প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৭

 

প্রদীপ

দীপক সেনগুপ্ত


সচিত্র মাসিক পত্রিকা ‘প্রদীপ’ প্রকাশিত হয় ১৩০৪ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে (১৮৯৭ সালের ডিসেম্বর)। ‘প্রবাসী’ খ্যাত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘প্রদীপ’ ছিল বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজতত্ব, দারিদ্র্য ও অন্নসমস্যা ইত্যাদি বিবিধ বিষয় দিয়ে ‘প্রদীপ’-এর ছিল উজ্জ্বল প্রকাশ। ‘প্রদীপে’ই রামানন্দ লিখেছেন :

“একখানি আদর্শ কাগজ চালাইতে হইলে যদি আপাততঃ আয়ের অতিরিক্ত কিছু টাকা ব্যয় হয়, তাহা নির্বাহ করিবার উপায় করা উচিত। বস্তুতঃ লোকশিক্ষার জন্য যেমন বিদ্যালয়ের প্রয়োজন, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকাদিরও তদ্রূপ প্রয়োজন। যেমন স্কুল কলেজ চালাইবার জন্য বড়লোকেরা টাকা দেন, তেমনি ভাল কাগজ চালাইবার জন্যও দান করা উচিত। ..... আমি সম্পাদকের কার্য্যকে শিক্ষক বা অধ্যাপকের কার্য্য অপেক্ষা কম পবিত্র ও দায়িত্ত্বপূর্ণ মনে করি না। স্কুল কলেজের উন্নতি করিতে হইলে endowment চাই। যেমন পুরাকালে চতুষ্পাঠী এবং দেবমন্দিরের ব্যয় নির্বাহার্থ ব্রহ্মোত্তর ও দেবোত্তর জমি দান করা হইত, একালে তদ্রূপ বিদ্যা-মন্দিরের ব্যয় নির্বাহার্থ সম্পত্তি দান প্রয়োজন। আমার মতে সাময়িক সাহিত্যের উৎকর্ষ বিধান এবং মর্য্যাদা রক্ষার জন্যও এইরূপ সম্পত্তির প্রয়োজন।”

প্রতিটি নতুন পত্রিকা প্রকাশের শুরুতে পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে দু’চার কথা বলা হয়ে থাকে। ‘প্রদীপে’র সূচনা অংশে বলা হয়েছে :

“ “প্রদীপে”র বিজ্ঞাপন পড়িয়া হয়ত অনেকেই ভাবিয়াছেন, -“এতগুলি মাসিক পত্র থাকিতে আবার একটি কেন ?” ইহার উত্তরে আমাদের বক্তব্য এই যে, যতপ্রকার মাসিক পত্র হইতে পারে , বাঙ্গালায় তৎসমুদয়ই আছে, ইহা, বোধ হয়, কেহই বলিবেন না। “প্রদীপ”কে আমরা যেরূপ কাগজ করিতে চাই, তদ্রূপ বাঙ্গালা কাগজ একটিও নাই। ইহাই ইহার প্রকাশের কারণ। অবশ্য আমাদের কথার অর্থ এ নয় যে আমরা অশ্রুতপূর্ব্ব একটা কিছু করিব; বা “প্রদীপ” সর্ব্বোৎকৃষ্ট মাসিক পত্র হইবে, ইহার আলোকে অপর পত্রগুলি নিষ্প্রভ হইয়া যাইবে। আমরা কেবল এই বলিতে চাই যে আমরা নিজ ক্ষুদ্র সাধ্যানুসারে সামান্য ভাবে নূতন কিছু করিতে চেষ্টা করিব।
“ “প্রদীপে” কি কি বিষয়ে প্রবন্ধাদি থাকিবে ? এই প্রশ্নও অনেকের মনে উদিত হইয়া থাকিবে। ইহার যথোচিত উত্তর দেওয়া বড় কঠিন। অন্যান্য সামগ্রীর ন্যায় প্রয়োজনানুসারে নানাবিধ রচনা ফরমাইস দিলেই পাওয়া যায় না। সুতরাং প্রথম হইতে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া ভাল নয়, এবং অঙ্গীকার করা সম্ভবপরও নহে। তদ্ভিন্ন পাঠকবর্গের রুচি এবং প্রয়োজন এরূপ বিভিন্ন প্রকারের যে, সকলের মনোরঞ্জন অসম্ভব বলিলেও চলে। যদি আমরা বলি, “প্রদীপে” নানাবিষয়ক গভীর তত্ত্বনিচয় আলোচিত হইবে, তাহা হইলে সারগ্রাহী ব্যক্তিগণ সন্তুষ্ট হইবেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু অপর দিকে যাহারা প্রধানতঃ বা কেবলমাত্র চিত্তবিনোদন ও কালক্ষেপের জন্য মাসিকপত্র পাঠ করেন, তাঁহারা অসন্তুষ্ট হইবেন। আবার যদি বলি, ইহাতে গল্প এবং কৌতূহলজনক প্রবন্ধ ও কবিতা প্রচুর পরিমাণে থাকিবে, তাহা হইলে তত্ত্বান্বেষিগণ রাগিবেন, কিন্তু আমোদলিপ্সুগণ নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হইবেন। এবম্বিধ সঙ্কটে পরিয়া অর্দ্ধজরতীয় ন্যায় অনুসারে উভয় পক্ষের সন্তোষজনক কোন উত্তর দেওয়া সম্ভব কিনা, সন্দেহের বিষয়। যাহাই হউক, সংক্ষেপে এইমাত্র বলিতে পারি যে, শিক্ষা এবং চিত্তবিনোদন উভয়ের যথাযোগ্য সংমিশ্রণের প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া আমরা “প্রদীপ” সম্পাদন ও পরিচালনের চেষ্টা করিব। সংসারে মানবের অনুশীলনীয় যতগুলি বিষয় আছে, তৎসমুদয়ের তালিকা দিয়া, সর্ব্ববিষয়ক প্রবন্ধ “প্রদীপে’ থাকিবে, এরূপ লিখিয়া দিলে শুনায় ভাল এবং আড়ম্বরও বেশ হয়। কিন্তু আমরা আড়ম্বরের বিরোধী; সুতরাং এ বিষয়ে প্রচলিত বিধির অনুসরণ করিতে পারিলাম না।
“অঙ্গীকার করিলেই যে অঙ্গীকার পালন করিতে পারা যায়, তাহা নয়। সুতরাং কার্য্য দেখিয়া বিচার করাই ভাল। কিন্তু আমাদের বিনীত অনুরোধ এই, বঙ্গসাহিত্যানুরাগিগণ “প্রদীপে”র প্রথম সংখ্যা দেখিয়াই যেন শেষ সিদ্ধান্তে উপনীত না হন।
“পরমেশ্বরের কৃপার উপর নির্ভর করিয়া আমরা কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলাম, আমরা কেবল খাটিতেই অধিকারী, ফলে আমাদের অধিকার নাই, দলদাতা তিনি। কিমধিকমিতি।”

“সূচনা” অংশ দীর্ঘ হলেও এটির সবটুকুই উধৃত হল, না হলে পত্রিকা সম্পাদকের উদ্দেশ্য এবং মূলতঃ কোন শ্রেণীর পাঠককে তিনি অগ্রাধিকার দিচ্ছেন সেটা স্পষ্ট হত না। ‘প্রদীপে’র প্রথম সংখ্যায় যে সব লেখা স্থান পেয়েছিল, সেগুলি হলঃ – ‘সূচনা’ (সম্পাদক), ‘ঈপ্সিত’ (কবিতা) (সম্পাদক?), ‘মরিব কি বাঁচিব বা শস্য ও স্বাস্থ্য’ (জ্ঞানেন্দ্রলাল রায়), ‘আগ্রা – ১৮৫৭ অব্দের মধ্যভাগে’ (রজনীকান্ত গুপ্ত), ‘মায়াবাদ – সুখীর উক্তি ও দুঃখীর উক্তি’ (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়), ‘মনের প্রতি উপদেশ’ (কবিতা) (বিনয় কুমারী ধর), ‘অশ্রু’ (কবিতা) (পূর্ণচন্দ্র সেন), ‘জ্যোতিষ’, ‘কলিকাল’ (উপন্যাস), ‘সীমান্ত সংগ্রাম’ (হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘোষ), ‘পরজীবী’ (যোগেশচন্দ্র রায়), ‘যোদ্ধা প্যারীমোহন’ (সম্পাদক)। এখানে ‘জ্যোতিষ’ প্রবন্ধে জ্যোতির্বিদ্যা (astronomy) আলোচিত হয়েছে, জ্যোতিষশাস্ত্র (astrology) নয়।

‘প্রদীপে’র প্রথম ভাগে (১৩০৪ পৌষ – ১৩০৫ অগ্রহায়ণ) রয়েছে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসুর প্রতি’ – “বিজ্ঞান-লক্ষ্মীর প্রিয় পশ্চিম মন্দিরে / দূর সিন্ধুতীরে / হে বন্ধু গিয়েছ তুমি ; - জয়মাল্যখানি / সেথা হতে আনি / দীনহীনা জননীর অবনত শিরে / পরায়েছ ধীরে / ......।” এর পরেই রয়েছে সম্পাদক রামানন্দর লেখা প্রবন্ধ ‘জগদীশচন্দ্র বসু’। প্রথিতযশা মনীষীদের জীবনচর্যা সম্বন্ধে লোককে অবহিত করতে পত্রিকাটিতে নিয়মিত জীবনী ছাপা হত। প্রথম ভাগেই মুদ্রিত হয়েছে – ‘অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায়’ (সম্পাদক), ‘আনন্দমোহন বসু’ (শিবনাথ শাস্ত্রী), ‘স্বর্গীয় উমেশচন্দ্র বটব্যাল’ (রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তী), ‘পন্ডিতবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ (শিবনাথ শাস্ত্রী), ‘শ্রীগোপালভট্ট গোস্বামী ও তদীয় শিষ্য শীর্ষশ্রীনিবাস আচার্য্য’ (অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়), ‘ডক্টর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদক), ‘শ্রীযুক্ত ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার’ (যোগীন্দ্রনাথ বসু, বৈদ্যনাথ, দেওঘর) প্রভৃতি। শৈলেশচন্দ্র মজুমদারের উপন্যাস ‘কলিকাল’ ও অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র ঐতিহাসিক উপাখ্যান ‘লাল পল্টন’ রয়েছে প্রথম ভাগে, দুটোই ধারাবাহিক। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘সিমলা-শৈল’ ও জলধর সেনের ‘প্রবাসের সুখ’ ভ্রমণ পিপাসুরা উপভোগ করবেন ; সঙ্গে রয়েছে উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর মূল্যবান প্রবন্ধ ‘হাফটোন ছবি’। প্রবন্ধটিতে এদেশে হাফটোন ছবির প্রবর্তক উপেন্দ্রকিশোর সহজবোধ্য ভাষায় হাফটোন ছবির তত্ত্ব ও প্রস্তুত প্রণালী বর্ণনা করেছেন। ১৩০৫ আষাঢ় সংখ্যায় ‘ “ ’চৈতালী”-সমালোচনা সম্বন্ধে বক্তব্য’ শীর্ষক রমণীমোহন ঘোষের একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য প্রবন্ধ।
গল্প লিখেছেন দীনেন্দ্রকুমার রায়, রাধামণী দেবী, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রমুখ। কবিতা লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, কুমারী লজ্জাবতী বসু, বিনয়কুমারী ধর, প্রমথনাথ রায় চৌধুরী, শরচ্চন্দ্র রায় চৌধুরী এম. এ. বি. এল., পূর্ণচন্দ্র সেন, রমণীমোহন ঘোষ, অবিনাশচন্দ্র দাস বীরেশ্বর গোস্বামী প্রভৃতি।

পত্রিকার দ্বিতীয় ভাগে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে যেমন, ‘আলোকতত্ত্ব’ (রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী), ‘উদয়াস্তের সূর্য্য কেন বড় দেখায়?’ (উপেন্দ্রকিশোর রায়), ‘দৃষ্টি বিভ্রম’ (জগদানন্দ রায়), ‘অণুবিক্ষণ’ (যোগেশচন্দ্র রায়), ‘ভারতীয় মানমন্দির’ (অপূর্ব্বচন্দ্র দত্ত)। স্পষ্টতই বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদক রামানন্দ মানুষকে বিজ্ঞান-সচেতন করে তোলার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়ের রচনার কয়েকটি ত্রুটি উল্লেখ করে যোগেশচন্দ্র রায় প্রবন্ধ লিখেছেন ‘ক্ষিতীজস্থ চন্দ্র সূর্য্য বিম্ব বড় দেখায় কেন?’ ক্ষুব্ধ উপেন্দ্রনাথ এর প্রত্যুত্তরও দিয়েছেন।

প্রথম ভাগের মতই দ্বিতীয় ভাগেও দেশের ও বিদেশের মনীষীদের জীবনী লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন – ‘এলিজাবেথ বেরেট ব্রাউনিং’, ‘আচার্য্য মাক্সমূলার’, ‘শ্রীমান শঙ্করাশ্রম স্বামী’, ‘হাজি মহম্মদ মহসীন’, ‘বুদ্ধদেব’, ‘বাবা লছমনদাস’, ‘বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘চাণক্য’, ‘রায় কালীপ্রসন্ন ঘোষ বাহাদুর’ প্রভৃতি।

উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মূল্যবান প্রবন্ধ – ‘আমাদের গৃহে অন্তঃপুর শিক্ষাও তাহার সংস্কার’ (স্বর্ণকুমারী দেবী) [‘অবসরে’ সঙ্কলিত হয়েছে], ‘ইতর প্রাণীর মুখে মানবীয় ভাব’ (আদিত্যকুমার চট্টোপাধ্যায়), ‘উদ্দেশ্যবিহীন মিথ্যা কথা’ (জ্ঞানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘গুর্জ্জর কাহিনী’ (দীনেন্দ্রকুমার রায়), ‘বঙ্গভাষা ও বঙ্গসাহিত্য’ (দীনেশচন্দ্র সেন), ‘বিলাতে সন্তানশিক্ষা’ (কৃষ্ণভাবিনী দাস), ‘চিত্ত-বিকাশ’ (প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়), ‘ফলিত জ্যোতিষ’ (রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী), ‘ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস’ (দীনেন্দ্রকুমার রায়), ‘জন্মান্তর সমস্যা’ (দীনেশচন্দ্র সেন), ‘ভাষা রহস্য’ (অপূর্ব্বচন্দ্র দত্ত), ‘বঙ্গের রমণীকবিগণ’ (দীনেশচন্দ্র সেন), ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ (শ্রীম কথিত), ‘বঙ্গভাষায় বৈদেশিক পারিভাষিক শব্দ’ (যদুনাথ চক্রবর্ত্তী), ‘দেশী ও বিলাতী জিনিস’ (কৃষ্ণভাবিনী দাস), ‘বলেন্দ্রনাথের অসমাপ্ত রচনা’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘সাহিত্যে ভাণ’ (হরিসাধন মুখোপাধ্যায়), ‘অষ্টেন্ড কোম্পানী’ (নিখিলনাথ রায়), ‘সমাজ চিত্র’ (জলধর সেন), ‘স্বাধীন ও পরাধীন নারীজীবন’ (কৃষ্ণভাবিনী দাস)।
‘খুকুমণির ছড়া (সমালোচনা)’ (অগ্রহায়ণ ১৩০৬) নামক প্রবন্ধে শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছোটদের জন্য রচিত বহু প্রচলিত ছড়ার অবাস্তবতা নিয়ে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন। দৃষ্টান্ত স্বরূপ-

“অনেকগুলি ছড়া খুকুমণির অমিশ্রিত খোসামোদ। মাতা খুকুকে বিদায় দেবার সময় পোষাক পরাইতেছেন, আর তাহাকে সুরসংযোগে কহিতেছেন – ‘খোকা যাবে নায়ে / লাল জুতা পায়ে’ ......। “...... এই ছড়ার কতকগুলি আগাগোড়া মিথ্যা কথা। এমন কি সম্মানযোগ্য নারীজাতি কর্ত্তৃক তাহা উক্ত না হইলে তাহাকে গাঁজাখুড়ি বলিতে কুন্ঠিত হইতাম না। যথা – ‘সোনার পটল ভেজে দেবো / হীরের বেগুণ পোড়া’ ......” । এরূপ অসম্ভব সুখের প্রত্যাশা খোকনমণিকে দেওয়া মাতার নিতান্ত অনুচিত কার্য্য।

দ্বিজেন্দ্রলাল আরও লিখেছেন -

“কতকগুলি ছড়া আবার খোকনমণির কল্পিত ভবিষ্যৎ জীবনের আলেখ্য। তাহার মধ্যে প্রধান ব্যাপার খোকনমণির বিবাহ। তদ্ভিন্ন আর কি হইতে পারে ? বঙ্গীয় রমণী জীবনের মধ্যে একটি কার্য্যের খবর রাখেন। তাহা বিবাহ। তাঁহার খোকন যে ভবিষ্যতে কেশব সেন কি বঙ্কিম চাটুর্য্যে কি রমা বাই হইবে, এরূপ আশা জননীর মনে সাধারণতঃ উদিত হয় না। তাহার কিরূপ বিবাহ হইবে তাহাই তাঁহার প্রধান আলোচ্য বিষয়।

তাই তিনি বলিয়াছেন –

‘খোকাবাবু করবে বিয়ে / সোণার টোপর মাথায় দিয়ে’ । ‘খুকু যাবে শ্বশুর বাড়ি সঙ্গে যাবে কে / বাড়ীতে আছে হুলো বিড়াল কোমর বেঁধেছে’।

...ইত্যাদি।

দেশাত্মবোধে সদা জাগ্রত দ্বিজেন্দ্রলাল অতি মাত্রায় বাস্তববাদী। একই ধারায় কল্পনা বর্জিত আবেগ রহিত বাস্তবতা বোধে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার তরী’-রও সমালোচনা করেছেন।

‘প্রদীপে’র দ্বিতীয় ভাগে প্রকাশিত অন্য কয়েকটি রচনা – ‘সেলিনা বেগম’ (গল্প, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়), ‘বালি দ্বীপের হিন্দুরাজ্য’ (প্রবন্ধ, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়), ‘তাতার প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়’ (প্রবন্ধ, অজ্ঞাত), ‘সোণার ছবি’ (কবিতা, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়)। গ্রন্থ সমালোচনা বিভাগে রয়েছে ‘সিদ্ধান্তদর্পণঃ’ নামে সংস্কৃত ভাষায় রচিত জ্যোতিষ বিষয়ক একটি গ্রন্থ, ‘শ্রীমচ্চন্দ্রশেখর সিংহেন বিরচিতঃ’।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচিত ‘সোণার ছবি’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি –

“হেমন্তেরি নীরব স্নিগ্ধ শান্ত দুপর বেলা, / বকুল তলায় ঘাসের উপর, একান্ত একেলা, / ধূলা নিয়ে আপন মনে খেলা করে’ খানিক / ঘুমিয়ে গেছে যাদু আমার ঘুমিয়ে গেছে মাণিক। / ধূলার প্রাসাদ তৈরি করে’ বাছার গরব ভারি; / নিজের বাহাদুরিটুকু কর্ত্তে যেন জারি / বাজাচ্ছিল কাঠি দিয়ে কাঠের বাক্স ভাঙা, / হাস্যে আরো মিষ্ট করে’ ওষ্ঠ দুটি রাঙা / আপন মনে তৈরি সুরে আপন মনে গেয়ে;- / এমন সময় ঘুমটি এল নয়ন দুটি ছেয়ে, ......।”

সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ ছিল একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা। পত্রিকাটির মাসিকপত্র সমালোচনা বা গ্রন্থ সমালোচনা ছিল একটি আকর্ষণীয় বিভাগ। এখানে নিয়মিত সমকালীন বহু মাসিক পত্রিকা ও প্রকাশিত গ্রন্থের সমালোচনা লিপিবদ্ধ হত। সমালোচকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি স্বয়ং। ‘সাহিত্যে’র ১০ম বর্ষ ৩য় সংখ্যায় ‘প্রদীপ’ পত্রিকার ১৩০৬ জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় সংখ্যা দুটির দীর্ঘ সমালোচনা করা হয়েছে। সমালোচনার ভাষা সব সময় খুব মার্জিত ছিল না। অনেক সময় মূল লেখক এর তীব্র প্রতিবাদও করেছেন, অনেক তর্ক বিতর্কও হয়েছে। এখানে ‘সাহিত্যে’ প্রকাশিত ‘প্রদীপে’র উক্ত যুগ্ম-সংখ্যার সমালোচনা উধৃত করছি –

“ প্রদীপ। জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ়। প্রথমেই শ্রীযুক্ত হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের “সেলিনা বেগম” ইত্যভিধেয় একটি গল্প। লেখক গল্প রচনায় অকৃতকার্য্য হইয়াছেন। তাঁহার নায়িকার প্রেম তিনি নিজে ব্যক্ত করিয়া গল্পটির রসভঙ্গ করিয়াছেন; নায়িকার কথায়, কার্য্যে, সেই প্রেম কোথাও পরিস্ফুট ও পরিব্যক্ত হয় নাই। সুতরাং গল্পটি অবলম্বনহীন ও শিথিল হইয়া পড়িয়াছে। কেমন করিয়া প্যারাগ্রাফ ফেনাইয়া প্রবন্ধে পরিণত করিতে হয়, শ্রীযুক্ত অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় তাঁহার রচিত “বালি দ্বীপের হিন্দুরাজ্য” প্রবন্ধে তার আদর্শ দেখাইয়াছেন। “তাতার প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়” প্রবন্ধটি বেশ হইয়াছে। “গুর্জ্জরকাহিনী” প্রবন্ধে লেখক শ্রীযুক্ত দীনেন্দ্রকুমার রায় গুজরাটীদের যে সব কুৎসিত চরিত্র-লক্ষণ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা পড়িলে বিস্মিত হইতে হয়। লেখক মাস পাঁচ ছয় বরোদায় থাকিয়া তত্রত্য প্রত্যেক জাতির সম্বন্ধে যেরূপ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিয়া আসিয়াছেন, সহসা তাহার উপর নির্ভর করিতে আমার ভরসা হয় না। এই অভিজ্ঞতা লেখকের পর্য্যবেক্ষণের ফল, না কোনও শ্বেতাঙ্গের পূর্ব্বলব্ধ অভিজ্ঞতার বঙ্গীয় পুনরাবৃত্তি? লেখক গুজরাটী সাহিত্য সম্বন্ধে অনেক মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন। তাহার সত্য মিথ্যা নির্ণয় করিবার আমাদের সামর্থ্য নাই। কিন্তু ইহা জানি, গুজরাটী সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির জন্যে গুজরাটবাসীর যথেষ্ট চেষ্টা বিদ্যমান। শ্রীযুক্ত নারায়ণ হেমচন্দ্র নামধেয় একজন গুজরাটী আত্মত্যাগী স্বদেশী সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধিকল্পে আত্মোৎসর্গ করিয়াছেন,-তিনি গুজরাটী ভাষার পরিপুষ্টির জন্য অনেক উৎকৃষ্ট বাঙ্গালা পুস্তকের গুজরাটী অনুবাদ প্রচারিত করিয়াছেন, তাহা আমরা জানি। লেখক গুজরাটে ছিলেন, কিন্তু এসব তথ্য জানেন না দেখিতেছি। তাঁহার চোখের চশমাখানিতে বিদ্বেষের রঙ্গ কিছু ঘোরাল – স্বদেশী ভ্রমণকারীর রচনায় আমরা সহানুভূতি দেখিবার প্রত্যাশা করি। সহানুভূতির অভাব জাতীয়-চরিত্র-নির্ণয়ের প্রধান প্রতিবন্ধ, সে বিষয়ে সন্দেহমাত্র নাই। শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের “সোণার ছবি” একটি অতিসুন্দর, আন্তরিকতাপূর্ণ, স্নেহস্নিগ্ধ মধুর কবিতা। ভাষার আড়ম্বর নাই, অনুপ্রাসের কোলাহল নাই, উজ্জ্বল বর্ণের বাহুল্য নাই; সহজ ভাষায়, শাদা কথায়, আপনার মনে কবি গাহিয়া গিয়াছেন; অথচ এই সহজ সুন্দর কবিতাটির মধ্যে বাৎসল্যরসের একটি কমনীয় ছবি ধীরে ধীরে বিকশিত হইয়া উঠিয়াছে। “গ্রন্থ-সমালোচনায়” সিদ্ধান্তদর্পণ নামক জ্যোতিষশাস্ত্রীয় পুস্তকের পরিচয়প্রসঙ্গে, সমালোচক গ্রন্থপ্রণেতা মহামহোপাধ্যায় সামন্ত শ্রীচন্দ্রশেখর সিংহের জীবনকাহিনীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। ভারতবর্ষের এই প্রতিভাশালী জ্যোতিষীর জীবন যেমন অপূর্ব্ব, তেমনি আড়ম্বরহীন। পাঠকগণ পড়িয়া নিশ্চিত মুগ্ধ হইবেন। শ্রীযুক্ত জলধর সেনের “সমাজচিত্র” একটি সুলিখিত সুখপাথ্য সামাজিক গল্প। ......”

স্পষ্টতই সমালোচনার ভাষা সময় সময় একটু রূঢ় মনে হতেই পারে। তবে দীনেন্দ্রকুমার তার বিরুদ্ধে শাণিত বাক্যবন্ধের জবাব যথাযথ ভাবে দিয়েছেন তার ‘গুর্জ্জর কাহিনী লেখকের নিবেদন’ শীর্ষক নিবন্ধের মাধ্যমে (‘প্রদীপ’, ভাদ্র ১৩০৬)। কলেবর বৃদ্ধির ভয়ে সেই দীর্ঘ প্রত্তুত্যর উধৃত করলাম না।

এবার ‘সাহিত্যে’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘প্রদীপে’র সমালোচনার দ্বিতীয় অংশ। এটি যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। এই অংশে বলা হয়েছে – “এবারকার ‘প্রদীপের’ শেষ পৃষ্ঠায় “একটি প্রশ্ন” মুদ্রিত হইয়াছে। প্রশ্নটি এক টুকরা কাগজে স্বতন্ত্র মুদ্রিত ও প্রদীপের পৃষ্ঠায় সংলগ্ন। প্রশ্নকর্ত্তার জিজ্ঞাসা –

লক্ষ্মীণধরের বাড়ী কোথায়? কিন্তু বন্ধুজনের অনুগ্রহে পরিশেষে জানিতে পারিলাম, ‘প্রদীপের’ “প্রশ্ন” একটি বুজরুকী। প্রশ্নের পশ্চাতে একটি অপরূপ কবিতা মুদ্রিত আছে, তাহার নাম “একটি কুকুরের প্রতি।” স্বাক্ষরের স্থলে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় নামক এক ব্যক্তির নাম মুদ্রিত আছে। প্রথম দৃষ্টিতে “প্রশ্ন” ভিন্ন আর কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না বটে, কিন্তু একটু চেষ্টা করিয়া দেখিলে নিম্নলিখিত কবিতাটি সহজে পড়া যায়, - “একটি কুকুরের প্রতি।
“চিরদিন পৃথিবীতে আছিল প্রবাদ
কুকুর চীৎকার করে চন্দ্রোদয় দেখি
আজি এ কলির শেষে অপরূপ একি
কুক্কুরের মতিভ্রম বিষম প্রমাদ।
চিরদিন চন্দ্রপানে চাহিয়া চাহিয়া
এতদিনে কুক্কুর কি হইল পাগল ?
ভাসিছে নবীনরবি নভঃ উছলিয়া
তাহে কেন কুক্কুরের পরাণ বিকল ?
নাড়িয়া লাঙ্গুলখানি ঊর্দ্ধপানে চাহি
ঘেউ ঘেউ ভেউ ভেউ কররে ফুকারিয়া,
তবু ত রবির আলো ম্লান হোল নাহি,
নাহি হোল অন্ধকার জগতের হিয়া!
হে কুক্কুর ঘোষ কেন আক্রোশ নিস্ফল
অত ঊর্দ্ধে পৌঁছে কি কন্ঠ ক্ষীনবল ?
শ্রীপ্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়।”

“ পাতা ঢাকা ফুল, ঘোমটা দেওয়া মুখ প্রভৃতির প্রতি কুতূহলী দৃষ্টি সহজে ও আগে আকৃষ্ট হয়, তাই প্রদীপ পাতলা কাগজে ছাপা প্রশ্নের আবরণ দিয়া কবিতাটির আকর্ষণশক্তির বৃদ্ধি করিয়াছেন। প্রদীপের ও কবিপুঙ্গব প্রভাতের এই অপূর্ব্ব কীর্ত্তি “সাহিত্যে” উদ্ধৃত করিলাম। কবিতাটির ‘রবি’ ও ‘ঘোষ’ এই দুইটি শব্দে বেশ বুঝা যায়, শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সমালোচক কোনও ঘোষ (শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ ?) ইহার লক্ষ্য। এই ব্যক্তিগত গালাগালির বিষয়ে বাক্যব্যয় করিয়া আমরা “সাহিত্য” কলঙ্কিত করিব না। সাহিত্যসমাজে ‘মোসাহেবির’ এমন সুন্দর দৃষ্টান্ত অতি বিরল। চন্দ্রের প্রতি চাহিয়া কুক্কুর চীৎকার করে কি না, তাহা আমাদের সাহিত্যিক ‘চন্দ্র’গণই বলিতে পারেন এবং এই শ্রেণীর মোসাহেবগণ জীবতত্ত্বে কোন অধ্যায়ে নিবিষ্ট, তাহার নীমাংসার ভার শ্রীযুক্ত রামব্রহ্ম সান্যাল মহাশয়ের প্রতি অর্পণ করিয়াই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। কিন্তু পবিত্র সাহিত্যক্ষেত্রে এইরূপ মোসাহেবি ও মেছুনীর আবার যুগপৎ আবির্ভাব দেখিয়া শঙ্কা হয়, আবার কি কবির গান বাঙ্গালা সাহিত্যের আসরে অবতীর্ণ হইবে ? ভগবান রবিবাবুকে এই ‘ভক্তের’ হস্ত হইতে রক্ষা করুন।”

প্রভাতকুমার রচিত এই ব্যঙ্গ কবিতাটির একটি প্রেক্ষাপট আছে। ১৩০৬-এর বৈশাখ সংখ্যা ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষের ‘প্রণয়ের পরিণাম’ শীর্ষক একটি গল্প প্রকাশিত হয়। দ্বাদশ পৃষ্ঠাব্যাপী রচনাটিতে কোথাও রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারিত না হলেও এটি যে তার ব্যক্তিজীবন নিয়ে কুৎসামূলক লেখা তাতে কোন সন্দেহ থাকে না। এই অপ্রয়োজনীয় বিদ্বেষপ্রসূত লেখার প্রতিবাদেই প্রভাতকুমারের কবিতা। সে সময়, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে, কি ধরণের বাদ প্রতিবাদের ফোয়ারা ছুটতো এটা তারই একটা সামান্য উদাহরণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, ‘দাসী’ পত্রিকার ১৮৯৭ ডিসেম্বর সংখ্যায় হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ রচিত ‘চৈতালী (সমালোচনা)’ নামে রবীন্দ্রনাথের কবিতার সমালোচনা করে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর উত্তরে ‘প্রদীপে’র ১৩০৫ আষাঢ় সংখ্যায় ‘ “চৈতালী”-সমালোচনা সম্বন্ধে বক্তব্য’ নামক রমণীমোহন ঘোষ একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। এখানেও মূলত সেই একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি।

তবে ‘পুণ্য’ ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা হওয়া সত্বেও উক্ত সমালোচনাকে একটু অন্যচোখে দেখেছে। ‘পুণ্য’-র সমালোচকের মতে –

“ ‘চৈতালী সমালোচনা সম্বন্ধে বক্তব্য’ প্রবন্ধটি অনেকটা ব্যক্তিগত দ্বেষ হিংসার বশবর্ত্তী হইয়া লিখিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। কোনকালে ‘দাসী’তে ‘চৈতালী সমালোচনা’ বাহির হইয়াছিল, লেখক রমণীমোহন ঘোষ আজ তাহার প্রতিবাদ লিখিয়া এক ঢিলে দুই পাখী মারিবার চেষ্টা করিয়াছেন। প্রবন্ধের লক্ষ্য শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ ও সাহিত্য সম্পাদক শ্রীসুরেশচন্দ্র সমাজপতি। কিন্তু এরূপ বৃথা বিবাদে সাহিত্যের মহান লক্ষ্য সিদ্ধ হইবার সম্ভাবনা নাই। সাহিত্যের মুখ্য উদ্দেশ্য জগতের হিতসাধন। ......” (‘পুণ্য’, আষাঢ় ও শ্রাবণ ১৩০৫)।

‘বিবাহ বাসরে বিধবা বালিকা’ নামক সরলা দত্ত রচিত আবেগপূর্ণ ও করুণ রসাশ্রিত একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছে ১৩০৬ চৈত্র সংখ্যায়। কয়েক পংক্তি –

“এক ধারে একাকিনী
কে তুই দাঁড়ায়ে বল,
এ আনন্দ কোলাহলে
কেন আঁখি ছল ছল ?
সকল মঙ্গল কাজে
কেহ নাহি ডাকে তোরে,
না বলিতে কেহ কিছু
এক ধারে যাস সরে
.....................
সকলি মুছেছে তোর
সিন্দুর বিন্দুর সাথে –
গিয়াছে আলোক ডুবে
গভীর আঁধার রাতে
কেবলি আছিস তুই
সহিতে ঝটিকা ভার;
আর আছে প্রাণ ভরা
দুঃখ শোক হাহাকার ......”

‘বিবাহ’ শীর্ষক শিবনাথ শাস্ত্রীর একটি দীর্ঘ কবিতা রয়েছে ১৩০৭ বৈশাখ সংখ্যায়। দ্বাবিংশ বর্ষের সরলপ্রাণা এক যুবতীর সঙ্গে ‘পঞ্চাধিক বিংশতি বয়সের’ এক সুদৃঢ় সুন্দর যুবকের প্রেম পশুপ্রকৃতি কুচক্রী এক ইংরাজের লালসার আগুনে দগ্ধ হয়ে যে করুণ পরিণতি লাভ করল, তারই মর্মস্পর্শী কাহিনী বিবৃত হয়েছে কবিতাটিতে। দেশী বিদেশী মনীষীদের জীবনী যথারীতি প্রকাশিত হয়েছে পরবর্তী সম্পাদকের সময়ে।

‘প্রদীপে’র অন্যান্য সংখ্যায় কিছু উল্লেখযোগ্য রচনা – ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়’ (হেমচন্দ্র সরকার এম. এ.), ‘বঙ্গসাহিত্যে বঙ্কিম’ (হারাণচন্দ্র রক্ষিত), ‘কাব্য ও কবিত্ব’ (শিবনাথ শাস্ত্রী), ‘ঐতিহাসিক চরিত্রোদ্ধার জেবউন্নিসা বেগম’ (হরিসাধন মুখোপাধ্যায়), ‘পান্ডুয়ার মেলা’ (রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তী), ‘হিমালয়’ (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়) [‘অবসরে’ প্রকাশিত], ‘প্রবাসে একরাত্রি’ (জলধর সেন), ‘অল বেরুণী’ (অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়), ‘অভিধান আলোচনা’ (মুরলীধর রায় চৌধুরী এম. এ.), ‘বাঙ্গালা শব্দদ্বৈত’ (শ্রীশ্রীনিবাস বন্দ্যোপাধায় বি. এ.), ‘বারাণসীর পথে’ (?), ‘সাময়িক সাহিত্যের কথা’ (রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়), ‘তারবিহীন তাড়িত বার্ত্তা’ (নগেন্দ্রচন্দ্র নাগ এম. এ.), ‘সৃষ্টির বিশালত্ব’ (উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী), ‘হিমাচল বক্ষে’ (জলধর সেন), ‘আলোকবার্ত্তা বা তারবিহীন টেলিফোন’ (চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বি. এ.), ‘ইংরেজের বঙ্গাধিকার’ (অম্বিকাচরণ গুপ্ত), ‘জড় ও চৈতন্য’ (রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী এম. এ.), ‘পুরাতন পুঁথি শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গল’ (মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি), ‘বৈদিক যুগে আর্য্যভূমি’ (অতুলবিহারী গুপ্ত), ‘কোথা হতে আসি-কোথা ভেসে যাই?’ (কালীপ্রসন্ন সেনগুপ্ত), ‘হেমচন্দ্র’ (হারাণচন্দ্র রক্ষিত), ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ সম্বন্ধে কতকগুলি কথা’ (রজনীকান্ত চক্রবর্ত্তী), ‘সৌর জগৎ’ (চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘কবির প্রতি কবি-প্রিয়া’ (কবিতা, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী), ‘কাব্য ও কবিত্ব’ (শিবনাথ শাস্ত্রী), ‘কংগ্রেস’ (ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়), ‘সুখ দুঃখ (হেতুবাদ)’ (প্রসাদদাস গোস্বামী) প্রভৃতি।

১৩০৯ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ থেকে অগ্রহায়ণ পাঁচ মাসের পত্রিকা এক সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। এ সম্বন্ধে শেষ পৃষ্ঠায় রয়েছে ‘আমার কৈফিয়ৎ’ শিরোনামে সম্পাদকের কারণ বিশ্লেষণ। কারণটা মূলত আর্থিক।

১৩০৭ জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে লেখা প্রিয়নাথ সেনের চিঠি ও রবীন্দ্রনাথের প্রত্যুত্তর তাদের স্বাক্ষর সহ পাশাপাশি ছাপা হয়েছে ; (এই রচনার শেষে প্রতিলিপি দেওয়া হল)।

পত্রিকা সম্পাদনা এবং উৎকর্ষ অক্ষুণ্ণ রেখে রচনা প্রকাশের ক্ষেত্রে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় একটি স্মরণীয় ব্যক্তি। বেশ কয়েকটি পত্রিকা রামানন্দ সম্পাদনা করেছেন। পত্রিকার উচ্চমান বজায় রাখতে তিনি ছিলেন যথার্থই আন্তরিক। সব রচনাই তিনি নিজে পড়তেন এবং প্রয়োজন হলে লেখকদের দিয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করিয়ে নিতেন। এজন্যই হয় ত তিনি “লেখকবর্গের প্রতি নিবেদন” অংশে জানিয়েছেন – “বিষয় ও ভাষা চিত্তাকর্ষক না হইলে কোন রচনা ক্রমশঃ প্রকাশিত হয় না। ক্রমশঃ প্রকাশ্য রচনা একেবারে আদ্যোপান্ত সম্পাদকের হস্তগত হওয়া আবশ্যক।” লেখকদের সঙ্গে তাদের ছবিও ছাপা হত। ‘প্রদীপ’-এ আলোচনা বিভাগ ছিল অনন্য। পাঠক এবং লেখক উভয়েই এই বিভাগে তাদের মতামত জানাতে পারতেন।

রামানন্দ অবসর গ্রহণ করলে ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন (৩য় বর্ষ ৩য় সংখ্যা) থেকে সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত। রামানন্দ কার্যোপলক্ষে এলাহাবাদে থাকতেন। সেখান থেকেই তিনি ‘প্রদীপ’ সম্পাদনা করতেন। নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছেন – “মাঘ মাসের প্রদীপ সম্পাদনা করিয়া শ্রীযুক্ত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় প্রদীপের সম্পদকতা পরিত্যাগ করিয়াছেন। বিদেশে বাস বশতঃ সম্পাদকের যে অসুবিধা তাহা তিনি অনেকদিন হইতেই অনুভব করিতেছিলেন। ...... এই সংখ্যা হইতে প্রদীপের সম্পাদকতার ভার আমি গ্রহণ করিলাম।” এই মর্মে ‘সম্পাদকের বিদায় গ্রহণ’ নামে রামানন্দর একটি চিঠি ১৩০৬ ফাল্গুন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরিবর্তন হলেও নগেন্দ্রনাথ সম্পাদক ছিলেন মাত্র চার মাসের জন্য। ১৩০৭-এর জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় “প্রদীপের উন্নতিকল্পে” শিরোনামে একটি বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। সম্ভবতঃ পরিচালক মহাশয়ই এটা লিখেছেন। বলা হয়েছে – “বাঙ্গালা সাহিত্য ও প্রদীপ আমাদের নিকট অভিন্ন। প্রদীপের পরিচর্যা করিয়া মাতৃভাষারই সেবা করিলাম ভাবিয়া আপনাকে কৃতার্থ বোধ করি। প্রদীপের উন্নতিকল্পে যাহা প্রয়োজন, সহজসাধ্য হউক আর কষ্টসাধ্য হউক, করিতে কখনই কুন্ঠিত নহি। এতকাল ব্যক্তিবিশেষের হস্তে প্রদীপ সম্পাদন ভার ন্যস্ত ছিল। শ্রীযুক্ত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত মহাশয় বিশেষ দক্ষতার সহিত প্রদীপ সম্পাদন করিয়া গ্রাহকবর্গ ও সাধারণের প্রীতি বর্দ্ধন করিয়াছেন। আমরা সেইজন্য তাহাদের নিকট চিরঋণী। কিন্তু দেখিলাম একের অনুরাগ ও যত্নের উপর নির্ভর না করিয়া যদি প্রদীপ দশের সমবেত যত্ন ও পরিচর্য্যা লাভ করিতে পারে, তবে ইহার উন্নতি ক্ষিপ্রতর হইবে। উদ্দেশ্য প্রদীপের উন্নতি ...... এই উন্নতির উদ্দেশ্যে কয়েকজন সাহিত্যিক লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক লইয়া প্রদীপ পরিষদ গঠিত হইল। এখন হইতে প্রদীপ সম্পাদন ভার এই পরিষদের উপর ন্যাস্ত হইল।” লেখকের নাম না থাকলেও এটি পরিচালক বৈকুন্ঠনাথ দাস লিখেছিলেন সেটি নিশ্চিত। প্রকাশক ও সত্ত্বাধিকারীর সঙ্গে মতবিরোধের জন্যই রামানন্দ ও নগেন্দ্রনাথ সম্পাদনার কাজ ত্যাগ করেছিলেন বলে জানা যায়।

সম্পাদকের নাম নিয়ে পাঠকদের মধ্যেও কৌতূহল ও বিভ্রান্তি ছিল। এ বিষয়ে ১৩০৭ পৌষ সংখ্যায় পরিচালক বা ‘অজ্ঞাত’ সম্পাদক শুরুতেই জানিয়েছেন –

“দুইটি কৈফিয়ৎ দিবার আছে। অনেকেই ‘প্রদীপে’ সম্পাদকের নাম ও মাসিক সাহিত্য সমালোচনা প্রকাশিত না হইবার কারণ জানিতে চাহিয়াছেন। বলি, পাঠক প্রবন্ধই পাঠ করিবেন, সম্পাদকের নাম ত পাঠ করিবেন না । আর সম্পাদকের যোগ্যতার বিচার বিষয়ে তাঁহার নাম অপেক্ষা কার্য্যই অধিক উপযোগী নয় কি ? অধিকন্তু সম্পাদকের নাম প্রকাশ না করিলে যে, কোন অঙ্গ হানি হয়, তাহা ত বোধ হয় না। দ্বিতীয় জিজ্ঞাস্য বিষয়ে বক্তব্য এই যে আমরা প্রদীপে কখনো মাসিক সাহিত্যের সমালোচনা করি নাই, করিবার প্রবৃত্তিও রাখি না।”

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় পত্রিকা থেকে সরে যাবার পর যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লিখেছেন –
“রামানন্দবাবু প্রদীপ ত্যাগের পর প্রদীপের অবনতি হচ্ছিল, গল্পের পরিসর বাড়ছিল। বোধ হয় প্রদীপ পরিষদ প্রদীপের জন্য ঘৃত সংগ্রহ করিতে পারেন নাই। আমার মনে পড়ছে, প্রকাশক বৈকুন্ঠনাথ দাস সম্পাদকের আসনে বসেছিলেন, কিন্তু চলতি দোকানও যে-সে চালাতে পারে না। লোকে যাকে তাকে মাল যোগায় না, যার তার দোকান হতে কেনে না। প্রদীপের সঞ্চিত ঘৃত ফুরিয়ে গেল, প্রদীপও নিভল। নূতন সম্পাদকের হাত দিয়ে এমন কদর্য গল্প বেরল, আমার মনে আছে, পাতাগুলা ছিঁড়ে ফেলে দিতে হয়েছিল। পরের মাসের প্রদীপেও দেখি সেইরূপ অশ্রাব্য অপাঠ্য গল্প। আমার নামে প্রদীপ পাঠাতে নিষেধ করতে হল।”
‘প্রদীপ পরিষদ’ও বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। পৌষ ১৩০৮ থেকে জ্যৈষ্ঠ ১৩০৯ পর্যন্ত সম্পাদক ছিলেন স্বত্ত্বাধিকারী বৈকুন্ঠনাথ দাস স্বয়ং। এরপর ১৩১২-র অগ্রহায়ণ পর্যন্ত নতুন স্বত্ত্বাধিকারী বিহারীলাল চক্রবর্ত্তী পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন।

রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তুলনীয় বিদগ্ধ ও দক্ষ সম্পাদক সংখ্যায় নিশ্চয়ই বেশি নয়। তা সত্বেও বলতে হয়, সামগ্রিক ভাবে ‘প্রদীপ’ ছিল একটি উচ্চশ্রেণীর পত্রিকা। বার্ষিক মূল্য প্রথমে ছিল দু’টাকা, পরে আড়াই টাকা। অন্যান্য বহু পত্রিকার মত ‘প্রদীপে’ও প্রতি পৃষ্ঠায় প্রকাশনার বছর বা সংখ্যার উল্লেখ ছিল না। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সম্পাদনাকালে পত্রিকার প্রচার সংখ্যা ছিল তিন হাজার। পত্রিকাটি সম্ভবতঃ আট বছর চলেছিল। পত্রিকার স্বত্বাধিকারী ও পরিচালকের সঙ্গে মতানৈক্যকে কেন্দ্র করে রামানন্দ যদি ‘প্রদীপ’ সম্পাদনা ত্যাগ না করতেন তা হ’লে ‘প্রদীপ’ই হয় ত ‘প্রবাসী’র স্থান অধিকার করত। পরে ‘প্রদীপ’-এর ধাঁচেই রামানন্দ ‘প্রবাসী’ সম্পাদনা শুরু করেছিলেন।
সংযুক্ত প্রতিলিপি পরিচয় –
চিত্র – ১ : পত্রিকার একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র।
চিত্র – ২ : অগ্রহায়ণ ১৩১০ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন।
চিত্র – ৩ : আষাঢ় ১৩১১ সংখ্যায় মুদ্রিত পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ছবি।
চিত্র – ৪ : রবীন্দ্রনাথকে প্রেরিত প্রিয়নাথ সেনের কবিতা ও রবীন্দ্রনাথের প্রত্যুত্তর।
( বড় করে দেখতে হলে Ctrl key চেপে রেখে + টিপুন )।










লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।