১), ‘মাসিক বসুমতী’ (১৯২২), ‘কল্লোল’ (১৯২৩), ‘বিচিত্রা’ প্রভৃতি। ছোটোদের পত্রিকার মধ্যে রয়েছে ‘শিশুসাথী’ (১৯২২), ‘রামধনু’ (১৯২৭), ‘যাদুঘর’ (১৯২৭) এবং আরও কয়েকটি। এদের মধ্যে ‘বঙ্গবাণী’র যাত্রা শুরু হয়েছিল আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উৎসাহ ও সক্রিয়তায়। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা পঠন পাঠন চালু করার ক্ষেত্রে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আগ্রহ ও উদ্যোগ অনেকেরই জানা। তার পুত্রদ্বয়ের ইচ্ছা ছিল বাংলায় চিন্তাশীল লেখকদের সৃষ্টিধর্মী রচনা একটি পত্রিকার মাধ্যমে নিরন্তর সাধারণের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাদের রুচিবোধকে পরিচ্ছন্ন করে উচ্ছৃঙ্খলতার হাত থেকে রক্ষা করা। এর জন্যই একটি পত্রিকার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এভাবেই ‘বঙ্গবাণী’র যাত্রা শুরু। অবশ্যই এর পেছনে ছিল আশুতোষের প্রত্যক্ষ সমর্থন। ‘বঙ্গবাণী’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩২৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে (১৯২১ খ্রিঃ)। যুগ্মভাবে পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন বিজয়চন্দ্র মজুমদার ও দীনেশচন্দ্র সেন। বিজয়চন্দ্র ছিলেন ভাষাতত্ববিদ, প্রত্নতাত্বিক, গবেষক ও কবি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রধান শিক্ষক দীনেশচন্দ্রই প্রথম বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে বাংলা সাহিত্যের গবেষণায় প্রবৃত্ত হন এবং ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’, ‘হিস্টরি অফ বেঙ্গলী লাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিটারেচার’ প্রভৃতি বিখ্যাত গ্রন্থ রচনা করেন। পরবর্তী কালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু রিসার্চ ফেলোশিপ পদে যোগদান করেন দীনেশচন্দ্র। অতএব ‘বঙ্গবাণী’ যোগ্য নেতৃত্বের হাত ধরেই সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিল। পত্রিকার কার্য্যাধক্ষ ও সত্বাধিকারী ছিলেন রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। ৭৭নং আশুতোষ মুখার্জি রোড, ভবানীপুরে ছিল পত্রিকা কার্যালয়। মূল্য ছিল প্রতি সংখ্যা সাত আনা ও বার্ষিক চারটাকা বার আনা।
‘বঙ্গবাণী’র বৈশিষ্ট্য ছিল এর নিরপেক্ষতা। ‘সবুজপত্রে’ যেমন ছিল প্রমথ চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথের প্রাধান্য, চিত্তরঞ্জনের ‘নারায়ণ’ ছিল রবীন্দ্রবর্জিত। এদের কেন্দ্র করে পত্রিকার নিজস্ব লেখকগোষ্ঠিও গড়ে উঠেছিল। ‘বঙ্গবাণী’র কোন লেখকগোষ্ঠি ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্গবাণী’তে লিখেছেন। ‘নারায়ণে’র বিপিনচন্দ্র পালেরও বহু লেখা পত্রিকায় বেরিয়েছে। চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর পর ‘বঙ্গবাণী’র বিশেষ সংখ্যাও প্রকাশিত হয়েছে। সে সময়ে ‘কল্লোল’ পত্রিকা সাহিত্য রচনার প্রচলিত রীতি ও ধারাকে সরিয়ে রেখে ‘বাস্তবমুখী’ বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে লেখা প্রকাশ করতে এগিয়ে এসেছিল। ‘কল্লোলে’র এই সাহসী পদক্ষেপে রক্ষণশীলেরা সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। এই পত্রিকার দুই সম্পাদক গোকুলচন্দ্র নাগ ও দীনেশরঞ্জন দাশের লেখাও নির্দ্বিধায় ‘বঙ্গবাণী’ ছেপেছে। এজন্যই ‘বঙ্গবাণী’ ঘোষণা করেছিল –“আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল এই পত্রিকাকে কোন দল বিশেষের বা সম্প্রদায় বিশেষের মুখপত্র করিব না। সকল শ্রেণীর চিন্তাশীল সুলেখকদিগকে স্বাধীনভাবে তাঁদের বিভিন্ন মতবাদ প্রকাশ করিতে অনুরোধ করিব।” অন্যত্র বলা হয়েছে –“স্বাধীন চিন্তাই প্রাণ, ও মতভেদের বৈচিত্র্যই উন্নত সমাজের বিশিষ্টতা। সুতরাং কোন সম্প্রদায় বা দলবিশেষের আধিপত্য বাড়াইয়া সাহিত্যকে সঙ্কীর্ণ করা হইবে না। এই পত্রিকায় চিত্ত বিনোদনের উপকরণের সঙ্গে গুরুতর চিন্তার বিষয়গুলিও থাকিবে।” এই ঘোষণা আক্ষরিক অর্থেই বাস্তবায়িত হয়েছিল।
প্রথম সংখ্যায় পত্রিকার শুরুতেই রয়েছে ‘বঙ্গবাণী’ নামক কবিতা, যার প্রথম ক’টি পংক্তি –
শেষ দু’টি পংক্তি –
এর পর সম্পাদকের বিবৃতির পরেই রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘বাণী-বিনিময়’। প্রতি সংখ্যার প্রারম্ভিক পৃষ্ঠার শীর্ষদেশে ছাপা হত শিব মন্দিরের ছবি এবং তার নীচে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা থেকে উদ্ধৃতি – “আবার তোরা মানুষ হ।” সম্পাদকের বক্তব্যের কিছু অংশ থেকে হয় তো পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য আরো একটু স্পষ্ট হবে – “নূতন যুগ আসিয়াছে; দেশে নূতন উৎসাহ ও উদ্দীপনা দেখা দিয়াছে। এটি ইতিহাসসিদ্ধ যে, নূতন উৎসাহ ও উদ্দীপনার যুগে অনেক নূতন বিপদ আসিয়া উন্নতির বাধা হইয়া দাঁড়ায়। ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতায় সেই বিপদ এড়াইবার ব্যবস্থা করিতে হইবে। সুবুদ্ধির পরিচালনা না থাকিলে হিতৈষণার মোহ, কেবল অন্ধকার সৃষ্টি করে, ও উচ্ছৃঙ্খল উৎসাহ সমাজে আত্মদ্রোহ ও আত্মহত্যা টানিয়া আনে। যাহারা কর্ম্মের নামে ব্যগ্র ও চঞ্চল, তাহারা চিন্তাশীলদিগকে অকর্ম্মা বলিয়া উপেক্ষা করিবেই, কিন্তু উৎসাহ-পীড়িত কর্ম্মিদলের নায়কদিগকে পরোক্ষভাবে নিয়মিত করিবার জন্য চিন্তাশীলদিগের অভিজ্ঞতার বাণী নিরন্তর প্রচার করিবার প্রয়োজন। আমরা এদিনে হিতৈষী মন্ত্র-দ্রষ্টাদের মন্ত্রণা ভিক্ষা করিতেছি। ......”
প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত রচনাগুলি ছিল – ‘বঙ্গবাণী’ (কবিতা), সম্পাদকীয়, ‘বাণী-বিনিময়’ (কবিতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবির হস্তাক্ষরের প্রতিলিপি সহ), ‘শিল্পে অনধিকার’ (প্রবন্ধ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘অপরাজিতা’ (ধারাবাহিক উপন্যাস, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ), ‘ভারতে শাসনসংস্কার’ (প্রবন্ধ, প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘একখানি উপন্যাস’ (কবিতা, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়), ‘গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের পত্রালী’ (হেমেন্দ্র সরকারকে লিখিত পত্রগুচ্ছ), ‘বর্ত্তমান সমস্যা’ (প্রবন্ধ, অক্ষয়কুমার সরকার), ‘গ্রেপ্তার’ (সংক্ষিপ্ত রম্য-রচনা, লেখকের নাম নেই), ‘পাষাণী’ (গল্প, সুনীতি দেবী), ‘শিক্ষার কথা’ (প্রবন্ধ, সুরেন্দ্রনাথ সেন), নিয়মিত বিভাগ - ‘ছিটে ফোঁটা’, দুটি কার্টুন, ‘টমাস ও রামরাম বসু’ (প্রবন্ধ, দীনেশচন্দ্র সেন), ‘হারানো খাতা’ (ধারাবাহিক উপন্যাস, অনুরূপা দেবী), ‘রেবাতটের স্মৃতি’ (কবিতা, কালিদাস রায়), নিয়মিত বিভাগ-‘আইন আদালত’, ‘পুরাতনী’ (অমরেন্দ্রনাথ রায়), ‘প্রতিধ্বনি’ (আনাতোল ফ্রাঁসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি উপলক্ষ্যে রচিত প্রবন্ধ, সতীশচন্দ্র বাগচী), কিছু টুকরো খবর (রক্ত পরীক্ষায় রক্তের সম্পর্ক নির্ণয়, কুলকরনীর কথা, অতুলপ্রসাদের মৃত্যু), ‘কৃষিজীবী’ (প্রবন্ধ, নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়), ‘বিলাতী বিজ্ঞানের দেশী চাষ’ (প্রবন্ধ, বিজলীবিহারী সরকার), নিয়মিত ফিচার – ‘ফাল্গুনে’, রোগশয্যা থেকে বিপিনচন্দ্র পালের বক্তব্য। এরপর ছাপা হয়েছে বিজ্ঞাপন এবং সব শেষে রয়েছে অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি। প্রথম সংখ্যাটি ছিল ১০২ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে ‘শিল্পে অধিকার’ প্রবন্ধটি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে অবনীন্দ্রনাথের বাগীশ্বরী প্রফেসররূপে প্রদত্ত প্রথম বক্তৃতা। তার প্রদত্ত মোট সাতাশটি বক্তৃতা ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যায় প্রদত্ত রচনার তালিকা থেকে স্পষ্ট যে পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যাই বৃহৎ সংখ্যক বৈচিত্রপূর্ণ রচনাসম্ভার নিয়ে আত্মপ্রকাশ করত।
রবীন্দ্রনাথের একটি মাত্র গল্প ‘পরীর পরিচয়’ ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হয়েছে (বৈশাখ ১৩২৯)। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আহুত হয়ে কবি চীন যাত্রার আগে অনেক ব্যস্ততা সত্বেও ‘সাহিত্য’, ‘তথ্য ও সত্য’ এবং ‘সৃষ্টি’ নামক বক্তৃতা তিনটি দিয়েছিলেন ১৩৩০-এর ফাল্গুন ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখে। তিনটি বক্তৃতাই ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩১-এর বৈশাখ, ভাদ্র ও কার্তিক সংখ্যায়। রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি অভিভাষণও প্রকাশিত হয়েছে – ‘ম্যালেরিয়া’ (জ্যৈঃ ১৩৩১, এন্টি-ম্যালেরিয়া কো-অপারেটিভ সোসাইটির ৪র্থ বার্ষিক সভায় ১৯২৪ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি এলফ্রেড হলে সভাপতিরূপে প্রদত্ত ভাষণ), ‘রেঙ্গুনে বাঙলা সাহিত্য সম্মিলনীতে কবি সম্বর্ধনা উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের অভিভাষণ’ (জ্যৈঃ ১৩৩১), ‘ভারতীয় দার্শনিক সঙ্ঘের সভাপতির অভিভাষণ’ (ইংরাজি থেকে অনূদিত, মাঘ ১৩৩২), ‘সম্মান’ (চন্দননগর পৌরসভায় অভ্যর্থনা উপলক্ষ্যে কথিত, জ্যৈঃ ১৩৩৪)।
রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি কবিতাও ছেপেছে ‘বঙ্গবাণী’। এর মধ্যে রয়েছে – ‘বাণী বিনিময়’ (কবির হস্তাক্ষরের প্রতিলিপি মুদ্রিত হয়েছে প্রথম সংখ্যায়), ‘ভাঙা মন্দির’, ‘গানের সাজি এনেছি আজি’, ‘যাত্রা’, ‘বাতাস’, ‘পদধ্বনি’ প্রভৃতি। দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গে ১৯২৫-এর ২৯শে মার্চ ও ৮ই এপ্রিল রবীন্দ্রনাথের যে কথোপকথন হয় তার অনুলিখন দিলীপকুমার বোলপুরে কবিকে পাঠিয়েছিলেন। অসুস্থতা সত্বেও রবীন্দ্রনাথ তার নিজের বক্তব্যটুকু আদ্যন্ত লিখে দিয়েছিলেন। ‘রবীন্দ্রনাথ, সাহিত্য ও সঙ্গীত’ শিরোনামে তার সেই পরিমার্জিত কথোপকথনটি ‘বঙ্গবাণী’র ১৩৩২ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞানী রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের পত্রগুচ্ছ ‘রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলী’ নামে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে ফাল্গুন ১৩৩৩ থেকে আষাঢ় ১৩৩৪ পর্যন্ত।
রবীন্দ্রনাথ ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার ১৩৩৪-এর শ্রাবণ সংখ্যায় ‘সাহিত্যধর্ম্ম’ নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ‘কল্লোলে’র মত পত্রিকাগুলি সাহিত্য রচনার প্রচলিত রীতিনীতি বর্জন করে বাস্তবমুখী বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে যে লেখা ছাপতে শুরু করে, রক্ষণশীল গোষ্ঠির সজনীকান্ত দাস সেটা সহ্য না করতে পেরে রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হন। এই পরিস্থিতে রবীন্দ্রনাথ উপরোক্ত প্রবন্ধটি প্রকাশ করেন। নব্য ভাবধারার লেখকেরা এর প্রতিবাদে সোচ্চার হন। নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ভাদ্র সংখ্যায় ‘সাহিত্যধর্ম্মের সীমানা’ প্রবন্ধের মাধ্যমে রবীন্দ্রমতের সমালোচনা করেন। এরই রেশ ধরে নরেশচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের বাদানুবাদ সম্বলিত কিছু পত্র ‘‘সাহিত্য-ধর্ম্ম’-এর জের’ শিরোনামে ‘বঙ্গবাণী’র মাঘ সংখ্যায় (১৩৩৪) প্রকাশিত হয়। ‘সাহিত্যের আব্রুতা ও বে-আব্রুতা’ নিয়ে এই মতদ্বৈধে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও লেখনী হাতে এগিয়ে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গীর বিরোধিতা করে ‘বঙ্গবাণী’র আশ্বিন ১৩৩৪ সংখ্যায় তিনি ‘রসাহিত্যের রীতি ও নীতি’ নামক একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। এই বাদ-প্রতিবাদের মূল সুর ছিল কিঞ্চিৎ আক্রমণাত্মক – অবশ্যই মার্জিত ভাষায়্ পরিবেশিত। সমধর্মী রচনা হিসাবে গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরীর ‘সাহিত্য-ধর্ম্ম’ নামক প্রবন্ধটির উল্লেখ করা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের গল্প, কবিতা ও গান ছাড়াও বেশ কয়েকটি অভিভাষণ প্রকাশিত হয়েছে ‘বঙ্গবাণী’তে। বিজ্ঞানসাধক রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লেখা কবির পত্রগুচ্ছ ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছে চারটি সংখ্যায়। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি মাত্র গল্প বেরিয়েছে।
শুরুতে ‘বঙ্গবাণী’তে লেখা দিতে শরৎচন্দ্রের একটু অনীহা ছিল। তার বক্তব্য ছিল – “ও আশু মুখুজ্জের ছেলেদের কাগজ, সাহিত্য সৃষ্টি করা ওদের উদ্দেশ্য নয়, প্রবাসী ও মডার্ন রিভিউর পালটা গাইবার জন্য্ ওদের কাগজ বাহির করা - ওতে আমি লিখব না।” রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সনির্বন্ধ অনুরোধে শরৎচন্দ্র অবশেষে লিখতে রাজী হন। শরৎচন্দ্র ‘বঙ্গবাণী’তে তিনটি গল্প লিখেছেন – ‘মহেশ’ (আশ্বিন ১৩২৯), ‘অভাগীর স্বর্গ’ (মাঘ ১৩২৯) ও ‘সতী’ (আষাঢ় ১৩৩৪)। ‘মহেশ’ পাঠকমহলে যথেষ্ট আদৃত হয়েছিল। ‘শরৎচন্দ্রের ‘মহেশে’র প্রতি’ শীর্ষক কালিদাস রায়ের একটি কবিতা প্রকাশিত হয় ১৩৩৩-এর ফাল্গুন সংখ্যায়। এর পরেই উল্লেখ করতে হয় ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটির। এটি পত্রিকাতে প্রকাশের কৃতিত্ব পত্রিকার কার্যাধ্যক্ষ রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। ফেলে রাখা কাগজের স্তূপ থেকে অসমাপ্ত উপন্যাসটির পান্ডুলিপি পড়ে রমাপ্রসাদ মুগ্ধ হন এবং শরৎচন্দ্রকে অনুরোধ করেন উপন্যাসটি সম্পূর্ণ করে ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশ করতে। ১৩২৯-এর ফাল্গুন সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে ‘পথের দাবী’ ‘বঙ্গবাণী’তে ছাপা হতে থাকে। উপন্যাসটি পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলেছিল। তবে এটির প্রকাশ ছিল অনিয়মিত। কিছুটা উদাসীন ও অগোছালো শরৎচন্দ্রকে তাগাদা দিয়ে লেখাতে হত। মোট ২৪টি কিস্তিতে সমাপ্ত হয়েছিল উপন্যাসটি। ১৩৩২ বঙ্গাব্দে ‘পথের দাবী’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে তৎকালীন ইংরেজ সরকার রাজদ্রোহীতার অভিযোগ এনে গ্রন্থটি বাজেয়াপ্ত করে। সেটা অন্য প্রসঙ্গ। শরৎচন্দ্রের তিনটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়।
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ সম্বন্ধে শরৎচন্দ্রকে লেখা সুভাষ চন্দ্র বসুর চিঠি ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩২-এর কার্ত্তিক সংখ্যায়। মান্দালয় সেন্ট্রাল জেল থেকে ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট লেখা হয়েছিল চিঠিটি। এ ছাড়া ‘প্রতিধ্বনি’ বিভাগে ‘বর্ত্তমান হিন্দু মুসলমান সমস্যা’ শিরোনামে ‘হিন্দুসঙ্ঘে’ লেখা শরৎচন্দ্রের একটি প্রবন্ধ পুনর্মুদ্রিত হয়েছে কার্ত্তিক ১৩৩৩ সংখ্যায়।
‘পথের দাবী’ ছাড়া আরও কয়েকটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে ‘বঙ্গবাণী’তে। এগুলি হল – ‘অপরাজিতা’ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, ফাঃ ১৩২৮), ‘হারানো খাতা’ (অনুরূপা দেবী, ফাঃ ১৩২৮), ‘দেবত্র’ (নিরুপমা দেবি, ১৩২৯), ‘সতী’ (অনুরূপা দেবী, কাঃ ১৩৩০), ‘বিসর্জ্জন’ (চপলাবালা বসু, শ্রাঃ ১৩৩১), ‘খেয়ালী’ (সরোজবাসিনী গুপ্তা, ভাঃ ১৩৩২), ‘সমুদ্রগুপ্ত’ (রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়, আশ্বিন ১৩৩২), ‘তৃপ্তি’ (নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্যৈঃ ১৩৩৩), ‘দশচক্র’ (বনবিহারী মুখোপাধ্যায়, অগ্রঃ ১৩৩৩), ‘প্রজাপতির দৈত্য’ (সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, বৈঃ ১৩৩৪)। বন্ধনীর মধ্যে পত্রিকার যে সংখ্যা থেকে উপন্যাসটি শুরু হয়েছে সেটি দেওয়া হল।
পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষ শেষ হলে অন্যতম সম্পাদক দীনেশচন্দ্র সেন নিজের পদে আর থাকতে চান নি। এ বিষয়ে দ্বিতীয় বর্ষের শেষে ‘দীনেশবাবুর পত্র’ শিরনামে বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়েছে – “বঙ্গবাণীর দ্বিতীয় বর্ষ উত্তীর্ণ হইল। নানা কারণে আমি সম্পাদকরূপে পত্রিকার কার্য্য্ বিশেষ কোন সহায়তা করিতে পারি নাই। অনেক সময়েই আমি রোগের শয্যায় পড়িয়াছিলাম।, সুতরাং ইচ্ছা থাকিলেও কার্য্য করিবার শক্তি ছিলনা। এখনও আমার শরীর শোধরায় নাই, বিশেষতঃ বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুতর কর্ত্তব্য ভার কাঁধে বহন করিয়া বঙ্গবাণীর সেবায় আমরা ঈপ্সিত পরিমাণ মনোযোগ ভবিষ্যতে দিতে পারিব, ইহার কোন সম্ভাবনাই দেখিতে পাইতেছি না। সুতরাং বৃথা সম্পাদকীয় পদের সম্মানের প্রতি লোভ রাখা আমি যুক্তিযুক্ত মনে করি না।” প্রসঙ্গত আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রামতনু লাহিড়ী রিসার্চ ফেলোশিপ’ পদে যোগদান করেন দীনেশচন্দ্র। তবে সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিলেও পত্রিকার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয় নি, নিয়মিতই তিনি লেখা প্রকাশ করেছেন। তার বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও গল্প লিখেছেন মাত্র একটি। ‘পুত্র-স্নেহ’ নামে তার এই গল্পটি ছাপা হয়েছে ১৩৩২-এর ফাল্গুন সংখ্যায়।
কবি জীবনানন্দ ‘বঙ্গবাণী’তে কবিতা লেখার সময় নিজের পদবী লিখতেন দাশগুপ্ত। পরে ‘গুপ্ত’ বাদ দিয়ে শুধু ‘দাশ’ লিখতেন। ‘বঙ্গবাণী’তে তার বেশ কয়েকটি কবিতা বিধৃত রয়েছে। ‘দেশবন্ধুর প্রয়াণে’ (শ্রাঃ ১৩৩২), ‘বিবেকানন্দ’ (অগ্রঃ ১৩৩২), ‘হিন্দু মুসলমান’ (আষাঢ় ১৩৩৩), ‘ভারতবর্ষ’ (শ্রাঃ ১৩৩৩), ‘রামদাস’ (ভাঃ ১৩৩৩), ‘নিবেদন’ (কাঃ ১৩৩৩), ‘পলাতকা’ (মাঘ ১৩৩৪) ইত্যাদি কবিতাগুলির মধ্যে কয়েকটি যথেষ্ট আদৃত হয়েছিল। অন্যান্য কবিদের মধ্যে রয়েছেন কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কামিনী রায়, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, বন্দে আলি মিয়া, কিরণধন চট্টোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, ভূজঙ্গধর রায়চৌধুরী, প্যারীমোহন সেনগুপ্ত, মুনীন্দ্রনাথ ঘোষ, যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, প্রিয়ম্বদা দেবী, গোলাম মোস্তাফা, আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কবিগুণাকর প্রমুখ।
বিপ্লবী ভ্লাদিমির লেনিন ইহলোক ত্যাগ করেন ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে জানুয়ারি (মাঘ ১৩৩০)। জ্যৈষ্ঠ ১৩৩১ সংখ্যায় কবি যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য আবেগমথিত হয়ে তার বিখ্যাত ‘লেনিন’ কবিতাটি প্রকাশ করেন। কবিতার শেষ কয়টি পংক্তি ছিল –
কাজি নজরুল ইসলামের খুব বেশি লেখা ‘বঙ্গবাণী’তে প্রকাশিত হয় নি। তার ‘শায়ক-বেঁধা-পাখী’ বেরিয়েছে আষাঢ় ১৩২৯ সংখ্যায়; আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়াণে নজরুল লিখেছেন ‘আশু-প্রয়াণ গীতি’ (আষাঢ় ১৩৩১)। তার সুবিখ্যাত ‘কান্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটি ‘বঙ্গবাণী’তেই প্রথম প্রকাশিত হয় জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩-এ। ‘চির-চেনা’ নামে একটি গান রয়েছে শ্রাবণ ১৩২৯ সংখ্যায়। এছাড়া দুটি গজল গানও লিখেছেন বিদ্রোহী কবি। সুকবি বিজয়চন্দ্র মজুমদার সম্পাদকীয় কাজ করেও বহু লেখা পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ। পত্রিকার প্রয়োজনে তাকে লিখতেই হয়েছে, প্রায় প্রতি মাসেই তার লেখা বেরিয়েছে।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের কয়েকটি অভিভাষণ চোখে পড়ে – ‘বর্ত্তমান যুগ-সমস্যা ও ছাত্রগণের কর্ত্তব্য’ (সিরাজগঞ্জ ছাত্র সম্মিলনীতে সভাপতির অভিভাষণ), ‘জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা’ (ফাঃ ১৩৩০, মেদিনীপুর জেলার কলাগাছিয়া গ্রামে ১৯২৪-এর ১৫ই জানুয়ারি প্রদত্ত ভাষণ), ‘দিনাজপুর রাষ্ট্রীয় সমতির সভাপতির অভিভাষণ’ (শ্রাঃ ১৩৩১)। এ ছাড়াও রয়েছে তার কিছু প্রবন্ধ – ‘বিবেকানন্দ ও বর্ত্তমান বাঙ্গালা’, ‘সামাজিক ব্যাধি ও তার বিষময় ফল’ প্রভৃতি।
চিকিৎসক সাহিত্যিক বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ‘বনফুল’ ছদ্মনামেই সমধিক খ্যাত। তিনি অনেক ছোট গল্পের রচয়িতা। ‘বঙ্গবাণী’তে তিনি ছ’টি কবিতা ও একটি ছোট গল্প লিখেছেন। ‘এক ফোঁটা গল্প’ নামে তার এক পৃষ্ঠার গল্পটি ছাপা হয়েছে ১৩২৯-এর মাঘ সংখ্যায়। ড: বনবিহারী মুখোপাধ্যায় যখন মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকতা করেছেন তখন বনফুল তার ছাত্র ছিলেন। ব্যঙ্গসাহিত্যস্রষ্টা বনবিহারী ছিলেন সাহিত্যক্ষেত্রে বনফুলের অন্যতম প্রেরণাদাতা। মাস্টার মশাইয়ের জীবন অবলম্বন করে বনফুল তার ‘অগ্নীশ্বর’ উপন্যাস রচনা করেছেন। চলচ্চিত্রায়িত ‘অগ্নীশ্বর’ খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। বনবিহারী ‘বঙ্গবাণী’তে লিখেছেন উপন্যাস, নাটক, গল্প ও কবিতা।
‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ খ্যাত স্বল্পায়ু রবীন্দ্রনাথ মৈত্র একটি মাত্র গল্প লিখেছেন পত্রিকায়। ‘কল্লোল’ পত্রিকার সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ ও সহকারী সম্পাদক গোকুলচন্দ্র নাগ গল্প লিখেছেন যথাক্রমে দু’টি ও চারটি। কিন্তু ‘কল্লোলে’র সুনীতি দেবী লিখেছেন দশটি গল্প ও দশটি কবিতা।
বিপিনচন্দ্র পাল ধারাবাহিক ভাবে লিখেছেন ‘বাংলার নবযুগের কথা’। গল্প ছাড়াও ‘মার্কিনে চারিমাস’ নামক তার একটি ভ্রমণ কাহিনীও প্রকাশিত হয়েছে ‘বঙ্গবাণী’ পত্রিকায়। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ও মণীশ ঘটকের তিনটি করে গল্প প্রকাশিত হয়েছে। খগেন্দ্রনাথ মিত্র, শান্তা দেবী, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, মণীন্দ্রলাল বসু ও প্রেমোৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় (লেখক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র) লিখেছেন মাত্র একটি করে গল্প। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ও পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের দু’টি করে গল্প বেরিয়েছে। একটি গল্প ও একটি কবিতা লিখেছেন সজনীকান্ত দাস। এছাড়াও ছিলেন মাণিক ভট্টাচার্য, প্রবোধকুমার সান্যাল, গোপাল হালদার, অনুরূপা দেবী, জগদীশ গুপ্ত প্রমুখ লেখকেরা।
নাট্যকার গিরিশচন্দ্র সম্বন্ধে কুমুদবন্ধু সেন ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন ‘গিরিশ স্মৃতি’। গিরিশচন্দ্রকে অন্য কয়েকটি লেখাও বেরিয়েছে – ‘গিরিশচন্দ্র’ (শৈলেন্দ্রনাথ মিত্র, ফাঃ ১৩৩০), ‘গিরিশ স্মৃতি ও গিরিশচন্দ্র’ (দেবেশন্দ্রনাথ বসু, মাঘ ১৩৩৪)। ‘বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাস’ ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বিপ্লবী ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। একাধিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে জ্যোতিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিজ্ঞান ও ধর্ম্ম’। ক্রমশঃ প্রকাশিত হয়েছে বিপিনচন্দ্র পালের ‘বাংলার নবযুগের কথা’। ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয়েছে মহেন্দ্রচন্দ্র রায়ের ‘মেটারলিঙ্কীয় মতবাদ’। নরেশচন্দ্র সেনের ধারাবাহিক রচনা বেরিয়েছে ‘ময়মনসিংহের কাব্যকথা’। বিপ্লবীদের নিয়ে একাধিক সংখ্যায় ‘বন্দীজীবন’ নামে কাহিনী লিখেছেন শচীন্দ্রনাথ সান্যাল। ‘কলিকাতা সংস্কৃত কলেজের ইতিহাস’(ক্রমশঃ) লিখেছেন পূর্ণচন্দ্র দে। সমর সচিব ট্রটস্কি প্রণীত জার্মান গ্রন্থ অবলম্বনে বিনয়কুমার সরকার লিখেছেন ‘রুশিয়ার ১৯০৫ সাল’ (জ্যৈঃ ১৩৩১)। শ্রীম প্রণীত রামকৃষ্ণ কথামৃতের কিছু অংশ প্রকাশিত হয়েছে ‘বঙ্গবাণী’তে।
গল্প কবিতা বা প্রবন্ধ ছাড়া বেশ কয়েকটি ভ্রমণ কাহিনীও ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। এর মধ্যে রয়েছে ‘মার্কিনে চারি মাস’ (ক্রমশঃ, বিপিনচন্দ্র পাল, জ্যৈঃ ১৩২৯), ‘আমাদের য়ূরোপ প্রবাস’ (ক্রমশঃ, দিলীপকুমার রায়, শ্রাবণ ১৩২৯), ‘স্যাকসন-নগর ড্রেসডন’ (বিনয়কুমার সরকার, ফাঃ ১৩৩০), ‘পূবের চিঠি’ (কালিদাস নাগ, জ্যৈঃ ১৩৩১), ‘গয়া’ (রমেশচন্দ্র মজুমদার, শ্রাঃ ১৩৩৪) প্রভৃতি।
‘বঙ্গবাণী’তে বহু গল্প এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে চিন্তামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। গল্প লেখকদের উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। প্রবন্ধকারদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগাদানন্দ রায়, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিহর শেঠ, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয়কুমার সরকার, জ্যোতির্ম্ময়ী দেবী, ক্ষিতিশচন্দ্র মজুমদার, মহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রভৃতি নামী ও নব্য লেখকেরা। লোকমান্য তিলকের তৃতীয় তিরোভাব দিবস উপলক্ষ্যে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র তিলক সংখ্যার অংশবিশেষ মুদ্রিত হয়েছে ‘প্রতিধ্বনি’ বিভাগে (ভাদ্র ১৩৩০)। পৃথকভাবে ‘তিলক চরিত্র’ ধারাবাহিক ভাবে লিখেছেন সুরেন্দ্রনাথ সেন। স্যার আশুতোষের চিঠিপত্র কার্তিক ১৩৩১ থেকে শুরু করে কয়েকটি সংখ্যায় ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
সঙ্গীতও স্থান পেয়েছে ‘বঙ্গবাণী’তে। পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যার প্রারম্ভিক পৃষ্ঠায় শিব মন্দিরের নীচে কবিতার যে কিছু অংশ ছাপা হত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত সেই গীতি-কবিতা ‘আবার তোরা মানুষ হ’ স্বরলিপি সহ মুদ্রিত হয়েছে ভাদ্র ১৩২৯ সংখ্যায়। খাম্বাজ রাগে দাদরা তালাশ্রিত স্বরলিপি করেছেন মোহিনী সেনগুপ্তা। অন্যান্য অনেক গানের স্বরলিপিও তিনি করেছেন। ‘চন্দ্রগুপ্ত’ ও ‘মেবার পতন’ নাটকের গানের স্বরলিপিও রয়েছে। কীর্তন ও উচ্চসঙ্গীত সম্বন্ধে মূল্যবান আলোচনা করেছেন সাহানা দেবী। কীর্তন নিয়ে খগেন্দ্রনাথ মিত্রের একটি আলোচনাও মনোজ্ঞ।
‘বঙ্গবাণী’ দুটি বিশেষ স্মরণ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। আষাঢ় ১৩৩১ সংখ্যাটি উৎসর্গ করা হয়েছে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মহাপ্রয়াণে। অপর সংখ্যাটি (শ্রাবণ ১৩৩২) শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে। দুটি সংখ্যাতেই নামী লেখকদের লেখা বেরিয়েছে। ১৫৮ পৃষ্ঠার আশুতোষ সংখ্যায় লিখেছেন – নলিনীমোহন মুখোপাধ্যায়, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, কিরণধন চট্টোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন, স্বর্ণকুমারী দেবী, দিলীপকুমার রায়, বিভূতিভূষণ ঘোষাল, হেমলতা দেবী, শ্যামপদ চট্টোপাধ্যায়, মোহিনীমোহন মুখোপাধ্যায়, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, বিপিনচন্দ্র পাল, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য (কাব্যবিনোদ), শিশিরকুমার মৈত্র, বিভাসচন্দ্র রায়চৌধুরী, শ্যামসুন্দর চক্রবর্ত্তী, কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য, অমৃতলাল বসু, রাজেন্দ্রনাথ বিদ্যাভূষণ, হেমেন্দ্রনাথ সেন, অমরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, সুরেন্দ্রনাথ সেন, যাদবেশ্বর তর্করত্ন, মানকুমারী বসু, ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ, কাজী নজরুল ইসলাম, ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন সাময়িকপত্রে প্রকাশিত মন্তব্য। ‘স্যার আশুতোষের চিঠিপত্র’ প্রকাশিত হয়েছে কার্তিক ১৩৩১ সংখ্যায়।
একশ ছত্রিশ পৃষ্ঠার চিত্তরঞ্জন সংখ্যাটি শুরু হয়েছে দেশবন্ধুর অপ্রকাশিত গান দিয়ে। এর পরে রয়েছে মহাত্মা গান্ধীর হস্তাক্ষরে দেশবন্ধু সম্বন্ধে মহাত্মার মূল্যায়ন। যাদের লেখায় বিশেষ সংখ্যাটি সমৃদ্ধ হয়েছে তারা হলেন – সাতকড়িপতি রায়, কালিদাস রায়, শ্যামসুন্দর চক্রবর্ত্তী, নলিনীমোহন মুখোপাধ্যায়, কুমদবন্ধু সেন, দীনেশচন্দ্র সেন, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, সুরেন্দ্রনাথ সেন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সরোজনাথ ঘোষ, সতীশচন্দ্র রায়, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, শরৎচন্দ্র রায়চৌধুরী (দেশবন্ধুর সহপাঠী), বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়, জীবনানন্দ দাশগুপ্ত, অমরেন্দ্রনাথ রায়, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী, যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, শান্তিকুমার রায়চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, শ্যামরতন চট্টোপাধ্যায়, নিরুপমা দেবী, বি.সি. চ্যাট্টার্জ্জি, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু লেখাও প্রকাশ করেছে ‘বঙ্গবাণী’।
পাঠকেরা কিছু কিছু লেখার সমালোচনা করেছেন, সেটার সঙ্গে লেখকের উত্তরও ছাপা হয়েছে।
‘বঙ্গবাণী’’তে অনেকগুলি বিভাগ ছিল; যেমন ‘পুরাতনী’তে পুরনো পত্রিকা থেকে কিছু অংশের পুনর্মুদ্রণ; ‘প্রতিধ্বনি’তে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর নাতিদীর্ঘ আলোচনা; ‘ছিটে-ফোঁটা’তে সমকালীন ঘটনাকে কেন্দ্র করে কৌতূক-নক্সা, ব্যঙ্গ-কবিতা প্রকাশ; ‘আইন-আদালত’ বিভাগে আইন-কানুন সম্পর্কিত বিষয়ের সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা ইত্যাদি। ‘শোক-সংবাদ’-এ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পরলোক গমনের সংবাদ এবং ‘পুস্তক পরিচয়ে’ থাকত সমকালে প্রকাশিত পুস্তকে আলোচিত বিষয়বস্তুর যুক্তিনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সমালোচনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমালোচকের নাম থাকত না তবে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, কালিদাস রায় ও দীনেশচন্দ সেনের মত বিদগ্ধ ব্যক্তিরাও এতে অংশ গ্রহণ করেছেন। প্রসঙ্গতঃ মাসিক পত্রে গ্রন্থ-সমালোচনা প্রথম শুরু হয় রাজেন্দ্রলাল মিত্রের ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’তে।
সঙ্কীর্ণতাকে সরিয়ে রেখে গোষ্ঠিতন্ত্রের ঊর্দ্ধ্বে উঠে নামী অনামী সব লেখকদের উৎকৃষ্ট রচনা নিরপেক্ষভাবে প্রকাশ করে ‘বঙ্গবাণী’ একটি সুস্থ সাহিত্য-পরিমন্ডল গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল। এর প্রতিটি সংখ্যাই ছিল স্বকীয়তায় সমুজ্জল। এ ধরণের একটি পত্রিকা কেন মাত্র ছ’বছর পরেই অন্তর্হিত হয়েছিল সেটা বলা শক্ত। তবে একজন পাঠকের পক্ষে অনেকগুলি পত্রিকার গ্রাহক হওয়া বা দৈনন্দিন কাজের মধ্যে প্রতিমাসে একাধিক পত্রিকা পড়ে ওঠা তো সম্ভব না। ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতবর্ষে’র জনপ্রিয়তা ও উৎকর্ষের সঙ্গে সমকালে প্রকাশিত অন্য অনেক পত্রিকা সাহিত্যমান ও বৈচিত্র বজায় রাখা সত্বেও হয়তো বেশি দিন প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকতে পারে নি।
সংযুক্ত প্রতিলিপি পরিচয় –
চিত্র – ১ : পত্রিকার একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র।
চিত্র – ২ : পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ প্রথমার্দ্ধের প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা।
চিত্র – ৩ : একদা খ্যাত ঢাকার শক্তি ঔষধালয়ের বিজ্ঞাপন।
চিত্র – ৪ : বিজ্ঞাপন বহুল ‘বঙ্গবাণী’র একটি পৃষ্ঠা।
চিত্র – ৫ : সে যুগে কে. সি. দে এন্ড সন্সের ১৩৫ টাকা মূল্যের গ্রামোফোনের বিজ্ঞাপন।
( বি: দ্র: - এযাবৎ আলোচিত পত্রিকাগুলি মোটামুটিভাবে প্রকাশের কালানুযায়ী সাজানো হয়েছে। সে হিসাবে ‘বঙ্গবাণী’র আলোচনা অনেক পরে হবারই কথা। কিন্তু অনবধানতা বশতঃ সঠিক পত্রিকাটির পরিবর্তে ‘বঙ্গবাণী’ পর্বটি শেষ হওয়ায় সেটিই প্রকাশ করা হ’ল )।
চিত্র – ১ : পত্রিকার একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র।
চিত্র – ২ : পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ প্রথমার্দ্ধের প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা।
চিত্র – ৩ : একদা খ্যাত ঢাকার শক্তি ঔষধালয়ের বিজ্ঞাপন।
চিত্র – ৪ : বিজ্ঞাপন বহুল ‘বঙ্গবাণী’র একটি পৃষ্ঠা।
চিত্র – ৫ : সে যুগে কে. সি. দে এন্ড সন্সের ১৩৫ টাকা মূল্যের গ্রামোফোনের বিজ্ঞাপন।
লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.