মানসী, মর্ম্মবাণী, মানসী ও মর্ম্মবাণী
দীপক সেনগুপ্ত
মানসী
কলকাতায় সেকালের নাম করা ফটোগ্রাফির দোকান ছিল ৪নং চৌরঙ্গী লেনস্থ হপসিং কোম্পানি। এরই অফিসে সাহিত্য-আড্ডা জমত, উদ্যোক্তা ছিলেন বিশিষ্ট ছোট গল্প লেখক ও ঔপন্যাসিক ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অনেক উৎসাহী তরুণ সাহিত্যসেবী এই আড্ডায় এসে যোগ দিত। এখান থেকেই শুরু হয় একটি নতুন পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা। রবীন্দ্রনাথের উপদেশ নিতে গেলে তিনি পত্রিকা প্রকাশের মত দুরূহ বিষয় নিয়ে এগোবার আগে আরও ভেবে দেখতে বললেন। তবে উৎসাহী আয়োজকেরা হতোদ্যম না হয়ে পত্রিকা প্রকাশে অনড় থাকে - প্রকাশিত হয় 'মানসী'। অবশ্য প্রকাশের পর রবীন্দ্রনাথ তার লেখা দিয়ে উদ্যোক্তাদের যথেষ্ট সাহায্য ও উৎসাহিত করেছেন।
'মানাসী'র প্রথম সংখ্যা বেরোয় ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। প্রথম সংখ্যার শুরুতেই ‘মানসী সম্পাদকীয় বিভাগ’-এ লেখা হয়েছে – “ইহার সম্পাদনভার কোন একজন বিশিষ্ট সম্পাদকের উপর নির্ভর করা হয় নাই। ইহা মাননীয় সভ্যগণের অনুমত্যানুসারে চারি জন বিশিষ্ট সভ্যগণের উপর ন্যস্ত করা হইয়াছে ...” এরপর সভ্যদের নাম দেওয়া হয়েছে - ইন্দুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। দ্বিতীয় সংখ্যায় জ্ঞানেন্দ্রনাথের পরিবর্তে শিবরতন মিত্রের নাম পাওয়া যায়। এর পরেও বদল ঘটেছে, পত্রিকা প্রকাশের কিছুকাল পর শিবরতন মিত্র ব্যক্তিগত কারণে ওই পদ ছেড়ে দিলে তার স্থলাভিষিক্ত হ’ন যতীন্দ্রমোহন বাগচী।” কর্মাধ্যক্ষ ছিলেন হপসিং কোম্পানির ম্যানেজার সুবোধচন্দ্র দত্ত।
প্রথম সংখ্যা 'মানসী' শুরু হয়েছে মুনীন্দ্রনাথ ঘোষের 'বন্দনা' কবিতা দিয়ে। অন্যান্য লেখক এবং রচনার নাম ছিল - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ('সূচনা'); সম্পাদক ('সঙ্কল্প'); অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় ('লক্ষ্মণ সেনের পলায়ন-কলঙ্ক'); শশীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ('জাতিভেদ ও নবীনচন্দ্র'); দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ('রমণীর মুখ' - কবিতা); ইন্দুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় ('কবিত্বের প্রসার'); দেবকুমার রায়চৌধুরী ('প্রার্থনা' - কবিতা); সুবোধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (‘ভাষা ও ব্যাকরণ'); জলধর সেন (‘চিতার আগুন’ - গল্প); ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ('এটোয়ায় পৃথ্বিরাজের দুর্গ’); (যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় (‘পাশ্চাত্য সভ্যতার আওতা’); হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ ('নবীনচন্দ্র ও জাতীয়ভাব')। প্রথম সংখ্যাটি ছিল ৪৮ পৃষ্ঠার। তবে পত্রিকার কলেবর পরে বৃদ্ধি পেয়েছে, ১৩২০ ফাল্গুন সংখ্যাটির পৃষ্ঠা-সংখ্যা ছিল ১৬০।
রবীন্দ্রনাথের আশীর্বচন সহ ‘সূচনা’ অংশের কিছুটা – “...... এই উপলক্ষে পত্রিকার উদ্দেশ্য ও পরিচালন সম্বন্ধ কিছু উপদেশ দিব এমন প্রত্যাশা কেহ কেহ করেন। উপদেশ দেবার মত এত বাহুল্য কাজ জগতে আর কিছুই নাই। উপদেশের সব কথাই পুরাণো হইয়া গেছে। একথা বলা সহজ যে কাগজখানিকে এমন করিয়া চালানো উচিত, যাহাতে বঙ্গ-সাহিত্যের পুষ্টি ও বঙ্গ-দেশের কল্যাণ সাধিত হইতে পারে। কেমন করিয়া তাহা হইতে পারে ইহাই যাঁহারা প্রমাণ করিবার জন্য উদ্যোগী হইয়াছেন, তাঁহারা এই উপদেশটুকুর জন্য অপেক্ষা করিয়া নাই এবং পাঠকগণও আমার দায়িত্ব-বিহীন কথামাত্রের উপর নির্ভর করিয়া কিছুমাত্র আশ্বাস লাভ করিবেন না।
“ তবে আমার কাজটুকু কেবল এই যে, “মানসী” যখন মানস-তপোবন হইতে যাত্রা করিয়া পাঠক-সাধারণের রাজ-প্রাসাদ-অভিমুখে শঙ্কিত-চরণে চলিয়াছে তখন তাহাকে এই বলিয়া আশীর্ব্বাদ করা :-
প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত কবিতা ‘রমণীর মুখ’ যারা পড়েন নি তাদের জন্য সম্পূর্ণ কবিতাটি এখানে উধৃত হ’ল –
পত্রিকা প্রকাশিত হলেও নিজস্ব ছাপাখানা না থাকায় বিভিন্ন প্রেস থেকে পত্রিকা ছাপা হতে থাকে। প্রথম দুটি সংখ্যা ছাপা হয় হাওড়ায় খুরুট রোডে কর্ম্মযোগ প্রিন্টিং ওয়ার্কস থেকে; তৃতীয় সংখ্যার কাজ হয় ৭৭নং পটলডাঙ্গা স্ট্রীটস্থ জয়ন্তী প্রেসে; পরের সংখ্যার জন্যই আবার দ্বারস্থ হতে হয় করায়বাজারের সান্টো প্রেসে ও নারকেল বাগানের লক্ষ্মীবিলাস প্রিন্টিং-এ। এতবার ছাপাখানা পরিবর্তনের জন্য ছাপার মান বিভিন্ন রকমের হয়েছে, পত্রিকার প্রকাশের সময়ও ঠিকমত ধরে রাখা যায় নি। এজন্য কর্তৃপক্ষ জানিযেছেন -"প্রেসের অভাবে আমরা শত প্রতিশ্রুতিভঙ্গে কলঙ্কিত হইয়াছি সত্য, কিন্তু ভবিষ্যতে যাহাতে এ প্রকার অন্যায়, ত্রুটি পুনরায় না হয়, সে বিষয়ে বিশেষ বন্দোবস্ত করিতেছি। চতুর্থ বর্ষের প্রথম সংখ্যা এক সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় সংখ্যা যথাসময়ে আপনাদের নিকট উপস্থিত করিব এরূপ আশা করি।" পত্রিকার প্রতি সংখ্যার মূল্য ছিল চার আনা এবং বার্ষিক মূল্য নির্দিষ্ট ছিল দু’টাকা ছ'আনা। পূর্ণ পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপনের দাম ছিল চার টাকা, পরে সেটা হয়েছিল বারো টাকা। এটি পত্রিকার জনপ্রিয়তার একটি সূচকও হতে পারে।
প্রথম কয়েকটি সংখ্যায় 'গ্রন্থ সমালোচনা' ছিল না। এটি শুরু হয় ৩য় সংখ্যা অর্থাৎ বৈশাখ ১৩১৬ থেকে। 'মানসী’র অন্যান্য সংখ্যাতেও বহু লেখক বিভিন্ন আকর্ষণীয় বিভাগে লেখা প্রকাশ করেছেন। পত্রিকার নামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বেশ কিছু মনোহর ছবি ছাপা হযেছে বিভিন্ন সংখ্যায়।
কবিতা লিখেছেন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কালিদাস রায়, মোহিতলাল মজুমদার, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, মুনীন্দ্রনাথ ঘোষ, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, প্রিয়ম্বদা দেবী, নিরুপমা দেবী, হেমলতা দেবী, দেবেন্দ্রনাথ সেন, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, দেবকুমার রায়চৌধুরী, রমণীমোহন ঘোষ, জগদিন্দ্রনাথ রায়, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, লীলা দেবী, মৃন্ময়ী দেবী, মানকুমারী, গিরিজানাথ মুখোপাধ্যায়, কালিদাস রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। রবীন্দ্রনাথের নাম ছাপা হয়েছে স্যার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,ডি.লিট্. হিসাবে। এ ছাড়া অন্যান্য বহু কবির রচিত কবিতা ছড়িয়ে রয়েছে ‘মানসী’র পাতায়।
আকর্ষণীয় ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ করেছেন বেশ কিছু লেখক। অনুরূপা দেবীর উপন্যাস 'উল্কা' প্রকাশিত হয়েছে ১৩২২-এর বৈশাখ থেকে; জলধর সেনের উপন্যাস 'বিশুদাদা' ও 'কাঙাল হরিনাথ' শুরু হয়েছে যথাক্রমে ফাল্গুন ১৩১৬ ও ফাল্গুন ১৩১৮ থেকে। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের দু'টি উপন্যাস 'রত্ন-দীপ' ও 'জীবনের মূল্য' প্রকাশিত হতে থাকে ১৩১৯ ফাল্গুন ও ১৩২২ শ্রাবণ থেকে। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক উপন্যাস 'শশাঙ্ক' শুরু হয ১৩১৯-এর অগ্রহায়ণ থেকে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বিবিধ প্রসঙ্গ - জীবনী, শোক সংবাদ, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, ইতিহাস, সামাজিক সমস্যা ইত্যাদি অবলম্বনে গৌরহরি দাসের 'নিদর্শন' ১৩১৯-এর পৌষ সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সংখ্যায় যারা লিখেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন রমেশচন্দ্র মজুমদার, রাজেন্দ্রলাল আচার্য্য, রজনীকান্ত সেন, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, শশীভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ইন্দুপ্রকাশ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সম্পাদকমণ্ডলীর সুবোধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিবরতন মিত্র।
গল্প ও কবিতা ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে বহু তথ্য সম্বলিত এবং মননধর্মী রচনাও স্থান পেয়েছে ‘মানসী’তে। কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে – ‘জ্যোতির্বিদ কবি ওমর খৈয়াম’ (মোহিতলাল মজুমদার), ‘জাপানে স্ত্রী-চরিত্র’ (মন্মথনাথ ঘোষ), ‘বঙ্কিমচন্দ্র ও বঙ্গভাষা’ (হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ), ‘বঙ্গসাহিত্য’ (শিবরতন মিত্র), ‘শিবাজীর মানবত্ব’ (ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়), ‘সাহাজাদা খসরু’ (হরিসাধন মুখোপাধ্যায়), ‘অধ্যাত্মবাদ ও ভারতের দুর্দ্দশা’ (জলদকান্তি ঘোষ বি,এ), ‘সামাজিক সমস্যা’ (যদুনাথ চক্রবর্ত্তী), ‘ফতেপুর সিকরি’ (নবকৃষ্ণ ঘোষ), ‘চৌম্বক ঝটিকা’ (জগদানন্দ রায়), ‘ভারতে স্থাপত্য-কলা’ (হেমেন্দ্রকুমার রায়), ‘কবি সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি’ (দেবেন্দ্রনাথ সেন), ‘ভূবিদ্যা’ (হেমচন্দ্র দাশ গুপ্ত), ‘খন্ডগিরি’ (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়), ‘চীনে বিবাহ-প্রথা’ (ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘বিক্রমসংবতের উৎপত্তি’ (অমূল্যচরণ ঘোষ বিদ্যাভূষণ), ‘আহারের সহিত মানসিক অভিব্যক্তির সম্বন্ধ’ (ইন্দুমাধব মল্লিক এম,এ,বি এল,এম ডি), ‘ময়মনসিংহে সাহিত্যচর্চ্চা’ (কেদারনাথ মজুমদার), ‘সমাজ ও ব্যক্তি’ (খগেন্দ্রনাথ মিত্র এম এ), ‘মোহনবাগানের জয়’ (চারুচন্দ্র মিত্র এম,এ বি,এল), ‘ফরিদপুর খাঁটরার বাসুদেব মূর্ত্তি’ (যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত), ‘মানবদেহে জীবানুর প্রভাব’ (ডাক্তার হেমচন্দ্র চক্রবর্ত্তী), ‘সরল সাংখ্যদর্শন’ (গৌরীনাথ শাস্ত্রী বি.এল), ‘দক্ষিণ হস্তাদি কর্ম্মপটু কেন’ (জগদানন্দ রায়), ‘বঙ্গসাহিত্যে হরিনাথ’ (দীনেন্দ্রকুমার রায়), ‘বঙ্কিমচন্দ্র জীবনপঞ্জী’ (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বি,এ, বার-এট-ল), ‘নাট্যকার গিরিশচন্দ্র’ (ব্যোমকেশ মুস্তাফী), ‘কালিদাসে নাটকে বিহঙ্গ-পরিচয়’ (সত্যচরণ লাহা এম-এ,বি-এল, F.Z.S.), ‘বরাবর পাহাড়’ (ভ্রমণ কাহিনী, ৺অনাথকৃষ্ণ দেব), ‘দেবতা-কান্ড’ (হীরেন্দ্রনাথ দত্ত এম,এ,বি,এল,সি,আর,এস), ‘বাঙ্গালার শিক্ষিত-সম্প্রদায় ও ছাত্রগণের স্বাস্থ্য’ (প্রফুল্লচন্দ্র রায় পি,এইচ,ডি; ডি,এস,সি, সি,আই,আই) ইত্যাদি।
‘মানসী’তে গল্পের সংখ্যা কবিতার তুলনায় অনেক কম। গল্প লিখেছেন – খগেন্দ্রনাথ মিত্র এম,এ, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, নরেন্দ্রনাথ চৌধুরী, অমলা দাস গুপ্তা, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, অধরচন্দ্র ঘোষ, উর্ম্মিলা দেবী, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, জ্ঞানেন্দ্রনারায়ণ বাগচী এল,এম,এস, জলধর সেন, নফরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রণতা দেবী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অঘোরনাথ ঘোষ, প্রবোধচন্দ্র ঘোষ, যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ।
ষষ্ঠ বর্ষে্র প্রথম সংখ্যা (১৩২০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন) থেকে পত্রিকা সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন নাটোরাধিপতি জগদিন্দ্রনাথ রায়। ক্রীড়ামোদী ও সাহিত্যপ্রেমী জগদানন্দ ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। পাখোয়াজ বাদনেও তিনি ছিলেন দক্ষ। তবে ফাল্গুন সংখ্যা থেকে সম্পাদক পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে ১৩২১ বৈশাখ থেকেই হয়ত জগদানন্দ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সংখ্যার প্রথমেই ‘সম্পাদকের নিবেদন’-এ তিনি লিখেছেন –
“ আজ নববর্ষ-সমাগমে পর্য্যাপ্ত পুষ্পপল্লবসম্পদে বনস্থলী পূর্ণ, কানন-প্রান্তর বিহগবন্দনাগীতে মুখরিত, দিগন্তব্যাপী নীলাকাশ আলোকোজ্জ্বল, মনে হইতেছে, বিশ্বে “মানসী” আজি মূর্ত্তিমতী। এই শুভ অবসরে আমি মানসীর ভার গ্রহণ করিলাম তাহাকেও এমনি সুন্দর ও মনোরম করিয়া তুলিবার চেষ্টা ও সাধনাকে অশ্রান্ত রাখিতে পারি ভগবচ্চরণে ইহাই আমার একান্ত প্রার্থনা।”
‘মানসী’কে আকর্ষনীয় করে তুলতে জগদানন্দের চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না। সাহিত্যিকদের সঙ্গে তিনি খোলাখুলি আলোচনা করতেন, বিশেষ করে নতুন লেখকদের সঙ্গে। তার বাড়িতে এদের আড্ডাও বসত। সম্পাদনার দায়িত্ব জগদানন্দ গ্রহণ করায় প্রমথ চৌধুরী (বীরবল) খুসি হয়ে ১৩২১ বৈশাখ সংখ্যায় ‘বীরবলের চিঠি’তে লিখেছেন – “ “মানসী” যে সম্পাদক-সঙ্ঘের হাত থেকে উদ্ধার লাভ ক’রে অতঃপর রাজ-আশ্রয় গ্রহণ করেছে এতে আমি খুসি ; কেন না, এ দেশে পুরাকালে কি হত তা পুরাতত্ত্ববিদেরা বলতে পারেন, তবে এ কালে সব জিনিসই যে পঞ্চায়তের হাতে পঞ্চত্ব প্রাপ্তি লাভ করে সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই।”
'মানসী' মাঝে মাঝে আত্মসমীক্ষা করেছে। পত্রিকার সার্বিক উৎকর্ষ বজায় রাখতে গত বছরে প্রকাশিত রচনা সমূহের গুণগত মান বিশ্লেষণের চেষ্টা হয়েছে - "......বৎসরান্তে সাহিত্যিকজীবনে আমাদের বড় সাধের 'মানসী' তাহার আদর্শের পথে কতদূর অগ্রসর হইল বা সে আদর্শ হইতে কত পশ্চাতে পড়িয়া রহিল, তাহা দেখিতে হইবে - রবীন্দ্রনাথের শুভাশিষ লইয়া যাহার জন্ম - বাঙ্গালার সাহিত্যিকদিগের সাধন-সলিল-সেচনে যাহার অঙ্গপুষ্টি হইতেছে - যে সকল সাহিত্য-রথদিগের তাড়নে জর্জ্জরীভূত হইয়া ত্রুটি ও প্রমাদের সংশোধনের জন্য চির-উন্মুখ সেই মানসীর গত বৎসরের সাহিত্য সাধনে একটা হিসাব-নিকাশ করা অযৌক্তিক বলিয়া মনে করি না। আর দেখিতে হইবে গত বৎসরের সাহিত্যের প্রকৃতি হইতে, তাহার উন্নতি বা অবনতি হইতে, মানসী কতদূর গিয়া পড়িয়াছে।"
পত্রিকার নতুন বছরের প্রারম্ভে প্রতি ফাল্গুন সংখ্যার ‘মানসী’তে সাহিত্যসেবার দৃঢ় সঙ্কল্প ও আদর্শের প্রতি গভীর প্রত্যয় ও নিষ্ঠা ব্যক্ত করা হয়েছে ‘নববর্ষে’, ‘বর্ষ সমাগমে’, ‘বর্ষ-বর্ত্তন’, ‘মূতন খাতা’ প্রভৃতি শীর্ষক রচনার মাধ্যমে ; লেখকেরা ছিলেন ব্যোমকেশ মুস্তফী, পূর্ণচন্দ্র ঘোষ, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, চারুচন্দ্র মিত্র প্রমুখ।
মর্ম্মবাণী
বিদ্যানুরাগী ভাষাবিদ অধ্যাপক অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন পণ্ডিত ব্যক্তি। 'মানসী'তেও তিনি লেখা প্রকাশ করেছেন। জলধর সেনের সঙ্গে 'ভারতবর্ষ' পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক এবং 'রাণী', 'পঞ্চপুষ্প' প্রভৃতি পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে কাজ করে পত্রিকা সম্পাদনার কাজে তিনি ছিলেন যথেষ্ট অভিজ্ঞ। সাহিত্যপিপাসু জগদিন্দ্রনাথ শুধু ‘মানসী’তেই সন্তুষ্ট থাকতে পারেন নি, তার ইচ্ছা হল মাসিক পত্রিকা 'মানসী' ছাড়াও আর একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা তিনি প্রকাশ করবেন। তিনি যোগাযোগ করেন অমূল্যচরণের সঙ্গে ; জগদিন্দ্রনাথের ইচ্ছা ও প্রচেষ্টার সার্থক রূপায়ন ঘটে 'মর্ম্মবাণী' পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে। ১৩২২-এর ১৩ই শ্রাবণ সাপ্তাহিক 'মর্ম্মবাণী'-র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। যুগ্মভাবে সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন জগদিন্দ্রনাথ রায় ও অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ; সহকারী সম্পাদক হ’ন হেমেন্দ্রকুমার রায়। 'মর্ম্মবাণী'-র কার্যালয় ছিল ২২ নং কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটে। 'মর্ম্মবাণী'-র সূচনায় অমূল্যচরণ লিখেছেন - "সুসাহিত্যের পুষ্টির জন্য, জ্ঞান ও সত্যের প্রচারের জন্য, সুনিতীর উপচয়ের জন্য, সুরুচির উৎকর্ষ সাধনের জন্য, যে চেষ্টা তাহাই সাহিত্য সেবা। এই সেবা দ্বারা মনুষ্যত্ব লাভের পথ পরিষ্কৃত হইতে পারে। যাহাকে প্রকৃত উন্নতি বলা যায়, এই সেবাদ্বারা তাহা লাভ হইতে পারে। সাহিত্যের উৎকর্ষ হইলে সমাজের মঙ্গল হইবে, দেশের ও দশের কল্যাণ হইবে। এই মহান লক্ষ্যের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া আমরা 'মর্ম্মবাণী' প্রচারে অগ্রসর হইলাম। ইতিহাস, ধর্ম্মনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, দর্শন ও বিজ্ঞান প্রভৃতির আলোচনা দ্বারা সমাজের উন্নতিসাধন মর্ম্মবাণীর প্রধানতম উদ্দেশ্য।"
'মর্ম্মবাণী'-তে কবিতা লিখেছেন যতীন্দ্রমোহন বাগচী, কালিদাস রায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদিন্দ্রনাথ রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্রনাথ ঘোষ, যতীন্দ্রপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য ও আরও অনেকে। প্রবন্ধ রচয়িতাদের মধ্যে রয়েছেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সতীশচন্দ্র ঘটক, রমেশচন্দ্র মজুমদার, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি। গল্পের সংখ্যা তুলনামোলক ভাবে কম। গল্প লিখেছেন হেমেন্দ্রকুমার রায়, বিজয়রত্ন মজুমদার, নরেন্দ্র দেব, সরোজনাথ ঘোষ, শশীভূষণ বিশ্বাস, মৃণালমালা দেবী, বিশ্বপতি চৌধুরী প্রমুখ লেখকেরা। খগেন্দ্রনাথ মিত্রের ১৩২৭-এর শ্রাবণ সংখ্যায় মাত্র একটি রচনা চোখে পড়ল। এ ছাড়াও ছিল অন্যান্য নানা বিষয়ে রচনা। এই লেখকদের মধ্যে ছিলেন রমণীমোহন দেব, রমাপ্রসাদ চন্দ, ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রসিকমোহন বিদ্যাভূষণ, পুলিনবিহারী দত্ত, অতুলকৃষ্ণ গোস্বামী, গিরীশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি।
সাপ্তাহিক ‘মর্ম্মবাণী’র আকার ছিল ৩৮ x ২৯ সেঃ মিঃ এবং পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ২৪। এত প্রচেষ্টা ও আন্তরিকতা সত্বেও ১৩২২-এর ১৩ই শ্রাবণ থেকে ১৩২২-এর ১৩ই মাঘ পর্যন্ত মাত্র পঁচিশটি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর 'মর্ম্মবাণী' বন্ধ হযে যায়; কারণটা স্পষ্ট নয়।
মানসী ও মর্ম্মবাণী
‘মর্ম্মবাণী' কিন্তু বিলীন হয়ে যায় নি। 'মানসী'-র অষ্টম বর্ষের (১৩২২ বঙ্গাব্দ) ফাল্গুন সংখ্যা থেকে 'মর্ম্মবাণী' 'মানসী'-র সঙ্গে যুক্ত হয়ে 'মানসী ও মর্ম্মবাণী' নামে প্রকাশিত হতে থাকে। সম্পাদকদের নামও লিখিত হয়েছে "মহারাজ শ্রী জগদিন্দ্রনাথ রায় ও শ্রী প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বি-এ, বার-এট-ল।" "১৪ এ রামতনু বসু লেনের "মানসী" প্রেসে শ্রীশীতলচন্দ্র ভট্টাচার্য্য কর্ত্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত।" প্রথম সংখ্যার প্রথম লেখাটি 'বসন্তে' নামক কবিতা রচয়িতা জগদিন্দ্রনাথ রায়। সংখ্যার তৃতীয় রচনা 'নববর্ষ' নিবন্ধে চারুচন্দ্র মিত্র লিখেছেন - " 'মানসী' এতদিন একা ছিল; আজ সে 'মর্ম্মবাণী'কে সখীরূপে পাইয়াছে। দুই সখী যেন পরস্পরের বাহু ধরিয়া সাহিত্যের নন্দনকাননে আসিযা দাঁড়াইয়াছে। ফাল্গুনের প্রথম মলয়-সমীরণ তাহাদের চূর্ণ এলায়িত অলকদামে মৃদু হিল্লোল তুলিয়া বহিতেছে। ..... প্রভাত বাবুকে সহযোগীরূপে পাইয়া সম্পাদক জগদিন্দ্রনাথও যেমন নববলে বলীয়ান হইলেন, তেমনি পাঠকবর্গও তাঁহাকে এই যুগ্ম পত্রিকার অন্যতম সম্পাদকের আসন অলঙ্কৃত করিতে দেখিয়া মনে নব নব আশা পোষণ করিতেছেন।"
'মানসী ও মর্ম্মবাণী'-তে বহু সংখ্যক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। সবচেয়ে বেশী সংখ্যায় কবিতা লিখেছেন কালিদাস রায়। এ ছাড়া রয়েছেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, প্যারীমোহন সেনগুপ্ত, প্রিয়ম্বদা দেবী, প্রসন্নময়ী দেবী, পরিমলকুমার ঘোষ, বন্দে আলি মিয়া, বীনাপাণি রায়, মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, রমণীমোহন ঘোষ, পতিপ্রসন্ন ঘোষ, সতীপ্রসন্ন চক্রবর্তী এবং আরও অনেকে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছাপা হয়েছে এগারটি।
ধারাবাহিক উপন্যাস বেরিয়েছে বেশ কয়েকটি। কয়েকটির উল্লেখ করা যেতে পারে – (বন্ধনীর মধ্যে রয়েছে যে সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছে তার উল্লেখ)। ইন্দিরা দেবী লিখেছেন 'স্পর্শমণি' ( ১৩২৩ ভাদ্র ) ও 'স্রোতের গতি' ( ১৩২৭ ফাল্গুন ); গিরিবালা দেবীর রচনা 'হিন্দুর মেয়ে' ( ১৩৩৫ ভাদ্র ); প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস বেরিয়েছে পাঁচটি - 'জীবনের মূল্য' ( ১৩২২ ফাল্গুন ), 'সিন্দুর কৌটা' ( ১৩২৩ ফাল্গুন ), 'মনের মানুষ' ( ১৩২৭ ফাল্গুন ), 'সত্যবালা' ( ১৩২৯ ফাল্গুন ) ও 'গরীব স্বামী' ( ১৩৩৩ ফাল্গুন )। মনোমোহন চট্টোপাধ্যায়ের রযেছে তিনটি উপন্যাস - 'অপরাজিতা' ( ১৩২৬ বৈশাখ ), 'অশ্রুকুমার' ( ১৩২৭ ভাদ্র ), 'নগবালা' ( ১৩৩১ বৈশাখ )। দু'টি লিখেছেন মাণিক ভট্টাচার্য্য - 'চির অপরাধী' ( ১৩২৬ কার্ত্তিক ), 'অপূর্ণ' ( ১৩২৯ ভাদ্র )। রাজেন্দ্রলাল আচার্য্যের রয়েছে তিনটি - 'প্রায়শ্চিত্ত' ( ১৩৩১ ফাল্গুন ), 'পুণর্জন্ম' ( ১৩৩৩ অগ্রহায়ণ ) ও 'দেব দেউল' ( ১৩৩৫ আষাঢ় )। শৈলবালা ঘোষজায়া লিখেছেন 'আড়াই চাল' ( ১৩২৫ বৈশাখ ) ও 'জন্ম অপরাধী' ( ১৩২৫ কার্ত্তিক )। সরসীবালা বসুর 'বঙ্গবধূ' শুরু হয়েছে ১৩৩২-এর ফাল্গুন সংখ্যা থেকে। এ ছাড়া রযেছে সরোজবাসিনী গুপ্তার 'মিলন পথে' ( ১৩৩০ মাঘ )।
'মানসী'-র তুলনায় 'মানসী ও মর্ম্মবাণী'-তে গল্প বেশী প্রকাশিত হয়েছে। গল্প লিখেছেন খগেন্দ্রনাথ মিত্র, দীনেন্দ্রকুমার রায়, জলধর সেন, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ থাকুর, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, তরুবালা দেবী, গিরিবালা দেবী, ননীবালা দেবী, অনিলবরণ রায়, অপূর্ব্বমণি দত্ত, অমিয়া দেবী, ঊষা দেবী, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, কিরণবালা দেবী, প্রমীলা সেন, ফকিরচন্দ্র চত্তোপাধ্যায়, পাঁচুলাল ঘোষ, প্রমথনাথ চৌধুরী, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিজয়রত্ন মজুমদার, মাণিক ভট্টাচার্য্য, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্য্যায়, বিভাবতী ঘোষ, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, শরচ্চন্দ্র ঘোষাল, সতীশচন্দ্র ঘটক, সরসীবালা বসু, হেমেন্দ্রকুমার রায়, সুবোধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সরোজনাথ ঘোষ, হেমবালা বসু, সুরেশচন্দ্র ঘটক, সূর্য্যমুখী দেবী, সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, হেমচন্দ্র বক্সী প্রমুখ। এদের মধ্যে অনেকে পরবর্তী কালে প্রাসঙ্গিক থেকেছেন, অনেকের নাম আর তেমন শোনা যায়নি। তবে সমসাময়িক অনেক পত্রিকায় এদের অনেকেই নিয়মিত লিখেছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বহু সংখ্যক মহিলা সে সময়ে সাহিত্য রচনায় অংশগ্রহণ করেছেন।
'মানসী ও মর্ম্মবাণী'-তে বেশ কিছু ভ্রমণ কাহিনী বেরিয়েছে। কয়েকটি ধারাবাহিক ভাবেও প্রকাশিত হযেছে। ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়, অনুরূপা দেবী, ঊষা দেবী, কালীপদ মিত্র, পূর্ণচন্দ্র রায়, ফকিরচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ব্রহ্মচারী হেমচন্দ্র, মন্মথনাথ দে, পরশুরাম কুণ্ডু, সরযূবালা মিত্র, সুরুচিবালা চৌধুরাণী, সুশীলা বসু প্রমুখ। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য্যের ‘সেকালের কথা’ প্রকাশিত হয়েছে ১৩৩৪-এর ফাল্গুন সংখ্যায়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত 'প্রতাপ সিংহ'-এর গান স্বরলিপি সহ ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করেছেন মোহিনী সেনগুপ্তা ১৩২৮-এর ফাল্গুন সংখ্যা থেকে। ব্রজেন্দ্রনারায়ণ আচার্য্য চৌধুরী শিকার কাহিনী শুনিয়েছেন ধারাবাহিক 'শিকার ও শিকারী'-তে ১৩৩০-এর জৈষ্ঠ্য থেকে। সত্য ঘটনা অবলম্বনে বীরেশ্বর সেন শুনিয়েছেন 'পুলিসের গল্প', শুরু ১৩২৮-এর জৈষ্ঠ্য। ১৩২৭-এর চৈত্র থেকে অতুলপ্রসাদ সেন তার গানের কথা ( স্বরলিপি নয় ) ক্রমশঃ প্রকাশ করেছেন ১৩২৭-এর চৈত্র থেকে। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মুক্তি আন্দোলন নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেছেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ধারাবাহিক ‘বেদকথা’ বেরিয়েছে ১৩৩৪-এর বৈশাখ থেকে। জগদিন্দ্রনাথ রায় ৩৮ টি সংখ্যায় লিখেছেন ‘শ্রুতি-স্মৃতি’। ‘গ্রন্থ সমালোচনা’ ছাড়াও পত্রিকাটিতে একটি বিভাগ যোগ হয়েছে সেটি হল ‘বৈদেশিকি’। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদ , সাহিত্য, বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ, সমাজচিত্র প্রকাশ ও তার বিশ্লেষণ করেছেন গৌরহরি সেন ও নীলমণি চট্টোপাধ্যায়। ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ বিভাগে ভারতবর্ষ ও বাংলার গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশ পেয়েছে।
১৯২৬ খৃষ্টাব্দের ৫ই জানুয়ারী পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক মহারাজ জগদিন্দ্রনাথ রায় পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যুর পর প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে মহারাজ যোগীন্দ্রনাথ রায় সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু পত্রিকা ক্রমশঃ আর্থিক অসচ্ছলতার কবলে পড়ে ; নিয়মিত প্রকাশে ব্যাঘাত ঘটে। অনেক বৈচিত্র, বিবিধ বিষয় ও বিপুল লেখক সংখ্যা সত্বেও 'মানসী ও মর্ম্মবাণী'-কে বাঁচিয়ে রাখা যায় নি। শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩৩৬-এর মাঘ মাসে; এটি ছিল ২১ বর্ষের ২য় খণ্ড ৬ষ্ঠ সংখ্যা। এ ভাবেই বহু লেখকের সাহিত্য প্রেরণার উৎস এবং বিভিন্ন রুচির বিপুল সংখ্যক পাঠকবর্গের চিত্ত বিনোদনকারী একটি উৎকৃষ্ট মানের সাময়িক পত্রের বিলুপ্তি ঘটে।
'মানসী'-র জীবদ্দশা ধরলে 'মানসী ও মর্ম্মবাণী'-র মোট আয়ুষ্কাল ছিল একুশ বছর। সময়টা খুব কম নয়। মনে রাখতে হবে সে সময়ে 'প্রবাসী' ও 'ভারতবর্ষ'-এর মত দু'টি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকতে হয়েছে এই পত্রিকাটিকে। 'মানসী ও মর্ম্মবাণী'-র শেষ সংখ্যায় লিখেছেন নগেন্দ্রনাথ হালদার, গিরিবালা দেবী, নিবেদিতা ভৌমিক, শশধর রায়, জগদানন্দ বাজপেয়ী, মনীন্দ্রমোহন বসু, পরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, অযোধ্যানাথ দেব, ঊষা দেবী, প্রবোধনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমদাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, নিকুঞ্জমোহন সামন্ত, সারদাপ্রসাদ ঘোষ, নীলমণি চট্টোপাধ্যায়, প্যারীমোহন সেনগুপ্ত, যতীন্দ্রমোহন সিংহ, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, দিগ্বিজয় রায়চৌধুরী, গিরিজাকুমার বসু, যদুনাথ চক্রবর্তী। এসব নামের অনেকগুলিই এখন বিস্মৃত।
'মানসী ও মর্ম্মবাণী' বাংলা সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকবে।
চিত্র – ১ : ‘মানসী’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা।
চিত্র – ২ : ‘মানসী’ পত্রিকার একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র।
চিত্র – ৩ : ‘মর্ম্মবাণী’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা।
চিত্র - ৪ : ‘মানসী ও মর্ম্মবাণী’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা।
চিত্র - ৫ : ‘মানসী’র ১৩২২ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় মুদ্রিত ‘নিদাঘ-দাহ’ নামাঙ্কিত চিত্র।
চিত্র – ৬ : ফরাসী চিত্রশিল্পী Francois Boucher-এর আঁকা ‘বিজনে’ নামাঙ্কিত চিত্র (১৩৩৪ বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত)।
লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।
Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.