অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

মে ৩০, ২০১৭

 

কেদারনাথ, আরতি ও সৌরভ

দীপক সেনগুপ্ত

এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি সাময়িক পত্রের আলোচনা করা হয়েছে। এর প্রায় সবকটিই কলকাতা বা তার উপকন্ঠ থেকে প্রকাশিত। পূর্বে আলোচিত ‘অঞ্জলি’ প্রকাশিত হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। বর্তমানের আলোচ্য পত্রিকা দুটির প্রকাশস্থল অবিভক্ত বঙ্গভূমির ময়মনসিংহ। উদ্যোক্তা ছিলেন কেদারনাথ মজুমদার, যিনি সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে এক গৌরবোজ্বল ব্যক্তিত্ব। সাহিত্য ছিল তার ধ্যান জ্ঞান। ১২৭৭ বঙ্গাব্দের ২৬শে জ্যৈষ্ঠ ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ মহকুমার কাপাসাটিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা লোকনাথ মজুমদার ও মা জয়দুর্গা দেবী। কেদারনাথের সাহিত্য প্রীতির মূলে ছিলেন তাঁর বাবা-মা। বাবার ছিল নিজস্ব একটি লাইব্রেরি। এই গ্রন্থাগারের সংস্পর্শে এসেই বই পড়ার নেশা তৈরি হয় কেদারনাথের। তাঁর আগ্রহ ছিল বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তৃত।

গ্রামের পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে কেদারনাথ ময়মনসিংহ শহরে মামার বাড়িতে চলে আসেন এবং ভর্তি হন নাসিরাবাদ এন্ট্রান্স স্কুলে। এখানেই তিনি সংস্পর্শে আসেন হেড পণ্ডিত উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্নের। পুরাকালের ইতিহাস ও পুরাতত্বের উপর স্বাভাবিক আগ্রহ ছিল কেদারনাথের। বিদ্যারত্ন মহাশয়ের এসব বিষয়ে গভীর জ্ঞান কেদারনাথের আগ্রহ আরও বাড়িয়ে তোলে। পরবর্তী কালে কেদারনাথ যে রামায়ণের সমাজ ও তৎকালীন সভ্যতা সম্বন্ধে গবেষণা করেছিলেন তার মূলে ছিল এই পণ্ডিতের প্রত্যক্ষ প্রভাব।

স্কুলের পাঠ্য বিষয়ে কেদারনাথের বিশেষ আগ্রহ ছিল না। তিনি পিছনের বেঞ্চে বসে সাহিত্য রচনায় ব্যস্ত থাকতেন। নদী অধ্যুষিত দেশে (এখনকার বাংলাদেশ) প্রায় প্রতি বছরই বন্যা ছিল একটা স্বাভাবিক ঘটনা। একটা সময় জলদস্যু ও মগের অত্যাচার ছিল অবর্ণনীয়। বন্যার জলে ভেসে যাওয়া বা নদীর ঘাটে স্নানরতা মেয়েদের তুলে নিয়ে যেত এই দুর্বৃত্তরা, অনেক সময় বিক্রিও করে দিত এদের। এদের বলা হত ‘ভরার মেয়ে’। এই সব মেয়েদের উপজীব্য করে বহু গল্প কাহিনী রচিত হয়েছে। ১৮৭৭ সালে নোয়াখালি জেলা প্রচন্ড জলপ্লাবনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই স্মৃতি ও মানুষের দুর্দ্দশা কেদারনাথকে গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছিল। ১৮৮৮ সালে স্কুলের ছাত্র অবস্থাতেই ‘ভরার মেয়ে’র কাহিনী নিয়ে একখানি উপন্যাস লিখে ফেললেন কেদারনাথ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’র ‘প্রফুল্ল’র অনুকরণে তিনি উপন্যাসটির নামকরণ করেন ‘প্রফুল্ল’। পরে যখন ‘সৌরভ’ পত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয় তখন নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘স্রোতের ফুল’ ; অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত নাম সন্দেহ নেই।

অল্প বয়স থেকেই কেদারনাথের সাময়িক পত্রিকা প্রকাশের ঝোঁক ছিল। সেসময়ে কলকাতার ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত ‘বালক’ পত্রিকার দ্বারা প্রাণিত হয়ে তিনি ‘কুমার’ নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন। তখন তিনি জেলা স্কুলের সপ্তম কি অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের বাঁধা-ধরা পাঠক্রম কেদারনাথের পছন্দ হয় নি। তাঁর আগ্রহ ছিল পাঠ্য বহির্ভূত একাধিক বিষয়ে। শ্রীনাথ চন্দ তাঁর আত্মজীবনীমূলক ‘ব্রাহ্মসমাজে চল্লিশ বৎসর’ গ্রন্থটিতে কেদারনাথ সম্বন্ধে লিখেছেন – “ছাত্রজীবনেই এভাবে সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত হয়ে ও সামাজিক গ্রন্থ পাঠ করতে করতে স্বাধীনভাবে জ্ঞানার্জন-স্পৃহা তাঁর এতই বেড়ে গিয়েছিল যে, স্কুলের গন্ডীঘেরা জীবন তাঁর কাছে অসহ্য হয়ে উঠলো। শেষ পর্য্যন্ত ১৮৮৯ সালে এন্ত্রান্স পরীক্ষা দিয়েই স্কুল ছেড়ে দিলেন, আর কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের চৌকাঠ তিনি মাড়ান নি।”

কেদারনাথ যখন জেলা স্কুলে পড়তেন তখন সেখানে ‘মনোরঞ্জিকা ক্লাব’ নামে একটি সংগঠন ছিল। ১৮৬৭ সাল নাগাদ আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর পিতা ভগবানচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে ময়মনসিংহে ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়, ‘মনোরঞ্জিকা ক্লাব’টি ছিল এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। এই ক্লাবে স্কুলের সেরা ছাত্রদের সঙ্গে অনেক লেখক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যোগদান করতেন। কেদারনাথ নিজে ব্রাহ্মসমাজে যোগদান না করলেও বহু বিদগ্ধ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে নিজের মনকে যুক্তিনিষ্ঠ ও পরিশীলিত করে গড়ে তুলেছিলেন। মনের উপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ কত দৃঢ় ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রিয় কন্যা আরতির মৃত্যুর ঘটনায়। চন্দ্রকুমার দে লিখেছেন – “অতিমাত্র শোকেও আমি কখনও তাঁকে বিচলিত হতে দেখি নাই। তাঁহার কন্যা ‘আরতি’ যেদিন মারা যায়, সেদিন আমি তাঁর বাসায় ছিলাম। সৌরভ কার্য্যালয়ে বসিয়া দুইজনে প্রুফ দেখিতেছি, এমন সময় একজন আসিয়া বলিল আরতিকে বাহিরে রাখিয়া আসিয়াছি একবার দেখে যান। কেদারনাথ অবিচলিতভাবে বলিলেন, আর দেখে কি হবে নিয়ে যাও। এই আরতিকে তিনি প্রাণের চেয়ে ভালবাসিতেন হৃদয়ের সমস্ত জ্বালা চাপিয়া রাখিয়া অশ্রুকে নিরুদ্ধ করিতে এমন মানুষ আমি এই প্রথম দেখিলাম। ভিতর বাড়ীটা বুকফাটা হাহাকারে ভাঙ্গিয়া যাইবার মত হইতেছিল। কিন্তু কেদারনাথ অবিচলিত; সংসারের সুখ দুঃখের ধূলাখেলাটাকে তিনি এমনই উপেক্ষা করিতে শিখিয়াছিলেন।” তাঁর পুত্র সৌরভের মৃত্যুতেও তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হন নি। কন্যা ও পুত্রের নামেই তিনি প্রকাশ করেছিলেন দুটি মাসিক পত্রিকা ‘আরতি’ ও ‘সৌরভ’।

কেদারনাথের ইচ্ছা ছিল প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটা সাহিত্য-সঙ্ঘ গড়ে উঠুক। আনন্দমোহন কলেজের ছাত্ররা ‘সারস্বত সাহিত্য সঙ্ঘ’ তৈরি করতে উদ্যোগী হলে কেদারনাথ সক্রিয়ভাবে তাদের সাহায্য করেছিলেন। সাহিত্য সাধনায় তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল – (১) সাহিত্য সঙ্ঘ গড়ে তুলে সাহিত্যালোচনা করা (২) পত্রিকা প্রকাশ করা ও নতুন লেখক গোষ্ঠি তৈরি করা (৩) পুরাকীর্তি ও প্রাচীন সাহিত্যের উদ্ধার ও সংরক্ষণ। এই উদ্দেশ্য সফল করতে তিনি আজীবন নিরলস চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। সাহিত্য চর্চায় পারিবারিক দুর্ভোগ ছাড়াও আর একটি অন্তরায় ছিল কেদারনাথের ব্যাধিক্লিষ্ট শরীর। তিনি প্রায় আজীবন শারীরিক কষ্ট ভোগ করেছেন, কিন্তু অসাধারণ ছিল তাঁর মনের জোর ও সাহিত্য স্পৃহা। এত প্রতিকূলতা সত্বেও তিনি সারা জীবন সাহিত্য সেবা করে গিয়েছেন। কেদারনাথের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য’। এই মূল্যবান গ্রন্থটিতে শিক্ষা, সাহিত্য, সংবাদপত্র, মুদ্রণ ব্যবস্থা, ডাক ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে বহু জ্ঞাতব্য তথ্য সংগৃহীত ও লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রাসঙ্গিক বিষয়ে সে যুগের ইতিহাস রচনায় এগুলি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসাবে নিশ্চিত ভাবে গণ্য হতে পারে। বইটির দুটি অংশ। প্রথম অংশে রয়েছে ছ’টি অধ্যায়। সূচনা অংশে রয়েছে – বাঙ্গালা সাময়িক পত্রের প্রচারকাল, বিভিন্ন দেশের পত্রিকার সংখ্যা, ভারত, ইটালি ও ইংল্যান্ডের সংবাদপত্র, বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্যের প্রভাব ইতাদি। অন্যান্য অধ্যায়ে রয়েছে – মিশনারি যুগের বাঙ্গালা মুদ্রিত গ্রন্থ (১ম অধ্যায়); কোম্পানির আমলে দেশীয় শিক্ষার অবস্থা ও ব্যবস্থা (২য় অধ্যায়); বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্যের ক্রমবিকাশ ও বঙ্গসমাজ (৩য় অধ্যায়); বাঙ্গালায় ইংরেজি সংবাদপত্রের জীবন সংগ্রাম (৪র্থ অধ্যায়); সাহিত্য প্রচারে প্রাচীন রাজবিধি (৫ম অধ্যায়); সেকালের ডাকের ব্যবস্থা ও মফসসলের সাময়িকপত্র (৬ষ্ঠ অধ্যায়)। বইয়ের দ্বিতীয় অংশে রয়েছে বেশ কয়েকটি সাময়িক পত্রের বিবরণ (দিগদর্শন, ব্রাহ্মণ সেবধি, সংবাদ প্রভাকর, সংবাদ ভাস্কর, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রভৃতি)। এ ছাড়াও বন্ধুদের আগ্রহাতিশয্যে ‘রামায়ণের সমাজ’ রচনা করতে শুরু করেন। এই গ্রন্থের উপাদান ও তথ্য সংগ্রহে তাকে দীর্ঘ সময় ধরে বহু পত্র-পত্রিকা ও বই ঘাঁটতে হয়েছে, গবেষণা চালাতে হয়েছে। এটি তাঁর রচনাবলীর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। ‘রামায়ণের সমাজ’ সম্বন্ধে ড: দিলীপ মজুমদারের মন্তব্য – “কেদারনাথের এই সুবিশাল গ্রন্থ দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে কাব্য ও কবির পরিচয় – রামায়ণ আদি কাব্য ও বাল্মীকি আদি কবি কিনা – রামায়ণের সমাজ ও কবির সমসাময়িকতা – ছন্দ ও রচনা রীতি – আর্ষ প্রয়োগ – বাল্মীকির রচনার পরিমাণ – প্রক্ষিপ্ত রচনা ও তার মূল্যায়ন – রামায়ণ কথার প্রচার – প্রভৃতির আলোচনা আছে কয়েকটি অধ্যায়ে। দ্বিতীয় ভাগের সাতটি অধ্যায়ে আছে রামায়ণের ঐতিহাসিকতা, সমাজধর্ম, সামাজিক ক্রিয়া ও অনুষ্ঠান, সমাজের দেবতা, খাদ্য সামগ্রী, সামাজিক নিয়ম ও লৌকিক আচরণ, শাস্ত্রানুশাসন প্রভৃতি।”

সারাজীবন শোক, অশান্তি ও ব্যাধির সঙ্গে সংগ্রাম করে কেদারনাথ সাহিত্য চর্চা চালিয়ে গেছেন। এই স্থিতধী পুরুষের মৃত্যু হয় ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের ৬ই জ্যৈষ্ঠ। কেদারনাথের শেষ সময়ের এক মর্মস্পর্শী বিবরণ দিয়েছেন সুরজিৎ দাস – “মৃত্যুর ঠিক একুশ ঘন্টা আগে আমি তাঁকে দেখে গেছি। অর্দ্ধ উলঙ্গ অবস্থায় বিছানায় পড়ে ছটফট করছেন, তাঁর সেই পঙ্গু হাতখানা বুকে বুলাচ্ছেন আর যন্ত্রণায় আর্ত্তনাদ করছেন। আমার গলা শুনে ঘোলা চোখ দু’টো দিয়ে আমার দিকে তাকালেন; বোধ হ’লো চিনতে পারলেন না। চলে এলাম; পরদিন শুনলাম তাঁর সর্ব্ব যন্ত্রণার অবসান হয়েছে।”

আরতি

চিত্র ১– ‘আরতি’ পত্রিকার আখ্যাপত্রের প্রতিলিপি

‘আরতি’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩০৭ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে। সম্পাদক ছিলেন উমেশ চন্দ্র বিদ্যারত্ন। কেদারনাথ মজুমদারের তত্ত্বাবধানে এর আগে ‘কুমার’ নামে পত্রিকা বেরিয়েছিল ১২৯৪ সালে, যদিও সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। পত্রিকা প্রকাশনায় কেদারনাথের উদ্দেশ্য ছিল আরও বেশি সংখ্যক মানুষের মনে সাহিত্যপ্রীতি জাগিয়ে তোলা এবং নতুন লেখক গোষ্ঠি তৈরি করা। একজন সাহিত্য সেবক হিসাবে কেদারনাথ এটাকে তাঁর কর্তব্য বলে মনে করতেন। পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন উমেশ চন্দ্র তবে প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার শুরুতেই ‘অবতরণিকা’ অংশটি সম্ভবত কেদারনাথই লিখেছেন। এটি খুব দীর্ঘ নয়, এখানে সম্পূর্ণটাই উদ্ধৃত হল -

“ মাতৃপূজায় “আরতির” শঙ্খ-ঘন্টা ধ্বনিত হইতে চলিল। অর্চনোপযোগী উপাচার-সংগ্রহে “আরতি” কতদূর কৃতিকার্য্য হইয়াছে, এবং যে ক্ষেত্রে ভারতী, নব্যভারত, সাহিত্য প্রভৃতি মাতৃ সেবায় দেহ-মন উৎসর্গ করিয়াছেন, সে ক্ষেত্রে “আরতির” ক্ষুদ্র শক্তি সংযোগের কিছুমাত্র আবশ্যকতা আছে কি না, ইত্যাদি বিষয় ভাবিবার অবসর হয় নাই। আত্মবলের গুরুত্ব ও তাঁর কার্য্যকারিতাশক্তি পরিমাপ না করিয়া এ দুরূঢ় কার্য্যে অগ্রসর হওয়ার প্রয়োজন কি ? এ প্রাংশু লভ্য ফলে বামন কেন উদ্বাহু হইতেছে ? এ প্রশ্ন উত্থিত হইতে পারে, তাহার উত্তর নাই – কর্ত্তব্য জ্ঞানের উন্মাদিনী শক্তি অতীব বিস্ময়কর। সে শক্তিতে অনুপ্রাণিত হইলে উদ্দেশ্য পথে প্রধাবিত হওয়া ভিন্ন গত্যন্তর নাই। আপনার শক্তি কতটুকু এবং তাহা কার্য্যসিদ্ধির অনুকূলতা সম্পাদনে কতদূর কৃতকার্য্য হইবে, ভাবিবার অবসর থাকে না। সেইজন্যই রাঘব-শ্রেষ্ঠ রামচন্দ্রের সাগরবন্ধনব্যাপারে ক্ষুদ্রদেহ “কাষ্ঠমার্জ্জার” আপনার ক্ষুদ্রশক্তি টুকু সংযোগ করিতে ব্যাকুল হৃদয়ে অগ্রসর হইয়াছিল।

“ জিজ্ঞাস্য হইতে পারে, যে স্থানে “বঙ্গদর্শন” “বান্ধব” “আর্য্যদর্শন” প্রভৃতি বীরপূঙ্গবগণ, প্রতিযোগিতার প্রচন্ড আঘাতে ধরাশায়ী হইলেন, সে স্থানে ক্ষুদ্রাবয়বা ক্ষুদ্রশক্তি “আরতির” অধিষ্ঠান কতক্ষণ সম্ভবে ? এ কথার উত্তরে বলিব – মানবদেহ, কর্ম্মদেহ এবং এ সংসার তার কর্ম্মক্ষেত্র। এ কর্ম্মক্ষেত্রে আসিয়া যে ব্যক্তি, স্বীয় শক্তি কর্ত্তব্যানুষ্ঠানে নিযুক্ত করিতে না পারিলে তাহার জীবন পশু জীবনের সঙ্গেও তুলনীয় নহে। কর্ত্তব্যকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া অধিকদূর অগ্রসর হওয়া সাধ্যায়ত্ত না হউক, তাহাতে লজ্জা অথবা পরিতাপের বিষয় কিছুই নাই। যাহার যে বিষয়িণী শক্তি যত টুকুই থাকুক না কেন, জগতের হিতকার্য্যে তাহা নিয়োজিত করিতে পারিলেই তাহার কর্ত্তব্য ও সার্থকতা সম্পাদিত হইল। তবে “যত্নে কৃতে যদি ন সিধ্যতি কোঽত্র দোষঃ ?”

“ এ সংসারটা ভোগ করার জন্য কেহই মৌরশীপাট্টা লইয়া ভূমিষ্ঠ হয় নাই। জাতবস্তু মাত্রেরই অস্তিত্ব লোপ পাইবে। জন্ম হইলেই মৃত্যু হইবে, সংযোগ হইলেই বিয়োগ ঘটিবে, প্রকৃতির এ ধর্ম্ম সর্ব্বথাই অবশ্যম্ভাবী। বাত্যার তাড়নায় জলে বুদ্বুদ উঠে আবার জলেই লয় পায়। কর্ত্তব্য-জ্ঞানের তাড়নায় সময়ের স্রোতোজলে “আরতি” বুদ্বুদ ফুটিয়াছে, বাঙ্গলার জলবায়ু যতদিন স্বাথ্যের অনুকূল থাকিবে ততদিন “আরতি” সাধ্যানুসারে জাতীয় সাহিত্যের সেবা করিতে ত্রুটি করিবে না। স্বাস্থ্য ভগ্ন হইলে, আয়ুষ্কাল পূর্ণ হইয়া আসিলে, “আরতি” নীরবে আবার সময়ের কোলে মিলিয়া যাইবে ; ইহাতে লজ্জা অথবা পরিতাপের বিষয় কি? “আরতির” জীবনের সঙ্গে সঙ্গে কর্ত্তব্যের পরিসমাপ্তি ভাবিয়া আমরাও আশ্বস্ত হৃদয়ে অবসর গ্রহণ করিব।

“ ভগবন্নাম উচ্চারণ করিতে করিতে আজ কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলাম। সফলতার গিরিদুর্গে জয় বৈজয়ন্তী উড্ডীন করিতে সমর্থ হইব কিনা জানি না, জানিতে বাসনাও নাই। কর্ত্তব্যজ্ঞানে খাটিতে আসিয়াছি, খাটিয়া যাইব। ফলদাতা স্বয়ং ভগবান।”

‘আরতি’ পত্রিকাটির কতগুলি বৈশিষ্ট্য দেখে নেওয়া যাক। ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই সেই অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কিত বহু রচনা পত্রিকায় স্থান পেয়েছে। বহু সংখ্যক কবিতাও প্রকাশিত হয়েছে, বিশেষ করে প্রথম বর্ষে। কবিদের মধ্যে রয়েছেন বেশ কিছু মহিলা। কেদারনাথ নিজে ইতিহাস, পুরাণ ও পুরাতত্ত্বে আগ্রহী হওয়ায় এ বিষয়ক বহু রচনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সামাগ্রিক ভাবে গল্প, উপন্যাস ও কবিতার চেয়ে প্রবন্ধের সংখ্যা বেশি। ভ্রমণ কাহিনীও বেশ কিছু রয়েছে। তবে এর অনেকগুলিই ইতিহাস ঘেঁষা।

কবিতা লিখেছেন – শ্রীশ্রীনাথ চন্দ, মনোমোহন সেন, হরি প্রসন্ন দাসগুপ্ত, মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য, রমণীমোহন ঘোষ, মহীন্দ্র মোহন চন্দ, দীনেশ চন্দ্র চৌধুরী, সুরুচিবালা দাস গুপ্তা, সুরমাসুন্দরী ঘোষ, উপেন্দ্রচন্দ্র রায়, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, বিজয়চন্দ্র মজুমদার বি. এ., চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বি. এ., কুমার সুরেশচন্দ্র সিংহ, মহারাজ কুমুদচন্দ্র সিংহ বি. এ., যতীন্দ্রনাথ মজুমদার, বিনয় কুমারী ধর, সুভাষিণী দেবী, বিন্দুবাসিনী সরকার, কুমুদরঞ্জন মল্লিক, আশালতা গুপ্তা, সরোজকুমারী দেবী, উষা প্রমোদিনী বসু, যতীন্দ্রনাথ মজুমদার, কেদারনাথ মজুমদার, হেমচন্দ্র চক্রবর্ত্তী, কিশোরীমোহন মুখোপাধ্যায়, জীবেন্দ্রকুমার দত্ত, অম্বুজাসুন্দরী দাস, কুমারী সুনীতিবালা প্রমুখ।

গল্প তুলনামূলক ভাবে কমই বেরিয়েছে। লেখকদের মধ্যে রয়েছেন – কেদারনাথ মজুমদার, রজনীকান্ত চৌধুরী, শ্রীশ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জ্ঞানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, পাঁচকড়ি দে, রাজেন্দ্রলাল আচার্য্য বি. এ., সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার বি. এ., বসন্তকুমার পাল এম. এ. বি. এল., সরোজনাথ ঘোষ প্রভৃতি।

বেশ কয়েকটি ধারাবাহিক রচনা প্রকাশিত হয়েছে ‘আরতি’তে। এখানে লেখকের নাম ও প্রথম অংশ প্রকাশের সংখ্যা সহ কয়েকটির উল্লেখ করা যেতে পারে – ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত (মাঘ ১৩০৭), ‘বাংলার কার্পাস শিল্প’-কেদারনাথ মজুমদার (অগ্রহায়ণ ১৩০৭), ‘জ্যোতিষ ও কাল বিধান’-শ্রীচ বি. এ. (অগ্রহায়ণ ১৩০৭), ‘বেদ’-দুর্গাদাস রায় (শ্রাবণ ১৩০৭), ‘হত্যাকারী কে’-পাঁচকড়ি দে (কার্ত্তিক ১৩০৮), ‘আগ্রায়’-কেদারনাথ মজুমদার (বৈশাখ ১৩০৮), ‘জীবানুবাদ (Bacteriology)’-শ্রীশ্রীনিবাস বন্দ্যোপাধ্যায় (শ্রাবণ ১৩০৮), ‘দার্শনিক মতের সমন্বয়’-কোকিলেশ্বর ভট্টাচার্য্য এম. এ. (ভাদ্র-আশ্বিন ১৩০৮), প্রকৃতি-গ্রন্থ পাঠ’-মহেশচন্দ্র সেন (ফাল্গুন ১৩০৮), ‘শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী’-কৃষ্ণহরি গোস্বামী বিদ্যাবিনোদ (চৈত্র ১৩০৮), দিল্লীর আফগান শাসনের প্রকৃতি’-রামপ্রাণ গুপ্ত (শ্রাবণ ১৩০৯), ‘চোখের বালি’(সমালোচনা)-মহেশচন্দ্র সেন (চৈত্র ১৩০৯), ‘মোহাম্মদ’-রামপ্রাণ গুপ্ত (পৌষ ১৩০৯), ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’-কেদারনাথ মজুমদার (ফাল্গুন ১৩১১), ‘মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য’-রেবতীমোহন গুহ (জ্যৈষ্ঠ ১৩১২), ‘দস্যুর মহত্ব’-কেদারনাথ মজুমদার (আশ্বিন ১৩১২), ‘কৃষি’-যতীন্দ্রনাথ মজুমদার (মাঘ ১৩১২), ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও পুরাণান্তর্গত চন্ডী’-দুর্গাদাস ঠাকুর তত্ত্বরত্ন (বৈশাখ ১৩১৩), ‘কালী ধ্যানের আধ্যাত্মিক ভাবার্থ’-দুর্গাদাস ঠাকুর তত্ত্বরত্ন (অগ্রহায়ণ ১৩১৩) প্রভৃতি।

এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ‘চোখের বালি’র সমালোচনা পত্রিকার দুটি সংখ্যায় বিস্তৃত ভাবে করেছেন মহেশচন্দ্র সেন। তার একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করছি – “ধর্ম্মপরিণীতা পত্নী স্বামী প্রেমে বঞ্চিতা হইলে অভিমানে জলাঞ্জলি দিয়া এরূপ প্রেম যাচ্ঞা করা স্ত্রীস্বাধীনতার লীলাভূমি ইউরোপে ক্বচিৎ কুত্র সম্ভবপর হইলেও, তাহা এদেশে আশা করা যায় না। তাহাতে উপনায়ক নায়িকার মধ্যে-যেখানে প্রেমের স্বত্ব সাব্যাস্ত হয় নাই, সেস্থলে প্রেমলীলার এরূপ অপূর্ব্ব অভিনয় (!)-লজ্জাহীনতার ঘৃণিত চিত্র আজ পর্য্যন্ত কোন উপন্যাস লেখক কল্পনা করিতে পারেন নাই। বলি, ইহাই কি এই উপন্যাসের নূতনত্ব ?”

যেখানে ‘চোখের বালি’ সম্বন্ধে এরকম অভিমত প্রকাশ করা হয়েছে, সেই পত্রিকার ১৩১৫ চৈত্র সংখ্যায় কুমুদকিশোর আচার্য্য চৌধুরী রচিত ‘নগ্ন-সৌন্দর্য্য’ কবিতাটি অনায়াসেই স্থান পেয়েছে। প্রথম কয়েক পংক্তি –

“তব চঞ্চল নীল চিকণ অঞ্চল
খুলে ফেলে দেও দূরে,
তব কুন্তল দাম নভতল-শ্যাম
দেও গো শিথিল করে ;

দেও বসন্ত পবন করিতে চুম্বন
সুরভি মাধবী বক্ষ,
ওগো ত্বরা দাও খুলে বকুলের তলে
তোমার বিজন কক্ষ ;

দেও আনিতে পবনে মুখরিত বনে
বাঁশীর মধুর মন্দ্র,
দেও ভাসায়ে লজ্জা, বিমল শয্যা
ধুয়ে দিক চারুচন্দ্র ; ......” ইত্যাদি।

কেদারনাথ নিজে ইতিহাস, পুরাণ ও পুরাতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহী হওয়ায় এই বিষয়ের বেশ কিছু রচনা পত্রিকায় স্থান পেয়েছে। লেখকের নাম সহ কয়েকটি লেখা – ‘একখানি ঐতিহাসিক চিত্র’ [আলাউদ্দীনের জীবন কাহিনী]-রামপ্রাণ গুপ্ত, ‘বেদ অপৌরষেয় নহে’-উমেশ চন্দ্র বিদ্যারত্ন, ‘যুধিষ্ঠিরের আবির্ভাব কাল’-কেদারনাথ মজুমদার, ‘মহারাজ অশোক ও বৌদ্ধ ধর্ম্মের বিস্তৃতি’-কেদারনাথ মজুমদার, ‘গুজরাটের পুরাতত্ত্ব’-ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য্য এম. এ. বি. এল., ‘রাজমালা ও ত্রিপুর রাজবংশ’-উমেশ বিদ্যারত্ন, ‘বিদ্যাপতির অপ্রকাশিত কবিতা’-রসিকচন্দ্র বসু, ‘ময়মনসিংহের প্রাচীন কবি মুক্তারাম নাগ’-কেদারনাথ মজুমদার, ‘মুসলমানের সংস্কৃত চর্চ্চা’-রামপ্রাণ গুপ্ত, ‘ল্যাপচা জাতির ইতিবৃত্ত’-রাজেন্দ্রলাল আচার্য্য, ‘মোহাম্মেদ’-রামপ্রাণ গুপ্ত, ‘কালিদাস ও রঘুবংশ’-রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তী, ‘ময়মনসিংহের সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’-কেদারনাথ মজুমদার, ‘রাজা রঘুনাথ সিংহ’-যতীন্দ্রনাথ মজুমদার, ‘বিভীষণ-চরিত্র (বাল্মীকি ও কৃত্তিবাস’)-?, ‘ময়মনসিংহের প্রাচীন ও বর্ত্তমান সম্পদ’-মোহিনীশঙ্কর রায়, ‘মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য’-রেবতীমোহন গুহ, ‘একখানি পুরাতন কাগজ’-রসিকচন্দ্র বসু, ‘পাটলিপুত্র’-ব্রজসুন্দর সান্যাল, ‘বিক্রমপুরের প্রাচীন ইতিবৃত্ত’-যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ‘রামায়ণের সভ্যতা’-কামিনীকুমার সেন এম.এ.বি.এল., ‘হুমায়ুনের আউঢ যাত্রা’-ব্রজসুন্দর সান্যাল, ‘পৌরাণিক সময় নিরুপণে জ্যোতিষ’-সর্ব্বরঞ্জন লাহিড়ী, ‘মাধবাচার্য্য’-রাধারমণ গোস্বামী, ‘আরব দেশে জ্যোতিষশাস্ত্র’-অক্ষয়কুমার মজুমদার, ‘একটি প্রাচীন কবিতা’ [বর্ধমান জেলার ক্ষীরগ্রাম নামক গ্রামে অবস্থিত যোগাদ্যা দেবীর মন্দির ও মূর্তি সম্বন্ধে প্রাপ্ত একটি কবিতা]-দুর্গাদাস রায় প্রভৃতি।

এর মধ্যে দুটি রচনা নিয়ে খুব সংক্ষিপ্ত আলোচনা করছি। প্রথমটি ‘যুধিষ্ঠিরের আবির্ভাব কাল’, লেখক কেদারনাথ মজুমদার। মহাভারতের প্রকৃত সময় নির্ণয় নিয়ে বহু গবেষণা ও আলোচনা ইতিমধ্যেই হয়েছে, কিন্তু কোন সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় নি। গবেষকরা একাধিক সময়কাল নিজেদের যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। মোটামুটি দুটি আনুমানিক কাল বেশী প্রচলিত, একটি খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ এবং অন্যটি খ্রিষ্টপূর্ব্ব ৩০০০ বছর। এখন থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগের সপক্ষে বহু গবেষকই মত প্রকাশ করেছেন। যাই হোক, কেদারনাথ মজুমদার তার যুক্তি দিয়ে খ্রিষ্টপূর্ব্ব ২৪৪৮ বছরটি নির্দ্দিষ্ট করেছেন। মূল রচনাটি প্রকাশিত হয়েছে ‘আরতি’র আশ্বিন ও কার্ত্তিক ১৩০৭ সংখ্যায়। অন্য রচনাটি রসিকচন্দ্র বসু বিরচিত ‘একটি পুরাতন কাগজ’। ১৩১২ ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত রচনাটিতে লেখক মন্তব্য করেছেন –

“শুক্তি ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে কদাচিৎ মুক্তা মিলে; ছাই উড়াইতে উড়াইতে কখনও রত্ন পাওয়া যায়; যাঁহারা প্রত্নতত্ত্বের আশায় কিছুদিন গলিত জীর্ণ কাগজ বা দুর্গম অরণ্যের ইষ্টক স্তূপাদি প্রোৎসাহিত হইয়া পর্য্যবেক্ষণ করিয়াছেন, তাঁহারা ইহা ভাল জানেন। অল্পদিন হইল আমরা প্রাচীন বৈষ্ণব গ্রন্থাবলীর অনুসন্ধান করিতে করিতে একখানি গলিত জীর্ণ কাগজ পাইয়াছি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হইতে আরম্ভ করিয়া গৌর লীলার গোস্বামী ও মহান্তগণের সংক্ষিপ্ত জীবনী অর্থাৎ আবির্ভাব, তিরোভাব, সন্ন্যাস প্রভৃতির বর্ষ পরিমাণ ও শক ইহাতে লিখিত হইয়াছে। সুতরাং ঐতিহাসিক হিসাবে ইহার মূল্য অত্যন্ত অধিক। কিন্তু বড়ই দুঃখের বিষয় কাগজখানির সম্পূর্ণ অবয়ব আমরা পাই নাই, এবং যাহা পাইয়াছি তাহারও সমুদয় অংশ পঠন যোগ্য নাই। যতদূর পড়িতে পারা যায়, অদ্য আমরা বঙ্গীয় ঐতিহাসিক বৈষ্ণবগণের নিকট তাহাই উপস্থিত করিলাম। হয়ত এই আলোচনার ফলে কোনও ভাগ্যবান এই সংক্ষিপ্ত জীবনীর পূর্ণাবয়বের অনুসন্ধানে কৃতকার্য্য হইতে পারেন।”

এর পরে কাগজটির পাঠযোগ্য অংশটি লিখিত হয়েছে। তবে রচনার শেষে ‘ক্রমশঃ’ লেখা থাকলেও এর পরে আর কোন অংশ খুঁজে পাই নি।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘আরতি’ পত্রিকায় প্রবন্ধের সংখ্যাই বেশি। ইতিপূর্বে ধারাবাহিক রচনা বা পুরাতত্ত্ব বিষয়ক যে সব লেখার উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি সবই প্রবন্ধাকারে রচিত। সেগুলি ছাড়াও আরও কিছু প্রবন্ধ ও লেখকের নাম নীচে উল্লেখ করছি। এগুলি থেকে পত্রিকাটির চরিত্র সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা সহজ হবে।

‘ভারতেশ্বরীর ভারত রাজ্য’-দুর্গাদাস রায়, ‘মহরম’-শশধর সেন বি. এ., ‘মানব শব্দের বুৎপত্তি কি?'-(সম্পাদক?), ‘এপিকিউরস ও তাহার নীতি’-জ্ঞানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ‘খাদ্যাখাদ্য বিচার’-গিরিশচন্দ্র কবিরত্ন, ‘জল ও বায়ু’-অনুকূলচন্দ্র কাব্যতীর্থ, ‘বাঙ্গালা অকারান্তোচ্চারিত শব্দ’-শ্রীশ্রীনিবাস বন্দ্যোপাধ্যায় বি. এ., ‘ময়মনসিংহের সাহিত্যসভা’-কেদারনাথ মজুমদার, ‘শ্রীক্ষেত্রে’-অম্বুজাসুন্দরী দাস, ‘সুখ ও দুঃখ’-জ্ঞানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ. বি. এল., ‘সৃষ্টিরহস্য’-দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, ‘গ্রীষ্মাধিক্যে শোচণীয় ফল’-শ্রীশ্রীনিবাস বন্দ্যোপাধ্যায় বি. এ., ‘জাতিভেদ ও অর্থনীতি’-পরেশনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বি. এ., ‘দক্ষিণবঙ্গ’-রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তী, ‘নদীর গতি পরিবর্ত্তন’-করুণানাথ ভট্টাচার্য্য বি. এ., ‘প্রাকৃতিক দিগদর্শন যন্ত্র’-শ্রীশ্রীনিবাস বন্দ্যোপাধ্যায় বি. এ., ‘প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে নারী মর্য্যাদা’-জ্ঞানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এম. এ. বি. এল., ‘বনজ্ঞভাষায় আদিম গদ্য।–রসিক চন্দ্র বসু, ‘ভারতের ব্রাহ্মণ’-মহারাজ কুমুদচন্দ্র সিংহ বি. এ., ‘শক্তির অবিকল্পত্ব ও ভূগর্ভস্থ উত্তাপ’-শ্রীশ্রীনিবাস বন্দ্যোপাধ্যায় বি. এ., ‘শারদীয় পূজা’-ধর্ম্মানন্দ মহাভারতী, ‘শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথ’-অম্বুজাসুন্দরী দাস, ‘স্বামী বিবেকানন্দ ও ঠাকুর রামকৃষ্ণ’-মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত বি. এ., ‘সিদ্ধ বকুল’-দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার, ‘হিন্দুর দেবতা’-অনুকূলচন্দ্র কাব্যতীর্থ, ‘আমাদের কর্ত্তব্য কি ?’-সম্পাদক, ‘আমাদের বর্ণমালা’-রেবতীমোহন গুহ এম. এ. বি. এল., ‘নবযুগের নবশিক্ষা’-অক্ষয়কুমার মজুমদার, ‘জানকু পাথরের বিদ্রোহ’-কেদারনাথ মজুমদার [জানকু পাথর একজন ব্যক্তির নাম], ‘বর্ষ গণনা সঙ্কেত’-বিপিনচন্দ্র রায়, ‘রঘুবংশ ও কালিদাস’-রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তী, ‘ষড়রিপু’-দুর্গাদাস ঠাকুর তত্ত্বরত্ন, ‘সমাজ সংস্কার’-দুর্গাদাস ঠাকুর তত্ত্বরত্ন, ‘হুমায়ুনের বঙ্গবিজয়’-ব্রজসুন্দর সান্যাল, ‘ঈশা খাঁর চট্টগ্রাম অধিকার’-সৈয়দ নুরুল হোসেন, ‘বহু-বিবাহ’-যতীন্দনাথ মজুমদার, ‘ঢাকাই মলমল’-সৈয়দ নুরুল হোসেন, ‘নেতৃগণের কর্ত্তব্য’-কেদারনাথ মজুমদার, ‘সাহিত্য সেবার প্রয়োজন’-কামিনীকুমার সেন এম. এ. বি. এল. প্রভৃতি।

লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে কয়েকজন লেখকই বহু সংখ্যক রচনা প্রস্তুত করেছেন। অতএব লেখকের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। বস্তুতঃ কেদারনাথের মাসিক পত্রিকা প্রকাশের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল নতুন লেখক গোষ্ঠি গড়ে তোলা।

এ ছাড়া সব সংখ্যায় না হলেও মাঝে মাঝেই প্রকাশিত হয়েছে ‘গ্রন্থ সমালোচনা’ ও ‘মাসিক সাহিত্য’ শীর্ষক দুটি বিভাগ। এখানে সমকালীন প্রকাশিত গ্রন্থ ও মাসিক পত্রিকার সম্বন্ধে আলোচনা রয়েছে, সমালোচনা করেছেন মহেশচন্দ্র সেন, উপেন্দ্রচন্দ্র রায়, কেদারনাথ মজুমদার ও অন্যান্য বিদগ্ধ জনেরা।

‘আরতি’র প্রতি সংখ্যা ছিল ৩২ পৃষ্ঠার, মূল্য ছিল বার্ষিক দেড় টাকা, প্রতি সংখ্যা তিন আনা। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে -‘কেহ আট জন গ্রাহকের অগ্রিম মূল্য পাঠাইলে তাঁহাকে বিনামূল্যে এক বৎসর আরতি দেওয়া যাইবে।’ পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। কিন্তু পত্রিকার ১৩০৮ ভাদ্র-আশ্বিন সংখ্যায় কার্য্যাধক্ষ শচীন্দ্রসুন্দর রায় ‘নিবেদন’ শীর্ষক একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন – “আরতির ভূতপূর্ব্ব সম্পাদক শ্রীযুক্ত উমেশচন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয়ের হঠাৎ ময়মনসিংহ পরিত্যাগে ‘আরতি’ বাহির হইতে অনেক বিলম্ব হইয়া পড়িল। আশা করি গ্রাহক অনুগ্রাহকগণ আমাদিগের এ ত্রুটি মার্জ্জনা করিবেন। বর্ত্তমান সংখ্যা হইতে “আরতী” সম্পাদনের ভার শ্রীযুক্ত সারদাচরণ ঘোষ এম. এ. বি. এল. মহাশয়ের হস্তে ন্যস্ত হইল। ......” প্রকৃত ঘটনা কিন্তু ছিল অন্যরকম। একটি রচনা থেকে (সম্ভবতঃ কেদারনাথ মজুমদারের লেখা) জানা যায় যে সম্পাদকের সঙ্গে পরিচালকের মতবিরোধই সম্পাদক পরিবর্ত্তনের জন্য দায়ী। রচনাটির প্রাসঙ্গিক অংশ –

“ ‘আরতি’ বাহির হইবার সময় পণ্ডিত মহাশয়কে সম্পাদক করিয়াছিলাম। তিনি প্রথম সংখ্যায় “বেদ অপৌরুষেয় নহে” এই সংস্কার বিরোধী প্রবন্ধ লিখিয়া আমাদিগকে মহাবিপদে ফেলিয়াছিলেন; হিন্দু সমাজের নেতাগণ “আরতি”র বিরুদ্ধে দল সৃষ্টি করিলে আমরা অনন্যোপায় হইয়া যাইয়া পণ্ডিত মহাশয়কে এইরূপ ধর্ম্ম ও সংস্কার বিরুদ্ধ প্রবন্ধ লিখিতে নিষেধ করি। পণ্ডিত মহাশয় জেদ ধরিলেন – ‘আমাকে প্রতি সংখ্যায় এইরূপ কুসংস্কার উচ্ছেদী প্রবন্ধই লিখিতে হইবে, পত্রিকা এইরূপ নূতন মত লইয়াই সুপরিচিত ও সম্মানিত হইবে।’ নিরুপায় হইয়া আমরা কোনরূপে এক বৎসর চালাইয়া পরে সম্পাদক পরিবর্ত্তন করিতে বাধ্য হইলাম।”

সারদাচরণ ঘোষের পর সম্পাদক হয়েছিলেন উপেন্দ্রচন্দ্র রায়। ‘আরতি’ খুব সম্ভব আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। একটি উচ্চমানের পত্রিকা হিসাবে ‘আরতি’ নিশ্চয়ই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

সৌরভ

চিত্র ২ – ‘আরতি’ পত্রিকার আষাঢ় ১৩০৮ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি সুচীপত্র ও বিজ্ঞাপন

চিত্র ৩ – ‘সৌরভ’ পত্রিকার আখ্যাপত্রের প্রতিলিপি

‘কুমার’ ও ‘আরতি’ পত্রিকার মতই ‘সৌরভ’ মাসিক পত্রিকাটিও প্রকাশিত হয়েছিল কেদারনাথের হাত ধরেই। ‘সৌরভ’ দীর্ঘায়ু হয়েছিল, ছাব্বিশ বছর স্থায়ী হয়েছিল এটি। কেদারনাথের সম্পাদনায় প্রথম সংখ্যাটি বেরিয়েছিল ১৩১৯ বঙ্গাব্দের কার্ত্তিক মাসে। সম্পাদকের উদ্যোগেই ময়মনসিংহে স্থাপিত হয়েছিল ‘সৌরভ সাহিত্য সংঘ’। এ প্রসঙ্গে গৌরচন্দ্র নাথ লিখেছেন – “গত ৪!৫ বৎসর যাবৎ ‘রামায়ণের সমাজ ও রামায়ণী সভ্যতা’ নিয়াই তিনি বিশেষ ভাবে ব্যাপৃত ছিলেন। সাহিত্য সেবীগণ তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলেই তিনি ইহাদের যে কোন অংশ পড়িয়া শুনাইতেন। এত বড় বিরাট গ্রন্থ আদ্যোপান্ত এইরূপ পড়িয়া শুনান সম্ভবপর নহে। ‘সৌরভ সাহিত্য সংঘের’ প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল তাঁহার পুস্তক পড়িয়া শুনাইবার জন্যই। সঙ্ঘে প্রথম অধিবেশনের সভাপতি হইয়াছিলেন রায় শ্রীযুক্ত সারদাচরণ ঘোষ বাহাদুর। সভায় উপস্থিত ভদ্রমন্ডলীর সমালোচনা ও বন্ধুবান্ধবের মন্তব্য গ্রহণযোগ্য হইলে তিনি অতি সাদরে গ্রহণ করিতেন।”

মাসিক পত্রিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রে কেদারনাথের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্য চর্চার প্রসার ঘটিয়ে নতুন লেখক গোষ্ঠি গড়ে তোলা। স্থানীয় লেখকরা থাকা সত্বেও কেদারনাথের হয়ত মনে হয়েছিল কলকাতার প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা পত্রিকায় প্রকাশিত না হ’লে পত্রিকার উৎকর্ষ ও সুনাম বজায় থাকবে না। কিন্তু এটা করতে তাকে অনেকে নিরুৎসাহ করেন। এদেরই একজন সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য লিখেছেন – “ ‘সৌরভ’ পত্রিকা সম্পাদনার প্রধান অবস্থায় তিনি একবার বঙ্গের খ্যাতনামা বিভিন্ন সাহিত্যিকের নিকট প্রবন্ধ যাচ্ঞা করিয়া পত্র পাঠান। ঐ পত্রের উত্তরে লব্ধপ্রতিষ্ঠ রস-সাহিত্যিক শ্রীযুক্ত ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় কলকাতা হইতে কেদারবাবুকে জানান ‘খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের সারগর্ভ প্রবন্ধ ছাপাইতে কলিকাতাতে মাসিক পত্রিকার অভাব নাই। মফঃস্বল হইতে পরিচালিত পত্রিকাগুলিও যদি সহরের প্রসিদ্ধ লেখকদের লেখার দিকেই তাকাইয়া থাকেন, তবে মফঃস্বলের পত্রিকা পরিচালনের উদ্দেশ্য কিছুতেই সফল হইতে পারে না’।”

কেদারনাথ ময়মনসিংহে ‘কেদার মন্ডলী’ নামে একটি লেখক গোষ্ঠি গড়ে তুলেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন – কালীকৃষ্ণ ঘোষ, রসিকচন্দ্র বসু, গিরিশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ, কবিরাজ গিরিশচন্দ্র সেন, ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্ত, রাজা অরুণচন্দ্র সিংহ, কৃষ্ণদাস আচার্য্য চৌধুরী, মহারাজ ভূপেন্দ্রচন্দ্র সিংহ, গোবিন্দচন্দ্র দাস, অধ্যাপক উমেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বীরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, পন্ডিত সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য, অক্ষয়কুমার মজুমদার, চন্দ্রকুমার দে, যতীন্দ্রমোহন সিংহ প্রমুখ। এদের অনেকেই ‘আরতি’ ও ‘সৌরভ’ পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন।

আগেই বলা হয়েছে কেদারনাথ নিজে ছিলেন ইতিহাস, পুরাণ ও পুরাতত্ব বিষয়ে আগ্রহী, স্বাভাবিক ভাবেই এ ধরণের বেশ কিছু রচনা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর উৎসাহের প্রকাশ ও জ্ঞানের গভীরতা জানা যায় ‘সৌরভ সাহিত্য সংঘে’র একটি অধিবেশনের বিবরণী থেকে – “গত ৩০শে অগ্রহায়ণ রবিবার স্থানীয় দুর্গা বাড়ীতে উক্ত সাহিত্য সভার এক বিশেষ অধিবেশন হইয়াছিল। সভায় এই নগরের বহু সাহিত্যসেবী ও শিক্ষিত ভদ্রলোক উপস্থিত হইয়াছিলেন। সরকারী উকিল রায় শ্রীযুক্ত সারদা চরণ ঘোষ এম. এ. বি. এল. বাহাদুর সভাপতির আসন গ্রহণ করিলে সৌরভ সম্পাদক শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মজুমদার জগতের ‘প্রাচীনতম সভ্য সমাজ ও রামায়ণের সমাজ’ সম্বন্ধে একটি তুলনামূলক প্রবন্ধ পাঠ করেন। লেখক এই প্রবন্ধে রামায়ণের যুগ বা রামায়ণের রচনার কাল নির্দ্ধারিত করিতে যাইয়া মিসরীয় এসিরীয়, বাবিলনীয়, ইরীয়, ও গ্রীক সমাজের প্রাচীন অবস্থা , সভ্যতার প্রকৃতি, আদান প্রদানের ধারা ইত্যাদি আলোচনা করিয়া কোন সমাজ কত প্রাচীন ও সেই প্রাচীনতা নির্ণয়ের কতগুলি উপায় আলোচনা করেন। অতঃপর বেদ, ব্রাহ্মণ, রামায়ণ, উপনিষদ, মহাভারত প্রভৃতির রচনা কাল নির্দ্দেশ করেন।”

‘আরতি’ ও ‘সৌরভ’ পত্রিকা দু’টি একই ব্যক্তির দ্বারা পরিচালিত ও সম্পাদিত হওয়ায় অপেক্ষাকৃত পরে প্রকাশিত ‘সৌরভ’ প্রকৃতিগত ভাবে অনেকাংশে পূর্বে প্রকাশিত ‘আরতি’ পত্রিকারই অনুরূপ ছিল। তবে ‘সৌরভ’ দীর্ঘদিন ধরে চলায় অনেক নতুন নতুন লেখক এগিয়ে এসেছেন। সময়ের সঙ্গে বিষয়বস্তুর ব্যাপ্তি ও বৈচিত্রও বৃদ্ধি পেয়েছে। সব ধরণের লেখা থাকলেও পত্রিকায় চিন্তাধর্মী প্রবন্ধ অনেক বেশি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

‘সৌরভে’ কবিতা লিখেছেন – দেবেন্দ্রনাথ মহিন্তা, জীবেন্দ্রকুমার দত্ত, মনমোহন সেন, চন্দ্রকুমার দে, গোবিন্দচন্দ্র দাস, হৈমবতী দেবী, রমণীমোহন ঘোষ, অম্বুজাসুন্দরী দাসগুপ্তা, সুরেশচন্দ্র সিংহ, নরেন্দ্রনাথ ঘোষ, অমরেন্দ্র নারায়ণ আচার্য্য চৌধুরী, কুমুদবন্ধু ভট্টাচার্য্য, হরিপ্রসন্ন দাসগুপ্ত প্রমুখ।

গল্প লিখেছেন – ‘অদৃষ্টের উপহাস’ (সুরেশচন্দ্র সিংহ শর্ম্মা), ‘বাল্যবন্ধু’ (সুরেশচন্দ্র সিংহ), ‘হারাণো মাণিক’ (সুরেশচন্দ্র সিংহ), ‘মায়ার আরসী’ (সুরেশচন্দ্র সিংহ), ‘গদাধর মাষ্টার’ (গিরীশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী), ‘প্রায়শ্চিত্ত’ (কেদারনাথ মজুমদার?), ‘ক্ষুদ্র ভুল’ (কেদারনাথ মজুমদার), ‘ঝি’ (কেদারনাথ মজুমদার), ‘আদর্শ’ (কেদারনাথ মজুমদার), ‘শাখা’ (কমলা দেবী), ‘দর্পচূর্ণ’ (নরেন্দ্রনাথ মজুমদার প্রভৃতি। লক্ষণীয় যে মাত্র গুটিকয়েক লেখকই গল্প লেখায় হাত দিয়েছেন।

পত্রিকায় উপন্যাসের সংখ্যাও খুব বেশী নয়, অধিকাংশই ধারাবাহিক। কয়েকটি উপন্যাসের নাম লেখক ও প্রথম প্রকাশের সংখ্যা সহ উল্লেখ করছি – ‘সমস্যা’ (সামাজিক উপন্যাস, কেদারনাথ মজুমদার, চৈত্র ১৩২৬), ‘শুভদৃষ্টি’ (লেখকের নাম নেই, অগ্রহায়ণ ১৩২০), ‘স্রোতের ফুল’ (কেদারনাথ মজুমদার, মাঘ ১৩২৭), ‘স্নেহের দান’ (কেদারনাথ মজুমদার, মাঘ ১৩২৮), ‘যৌবন প্লাবন’ (যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, মাঘ ১৩৩৪), ‘অভিশপ্ত’ (সুরেন্দ্রলাল সেন, আষাঢ় ১৩৩৫), ‘জাহাজ চুরি’ (রেবতীমোহন সেন, আষাঢ় ১৩৩৯), ‘পরাজয়’ (সুরেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৪০) প্রভৃতি।

এবার প্রবন্ধর দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। মননধর্মী প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তু একটু বিশদ ভাবে পর্যালোচনা করলে হয় তো পত্রিকার মান নির্ণয়ে এগুলি সূচক হিসাবে কাজ করবে। লেখকদের নামও উল্লেখ করা হল তবে এরা এখন প্রায় সবাই বিস্মৃত। দু’একজন ছাড়া সকলেই স্বাভাবিক ভাবেই কালের গর্ভে বিলীন হয়েছেন। কেদারনাথ মজুমদারের কথাই বা ক’জন জানেন ? যেসব প্রবন্ধর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে সেগুলি হ’ল – ‘জাপানে সাহিত্য চর্চা’ (যদুনাথ সরকার), ‘কবিবর রবীন্দ্রনাথ’ (?), ‘বাঙ্গালীর অন্তঃপুর’ (?), ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতের রচনাকাল’ (বনমালী গোস্বামী), ‘পূর্ব্ব ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ’ (অচ্যুতচরণ চৌধুরী), ‘প্রমাণ না বিশ্বাস’ (প্রিয়গোবিন্দ দত্ত), ‘ব্রাহ্ম ও বৈষ্ণব’ (অমরচন্দ্র দত্ত), ‘জ্ঞান ও কর্ম্ম’ (উমেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য), ‘খাদ্য’ (হরিচরণ গুপ্ত), ‘গৌড়ের ভগ্নাবশেষ’ (রামপ্রাণ গুপ্ত), ‘প্রাচীন পুঁথির পরিচয়’ (চন্দ্রশেখর তরফদার), ‘বাঙ্গালা বানান’ (বীরেশ্বর সেন), ‘চীনা চিকিৎসা’ (বঙ্কিমচন্দ্র সেন), ‘একান্নবর্ত্তী পরিবার’ (যতীন্দ্রমোহন সিংহ), ‘বাঙ্গালার সমাজ’ (রঞ্জনবিলাস রায় চৌধুরী), ‘সেকালের দন্ডবিধান’ (রাজেন্দ্রকিশোর সেন), ‘ভারতীয় সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন’ (বঙ্কিমচন্দ্র সেনগুপ্ত), ‘ ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যপ্রসঙ্গ’ (উপেন্দ্রকুমার কর), ‘রামায়ণী যুগের বাণিজ্য ব্যবসায়’ (কেদারনাথ মজুমদার), ‘উপন্যাস ও আর্ট’ (যতীন্দ্রনাথ মজুমদার), ‘উপন্যাস ও অশ্লীলতা’ (যতীন্দ্রনাথ মজুমদার), ‘উপন্যাসে দাম্পত্য প্রেম’ (যতীন্দ্রনাথ মজুমদার), ‘রামায়ণে বিবাহ রীতি’ (কেদারনাথ মজুমদার), ‘বৈধ ও অবৈধ প্রণয়’ (চন্দ্রকুমার দে), ‘ব্যাধি ও জীবাণু’ (যতীন্দ্রনাথ মজুমদার), ‘ত্যাক্তেন ভুঞ্জিথাঃ’ (বীরেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী), ‘রবীন্দ্রনাথের কবি জীবনের অভিব্যক্তি’ (সুধীরচন্দ্র ভাদুরী), ‘ভাওয়ালের সন্ন্যাসী কুমার’ (রাজেন্দ্রকুমার শাস্ত্রী), ‘গীতায় স্বরাজ’ (ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্ত্তী), ‘প্রতিভায় রবীন্দ্রনাথ’ (?), ‘রবীন্দ্র জয়ন্তী’ (ফণীভূষণ রায়), ‘খেলা বনাম ব্যায়াম’ (রবীন্দ্রনাথ গুহ), ‘বাঙ্গালীর ব্যবসায় বুদ্ধি’ (অনঙ্গমোহন লাহিড়ী), ‘সাধক রামপ্রসাদ ও কবি রামপ্রসাদ’ (পূর্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য্য), ‘সাহিত্যসেবীর সদুপোদেশ’ (বঙ্কিমচন্দ্র সেন), ‘ঋগবেদে চন্দ্রগ্রহণ’ (তারাপদ মুখোপাধ্যায়), ‘ময়মনসিংহের প্রাচীন কথা’ (গিরিশচন্দ্র সেন কবিরত্ন), ‘ময়মনসিংহের কবি কাহিনী’ (বিজয়নারায়ণ আচার্য্য), ‘রামায়ণী যুগের বয়ন শিল্প’ (কেদারনাথ মজুমদার), ‘উপন্যাস ও লোক শিক্ষা’ (যতীন্দ্রমোহন মজুমদার), ‘হোমারীয় যুগে গ্রীক সমাজ’ (গৌরচন্দ্র নাথ), ‘ভাব অভিব্যক্তির আদিম রীতি’ (গৌরচন্দ্র নাথ) প্রভৃতি। বেশ কয়েকটি অভিভাষণ ও সাহিত্য সম্মেলনের রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়।

‘সৌরভে’র অন্য একটি আকর্ষণীয় বিভাগ ছিল ‘গ্রন্থ সমালোচনা’। প্রতি সংখ্যায় না হলেও মাঝে মাঝেই এটি থাকত। সে সময়ে প্রকশিত বইয়ের সমালোচনা প্রকাশিত হত এই বিভাগে। এই বিভাগটির মাধ্যমে পাঠকেরা বাজারে লভ্য গ্রন্থ ও তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় পেয়ে যেতেন। কয়েকটি গ্রন্থ – ‘সচিত্র কুন্তলীন পুরস্কার’ (হেমেন্দ্রমোহন বসু), ‘যুগমানব’ (বীরেন্দ্রকুমার দত্ত), ‘বিশ্ববীনা' (সুরেন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য্য), ‘ভারত পথিক’ (সতীশচন্দ্র চক্রবর্ত্তী), ‘গৃহ জ্যোতিষী’ (বঙ্কিমচন্দ্র কাব্যতীর্থ), ‘পারস্য প্রতিভা’ (মৌলবী মহম্মদ বরকতুল্লাহ), ‘কাশ্মীর ও জম্মু’ (ভ্রমণ কাহিনী, নরেন্দ্রকান্ত লাহিড়ী চৌধুরী) ইত্যাদি।

বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির মৃত্যুতে জীবনী ও শোকপ্রস্তাব প্রকাশ করে সম্পাদক তাঁর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। সুকুমার রায় চৌধুরী ও গগনচন্দ্র হোমের জীবনী ও শোকপ্রস্তাব বেরিয়েছে যথাক্রমে আস্বিন ১৩৩০ ও শ্রাবণ ১৩৩৬ সংখ্যায়। কেদারনাথ মজুমদার পরলোকে গমন করলে ‘সৌরভ’ একটি স্মৃতিসংখ্যা প্রকাশ করে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৩)।

‘সৌরভ’ ছিল একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা। কেদারনাথের মৃত্যুর পর তাঁর অনুজ নরেন্দ্রনাথ মজুমদার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। কিন্তু কেদারনাথের অবর্তমানে ‘সৌরভ’ ক্রমশঃ তার জৌলুস হারিয়ে ফেলে। পত্রিকাটির সম্পূর্ণ ‘ফাইল’ পাওয়া খুব শক্ত। সম্ভবতঃ পঞ্চবিংশ বর্ষ (১৩৪৪-৪৫) আশ্বিন সংখ্যাই ছিল ‘সৌরভে’র শেষ সংখ্যা।

মনন সমৃদ্ধ গম্ভীর প্রবন্ধ বিষয়ে বহুক্ষণ আলোচনা অনেকের কাছে ক্লান্তিকর মনে হতে পারে। একঘেয়েমি থেকে মুক্ত হ’তে ‘অবসর’-এর পাঠকদের ‘সৌরভ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ভূতের গল্প উপহার দিচ্ছি। লেখক গিরিশ চন্দ্র সেন কবিরত্ন ছিলেন ময়মনসিংহের একজন শ্রদ্ধেয় ও প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। শুধু তিনি নন, তাঁর সঙ্গে আরও অনেকে গল্পে উল্লেখিত ‘প্রেতাত্মা’টিকে ‘দর্শন’ করেছেন। বিশ্বাস করা না করা পাঠকের অভিরুচি।

ভূতের কান্ড (গিরিশচন্দ্র সেন কবিরত্ন)।
(মূল বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে)

৪৮ বৎসর পূর্ব্বে এই সহরে একটী মহিলা ভূতের সহিত আমার প্রথম দেখা-সাক্ষাৎ হয়। আজকাল অনেক কাগজ পত্রে আমরা অনেক বিলাতিভূতের অদ্ভুত গল্প শুনিতে পাই বটে কিন্তু সে সময় অনেকেই ভূতের কথায় বিশ্বাস করিতেন না ; আমার কোনও দিন ভূতে বিশ্বাস ছিল না। ভগবান অবিশ্বাসীর মনে বিশ্বাস জন্মাইয়া দিলেন, পরে আমারও ভূতে বিশ্বাস করিতে হইল। এখন যেখানে উকিল প্রসন্ন বাবুর বাসা, ঢাকা ময়মনসিংহ রেল হওয়ার পূর্ব্বে ঐ স্থানে আমার বাসা ছিল। ঐ বাসার উত্তরাংশে আদালতের মহাফেজ ভুবনচন্দ্র রায় বাস করিতেন, দক্ষিণাংশে আমি বাস করিতাম। তখন অখিল নামে আমার একটী প্রিয়ছাত্র আমার নিকট আয়ুর্ব্বেদ শিক্ষা করিয়া এই জেলার বাট্টাগ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের বাড়ী থাকিয়া চিকিৎসা ব্যবসায় করিত। ছাত্রটীর বাড়ী আমার বাড়ীর নিকট, সে আমাকে ঠিক পিতার ন্যায় ভক্তি শ্রদ্ধা করিত। একদিন শেষ বেলায় একখানা পালকী আমার বাসায় উপস্থিত হইল। পালকীর দ্বার উদ্গাটিত হইলে দেখিলাম, আমার সেই ছাত্র পালকীর মধ্যে রোগ যন্ত্রণায় ছটফট করিতেছে। নিকটে গেলে “মরে গেলাম, আমাকে রক্ষা করুন” – বলিয়া অখিল আমার পায় ধরিয়া কান্দিতে আরম্ভ করিল। আমি তাহাকে প্রবোধবাক্যে শান্ত করিয়া যথাশক্তি চিকিৎসা করিতে লাগিলাম। নানাবিধ চিকিৎসা হইল, অবশেষে গোপাল বাবুর নাশ টানা হইল, দুর্ভাগ্য বশতঃ কিছুতেই কিছু হইলনা। সে কখনো অজ্ঞান থাকিত, কখনো উন্মাদের ন্যায় মাতামাতী করিত প্রলাপ বকিত আবার কখনো অবসন্ন অবস্থায় পড়িয়া থাকিত। এই অবস্থায় দ্বাদশ দিন থাকিয়া ত্রয়োদশ দিনে মারা যায়।

মৃত্যুর পূর্ব্বদিন সন্ধ্যার পরে আমি একামাত্র অখিলের শয্যাপার্শ্বে বসিয়া আছি, হঠাৎ ঘরের বাতি নিবিয়া গেল। আমি বাতি জ্বালাইয়া বাড়ীর মধ্য হইতে বাহির হইয়া দেখি রোগীর ঘরের দ্বারে একটী মহিলা ঘরের দিকে মুখ দিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। পরিধানে ধবধবে পরিষ্কার সাদা একখানা ধুতি, বর্ণ ফিট গৌর। পূর্ণিমার রাত্রি, সমস্তই স্পষ্ট দেখা যাইতেছিল। আমি দরজার নিকট হইতে ২!৩ হাত ব্যবধান থাকিতেই মূর্ত্তি শূন্যে মিলাইয়া গেল, আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না।

এত বড় একটা অদ্ভুত কান্ড দেখিয়াও আমি সেদিকে তত লক্ষ্য করিলাম না কারণ তখন আমার মন ছাত্রের চিন্তায় ব্যাকুল, অন্য চিন্তা হৃদয়ে স্থান পাইতেছিলনা। আমি বাতি নিয়া ঘরে পহুছিতেই আবার তৎক্ষণাৎ বাতি নিবিয়া গেল, আমি আবার বাতি জ্বালাইতে বাড়ীর ভিতর গেলাম। বলা বাহুল্য সে সময়েও মেচ বাতির ব্যবহার সর্ব্বত্র ছিল না। আমি আমার শয়ন গৃহ হইতে বাতি জ্বালাইয়া বাহির হইতেই আমার সম্মুখে ঘরের দরজায় ঐ মূর্ত্তি পুনরায় স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। হঠাৎ গৃহ হইতে নামিতেই সেই মূর্ত্তি ঘরের একপার্শ্বে সরিয়া গেল।

আমি তখন বিস্মিত হইয়া কম্পিত স্বরে আমার ভ্রাতুষ্পুত্র ও ভৃত্যকে দুই তিন বার ডাকিলাম। তাহারা শীঘ্র শীঘ্র আমার নিকট আসিল। ভুবন রায় মহাশয়ও আসিয়া কি হইয়াছে, কি হইয়াছে, বলিয়া ডাকিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি বলিলাম একটা স্ত্রী লোক ঘরের দরজায় দাঁড়াইয়া ছিল, আমি নামিতেই ঘরের পাছে সরিয়া গেল। তাহারা তিন জনেই বাতি নিয়া ঘরের চতুর্দ্দিক ঘুরিয়া আসিলেন, কিছুই দেখিলেন না ; ঘরের পাছ দিয়া বাহির হইবারও পথ ছিল না। রায় মহাশয় মৃদু হাসিয়া বলিলেন – “আপনার মন ভাল নহে, ভ্রম হইয়াছে, ঘরের পাছে কিছুই নাই।” আমার ছাত্র মারা যায়, সম্মুখে বিভীষিকা দেখিতেছি - এই অবস্থায় রায় মহাশয়ের মৃদু হাসি দেখিয়া মনে কষ্ট হইল, রাগও হইল, মনে করিলাম এই ঘটনা নিয়া বাড়াবাড়ী করিলে রাত্রে যাহারা শুশ্রুষা করিতে ও রক্ষণাবেক্ষণ করিতে আইসে হয়ত তাহারা ভয় পাইয়া আর আসিবে না।

পর দিন আমাকে শোক দগ্ধ করিয়া অখিল ইহ জগত হইতে চলিয়া গেল। তাহার পর হইতে রাত্রিতে বাহির হইলে আমি প্রায়ই এই মহিলাটীকে দেখিতে পাইতাম। আমার বাড়ীর মধ্যে শুক্লপক্ষের রাত্রেতো স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম। বর্ণ পরিষ্কার চেহারা অতি সুন্দর ; ঘোমটা অতি অল্প, সুতরাং মুখমন্ডল প্রায় সমস্তই দেখা যাইত। এই মূর্ত্তি ছায়া মূর্ত্তির ন্যায় নিস্পন্দ ভাবে দাঁড়াইয়া থাকিত না ; সময় সময় তাহাকে একা চলিতেও দেখিয়াছি! যখন পদ বিক্ষেপে একস্থান হইতে অন্য স্থানে যাইত, তখন মৃদু গতিতে একটী মেয়ে লোকই হাঁটিতেছে বলিয়া ধ্রুব বিশ্বাস হইত। হাত দোলাইত, মাথায় ঘোমটা টানিতেও মধ্যে মধ্যে দেখা যাইত।

একদিন আমার স্ত্রী বাহিরে যাইবার পথে ঘরের দরজা খুলিয়াই সম্মুখে ঐ মূর্ত্তি দেখিতে পাইলেন। দেখিয়াই তিনি ত্রস্তভাবে আমাকে জাগাইয়া মূর্ত্তি দেখাইয়া দিলেন। আমি তাহাকে খুব সাহস দিয়া বলিলাম – “এইরূপ মূর্ত্তি অনেক দিন হইতে দেখিতেছি, ইহাকে ভয় করিও না; নিকটে গেলেই পলাইয়া যায়।” এই বলিয়া আমি মূর্ত্তির নিকট গিয়া তাহার অদর্শন পর্য্যন্ত দেখাইলাম। কিন্তু আমার স্ত্রী আর ঘরের বাহির হইলেন না, তাড়াতাড়ী দরজা বন্ধ করিয়া বিছানায় শয়ন করিলেন।

পর দিন রায় মহাশয়ের নিকট পূর্ব্বাপর সমস্ত বৃত্তান্ত বলিলাম। তিনি শুনিয়া বলিলেন – “ভয় করিবেন না, ঐ রূপ একটি স্ত্রী লোকের মূর্ত্তি আমরা অনেক দিন হইতেই দেখিয়া আসিতেছি। পাড়ার সকলেই জানে, কেহ ভয় করে না ; কাহারো কোন অনিষ্টও করেনা! বধুমাতা দেখিয়াছেন, আমি তাহাকে সাহস দিয়া বুঝাইয়া দিব যাহাতে তাহার ভয় দূর হইয়া যায়!”

যখন এই ঘটনা ঘটে তখন আমার পুত্র হয় নাই, তারপর আমার পুত্র শরতের জন্ম হয়।

সে ২১/২২ বৎসর বয়সে আদালতের কার্য্যে প্রবেশ করে ; সেই সময় অন্নদা গাঙ্গুলী নামে আদালতের একজন কর্ম্মচারী ছিলেন। তিনি পুরোহিত পাড়ায় গোপাল ভট্টাচার্য্যের বাসা ভাড়া করিয়া থাকিতেন। তাহার সহিত ঐ মহিলা ভূতের কথাবার্ত্তা পর্য্যন্ত হইয়াছিল।

উক্ত গাঙ্গুলী মহাশয় একদিন আমার কাছে আসিয়া বলিলেন, “কবিরাজ মহাশয়! শুনিয়াছি ঐ পাড়ায় থাকার সময় একটী বিধবা মহিলার সহিত মাঝে মাঝে আপনার দেখা সাক্ষাৎ হইত কিন্তু আমার সহিত কল্য রাত্রে তাহার কথাবার্ত্তা পর্য্যন্ত হইয়াছে। আমি আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করাতে তিনি বলিলেন – কল্য রাত্রে বড় গরম পড়িয়াছিল। অধিক রাত্রে বাহির বাড়ীর ঘরে বসিয়া তামাক খাইতেছিলাম এমন সময় দেখি বাসার সম্মুখের ফটকের বাঁশের খিল খসাইয়া একটী স্ত্রীলোক বাসায় প্রবেশ করিতেছে। এ বাসাটি আবার কে করিল এইরূপ বার বার বলিতেছে আর আমার সম্মুখে অগ্রসর হইতেছে। আমি কে, কে ? বলাতে বলিল – “ আমাকে চেন না, আমি আতরজান আমাকে পাড়ার সকলেই জানে।” ইহার পর আর কিছু দেখিলাম না, সে তৎক্ষণাৎ অদৃশ্য হইয়া গেল। আমি ভূতের সহিত কথা কহিতেছি - একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করিলাম না, আমি মনে করিলাম : কোথাকার একটা খারাপ মেয়ে লোক বাসায় প্রবেশ করিতেছে এখনই ইহাকে তাড়াইয়া দিতে হইবে। কিন্তু একা তাহাকে অন্বেষণ করিতে সাহস হইল না। প্রসন্ন বাবুর পুষ্করিণীর পারে একজন পশ্চিমা লোক ছিল, সে আমার বাসায় রোজ দুধ দিত। একটু অগ্রসর হইয়া তাহাকে ডাকিতে আরম্ভ করিলাম। উত্তর না পাইয়া আবার বলিলাম – শীঘ্র উঠ, বড় আশ্চর্য্য দেখিয়াছি! তখন সে বিছানায় থাকিয়াই বলিল – বাবু ঘরে যান , রাত্রি অনেক হইয়াছে, আর বাহিরে থাকিবেন না। আমি সাহস না পাইয়া অগত্যা গৃহে প্রবেশ করিলাম।

পর দিন ঐ দুগ্ধ ওয়ালা আমার মাতার নিকট আসিয়া জানাইল যে এ পাড়ায় অধিক রাত্রে একটী বিধবা স্ত্রীলোকের চেহারা অনেকেই দেখে, বাবুও বোধ হয় কল্য রাত্রে তাহাই দেখিয়া আমাকে ডাকিতে গিয়াছিলেন ; আমি উঠি নাই। আপনি নিষেধ করিবেন, আর কোন দিন ঐরূপ দেখিলে বাবু যেন তাহাকে তাড়াইতে যান না, তাহাতে ভয় পাওয়াও আশ্চর্য্যের বিষয় নহে।

অন্নদা বাবু এই আতরজানের কথা শেষ করিলেই আমার স্মরণ হইল বস্তুতঃই আতরজান নামে একটী মুসলমান মহিলা সেই পাড়ায় ছিলেন। এখন যেখানে নির্ম্মলাবাস তাহার একটু পূর্ব্ব দিকেই তাহার বাড়ী ছিল। আমি একবার তাহার বাত রোগের চিকিৎসাও করিয়াছি। তাহার জীবিত অবস্থায় তাহার চেহারা হাঁটা চলা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর ভূতের চেহারা হাঁটা চলা তার ভঙ্গী ঠিক একরকম, ইহাও তখন স্মরণ করিয়া বুঝিতে পারিলাম। ১২৮১ সন হইতে ১৩০৩ সন পর্য্যন্ত আতরজান ঐ পাড়ায় থাকিয়া অনেকের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিয়াছে। শেষ বারে কথাবার্ত্তা পর্য্যন্ত বলিয়াছে। বর্ত্তমানে সেখানে সে আছে কিনা জানিনা, সে পাড়ায় অনুসন্ধান করিলে ঐ ভূতের অস্তিত্ব অনস্তিত্বের খবর পাওয়া যাইতে পারে।



লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.