প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র: পশ্বাবলী(সূচী)

      ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থায় এদেশীয়দের বিদ্যা লাভের পথটা খুব মসৃণ হয় নি। অন্যান্য বহু বাধা বিপত্তির মধ্যে এদেশের লোকের দীর্ঘদিনের লালন করা মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গীও বিঘ্ন সৃষ্টি করেছিল। যেমন অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত রীতি ছিল ব্রাহ্মণের ছেলেরা অব্রাহ্মণ ছেলেদের সঙ্গে পড়বেনা। ইংরেজদের দ্বারা মুদ্রিত পুঁথি বা পুস্তক পাঠেও ছিল আপত্তি। সকলেই যে এতে সামিল হয়েছিল তা নয়, আবার এসবই যেহেতু আচরণ ও সংস্কারের বিষয়, ইংরেজরাও স্বাভাবিক কারণেই এতে এগিয়ে এসে জোর খাটায় নি। এসব কারণে শিক্ষা প্রসারে এবং শিক্ষিত লোক তৈরি হতে সময় লেগেছিল। ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও বাধা ছিল উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তকের অভাব। তখন কেবল বাইবেল ও নীতিকথা সম্বলিত কিছু বই ছিল। এই বাধা দূর করতে কলকাতায় ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয় ‘স্কুল বুক সোসাইটি’। এখান থেকেই প্রথম শিক্ষার্থীদের পাঠোপযোগি নানা বিষয়ে পুস্তক লিখিত ও প্রকাশিত হতে থাকে। এর পরের বছরেই মার্কুইস অফ হেস্টিংসের সভাপতিত্বে স্থাপিত হয় ‘স্কুল সোসাইটি’। এই সোসাইটির উদ্যোগে বহু বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। কেদারনাথ মজুমদার প্রদত্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৮২১ সালে ১১৫ টি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল এবং ছাত্র ভর্তি হয়েছিল ৩৮২৮ টি। এইসব ছাত্রদের প্রয়োজন মেটাতে স্কুল বুক সোসাইটির দায়িত্ব আরও বেড়ে যায়।

         ১৮২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা স্কুল বুক সোসাইটি ( Calcutta School Book Society ) থেকে বের হয় মাসিক পত্রিকা ‘পশ্বাবলী’। পশুদের নিয়ে লেখা এর প্রথম দিকের লেখাগুলি সম্পাদনা করেন পিয়ার্স ও জন লসন (W. H. Pearce and John Lawson)। জন লসন ধাতু খোদাই ও কাঠ খোদাই ব্লক তৈরী করতে বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। ভারতে এসে তিনি প্রথম শ্রীরামপুরে গিয়ে মিশন প্রেসে চীনা ভাষায় অক্ষর তৈরী শুরু করেন। পরে কলকাতায় এসে ধাতব ব্লক প্রস্তুত করায় মন দেন এবং স্কুল বুক সোসাইটি থেকে তার নিজের খোদাই করা সিংহের ছবি সম্বলিত ‘সিংহের বিবরণ’ নামে একটি পুস্তিকা বের হয়। ছাত্রদের কাছে এর চাহিদা দেখে প্রতি মাসে একটি পশুর ছবি নিয়ে লসন ‘পশ্বাবলী’ নাম দিয়ে পুস্তিকা বের করতে থাকেন। লসনের তৈরী কাঠে খোদাই করা ব্লক থেকে প্রস্তুত বিভিন্ন পশুদের ছবি সম্বলিত এই পত্রিকাটিই প্রথম সচিত্র পত্রিকা বলে জানা যায়। তখন প্রতিটি পশুর ছবির নীচে একটি কবিতা জুড়ে দেওয়া হত । প্রথম চারটি সংখ্যা প্রকাশের পর ৫ম ও ৬ষ্ঠ সংখ্যা অনেক দেরীতে বেরোয়। ১৮২৭ সালে লসনের আকস্মিক মৃত্যুর পরে পত্রিকাটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়।
এখানে সিংহের ছবি সম্বলিত একটি পাতার প্রতিলিপি দেওয়া হল। সিংহের ছবির নীচে চার লাইনের যে কবিতাটি এবং বিবরণ লেখা ছিল তা হল :

“সিংহের বৃত্তান্ত কথা শুন দিয়া মন,
যাহার প্রতিমা এই উপরে লিখন।
সকল পশুর মধ্যে হয় বলশালী,
সেই হেতু ইহাকে পশুর রাজা বলি।

         ইহার জন্মস্থান আফ্রিকা ও আসিয়া, এই উভয় দেশের মধ্যস্থানেই জন্মে, এই কারণে শীতস্থানে কখনও বাস করে না। যে ২ নিভৃত স্থানে উষ্ণের নিমিত্তে লোকেরা বাস করিতে পারে না, সেইখানে সিংহ অনায়াসে ও সুখে বাস করে। উষ্ণ দেশোৎপন্ন প্রযুক্ত তাহারা স্বাভাবিক রাগী ও বলবান হয়। পূর্ব্বে ঐ দেশদ্বয়ের মধ্যারণ্যে অনেক অনেক সিংহ উৎপন্ন হইত, কিন্তু এইক্ষণে তাহার অনেক ন্যূনতা দেখা যায়।” ইত্যাদি।

সিংহের ছবি নিয়ে একটি কৌতুকপ্রদ কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন জেমস লং তার ‘ডেসক্রিপ্টিব ক্যাটালগ অফ বেঙ্গলী ওয়ার্কস’ নামক গ্রন্থে। তখন হিন্দুদের মধ্যে অনেকের বিশ্বাস ছিল যে জগতে সিংহ মাত্র একটিই। ছাপানো ছবি দেখে একটি স্কুলের ছেলেদের ধারণা হয়েছিল যে সেই সিংহটি সশরীরে সেখানেই উপস্থিত হয়েছে। তারা এতটাই ভয় পেয়ে যায় যে মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত স্কুল ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।

         লসনের মৃত্যুর পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘পশ্বাবলী’র সম্পাদনা করেন হিন্দু কলেজের অধ্যাপক রামচন্দ্র মিত্র। সম্ভবতঃ ১৮৩৩ সালে “কুক্কুরের বৃত্তান্ত” দিয়ে তার এই পর্যায়ের যাত্রা শুরু। ইংরাজি ও বাংলা উভয় ভাষাতেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হত। দ্বিতীয় পর্যায়ের মোট ১৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয় - প্রথম খণ্ডে ৮টি ও দ্বিতীয় খণ্ডে ৮টি। প্রথম ৮টিতে ছিল - কুকুর,ঘোড়া, গাধা,ষাঁড়,মহিষ,ভেড়া,ছাগল ও উট। দ্বিতীয় খণ্ডে ছিল -নেকড়ে,চিতা,বাঁদর,বীবর,শীল, বাদুর,খরগোশ ও ইঁদুর। তবে সংখ্যাগুলির প্রকাশ ছিল অনিয়মিত। এ ছবিগুলির প্রস্তুতকারক কে ছিলেন তা কিন্তু অজানাই থেকে গেছে। এখানে উট এবং ছাগলের যে বিবরণ ছাপা হয়েছিল সেটি নীচে দেওয়া হল। জানা যায় কবিতাগুলি অনুবাদ করেছিলেন পিয়ার্স, সেক্ষেত্রে ইংরেজরা বাংলা ভালই আয়ত্ব করেছিলেন বলে মানতে হয়। নীচের উধৃতিতে বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।

“ক্ষুধা তৃষ্ণা সহে উষ্ট্র অতি উপকারি।
মরুভূমি রূপ সিন্ধু তরিবার তরী।।
অল্পাহারে তুষ্ট থাকে প্রভুভক্ত অতি।
যাইতে নির্জল দেশে হয় দৃঢ়মতি।।
আরাবেরা মানে সভে অনুকূল বিধি।
নহিলে দিবেন কেন উষ্ট্র রূপ নিধি।।”

ছাগলের বর্ণনায় রয়েছে –

“ছাগল শরল জাতি উপকারি হয়।
কিঞ্চিৎ করিলে স্নেহ বশ্য ভাবে রয়।।
অহিংসক ছাগকারু অপকারি নয়।
কে কোথা ছাগলে দেখে পাইয়াছে ভয়।।
ইহাকে বলির চলে মারি যেবা খায়।
তাহারা কেমন হিঁদু হায় হায় হায়।।”

       এখানে হিন্দু ধর্মের প্রতি প্রচ্ছন্ন কটাক্ষ লক্ষণীয়। এদেশের লোকদের কিছুটা শিক্ষিত করে নিজেদের কাজে লাগানো এবং একই সঙ্গে খৃষ্ট ধর্মের মহত্ব প্রচার ও হিন্দু ধর্মের সঙ্কীর্ণতা তুলে ধরাও ছিল প্রকাশিত পত্রিকাগুলির উদ্দেশ্য। তবে পরিশেষে একটা কথা। ‘পশ্বাবলী’র কি দ্বিতীয় মুদ্রণ হয়েছিল ? কারণ অনেক ক্ষেত্রে ঘোষিত সংখ্যার সঙ্গে বিজ্ঞাপিত পশুর ছবির অমিল রয়েছে মনে হয়।

প্রতিলিপি পরিচয় –

চিত্র ১

চিত্র ২


চিত্র ১ ও চিত্র ২ – উট এবং ছাগলের ছবি সহ প্রকাশিত ছড়া।

দীপক সেনগুপ্ত

 

 

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।



Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।