পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
অগাস্ট ১৫, ২০১৫
জ্ঞানাঙ্কুর
দীপক সেনগুপ্ত
মাসিক পত্রিকা ‘জ্ঞানাঙ্কুর’-এর প্রকাশ শুরু হয় ১৮৭২ সালে (আশ্বিন,১২৭৯ ) শ্রীকৃষ্ণ দাসের সম্পাদনায়। প্রথম দুটি সংখ্যা বোয়ালিয়া,রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হলেও পরে কোলকাতায় চলে আসে। পত্রিকাটিতে সাহিত্য,দর্শন,ভারতের ইতিহাস,বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে লেখা প্রকাশিত হত; কবিতা এবং উপন্যাসও থাকত। সমসাময়িক অন্যান্য অনেক পত্রিকার মত মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলা ছিল পত্রিকাটির একটি মুখ্য উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথের রচনাতেও পত্রিকাটির উল্লেখ পাওয়া যায় –
“এমন সময় জ্ঞানাঙ্কুর নমে কাগজ বাহির হইল। কাগজের নামের উপযুক্ত একটি অঙ্কুরোদ্গত কবিও কাগজের কর্তৃপক্ষেরা সংগ্রহ করিলেন। আমার সমস্ত পদ্যপ্রলাপ নির্বিচারে তাঁহারা বাহির করতে শুরু করিয়াছিলেন। ...... প্রথমে যে গদ্যপ্রবন্ধ লিখি তাহাও এই জ্ঞানাঙ্কুরেই বাহির হয়। তাহা গ্রন্থসমালোচনা। ....... আমি তখন ভুবনমোহিনীপ্রতিভা,দুঃখসঙ্গিনী ও অবসরসরোজিনী বই তিনখানি অবলম্বন করিয়া জ্ঞানাঙ্কুরে এক সমালোচনা লিখিলাম। খুব ঘটা করিয়া লিখিয়াছিলাম। খণ্ডকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, গীতিকাব্যেরই বা লক্ষণ কী, তাহা অপূর্ব্ব বিচক্ষণতার সহিত আলোচনা করিয়াছিলাম।”
পত্রিকাটির প্রথম বছরে তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘স্বর্ণলতা’ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়ের রম্য রচনা ‘মসলা-বাঁধা কাগজ’ এই পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রকাশনার তৃতীয় বছরে (১২৮২ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাসে ) রামসর্বস্ব বিদ্যাভূষণ সম্পাদিত একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ‘প্রতিবিম্ব’-র সঙ্গে মিশে গিয়ে ‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ নামে পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে থাকে। অগ্রহায়ণ ১২৮২ (৪র্থ খণ্ড ১ম সংখ্যা ) সংখ্যায় প্রথমেই শ্রীযোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব কার্য্যাধ্যক্ষ একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জানিয়েছেন :
“বিবিধ কারণ বশত জ্ঞানাঙ্কুর এতদিন বন্ধ ছিল,এক্ষণে ইহার কার্য্যভার হস্তান্তরিত হইল। আর ইহার প্রচার বিষয়ে গ্রাহকগণ সন্দেহ করিবেন না। ইহার সমুদায় বন্দোবস্ত নূতন হইল। যদিও ইহার অন্যান্য বন্দোবস্ত পরিবর্তিত হিল,তথাপি ইহার নিয়মগুলি পূর্ব্বের ন্যায়ই রহিল,আমরা তাহার কোন পরিবর্ত্তন করিলাম না।
“ জ্ঞানাঙ্কুরের সহিত প্রতিবিম্ব মিলিত হইল। কোন বঙ্গীয় মাসিকপত্র সম্বন্ধে প্রতিবিম্বে যে কথঞ্চিৎ বিদ্বেষভাব অঙ্কুরিত হইয়াছিল তাহার আর লেশমাত্র থাকিবে না।” পত্রিকার মূল্য ধার্য হয়েছিল বার্ষিক অগ্রিম তিন টাকা,ষান্মাষিক এক টাকা বার আনা এবং প্রতিখণ্ড ছ’আনা। মফঃসল গ্রাহকদের অতিরিক্ত ছ’আনা ডাক মাশুল লাগবে বলে বিজ্ঞাপিত হয়েছে।
মাত্র চার বছর বঙ্কিমচন্দ্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলেও ‘বঙ্গদর্শন’ একটি উচ্চশ্রেণীর সাময়িক পত্র হিসাবে গণ্য হয়। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ সম্বন্ধে ‘বঙ্গদর্শন’-এর মতামত সে কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। ‘বঙ্গদর্শন’-এর সমালোচনা কি ছিল দেখা যাক। ১২৭৯ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় ‘বঙ্গদর্শন’ লিখেছে :
‘সাহিত্য দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস সম্বন্ধীয় মাসিক পত্র। রাজশাহী,বোয়ালিয়া । রাজশাহী প্রেস।
“ এই পত্রিকাখানির কলেবর দেখিয়া অনেকের ভক্তির অভাব জন্মিবে। মন্দ কাগজে,মন্দ ছাপা, দেখিয়া অশ্রদ্ধা হইবে, ভিতরে পড়িয়া সেই পরিমাণে ভক্তি ও সুখের উদয় হইবে। যদি অন্যান্য সংখ্যা প্রথম সংখ্যার মত হয়,তবে ইহা যে বাঙ্গালা পত্রের মধ্যে একখানি অত্যুৎকৃষ্ট পত্র হইবে, তদ্বিষয়ে কোন সংশয় নাই। দেখা যাইতেছে যে, লেখকেরা কৃতবিদ্য, চিন্তাশীল এবং লিপিপটু। ভরসা করি পত্রখানা স্থায়ী হইবে। অধ্যক্ষকে আমরা অনুরোধ করি যে,পত্রখানি কলিকাতায় ছাপাইবেন। সুন্দরীকে জীর্ণ মলিন বসনাবৃত দেখিলে যেরূপ কষ্ট হয়,জ্ঞানাঙ্কুর দেখিয়া আমাদের সেই রূপ কষ্ট হইয়াছে।
“ ইহার মধ্যে একটি প্রবন্ধ ইংরাজিতে লিখিত হইয়াছে। আমরা জিজ্ঞাসা করি,কেন? কান্ট দর্শন বাঙ্গালায় লেখা নিতান্ত কঠিন ইহা আমরা স্বীকার করি। কিন্তু আমরা বলি,যে আমরা বাঙ্গালী,বাঙ্গালীর জন্য লিখিতেছি। যদি বাঙ্গালায় কান্ট দর্শন বুঝাইয়া লিখিতে পারি,লিখিব,বাঙ্গালায় বুঝাইয়া লিখিতে না পারি,লিখিব না। এরূপ প্রবন্ধ যে ইংরাজিতে লিখিবার কোন প্রয়োজন নাই এমন আমরা বলি না। কিন্তু তেলা মাথায় তেল দেওয়া,এখন দুদিন থাক। যাহাদের রুক্ষ কেশ,তাহাদের জন্য আগে তেলের কুলান করিয়া উঠা যাউক।”
এই পত্রিকাতেই রবীন্দ্রনাথের কাব্যোপন্যাস ‘বনফুল’ ১২৮২ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাস থেকে ১২৮৩-র কার্তিক অবধি ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘প্রলাপ’ এবং প্রথম গদ্যরচনা ‘ভুবনমোহিনী প্রতিভা,অবসর সরোজিনী ও দুঃখসঙ্গিনী’ এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়। সমসাময়িক কালে প্রকাশিত গ্রন্থের সমালোচনা প্রকাশিত হত ‘প্রাপ্ত গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত সমালোচন’ শীর্ষক বিভাগে। ‘আত্মচিকিৎসা’ শীর্ষক বিভাগে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি জানানো হয়েছে। ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকায় লেখকের নাম না থাকলেও ‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’তে ছিল। এতে লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্র নাথ ঠাকুর, দামোদর মুখোপাধ্যায়, হরিমোহন মুখোপাধ্যায়, বীরেশ্বর পাঁড়ে, রাম দাস সেন, কালীবর বেদান্তবাগীশ, তারকনাথ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিরা। ‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’-এর মূল্য ছিল – বার্ষিক অগ্রিম তিন টাকা, ষান্মাসিক একটাকা বার আনা, প্রত্যেক খন্ড ছ’আনা। এ ছাড়া মফঃস্বলের গ্রাহকদের ছ’আনা করে অতিরিক্ত ডাকমাশুল দিতে হত। প্রকাশিত হত ৫৫নং কলেজ ষ্ট্রিট, ক্যানিং লাইব্রেরি থেকে। পত্রিকার কার্যাধ্যক্ষ ছিলেন যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ।
‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ ১২৮৩ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়ে অর্থাৎ এক বছর পরেই বন্ধ হয়ে যায়।
সংযুক্ত প্রতিলিপি :
চিত্র ১ : ১৮৭৪ সালের ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ পত্রিকার আখ্যাপত্রের প্রতিলিপি।
চিত্র ২ : ১২৭৯ বঙ্গাব্দের দ্বিভাষিক পত্রিকার আখ্যাপত্র। প্রসঙ্গতঃ ‘জ্ঞানাঙ্কুর’ ইংরাজিতেও অনূদিত হত।
চিত্র ৩ : ‘জ্ঞানাঙ্কুর ও প্রতিবিম্ব’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা।
বিঃ দ্রঃ কোন প্রতিলিপি বড় করে দেখতে হলে ctrl টিপে রেখে + টিপুন।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST, Shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।