পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
নভেম্বর, ১৫, ২০১৬
নব্যভারত
দীপক সেনগুপ্ত
‘নব্যভারত’ ছিল একটি উচ্চ শ্রেণীর মাসিক পত্রিকা। এটির বিশেষত্ব হ’ল, এটি ছিল মুখ্যত: প্রবন্ধ নির্ভর। গল্প, উপন্যাস, নাটক প্রভৃতি বিষয় যেগুলি সাধারণভাবে যে কোন পত্রিকারই গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসাবে গণ্য হয়, ‘নব্যভারতে’ সেসবের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এতে কিন্তু পত্রিকাটির গ্রহণযোগ্যতা কমে নি, ধারাবাহিকতাও ব্যাহত হয় নি। ১২৯০ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসে পত্রিকাটির প্রথম খণ্ড ১ম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। সে বছর চৈত্র মাসেই ১১শ ও ১২শ সংখ্যা প্রকাশিত হয়ে, বাংলা পঞ্জিকানুযায়ী ২য় খণ্ডের ১ম সংখ্যা ১২৯১-এর বৈশাখ মাসেই প্রকাশিত হয় । এর পর প্রতি বছর বৈশাখ থেকে চৈত্র পর্যন্ত পত্রিকাটির ১২টি সংখ্যা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ‘নব্যভারতে’র প্রথম সম্পাদক ছিলেন দেবীপ্রসন্ন রায় চৌধুরী।
প্রথম সংখ্যার প্রারম্ভেই ‘নব্যভারত’ শিরোনামে ভূমিকা লিখেছেন সম্পাদক। এটি একটি দীর্ঘ রচনা। মূল বক্তব্য অতীতের ভারতবর্ষ যে সুমহান ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক ছিল কালের গতিতে সেসব আমরা হারিয়েছি।
“ .........সে গার্গী নাই, সে খনা নাই, সে লীলাবতী নাই, সে সাবিত্রী নাই, সে যুধিষ্ঠির নাই, সে ভীম নাই, সে রামচন্দ্র নাই, সে কণিক নাই, সে চার্ব্বাক নাই, সে কালিদাস নাই, সে আর্য্যভট্ট নাই, সে বরাহমিহির নাই – সে কালের আশা ভরসা কিছুই নাই।” কিন্তু সম্পাদক মনে করেন যে ভারতের পুনরুজ্জীবন শুরু হয়েছে। মনে হয় সম্পাদক উদ্দীপিত হয়ে একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। যেমন, “ ভারত-ইতিহাস লেখকগণ কলম ধরিয়া লিখুন,-১২৯০ সালের জ্যৈষ্ঠ মাসে প্রাচীন ভারত ‘নব্যভারত’ নামে অভিহিত হইল” অথবা “ ... এই কারণে সহজ জ্ঞানে বুঝা যায় বাঙ্গালা ভাষা কালে ভারতের ভাষা হইবে ...”
প্রভৃতি মন্তব্যে বাস্তবের প্রতিফলন যতটা ঘটেছে, আবেগের উচ্ছ্বাস রয়েছ তার চেয়ে অনেক বেশি। সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন ইংরেজ শাসনের যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন। তার মতে, অন্ধকারে অলিয়ে যাওয়া ভারতে নবযুগের অভ্যুদয় হয়েছে ইংরেজ শাসকদের হাত ধরেই। বিশেষ করে, লর্ড রিপনের সময় থেকেই নব্যভারতের সূচনা হয়েছে। রিপন ভারতের ভাইসরয় ছিলেন ১৮৮০ থেকে ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত। এটা ঠিকই উদার হৃদয় ও মুক্ত মনের মানুষ লর্ড রিপন ভারতবাসীর হাতে অনেক অধিকার তুলে দিতে চেয়েছিলেন; তবে সে চেষ্টা সব সময়ে ফলপ্রসূ হয় নি। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল ‘নব্যভারত’ পত্রিকা। দেবীপ্রসন্ন সে সময় থেকেই নবজাগরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন।
এখানে দীর্ঘ অবতরণিকা থেকে কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি। এ থেকে পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও হয় ত স্পষ্ট হবে।
“ ...... ভারত ভূমির সেই সূর্য্যোদয়ের কাল ইংরাজ রাজত্বের সময় হইতে গণনা করা যায়। যে কারণেই হউক, ইংরাজ ভারতকে উদ্ধার করিলেন,- ভারতকে জীবিত করিলেন। তারপর কি হইল ? – সূর্য্য ধীরে ধীরে গগণে উঠিতে লাগিল; যে জাতি শত শত বৎসর অন্ধকারে বাস করিয়া চক্ষুর জ্যোতি হারাইয়াছিল, সেই জাতির আলোক সহ্য হইল না,-তাহারা কলরব করিয়া উঠিল,- অত্যাচার-অবিচার-অধীনতা এই প্রকার কত কর্কশ ধ্বনি আকাশে তুলিতে লাগিল। ইংরাজ রাজত্বকে দুঃখের বলিতে চাও বল, কিন্তু ভাই, নিশ্চয় জানিও, ঐ সূর্য্য কখনও এত শীঘ্র ভারত-গগণে উদিত হইত না, যদি ইংরাজ ভারতে পদার্পন না করিত।
...... প্রাচীন ভারতের সহিত নূতন ভারতের কি প্রভেদ, একথার আলোচনায় আমরা অদ্য প্রবৃত্ত হইব না, আমরা এই মাত্র বলি, সে সময়ের ভাল সেই সময়েই ভাল লাগিয়াছে – আর এ সময়ের ভাল এ সময়েই ভাল লাগিতেছে। কিন্তু একটি কথা আমরা এস্থলে বলিব, সে সময়ে বাহুবলে যাহা সংসিদ্ধ হইত, এ সময়ে বুদ্ধিবলে ও জ্ঞানবলে তাহা সংসাধিত হইবে, আশা হইতেছে। ‘নব্যভারত’ এখন বুঝিতে পারিতেছে – নীতি বলের ন্যায় পৃথিবীতে আর বল নাই ; পাপের ন্যায় আর ভয়ানক শত্রু নাই। ‘নব্যভারত’ আর কি বুঝিতে পারিতেছেন ? – বুঝিতেছেন, একতাই মানবের মহাশক্তি,- প্রেম একতার মূল সূত্র, নীতি ও পুণ্য একতার প্রাণ;- বুঝিতেছেন এক সময়ে পৃথিবী হইতে পাশব শক্তির আদর উঠিয়া যাইবে,-নীতির আদর সর্বত্র ব্যাপ্ত হইবে;-শণিতপাত-অত্যাচার-হিংসার চরমফল যুদ্ধবিগ্রহ এক সময়ে পৃথিবী হইতে পলায়ন করিবে। ইহা বুঝিয়া নব্যভারত দিন দিন সেই বলে বলীয়ান হইতেছেন। অনেকে মনে করিয়া থাকেন, ‘নব্যভারত’ ও ‘নব্য ইটালী’ একই প্রকার। আমরা বলি ‘নব্যভারত’ ও ‘নব্য ইটালী’ এক প্রকার নহে। ‘নব্য ইটালীতে’ নীতির আদর থাকিলেও অস্ত্রের সহিত একেবারে ইহার সম্বন্ধ রহিত হয় নাই-কিন্তু অস্ত্রের সহিত ‘নব্যভারতের’ কোন সম্পর্ক নাই। ,- ‘নব্যভারত’ একমাত্র নীতি ও পুণ্যের উপর দণ্ডায়মান হইয়া পৃথিবীর চক্ষুকে আকৃষ্ট করিতেছেন। ‘নব্যভারত’ শরীরের বলের আদর্শ দিন দিন বিস্মৃত হইয়া জ্ঞানবলে ও ধর্ম্মবলে বলীয়ান হইতেছেন। ‘নব্য ইটালী’র আবার পতন হইতে পারে- আবার অত্যাচার আসিয়া ইহাকে আক্রমণ করিতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেই, ‘নব্যভারত’ যদি অটলভাবে আপন লক্ষ্য পথে অগ্রসর হইতে পারেন, তবে ইহার সে পতনের আর সম্ভাবনা নাই।”
‘নব্যভারত’ নব বেশে দেশে নব যুদ্ধ ঘোষণায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন; এই সময়ে যদি কেউ অগ্রসর হইয়া ‘নব্যভারতে’র গুপ্ত অস্ত্র কি, একথা জিজ্ঞাসা করেন, তবে আমরা তাহাকে নির্ভয়চিত্তে বলিব – নব্যভারতে এক হস্তে পবিত্রতা, অন্য হস্তে উদারতা-মস্তিষ্কে জ্ঞান ও স্বাধীন চিন্তা, হৃদয়ে প্রেম, - আর সমস্ত শরীরে ওতপ্রোতভাবে মানবের রাজা স্বয়ং ঈশ্বর অধিষ্ঠিত।
...... আর একটি কথা বলা হইলেই আমাদের বক্তব্য শেষ হয়। ‘নব্যভারতে’র কাল দশ বৎসর পূর্ব্ব হইতে ধরা যায় কি না ? আমরা বলি, তাহা যায় না। যখন সুপ্তোত্থিত ভারতবাসী ইংরাজকে অন্তরে অন্তরে ভারতবর্ষ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দিবার কামনা করিত, মুখে ‘ভারতজয়’, ‘ভারতজয়’ গান করিয়া সুখ পাইত, বিদ্যাশিক্ষাকে চাকুরী বা দাসত্বের কেন্দ্র বলিয়া তাহার অনুসরণ করিত, স্ত্রীশিক্ষাকে ঘৃণা করিত, বাঙ্গালী বাঙ্গালা ভাষাকে বিদ্বেষের চক্ষে দেখিত, পরানুকরণে জীবনকে ডুবাইয়া সুখী হইত, ধর্ম্মের নামে উপহাস না করিয়া জলগ্রহণ করিত না, একজন আর একজনকে কাঁদিতে দেখিলে হাস্য সম্বরণ করিতে পারিত না, ভারতবাসী দেশহিতৈষী নাম গ্রহণ করিত কেবল যশমানের জন্য, পরোপকার করিত ইংরাজের কৃপা পাইবার জন্য,-এবং ভাই ভাই কাটাকাটি করিয়া মরিত, সে সময়কে ‘নব্যভারতে’র কাল বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না। বর্ত্তমান সময়ে আর ভারতের সে সময় নাই, এক্ষণে ভারত জাতীয় ভাবের ও জাতীয় ভাষার আদর শিখিতেছেন,-এক হৃদয়ের দুঃখে অন্য হৃদয় কাঁদিতেছে; জাতিভেদকে সর্ব্বনাশের মূল কারণ বলিয়া বুঝিতেছেন, স্বাধীনতার আদর বুঝিতেছেন, জ্ঞানের মর্য্যাদা ও বিদ্যার জন্য বিদ্যার আদর করিতে শিখিতেছেন। আর মুখে ‘জয় ভারতের জয়’ বলিয়া ইংরাজকে তাড়াইতে ভারতবাসীর ইচ্ছা নাই;- এক্ষণ ভারতবাসী বুঝিতেছেন- আরও অনেককাল ইংরাজের নিকট শিক্ষা করিতে হইবে। ভারতবাসী এক্ষণে স্ত্রীশিক্ষার আদর বুঝিতেছেন, ধর্ম্মের নামে আর উপহাস করিতে ইচ্ছা নাই,- কাহারও কৃপা পাইবার জন্য বা যশের জন্য পরোপকার করাকে ঘৃণার কার্য্য বলিয়া বুঝিতেছেন। এক্ষণে বিদ্যা শিখিয়া ভারতবাসী দেশের উপকার করিতে ধাবিত হইতেছেন;- বিলাত হইতে শিক্ষা করিয়া ভারতে আসিয়া জাতীয় ভাব ও ভাষার উন্নতির চেষ্টা করিতেছেন। এই সময়ে ভারতের যে কি এক অপরূপ শোভা হইয়াছে, তাহা সকলেই বুঝিতেছেন। এই অভিনব সময়কে আমরা ‘নব্যভারতে’র সময় বলিয়া নির্দ্দেশ করিলাম। স্বায়ত্ব শাসনের আন্দোলনে ভারত দেখাইয়াছেন, ভারত রাজনীতি চায়,- ভারত একতার জন্য উৎসুক। ফৌজদারী কার্য্যবিধির বিল সম্বন্ধীয় আন্দোলনে ভারত দেখিয়াছেন, ভারতকে আর পদতলে রাখিতে উদারচেতা ইংরাজদের ইচ্ছা নাই,- ভারতও নানারূপে দেখাইয়াছেন ভারত আর বিচ্ছিন্ন নাই – একের সুখে অন্যের হৃদয় ফুল্ল হয়, একের দুঃখে অন্যের হৃদয় ব্যথিত হয়। ভাষার আদরের সহিত সংবাদপত্রের আদর বাড়িতেছে, ভারত আলস্য পরিহার করিয়া কার্য্যদক্ষ হইতে প্রবাসী হইয়াছেন। প্রজা ভূম্যধিকারীর বিলের আন্দোলনে ইহা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণীকৃত হইয়াছে, ভারতে দুঃখী প্রজাদের জন্য কাঁদিবার অনেক লোক আছে। আরো অসংখ্য কারণে আমরা উদারচেতা মহামতি লর্ড রিপণের শাসন কালকেই ‘নব্যভারতে’র কাল বলিয়া নির্ণয় করিলাম। ইঁহার ন্যায় উদারনৈতিক শাসনকর্ত্তা আর কখনো ভারতবর্ষে পদার্পণ করেন নাই। ইনিই যেন ভারতকে নবভূষণে সাজাইয়া তুলিতেছেন। ...... ‘নব্যভারত’ যদি সত্য প্রচার করিতে পারেন, তবে কেহই সে সত্যের অপলাপ করিতে পারিবে না। মিথ্যা জগতে কখনো স্থায়ী হইবে না, সুতরাং ‘নব্যভারত’ যদি মিথ্যা প্রচার করেন, তবে তাহাও কেহ ধরিয়া স্থায়ী করিতে পারিবে না। বন্ধু বান্ধব সকলে ‘নব্যভারত’কে আশীর্ব্বাদ করুন, তাঁহাদের ও ঈশ্বরের কৃপা মস্তকে ধারণ করিয়া উদারভাবে ‘নব্যভারত’ জগতে সত্য প্রচারে রত থাকুক। সকলে আশীর্ব্বাদ করুন, স্বাধীনতা, পবিত্রতা ও উদারতা ইহার মূলমন্ত্র হউক; - একতা-শান্তি এবং সাম্য ইহার চরম লক্ষ্য হউক।”
ভূমিকাতে ‘নব্যভারতে’র অর্থ ও পত্রিকার নামকরণের সার্থকতা যতটা স্পষ্ট করা হয়েছে, ‘নব্যভারত’ যে মূলত: প্রবন্ধ নির্ভর হবে সেই সিদ্ধান্ত বা তার কারণ কিন্তু ব্যাখ্যা করা হয় নি। প্রথম সংখ্যার রচনাগুলি ছিল – ‘নব্যভারত’ (সম্পাদক), ‘জীবন-গতি নির্ণয়’ (ধারাবাহিক, চণ্ডীচরণ সেন), ‘ওরে প্রাণ কি তোর বাসনা?’ (পদ্য, বিজয়চন্দ্র মজুমদার), ‘পাশ্চাত্য মায়াবাদ’ (ধারাবাহিক, সীতানাথ দত্ত), ‘অচিন্ত্য শকতি তব কি বুঝিব দয়াময়’ (পদ্য, যোগীন্দ্রনাথ বসু বি. এ.), ‘রামমোহন রায়ের ধর্ম্ম বিষয়ক মত’ (নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়), ‘সূর্য্য’ (সূর্য্যকুমার অধিকারী বি. এ.), ‘সন্তোষ ক্ষেত্র’ (রজনীকান্ত গুপ্ত), ‘স্বাধীনতা’ (পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী এম. এ.), ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ (সম্পাদক)।
এখন প্রকাশিত রচনাগুলির সঙ্গে কিছুটা পরিচিত হওয়া যাক। ‘নব্যভারত’ প্রবন্ধটি যে পত্রিকার ভূমিকা ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে সম্পাদকের নিবেদন সেটা আগেই বলা হয়েছে। ‘জীবন-গতি নির্ণয়’ রচনাটিতে চন্ডীচরণ সেনের মূল বক্তব্য কিছু কিছু বাক্যাংশ উদ্ধৃতির মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা যেতে পারে –
“ ...... চন্দ্র, সূর্য্য এবং অপরাপর গ্রহ উপগ্রহ সকলেই নির্দ্দিষ্ট নিয়মানুসারে আকাশমন্ডলে পরিভ্রমণ করিতেছে। বৃক্ষ, লতা, ফল, ফুল, এ সকলই নির্দ্দিষ্ট নিয়মে উৎপন্ন এবং পরিবর্দ্ধিত হইতেছে। পৃথিবীস্থ জীবজন্তুর শারীরিক কার্য্যকলাপ, তাহাদিগের ক্ষুধা তৃষ্ণা নির্দ্দিষ্ট নিয়মাবলীর দ্বারা পরিশাসিত হইতেছে। বিশাল বিশ্বসংসার একটি যন্ত্রের ন্যায় বিশ্বনিয়ন্তার অলঙ্ঘ্য নিয়মে অবিশ্রান্ত ঘূর্ণায়মান হইতে হইতে ক্রমেই অবস্থান্তর প্রাপ্ত হইতেছে ...... কিন্তু বহির্জগতের এই সকল পরিবর্তনই কি কেবল জগৎপিতার অখণ্ডনীয় এবং অপ্রতিহত নিয়মের অধীন রহিয়াছে ? অন্তর্জগতের পরিবর্তনসমূহ কি কোন নির্দ্দিষ্ট নিয়মের অধীন নহে ? মানবজীবনের কার্য্যকলাপের মধ্যে কি কোন নির্দ্দিষ্ট নিয়মাবলী লক্ষিত হয় না ? মানবজীবন কি কেবল ঘটনার স্রোতের দ্বারা পরিচালিত হইয়া অদ্য রাজসিংহাসন লাভ, কল্য বৃক্ষতল আশ্রয় করে ? ...... বর্ব্বর জাতি কর্ত্তৃক রোম রাজ্যের বিনাশ, অর্জ্জুন কর্ত্তৃক ত্রিভূবনবিজয়ী ভীষ্ম কর্ণের পরাজয়, সিপিও কর্ত্তৃক কার্থেজের বীর-গৌরব হানিবলের গৌরব বিচূর্ণন, এই সকল ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্যে কি কার্য্যকারণ শৃঙ্খল লক্ষিত হয় না ? বস্তুত: বিজ্ঞানের চক্ষে দৃষ্টি করিলে প্রত্যেক ঐতিহাসিক ঘটনার মূলে সুস্পষ্টরূপে অনিবার্য্য কারণসকল লক্ষিত হইয়া থাকে। ......
ইতিপূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে যে, পৃথিবী যেমন তদুপরিস্থ সমুদয় বস্তু কর্ত্তৃক আকৃষ্ট হওয়া সত্ত্বেও, তদুপরিস্থ পদার্থ সমূহের নিকট পরিচালিত না হইয়া, আপন প্রবলতর আকর্ষণ দ্বারা উপরিস্থ পদার্থ সকলকে আপনার দিকে আকর্ষণ করিয়া ভূতলশায়ী করিতেছে, সে প্রকার মানব মনের আভ্যন্তরিক শক্তি, বহির্জগতের পদার্থ, ঘটনা ও অবস্থা-সমুত্থিত শক্তি অপেক্ষা প্রবলতর হইলে নিশ্চয়ই মনুষ্য অবস্থার দাসত্ব শৃঙ্খল হইতে নির্ম্মুক্ত হইতে পারে। ......
মন যে কি পদার্থ – তাহা কেহই জানিতে পারে না। মনের প্রকৃতি মনুষ্যের সম্পূর্ণ অজ্ঞেয়। আমরা কেবল মানসিক কতকগুলি ক্রিয়া জানিতে ও অনুভব করিতে পারি, এবং সেই ক্রিয়াগুলি যে কারণ বা শক্তি হইতে সমুৎপন্ন হয়, তাহাকে মন বলিয়া নির্দ্দেশ করি; ...... আবার জড় জগতের পদার্থ সকল যেমন তাহাদিগের প্রকৃতির প্রতিকূল ঘটনা বা অবস্থার সংঘর্ষণে বিকৃত অবস্থা প্রাপ্ত হয়, মানব মনও তদনুরূপ স্বীয় প্রকৃতিগত কার্য্যপ্রণালীর বিপর্য্যাবস্থা ঘটিলে প্রকৃতিভ্রষ্ট হইয়া অবনত অবস্থা প্রাপ্ত হইয়া থাকে। মানব মনের আভ্যন্তরিক শক্তি বহির্জগত সমুত্থিত শক্তিকে অতিক্রম করিয়া মনুষ্যকে অবস্থার দাসত্ব হইতে বিমুক্ত করিতে পারে। ...... সুতরাং মানব জীবনের কার্য্যকলাপ নির্দ্দিষ্ট নিয়মাধীন বলিয়া প্রতিপন্ন করিতে পারিলে, মনের প্রকৃতিগত গতি এবং মনের আভ্যন্তরিক শক্তিও যে নির্দ্দিষ্ট নিয়মাধীন তাহা সহজেই প্রতিপন্ন হইবে।”
লেখক ইউরোপীয় দার্শনিক স্পিনোজার মতবাদও সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। মোট ৭টি সংখ্যায় বিস্তৃত রচনাটিতে প্রবন্ধকার জটিল বিষয়টি বিশ্লেষণাত্মক ভঙ্গিতে প্রাঞ্জলভাবে যেরকম বিশদ ব্যাখ্যা সহকারে পরিবেশন করেছেন সেটা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। ভারতীয় যোগ সাধনায় মনের সঙ্কল্প-বিকল্প ও বিক্ষেপকে নিয়মিত অভ্যাস ও চেষ্টার দ্বারা ক্রমশ: অতিক্রম করে সাম্য অবস্থায় পৌঁছোনর যে প্রণালী বর্ণিত হয়েছে তার কার্যকারণ সম্পর্কের কিছুটা ব্যাখ্যাও মিলবে রচনাটি থেকে।
এর পরের প্রবন্ধটি ‘পাশ্চাত্য মায়াবাদ’, লেখক সীতানাথ দত্ত। শুরুতেই তিনি জানিয়ে দিয়েছেন –
“সংস্কৃত দার্শনিক সাহিত্যে মায়াবাদ কাহাকে বলে আমরা ঠিক বলিতে পারি না; আমরা সংস্কৃতাভিজ্ঞ নহি। পাশ্চাত্য Idealism এর সহিত আমাদের দেশীয় প্রাচীন মায়াবাদের কথঞ্চিৎ সাদৃশ্য আছে, সংস্কৃতাভিজ্ঞদিগের মুখে ইহা শুনিয়া আমাদের আলোচ্য বিষয়কে মায়াবাদ আখ্যা প্রদান করিলাম।”
এরপর লেখক নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন, -
“কোন কোন পাঠক হয়ত বলিবেন, এরূপ শুষ্ক অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের আলোচনার প্রয়োজন কি ? জ্ঞান-কৌতূহল চরিতার্থ করিবার পক্ষে ইহা উপযোগী হইতে পারে, কিন্তু দৈনন্দিন কার্য্যগত জীবনের সহিত ইহার সম্বন্ধ কি?” ...... এ বিষয়ে লেখকের বক্তব্য – “ইহার উত্তরে আমাদের বক্তব্য এই, যদি আমাদের আলোচ্য বিষয় কেবল জ্ঞান-কৌতূহল চরিতার্থ করিবার পক্ষেই উপযোগী হইত, আর কোন প্রয়োজনে না লাগিত, তাহা হইলেও ইহার আলোচনা নিষ্প্রয়োজনীয় হইত না, যাহা কিছু মানব-হৃদয়ে পবিত্র উচ্চতর সুখদান করে তাহার আলোচনা কখনই নিষ্প্রয়োজনীয় হইতে পারে না, পরন্তু প্রত্যেক মানব-হিতৈষীর পক্ষে তাহা সযত্নে অনুসরনীয়; যিনি সূক্ষ্মতর দার্শনিক প্রশ্নের আলোচনায় সুখানুভব করিতে শিখিয়াছেন, তিনি মানসিক উন্নতির সোপানে অনেক দূর উঠিয়াছেন, ......”
প্রবন্ধটি ৫টি সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম সংখ্যায় মুখ্যত: ভূমিকাটি আলোচিত হয়েছে। কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত করে আমরা বিষয়টির সঙ্গে পরিচিত হতে চেষ্টা করি।
“...... ধর্ম্মবিজ্ঞানের সহিত মায়াবাদের অতি নিকট সম্বন্ধ; আমরা প্রস্তাবের উপসংহারে দেখাইতে চেষ্টা করিব যে মায়াবাদের সাহায্য ব্যতীত ধর্ম্মবিজ্ঞানের কয়েকটি অতি জটিল অথচ গুরুতর প্রশ্নের মীমাংসা একেবারে অসম্ভব। ...... মায়াবাদ প্রথমতই সমুদয় জ্ঞানের আধার, সমুদয় চিন্তার আধার, সমুদয় সন্দেহ অবিশ্বাসের আধাররূপী মানবাত্মার প্রকৃত ও মূলগত (Substantial) অস্তিত্ব মানিয়া লন এবং অটল শৈলের উপর অন্যান্য মতের প্রতিষ্ঠা করেন। ইহা স্বীকার করিয়া অতঃপর বলেন যাহাকে ভৌতিক পদার্থ বলা হয়, যাহা আমরা চক্ষু কর্ণাদি ইন্দ্রিয় দ্বারা প্রত্যক্ষ করি, তাহার অস্তিত্ব আছে সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহার অস্তিত্ব জ্ঞান-নিরপেক্ষ নহে; তাহার অস্তিত্ব জ্ঞান হইতে স্বতন্ত্র নহে; তাহা জ্ঞানের উপর নির্ভর করে। দৃষ্ট বস্তু যতক্ষণ দৃষ্টির বিষয়, ততক্ষণই তাহার অস্তিত্ব; শ্রুতির অগোচরে, শ্রুতি-বিচ্যুত অবস্থায় তাহার অস্তিত্ব অসম্ভব। ......
...... পাঠক একটি কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন – তবে কি আমরা যখন জড় পদার্থ প্রত্যক্ষ না করি, তখন তাহা ধ্বংস হইয়া যায় ? না, তাহা নহে, জড় পদার্থের জ্ঞান-নিরপেক্ষ অস্তিত্ব অসম্ভব ইহা সত্য, কিন্তু মানবজ্ঞানই একমাত্র জ্ঞান নহে, আমরা যে সকল বস্তু দর্শন করিয়াছি, করিতেছি ও করিব, সমুদয়ই পরমাত্মার ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্ত্তমান-দর্শী চির জাগ্রত জ্ঞানের সম্মুখে বিরাজ করিতেছে। সুতরাং জড় পদার্থের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নাই বটে, কিন্তু পরমাত্মাতে তাহাদের অস্তিত্ব নিত্য, তারা ঈশ্বরের অনন্ত মনের চিরস্থায়ী সম্পত্তি; কেবল মানবাত্মার নিকট তাহাদের আবির্ভাব ও তিরোভাবই অনিত্য।
...... দর্শনানভিজ্ঞ ব্যক্তিরা মায়াবাদের সপক্ষে প্রদর্শিত যুক্তি আলোচনা করিবার পূর্ব্বেই ইহাকে একেবারে অসম্ভব অননুভবনীয় বলিয়া উড়াইয়া দেন; তাঁহারা বলেন মন হইতে সম্পূর্ণ পৃথক বাহ্যবস্তু না থাকিলে কি মনোমধ্যে ইন্দ্রিয়-গোচর বস্তুর অনুভূতি কখনও সম্ভব ? বহির্দ্দেশে বর্ণ না থাকিলে মনোমধ্যে বর্ণানুভূতি সম্ভব নহে, বহির্দ্দেশে শব্দ না থাকিলে শব্দানুভূতি অসম্ভব ইত্যাদি; সমুদয় ইন্দ্রিয় ব্যাপার সম্বন্ধেই এইরূপ। এরূপ সংস্কার যে নিতান্ত ভ্রমমূলক তাহা সহজেই দেখান যাইতে পারে। স্বপ্নাবস্থায় কি ঘটে একবার ভাবিয়া দেখ। মনে কর, পাঠক, স্বপ্নাবস্থায় দেখিতেছ তুমি নানা বর্ণে অনুরঞ্জিত একটি কল কল শব্দযুক্ত স্রোতস্বতী-তীরে অবস্থিত, সুগন্ধ পুষ্পোদ্যান-বেষ্টিত, রসনা তৃপ্তিকর নানা সুখাদ্য পরিপূর্ণ, স্পর্শসুখোৎপাদক নানা প্রকার আসন ও শয্যা-পরিশোভিত একটি মনোহর ভবনে উপবিষ্ট রহিয়াছ; এরূপ, অথবা অনেকাংশে এরূপ স্বপ্ন আমরা অনেক সময়েই দেখিয়া থাকি। সময়ে তোমার নিদ্রাভঙ্গ হইল, স্বপ্নের বিষয়ীভূত পদার্থ সমূহ বিশ্বাসের ভূমি হইতে দূরীভূত হইল। আচ্ছা, এখন বল দেখি, পাঠক, এই যে স্বপ্ন-দৃষ্ট মনোহর ভবন, যাহা ক্ষণকালের জন্য তোমার বিশ্বাসের রাজ্যে স্থান পাইয়াছিল – ইহা কি ? ইহা কি তোমার মন-বহির্ভূত কোন স্বতন্ত্র ভৌতিক পদার্থ ? নিতান্ত বুদ্ধিভ্রংশ না হইলে আর কে এই কথা বলিবে ? তবে ইহা কি ? বিন্দুমাত্র চিন্তা করিলেই বুঝিতে পারিবে, ইহা তোমার মনোমধ্যে সমুৎপন্ন ভাব পরম্পরা মাত্র, ক্ষণস্থায়ী মানসিক অবস্থা মাত্র। অতএব দেখ, তুমি যাহাকে প্রকৃত বাহ্যিক ভৌতিক পদার্থ বল, তাহার বর্ত্তমানতা ব্যতিরেকও প্রাকৃতিক নিয়মানুসারেই বল, আর ঈশ্বরেচ্ছানুসারেই বল, মনোমধ্যে বর্ণ, শব্দ, ঘ্রাণ, আস্বাদ, কঠিনতা, কোমলতা, বিস্তৃতি প্রভৃতি সমুদায় ভৌতিক বস্তুর অনুভূতি সম্ভব। তবে আর কেমন করিয়া বল, বাহ্য বস্তুর অবর্ত্তমানতায় ইন্দ্রিয়-জ্ঞান সম্ভবপর নহে ? ...... অতঃপর আমরা যুক্তিস্বারা দেখাইতে চেষ্টা করিব, যাহাকে আমরা বাহ্যবস্তু বলি তাহা মানসিক ভাব পরম্পরা ব্যতীত আর কিছুই নহে ......।”
প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত এর পরের রচনা ‘রামমোহন রায়ের ধর্ম্মবিষয়ক মত’ সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ব্যক্তি বিশেষের মতের সমর্থনে ও বিপক্ষে অনেক তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। দীর্ঘ কাল ধরে অনুসৃত হিন্দুধর্মের নানা গোঁড়ামি ও কর্মানুষ্ঠানের আচরণে প্রকরণে পুঞ্জীভূত কুসংস্কারকে দূরে সরিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন সর্বজনীন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা ও প্রচার করার প্রয়োজনীয়তার কথা হয়ত সে সময়ে শিক্ষিত সমাজের কিছু লোকের মনে হয়েছিল। রামমোহন এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। তবে প্রাসঙ্গিকভাবে একটা কথা উল্লেখ করা যেতেই পারে। ‘নব্যভারত’ সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায় চৌধুরী নিজে ব্রাহ্মমতালম্বী হয়েও ব্রাহ্মধর্মের ক্ষয়িষ্ণু প্রভাব ও জনপ্রিয়তা হারাবার কারণ অনুসন্ধানে এগিয়ে এসেছেন। পত্রিকায় প্রকাশিত ‘ব্রাহ্মসমাজের অবস্থা’ ও ‘এত দেশব্যাপী ব্রাহ্মবিদ্বেষের কারণ কি?’ শীর্ষক দু’টি প্রবন্ধে তিনি নিরপেক্ষভাবে এর কারণ বিশ্লেষণ করেছেন। একটা গোঁড়ামি দূর করতে গিয়ে অন্য এক গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেবার ফল ভাল হয় নি।
এর পরের প্রবন্ধ ‘সূর্য্য’ একটি বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা। অবশ্য সেকালের চিন্তাধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তিনি বিজ্ঞানের সঙ্গে শাস্ত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন –
“বর্ত্তমান বিজ্ঞান শাস্ত্র সূর্য্যের যে অপার মহিমা ও অপরিসীম শক্তির কথা ঘোষণা করিতেছেন, বৈদিক কাল সম্ভূত সূর্য্যোপাসক ব্রাহ্মণদিগের তাহা অবিদিত ছিল না। সৌরতেজেই যে জীবের উৎপত্তি ও পরিপুষ্টি হয়, এবং বস্তুমাত্রের গতিই যে ঐ তেজ সম্ভূত, বেদের অনেক স্থানে তাহার নির্দ্দেশ আছে।”
তবে বর্তমান সময়ের মত সে সময়ে ত বিজ্ঞানের এতটা অগ্রগতি হয় নি। অতএব বিজ্ঞানের বহুবিধ আলোচনা ১৩০ বছর আগের রচনায় স্থান পেলেও এখনকার পর্যবেক্ষণ স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বেশি তথ্যসমৃদ্ধ ও লব্ধ জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। সাহিত্য, ধর্ম ইত্যাদির সঙ্গে বিজ্ঞান আলোচনাও যে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সেটা বুঝতে পেরে বিভিন্ন রচনা প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার প্রয়াস অবশ্যই প্রশংসনীয়।
রজনীকান্ত গুপ্ত রচিত ‘সন্তোষ ক্ষেত্র’ নামক প্রবন্ধটি একটু ইতিহাস ঘেঁষা। ‘সন্তোষ ক্ষেত্র’ নামের সঙ্গে এ যুগের খুব কম লোকেরই পরিচয় আছে। রচনার কিছু অংশ –
“ খ্রীঃ সপ্তম শতাব্দীতে,-যখন মহারাজ হর্ষবর্ধন শিলাদিত্য কান্যকুব্জের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থাকিয়া পূর্ব্বে ও পশ্চিমে অনেক রাজ্য আপনার বিজয়-পতাকায় পরিশোভিত করিতেছিলেন, যখন মহাবীর পুলকেশ আপনার অসাধারণ ভূজবলের মহিমায় মহারাষ্ট্র রাজ্যের স্বাধীনতার গৌরব রক্ষা করিয়া আসিতেছিলেন, চীনদেশের চির-প্রসিদ্ধ দরিদ্র পরিব্রাজক যখন নালন্দার সঙ্ঘরামে জ্ঞানবৃদ্ধ শীলভদ্রের পাদতলে বসিয়া হিন্দু আর্য্য ঋষিগণের অপূর্ব্ব জ্ঞান গরিমার সৌন্দর্য্য-রসাস্বাদনে পরিতৃপ্ত হইতেছিলেন, তখন মহারাজ শিলাদিত্য গঙ্গাযমুনার সঙ্গমস্থল পবিত্র তীর্থ প্রয়াগে একটি মহোৎসবের অনুষ্ঠান করিতেন। প্রয়াগের পাঁচ ছয় মাইল বিস্তীর্ণ ভূমিখন্ড এই মহোৎসবের ক্ষেত্র ছিল। দীর্ঘকাল হইতে এই ভূমি “সন্তোষ ক্ষেত্র” নামে পরিচিত হইয়া আসিতেছিল। সন্তোষ-ক্ষেত্রের উৎসব প্রাচীন ভারতবর্ষের একটি প্রধান ঘটনা। এই ক্ষেত্রের চারি হাজার বর্গ ফিট পরিমিত ভূমি গোলাপ ফুলের গাছে পরিবেষ্টিত হইত। পরিবেষ্টিত স্থানের বৃহৎ বৃহৎ গৃহে স্বর্ণ ও রৌপ্য, কার্পাস ও রেসমের নানাবিধ বহুমূল্য পরিচ্ছদ এবং অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য স্তূপাকারে সজ্জিত থাকিত। এই বেষ্টিত স্থানের নিকটে ভোজন-গৃহ সকল বাজারের দোকানের ন্যায় শ্রেণীবদ্ধ ভাবে শোভা পাইত। এই সকল ভোজন-গৃহের এক একটিতে একবারে প্রায় সহস্র লোকের ভোজন হইতে পারিত। উৎসবের অনেক পূর্ব্বে সাধারণ্যে ঘোষণা দ্বারা ব্রাহ্মণ শমণ, নিরাশ্রয় দুঃখী, পিতৃ মাতৃহীন, আত্মীয় বন্ধুশূণ্য নিঃস্ব ব্যক্তিদিগকে নির্দ্দিষ্ট সময়ে পবিত্র প্রয়াগে আসিয়া দান গ্রহণের জন্য আহ্বান করা হইত। মহারাজ শিলাদিত্য আপনার মন্ত্রী ও করদ রাজগণের সহিত এইস্থানে উপস্থিত থাকিতেন। ......”
রচনাটিতে পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর কথাও উল্লেখিত হয়েছে –
“পবিত্র প্রয়াগে পবিত্র-স্বভাব চীন দেশীয় শ্রমণ হিউয়েনঙ্গসাঙ্গ এইরূপ মহোৎসব দেখিয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছিলেন। এইরূপ মহোৎসবের অনুষ্ঠান পূর্ব্বক ভারতের প্রাচীন নৃপতিগণ আপনাদিগকে অনন্ত সন্তোষ এবং অন্তিমে অনন্ত পুণ্যের অধিকারী বলিয়া বিবেচনা করিতেন।” .........
সময়ের সঙ্গে সব কিছুর পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী জেনেও আমরা প্রাচীন ধ্যান-ধারণা ও জীবনাচরণকে বহুদিনের সখ্যতা ও অভ্যাস বশতঃ আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই। ‘সন্তোষ ক্ষেত্রে’র লেখকরও এই আক্ষেপ যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। আবেগমথিত ভাষায় তিনি আখ্যানটির উপসংহার টেনেছেন এই ভাবে –
“যদি ভারতবর্ষ যবনের পর ইংরেজের পদানত না হইত, যদি বৈদেশিক সভ্যতা-স্রোত ভারতের একপ্রান্ত হইতে আর এক প্রান্তে গড়াইয়া না পড়িত, ভারতের সন্তানগণ যদি আপনাদের জাতীয়ভাব হইতে বিচ্যুত না হইত, তাহা হইলে বোধহয়,, আজও ভারতবর্ষ এই প্রাচীন আর্য্যকীর্ত্তির মহদাড়ম্বরে পরিপূর্ণ থাকিত এবং আজ এই অপূর্ব্ব দানশীলতার অপার মহিমায় ভারতের দুঃখ দারিদ্র্য অন্তর্হিত হইয়া যাইত। ভারতের দুরদৃষ্টবশতঃ এ অপূর্ব্ব দৃশ্য চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হইয়াছে। আজ কয়জন ভারতবাসী ইহার জন্য নীরবে নির্জ্জনে অশ্রুপাত করিয়া থাকেন ? কয়জনের হৃদয় এ অতীত স্মৃতির তীব্র দংশনে কাতর হইয়া পড়ে ? কে ইহার উত্তর দিবে ? প্রতিধ্বনি বিষণ্ণ মুখে জিজ্ঞাসা করিতেছে, কে উত্তর দিবে ?”
প্রথম সংখ্যার শেষ প্রবন্ধটি শিবনাথ শাস্ত্রী এম. এ. রচিত ‘স্বাধীনতা’। শিবনাথ শাস্ত্রী সেকালের ব্রাহ্মসমাজের একজন নাম করা ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাবিদ হিসাবে খ্যাত ছিলেন। এই প্রবন্ধটিতে তিনি স্বাধীনতার অর্থ, স্বাধীনতা কেন হারাতে হয়, জনসমাজ ব্যক্তিবিশেষের স্বাধীনতায় কতদূর হস্তেক্ষেপ করতে পারে ইত্যাদি বিষয় তিনটি সংখ্যায় আলোচনা করেছেন। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত অংশটি থেকে কিছু কিছু উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে প্রবন্ধটির গতিপথ কিছুটা অনুমান করা যাবে –
“ একদিন বসিয়া চিন্তা করিতেছিলাম, ইতিহাসে এমন ঘটনা কেন হইল যে, যে রোমানগণ একদিন স্বাধীনতা ও তেজস্বীতা গুণে জগতে অগ্রগণ্য ছিল, যাহাদের ভুজবলে এক সময়ে সমুদায় জাতি কম্পিত হইয়াছিল, যাহারা সতী লুক্রিশিয়ার মান হানির জন্য স্বীয় রাজাদিগকে জন্মের মত বিদায় করিল, যাহারা তৎপরে বহু শতাব্দী ব্যাপিয়া স্বায়ত্তশাসনের সুখ সম্ভোগ করিল, এরূপ কেন হইল যে, সেই রোমানগণ আবার অবশেষে সম্রাটদিগের যথেচ্ছাচারের শৃঙ্খল কণ্ঠে বহন করিতে প্রস্তুত হইল ? এটি একটি ইতিহাসের গভীর সমস্যা। ইহাকে সমস্যা বলি তাহার কারণ এই যে, ইহা দশদিন উপভোগ করিলে, ইহার প্রতি মমতা জন্মে। এরূপ মমতা জন্মে যে, তৎপরে লোকে বরং প্রাণ দিতে পারে কিন্তু স্বাধীনতা দিতে পারে না। ......
ইহা ইতিহাসের একটি অভ্রান্ত প্রমাণিত সত্য যে, সমাজের গঠনের মধ্যে, রক্ত মাংসের মধ্যে যদি দুর্ব্বলতার বীজ নিহিত না থাকে, তাহা হইলে কোন প্রকার আকস্মিক বা বাহ্যিক কারণে তাহাকে দুর্ব্বল করিতে পারে না। আমি দেখিতেছি রোম যখন শ্রীবৃদ্ধিশালী, রোম যখন পরম প্রতাপবান, রোম যখন ভুবনবিজয়ী, রোম যখন স্বাধীনতা ও মনুষ্যত্বের আদর্শ স্বরূপা, তখনও ওই সকল দুর্গতির বীজ রোমীয় সমাজ বক্ষে বিদ্যমান ছিল।
সে বীজ কি ? প্রথম বীজ এই যে, রোমে জাতিভেদ প্রথা ছিল, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র প্রভৃতি বর্ণভেদ ছিল না বটে, কিন্তু প্রেট্রীসিয় ও প্লিবীয় ছিল। ইহারা কে ? কিরূপে ইহাদের উৎপত্তি হইল ? রাজ্য মধ্যে ইহাদের ক্ষমতা ও অধিকারের সীমা নির্দ্দেশ কিরূপে হইতে ? এই উভয় শ্রেণীর মধ্যে সময়ে সময়ে বিবাদ ঘটনা হইয়া কিরূপ আন্দোলন ও পরিবর্ত্তন সকল সংঘটিত হইত ? তাহা এখন সবিশেষ উল্লেখ করিবার সময় নাই। ......
কিন্তু রোমের প্রতাপ ও সুখ সৌভাগ্যের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রোমীয় ধনিদের প্রভুত্ব বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তাহারা দরিদ্র প্লীবিয়দিগের প্রতি অত্যাচার করিতে আরম্ভ করিল। ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণগণ শূদ্রদিগের প্রতি যেরূপ অত্যাচার করিত, এ অত্যাচার কোন অংশে তাহা হইতে ন্যূন নহে। ধনিদিগের এই অত্যাচার কালক্রমে এত বৃদ্ধি পাইয়াছিল যে, খ্রীষ্টীয় নবম ও দশম শতাব্দীতে ইহা অসহ্য আকার ধারণ করিয়াছিল। অধিক কি, এই ধনিদিগের অত্যাচারে ইটালীর লোকদিগকে অস্থির হইতে হইয়াছিল। গীবন তাঁহার ইতিবৃত্তে ইটালীর ইতিহাস লেখকদিগের গ্রন্থাবলী হইতে যে সকল বর্ণনা উদ্ধৃত করিয়াছেন, তাহা পাঠ করিলে দৃষ্ট হয় যে, এই ধনীরা এক একজন স্বাধীন রাজার মত হইয়া পড়িয়াছিল, এক একজনের বহু সংখ্যক সৈন্য ও দাস থাকিত, ইহারা নিজ দলের রক্ষার জন্য দুর্গ নির্ম্মান করিত, সর্ব্বদাই পরস্পরের সহিত যুদ্ধ বিগ্রহ দাঙ্গা হাঙ্গামা রক্তপাতে প্রবৃত্ত হইত, যাত্রা, মহোৎসব বিবাহ প্রভৃতি উৎসবে জাঁক জমকের পরিসীমা রাখিত না; নদী হইতে জাহাজ সকল মারিয়া লইত এবং স্থলে ডাকাতি করিত ; ইহাদের উপদ্রবে সামান্য ও দরিদ্র লোকেরা সুখে নিদ্রা যাইতে পারিত না ; বল প্রয়োগদ্বারা দরিদ্রদিগকে স্বীয় দাসত্বে নিয়োগ করিত ; দরিদ্র প্লীবিয়দিগের কুল কন্যাদিগেরও মান সম্ভ্রম রক্ষা করিয়া চলা দুষ্কর হইত। এমন কি, ইহাদের দৌরাত্ম্যে পোপদিগকেও সশঙ্কিত হইয়া থাকিতে হইত।
পেট্রীসিয় ও প্লীবিয়দিগের এই জাতিভেদের ন্যায় দুর্গতির আর একটি বীজ কালক্রমে রোমীয় সমাজে নিহিত হইয়াছিল। রোমানগণ যখন বিদেশ অধিকার করিতে যাইতেন, তখন যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া বহুসংখ্যক লোককে বন্দী করিয়া আনিতেন। রণক্ষেত্রে পরাজিত ও বন্দীকৃত ব্যক্তিদিগকে দাসত্বে পরিণত করা প্রাচীন কালের সাধারণ রীতি ছিল। এই বন্দীকৃত দাসদিগকে রোমে আনিয়া বিক্রয় করা হইত এবং ধনবান ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ ইহাদিগকে ক্রয় করিয়া লইতেন। এক একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির আশ্রয়ে এমন দুই তিন শত বা ততোধিক দাস থাকিত এমন কি, দাসের সংখ্যা অনুসারে সমাজ মধ্যে ধনীদিগের সম্ভ্রমের তারতম্য হইত। ধনিগণ এই সকল ক্রীত দাসকে সর্ব্বপ্রকার শ্রমসাধ্য কার্য্যে নিযুক্ত করিতেন ; ইহাদের দ্বারা অশ্ব গো প্রভৃতির কার্য্য করাইতেন ; কোন প্রকার আনন্দ উৎসব উপস্থিত হইলে ইহাদিগের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধাইয়া দিয়া বন্ধুদিগকে কৌতুক দেখাইতেন ; কখনো কখনো সিংহ ব্যাঘ্র প্রভৃতি হিংস্র পশুদিগের মুখে ইহাদিগকে ফেলিয়া দিয়া রঙ্গ দেখিতেন। ইহাদের আর্তনাদে যখন নাটমন্দির কম্পিত হইত এবং ইহাদের রক্তে যখন উক্ত মন্দিরের প্রাঙ্গনভূমি সিক্ত হইত, তখন সমবেত দর্শকগণ পরম কৌতুক উপভোগ করিয়া আনন্দসূচক করতালি ধ্বনি করিত। ......
উপরে যে কারণ নির্ণিত হইল তাহাতে ইহাই উক্ত হইল যে জাতীয় মন হইতে স্বাধীনতা প্রবৃত্তি নির্ব্বাণ প্রাপ্ত না হইলে সে জাতির কণ্ঠে পরাধীনতা শৃঙ্খল দেওয়া সহজ নয়। কিন্তু স্বাধীনতা প্রবৃত্তি কাহাকে বলে ? মানুষ যখন মানুষকে দাসত্বে পরিণত করে, মানুষ যখন মানুষের স্বাধীনতা হরণ করে, তখন তাহার আচরণে কি প্রকাশ পায় ? সে আচরণের অর্থ এই, ও ব্যক্তি আমার সমান জগতের ধনধান্য ও সুখ সমৃদ্ধি ভোগে অধিকারী নয় ; আমার সুখের জন্য উহার সুখ বিসর্জ্জন করিতে হইবে ; আমি উহার অপেক্ষা বলবান বা ধনী, বা সদ্বংশ জাত, অতএব ও আমার সমশ্রেণী গণ্য জীব নয় ; আমি যদি মানুষ হই, ও ব্যক্তি মানুষ অপেক্ষা হীন ; যে ক্লেশ আমি পেলে অন্যায় হয়, সে ক্লেশ ও পেলে অন্যায় হয় না। সংক্ষেপে ও আমার ভাই নয়, সৃষ্টিকর্ত্তার চক্ষে আমার সমান নয়। অতএব সকল প্রকার পরাধীনতার মূলে দুইটি মহা সত্যের বিলোপ। প্রথম সত্য মানুষ মানুষের ভাই – দ্বিতীয় সত্য, মানুষের আত্মা একটি মহৎ বস্তু, ইহাকে ঈশ্বর যে সকল শক্তি সামর্থ্য দিয়াছেন তাহা হরণ করা বা তাহার পথ রোধ করা অপরের পক্ষে অকর্ত্তব্য। যে সমাজ মধ্যে জন্মগত, ধনগত, বাহুবলগত, ধর্ম্মগত, বা শাসনগত প্রাধান্য ঘটিত সামাজিক বা রাজনৈতিক অধিকারের তারতম্য থাকে, যে স্থানে এই কারণে জাতিভেদ থাকে, সেখানে উক্ত উভয় সত্য ক্রমে লোকের হৃদয় হইতে বিলুপ্ত হইয়া যায় ; এবং সমাজ বক্ষে পরাধীনতার বীজ নিহিত হয়।” ......
‘সাময়িক প্রসঙ্গ’ বিভাগে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া একটি বিভাগ ছিল ‘প্রাপ্ত গ্রন্থের সমালোচনা’। এখানে পত্রিকা দপ্তরে প্রেরিত গ্রন্থের সমালোচনা ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়া হত। তবে প্রতিটি বিভাগ যে সব সংখ্যাতেই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তা হয়ত নয়।
প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলির দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়া হল কারণ, এ থেকে হয় ত নির্বাচিত প্রবন্ধে ব্যবহৃত ভাষা, পত্রিকাটির চিন্তন মনন ও দিক-দর্শনের আভাস কিছুটা মিলবে। মুখ্যত: প্রবন্ধ-নির্ভর ‘নব্যভারতে’ প্রবন্ধের সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার। অধিকাংশ রচনাই ছিল চিন্তামূলক ও ভাবসমৃদ্ধ, তবে বিষয় বৈচিত্র্য অবশ্যই ছিল। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, শিক্ষা, ধর্ম, রাজনীতি, পুরাতত্ব, ভ্রমণ প্রভৃতি বিবিধ বিষয় আলোচনায় স্থান পেয়েছে। এখানে প্রকাশিত বিভিন্ন বিষয়ের কিছু কিছু রচনার নাম উল্লেখ করছি ; আলোচ্য বিষয় ও রচনার নাম থেকে হয়ত পত্রিকাটি সম্বন্ধে সামগ্রিক ভাবে একটা ধারণা গড়ে তোলা যাবে। তবে বিষয়ের বিভাজনটি নিখুঁত নয় অর্থাৎ ধর্ম বিষয়ক কোনও রচনাকে হয়ত দর্শন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা যেত। অন্যান্য বিভাগ সম্বন্ধেও এটা প্রযোজ্য।
‘সাহিত্য’
‘আনন্দমঠ’ (সমালোচনা), ‘চন্দ্রশেখর’ (সমালোচনা), ‘নভেলের শিল্প বা কবিত্ব’, ‘বঙ্গে সংস্কৃত চর্চ্চা’, ‘ইংরাজ শাসনে বঙ্গসাহিত্য’, ‘কড়ি ও কোমল’ (সমালোচনা), ‘বৈদিক সাহিত্য’, ‘মাইকেল মধুসূদনের কবিতায় জাতীয়তার অভাব কেন ?’, ‘কৃষ্ণচরিত সমালোচনা’, ‘বঙ্গসাহিত্যে নাটক সৃষ্টি’, ‘বাল্মীকি ও বেদব্যাস’, ‘বাংলা উপন্যাসের বিশেষত্ব’, ‘সাহিত্যের সাধারণতন্ত্র’, ‘দুর্গেশনন্দিনীর বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘ইতিহাসে কবিত্ব’, ‘বানান বিভ্রাট’, ‘মেঘদূত-উত্তরমেঘ’, ‘সাময়িক সাহিত্য’, ‘কলিকাতায় ইংরাজী চর্চ্চা’, ‘চতুর্দ্দশপদী কবিতা’, ‘জাতীয় সাহিত্য’, ‘বর্ত্তমান বঙ্গভাষা’, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য (সমালোচনা)’, ‘মুসলমান সাহিত্য’, ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’, ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ ইত্যাদি।
‘ধর্ম’
‘শাক্যচরিত, বৌদ্ধধর্ম্ম ও বৌদ্ধদর্শন’, ‘রামমোহন রায়ের ধর্ম্মবিষয়ক মত’, ‘ভারতে পৌত্তলিকতা’, ‘চৈতন্যচরিত ও চৈতন্যধর্ম্ম’, ‘পাশ্চাত্য শিক্ষা ও হিন্দুধর্ম্ম’, ‘পৌত্তলিকতা সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’, ‘ভক্তিসূত্র’, ‘পরাশর সংহিতা’, ‘গুরুবাদ ও প্রচারবাদ’, ‘ধর্ম্ম ও সমাজ’, ‘ধর্ম্ম ও নীতি’, ‘হিন্দুসমাজ ও ব্রাহ্মসমাজ’, ‘বঙ্গে জৈনসম্প্রদায়’, ‘বঙ্কিমচন্দ্র ও ব্রাহ্মধর্ম্ম’, ‘তত্ত্ববিচার ও অদ্বৈতমীমাংসা’, ‘ধর্ম্মবিশ্বাসের ক্রমবিকাশ’, ‘বিবেকানন্দ ও ব্রাহ্মসমাজ’, ‘অধ্যাত্ম ধর্ম্মের প্রকৃত ভিত্তি’, ‘কৃষ্ণভক্তি রসামৃতং’, ‘ইউরোপে দর্শন ও ধর্ম্ম প্রচার’, ‘ধর্ম্ম বিশ্বাসের ক্রমবিকাশ’, ‘সাকার ও নিরাকার উপাসনা’, ‘বৌদ্ধধর্ম্ম’, ‘খ্রীষ্ট ও তাঁহার ধর্ম্ম’, ‘ব্রাহ্মসমাজের অবস্থা’ ইত্যাদি।
‘দর্শন’>
‘ধর্ম্ম নীতি ও সমাজ’, ‘পাশ্চাত্য মায়াবাদ’, ‘যোগ’, ‘নাস্তিকতা’, ‘আমি-তত্ত্ব’, ‘আমি-রহস্য’, ‘ঈশ্বর বিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয়’, ‘উনবিংশ শতাব্দী ও ঈশ্বর বিশ্বাস’, ‘সাংখ্যদর্শন’, নূতনত্ব ও সৃষ্টিরহস্য’, ‘প্রার্থনাতত্ত্ব’, ‘বেদান্তসার’, ‘আত্মা ও অহংবৃত্তি’, ‘নিয়তি এবং কর্ত্তব্য কর্ম্ম’, ‘পুরুষকার’, ‘কারণবাদ ও পরমেশ্বরের অস্তিত্ত্ব’, ‘আত্মার স্বাধীনতা’, ‘জীবাত্মার বিবর্তনবাদ’, ‘বিজ্ঞান ও বিশ্বাস’, ‘ব্রহ্ম ও জগৎ’, ‘যোগদর্শনের চিত্ত’ ইত্যাদি।
‘শিক্ষা’
‘স্ত্রীজাতির উচ্চশিক্ষা-ইউরোপ’, ‘শিক্ষা’, ‘আর্য্যাবর্ত্তে বঙ্গমহিলা’, ‘স্ত্রী-শিক্ষা বিবরণ’, ‘নূতন শিক্ষা প্রণালীর প্রস্তাব’, ‘জাতীয় শিক্ষা সমস্যা’, ‘শিক্ষার ইতিহাস ও জাতীয় শিক্ষা পরিষৎ’, ‘ভারতবর্ষের প্রাচীন ও বর্ত্তমান শিক্ষা পদ্ধতি’, ‘আমাদের শিক্ষা ও সংগ্রাম’ ইত্যাদি।
‘বিজ্ঞান’
‘আকাশের তারা’, ‘সূর্য্য’, ‘জড়পদার্থের বল’, ‘বিজ্ঞানের উপকারিতা’, ‘আলোক ও দৃষ্টি’, ‘ভূ-পৃষ্ঠে পরিবর্ত্তন’, ‘পৃথিবীর বয়স কত ?’, ‘কয়লার খনি’, ‘পৃথিবীর উৎপত্তি’, ‘আইনস্টাইন ও বর’ [Bohr], ‘সভ্যতার বিকাশে বিজ্ঞান ও কলাবিদ্যা’, ‘গতিরহস্য’, ‘বায়ু’, ‘শনিগ্রহ’, ‘মঙ্গলগ্রহ’, ‘উদ্ভিদের চেতনাশক্তি’, ‘তরল বায়ু’ ইত্যাদি।
‘রাজনীতি / সমাজব্যবস্থা’
‘সামাজিক শাসন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা’, ‘জাতীয় আন্দোলন’, ‘হিন্দুসমাজের জাতিভেদ’, ‘জাতীয় পতন’, ‘সামাজিক ব্যাধি’, ‘সংস্কারকদিগের প্রতি’, ‘অবরোধ প্রথা’, ‘নব্যভারত ও রাজনীতি’, ‘নব্যবঙ্গ’, ‘বাল্যবিবাহ’, ‘যৌবনবিবাহ ও ব্রাহ্মসমাজ’, ‘হিন্দু সমাজের প্রাচীন ও আধুনিক অবস্থা’, ‘প্রজাশক্তি ও রাজশক্তি’, ‘মহারাষ্ট্রীয়দিগের আচার ব্যবহার’, ‘ইংরাজ শাসনাধীনে ভারতের আর্থিক অবস্থা’, ‘আরঙ্গজীবের রাজনীতি’, ‘বিধবা বিবাহ’, ‘ভারত সমাজ’, ‘আদিশূর ও বঙ্গীয় কায়স্থা সমাজ’, ‘জাতীয় চরিত্র গঠন’, ‘বিদ্যাসাগরের অপ্রকাশিত ও বিধবা বিবাহের প্রথম পাতি’, ‘জাতীয় উন্নতির উপায়’, ‘সমাজ ব্যাধির চিকিৎসা’, ‘ব্রাহ্ম বিবাহ বিধি’, ‘ইংরাজ রাজ ও আমরা’, ‘প্রাচীন আর্য্য সমাজ’, ‘বিবেকানন্দ ও ব্রাহ্মসমাজ’, ‘জমীদারদের রাজত্ব’, ‘জমীদারগণ সাবধান!’, ‘দেশীয় শিল্প’, ‘কৃষিকার্য্যের উন্নতি’, ‘যুগ সমস্যা’ ইত্যাদি।
‘ইতিহাস’
‘কলিকাতা দুইশত বৎসর পূর্ব্বে’, ‘ইতিহাসে নাস্তিকতা’, ‘প্রাচীন আর্য্যসমাজ’, ‘দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ’, ‘প্রাচীনতত্ত্ব’, ‘আর্য্যাবর্ত্তে বঙ্গমহিলা’, ‘আয়ুর্ব্বেদ ও ভারতবর্ষ’, ‘বৌদ্ধযুগে নারীর স্থান’, ‘কালের তরঙ্গাঘাতে নব্য ভারত’, ‘নেপালের পুরাতত্ত্ব’, ‘বুয়র যুদ্ধ’, ‘কুকিদিগের বিবরণ’, ‘ঢাকার পুরাতন কাহিনী’, ‘হিন্দু আর্য্যদিগের প্রাচীন ইতিহাস’, ‘ইতিহাস শিক্ষা’, ‘প্রাচীন ভারতের অবনতি’, ‘মগধের রাজবংশ’, ‘যুধিষ্ঠিরের কালনির্ণয়’, ‘তমোলুকের ইতিহাস’, ‘ভারতীয় ইতিহাসের একাংশ’, ‘ইউরোপীয় সভ্যতার ইতিহাস’, ‘প্রাচীন ভারতের সাম্রাজ্যবাদ’, ‘চীন ও জাপানে ভারতের বাণী’ ইত্যাদি।
‘জীবনী’
ভক্ত কেশবচন্দ্র’, ‘শঙ্করাচার্য্য’, ‘জ্ঞানী কার্লাইল’, ‘তুকারাম ও রামপ্রসাদ’, ‘ভবভূতি’, ‘মহাত্মা অক্ষয়কুমার দত্ত’, ‘রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র’, ‘জন লক’, ‘কুমারিল ভট্ট ও শঙ্করাচার্য্য’, ‘স্বদেশপ্রেমিক কবি দ্বিজেন্দ্রলাল’, ‘শ্রীমৎসনাতন ও শ্রীমৎরূপগোস্বামী’, ‘স্বর্গীয় মহাত্মা কিশোরীলাল রায়’, ‘দীন-জননী মহারাণী স্বর্ণময়ী’, ‘অকৃত্রিম দেশনায়ক-বাল গঙ্গাধর তিলক’, ‘মধ্বাচার্য্য’, ‘স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়’ ইত্যাদি।
‘ভ্রমণ / বিবিধ’
‘আন্ডামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসী’, ‘প্রেম কি উন্মত্ততা ?’, ‘সভ্যতা’, ‘আমাদিগের বিবাহ প্রণালী’, ‘বাঙ্গালীর ইতালী ভ্রমণ’, ‘বাঙ্গালীর ইউরোপ দর্শন’, ‘তীর্থদর্শন ও দেশ ভ্রমণ’, ‘বিলাতের পল্লীজীবন’, ‘বাঙ্গালীর খাদ্য – আমিষ ভক্ষণ’, ‘বোম্বে ও পুণা ভ্রমণ’, ‘সঙ্গীত বিদ্যার প্রয়োজনীয়তা’, ‘যাত্রা ও থিয়েটার’, ‘নিরামিষ ও আমিষ ভোজন’, ‘উৎকল ভ্রমণ’, ‘স্নান সম্বন্ধে দু একটি কথা’, ‘বাঙ্গালীর স্বাস্থ্য’, ‘অভিনয়ের উপযোগিতা’, ‘কাশ্মীর’, ‘দার্জ্জিলিং’, ‘বিশ্বভারতী’, ‘ভারতবর্ষের মূর্ত্তিশিল্প’, ‘রবি সম্বর্দ্ধনা’, ‘ভারতে দুর্ভিক্ষ’, ‘সৌন্দর্য্য ও শ্লীলতা’, ‘খাদ্য’, ‘পঞ্চনদ প্রদেশ’, ‘বিলাতে বড়দিন’, ‘চাঁদনীর চিকিৎসা’, ‘দক্ষিণ-ভ্রমণ’, ‘মহাত্মাগান্ধীর পত্র’, ‘অজন্তা’ ইত্যাদি।
‘নব্যভারত’ মুখ্যতঃ প্রবন্ধ-নির্ভর হলেও এখানে পদ্য প্রকাশিত হয়েছে বেশ কয়েকটি। রচনা করেছেন – দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, গোবিন্দচন্দ্র দাস, চন্দ্রকান্ত সেন, আনন্দচন্দ্র মিত্র, বিষ্ণুচরণ চট্টোপাধ্যায়, বরদাচরণ মিত্র, অটলবিহারী সিংহ, অক্ষয়কুমার বড়াল, কিশরীলাল গুপ্ত, হেমনাথ মিত্র প্রমুখ।
উপন্যাস বেরিয়েছে খুবই কম। চোখে পড়েছে প্রথম সংখ্যাতে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত সম্পাদকের লেখা ‘নবলীলা’ এবং ৩য় সংখ্যায় ধারাবাহিক কিন্তু লেখকের নাম হীন ‘ইন্দুবালা’।
দেবীপ্রসন্ন রায় চৌধুরী দীর্ঘ প্রায় ৩৮ বছর যোগ্যতার সঙ্গে ‘নব্যভারত’ সম্পাদনা করেছেন। প্রতি সংখ্যায় বহুসংখ্যক প্রবন্ধ প্রকাশ করে এত দীর্ঘ সময় পাঠকসমাজের আনুকূল্য লাভ করা কম কৃতিত্বের কথা নয়। ১৩২৭ সালের আশ্বিন সংখ্যা পর্যন্ত তিনি সম্পাদকের কাজ করেছেন। ১৮ই আশ্বিন তিনি প্রয়াত হন। ১৩২৭-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যার শেষে এবং পৌষ সংখ্যায় বহু লেখক তাদের রচনার মাধ্যমে দেবীপ্রসন্নের স্মৃতিচারণ সহ তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ অর্পন করেছেন। পরবর্তী সম্পাদক হয়েছিলেন দেবীপ্রসন্নের একমাত্র পুত্র প্রভাতকুসুম রায় চৌধুরী। দুর্ভাগ্যবশতঃ এক বছর পূর্ণ হবার আগেই ১৩২৮-এর ১২ই ভাদ্র তিনিও লোকান্তরিত হন। সেই বছরেই পত্রিকার আশ্বিন-কার্ত্তিক যুগ্মসংখ্যা বেরোয় এবং সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রভাতকুসুমের স্ত্রী ফুল্লনলিনী দেবী। প্রকাশনার ৪৩ বছর পূর্ণ করে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসেই প্রকাশিত হয় ‘নব্যভারতে’র শেষ সংখ্যা। সাহিত্যাকাশে ‘নব্যভারত’ অবশ্যই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মত বিরাজ করবে।
সংযোজন-
চিত্র – ১ : পত্রিকার একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র।
চিত্র – ২ : পত্রিকায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।