পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
মার্চ ১, ২০১৭
মহিলা
দীপক সেনগুপ্ত
উনিশ শতকে স্ত্রী-শিক্ষার সূচনা হয় রাধাকান্ত দেব, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখ বিদ্যানুরাগী ও সমাজ সংস্কারকদের হাত ধরে। এ বিষয়ে অবশ্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল খ্রিস্টান মিশনারিরা। মেয়েদের প্রথম স্কুল স্থাপনের কৃতিত্ব যদিও রবার্ট মে নামে জনৈক মিশনারির, কিন্তু ১৮১৮ সালে তার মৃত্যুতে এই চেষ্টা তেমন ফলপ্রসূ হয় নি। কিছু সহৃদয় ও মুক্তমনা ইংরেজ মহিলা ও মিশনারিদের সাহায্য নিয়ে কলকাতা স্কুল সোসাইটির সম্পাদক রেভারেন্ড ডবল্যু এইচ পিয়ার্সের সভাপতিত্বে ১৮১৯ সালে গড়ে ওঠে ‘ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’। ১৮২৩-এ স্কুলের সংখ্যা দাঁড়ায় আট। কিন্তু এই সব স্কুলে অনেক বাঙালি তাদের মেয়েদের পাঠাতে চাইতেন না কারণ, এই স্কুলগুলির মুখ্য উদ্দেশ্যে ছিল শিক্ষাকে সামনে রেখে খ্রিষ্টধর্মের গুণ কীর্তন করা এবং সম্ভব হলে ধর্মান্তরে উৎসাহ দেওয়া। বাইবেল ছিল অবশ্য পাঠ্য এবং অনেক সময় প্রলোভন দেখিয়েও দরিদ্র বালিকাদের ভর্তি হতে উৎসাহিত করা হতো। এই সব কারণে যারা স্ত্রীশিক্ষা প্রচারে উৎসাহী ছিলেন এরকম হিন্দু প্রগতিবাদীরাও বিরূপ হয়ে ওঠেন। অপর পক্ষে ছিল রক্ষণশীল পন্থীদের মেয়েদের পড়াশোনার বিপক্ষে প্রচার চালানো এবং এ ধরণের যে কোনও প্রচেষ্টায় বাধা সৃষ্টি করা। রক্ষণশীলদের বক্তব্য ছিল মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে তারা নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন হয়ে উঠবে এবং পুরুষেরা তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাবে। এছাড়া নাটক নভেল পড়তে শিখে মেয়েদের মন বহির্মুখী হয়ে উঠবে ; পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার এই ছিল বিধান। সে সময়ে প্রকাশিত পত্র পত্রিকাও এ প্রসঙ্গে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। স্ত্রীশিক্ষা প্রসারের বিরুদ্ধে যে সব পত্রিকা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল তাদের মধ্যে ছিল ‘বেদব্যাস’, ‘পরিচারিকা’, ‘অনুসন্ধান’, ‘দৈনিক’ প্রভৃতি। ‘অবলাবান্ধব’, ‘সাধারণী’ ইত্যাদি পত্রিকা ছিল স্ত্রীশিক্ষার সমর্থক। দুটি বিপরীতমুখী স্রোতের আবর্তে পড়ে স্ত্রীশিক্ষার অগ্রগতি ক্রমাগত বাধাপ্রাপ্ত হয়। সভা সমিতিতে তর্ক বিতর্কের মাধ্যমে প্রত্যেক পক্ষই তাদের স্বমতে জোরালো প্রচার চালাতে থাকে। মদনমোহন তর্কালঙ্কার তার নিজের মেয়েদের স্কুলে পাঠানোয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন এবং প্রায় ন’বছর মদনমোহনকে সমাজচ্যুত অবস্থায় থাকতে হয়। অনেক সামাজিক অত্যাচারও তাকে সহ্য করতে হয়েছে। গোবিন্দচন্দ্র গুপ্ত তার মেয়ে ও ভাগ্নিকে স্কুলে পাঠানোয় মেয়ে দুটির বিয়ের ব্যাপারে সমস্যার সৃষ্টি হয়।
এই আবিল পরিস্থিতিতে ১৮৪৮ সালের এপ্রিল মাসে বড়লাটের আইন পরিষদের সদস্য হয়ে ভারতে আসেন ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। তার প্রচেষ্টায় ১৮৪৯ সালের মে মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় ক্যালকাটা ফিমেল স্কুল। বেথুন সাহেব ইংরেজ হওয়ায় সরকারী সাহায্য পেতে সুবিধা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার প্রচেষ্টায় পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা জুগিয়েছিলেন রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, গোবিন্দচন্দ্র গুপ্ত, প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ উদারমনা সমাজসচেতন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা। বেথুন ইংরেজ হলেও তার উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতই মহৎ। মেয়েরা শিক্ষিত না হলে সমজের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি সম্ভব নয় এই মানসিকতা নিয়েই বেথুন এগিয়েছিলেন, স্কুল খোলার পিছনে অন্যান্য মিশনারিদের মত খ্রিষ্টধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্য তার ছিল না। এর আগে অবশ্য ১৮৪৭ সালে কালীকৃষ্ণ মিত্র, প্যারীচাঁদ সরকার, নবীনকৃষ্ণ মিত্র প্রমুখ কতিপয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় বারাসাতে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু অবস্থানগত বা অন্য যে কোনও কারণেই হোক সেটি জনসাধারণের তেমন সমর্থন লাভ করে নি।
বলা চলে, বেথুনের হাত ধরেই বাংলায় স্ত্রীশিক্ষার প্রকৃত সূত্রপাত ঘটেছিল। এর পর ক্রমাগ্রগতির ইতিহাস দীর্ঘ। বিশদ আলোচনার ক্ষেত্র এটা নয়। তবে এর পরেই মহিলাদের শিক্ষা প্রসারের পথ অনেকটাই সুগম হয়ে ওঠে। রক্ষণশীল পন্থীরাও তাদের অনমনীয় মনোভাব অনেকটাই পরিত্যাগ করেন। এমন কি কিছু কিছু মুসলমান মহিলাও শিক্ষা লাভে উৎসাহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল স্ত্রীশিক্ষার বিরোধী। তাহেরণলেছা নামে জনৈকা মুসলমান ছাত্রী স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছিলেন এবং পড়াশোনা শিখে ১৮৬৪ সালের ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’য় মহিলাদের শিক্ষার সপক্ষে মত প্রকাশ করে একটি লেখা পাঠান। ‘বালারঞ্জন’ পত্রিকার সম্পাদক আবদুর রহিম স্ত্রীশিক্ষার সমর্থক ছিলেন। একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ১৮৮০ সালে ঢাকার ইডেন স্কুলের ১৫৩ জন ছাত্রীর মধ্যে মাত্র একজন ছিলেন মুসলমান। তবে বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও নারীদের শিক্ষা লাভের জন্য প্রচেষ্টা চলতেই থাকে এবং বাংলার মেয়েরা ধীরে ধীরে ছেলেদের সঙ্গে সমান তালে চলার ও শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের সমকক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টায় ব্রতী হন। শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে লেখক গোষ্ঠীও গড়ে ওঠে, পাঠক সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়, প্রকাশিত হতে থাকে নানা পত্র পত্রিকা। এর মধ্যে বেশ কিছু পত্রিকা মেয়েদের জ্ঞাতব্য বিষয় নিয়ে তাদের উপযোগী লেখা প্রকাশ করলেও সম্পাদকেরা ছিলেন সবাই পুরুষ। এ ধরণের পত্রিকার মধ্যে ছিল – ‘অবলাবান্ধব’ (পাক্ষিক, ১০ই জ্যৈষ্ঠ ১২৭৬, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়), ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’ (ভাদ্র ১২৭০, উমেশচন্দ্র দত্ত), ‘হেমলতা’ (কার্ত্তিক ১২৮০, মহেন্দ্রনাথ ঘোষ), ‘বিনোদিনী’ (বৈশাখ ১২৮২, ভুবনমোহিনী দেবী ছদ্মনামে নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়), ‘বঙ্গমহিলা’ (বৈশাখ ১২৯০, নগেন্দ্রনাথ ঘোষাল), ‘বালিকা’ (ভাদ্র ১২৯০, অক্ষয়কুমার গুপ্ত), ‘বঙ্গবালা’ (কার্ত্তিক ১২৯২, কালীচরণ বসু), ‘সাবিত্রী’ (মাঘ ১৩০৩, রামযাদব বাগচী) প্রভৃতি। এই পত্রিকাগুলি অধিকাংশই ছিল স্বল্পজীবী, পাঠকসংখ্যা ছিল খুবই কম। ১২৭৭ সালের বৈশাখ মাসে প্রথম মহিলা সম্পাদিত মাসিক পত্রিকা ‘বঙ্গমহিলা’ প্রকাশিত হবার পর একে একে মহিলা সম্পাদিত অনেক পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে। পরিস্থিতি অনুকূল হ’লে পরে এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।
বর্তমানে আমাদের আলোচ্য পত্রিকাটির নাম ‘মহিলা’। এটি উপরোক্ত পত্রিকাগুলির মতই মহিলাদের প্রয়োজনে তাদেরই উপযোগী শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে নানা রচনা প্রকাশ করেছে। ‘মহিলা’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩০২ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে। প্রথম সম্পাদক ছিলেন গিরিশচন্দ্র সেন। ইনিই ‘আদি কথামৃত’ গ্রন্থ প্রণেতা গিরিশচন্দ্র সেন কি না জানা নেই। পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত নববিধান ব্রাহ্মসমাজের পৃষ্ঠপোষকতায়। প্রথম প্রকাশের সময় লেখা হয় –“মহিলারা আপনাদের প্রাপ্য সম্মান যাতে লাভ করেন, তজ্জন্য কায়মনোবাক্যে পরিশ্রম করিতে কৃতসংকল্প হইয়া ‘মহিলা’ অদ্য কার্য্যক্ষেত্রে অবতরণ করিল। ...... মহিলাদের শিক্ষার জন্য স্থাপিত ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষাপ্রণালী ও শিক্ষার্থে প্রদত্ত বক্তৃতাগুলি উহাতে রীতিমত প্রকাশিত হইবে।” পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হয়েছে –“স্বদেশের সতী আর্য্যনারীদের উচ্চ জীবন ও সুনীতিকে আদর্শ করিয়া জাতীয়ভাবে নারীচরিত্র গঠন ও সংশোধন এবং সমুন্নত করিতে প্রথম হইতে মহিলা পরামর্শ দান ও যত্ন করিয়া আসিয়াছেন, চিরকাল এইরূপ যত্ন করিবেন তাঁহার এই সঙ্কল্প। বঙ্গীয় নারীমণ্ডলীতে যে সকল কুসংস্কার ও অনীতি এবং দূষিত আচার ব্যবহার বদ্ধমূল হইয়া আছে এবং বিজাতীয় অন্তঃসারশূন্য বিলাসাড়ম্বর প্রবেশ করিতেছে, চিরকাল মহিলা সে সকলের প্রতিবাদ করিবেন, ধর্ম্ম, সুনীতি ও সদাচারের এবং নারী প্রকৃতির অনুযায়িনী সৎশিক্ষায় সমর্থন করিবেন, মহিলার এই সঙ্কল্প ও উদ্দেশ্য।”
পত্রিকার প্রতি সংখ্যার প্রারম্ভিক পৃষ্ঠায় মূল রচনা শুরু হবার আগে দেবনাগরী অক্ষরে মুদ্রিত থাকত মনুর বিখ্যাত উক্তি –“যত্র নার্য্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ”। পত্রিকাটির প্রকাশ-বর্ষ উল্লেখ করতে প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় বর্ষ ইত্যাদি না লিখে লেখা হয়েছে প্রথম ভাগ দ্বিতীয় ভাগ ইত্যাদি। প্রতিটি সংখ্যা ছিল ২৪ পৃষ্ঠার, মূল্য ছিল ডাকমাশুল সহ অগ্রিম দু’টাকা মাত্র। পত্রিকাটিকে সচিত্র না বলাই শ্রেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছাপা হয়েছে ব্যক্তির মুখাবয়বের কিছু ছবি।
সেকালের রীতি মেনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রচয়িতাদের নাম নেই। প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই ‘মহিলাদের রচনা’ নামে একটি বিভাগ ছিল। এখানে বেশ কিছু লেখিকা তাদের লেখা পাঠাতেন। এতেই অনুমান করা যায় বাকি রচনাগুলি পুরুষদেরই লেখা। মহিলাদের লেখার কিছু নমুনা দেওয়া যেতে পারে। সমস্তিপুর থেকে ‘শ্রীমতী সুঃ -’ লিখেছেন ‘বসন্ত’ ও ‘বর্ষা’ নিয়ে কবিতা। কয়েকটি পঙক্তি –
“ শীত ঋতু হল শেষ, নিসর্গের নব বেশ,
শীত অবসানে হইল উদয়;
মনোহর শোভা চারু, নব পত্রে শোভে তরু,
কোকিলকাকলী মোহিছে হৃদয়। ......”
*****
“ বর্ষা ঋতু সমাগত, মেঘ রাশি ঘনীভূত,
বরষে শীতল বারি অজস্র ধারায়;
তপনতাপিত ধরা বর্ষাজলে হলে ভরা,
নদ নদী মাঠ ঘাট পূর্ণ হলো তায়। ......”
( ৩য় ভাগ ১১ সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩০৫, জুন ১৮৯৮ )।
বালবিধবাদের প্রতি সান্ত্বনা জানিয়ে ‘শ্রীমতী স-’ লিখেছেন -
“ কেন কেন হেন বিরস বদন,
ললাটে কেন রে বিষাদ রেখা,
নয়ন যুগল করে ছল ছল,
আপাঙ্গেতে অশ্রু দিতেছে দেখা।
*****
“ আহা! ভারতের প্রতি ঘরে ঘরে,
অজানা দুঃখিনী রমণী কত;
মলিন হৃদয়ে বিবাগ জীবনে,
যাপিছে জীবন তোমারি মত।
*****
“ তাই বলি বোন মানব জনম,
বৃথাই জনম বলো না আর,
নিরানন্দে সদা মগন হইয়ে,
করো না করো না হৃদয়ভার।
সব দুঃখ দূরে করিয়া ক্ষেপণ,
পরমেশ পদে পরাণ দাও,
বিশাল জগতে কর্ম্মক্ষেত্র মাঝে,
বিবেক সহায়ে চলিয়ে যাও। ......”
(বানান অপরিবর্তিত, ৩য় ভাগ ১২ সংখ্যা, আষাঢ় ১৩০৫, জুলাই ১৮৯৮)।
পনেরো কুড়ি বছর পরে প্রকাশিত সংখ্যাগুলিতে প্রকাশিত কবিতায় কিছু কিছু নাম মুদ্রিত হয়েছে। সেখানে কবিদের মধ্যে পাওয়া যায় ইন্দুপ্রভা দেবী, কিরণপ্রভা দে, নিরুপমা দেবী, কিরণময়ী সেন প্রভৃতি নাম। পুরুষ লেখকদের পাওয়া যায় ডা: সত্যেন্দ্রনাথ সেন, পুলকচন্দ্র সিংহ, গণেশপ্রসাদ, রজনীকান্ত গুহ প্রভৃতি নাম।
‘আশাকুটীর’ টাঙ্গাইল থেকে ভক্তিসুধা দেবী লিখেছেন ‘সৎ-সংসর্গ’ নামক রচনা। এটি প্রকাশিত হয়েছে ১৬শ ভাগ, ১ম সংখ্যায়, শ্রাবণ ১৩১৭, আগষ্ট ১৯১০-এ। কিছু অংশ –
“ ...... মানবমাত্রেই সংসর্গপ্রিয়, মনুষ্য কখনো একা থাকিতে পারে না। সৎ-সংসর্গের অশেষ গুণ, তেমনি কুসংসর্গ তাহার বিপরিত। সৎসংসর্গে দুষ্ট লোকও সাধু হয়। এবং কুসংসর্গে সাধুকেও দুশ্চরিত্র করে। ...... কোন দেশের একটি চিত্রকরের মনে একবার একটি সর্ব্বাপেক্ষা সুন্দর চিত্র অঙ্কিত করিবার ইচ্ছা হইলে তিনি অনেক ভ্রমণ করিয়া অবশেষে একটি পুষ্প সদৃশ কোমল শিশুকে দেখিতে পাইয়া তাহার চিত্র অঙ্কিত করিলেন। এবং কয়েক বৎসর পরে সেই চিত্রকরের মনে একটি অতি কুৎসিত চিত্র অঙ্কিত করিবার বাসনা হওয়াতে তিনি নানা স্থান পরিভ্রমণ করিয়া পরিশেষে এক কারাগারে কয়েদী বেশে অতি কুৎসিত আকার বিশিষ্ট একটি যুবককে দেখিতে পাইয়া তাহার চিত্র অঙ্কিত করিয়া উভয় চিত্রই তিনি তাঁহার শয়নাগারে ঝুলাইয়া রাখিয়া দেন; ক্রমে দেখিতে দেখিতে দুই চিত্রের মুখাবয়ব সদৃশ বলিয়া মনে হইল। অবশেষে তিনি অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন যে সে শিশুই এই কারাগারের যুবক, কুসংসর্গে পড়িয়া তাহার এই দুর্দ্দশা!!” .........
প্রায় প্রতিটি সংখ্যার শেষে ‘সংবাদ’ শিরোনামে পরিবেশিত হয়েছে বৈচিত্রময় নানা খবর। দেশের ছাড়াও বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সম্বন্ধেও পাঠককে অবহিত করা হয়েছে। এখানে কয়েকটি সংখ্যা থেকে সংবাদের কিছু কিছু অংশ তুলে দেওয়া হল -
“ বিগত ১০ই শ্রাবণ মহিলা কার্য্যালয়ে নবসংহিতানুসারে একটি অসবর্ণ বিধবা বিবাহ হইয়াছে। পাত্রীর নাম শ্রীমতী চারুবালা, ৯ বৎসর বয়সের সময় তাঁহার বিবাহ হইয়াছিল, ৬ মাস অন্তেই তিনি বিধবা হন। তিনি কলিকাতাস্থ সম্ভ্রান্ত বৈদ্যকুলোদ্ভবা জননীর একমাত্র কন্যা, ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী। হিন্দু পরিবারের দুঃখিনী বিধবা মাতা অনেক বিঘ্ন বাধা অতিক্রম করিয়া তাঁহাকে পাত্রস্থ করিয়াছেন। এখন তাঁহার বয়স ১৫ বৎসর। যশোহর জিলার অন্তর্গত ফুলবাড়িয়া গ্রামে বরের নিবাস, বর পিরালি বংশোদ্ভব। তাঁহার নাম জ্ঞানেন্দ্রনাথ হালদার।”
( ৩য় ভাগ ১ম সংখ্যা। শ্রাবণ ১৩২৪, আগষ্ট ১৮৯৭ )।
“ বম্বে ও পুনা নগর বিয়ুবিনিক নামক এক নূতন প্রকারের সাঙ্ঘাতিক সংক্রামক রোগে উৎসন্ন হইতে চলিয়াছে। নগরবাসিগণ গৃহ সম্পত্তি ও আত্মীয় বন্ধু পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে পলায়ন করিয়াছে ও করিতেছে। সহস্র সহস্র লোক উক্ত রোগে আক্রান্ত হইয়া বিষম যন্ত্রণায় কালগ্রাসে পতিত হইয়াছে। রোগীদিগের নিকট ভয়ে তাহাদের আত্মীয় স্বজনেরা পর্য্যন্ত যাইতে চাহে না। এ দিকে ইউরোপ হইতে কতিপয় সেবাব্রতপরায়ণা মহিলা দয়ার আবেগে প্রাণের মায়া পরিত্যাগপূর্ব্বক বম্বে ও পুনা নগরে উপস্থিত হইয়া উক্ত রোগাক্রান্ত রোগী দিগের সেবা শুশ্রূষায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন। পুনা নগরে কুমারী মর্গেণ এবং বম্বে নগরে কুমারী মেকডোনেল গল রোগীর শুশ্রূষা করিতে যাইয়া উক্ত রোগে আক্রান্ত হইয়া মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইয়াছেন। এই দুই পরসেবাব্রতধারিণী পুণ্যবতী নারীর পরলোক প্রাপ্তিতে মহারাণী ভিক্টোরিয়া দেবী দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন।”
( ৩য় ভাগ ৫ম সংখ্যা। অগ্রহায়ণ ১৩০৪, ডিসেম্বর ১৮৯৭ )।
“ বজবজনিবাসী হেমেদ্র খাড়া নামক এক যুবকের পত্নী পতির নিকট পূজার কাপড় ও অন্যান্য দ্রব্য প্রার্থনা করিয়াছিল, যুবক তাহা প্রদানে অসমর্থ হওয়ায় উভয়ের বচসা হয়। হেমেন্দ্র পত্নীর কটূক্তিতে ক্রোধান্ধ হইয়া উঠে, একটা গরাদে দ্বারা স্ত্রীর মস্তকে সবলে আঘাত করে, তাহাতে তাহার পূজার কাপড় পরিবার সাধ চিরদিনের জন্য মিটিয়া গিয়াছে, স্বামীর নিষ্ঠুর আঘাতে তৎক্ষণাৎ তাহার মৃত্যু হইয়াছে। হেমেন্দ্র বিচারাধীন আছে।”
( ১০ম ভাগ ৫ম সংখ্যা। অগ্রহায়ণ ১৩১১, ডিসেম্বর ১৯০৪ )।
“ রুস ও জাপানের ভীষণ যুদ্ধের বিবরণ মহিলার পাঠিকাগণ সকলেই অবগত হইয়া থাকিবেন। ছয় মাসেরও অধিক কাল ব্যাপিয়া এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে উভয় পক্ষের লক্ষাধিক সৈন্য হতাহত হইয়াছে। এই প্রকার দীর্ঘকালব্যাপী ভয়ানক সংগ্রাম কখনও হইয়াছে শুনা যায় না। পৃথিবীর মধ্যে রুস সম্রাটের মহাপ্রতাপ, তাঁহার ন্যায় প্রবল সৈন্যবল কোন সম্রাটের নাই। সকলেই রুসকে ভয় করিয়াছে। স্বেচ্ছাচারী পররাজ্যলোলুপ গর্ব্বিত রুস বিধাতার কৌশলে আজ ক্ষুদ্র জাপানের দ্বারা লাঞ্ছিত ও পরাজিত।”
( ১০ম ভাগ ৫ম সংখ্যা। মাঘ ১৩১১, ফেব্রুয়ারি ১৯০৫ )।
যুদ্ধের খবর, ফলাফল ও তার প্রভাব ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ শিরোনামে পরের দিকের সংখ্যায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে।
“ শ্রীমান যতীন্দ্রনাথ সেন নামে একজন যুবক বরিশালের কুলকাটি নামক গ্রামের বাবু চণ্ডীচরণ রায় চৌধুরীর কন্যাকে বিবাহ করিতে আসিয়াছিল। এই বিবাহার্থী যুবক বিবাহের অব্যবহিত পূর্ব্বে তাহার আত্মীয় কর্ত্তৃপক্ষকে জানাইল যে, তাঁহারা কন্যাপক্ষ হইতে যৌতুকাদিব্যপদেশে যে টাকা লইয়াছেন, তাহা কন্যাপক্ষকে ফিরাইয়া না দিলে সে কিছুতেই বিবাহ করিবে না। বাধ্য হইয়া বরকর্ত্তা সমস্ত টাকা প্রত্যর্পণ করিলেন। এই যুবকের নির্লোভ সৎসাহসকে আমরা প্রশংসা করি। যুবকগণ বৃথা বক্তৃতা ও হুজুগ না করিয়া এইরূপ নিঃস্বার্থ দেশহিতৈষণার কার্য্যে ব্রতী হইলে সমাজের কত কুপ্রথা কলঙ্ক দূর হইতে পারে।”
( ১৫শ ভাগ ২য় সংখ্যা। ভাদ্র ১৩১৬, সেপ্টেম্বর ১৯০৯ )।
পত্রিকায় ‘কুসুমহার’ নামে একটি বিভাগ প্রথম দিকে প্রকাশিত হতো। এখানে মহিলাদের জ্ঞাতব্য নানা বিষয় ও উপদেশাবলী মুদ্রিত হয়েছে। একটি উদাহরণ-
“ ললনে! তুমি কি জন্য লেখাপড়া শিক্ষা করিয়া থাক ? যদি কুৎসিত কাব্য নাটকাদি পড়িয়া আমোদ করিয়া সময় কাটান উদ্দেশ্য হয় তাহা হইলে এরূপ লেখাপড়া শিক্ষা না করা – বর্ণজ্ঞানহীন মূর্খ হইয়া থাকা তোমার পক্ষে শ্রেয়ঃ। ...... তোমার বিদ্যা শিক্ষা তোমার বিভিন্ন মনোবৃত্তি ও আধ্যাত্মিক প্রকৃতি সকলের উন্মেষসাধন জন্য হউক, এবং ভগবানের অচিন্ত্যমহিমার পরিচয় পাইবার জন্য হউক।” ......
এই বিভাগটি পরে আর দেখা যায় নি, পরিবর্তে ‘স্ত্রীনীতিসার’ নামে একটি বিভাগ একই উদ্দেশ্য নিয়ে সংযুক্ত হয়েছে। এখানেও নানা সদুপোদেশ মহিলাদের উদ্দেশ্যে বর্ষিত হয়েছে। যেমন –
“ ক্ষমা, প্রীতি, সহিষ্ণুতা দেবভাব। এই সকল দেবগুণ পতিব্রতার জীবনের অলঙ্কার। তিনি অন্তরের কোমলতা ও স্বর্গীয় উচ্চ প্রীতি ও নীতি দ্বারা চালিত হইয়া অসাধু অজিতেন্দ্রিয় পতিকে স্বর্গাভিমুখে আকর্ষণ করেন, তাঁহার হৃদয়ে পবিত্র প্রীতি ও সাধু ভাবের সঞ্চার করিয়া থাকেন। পতিব্রতা পতির পরিত্রাণের উপায় হন। সতী পতিব্রতা ভূলোকে দেবীরূপে প্রতিভাত হইয়া থাকেন। ......”
এই বিভাগটিরও পরে আর দেখা মেলে নি।
‘মহিলা’তে ২য় ও ৩য় ভাগে ‘ক্রোড়পত্রে’ প্রকাশিত হয়েছে ‘স্বর্গগতা দেবী অঘোরকামিনীর পত্রাবলী’। এই সাধ্বী পরহিতব্রতী মহিলার জীবনী ও তার চিঠিপত্র পাঠে মহিলা পাঠকদের অশেষ উপকার হবে মনে করেই সম্পাদক মহাশয় ধারাবাহিকভাবে এই রচনা প্রকাশ করেছেন। অঘোরকামিনীর জীবনী প্রকাশিত হয়েছে ১ম ভাগের ১২শ সংখ্যায়। বর্তমান পাঠকদের কাছে তার তেমন পরিচিতি নেই বলে দু’চার কথায় সেটা তুলে ধরছি। অঘোরকামিনীর জন্ম উত্তর-পূর্ববঙ্গের টাকী গ্রামের একটি কায়স্থ পরিবারে ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের মে-জুন মাসে। ছোটবেলায় তার লেখাপড়া তেমন হয় নি। তার বিয়ে হয় টাকীনিবাসী প্রকাশচন্দ্র রায়ের সঙ্গে। বিয়ের পরেই তার স্বামী অঘোরকামিনীর পড়াশোনা, জ্ঞানার্জন ও ধর্মশিক্ষার জন্য সচেষ্ট হন। ২৯ বছর বয়সে অঘোরকামিনীর ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা হয়। একদা প্রবল ঝড়ে বঙ্গদেশের বহু সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তিনি তাদের সাহায্যার্থে নিজের সোনার কবচ ও অলঙ্কারাদি বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি স্বামীর কর্মক্ষেত্র বিহারে চলে যান। বর্তমান যুগে তার বড় পরিচয় তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের রূপকার অকৃতদার মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের জননী। অঘোরকামিনীর ছয় সন্তানের মধ্যে বিধানচন্দ্র ছিলেন সর্বকণিষ্ঠ। অঘোরকামিনীর ডাক নাম ছিল ‘ঘোরী’। ‘মহিলা’ পত্রিকায় তার প্রকাশিত চিঠিপত্রে এই নামই ব্যবহৃত হয়েছে। ১৮৯৬ সালের ১৫ই জুন তার মৃত্যুর পর স্বামী প্রকাশচন্দ্র সম্ভবতঃ নিজের খরচায় ‘অঘোর-প্রকাশ’ নামে একটি পুস্তক বের করেন। এটি এখন দুষ্প্রাপ্য।
৩য় ভাগ ৮ম সংখ্যায় (ফাল্গুন ১৩০৪, এপ্রেল ১৮৯৮) ‘আচার্য্যপত্নী জগন্মোহিনী দেবী’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে কেশবচন্দ্র সেনের সহধর্মিনীর মৃত্যু সংবাদ। কেশবচন্দ্র সেন প্রতিষ্ঠিত নববিধান ব্রাহ্মসমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মহিলা’ প্রকাশিত হতো বলে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে কালো বর্ডার লাইন দিয়ে শোক সংবাদটি মুদ্রিত হয়েছে। জগন্মোহিনী দেবীর মৃত্যু হয় ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ১৮ই ফাল্গুন মঙ্গলবার সকাল ৮টায়। দীর্ঘদিন তিনি বহুমূত্র রোগে কষ্ট পাচ্ছিলেন। অসাধারণ বাগ্মীতার জন্য জনসমাজে সুপরিচিত ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের আচার্য কেশবচন্দ্র সেন। মৃত্যুশয্যায় শায়িত তার পত্নীর শেষ সময়ের বেদনাবিধুর মুহূর্তের কটি ছবি মূর্ত হয়ে উঠেছে শোকসংবাদটিতে। অনেক তথ্যেরও সন্ধান পাওয়া যাবে এখানে। রচনাটি দীর্ঘ। সামান্য কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি -
“ সোমবার দিন রোগযাতনা বিশেষ বৃদ্ধি পায়। তাঁহার জ্যেষ্ঠা কন্যা কুচবিহারের মহারাণী [সুনীতি দেবী] জননীর পীড়াবৃদ্ধির সংবাদ পাইয়া কুচবিহার হইতে সেইদিন মধ্যাহ্নে উৎকন্ঠিতহৃদয়ে উপস্থিত হন। প্রিয়তমা কন্যাকে দেখিতে পাইয়া মাতার মনে কথঞ্চিৎ স্ফূর্তি হয়। তিনি মহারাণীকে আশীর্ব্বাদ করিয়া মহারাজা কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করেন, “মহারাজের কুশল, তিনি তোমাকে প্রনাম দিয়াছেন” মহারাণী মাতৃদেবীকে এরূপ জ্ঞাপন করেন। তাহার জননী নিঃশব্দে অশ্রুবর্ষণ করিতে থাকেন, ইহার পরে আর তাঁহার কথা কহিবার শক্তি হয় নাই। পূর্ব্ব দিন জ্যেষ্ঠপুত্র শ্রীমান করুণাচন্দ্রের নিকটে তিনি বিদায় গ্রহণ করেন। তৎসময়ে তাঁহাকে তিনি এরূপ বলিয়াছিলেন, “ডাক্তর দিগের বৃথা আশা, এবার আমি যাত্রা করিতেছি। আমি কন্যাদিগকে বিবাহ দিতে পারিলাম না, তুমি পাত্রস্থ করিবে। তোমার উপরে সমুদায় ভার রহিল।” ...... তাঁহার বৃদ্ধা জননী কন্যারত্ন হারাইয়া শোকে হাহাকার করিতেছেন। কন্যার শেষ অবস্থায় তিনি তাঁহার শয্যার পার্শ্বে ছিলেন। ......”
৯ম ভাগ ৬ষ্ঠ সংখ্যায় (পৌষ ১৩১০, জানুয়ারি ১৯০৩) ‘একটি বালিকার পদ্যরচনা’ শিরোনামে দুটি কবিতা প্রকাশ করা হয়েছে। প্রথমটি দশ বছর বয়সে ও দ্বিতীয়টি বার বছর বয়সে রচিত। লেখা হয়েছে
“......... স্নেহের বালিকাটির এখন চতুর্দ্দশ বৎসর বয়ঃক্রম, তিনি কলিকাতার লরেটে থাকিয়া বিদ্যাশিক্ষা করিতেছেন। দুই বৎসর যাবৎ তিনি কবিতা রচনা করেন না। তাঁহার দশ এগার বার বৎসর বয়সে রচিত কতকগুলি কবিতা একটি খাতায় লেখা ছিল। তাঁহার চঞ্চল প্রকৃতি কণিষ্ঠ ভ্রাতা পাইয়া সেই খাতা খানার অনেক দূর ছিঁড়িয়া ফেলে। পিতার হস্তে সেই ছিন্ন খাতা পতিত হয়। তিনি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের কবিতা পড়িয়া মুগ্ধ হন, এবং সযত্নে ছিন্ন পত্রগুলি জুড়িতে জুড়িতে আমাদের পড়িতে দেন। আমরা পড়িয়া বিস্ময়ে স্তম্ভিত হই। ...... ঈশ্বরপ্রদত্ত বিশেষ শক্তিসম্পন্ন স্বাভাবিক কবি ইহাকেই বলে। ......”
কবিতা দুটির প্রথমটির নাম ‘কে তুমি মহান’ ও দ্বিতীয়টির ‘মৃত্যু’। এখানে সামান্য কয়েকটি পংক্তি উদ্ধৃত –
>
“ কাহার আদেশে , সুনীল আকাশে
রবি করে আলো দান, বাঁচায় জীবের প্রাণ ?
কে তিনি মহান ?
কাহার আদেশে , কৌমদী হাসে,
চাঁদিমার সাথে , চাঁদিনীর রাতে,
কে তিনি মহান ? ......”
*****
কে বলে নিদয় তোরে, তুই রে মরণ,
মানবের মুকতির অনন্ত উপায়।
ভ্রান্ত নর বোঝে না তো তাইত তোমারে
বলে নিরদয় অতি পাষাণের প্রায় ।।
নাহি তোর দয়া মায়া, হৃদয় কঠিন,
মাতার অঞ্চল নিধি নিয়ে চুরি করে,
পালাস আপন পুরে ওরে রে নিদয়
শোক শেল বিঁধে তারে চিরদিন তরে ।। ......”
পত্রিকার সূচনাংশে ঘোষিত নীতি অনুযায়ী ভিক্টোরিয়া মহাবিদ্যালয়ের বার্ষিক অধিবেশনের কার্য বিবরণ ও অন্যান্য অনুসৃত নিয়মাবলী বিশদ ভাবে মুদ্রিত হয়েছে। এই সঙ্গে মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়েছে ধর্মবিষয়ক ঐতিহাসিক আলোচনা ও আনুষঙ্গিক জ্ঞাতব্য বিষয়। ৩য় ভাগে ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছে ‘রাজরাজেশ্বরী ভিক্টোরিয়ার জীবন’।
‘মহিলা’তে বেশ কিছু ‘ভ্রমণ বৃত্তান্ত’ও প্রকাশিত হয়েছে। রেঙ্গুনস্থ পুষ্পমালা দেবীর মালয় রাজ্যে ভ্রমণকথা ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছে। ত্রৈলোক্যনাথ দেবের জ্যেষ্ঠ পুত্র সত্যসুন্দর দেব উচ্চশিক্ষার্থে জাপানে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে প্রেরিত ‘জাপানবাসীর পত্র’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছে। সেইসঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছে স্বর্গগতা প্রমীলাদেবীর ইউরোপ ভ্রমণ সংক্রান্ত পত্রাবলী। এ ছাড়া একাধিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে গয়া, চাতরা, হাজারিবাগ, পালামউ-ডেল্টানগঞ্জ, কক্সবাজার, নোওয়াখালি, কুমিল্লা প্রভৃতি স্থানের ভ্রমণ বৃত্তান্ত। ‘মহিলার রচনা – কূপমন্ডূকের হিমালয় দর্শন’ (কার্ত্তিক ১৩১১) পড়তে ভাল লাগে।
মহিলাদের চরিত্র গঠনের সহায়ক মনে করে পত্রিকায় মৈত্রেয়ী, গার্গী, সাবিত্রী, মীরাবাঈ প্রভৃতি বেশ কিছু আদর্শ নারীর জীবনকথা পরিবেশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে আলোচিত হয়েছে কয়েকজন মহিলার কথা যারা স্বার্থ ত্যাগ করে সেবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পরহিতব্রতে কাজ করেছেন।
‘মহিলা’য় প্রকাশিত কিছু রচনার নাম উল্লেখ করলে হয় ত সামগ্রিক ভাবে পত্রিকাটির মূল্যায়নের সুবিধা হবে। আগেই বেশ কিছু লেখার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া উল্লেখ করা যায় – ‘ধার্ম্মিক দম্পতী, ‘স্ত্রী ও স্বামীর প্রসঙ্গ’, ‘বিহার প্রদেশস্থ নারীদিগের অবস্থা’, ‘বঙ্গনারী ও জলের ব্যবহার’, ‘বিবাহ’, ‘মহিলাদের অবরোধ প্রথা’, ‘বৈদিক সময়ের ইতিহাস’, ‘স্ত্রীজাতির অন্তঃপুরে আবদ্ধ থাকা সমুচিত নহে’, ‘বিধবা বিবাহ’, ‘সুখী পরিবার’, ‘যুদ্ধ ও মাতৃজাতি’, ‘য়ূরোপের ভীষণ যুদ্ধ’, ‘বন্যা ও দুর্ভিক্ষ’ ,’আদর্শ নারী’, ‘চিন্তা ও কার্য্য’, ‘ডাঃ জগদীশচন্দ্র বসু’, ‘সভ্যতা ও সততা’, ‘আত্মসংযম-বিজ্ঞান’, ‘সময়ের সদ্ব্যবহার’, ‘বর্ত্তমান যুগ ও এদেশীয় নারীজাতি’, ‘সঙ্গীত চর্চ্চা’ ইত্যাদি রচনার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত। স্বাভাবিক ভাবেই এ সময়ে প্রকাশিত পত্রিকায় যুদ্ধের খবর ও প্রাসঙ্গিক রচনা গুরুত্ব সহকারে পরিবেশিত হয়েছে।
সমসাময়িক পত্রিকাতে ‘মহিলা’ পত্রিকাটির সমালোচনাও চোখে পড়ে। ‘পুণ্য’ পত্রিকার ১৩০৫ পৌষ-মাঘ-সংখ্যায় ‘মহিলা’র বৈশাখ সংখ্যার আলোচনা –
“নামেই পাঠক বুঝিতে পারিতেছেন, এই মাসিকপত্রখানি মহিলাদের জন্য কল্পিত। ইহাতে স্ত্রীজাতির উপকারী ও আবশ্যক বিবিধ বিষয়ের অল্পবিস্তর আলোচনা থাকে। বর্ত্তমান সংখ্যায় “পূর্ব্ববঙ্গের স্ত্রী-আচার” প্রবন্ধটি সাধারণেরও তৃপ্তিবিধান করিবে। বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রদেশে সামাজিক অনুষ্ঠানের বিভিন্ন বিবিধ রূপ প্রচলিত আছে। সেই সমস্ত বিবরণ লিপিবদ্ধ হইলে, ‘মানব-তত্ত্ব-বিজ্ঞানের’ যথেষ্ট উপকারে আসিতে পারে।– বৈদেশিক বৈজ্ঞানিকগণের অনুগ্রহে আমরা সাইবীরিয়ার অধিবাসীদের দৈনিক জীবনযাত্রার সম্পূর্ণ বিবরণ অবগত হইতে পারি, কিন্তু আমাদের জন্মভূমি বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রদেশের সামাজিক অনুষ্ঠান ও আচার ব্যবহারের বিন্দুমাত্র বিবরণ জানিবার উপায় নাই। মফস্বলবাসী লেখকগণ এ বিষয়ে অবগত হইলে সুফললাভের আশা করা যায়। “শিশুর খাদ্যের পরিমাণ” প্রসূতিগণের অবশ্যজ্ঞাতব্য বিবিধ তথ্যে পরিপূর্ণ। গৃহলক্ষ্মীগণ এই সকল পরীক্ষাসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক নিয়ম পালন করিয়া চলিলে শিশুদের অকাল মৃত্যুর অনেক হ্রাস হইতে পারে।”
বর্তমান রচনার শুরুতে স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে উনিশ শতকের কিছু কথা লেখা হয়েছে। বিশ শতকের গোড়ায় ‘মহিলা’র ভাদ্র ১৩১৯ সংখ্যায় ‘দুইটি প্রশ্ন’ শিরোনামে জনৈকা মহিলা পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রচনার বিষয়ের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। আজ থেকে একশ’ বছরের কিছু বেশি আগে স্ত্রীশিক্ষা ও মহিলাদের রাস্তাঘাটে চলাফেরা সম্বন্ধে এক শ্রেণীর লোকের দৃষ্টিভঙ্গী কিরকম ছিল সেটা ভাবলে অবাক হতে হয়। রচনাটি থেকে কিছু কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি।
“ মহিলাতে পড়িলাম – এক জায়গায় কেহ লিখিতেছেন “বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কেবল প্রয়োজন নয়, তাহা নহে, কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে একান্ত যত্ন চেষ্টা করা অনিষ্ট কর ও পাশ হওয়াও অশান্তিকর।” এই নিবন্ধটির উত্তরে লেখিকা মতামত জানিয়েছেন – “ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যা যে শিক্ষালাভের সর্ব্বোৎকৃষ্ট প্রণালী তাহা আমাদের আলোচনার বিষয় নহে, কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কোন প্রয়োজন নাই কিম্বা পাশ হওয়া অশান্তিকর এ কথায় তো অন্ততঃ আমার মন সায় দেয় না। ...... পরীক্ষার ভিতর দিয়া য কত শিক্ষা আসে তাহা কি যাঁহারা পরীক্ষা দিয়াছেন তাঁহারা অস্বীকার করিবেন ? ...... জীবনেও তো এমন অনেক ঘটনা হয় যার উপকারিতা কিছুই বুঝিতে পারা যায় না। জীবনে কিছুই বৃথা যায় না। অঙ্কশাস্ত্র যাহা মেয়েদের কোনই দরকার মনে হয় না, তাহাও চঞ্চল মনকে স্থির করিবার, চিন্তা শক্তি বাড়াইবার এক ভাল উপায়। (অবশ্য কাহারও কাহারও চিন্তাশক্তি না বাড়িয়া বরং নাম শুনিলেই চিন্তাশক্তি লুপ্ত হইয়া যায়)।”
মেয়েদের বাইরে বেরনোর বিষয়ে বলা হয়েছে –
“ যদি আজ বেড়িয়ে কাল আবার যাইতে চাই, তাহা হইলে শুনিতে হইবে ‘মেয়েছেলের আবার রোজ বেড়ান কি ?’ এই অবরোধ প্রথা যে কি অনিষ্ট করিতেছে তাহা লোকে কলিকাতায় আসিলে বেশ বুঝিতে পারে। ...... আমাদের দিনে রাতে বেড়াইতে দেওয়া হউক তাহাও বলি না, কেন না কলিকাতার ট্রাম গাড়ীতে ধাক্কা খাইয়া লোকের ঠেলাঠেলির ভেতর দিয়া হাঁটিয়া যাওয়া বড় সুখকর নয় ; কিন্তু দরকারী কাজের সময় যেমন বাড়ীর অল্পদূর হইলে হাঁটিয়া স্কুলে যাওয়া কিম্বা প্রতিবেশিনীদের অসুস্থ ইত্যাদি হইলে দেখিতে যাওয়া, কি মন্দিরে যাওয়া – প্রথমে এই সব সময়ে অবরোধ প্রথা উঠাইবার চেষ্টা করা খুব উচিত। ...... মেয়েরা যাঁহারা বাহির যাইবেন, তাঁহাদের মনে রাখা উচিত যে রাস্তায় হাঁটিতে হইলে সপ্রতিভ ও স্বাভাবিক ভাবে চলা উচিত, কাপড়ের গাঁটরীর মত জড়সড় হইয়া চলিলে, যিনি সঙ্গে লইয়া যান তাঁহারও বিষম বিপদ হয়। ......মেয়েদের রাত্রে হাঁটা কিছু কিছু আরম্ভ হইয়াছে, দিনে দরকার হইলে হাঁটিতে লজ্জা কিসের ? কিছু দোষ করছি না তো যে লুকিয়ে করিব।”
‘রমণীর দায়িত্ব ও শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা’ নামক একটি মূল্যবান প্রবন্ধ ভাদ্র ১৩২২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
১৩১৭ বঙ্গাব্দের ৩০ শে শ্রাবণ ঢাকায় সম্পাদক গিরিশচন্দ্র সেনের মৃত্যু হলে ব্রজগোপাল নিয়োগী সম্পাদক নিযুক্ত হন। তিনি সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন পত্রিকার মান অক্ষুণ্ণ রাখতে। কিন্ত বাধা সৃষ্টি করেছে অনাদায়ী গ্রাহক মূল্য। গ্রাহকেরা মূল্য পরিশোধ না করার কারণেই কত পত্রিকা যে বিলুপ্ত হয়েছে তার হিসাব নেই। ‘মহিলা’র ক্ষেত্রেও প্রথম প্রকাশের বছর তিনেক পর থেকেই ক্রমাগত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হয়েছে গ্রাহক মূল্য মিটিয়ে দেবার জন। আবেদনের সঙ্গে মাঝে মাঝে রূঢ় ভাবেও বাকি মূল্য পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তেমন কোন ফল হয়েছে বলে মনে হয় না কারণ, এ ধরণের বিজ্ঞপ্তি ক্রমাগতই প্রকাশিত হয়েছে। ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠাতেই নতুন সম্পাদক আবেদন জানিয়েছেন –
“ ...... যাঁহাদের নিকট ‘মহিলা’ প্রেরিত হয়, তাঁহারা কৃপা করিয়া ইহার মূল্য যথাসময়ে পাঠাইলে একান্ত অনুগৃহীত হইব। যাঁহারা এ কৃপা প্রদর্শন করিতে একান্ত অনিচ্ছুক, তাঁহারা অনুগ্রহ করিয়া পত্রিকাখানি ফেরত দিবেন; আমাদিগকে যেন আর ক্ষতিগ্রস্ত হইতে না হয়।”
এ সত্বেও পত্রিকাখানি যে সচল ছিল তার কারণ, পত্রিকার পিছনে ছিল নববিধান ব্রাহ্মসমাজের প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন। গ্রাহকদের পত্রিকার মূল্য পরিশোধ ও বাকি রাখা বিষয়ে একটি দীর্ঘ লেখা প্রকাশিত হয়েছে শ্রাবণ ১৩১০ সংখ্যায় ‘বিভিন্ন শ্রেণীর গ্রাহক গ্রাহিকা’ নামক নিবন্ধে।
‘মহিলা’ পুরুষ পরিচালিত ও সম্পাদিত হলেও মহিলাদের উপযোগী রচনা প্রকাশের মাধ্যমে পত্রিকাটিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে এবং আদর্শ নারী চরিত্র গঠন করার প্রচেষ্টায় উদ্যম ও আন্তরিকতার কোনো ত্রুটি ছিল না। পত্রিকাটি দীর্ঘস্থায়ী ছিল বলা হয়েছে কিন্তু শেষ সংখ্যাটি কবে বেরিয়েছে সেটা জানতে পারিনি, তবে পত্রিকাটি সম্ভবত একুশ বছর স্থায়ী হয়েছিল।
সংযোজিত প্রতিলিপি
চিত্র – ১ : পত্রিকার একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র।
চিত্র – ২ : পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।