অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

নভেম্বর ১, ২০১৭

 

ভারতবর্ষ

দীপক সেনগুপ্ত

বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যে সব সাহিত্য পত্রিকা বেরিয়েছে উৎকর্ষের বিচারে তার মধ্যে বেশ কয়েকটি হয় ত উল্লেখের দাবী রাখে; কিন্তু বিষয় ভাবনা, বৈচিত্র ও মননধর্মী রচনার নিরীখে যে দু’টি পত্রিকা পাঠকসমাজে বিশেষ ভাবে আদৃত হয়েছিল সে দুটি হল ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতবর্ষ’। দীর্ঘায়ু এ দুটি মাসিক পত্র দীর্ঘকাল ধরে পাঠকদের মনোরঞ্জন করেছে। ‘প্রবাসী’ ও সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এই ধারাবাহিকে আগেই আলোচনা করা হয়েছে; এবার ‘ভারতবর্ষ’ সম্বন্ধে দু-একটি কথা।

‘ভারতবর্ষ’ প্রকাশের মাধ্যমে যার সুপ্ত ইচ্ছা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছিল তিনি হলেন প্রখ্যাত নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। পটভূমিকাটা একটু দেখে নেওয়া যাক। ১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে মেট্রোপলিটন কলেজের কিছু ছেলে সুকিয়া স্ট্রীটে ‘ফ্রেণ্ডস ড্রামাটিক ক্লাব’ নামে একটি ‘মিলনী’ গঠন করেন। পরে মতানৈক্যের কারণে এই ক্লাবের প্রধান দুই প্রবর্তক সদস্য হরিদাস চট্টোপাধ্যায় (বিখ্যাত প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র) ও প্রমথনাথ ভট্টাচার্‍্য ক্লাব থেকে বেরিয়ে এসে ‘কলিকাতা ইভিনিং ক্লাব’ নামে একটি ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ঘটনাক্রমে দ্বিজেন্দ্রলাল এই ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন ও সভাপতির পদ গ্রহণে অনুরুদ্ধ হন। দ্বিজেন্দ্রলালের বহুদিনের ইচ্ছা ছিল ‘একটা নূতন ধরণের Ideal (আদর্শ) মাসিক কাগজ’ বের করেন ; এখন ‘ইভিনিং ক্লাবে’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার সেই ইচ্ছা ফলপ্রসূ করতে উদ্যোগী হন। কিন্তু হরিদাস চট্টোপাধ্যায় তাকে জানান যে ‘ক্লাবের সে আর্থিক সঙ্গতি নেই এবং একটা ক্লাবের কাগজ বাইরের দশজনে যে লইবে, সে আশাও দুরাশা’। দ্বিজেন্দ্রলাল মনক্ষুণ্ণ হলে হরিদাসবাবু তাকে বলেন –

“আপনার এ ইচ্ছা পূরণ না হইলেও আমি আর একটা প্রস্তাব করিতে পারি। আপনি যদি স্বয়ং সম্পাদক হতে স্বীকার করেন ত আমি নিজ ব্যয়ে বাংলাদেশে প্রকাশিত আর সমস্ত মাসিক পত্রের চেয়ে বড় ও আপনারই নামের যোগ্য, একখানি উৎকৃষ্ট মাসিক পত্র প্রকাশের ভার গ্রহণে সম্পূর্ণ রাজি আছি।”

দ্বিজেন্দ্রলাল হরিদাসবাবুর এ কথায় উল্লসিত হয়ে বললেন – “বেশ, তা হলে এ কাগজ এখনই বাহির হউক। আমিও খুব শীঘ্র পেন্সান লইয়া নিজেকে ইহার সম্পাদক পদে নিযুক্ত করিয়া দিব।” ১৩১৯ বঙ্গাব্দের ৭ই চৈত্র পত্রিকা প্রকাশের পূর্বে একটি প্রচার পত্র বিলি করা হয়। সেটি ছিল –

“বাংলাদেশে যে সর্ব্বাঙ্গসুন্দর পত্রিকার অভাব আছে, তাহা কেহই অস্বীকার করিতে পারিবেন না। অন্যান্য সভ্যদেশের তুলনায় আমাদের দেশে মাসিক পত্রিকার সংখ্যা যে কম তাহা আর বলিতে হইবে না। এই সকল বিষয় চিন্তা করিয়া আমরা একখানি সর্ব্বাঙ্গসুন্দর মাসিক পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা করিয়াছি। বঙ্গ সাহিত্যের জনৈক সুপ্রসিদ্ধ মনীষী আমাদের সঙ্কলিত পত্রিকার সম্পাদনাভার গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন।”

প্রখ্যাত প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় প্রচারিত এই পত্রটি সম্বন্ধে জনসাধারণের কৌতূহল ছিল তুঙ্গে এবং পরিশেষে যখন সম্পাদক পদে দ্বিজেন্দ্রলালের নাম প্রকাশিত হল তখন সাহিত্যানুরাগী পাঠক আগ্রহের সঙ্গে পত্রিকা প্রকাশের অপেক্ষায় ছিলেন।

অনেক আলোচনা ও বিতর্কের পর পত্রিকার নাম দ্বিজেন্দ্রলালের প্রস্তাবিত ‘ভারতবর্ষ’ রাখাই সাব্যাস্ত হয়। প্রথমে ঠিক ছিল বৈশাখ মাসেই পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হবে; কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের পেনশন মঞ্জুর হতে দেরি হওয়ায় আষাঢ় মাসে পত্রিকা বের হবে ঠিক হয়। পত্রিকা প্রকাশের প্রাথমিক পর্বেই একটা অঘটন ঘটে যায়, বিষাদের ছায়া নেমে আসে। সাহিত্যিক জলধর সেন ‘সুলভ সমাচারে’র চাকরি হারিয়ে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। তার কথাতেই বাকিটা শোনা যাক

“ ‘সুলভ সমাচারে’র চাকরি তো গেল। তারপর কি করা যায়! সার্টিফিকেট-অব-অনার ধুয়ে জল খেলে তো পেট ভরবে না! ‘সুলভ সমাচার’ উঠে যাওয়ার সংবাদ পেয়েই আমার পরম হিতৈষী বন্ধু আমার পূর্ব্ব মনিব সন্তোষের কবি জমিদার শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ রায় চৌধুরী মহাশয় আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং যতদিন আর কোন সুবিধা না হয় ততদিন তাঁর প্যারাগন প্রেসের ভার নিতে বললেন। এখন যেখানে আমাদের ভারতবর্ষ আফিস হয়েছে পূর্ব্বে সেখানে ট্রাম কোম্পানীর আস্তাবল ছিল। সেই আস্তাবলের ঘরগুলি ভাড়া নিয়ে প্রমথবাবু প্যারাগন প্রেস করেছিলেন। আমি সেই প্রেসের ম্যানেজার হলাম।

“তখন ভারতবর্ষ প্রচারের বিপুল আয়োজন চলছে। কবিবর দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও পন্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ যুগ্ম-সম্পাদক হয়েছেন। সেই সময়ে ভারতবর্ষের স্বত্বাধিকারী হরিদাস চট্টোপাধ্যায় মহাশয় আমাকে বললেন যে তিনি প্যারাগন প্রেসেই ‘ভারতবর্ষ’ ছাপতে চান। আমার আর তাতে আপত্তি কি! অতবড় একখানি কাগজ ছাপবার জন্য যা কিছু ব্যবস্থা করতে হয় আমি তাই করতে লাগলাম। হরিদাসবাবু কিছু টাকা অগ্রিমও দিলেন। তখন ‘ভারতবর্ষে’র সঙ্গে আমার ঐ টুকুই সমন্ধ ছিল।

“আমি চার পাঁচ ফর্ম্মার মত কম্পোজ তুলে দিলাম। প্রথম ফর্ম্মার পেজ সাজিয়ে যেদিন দ্বিজেন্দ্রলালের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম, সেই দিনই সেই ফর্ম্মার প্রুফ দেখতে দেখতেই অকস্মাৎ দ্বিজেন্দ্রলাল অমরধামে চলে গেলেন।”

দ্বিজেন্দ্রলালের মৃত্যুতে উদ্যোক্তারা মহাসঙ্কটে পড়লেন। তখন ত আর থামা যায় না। দ্বিজেন্দ্রলালের স্থলাভিষিক্ত কে হবেন ? অনেকের নাম বিবেচিত হল; এর মধ্যে ছিলেন সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সারদাচরণ মিত্র। কিন্তু কোনটিই সর্বসম্মত হল না। শেষে প্রস্তাবিত হয় জলধর সেনের নাম এবং সেটিই গৃহীত হয়। জলধরের কথায় – “অনেকের নাম প্রস্তাবিত হল। অবশেষে হরিদাসবাবু আমাকেই দ্বিজেন্দ্রলালের শূণ্যপদে জোর করে বসিয়ে দিলেন।”

জলধর সেন তখন সাহিত্যসমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত; তার রচিত হিমালয় ভ্রমণের কাহিনী তখন বিরাট সংখ্যক পাঠকের মনে আলোড়ন তুলেছিল। জলধরের সম্বন্ধে ‘অবসরে’র ভ্রমণ সংখ্যায় ও অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করেছি, পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন।

শোকের আবহকে সঙ্গী করেই ‘ভারতবর্ষে’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হল ১৩২০ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে। প্রয়াত কান্ডারীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে পত্রিকার আখ্যাপত্রে ছাপা হল “দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রতিষ্ঠিত” কথাটি। শেষ সংখ্যা অবধি এই ক’টি শব্দ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সম্পাদক হলেন জলধর সেন, সঙ্গে অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ। প্রথম সংখ্যাটি ছিল ১৫২ পৃষ্ঠার। এই সংখ্যার ‘নিবেদন’ অংশে প্রকাশক জানিয়েছেন –

“...... প্রতি সংখ্যায় ১৫ ফর্ম্মা – ১২০ পৃষ্ঠা দিতে প্রতিশ্রুত ছিলাম; কিন্তু সহৃদয় ও শুভানুধ্যায়ী লেখকগণের অনুকম্পায় আমরা এত প্রবন্ধ পাইয়াছি যে, এবার ১৯ ফর্ম্মা অর্থাৎ চারি ফর্ম্মা অতিরিক্ত দিয়াও অনেক উৎকৃষ্ট প্রবন্ধের স্থান করিতে পারিলাম না ......”।

এই সঙ্গে আরও জানিয়েছেন –

“ ...... বর্ত্তমান সংখ্যায় আমরা স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মহাশয়ের ‘ভারতবর্ষ’ শীর্ষক গীতি-কবিতার স্বরলিপি প্রকাশ করিতে চাহিয়াছিলাম, কিন্তু অপ্রতিবিধেয় কারণে এবার তাহা দিতে পারিলাম না।”

প্রসঙ্গতঃ প্রথম সংখ্যায় কবিতা অংশটি ছিল এবং পাদটীকায় লেখা হয়েছিল ‘ইহার স্বরলিপি শেষে দ্রষ্টব্য’ কিন্তু স্বরলিপি মুদ্রিত হয় নি, পরিবর্তে রয়েছে অন্য গানের স্বরলিপি।

প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সূচনা’ অংশটি দ্বিজেন্দ্রলাল তার মৃত্যুর আগেই রচনা করে গিয়েছিলেন। বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও দেশের প্রতি অকুন্ঠ ভালবাসা ও শ্রদ্ধা সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে রচনার প্রতি ছত্রে। কিছুটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি –

“ ...... বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গভাষায় উচ্চ মাসিক-পত্র সৃষ্টি করিলেন, ঐন্দ্রজালিক শব্দবিন্যাস সৃষ্টি করিলেন, মনোহর উপন্যাস সৃষ্টি করিলেন, নূতন প্রণালীর ব্যাখ্যা সৃষ্টি করিলেন, সহজ-সরল বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ সৃষ্টি করিলেন, উচ্চ অঙ্গের রসিকতা সৃষ্টি করিলেন। মাইকেলও তেমনই অমিত্রাক্ষর কবিতা সৃষ্টি করিলেন, ‘সনেট’ সৃষ্টি করিলেন, মহাকাব্য সৃষ্টি করিলেন, খন্ডকাব্য সৃষ্টি করিলেন, নাটক সৃষ্টি করিলেন, নূতন বৈষ্ণব কবিতা সৃষ্টি করিলেন। বলিলে অত্যুক্তি হয় না যে, বঙ্কিমচন্দ্র আধুনিক বাঙ্গলা পদ্য সাহিত্যের, সৃষ্টিকর্ত্তা। তাঁহাদের স্মৃতি অমর হউক। “ ...... এই সাহিত্য বাঙ্গালী জাতির মজ্জায় মজ্জায় প্রবেশ করিয়াছে। এই উদ্দাম স্রোতের ফেনিল তরঙ্গে বাঙ্গালী গা ভাসাইয়া দিয়াছে। বাঙ্গালী বঙ্গভাষাকে ভালবাসিতে শিখিয়াছে। তথাপিবড় কষ্টে বড় অবজ্ঞায় পর্বতভার ঠেলিয়া বঙ্গভাষাকে উঠিতে হইতেছে।

“ প্রথমতঃ আমদের দেশের শাসন-কর্ত্তারা বাঙ্গালাভাষা জানেন না, শিখিতেও চাহেন না। তাঁহাদের মতে বাঙ্গালা সাহিত্য দুই শ্রেণীতে বিভক্ত, - অর্থাৎ (১) যাহা রাজবিদ্বেষমূলক, এবং (২) যাহা রাজবিদ্বেষমূলক নহে। প্রথোমক্ত শ্রেণীর সাহিত্য বুঝিবার জন্য তাঁহারা অনুবাদকের সাহায্য গ্রহণ করেন। শেষোক্ত শ্রেণীর সমস্ত সাহিত্য তাঁহাদের দ্বারা সমভাবে অবজ্ঞাত, উপেক্ষিত, বর্জ্জিত। আমাদের শাসন-কর্ত্তারা যদি বঙ্গসাহিত্যের আদর জানিতেন তাহা হিলে বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র ও মাইকেল Peerage পাইতেন ও রবীন্দ্রনাথ Knight উপাধিতে ভূষিত হইতেন।

“ দ্বিতীয়তঃ আমাদের দেশের রাজা মহারাজাদের মধ্যে অধিকাংশই বাঙ্গালা ভাষা সম্বন্ধে জানেন না ও তাহার আদর করেন না। তাঁহাদের সজ্জিত প্রাসাদের প্রশস্ত পাঠাগারে মহামূল্য আলমারিগুলি অপঠিত ইংরাজি গ্রন্থের ও মাসিক-পত্রিকার উজ্জল সমাবেশ সগর্ব্বে বক্ষে ধারণ করিতেছে। কিন্তু বাঙ্গালা গ্রন্থ ও মাসিক-পত্রিকা তাঁহাদের চরণ প্রান্তেও স্থান পায় না। কোন বাঙ্গালী রাজা গর্ব্ব করিয়া বলিয়াছিলেন যে, তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস পাঠ করেন নাই। স্পষ্ট শুনিলাম যে, এই বঙ্গীয় যুবকের এই নির্ল্লজ্জ উক্তি শুনিয়া বঙ্গভাষা লজ্জায় অধোবদন হইয়া বলিয়া উঠিলেন – “ভগবতী বসুন্ধরে! দ্বিধা হও, আমি প্রবেশ করি।” এ লজ্জা কি রাখিবার স্থান আছে!

“ আজ প্রধানতঃ মধ্যবিত্ত ও ছাত্র সম্প্রদায়ই বাঙ্গালা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। তাঁহারা বাঙ্গালা গ্রন্থ ও মাসিক-পত্রিকা পাঠ করেন, বাঙ্গালা বক্তৃতা শ্রবণ করেন, বাঙ্গালা নাটকের অভিনয় করেন, বাঙ্গালা কবির সমাদর করেন। সে দিন বঙ্গদেশের এক অতি শুভদিন, যেদিন এই সম্প্রদায় সমবেত ভদ্রমন্ডলীর সমক্ষে কবিবর রবীন্দ্রনাথের গলে বরমাল্য পরাইয়া দিয়াছিলেন। সে সম্মানে সমস্ত বঙ্গভাষা সম্মানিত হইয়াছিল। তাঁহাদের জয় হউক।

“ বঙ্গসাহিত্যের প্রতি এই সমাদর, জাতীয়ত্বের এই গভীর আলোড়ন, মাতৃভাষার প্রতি জাতির এই অচলা ভক্তি, শেষে গভর্মেন্টের হৃদয়ের দ্বারে আঘাত করিয়াছে। মহামতি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উপদেশানুসারে এই অনাদৃত বঙ্গভাষাকে গভর্মেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন দিয়াছেন। সে দিন বঙ্গদেশের একটি স্মরণীয় দিন, যেদিন হইতে বাঙ্গালা ভাষা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবশ্যপাঠ্য বিষয় বলিয়া গণিত হইয়াছে। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাসে আশুতোষের স্থান অক্ষয় হউক।

“ ...... বঙ্গভাষা পরাধীন দেশের ভাষা বলিয়া হতাশ হইবার কোন কারণ নাই। পরাধীন ইটালী ডান্টে ও পেট্রার্কের জন্ম দিয়াছিল। এই পরাধীন বঙ্গই চন্ডিদাস ও মাইকেলের জননী। হতাশার কারণ নাই। চাই শুধু সাধনা। চাই শুধু অবিশ্রান্ত সেবা। চাই শুধু অটল বিশ্বাস, আর অচলা ভক্তি। ......... আমাদের ভাগ্যবিধাতা দূরে অলক্ষ্যে বসিয়া আমাদের সেই উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গঠন করিতেছেন। আমরা যেন না পিছু হটি। আমরা যেন না ভয় পাই। আমরা যেন সাহিত্যের বাতাসকে পবিত্র রাখিতে পারি। আমাদের বন্দনায় যেন বিগলিত-স্নেহ জননীর চক্ষু ফাটিয়া জল পড়ে। আমাদের গানে যেন জগৎ মাতিয়া ছুটিয়া আসিয়া আমাদিগকে ভাই বলিয়া আলিঙ্গন করে। আমরা যেন আত্মসম্মানকে বক্ষে রাখিয়া, অপবিত্রতাকে দূরে রাখিয়া, মনুষ্যত্বকে মাথায় রাখিয়া সাহিত্যের কুসুমিত পথে নির্ভয়ে চলিয়া যাই। তাহা হইলে আমাদের আর জগতের কাছে সম্মান ভিক্ষা করিতে যাইতে হইবে না। সে সম্মান দ্বারে আপনি আসিয়া পহুছিবে।”

দ্বিজেন্দ্রলালের জীবন সায়াহ্নে এই আবেগ মথিত দেশপ্রেমের বাণী ও বাংলা ভাষার প্রতি অনাবিল ভালবাসা আমাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ অঙ্কনের কৃতিত্ব দ্বিজেন্দ্র গোস্বামীর। প্রচ্ছদ চিত্রের নাম ‘ভারতবর্ষ’। সুনীল জলধি থেকে উঠে আসছেন ভারতমাতা, মাথায় মুকুট, গলায় সাতনরী হার, ডান হাতে শস্যগুচ্ছ। আখ্যাপত্রে লেখা ছিল –

“সচিত্র মাসিক পত্রিকা, প্রথম বর্ষ – প্রথম খন্ড, আষাঢ় – অগ্রহায়ণ, ১৩২০, সম্পাদক শ্রীজলধর সেন ও শ্রী অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, প্রকাশক শ্রীগুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স, ২০১নং কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট, কলিকাতা।”

প্রথম বর্ষের শেষে সহ-সম্পাদক অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ কিছুটা অভিমান ভরে পদত্যাগ করেন এবং ‘মানসী ও মর্ম্মবাণী’ পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন। এসেছিলেন উপেন্দ্রকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়; তিনিও বেশিদিন থাকেন নি। এরপর সুদীর্ঘ ২৬-২৭ বছর জলধর একাই সম্পাদনার দায়িত্ব সামলেছেন। তিনি ‘স্মৃতি-তর্পণে’ লিখেছেন –

“প্রথম বৎসর পন্ডিত অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ আমার সহযোগী ছিলেন। দ্বিতীয় বর্ষের আরম্ভে তিনি চলে গেলেন, ‘বঙ্গনিবাসী’র সম্পাদক শ্রীযুক্ত উপেন্দ্রকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় আমার সহযোগী হলেন। তৃতীয় বৎসরে তিনিও চলে গেলেন। সেই থেকে এই সুদীর্ঘকাল আমি একাকী ‘ভারতবর্ষ’ নিয়ে বসে আছি।”

কেন চলে গিয়েছিলেন সহ-সম্পাদকেরা ? শোনা যায় তাদের যথেষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হত না। অধিকাংশ কাজ জলধর একাই করতেন; অতএব বাকিরা নিজেদের অপ্রয়োজনীয় মনে করেছিলেন।

প্রথম সংখ্যায় যে লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলি হ’ল – ‘স্বস্তিবাচন’ (ঋগ্বেদীয় স্বস্তিসূক্ত) ও শ্যামাচরণ কবিরত্নকৃত কবিতার অনুবাদ; ‘ভারতবর্ষ’ (কবিতা-‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে – দ্বিজেন্দ্রলাল; ‘সূচনা’ (সম্পাদকীয়) – দ্বিজেন্দ্রলাল; ‘কাবেরী-তীরে’ – বিজয়চন্দ্র মজুমদার; ‘বুদ্ধগয়া’ – রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, এম, এ; ‘জম্মুতে বিবাহোৎসব’ – নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত; ‘মৌর্য-সাম্রাজ্য-বিলোপের কারণ’ – চারুচন্দ্র বসু; ‘কুলগ্রন্থে ঐতিহাসিকতা ও ভোজের নবাবিস্কৃত তান্রশাসন’ (চট্টগ্রাম-সাহিত্য-সম্মিলনে পঠিত) – নগেন্দ্রনাথ বসু; ‘ব্যাথিত’ (গল্প) – যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত; ‘ছিন্নহস্ত’ (শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত) (ধারাবাহিক) ; ‘দর্পচূর্ণ’ – যতীন্দ্রমোহন বসু এম, এ; ‘মন্ত্রশক্তি’ (ধারাবাহিক) – অনুরূপা দেবী; ‘কুলগাছ’ (গল্প) - সরোজনাথ ঘোষ; ‘কৌতূহল’ (ফেরিয়ারের গ্রন্থ হইতে গৃহীত) – খগেন্দ্রনাথ মিত্র; ‘ভারতবর্ষের অদ্বৈতবাদ’ (ধারাবাহিক) – কোকিলেশ্বর ভট্টাচার্য, বিদ্যারত্ন, এম, এ; ‘শঙ্কর-দর্শন’ (ধারাবাহিক); স্বর্গীয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ছবি; ‘কবিবর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়’ (কবিতা) – নরেন্দ্র দেব; ‘বাণী’ (কবিতা) – প্রমথনাথ রায় চৌধুরী; ‘সুখী-দম্পতি’ (কবিতা) – রসময় লাহা; ‘গৃহ’ (কবিতা) – প্রসন্নময়ী দেবী; ‘জন্ম-মঙ্গল’ (কবিতা) – প্রিয়ম্বদা দেবী; ‘মন্দির’(ভুবনেশ্বর)(কবিতা) – কালিদাস রায়; ‘বিন্দু সরোবর’(ভুবনেশ্বর)(কবিতা) – কালিদাস রায়; ‘সাগর সঙ্গীত’ (কবিতা) – চিত্তরঞ্জন দাশ; ‘দুগ্ধের উপকরণ ও উপকারিতা এবং দধির বিশেষ গুণ’ – ইন্দুমাধব মল্লিক; ‘বায়োস্কোপ’ – প্রমথনাথ ভট্টাচার্য; ‘সংক্ষিপ্ত উদ্যান’ – প্রবোধচন্দ্র দে; ‘সেকেলে কথা ও বিবিধ প্রসঙ্গ’ – নিস্তারিণী দেবী; ‘পান্ডুয়া কাহিনী’ (ইতিহাস) – লেখকের নাম নেই; ‘সঙ্কলন’; ‘দ্বিজেন্দ্রলাল’ – অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ; ‘জীবন-কথা’ [দ্বিজেন্দ্রলালের] – প্রসাদদাস গোস্বামী; ‘উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনী-সভাপতির অভিভাষণ’ – আশুতোষ চৌধুরী; ‘স্বরলিপি’ (গান – বধূ তুমি সে পরশমণি হে’) – রজনিকান্ত রায় দস্তিদার, এম,এ, এম,আর,এস,এ (লন্ডন); ‘চিত্র’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে সচিত্র নানা খবর – ‘শ্রীমান প্রমথনাথ সরকার’ (কৃতী ছাত্রের পরিচয়), ‘বর্ষায় কলকাতার রাজপথ’, ‘কবিবর শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’, মুদ্রিত হয়েছে স্বর্গীয় গিরিশচন্দ্র ঘোষের মধ্য বয়সের একখানি ছবি এবং ‘পুন্নাগ শ্রেণী’ নামে একখানি পূর্ণ পৃষ্ঠার ছবি, সর্বশেষে ‘নিবেদন’ – প্রকাশক।

প্রথম সংখ্যার বিষয়-সূচীর দিকে তাকালেই বোঝা যায় বিভিন্ন লেখকের রচনার কি বিপুল সম্ভার নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল ‘ভারতবর্ষ’। ‘ভারতবর্ষ’ যখন প্রকাশিত হয় ‘প্রবাসী’র বয়স তখান বারো বছর। একটি প্রথম শ্রেণীর মাসিক-পত্রিকা হিসাবে তার খ্যাতি তখন মধ্য গগনে। অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকও তার লেখা ‘প্রবাসী’তে ছাপা হলে শ্রম সার্থক জ্ঞান করতেন। ‘প্রবাসী’র মূল্য ছিল বার্ষিক তিন টাকা ছ’আনা, আর ‘ভারতবর্ষে’র ছ’ টাকা। তা সত্বেও স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরে ‘ভারতবর্ষ’ পাঠকবর্গের আনুকূল্য লাভ করেছিল দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে। বিভিন্ন লেখক ও চিত্র-শিল্পীদের কাছ থেকে নিয়মিত তাদের রচনা ও অঙ্কণ যোগাড় করতে জলধরকে কম পরিশ্রম করতে হয় নি। তবে এক্ষেত্রে একটা বড় সহায়ক ভূমিকা নিয়েছিল জলধর সেনের মধুর ব্যবহার, নিরহঙ্কার ও অমায়িক প্রকৃতি। তার অনুরোধ অনেকেই ফেরাতে পারতেন না। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ভাষায় –“নামী কাগজে যিনি আমাদের আহ্বান করলেন তিনি জলধর সেন। শুধু স্থান দিলেন না, সম্মান দিলেন, অনুগ্রহ নয়-দিলেন অধিকার। সেদিনকার আবিল আবহাওয়ার উর্দ্ধে সাহিত্যের প্রতি তার নিষ্পক্ষপাত ও নিঃসঙ্কোচ আতিথেয়তা আমাদের পক্ষে একটা গভীর অনুভবের বিষয় ছিল যা ইহজীবনে কখনো বিস্মৃত হব না।” তিনি ছিলেন ‘সর্বকালের সর্ববয়সের চিরন্তন দাদা’। তবে শরৎচন্দ্রের লেখা যোগাড় করতে তাকে একবার অন্য পথ নিতে হয়েছিল। সে কথা পরে।

দ্বিজেন্দ্রলালের পরলোক গমনের পর মাঝে মাঝেই তাকে নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সংখ্যায়; তার সম্বন্ধে রচনা কোন একটি বিশেষ সংখ্যায় আবদ্ধ ছিল না। প্রথম সংখ্যাতেই তাকে স্মরণ করে কিছু কবিতা ও প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নরেন্দ্র দেব তার ‘কবিবর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়’ কবিতায় কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছেন। শেষের ক’টি পংক্তি ছিল – “জাগিয়েছে যে, নাচিয়েছে যে, / মাতিয়েছে যে বাংলা দেশ! / চলে গেছে হঠাৎ সে আজ / ফেলে তাহার জীর্ণ বেশ।” অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ তার ‘দ্বিজেন্দ্রলাল’ প্রবন্ধে কবির সম্বন্ধে আলোচনা করে প্রার্থনা করেছেন – “মঙ্গলময়ের মঙ্গলাশীষে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রাণপ্রিয় ‘ভারতবর্ষ’ যেন বাঙ্গালীর ও বঙ্গ ভাষাভাষীর মনোরঞ্জন করতে সমর্থ হয়।” দ্বিজেন্দ্রলালের একটি সংক্ষিপ্ত ‘জীবনকথা’ প্রকাশিত হয়েছে। মুদ্রিত হয়েছে মহাপ্রয়ানের তার অন্তিম শয়নের একটি চিত্রও।

বহু সংখ্যক লেখক ও কবি তাদের রচনা সম্ভার দিয়ে ‘ভারতবর্ষ’কে সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের রচনা সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত আলোচনার আগে দু’জন স্বনামধন্য মনীষীর কথা উল্লেখ করতে হয়; একজন হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অপরজন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘প্রবাসী’ ছিল উচ্চমানের সাহিত্য পত্রিকা এবং শরৎচন্দ্র লব্ধপ্রতিষ্ঠ কথাসাহিত্যিক, তা সত্বেও শরৎচন্দ্র ‘প্রবাসী’তে লেখেন নি বা ‘প্রবাসী’ তার লেখা প্রকাশে উৎসাহ দেখায় নি। একথা ‘প্রবাসী’ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। ‘প্রবাসী’কে বর্ণময় করে রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ আর ‘ভারতবর্ষে’র প্রাণপুরুষ ছিলেন শরৎচন্দ্র। শরৎচন্দ্রের বহু উপন্যাস ও গল্প ‘ভারতবর্ষ’ প্রকাশ করেছে। পত্রিকাটির জনপ্রিয়তার পিছনে শরৎচন্দ্রের অবদান অনস্বীকার্য। ১৩২০ বঙ্গাব্দের পৌষ-মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিরাজ-বৌ’। এরপর একে একে বেরিয়েছে ‘পন্ডিত মশাই’, ‘মেজদিদি’, ‘দর্পচূর্ণ’, ‘আঁধারে আলো’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘বৈকুন্ঠের উইল’, ‘অরক্ষণীয়া’, ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী’, ‘দেবদাস’, ‘নিষ্কৃতি’, ‘একাদশী বৈরাগী’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’, ‘দেনা-পাওনা’, ‘নব বিধান’, ‘শেষ প্রশ্ন’, ‘অনুরাধা’ ও ‘শেষের পরিচয়’। ‘শেষের পরিচয়’ উপন্যাসটি ‘ভারতবর্ষে’ ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের আষাঢ়-আশ্বিন, অগ্রহায়ণ, ফাল্গুন-চৈত্র, ১৩৪০-এর বৈশাখ, আশ্বিন ও অগ্রহায়ণ, ১৩৪১-এর আষাঢ়-শ্রাবণ, কার্তিক, ফাল্গুন এবং ১৩৪২-এর বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পঞ্চদশ অধ্যায় অবধি লেখার পর শরৎচন্দ্র পরলোক গমন করেন। রাধারাণী দেবী ছিলেন শরৎচদ্রের বিশেষ প্রিয়পাত্র। তিনি আরও এগারটি পরিচ্ছেদ লিখে মোট ছাব্বিশটি পরিচ্ছেদে উপন্যাসটি শেষ করেন। ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে এটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়।

রামানন্দের নিরন্তর তাগাদা না থাকলে যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘গোরা’র প্রকাশ ঘটত না বা বিলম্বিত হত, জলধর সেনও তেমনি পেছনে লেগে থেকে অলসতাপ্রিয় শরতচন্দ্রকে দিয়ে অনেক লেখে লিখিয়ে নিয়েছেন। লেখা আদায়ের জন্য জলধর ও শরৎচন্দ্রকে নিয়ে একটি কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনী শোনা যায়। রবীন্দ্রনাথের মত শরৎচন্দ্র নিয়ম করে কিছু লিখতেন না। অনেক সময়েই প্রকাশকের তাগাদায় পড়ে লিখতেন। জলধর শরৎচন্দ্রের বাড়ি অবধি ধাওয়া করতেন। তার পরিচারক ভোলাকে ডেকে বলতেন –

“ ‘ওরে ও ভোলা, চা নিয়ে আয়, আর ভেতরে বৌমাকে বলে দে যে, আজ আমি এখানেই নাইব খাব’। তারপর কাপড়-চোপড় পালটে বালিশে হেলান দিয়ে শুয়ে তিনি চুরুট খেতে লাগলেন। শরৎবাবু কান্ড দেখে হেসে বললেন, -‘কি ব্যাপার দাদা ? এসবের মানেটা কি?’ ‘মানে পাঁচটার সময় চা খেয়ে ফিরব, সঙ্গে তোমার লেখাটাও নিয়ে যাব। কাজে-কাজেই সময় নষ্ট না করে লিখতে বসে যাও।”

রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘ভারতবর্ষে’ অল্প হলেও লিখেছেন। জলধরের সঙ্গে তার ছিল প্রীতির সম্পর্ক। জলধর-প্রয়াণে কবি পুরীতে ২৬শে মার্চ ১৯৩৯-এ চার লাইনের একটা ছোট কবিতা লিখেছিলেন, স্বহস্তে লিখিত তার কবিতার প্রতিলিপি পত্রিকার ১৩৪৬-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ‘জলধর নামাঙ্কিত কবিতাটি ছিল – “ বাঙালীর প্রীতি অর্ঘ্যে তব দীর্ঘ জীবনের তরী / স্নিগ্ধ শ্রদ্ধা সুধারস নিঃশেষে লয়েছে পূর্ণ করি। / আজি সংসারের পারে, দিনান্তের অস্তাচল হতে / প্রশান্ত তোমার স্মৃতি উদ্ভাসিত অন্তিম আলোতে ।।” শরৎচন্দ্রের পরলোক গমনের পরেও একই ভাবে রবীন্দ্রনাথ চার লাইনের স্মরণিকা রচনা করেছিলেন। সেটি ছিল – “ যাহার অমরস্থান প্রেমের আসনে, / ক্ষতি তার ক্ষতি নয় মৃত্যুর শাসনে। / দেশের মাটির থেকে নিল যারে হরি’ / দেশের হৃদয় তারে রাখিয়াছে ধরি।।” ‘শরৎচন্দ্র’ নামাঙ্কিত ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ১২ই মাঘ তারিখে রচিত তার কবিতাটি ‘ভারতবর্ষে’ প্রকাশিত হয় ১৩৪৪-এর ফাল্গুন সংখ্যায়।

মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে কবির সাক্ষাৎকারের বর্ণনা কবি লিপিবদ্ধ করেছেন ‘তীর্থ-যাত্রী’ নামক রচনায় (অগ্রহায়ণ ১৩৩৯)। ‘বাঁশরী’ নাটকটি ছাপা হয়েছিল তিনটি কিস্তিতে – ১৩৪০-এর কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ সংখ্যায়। প্রবোধকুমার সান্যালের সাড়া জাগানো ভ্রমণ উপন্যাস ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ ‘ভারতবর্ষে’ প্রকাশিত হবার পর ৫ই নভেম্বর ১৯৩৩-এ লেখা কবিগুরুর চিঠি ‘মহাপ্রস্থানের পথে’ নাম দিয়ে ১৩৪০-এর পৌষ সংখ্যায় বেরিয়েছে। এটিতে কবি ‘সংস্কৃতি’-র পরিবর্তে ‘কৃষ্টি’ শব্দটি ব্যবহার করায় প্রবোধকুমারকে মৃদু ভর্ৎসনা করেছেন। এ ছাড়া রয়েছে ‘উত্তর-প্রত্যুত্তর’ – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আশালতা দেবী (‘অমিতার প্রেমে’র আলোচনা) – আষাঢ় ১৩৪১। রয়েছে ‘একখানি চিঠি’ (শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্য্য-আশ্রমের উদ্দেশে তথাকার সর্ব্বাধ্যক্ষকে লিখিত) – ‘চয়ন’ বিভাগে মুদ্রিত-আষাঢ় ১৩২৮।

রবীন্দ্রনাথের দিদি সৌদামিনী দেবীর বিয়ে হয়েছিল সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে; তাদের পুত্র সত্যপ্রসাদ এবং কন্যাদ্বয় ইরাবতী ও ইন্দুমতী। ইরাবতীর পুত্র অর্থাৎ সৌদামিনী্র দৌহিত্র অরুণরঞ্জন মুখোপাধ্যায় ‘অনামি” শীর্ষক একখানি কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়ে দেন পরিমার্জনের জন্য। রবীন্দ্রনাথ সেটির ভাষা আগাগোড়া বদলে দিয়ে ‘গোধূলি লগ্ন’ নামকরণ করে পাঠিয়ে দেন। দুটি কবিতারই রচনার তারিখ ২০শে মার্চ, ১৯৩১। ঘটনাটি খুবই কৌতূহলজনক। ‘ভারতবর্ষে’র পৌষ ১৩৩৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা দুটি। এই রচনার শেষে কবিতা দুটির প্রতিলিপি সংযুক্ত হয়েছ। রবীন্দ্রনাথ নিজে কম লিখলেও তাকে নিয়ে বহু লেখাই কিন্তু ছড়িয়ে রয়েছে ‘ভারতবর্ষে’র পাতায়।

‘ “ভারতবর্ষে”র গতবর্ষ’ শীর্ষক ১৩২১-এর আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত একটি আলোচনায় সম্পাদকদ্বয় লিখেছেন –

“...... মাসিক পত্রের অবস্থা এখন যাহা দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে দেখা যাইতেছে যে, অনেকে পাঁচ ফুলে সাজি সাজাইয়া পাঠক-দেবতার সেবায় লাগাইতেছেন, আর যাহার সাজিতে সুদৃশ্য ও সুগন্ধ ফুলের যত ঘন সন্নিবেশ হইয়াছে, তাহার ততই কৃতিত্ব জাহির হইতেছে। একটা ধুয়া উঠিয়াছে লোকে গল্প-কবিতা-নাটক-উপন্যাসে মশগুল হইয়া পড়িয়াছে, তাই গভীর বিষয়ের আলোচনা পড়িতে চায় না – মাসিক-পত্রের পরিচালক আমরা – আমরা কিন্তু সেকথা মানিনা। ...... হাটে বল করিয়া দাঁড়াইতে হইলে ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান, ভ্রমণ, সমালোচনা প্রভৃতি কোন বিষয়ই ত বাদ দিতে পারা যায় না। ...... তবে কএক বর্ষ হইতে শিশুপাঠ্য সাহিত্যের মত শিশুপাঠ্য মাসিক-পত্রের কিছ প্রাবল্য হইয়াছে ...”।

রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতবর্ষে’ কম লিখলেও তাকে নিয়ে কিন্তু বহু রচনা প্রকাশিত হয়েছে। এর কয়েকটির উল্লেখ করা যেতে পারে – ‘ভারতবর্ষের কালচার ও রবীন্দ্রনাথ’ (সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী), ‘সোনার তরী’ (বিভূতিভূষণ গুপ্ত), ‘রবীন্দ্রনাথ ও সঙ্গীত’ (দিলীপকুমার রায়), ‘রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কিছুক্ষণ’ (পরিমল গোস্বামী), ‘ভারতদূত রবীন্দ্রনাথ’ (সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়), ‘মৃত্যুঞ্জয় কবিগুরু’ (কালিদাস রায়), ‘রক্তকরবী’ (ক্ষেত্রলাল সাহা), ‘রবীন্দ্র-জয়ন্তী’ (নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত), ‘চিত্রকলায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ (মুকুলচন্দ্র দে), ‘রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের একটি বৈশিষ্ট্য’ (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘আর্ট ও রবীন্দ্রনাথ’ (সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত), ‘অতি-আধুনিক বাংলা কথা-সাহিত্য’ (অমলচন্দ্র হোম), ‘মর্ত্য হইতে বিদায়’ (লীলাময় রায়) ইত্যাদি। [‘লীলাময় রায়’ অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছদ্মনাম]।

সম্পাদক জলধর ছিলেন পত্রিকা-প্রতিষ্ঠাতা দ্বিজেন্দ্রলালের সহপাঠী। দ্বিজেন্দ্রলালের ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়েই ‘ভারতবর্ষে’র পাতায় মননধর্মী রচনা ও চিন্তামূলক প্রবন্ধের কিছু ঘাটতি ছিল না। প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছে ধারাবাহিক প্রবন্ধ কোকিলেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘ভারতবর্ষের অদ্বৈতবাদ’, ‘শঙ্কর-দর্শন’ প্রভৃতি। প্রায় চার হাজার প্রবন্ধ ছড়িয়ে রয়েছে ‘ভারতবর্ষে’র পাতায়। বিষয়-বৈচিত্র তুলে ধরতে মাত্র কয়েকটির এখানে উল্লেখ করছি –‘বাঙ্গালা ভাষায় বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা’ (পঞ্চানন নিয়োগী), ‘ভারতীয় অর্থোৎপাদন সম্বন্ধে কয়েকটি বক্তব্য’ (যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার), ‘ঋগ্বেদের পরিচয়’ (ভবভূতি ভট্টাচার্য্য), ‘মানব সভ্যতার ইতিহাস’ ( অধ্যাপক বিপিনবিহারী গুপ্ত), ‘মৃত্যু রহস্য’ (জ্যোতিষচন্দ্র ভট্টাচার্য্য), ‘অদ্বৈতবাদ ও কর্ম্মকান্ড’ (প্রমথনাথ তর্কভূষণ), ‘মনোবিজ্ঞান’ (অধ্যাপক চারুচন্দ্র সিংহ), ‘সঙ্গীত বিজ্ঞান’ (ক্ষিতীশপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়), ‘বাঙ্গালা ভাষার মঙ্গল-কাব্য’ (বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়), ‘মোগল যুগে স্ত্রী-শিক্ষা’ (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘ভৌতিক কান্ড’ (অধ্যাপক জগদানন্দ রায়), ‘মনের ঘাত-প্রতিঘাত’ (সরসীলাল সরকার), ‘পঞ্জিকা-সংস্কার’ (যোগেশচন্দ্র রায়বাহাদুর বিদ্যানিধি), ‘খাদ্যের অপরিহার্য্য উপাদান’ (পাঁচুগোপাল নন্দী), ‘সভ্যতা বিকাশের আর্থিক ব্যাখ্যা’ (বিনয়কুমার সরকার), ‘হিন্দুর পরলোকতত্ত্ব’ (বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়), ‘প্রাচীন ভারতের গৃহস্থ’ (হরিপদ চক্রবর্ত্তী), ‘ভারতীয় সঙ্গীত ও স্বরসম্বাদ’ (বাণী দেবী), ‘ভারতীয় দর্শনে দুঃখবাদ’ (ত্রিপুরাশঙ্কর সেন), ‘বাঙ্গালা বানান সমস্যা’ (ডক্টর মহম্মদ শহীদুল্লাহ), ‘বাংলার খাদ্য সমস্যা’ (ডাঃ হরগোপাল বিশ্বাস), ‘সাহিত্যে হাস্যরস’ (ডাঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘রাঢ়ে প্রচীন ইতিহাস’ (প্রভাসচন্দ্র পাল), ‘আফ্রিকার প্রবাসী ভারতীয়দের অবস্থা’ (স্বামী পরমানন্দ), ‘জাহানারার আত্মজীবনী’ (অধ্যাপক মাখনলাল রায়চৌধুরী), ‘নারী সমাজ’ (অম্বুজাবালা দেবী), ‘সাধনভূমি ভারতবর্ষ’ (প্রহ্লাদচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়), ‘কাপড়ের উপর নক্সা’ (রমলা বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘আধুনিক কাব্যের গতি’ (সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়), ‘অবিভক্ত বাংলায় মুসলমান আধিক্যের কারণ’ (রবীন্দ্রনাথ রায়), ‘স্বাধীনতার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম’ (গোকুলেশ্বর ভট্টাচার্য্য), ‘আত্মযোগ’ (খগেন্দ্রনাথ রায়), ‘আধুনিক বিষ ও মনুষ্য’ (ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়), ‘গান্ধিজীর সাধনা’ (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘কাঙাল হরিনাথের বাউল সঙ্গীত’ (সুশান্তকুমার মজুমদার কাব্যনিধি), ‘রবীন্দ্রনাথের শেষ রচনা’ (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধায়), ‘ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস’ (হরগোপাল বিশ্বাস), ‘ব্রহ্মমীমাংসা’ (ডক্টর রমা চৌধুরী), ‘রাশিয়া ও কম্যুনিজম’ (ডাঃ সুরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত), পার্ল বাক ও তাহার উপন্যাস (নীলিমা দেবী), ‘আচার্য্য ফ্রয়েড এবং আমরা’ (শশীভূষণ দাশগুপ্ত), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল গ্রন্থে মনস্তত্ব’ (মাখনলাল রায়চৌধুরী), ‘উপনিষদের নীতি’ (হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘মার্ক্সবাদ’ (অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত), ‘মায়াবাদ ও IDEALISM বা বিজ্ঞানবাদ’ (স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী) প্রভৃতি।

সম্পাদক জলধর সেন নিজে ছিলেন ভ্রমণ-পিপাসু। হিমালয়ের বিভিন্ন স্থানে তিনি ঘুরে বেরিয়েছেন শুধু পর্যটক হিসাবে নয়, দার্শনিকের মন নিয়ে। তার লিখিত ‘হিমালয়’(১৩০৭), ‘পথিক’(১৩০৮), ‘হিমাচল বক্ষে’(১৩১১), ‘হিমাদ্রি’(১৩১৮) প্রভৃতি ভ্রমণ সাহিত্য পাঠক সমাজে বিপুলভাবে আদৃত হয়েছে। তার লেখা ‘হিমাচল পথে’ , ‘হিমালয়ের কথা’ এই পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছে। ভ্রমণ বিষয়ক রচনা সম্বন্ধে তার আগ্রহ তাই স্বাভাবিক। অজস্র ভ্রমণ কাহিনী প্রকাশিত হয়েছে ‘ভারতবর্ষে’। বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করলে বর্তমান আলোচনা তথ্য-কন্টকিত হয়ে উঠতে পারে। তৎসত্বেও বেশ কিছু রচনা লেখকের নাম সহ তুলে ধরছি বৈচিত্র সম্বন্ধে পাঠকদের একটা ধারণা দেবার জন্য। পৃথিবীর খুব দেশই আছে যার কাহিনী এখানে অন্তর্ভুক্ত হয় নি। প্রত্যেকটি কাহিনিই বহু চিত্র শোভিত। পড়তে পড়তে একাত্ম হয়ে যেতে হয়। নীচের তালিকাটি কিছুটা দীর্ঘ কিন্তু সম্পূর্ণ নয়। লেখকদের নামের পাশে ডিগ্রির উল্লেখ করা হয় নি।

‘মার্কিন মুলুকে’(ইন্দ্রভূষণ দে মজুমদার), ‘য়ূরোপ ভ্রমণ’(বিজয় চন্দ মহতাব), ‘হিমালয়ের পত্র’(শ্রীশচন্দ্র মজুমদার), ‘যশোহর’(সৃজননাথ মিত্র মুস্তৌফি), ‘ব্রেজিল’(নরেন্দ্র দেব), ‘পক্ষীতীর্থ’(রায় রমণীমোহন ঘোষ বাহাদুর), ‘দক্ষিণপথ’(রায় জলধর সেন বাহাদুর), ‘রাজস্থান’(প্রেমাঙ্কুর আতর্থী), ‘ড্রেসড্রেনের চিত্রশালা’(মণিন্দ্রলাল বসু), ‘দ্বারকার পথে’(নীলিমাপ্রভা দত্ত), ‘উদয়পুর’(অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদার), ‘লাহোর’(হরিহর শেঠ), ‘পশ্চিমের পথিক’(ভবানী ভট্টাচার্য্য), ‘অজন্তার পথে’(অমিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘ইরাবতীর তীরে’(পরেশনাথ সেন), ‘মোটরে তিন হাজার দু’শ মাইল’(সুধাংশুমোহন চট্টোপাধ্যায়), ‘সিংহল দ্বীপ’(কুমার মুণীন্দ্রদেব রায় মহাশয়), ‘দেরাদুন’(হেমেন্দ্রলাল রায়), ‘পালামৌ’(কালিদাস লাহিড়ী), ‘চক্রধরপুর’(বিমলাচরণ সাহা), ‘বেলজিয়াম ও তাহার চিত্রসম্পদ’(ডাক্তার রুদ্রেন্দ্র কুমার পাল), ‘পেশোয়ার ও খাইবার পথ’(প্রবোধকুমার সান্যাল), ‘নেপালের পথে’(শ্রীপতি ঘোষ), ‘পঞ্জাব-সীমান্তে বহুদিন’(ডাক্তার ষষ্ঠিদাস মুখোপাধ্যায়), ‘প্যারিসে প্রথম কয়েকদিন’(অক্ষয়কুমার নন্দী), ‘মণিপুর রাজ্যে’(জিতেন্দ্রকুমার নাগ), ‘দ্বারকা’(হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ), ‘পশ্চিমের যাত্রী’(সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়), ‘গ্যাংটক দর্শন’(সুধীরকৃষ্ণ নাগ), ‘ভূস্বর্গ চঞ্চল’(দিলীপকুমার রায়), ‘অলিম্পিয়ার বার্লিন’(নির্ম্মলচন্দ্র চৌধুরী), ‘সুন্দর সুইটজারল্যান্ড’(সুবর্ণেন্দু গুপ্ত), ‘জাপান’(ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়), ‘হাজারিবাগের পথে’(সুধাংশুকুমার ঘোষ), ‘কন্যাকুমারী’(চিত্রিতা দেবী), ‘পঞ্চনদীর তীরে’(অন্নপূর্ণা গোস্বামী), ‘বারাণসী ধামে’(ক্ষণপ্রভা ভাদুড়ী), ‘তথাগতের পথে’(নরেন্দ্র দেব), ‘আফ্রিকার ভ্রমণ কাহিনী’(ব্রহ্মচারী রাজকৃষ্ণ), ‘আকাশপথের যাত্রী’(সুষমা মিত্র), ‘মিশরের ডায়েরী’(অধ্যাপক মাখনলাল রায়চৌধুরী), ‘সুন্দারবনের নদীপথে’(বিমলচন্দ্র সিংহ), ‘ভূটানের বুকে শিবধামে’(মতিলাল দাশ), ‘কৈলাসে কুম্ভ’(শরচ্চন্দ্র আচার্য্য),’তক্ষশীলা’(নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত), ‘অষ্ট্রেলিয়া ভ্রমণ’(অতুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়), ‘শিলং ভ্রমণ’(হেমনলিনী দেবী), ‘আল্পস পাহাড়’ (অধ্যাপক বিনয়কুমার সারকার), ‘নরওয়ে ভ্রমণ’ (বিমলা দাশগুপ্ত) প্রভৃতি। এর মধ্যে ১৩৩৬-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘মোটরে তিন হাজার দু’শ মাইল’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

‘ভারতবর্ষ’ দীর্ঘায়ু পেয়েছিল। দীর্ঘ গতিপথে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে উপন্যাসও স্থান পেয়েছে বহু সংখ্যায়। স্বাভাবিক ভাবেই এর প্রায় সব কটিই ধারাবাহিক। কয়েকটির নাম – ‘মহানিশা’ , ‘উত্তরায়ণ’ (অনুরূপা দেবী); ‘বিধিলিপি’ , ‘অনুকর্ষ’ (নিরুপমা দেবী); ‘মেঘনাদ’ , ‘তারপর’ (নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত); ‘ইমনদার’(শৈলবালা ঘোষজায়া); ‘উত্তরায়ন’(বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়); ‘মহাপ্রস্থানের পথে’(প্রবোধকুমার সান্যাল); ‘পদসঞ্চার’ , ‘লালমাটি’ , ‘উপনিবেশ’, ‘শিলালিপি’ (নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়); ‘বিজিতা’ , ‘দানের মর্য্যাদা’ , ‘পথের শেষে’ (প্রভাবতী দেবী সরস্বতী); ‘অসীম’(রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘মিলন-পূর্ণিমা’ , ‘বিপর্যয়’ (ডাক্তার নরেশচন্দ্র সেন); ‘অমূল তরু’ , ‘দিকশূল’ (উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়); ‘নায়েব মহাশয়’(দীনেন্দ্রকুমার রায়); ‘মনের পরশ’(দিলীপকুমার রায়); ‘ধোকার টাটি’ , ‘হাইফেন’ (চারু বন্দ্যোপাধ্যায়); ‘দ্বন্দ্ব’ (সরোজকুমারী বন্দ্যোপাধ্যায়); ‘ব্যাথার পূজা’(সুধীরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়); ‘গরমল’(নরেন্দ্র দেব); ‘মায়া প্রজাপতি’ (সত্যেন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত); ‘অন্তেষ্ট্যি’ , ‘তীর ও তরঙ্গ’ (স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য্য); ‘অপত্য স্নেহ’ (সৌরীন্দ্র মজুমদার); ‘ঝিন্দের বন্দী’ , ‘কালের মন্দিরা’ (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়); ‘মুমূর্ষু পৃথিবী’ (হীরেন্দ্রনারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়); ‘ঘাত প্রতিঘাত’ (কালীপ্রসন্ন দাশ); ‘নাগরিকা’ (চরণদাস ঘোষ); ‘কলঙ্কিনীর খাল’ (রাধিকাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়); ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ (মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়); ‘গণদেবতা’ , ‘দ্বারমন্ডল’ (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়); ‘স্বয়ম্বরা’ (আশালতা সিংহ) ; ‘লীলাভূমি’ (হীরেন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায়); ‘পতনে উত্থানে’ (নরেন্দ্রনাথ মিত্র); ‘ছিন্নবাধা’ (সমরেশ বসু); ‘নঞতৎপুরুষ’ , ‘জঙ্গম’ , ‘ভীমপলশ্রী’ (বনফুল); ‘দেহ ও দেহাতীত’ (পৃথ্বীশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য) প্রভৃতি। এরা অনেকেই সাহিত্যিক হিসাবে যথেষ্ট পরিচিত ও খ্যাতিমান।

অজস্র গল্প বেরিয়েছে ‘ভারতবর্ষে’। নামের দীর্ঘ তালিকা দিয়ে অবয়ব বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই। ‘ভারতবর্ষে’ই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে প্রবোধ কুমার সান্যালের সাড়া জাগানো ভ্রমণ কাহিনী ‘মহাপ্রস্থানের পথে’। ‘ভ্রমণের সঙ্গে কাহিনী যোগ করে ভ্রমণ কাহিনী সেটাই প্রথম’। লেখকের জীবদ্দশাতেই এটি ছায়াচিত্রে রূপান্তরিত হয়েছে ১৯৫২ সালে। ভ্রমণ পথে তার দেখা পাওয়া ‘রাণী’ এক রহস্যময়ী নারী। পথের বর্ণনা শেষ হলেও রাণীর সম্বন্ধে কৌতূহল শেষ হয় না। কাহিনীর শেষে রয়েছে রাণীর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার উল্লেখ। যাত্রার শেষ পর্যায়ে যখন বিদায়ের পালা তখন রাণীর জিজ্ঞাসা –“হ্যাঁ, ভ্রমণ কাহিনী কি আপনি লিখবেন ?” বললাম –“যদি লিখি ‘ভারতবর্ষে’ই লিখবো।” “ভালোই হবে, আমি ‘ভারতবর্ষে’র গ্রাহক। কিন্তু দেখবেন, সাবধান – আবার নাম-ধাম যেন প্রকাশ করবেন না।”

বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্পের নাম করা যায়, যার মধ্যে রয়েছে – ‘ঝরাপাতা’(গোকুলচন্দ্র নাগ, আশ্বিন ১৩২৯), ‘প্রথম ও শেষ’(বুদ্ধদেব বসু, বৈশাখ ১৩৩৬), ‘ব্যাধি’(তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, পৌষ ১৩৪০), ‘আত্মহত্যার অধিকার’(মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, পৌষ ১৩৪০), ‘আরোহন ও অবরোহন’(জগদীশ চন্দ্র গুপ্ত, আশ্বিন ১৩৪৭), ‘শবরী’(প্রেমেন্দ্র মিত্র, আষাঢ় ১৩৬১), ‘ভিখারীটা’(বনফুল, আষাঢ় ১৩৬৯) প্রভৃতি। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে ছিলেন হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, মাণিক ভট্টাচার্য্য, শক্তিপদ রাজগুরু, অখিল নিয়োগী, আশাবরী দেবী, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, হাসিরাশি দেবী, সতী দেবী, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নরেন্দ্র দেব প্রমুখ। এরা সকলেই সমকালে বা পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠিত। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, সম্পাদক হিসাবে জলধর সেন কিন্তু শুধু মাত্র নামী লেখকদের লেখাই ছাপেন নি। নতুন অনামী লেখকদেরও সুযোগ দিয়েছেন। পরে তারা অনেকেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। ‘পরশুরাম’ খ্যাত রাজশেখর বসু তখন তুলনামূলক ভাবে নবীন। তার প্রথম গল্প ‘শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ ১৩২৯-এর মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। পরের বছর কার্ত্তিক সংখ্যায় বেরিয়েছে তার সচিত্র সরস গল্প ‘চিকিৎসা-সঙ্কট’। ‘পরশুরাম’কে প্রতিষ্ঠিত করতে নিঃসন্দেহে অবদান রয়েছে ‘ভারতবর্ষে’র। এই পত্রিকার পাতাতেই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে নিস্তারিণী দেবীর ‘সেকালের কথা’। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইতিহাস বিষয়ক বহু লেখা বিকীর্ণ রয়েছে ‘ভারতবর্ষে’।

দীর্ঘ দিন ধরে ‘ভারতবর্ষে’ অসংখ্য কবিতা লিখেছেন প্রখ্যাত কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক। অন্যান্য বহু প্রথিতযশা কবি তাদের রচনা-সম্ভার দিয়ে পত্রিকার পাতা অলঙ্কৃত করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন – কালিদাস রায়, তরুলতা দেবী, সুরেশচন্দ্র ঘটক, প্যারীমোহন সেনগুপ্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, দেবকুমার রায়চৌধুরী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, কবিশেখর নগেন্দ্রনাথ সোম কবিভূষণ, গিরিজাকুমার বসু, কামিনী রায়, জ্যোতির্ম্ময়ী দেবী, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, নরেন্দ্র দেব, জসীম উদ্দীন, বন্দে আলী, দিলীপকুমার রায়, অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়, প্রভাতকিরণ বসু, মানকুমারী বসু, রবিদাস সাহা রায় প্রমুখ।

‘ভারতবর্ষে’ বেশ কয়েকটি নিয়মিত বিভাগ ছিল। ‘পুস্তক পরিচয়’ বিভাগে নতুন বইয়ের লেখকের নাম, মূল্য ও বিষয় বস্তুর কিছুটা বর্ণনা থাকত। যেমন ১৩২৪ আশ্বিন সংখ্যায় এই বিভাগে রয়েছে - ‘খাদ্য’ (রায় বাহাদুর চুনীলাল বসু, দেড় টাকা), ‘ব্রহ্মচর্য্য-সাধন’ (যোগেশচন্দ্র সেন ও হেমচন্দ্র সেন, এক টাকা), ‘স্বাস্থ্য ও শক্তি’ (পূর্ণচন্দ্র রায়, এক টাকা), ‘জাতক’ (ঈশানচন্দ্র ঘোষ, তিন টাকা), ‘মন্দাকিনী’ (শৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, ছ’আনা), ‘বিল্বদল’ (যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, আট আনা), ‘কাশীনাথ’ (শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেড় টাকা), ‘ছেলেদের বত্রিশ সিংহাসন’ (কুলদারঞ্জন রায়, আট আনা)। শরৎচন্দ্রের ‘কাশীনাথ’ প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, “এখানি উপন্যাস নহে, কয়েকটি গল্পের সংগ্রহ; ‘কাশীনাথ’ গল্পটিকে প্রথমে স্থান দিয়া লেখক বইখানীর নাম দিয়াছেন ‘কাশীনাথ’। লেখক মহাশয় যদি আমাদের পরামর্শ গ্রহণ করিতেন, তাহা হইলে আমরা তাহার ‘মন্দির’ গল্পটি প্রথমে দিয়া বইখানীর নাম দিতাম ‘মন্দির’। এই ‘মন্দির’ গল্পের ছোট একটু ইতিহাস আছে; তাহা ব্যক্তিগত হইলেও এই স্থলে উল্লেখ করিবার প্রলোভন সংবরণ করিতে পারিলাম না। বহুদিন পূর্ব্বে একবার আমরা ‘কুন্তলীন পুরস্কারের’ পুরস্কার যোগ্য গল্প নির্ব্বাচন করিয়া দিবার ভার পাইয়াছিলাম। ১২৬টি ছোট গল্প আমাদের হস্তগত হয়; সে বিপুল গল্প-সমুদ্র মন্থন করিয়া আমরা এই ‘মন্দির’ গল্পটিকে প্রথম স্থান দিয়াছিলাম। পরে শুনিয়াছি এই ‘মন্দির’ গল্পটিতেই শরৎচন্দ্রের হাতে-খড়ি; সেই শরৎচন্দ্র এখন, বাঙ্গালা উপন্যাস-লেখকগণের মধ্যে যাঁহারা শ্রেষ্ঠ, তাঁহাদের সহিত এক আসনে উপবিষ্ট......।”

‘সাহিত্য সংবাদে’ থাকত যেসব বই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে বা সদ্য প্রকাশিত হয়েছে তার খবর। ‘মাসপঞ্জী’ বিভাগে কোন একটি মাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনার সংক্ষিপ্ত সংবাদ পরিবেশিত হত। ‘বিবিধ প্রসঙ্গে’ থাকত বিভিন্ন জ্ঞাতব্য বিষয়ের বিশদ আলোচনা, লেখকের নামও থাকত সেই সঙ্গে। যেমন ১৩২৫-এর আষাঢ় সংখ্যায় রয়েছে – ‘রস-সাগর স্বর্গীয় কবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী’ (কবিভূষণ কৃষ্ণকান্ত দে), ‘ভারতীয় শিক্ষার বিশেষত্ব’ (অধ্যাপক যোগেশচন্দ্র দত্ত), ‘বঙ্গপল্লীর স্বাস্থ্যোন্নতির ব্যবস্থা’ (দীনেন্দ্রকুমার রায়), ‘আলোক-বিজ্ঞানের প্রাচীন কথা’ (তারাপদ মুখোপাধ্যায়)। ‘আলোচনা’ বিভাগে থাকত সমসাময়িক কোন এক বা একাধিক সংবাদকে চিহ্নিত করে তার সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা ও বিশ্লেষণ। ‘সাময়িকী’তে স্থান পেয়েছে সমসাময়িক সমাজ ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক ঘটনাবলীর বিশদ আলোচনা। যেমন আষাঢ় ১৩২৯ সংখ্যার ‘সাময়িকী’তে রয়েছে ‘দেশের কথা’ শীর্ষক একটি আলোচনা। এতে গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলন সম্বন্ধে খবরের বিশ্লেষণ রয়েছে, কিছু অংশ –“আইন অমান্য করলে আর রাজশক্তির রইল কি? এতটা প্রশ্রয় দেওয়া যেতে পারে না। চালাও ধর্ষণ - আরম্ভ কর repression। তখন চারিদিকে নগরে, সহরে, গ্রামে ধর-পাকড় আরম্ভ হোলো - ধর্ষণ শুরু হোলো। অসহযোগীর দল ‘গান্ধী মহারাজ কি জয়’ বলে, সমস্ত উৎপীড়ন সহ্য করে, বিনা বাক্য-ব্যয়ে, দলে দলে, হাসতে হাসতে জেলে যেতে লাগলো - এখনো যাচ্ছে। জেলের নাম তারা দিল ‘স্বরাজ-আশ্রম’ ।” এর পর রয়েছে ‘বাঙ্গালার ব্যবস্থা-পরিষদের সভাপতি’, ‘ব্যয় সঙ্কোচ কমিটি’, ‘বাঙ্গালীর সম্মান’, ‘মুদ্রাযন্ত্র আইন’, ‘সূতা ও কাপড়ের আমদানী-রপ্তানী’ শিরোনামে নানা আলোচনা। বিভিন্ন বিষয়ে বহু বছর ধরে যে বিপুল পরিমান সংবাদ ‘ভারতবর্ষে’র পাতায় সঞ্চিত রয়েছে সমসাময়িক ইতিহাস রচনার পক্ষে তা একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ।

‘সাহিত্য সংবাদ’টি নির্দিষ্ট ছিল সাহিত্য পুস্তক প্রকাশ সাহিত্য সংক্রান্ত সভা সমিতির খবর। ‘নিখিল প্রবাহ’ ও ‘বৈদেশিকী’ বিভাগে সাহিত্যের চর্চা হত। যেমন ১৩২২ মাঘ সংখ্যায় এবং ১৩২৩ বৈশাখ সংখ্যায় রসিকলাল রায় দুটি সচিত্র দীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেছেন, বিষয় ছিল যথাক্রমে ‘হিন্দি-সাহিত্য ও তার সেবকগণ’ এবং ‘গুজরাতি সাহিত্যের ক্রমবিকাশ’। অন্য দেশের সাহিত্যের অনুবাদও ছাপা হত। ‘চয়ন’ নামেও একটি বিভাগ ছিল। তবে যেটি বিশেষ উল্লেখের দাবী রাখে সেটি হল ‘খেলাধূলা’ বিভাগটি। ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার, বিলিয়ার্ড, টেনিস, ব্যায়াম ও শরীর চর্চা প্রভৃতি নানা বিষয়ে পরিপূর্ণ ছিল এর কয়েক পৃষ্ঠা। অলিম্পিকের খবরাখবর বিশদভাবে জানানো হয়েছে। সযত্নে পরিবেশিত হয়েছে বিভিন্ন খেলায় মহিলাদের অংশ গ্রহণের সংবাদও। বহু চিত্রে শোভিত ছিল এই বিভাগটি। ১৩৪১-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় একটি কৌতূহলোদ্দীপক বিমান প্রতিযোগিতার সংবাদ ছাপা হয়েছে। অংশ বিশেষ এখানে তুলে দিচ্ছি –“এবারকার বিশ্বজগতের উল্লেখযোগ্য ঘটনা – ‘মিলডেন হল-মেলবোর্ণ’ বিমান প্রতিযোগিতা। ২০শে অক্টোবর সকাল থেকে সহস্র সহস্র চক্ষু মিলডেন হল হ’তে মেলবোর্ণের আকাশপথে নিবদ্ধ ছিল। এই সুদূর ১১,৩০০ মাইল পথ কত মরু প্রান্তর, নদ নদী, সাগর পর্ব্বত সমন্বিত – কত দিন কত সপ্তাহ কেটে যায় অতিক্রম করতে। মানবের অসীম বুদ্ধিবলে ও দুর্জ্জয় সাহসে আজ এই সুদীর্ঘ পথও মাত্র তিন দিন অতিক্রান্ত হলো। কিছুদিন আগে কেহ ইহা কল্পনাতেও আনতে পারে নি।” এই সঙ্গে রয়েছে বিমান পথের বিশদ আলোচনা। পৃথক বিভাগ না থাকলেও জ্যোতিষশাস্ত্র ও পি. সি. সরকারের যাদুবিদ্যার বহু রচনা রয়েছে পত্রিকার পাতায়।

পত্রিকার শেষ লগ্নে ‘ব্যক্তিগত দ্বাদশ রাশির ফল’ এবং ‘ব্যক্তিগত দ্বাদশ লগ্নের ফল’ প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। ছোটদের জন্য ‘কিশোর জগৎ’ নামে একটি বিভাগও যুক্ত হয়েছিল। ১৩৬৭ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যার ‘কিশোর জগৎ’-এ’ ছিল উপানন্দের লেখা ‘বর্ষামঙ্গল’, সত্যচরণ ঘোষের লেখা ‘সুন্দরবনের বাঘ’, চিত্রগুপ্ত বিরচিত ‘ছুটির ঘন্টায়’, জ্যৈষ্ঠ মাসের ধাঁধাঁর উত্তর সহ নতুন ধাঁধাঁ ও বৈভব রচিত ‘মেঘোৎসবে’ নামক কবিতা। রয়েছে পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরে স্বরলিপি সহ গান। ‘কবিগুরুর “পূজারিণী” কবিতার মর্মকথা’ শীর্ষক প্রবন্ধে কবিতার অন্তর্নিহিত ভাব ব্যাখ্যা করেছেন বিষ্ণুপদ চট্টোপাধ্যায় কাব্যভারতী।

সম্পাদক জলধর সেন নামী-অনামী সব লেখকের রচনাই যত্ন সহকারে প্রকাশ করেছেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্ত্রী-শিক্ষা যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে, বহুসংখ্যক মহিলা সাহিত্য জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। তাদের রচিত উপন্যাস, গল্প, কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ‘ভারতবর্ষে’। মহিলা লেখকদের জন্য জলধর যে আলাদা ভাবে ভেবেছেন সেটা বোঝা যায় পত্রিকার ১৩২২-এর কার্ত্তিক সংখ্যাটি ‘মহিলা সংখ্যা’ হিসাবে চিহ্নিত করার ঘটনায়। মহিলা লেখকদের উৎসাহিত করে এই মর্যাদা দানের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। শুরুতেই রয়েছে ‘মাতৃ-মিলন’ নামক মানকুমারী বসুর কবিতা। অন্যান্য লেখিকাদের মধ্যে ছিলেন – গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, ইন্দিরা দেবী, অনুরূপা দেবী, প্রফুল্লময়ী দেবী, পরলোকগতা সুশীলা সেন, স্বর্গীয়া কুমারী প্রতিভা দত্ত, ফুলকুমারী গুপ্ত, কামিনী রায়, কাঞ্চনমালা দেবী, জোহরা রহমান, সুনীতি দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, কুসুমকুমারী দেবী, হেমনলিনী দেবী, সুরমাসুন্দরী ঘোষ, বিজনবালা দাসী প্রমুখ। এই সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছে দ্বিজেন্দ্রলালের বিখ্যাত ‘আজি গাও মহাগীত’ গানের কথা ও স্বরলিপি।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রয়াত হন ১৯৩৮ সালের ১৬ই জানুয়ারি (মাঘ ১৩৪৪)। একথা আগেই বলা হয়েছে যে তিনি ছিলেন ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার প্রাণপুরুষ। অনেকে শুধু তার লেখা পড়বার জন্যই পত্রিকা ক্রয় করতেন। তার মৃত্যুর পর পত্রিকা কর্ত্তৃপক্ষ ১৩৪৪ –এর ফাল্গুন সংখ্যাটিতে ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী সাহিত্যাচার্য্য শরৎচন্দ্রের জীবন ও সাহিত্য’ শিরোনামে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেন। বহু লেখক শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন কথাশিল্পীকে। প্রথমেই রয়েছে প্রবোধকুমার সান্যালের একটি লেখা। উদ্বেলিত জনতার সঙ্গে পুষ্পাচ্ছাদিত শবদেহের একাধিক ছবি মুদ্রিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ত লিখেইছেন , তার সঙ্গে রয়েছে তার স্বহস্তে লিখিত চার লাইনের কবিতার একটি প্রতিলিপি। অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন – সুভাষচন্দ্র বসু, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী, দীনেশচন্দ্র সেন, মুরলীধর বসু, নরেন্দ্র দেব, শিবরাম চক্রবর্ত্তী, রাধারাণী দেবী, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত প্রমুখ অসংখ্য গুণমুগ্ধ ব্যক্তি। এছাড়া রয়েছে দ্বিজেন্দ্রলালের ছেলে দিলীপকুমার রায়কে (মন্টু) লেখা শরৎচন্দ্রের অসাধারণ দু’টি চিঠি। পরের মাসে চৈত্র সংখ্যাতেও রয়েছে শরৎচন্দ্রকে নিয়ে একাধিক রচনা।

‘ভারতবর্ষে’র একটি আকর্ষণীয় বিষয় ছিল এর সঙ্গীত সংক্রান্ত অংশটি। আলাদা ভাবে সঙ্গীত বিষয়ক নানা প্রবন্ধ ত রয়েইছে, এছাড়া নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে গানের কথা, সুর ও স্বরলিপি। দ্বিজেন্দ্রলালের প্রবর্তিত পত্রিকায় সঙ্গীতের একটা বিশেষ গুরুত্ব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তার রচিত নাটকের বহু গান স্বরলিপিসহ মুদ্রিত হয়েছে। রয়েছে হাসির গানের স্বরলিপিও। ১৩২৪ পৌষ সংখ্যায় রয়েছে দ্বিজেন্দ্রলালের বিখ্যাত ‘নন্দলাল’-এর দিলীপকুমার রায় কৃত স্বরলিপি। স্বরলিপি সহ রবীন্দ্রসঙ্গীতও রয়েছে পত্রিকার পাতায়। সঙ্গীত বিষয়ে বিভিন্ন ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল, স্বামী বিবেকানন্দ, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, শান্তিদেব ঘোষ, সাহানা দেবী, তারাপদ চক্রবর্তী, অজয় ভট্টাচার্য্য, জগৎ ঘটক, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণা বেজবড়ুয়া প্রমুখ।

সমসাময়িক খ্যাতনামা ব্যক্তিদের পরলোক গমনের সংবাদ ‘শোকসংবাদ’ হিসাবে নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে, সেই সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ছাপা হয়েছে বহু বিখ্যাত লোকের জীবনী।

‘ভারতবর্ষে’র অপর উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হ’ল এর চিত্রসম্পদ। পত্রিকাটি ছিল চিত্র সজ্জিত। পত্রিকার ‘চিত্রসূচী’ পৃথক ভাবে মুদ্রিত হয়েছে। ‘ত্রিবর্ণ চিত্র’, ‘বহুবর্ণ চিত্র’ নানা ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে সমগ্র চিত্র তালিকাকে। প্রতিষ্ঠিত, অল্প পরিচিত বহু শিল্পীর অঙ্কিত ছবির স্থান হয়েছে জলধরের পত্রিকায়। এদের মধ্যে রয়েছেন প্রমোদকুমার চট্টোপাধ্যায়, যামিনী রায়, হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার, চারুচন্দ্র রায়, ভবানীচরণ লাহা, সুরেশ্চন্দ্র ঘোষ, সারদাচরণ উকিল প্রমুখ। বনবিহারী মুখোপাধ্যায় কার্টুন বা ‘রঙ্গ-চিত্র’ এঁকেছেন বহু সংখ্যায়। ১৩২৪ পৌষ সংখ্যায় রয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবীচৌধুরাণী’ অবলম্বনে তার চিত্রিত বিচিত্র কার্টুন। ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ভাবের অভিব্যক্তি’ শীর্ষক চিত্রমালা বিশেষ উপভোগ্য। ১৩২৮-এর আষাঢ় সংখ্যায় শিল্পী গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা একটি ‘রঙ্গ-চিত্রে’র নাম ছিল ‘বি-শৃঙ্খল’। ছবির পাদ দেশে ‘চিত্র পরিচয়’ নাম দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়েছে –

“দেশের পা দুখানি নানা শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। যদিও এই শৃঙ্খল ভারে দেহ মৃতের ন্যায় অসাড় তবু এখনও রক্ত ঝরিতেছে। বুঝা যাইতেছে এখনও প্রাণ আছে। এই আসন্ন মৃত্যুর কবল হইতে রক্ষা করিবার জন্য শৃঙ্খল মোচনের চেষ্টায় নানা উদ্যোগী পুরুষ নানা রকম চাবি লইয়া আসিতেছেন, কিন্তু হায়, চাবি এত প্রকান্ড যে তাহাতে শৃঙ্খলের কুলুপ খোলা যায় না। ছোট্ট একটি কুলুপ, হয় ত সামান্য একটি চাবিতে খুলিবে – কিন্তু কৈ সেই আসল চাবি!”

ছবিটি গভীর ভাব প্রকাশক। দেশের বা পৃথিবীর বর্তমান পরিস্থিতিতেও এটি প্রাসঙ্গিক। হয় ত চিরকালই প্রাসঙ্গিক ছিল ও থাকবে। মূল সমস্যার সমাধান নিয়ে কে ভাবছে? একটি ছবি যে কত ব্যাপক অর্থ ফুটিয়ে তোলে এটি তার একটি উদাহরণ। ‘অনেক কথা যাও যে বলে কোন কথা না বলি’ এখানেও প্রযোজ্য। ছবিটির একটি প্রতিলিপি এখানে দেওয়া হয়েছে, তবে মূল ছবির মত রঙিন নয়, সাদা-কালো।

‘ভারতবর্ষ’কে জনপ্রিয় করে তোলার মূল কারিগর ছিলেন সম্পাদক জলধর সেন। দীর্ঘ প্রায় ২৭ বছর সম্পাদনার কাজ করে গেছেন তিনি। আশি বছর বয়সে তার তিরোধান ঘটে ১৯৩৯ সালের ১৫ই মার্চ তারিখে (২৬শে চৈত্র ১৩৪৫)। তার অসাধারণ অবদানের কথা স্মরণ করে পত্রিকার ১৩৪৬ বৈশাখ সংখ্যায় ‘জলধর স্মৃতি-তর্পণ’ প্রকাশিত হয়। অজাতশত্রু অমায়িক স্নেহপ্রবণ এই মানুষটির মৃত্যুতে ছোট বড় সব লেখকই এগিয়ে এসেছেন শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনে। স্মৃতি-তর্পন অংশটি শুরু হয়েছে রবীন্দ্রনাথের হাতে লেখা ‘জলধর’ শীর্ষক কবিতার প্রতিলিপি দিয়ে। চার লাইনের কবিতাটি ছিল – “বাঙালীর প্রীতিঅর্ঘ্যে এক দীর্ঘ জীবনের তরী / স্নিগ্ধ শ্রদ্ধাসুধারস নিঃশেষে লয়েছে পূর্ণ করি। / আজি সংসারের পারে, দিনান্তের অস্তাচল হতে / প্রশান্ত তোমার স্মৃতি উদ্ভাসিত অন্তিম আলোতে।।” অন্যান্য বহু লেখকের মধ্যে কয়েকজনের নাম শুধু উল্লেখ করছি – রাজশেখর বসু, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, নরেন্দ্র দেব, কালিদাস রায়, স্যার বিজয়চাঁদ মহতাপ (মহারাজাধিরাজ বাহাদুর, বর্দ্ধমান), চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, প্রমথ চৌধুরী, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। সর্বজনশ্রদ্ধেয় ‘দাদা’র দেহাবসানে স্বতস্ফূর্তভাবে উৎসারিত হয়েছে আপনজন বিয়োগের শোকাশ্রু। রাজশেখর বসুর ভাষায়,

“দৈবক্রমে মাঝে মাঝে এমন লোক দেখা দেন যাঁর সঙ্গলাভে অগণিত লোক পরিতৃপ্ত হয়, যিনি স্বভাবসিদ্ধ উদারতায় সকেলরই পরমাত্মীয় হয়ে যান। ...... বিদ্যা বা রাজপ্রসাদের নিদর্শক উপাধি অনেকেই পায়, কিন্তু জনসাধারণ একযোগে অন্তর থেকে যা দান করে এমন উপাধি লাভ অল্প লোকের ভাগ্যেই ঘটে। বাংলাদেশের সমগ্র সাহিত্যসমাজ দাদা উপাধি দিয়ে জলধর সেনকে অন্তরঙ্গ অগ্রণী বলে মেনে নিয়েছে। এমন ঘনিষ্ঠ আন্তরিক মর্য্যাদা আর কোন সাহিত্যিক পান নি।”

কল্লোল যুগের এক বিদ্রোহী লেখক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের স্মৃতিচারণ –

“তখন তার বিস্তৃত-জ্ঞাত নামী কাগজে যিনি আমাদের সর্বপ্রথম আহ্বান করলেন তিনি জলধর সেন। শুধু স্থান দিলেন না, সম্মান দিলেন, অনুগ্রহ নয়-দিলেন অধিকার। সেদিনের আবিল আবহাওয়ার উর্দ্ধে সাহিত্যের প্রতি তাঁর সেই নিষ্পক্ষপাত ও নিঃসঙ্কোচ আতিথেয়তা আমাদের পক্ষে একটা গভীর অনুভূতির জিনিস ছিল যা ইহজীবনে কখনো বিস্মৃত হব না।”

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মর্তলোক থেকে বিদায় নেন ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২শে শ্রাবণ। ‘ভারতবর্ষে’র ভাদ্র সংখ্যায় প্রকাশিতব্য সমস্ত রচনারই তখন হয় ত মুদ্রণের কাজ শেষ। অতএব পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যায় রবীন্দ্র-প্রয়াণ প্রসঙ্গ অনুচ্চারিতই থেকেছে। শুধু পত্রিকার শেষে একপৃষ্ঠাব্যাপী একটি ছবির মাধ্যমে নীরব শ্রদ্ধা অর্পিত হয়েছে। আশ্বিন সংখ্যাটি ছিল স্মরণ-সংখ্যা। স্বাভাবিক ভাবেই বহু লেখক রচনার মাধ্যমে তাদের প্রনাম নিবেদন করেছেন। লিখেছেন – রাধারাণী দেবী, কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, নরেন্দ্র দেব, অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, প্যারীমোহন সেনগুপ্ত, রায়বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্র, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, আচার্য্য স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বনফুল, কবিশেখর কালিদাস রায়, প্রমথ চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, লীলাময় রায় [অন্নদাশঙ্কর রায়], নিরুপমা দেবী, কবিকঙ্কন অপূর্ব্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য, মানকুমারী বসু, প্রবোধকুমার সান্যাল, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র, অনুরূপা দেবী, প্রভাতকিরণ বসু, প্রিন্সিপাল সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, বন্দে আলী মিয়া প্রমুখ। এই সংখ্যাতেই প্রকাশিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ‘যে ছিল আমার স্বপনচারিণী’ গানটি শৈলজারঞ্জন মজুমদার কৃত স্বরলিপিসহ। মুদ্রিত হয়েছে কবির শববহনের দৃশ্যসহ অন্যান্য বেশ কয়েকটি ছবি। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ‘ভারতবর্ষে’ যেসব লেখা প্রকাশিত হয়েছে সে সম্বন্ধে আগেই বলা হয়েছে।

জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীর মহাপ্রয়াণেও ‘ভারতবর্ষ’ শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন করেছে ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যায়।

বিভিন্ন সময়ে পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন অমূল্যচরণ বিদ্যভূষণ ও জলধর সেন (১৩২০-১৩২১); জলধর সেন ও উপেন্দ্রকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায় (১৩২১-১৩২৩); জলধর সেন (১৩২৩-১৩৪৬); ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও সুধাংশুশেখর চট্টোপাধ্যায় (১৩৪৬-১৩৪৭); ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (১৩৪৭-১৩৬০); ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও শৈলেনকুমার চট্টোপাধ্যয় (১৩৬০-১৩৬৭?)|

প্রতি মাসে একটি নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশনার ক্ষেত্রে ‘ভারতবর্ষে’র সঙ্গে তুলনীয় ছিল একমাত্র ‘প্রবাসী’। আর কোন পত্রিকা এই কৃতিত্ব দাবী করতে পারে না। ‘ভারতবর্ষে’র বিষয়-বৈচিত্র ছিল এত বিস্তৃত এবং লেখক সংখ্যা এত বেশী যে প্রতি মাসে ১৫২ পৃষ্ঠা ব্যাপী এই পত্রিকার কন্দরে যে সব মণিমানিক্য সঞ্চিত আছে তার সম্যক পর্যালোচনা হলে সেকালের ইতিহাস রচনার কাজ অনেক সহজ হয়ে যাবে।


চিত্র – ১ : প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা ।



চিত্র – ২ : ১৩২৩ আশ্বিন সংখ্যার একটি বিজ্ঞাপন।

  চিত্র – ৩ : ১৩২৮ আষাঢ় সংখ্যায় গগনেন্দ্রনাথের আঁকা ছবি। এ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

  

 চিত্র - ৪ : ১৯১১ সালে শিল্ড বিজয়ী মোহনবাগান দলের খেলোয়াড়বৃন্দ।

চিত্র - ৫ : ১৩৩৮ পৌষ সংখ্যায় মুদ্রিত অরুণরঞ্জনের কবিতা ও রবীন্দ্রনাথের সংশোধন।

  

 চিত্র - ৬ : পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি।

চিত্র - ৭ : পত্রিকায় প্রকাশিত ছবি। ।



লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.