প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

অক্টোবর ১৫, ২০১৬

 

ভ্রমর

দীপক সেনগুপ্ত


‘ভ্রমর’ মাসিক পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১২৮১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। পত্রিকাটির আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র এক বছর তিন মাস। পনেরোটি সংখ্যা প্রকাশ করেই ‘ভ্রমরে’র গুঞ্জন স্তব্ধ হয়ে যায়। এই পত্রিকাটির আলোচনা হয় ত গুরুত্ব পেত না যদি না সম্পাদক হতেন বঙ্কিমচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ সহোদর ‘পালামৌ’ খ্যাত সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্র তার দাদার সম্বন্ধে লিখেছেন –

“পত্রখানি অতি উৎকৃষ্ট হইয়াছিল। এখন আবার তাঁহার তেজস্বিনী প্রতিভা পুনরুদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। প্রায় তিনি একাই ভ্রমরের সমস্ত প্রবন্ধ লিখিতেন।”

বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় ‘বঙ্গদর্শন’ বেরিয়েছিল ১২৭৯-এর বৈশাখে। এর ঠিক দু’বছর পর ‘ভ্রমরে’র আত্মপ্রকাশ। ‘বঙ্গদর্শনে’র মত একটি উচ্চাঙ্গের মাসিক পত্রিকা সচল থাকা অবস্থাতেই হঠাৎ সঞ্জীবচন্দ্র আর একখানি পত্রিকা প্রকাশ করলেন কেন ? বঙ্কিমচন্দ্র ‘বঙ্গদর্শন’ সম্পাদনা করেছেন চার বছর, এর পরের ছ’বছর সঞ্জীবচন্দ্রই পত্রিকাটির সম্পাদক হয়েছিলেন। তাহলে ‘ভ্রমরে’র কি প্রয়োজন ছিল ?

১২৮১-র জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ‘বঙ্গদর্শনে’ একটি বিজ্ঞাপন মুদ্রিত হয়। ‘ভ্রমর’ শিরোনামে এই বিজ্ঞাপনটি ছিল –
“ভ্রমর নামে একখানি অভিনব মাসিক পত্র বঙ্গদর্শন কার্য্যালয় হইতে বৈশাখ অবধি প্রকাশিত হইতেছে।
যাহা যাহা সুখপাঠ্য এবং যাহাতে বিশুদ্ধ আমোদ ও সুশিক্ষা একত্রে মিলিত করা যায়, তাহাই এই পত্রের উদ্দেশ্য। উপন্যাস, পদ্য, কৌতুকাবহ বৈজ্ঞানিকতত্ত্ব, দেশীয় সামাজিক কথা, ইত্যাদি বিষয় এই সামাজিক পত্রে লিখিত হইবে। যাহাতে কৃতবিদ্য এবং অল্পজ্ঞান উভয় শ্রেণীর লোকের মনোরঞ্জন হয় এমত যত্ন করা যাইবে।
ইহার মূল্য অতি অল্প। অগ্রিম বার্ষিক মূল্য একটাকা চার আনা ও ডাকমাশুল ছয় আনা। মোট এক টাকা দশ আনা। পশ্চাদ্দেয় মূল্য এক টাকা দশ আনা ডাকমাশুল ছয় আনা মোট দুই টাকা। প্রতি সংখ্যার মূল্য তিন আনা মাত্র।
যাঁহারা বঙ্গদর্শনের গ্রাহক তাঁহারা পাঁচ টাকার একখানি নোট পাঠাইলে দুই পত্রই পাইতে পারিবেন। ভ্রমরের আকার ১২ পেজি রয়েল ২৪ পৃষ্ঠা। ইহা প্রতি মাসের ১৫ই তারিখে প্রকাশ হয়। গ্রাহকগণ নিম্ন স্বাক্ষরকারীর নিকট নাম ও মূল্য পাঠাইবেন।
শ্রীপূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় / বঙ্গদর্শন কার্য্যাধ্যক্ষ।”

‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা একটু উচ্চমানের ছিল বলে যারা মনে করতেন তাদের সাহিত্য পিপাসা মেটানোর জন্যই হয় ত ‘ভ্রমরে’র কথা ভেবেছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার মূল্য ছিল সডাক তিন টাকা ছ’আনা এবং ‘ভ্রমরে’র ছিল দু’টাকা। সেজন্যই বিজ্ঞাপনে লেখা হয়েছে যে একত্রে নিলে পাঁচ টাকায় দুটি পত্রই পাওয়া যাবে।

প্রায় সব পত্রিকাতেই প্রথম সংখ্যায় পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। সঞ্জীবচন্দ্রও সেটা করেছেন, অবশ্যই তার আলঙ্কারিক ভাষায় ও নিজস্ব ভঙ্গীতে। ‘ভ্রমর’ নাম দিয়ে ভূমিকায় লেখা হয়েছে –

“আমরা, এক সুচতুর শিল্পকরকে ভ্রমরের একটি চিত্র ক্ষোদিত করিতে অনুরোধ করিলে তিনি স্বীকৃত হইয়াছিলেন। কিছুদিন পরে, তিনি আমাদিগকে চিত্রের একটি আদর্শ দেখাইলেন। দেখিলাম, যে এক পদ্ম, পদ্মপত্র সহিত শোভিত, তাহার উপর বসিয়া-এক মৌমাছি! আমরা শিল্পকরকে বলিলাম, “এযে মৌমাছি?” তিনি বলিলেন, “আজ্ঞে না, এই ভ্রমর।” আমরা সন্তুষ্ট হইয়া গৃহে আসিলাম। আমরাও বোধ হয় শিল্পকরের অনুকরী। আমরা বলিয়াছিলাম, ভ্রমর প্রকাশ করিব - হয়ত, আমাদেরও ভ্রমর মৌমাছি হইয়াছে। যদি তাহা হইয়া থাকে, ভরসা করি পাঠক, সন্তুষ্ট হইয়া গৃহে যাইবেন।
“বালিকারা উপকথা বলিয়া থাকে, এক রাজার দুয়া সুয়া দুই রাণী। দুয়া রাণী রাজসংসর্গে বঞ্চিতা - প্রণয় সুখের সাধ মিটাইবার জন্য আপন পর্ণকুটীরে কুলকাঁটা স্থাপন করিয়া, তাহাতে আপন অঞ্চল বাঁধাইয়া বলিতেছিল, “ছি রাজা! ছাড়।” আমরা এই কুরূপ মৌমাছিকে বঙ্গোদ্যানে ছাড়িয়া দিয়া, সাধ মিটাইবার জন্য বলিতেছি, ভ্রমর, একবার গুণগুণ কর! এই কুসুম কিরীটী বৈশাখে নানা ফুলের পরিমলগুরু মন্দ সমীরণে আরোহণ করিয়া, ঘরে২ গুণগুণ করিয়া আইস। যেখানে দেখিবে বঙ্গশোভা কামিনীকুসুম অধরে মধু, নয়নে বিষ লইয়া ফুটিয়া আছেন, সেইখানে গিয়া গুণগুণ করিয়া, তাঁহাদের গুণ বলিয়া আইস। যেখানে দেখিবে, বঙ্গদেশের মহিরূহগণ, বিষয় রৌদ্রে তপ্ত হইয়া, ফলভরে অবনত হইয়া, বিমনা হইয়া আছেন, সেইখানে গিয়া তাঁহাদের ছায়ায় উড়িয়া গুণগুণ করিয়া, তাঁহাদের গুণ গাইয়া আসিবে। আর যখন দেখিবে, যে বঙ্গসমাজের কেতকী, ঘন প্রাবৃট মেঘাচ্ছন্ন আকাশতলে সাতপুরু চিকণ কাপড়ের ঘোমটা দিয়া, অথচ গ্রীবা উন্নত করিয়া সেই ঘোমটা ঠেলিয়া ঈষৎ কটাক্ষ ক্ষেপণ করিতে করিতে কণ্টকময় জঙ্গলরূপ ধর্ম্ম সমাজে বসিয়া কাহার ধ্যান করিতেছেন, তখন ভ্রমর! তুমি তাঁহার ধ্যানভঙ্গ করিও না। দূর হইতে দুখানি পাখা জড় করিয়া নমস্কার করিয়া সে কেতকী সমাজ পরিত্যাগ করিও; নহিলে তোমার ঐ ঢল ঢল ঘন রুচিরঞ্জন কৃষ্ণকান্তি তাহার প্রচুর পরাগস্পর্শে ধূসরিত হইবে, তাঁহার কাঁটায় তোমার ঐ সূক্ষ্ম পত্রময় পক্ষদ্বয় ছিন্নভিন্ন হইবে, এবং হয় ত ভ্রমর! তুমি তাহার তীব্র গন্ধে একেবারে অন্ধীভূত হইবে। তুমি সেখানে যাইও না। তুমি বঙ্গীয় সম্বাদপত্ররূপিণী মধুমক্ষিকার মত, কোথায় মধু, কোথায় মধু করিয়া নিয়ত অন্বেষণ করিয়া বেড়াইও না। যে মধু সঞ্চয়ের প্রয়াস করে, সে মধুর অন্বেষণে রত রহুক; তুমি মধুকর, মধুকরে মধুসঞ্চয় করে না; তুমি বঙ্গের মধুকর, ফুলে ফুলে ভ্রমিবে, তাহাতেই তুমি ভ্রমর, আর নিয়ত গুণ গুণ করিবে সেইটিই তোমার গুণপনা। যে মধুমক্ষিকা সেই মধুচক্র করুক, তুমি কোন চক্রে থাকিও না, সঞ্চয়ী লোকেই চক্রে থাকে।”

পত্রিকার প্রারম্ভিক পৃষ্ঠায় পুষ্পশোভিত দুটি লতার নীচে যে পতঙ্গের ছবিটি ছাপা হয়েছে, সেটা দেখে ভ্রমর বা মৌমাছি কোনটিই মনে হয় না। ফড়িং-এর সঙ্গে অনেকটা সাদৃশ্য আছে ।

‘ভ্রমরে’র বিভিন্ন রচনায় লেখকের নাম কদাচিৎ প্রকাশিত হয়েছে। অবশ্য প্রবন্ধ ত প্রায় সবই সম্পাদক লিখেছেন বলে বঙ্কিমচন্দ্র জানিয়েছেন। পত্রিকার প্রতি সংখ্যা ছিল চব্বিশ পৃষ্ঠার। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল – ‘ভ্রমর’, ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’, ‘নিদ্রা’, ‘জলে ফুল’ (কবিতা) এবং ‘স্ত্রীজাতি বন্দনা’। ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’ একটি উপন্যাস। একুশ পৃষ্ঠাব্যাপী উপন্যাসটি প্রথম সংখ্যাতেই শেষ হয়েছে। এটি বাদে পত্রিকায় আর একটি মাত্র উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে, সেটির নাম ‘কন্ঠমালা’। প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু করে দশম সংখ্যা অবধি ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছে এটি। পদ্য ছিল মোট সাতটি। পদ্য রচয়িতাদের কয়েকজনের নাম রয়েছে। এরা হলেন – জ্যোতিশ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজকৃষ্ণ মিশ্র, প্রবোধ চন্দ্র ঘোষ ও গোপালচন্দ্র ঘোষ। কবিতা বাদ দিয়ে অন্যান্য রচনায় দু’জন লেখকের নাম রয়েছে – লালমোহন শর্ম্মা এবং শ্রীঃ।

দ্বাদশ সংখ্যায় মুদ্রিত ‘সরস্বতীর সহিত লক্ষ্মীর আপস’ একটি কৌতুকপ্রদ রচনা। এর প্রথম দিকের কিছু অংশ –

“ এক দিবস বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মী অন্তঃপুরে বসিয়া পাদপদ্মে অলক্ত পড়িতেছেন, এমন সময় স্বয়ং ভগবান জনার্দ্দন কতক গুলিন বঙ্গদেশীয় সম্বাদপত্র হস্তে লইয়া তথায় উপস্থিত হইলেন এবং নিকটে বসিয়া লক্ষ্মীর করকমল আপন হস্তমধ্যে লইয়া ক্রীড়া করিতে করিতে বলিলেন, “হে কমলা, আমি কিঞ্চিৎ বিপদগ্রস্ত হইয়া তোমার নিকট আসিয়াছি। তুমি বলিবে বিষ্ণুর আবার বিপদ কি ? আমার বিপদ আছে; স্মরণ করিয়া দেখ, অনেকবার বিপদে পড়িয়াছিলাম; সম্প্রতি আবার বিপদে পড়িয়াছি। এই সকল সমাচার পত্র পড়িয়া দেখ, বাঙ্গালায় দুর্ভিক্ষ উপস্থিত। শিব সংহারকর্ত্তা, মনুষ্য মরিলেই তাঁহার খোষনাম। আমি পালনকর্ত্তা, অপালনে বাঙ্গালি মরিলে আমার বদনাম, ইহার নিমিত্ত একান্ত পদচ্যুত না হই, অভাবপক্ষে যে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে, তাহার সন্দেহ নাই, অপালন দোষের প্রায়শ্চিত্ত কি তাহা জান ত ?”
লক্ষ্মী একে একে সম্বাদপত্র গুলিন পড়িয়া তাহা স্বামীর হস্তে পুনরর্পণ করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এক্ষণে উপায় ?
নারায়ণ কহিলেন, এক্ষণে উপায় তুমি। তুমি যদি একবার বাঙ্গালায় যাও, তাহা হইলে বাঙ্গালির সকল ক্লেশ নিবারণ হয়। মনে করে দেখ, তুমি অনেক কাল বাঙ্গালায় যাও নাই। বাঙ্গালিরা তোমার নিতান্ত অনুগত; তুমি একেবারে যাও না, অথচ তাহারা প্রায় প্রতি মাসে তোমার পূজা করে।
লক্ষ্মী উত্তর করিলেন, আমি যাই না কিন্তু আমার পেচক যাইয়া থাকে। আমি যে যাই না, তাহার কারণ আছে। শুনিয়াছি ইদানীং সরস্বতী নাকি বাঙ্গালায় যাতায়াত করিতেছে, সরস্বতীর সঙ্গে আমার চিরবিরোধ, সরস্বতী বাঙ্গালায় গেলে আমি যাব না।”

রচনাটির শীর্ষদেশে সম্পাদক মন্তব্য করেছেন –“এই প্রবন্ধটি আমরা বহুদিন হইল প্রাপ্ত হইয়াছি, কিন্তু যথাসময়ে প্রকাশ করিতে পারি নাই।” এ থেকে বোঝা যায়, এটি অন্তত সম্পাদক সঞ্জীবচন্দ্রের লেখা নয়।

অষ্টম সংখ্যায় মুদ্রিত হয়েছে ‘স্বপন’ নামক কবিতা। শুরুতেই সম্পাদক লিখেছেন –“নিম্ন লিখিত পদ্যটি বালকের রচিত বলিয়া আমরা সাদরে প্রকাশ করিলাম। স্থানে স্থানে দুই একটি কথা পরিবর্ত্তন করা গিয়াছে। বালকের নাম জ্যোতিশ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘ কবিতাটির প্রথম অংশটুকু তুলে দিচ্ছি –

“ বিমল গগনপটে শোভে শশধর,
উজলিয়া চারিদিক কৌমুদী রাশিতে।
ছুটিছে অম্বর মাঝে শ্বেত জলধর।
চারিদিকে তারামালা লাগিছে জ্বলিতে –
মুকুতা হারেরমত, আলো করি শূণ্য পথ,
নাচে তার প্রতিরূপ নদীর উপরি;
নৃত্যকরে শৈলবালা, পরিয়া হীরকমালা,..."

চতুর্দশ সংখ্যায় বেরিয়েছে ‘কীর্ত্তন’ নামক প্রবন্ধ। কীর্তন এখন আর তেমন শোনা যায় না। এক সময়ে এটির কিন্তু বহুল প্রচলন ছিল বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকেই যে কীর্তনের ঢেউ স্তিমিত হয়ে এসেছিল সে সম্বন্ধে লেখক জানিয়েছেন –

“ কীর্ত্তনে লোকের আর বড় রুচি নাই, জিজ্ঞাসা করিলে অনেকে বলেন যে, “কীর্ত্তনে টপ্পার মজা পাওয়া যায় না। উহার ভাষা বুঝা যায় না সুরও ভাল লাগে না।”
কীর্ত্তন যে কেন ভাল লাগে না তার মূল কারণ “কীর্ত্তনের ভাষা বুঝা যায় না।” ভাষা বুঝিলে সুরও ভাল লাগিত, “টপ্পা” অপেক্ষা অধিক “মজাও” পাওয়া যাইত।
কীর্ত্তনের ভাষা অতি সরল, কেবল তাহার গুটি কত কথা এক্ষণে আমাদের মধ্যে আর ব্যবহার নাই; এই গুটি কত কথা অমৃত ভান্ডারের দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে। আমাদের অনেকে আইরিস বালাডস (Irish Ballads) পড়িবার নিমিত্ত আয়ার্ল্যান্ড দেশের অপ্রচলিত ভাষা শিক্ষা করিয়াছেন, কিন্তু নিজ দেশের রত্ন ভোগ করিবার নিমিত্ত দুইটা পুরাতন কথার অর্থ সংগ্রহ করেন নাই। যদি তাঁহারা এই সামান্য শ্রমস্বীকার করেন, তাহা হইলে তাঁহাদের শ্রম নিতান্ত বৃথা যাইবে না।
এক্ষণে কীর্ত্তনের আদর নাই বলিয়া ক্রমে কীর্ত্তন লোপ পাইতেছে। বর্দ্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া প্রভৃতি কয়েকটি জেলায় কীর্ত্তন কিয়ৎপরিমাণে প্রচলিত আছে। কলিকাতাঞ্চলে কীর্ত্তন একেবারে নাই, ঢপের গীতকে তথায় কীর্ত্তন বলে। তাহাদের অনেকে ঢপ শুনিয়া কীর্ত্তনের প্রতি দেশ প্রকাশ করেন। ……… ইত্যাদি।

লেখক প্রবন্ধটির পাদদেশে কয়েকটি অপ্রচলিত শব্দের অর্থও লিপিবদ্ধ করেছেন। যেমন : দিঠি-দৃষ্টি, বিহি-বিধি, গেহা-গৃহ, লোর-চক্ষের জল প্রভৃতি।

দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতেই সম্পাদক ‘ভ্রমের আত্মকথা’ শিরোনামে পত্রিকা সম্বন্ধে লিখেছেন –

“ ভ্রমরের বয়ঃক্রম এক বৎসর পরিপূর্ণ হইল। এই অল্পকাল মধ্যে ভ্রমর যেরূপ আদরিত হইয়াছে তাহা আমরা প্রত্যাশা করি নাই। ভ্রমর অতি নম্রভাবে জন্মগ্রহণ করিয়াছিল; জন্মবার্ত্তা কোন সংবাদ পত্রে পাঠান হয় নাই, কুলা বাজাইতে কাহাকেও ডাকা হয় নাই; অথচ বাঙ্গালার পদ্মমাত্রেই ভ্রমরের বার্ত্তা পাইয়াছেন। এক্ষণে যেখানে পদ্ম সেই খানেই ভ্রমর। যে গৃহে ভ্রমর যায় না আমরা শুনিয়াছি যে গৃহে পদ্ম নাই কেবল শিমুল শর্ম্মারা বাস করেন।
অল্পকালমধ্যে ভ্রমর চট্টগ্রাম হইতে কাশ্মীর পর্য্যন্ত ভ্রমণ করিতে সক্ষম হইয়াছে, ইহাতেই বোধ হইবে ভ্রমর নিতান্ত দুর্ব্বল নহে।
ভ্রমরের গ্রাহক অনেক বাড়িয়াছে, নিত্য বাড়িতেছে; কিন্তু ভ্রমরের কলেবর বাড়িল না কেন, এই কথা জনৈক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। আমরা প্রত্যুত্তরে বলি, বয়স বাড়িলে কলেবর বাড়িবে।
অনেক সূক্ষ্মদর্শী বলিয়াছেন যে, ভ্রমর দুই একটি বড় কথা ছোট করিয়া বলিতে পারিয়াছে কিন্তু এ পর্য্যন্ত কোন ছোট কথা বড় করিয়া বলিতে পারে নাই। একথা যদি সত্য হয় তাহা হইলেন ভ্রমর বিশেষ আহ্লাদিত; ছোট কথা বড় করা আমাদের আধুনিক প্রথা – অপ্রতুলতার ফল। শূণ্য পাত্রের শব্দ অধিক।
ভ্রমরের ত্রুটি অনেক। কিন্তু সে সকল ত্রুটি সত্ত্বেও যদি ভ্রমর কখন এক মুহুর্ত্তের নিমিত্ত পাঠকদিগকে সুখী করিতে পারিয়া থাকে, তাহা হইলে ভ্রমর আপনাকে কৃতার্থ বিবেচনা করিবে; পাঠকদিগের সুখসাধন করা ভ্রমরের আর একটি অভিলাষ। পুরাকালিক পুরোহিতের ন্যায় ভ্রমর গ্রাহকদিগের হিতসাধনের ব্রত গ্রহণ করিয়াছে। হিতসাধন করিতে না পারে হিতাকাঙ্ক্ষী চিরকাল থাকিবে।”

স্পষ্টতই ১২৮২ সালের বৈশাখ মাসেও পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য যে সফল সে সম্বন্ধে সম্পাদক নিশ্চিত হয়েছেন। গ্রাহক সংখ্যা যে বেড়ে চলেছে সেটাও তিনি জানিয়েছেন। পত্রিকাটি যে উৎকৃষ্ট হয়েছে সেটা বঙ্কিমচন্দ্রের মন্তব্য থেকেও পরিস্কার। উপরের আলোচনাটি থেকে বোঝার উপায় নেই যে পত্রিকার প্রকাশ আর দু’মাস পড়েই বন্ধ হয়ে যাবে। কার্যত সেটাই হয়েছে, আষাঢ় মাসের পর ‘ভ্রমর’ আর বেরোয় নি। অথচ সংগৃহীত তথ্য থেকে জানা গেছে যে –

“ ১২৮৫ সালের ভাদ্র মাসে ‘ভ্রমরে’র “নতুন পর্য্যায় ১ম খন্ড ১ম সংখ্যা” ও পরবর্ত্তী আশ্বিন মাসে ২য়া সংখ্যা বাহির হইয়াছিল।”

পত্রিকাটি উঠেই বা গেল কেন বা আবার দু’টি সংখ্যা নতুন করে বেরোলো কেন সে উত্তর জানা নেই। কারো কাছে তথ্য থাকলে জানাতে পারেন।

উদ্ধৃত অংশে মূল বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।





চিত্র ১ : পত্রিকার একটি আখ্যাপত্র।

লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।