পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
মার্চ ১৫, ২০১৭
পুণ্য
দীপক সেনগুপ্ত
‘পুণ্য’ ঠাকুরবাড়ির মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত এবং প্রধানতঃ মহিলাদের জন্য একটি মাসিক পত্রিকা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ৩য় পুত্র ও রবীন্দ্রনাথের সেজদা হেমেন্দ্রনাথের তিন পুত্র এবং আট কন্যা । আট কন্যা হলেন : প্রতিভা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞা, মনীষা, শোভনা, সুনৃতা, সুষমা ও সুদক্ষিণা (পুর্ণিমা)। এদের উৎসাহেই প্রকাশিত হয় ‘পুণ্য’; এটিকে সম্পূর্ণ ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা বলা চলে। ‘পুণ্য’ প্রকাশিত হয় ১৩০৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে। প্রথম সম্পাদিকা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী। পত্রিকার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে ‘সূচনা’ অংশে বলা হযেছে –
“সিদ্ধিদাতা বিধাতাকে নমস্কার করিয়া, আমরা শরতের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই “পুণ্য” নামক এই মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত করিলাম। বর্ষার আগমনে শরতের প্রভাত যেরূপ বিচিত্রবর্ণে রঞ্জিত হইয়া প্রকৃতির মাঝে এবং মানবহৃদয়ে কত বিচিত্র ভাব জাগ্রত করিয়া তুলে, আশা করি, এই ক্ষুদ্র পত্রখানিও নানাবিধ প্রবন্ধে স্বীয় কলেবর সুসজ্জিত করিয়া জনসমাজের হিতসাধান ও মনোরঞ্জন করিতে সমর্থ হইবে।
“আমাদের সংসারে দুইটি বিষয় আছে; পাপ ও পুণ্য। ভগবানের ইচ্ছা যে আমরা তাঁহার এই জগৎরূপ বিচিত্র কার্য্যালয়ে পাপ পরিত্যাগ পূর্ব্বক পুণ্যকর্ম্মে নিযুক্ত হই। তিনি “শুদ্ধমপাপবিদ্ধং” আমরা তাঁহার সন্তান, আমাদের কর্ত্তব্য যে সেই শুদ্ধ অপাপবিদ্ধ বিশ্বকর্ম্মার অধীনে থাকিয়া এই বিশ্বের বিচিত্র কর্ম্মে আমরা যেন পুণ্যকেই জীবনের লক্ষ্য করি – পুণ্য উপার্জনে সচেষ্ট থাকি।
“ পুনাতীতি পুণ্যং। পবিত্র করে যাহা তাহাই পুণ্য। ঈশ্বর আমাদের অন্তরে যে শুভবুদ্ধি প্রদান করিয়াছেন তাহার দ্বারা পুণ্য ও পাপের পার্থক্য আমরা বেশ বুঝিতে পারি। সংসারে নানাবিধ কর্ত্তব্যকর্ম্মে পুণ্য আমাদের মলিনতা দূর করতঃ প্রাণ পোষণ করে।
“ সৎকার্য্য যত্নপূর্ব্বক সাধন করিলেও কখনও তাহাতে আমরা কৃতকার্য্য কখনও বা অকৃতকার্য্য হই এবং তজ্জন্য আমরা সুখী বা দুঃখী হই; কিন্তু ইহা নিশ্চয় যে আমরা আমাদের সাধ্যমত কর্ত্তব্য সাধনে নিযুক্ত থাকিলে কৃতকার্য্যতা ও অকৃতকার্য্যতার মধ্য হইতেও পুণ্যলাভ করিব – সেই পুণ্য হইতে আমাদিগকে কেহ বঞ্চিত করিতে সমর্থ হইবে না।
“ধর্ম্মকার্য্যং যতন শক্ত্যা নোচেৎ প্রাপ্নোতি মানবঃ।
প্রাপ্তো ভবতি তৎ পুণ্যমত্র মে নাস্তি সংশয়ঃ ”।।
“ বাল্যকালে পিতামাতা আমাদিগকে পরমপিতার পদানুসরণ করিয়া তাঁহারই ভাবের ছায়ায় আমাদের ক্ষুদ্রগৃহকে বিচিত্র কর্ম্মগৃহ করিয়া আমাদিগকে সুশিক্ষা দিতেন; নানা বিদ্যার আলোচনার দ্বারা বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়া পিতামাতা আমাদিগকে সেই ঈশ্বরের পবিত্র একত্বের রসাস্বাদন করাইবার জন্য ব্যাকুল হইতেন। - বৈচিত্র্যের মধ্যে থাকিয়া বিশুদ্ধ আনন্দের সহিত বেশ সহজে পরিশ্রম করিতে পারা যায়। সংসারে নানাবিধ কর্ম্মের মধ্যে পুণ্যই প্রাণদ হইয়া বিরাজ করে; ‘পুণ্যং প্রাণদমুচ্যতে।’ এই পবিত্র নামেই আমাদের এই পত্রের নামকরণ হইয়াছে। এই পত্রখানি এক্ষণে আমরা জনসমাজে প্রকাশ করিলাম সত্য, কিন্তু ইহা বহুপূর্ব্বাবধিই অন্তঃসলিলা স্রোতস্বতীর ন্যায় আমাদের ক্ষুদ্র গৃহমধ্যে প্রবাহিত হইয়া গৃহকেই পরিষিক্ত রাখিয়াছিল।
“ পূর্ব্বাবধি এই নামেই ইহা আমাদের গৃহে পরিচালিত হইত এবং হস্তযন্ত্রে মুদ্রিত হইয়া আমাদের আপনাদের মধ্যেই প্রকাশিত হইত। এখন তাহা লোকহিতার্থে জনসাধারণের মধ্যে প্রকাশিত হইল; বাল্যাবস্থা হইতে যেন নবযৌবনে পদার্পণ করিল।
“ এই পত্রে জনসমাজের উপযোগী সাহিত্য,বিজ্ঞান,প্রত্নতত্ত্ব,সঙ্গীত প্রভৃতি নানা বিষয়ক প্রবন্ধই স্থান লাভ করিবে। এতদ্ভিন্ন ইহাতে গৃহস্থের এবং মানবমাত্রেরই সর্ব্বপ্রধান অবলম্বন আহারের বিষয় প্রতি মাসেই থাকিবে। ইহাতে গার্হস্থ্য ধর্ম্মের অনুকূল শিল্পবিদ্যা প্রভৃতিও অভাব দূর করিবার সাধ্যমত চেষ্টা করা যাইবে। এক্ষণে সহৃদয় পাঠক পাঠিকাগণের নিকট আমাদের এই বিনীত নিবেদন যে, তাঁহারা যেন আমাদের এই পুণ্যকর্ম্মে সহায়তা করেন।”
হেমেন্দ্রনাথের স্ত্রী নীপময়ী সত্যেন্দ্রনাথ-পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর মত বাইরে বেরোবার সুযোগ পান নি। ঘরে বসেই তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন। তার আঁকা ছবি ‘হরপার্বতী’ ছাপা হয়েছে ১৩০৭-এর ‘পুণ্যে’। সম্পাদনার সঙ্গে সঙ্গে প্রজ্ঞা মাথা ঘামিয়েছেন রান্নাঘর নিয়ে। পত্রিকার একটি আকর্ষণীয় বিভাগ ছিল নানা ধরণের আমিষ ও নিরামিষ ব্যঞ্জনের রন্ধন প্রণালী। ঠাকুরবাড়ির প্রচলিত খাবারের বাইরে বেড়িয়ে তিনি বহু ধরণের রান্নার পদ তিনি নিজেই আবিষ্কার করেছেন। কয়েকটি পদের নামের সঙ্গে তিনি কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিদের নাম সংযুক্ত করেছেন। যেমন – ‘রামমোহন পোলাও’ (কার্তিক ১৩০৪); ‘বিদ্যাসাগর বরফি’ (আশ্বিন ও কার্তিক ১৩০৫) ইত্যাদি। সঙ্গে থাকত তৎকালীন বাজার দর। চিত্রা দেব তার ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে’ লিখেছেন –
“সুগৃহিণীর মতো তিনি আবার তৎকালীন বাজারদরটিও পাঠকদের জানিয়ে দিতেন, যাতে কেউ অসুবিধায় না পড়েন। কালের সীমানা পার হযে আজ সে বাজারদর আমাদের মনে শুধু সুখস্মৃতি জাগায়। মাছের দাম ছিল অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা - আধাসের পাকা রুই তিন বা চার আনা,চিতল মাছ তিন পোয়া ছয় আনা,বড় বড় ডিমওয়ালা কই আট-ন’টার দাম নয় দশ আনা,একটি ডিম একটা পয়সা, ঘি এক সের এক টাকা, দই এক সের চার আনা, টমেটো কুড়িটা দুই আনা ....।”
উপকরণ সহ বিভিন্ন রান্নার প্রস্তুত প্রণালী নিয়ে প্রজ্ঞার রচিত ‘আমিষ ও নিরামিষ আহারের’-এর তিনিটি খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল। ‘পুণ্যে’র পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে বিচিত্র সব খাবারের খবর।
‘পুণ্য’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত রচনাগুলি ছিল – ‘সূচনা’, ‘শরতকাল’ (কবিতা, হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর); ‘তর্পণতত্ত্ব-চন্দ্র ও পিতৃলোক’ (ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর); ‘জয়পুর পত্র’ (শোভনাসুন্দরী দেবী?); ‘চন্দ্রকণা বা চন্দ্রকান্ত মেঠাই’, ‘বাগদা চিংড়ির কাটলেট’, ‘মেটের দোপেঁয়াজা’ (প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী); ‘দেবী-প্রতিমা’ (কবিতা, হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর); ‘রমণীর মাতৃত্ব’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর); ‘বালক তানসেন’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর); ‘বঙ্গপ্রাকৃত’ (হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
হেমেন্দ্রনাথের পঞ্চম কন্যা শোভনাসুন্দরীর বিয়ে হয়েছিল হাওড়া নিবাসী নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক, কর্মক্ষেত্র সুদূর জয়পুর। স্বামীর সঙ্গে জয়পুরে গিয়ে সেখানকার প্রচলিত কাহিনী ও লোককথা নিয়ে বেশ কিছু গল্প লিখেছেন শোভনা। কয়েকটি প্রকাশিত হয়েছে ‘পুণ্য’ পত্রিকায়। যেমন – ‘দিলীপ ও ভীমরাজ’ (ফাঃ ,চৈঃ ১৩০৫); ‘লক্ষটাকার এক কথা’ (ভাঃ ১৩০৫); ‘ফুলচাঁদ’ (ফাঃ ,চৈঃ ১৩০৫); ‘গঙ্গাদেব’ (চৈঃ ১৩০৭); ‘ডালিমকুমারী’ (চৈঃ ১৩১০); ‘লুব্ধ বণিক তেজরাম’ (শ্রাঃ ১৩১১) ইত্যাদি। লোককাহিনী ছাড়াও শোভনাসুন্দরী সংগ্রহ করেছিলেন ‘কহাবৎ’ বা জয়পুরী ‘প্রবচন’ বা প্রবাদ। ভিন্নদেশীয় প্রবাদ বাংলায় অনুবাদ করে তার সমার্থক বাংলা প্রবচন খুঁজে বের করে শোভনা একটি অভিনব প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। কয়েকটি প্রবচনের নমুনা –
১। প্রবচন - সাত পাঁচ মিলে কীজে কাজ, হারে জীতে ন আবে লাজ।।
অর্থ – পাঁচ সাত জন মিলে কাজ কর; হার জিতে ( সিদ্ধাসিদ্ধিতে ) লজ্জার কারণ হইবে না।
বঙ্গীয় প্রবচন – দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।
২। প্রবচন - জঙ্গল মে মোঁর নাচা, কিসিনো না জানা।
অর্থ – বনে ময়ূর নাচলো, কেহ জানলে না অর্থাৎ বনে ময়ূর নাচলে কার কি ?
বঙ্গীয় প্রবচন – উলু বনে মুক্ত ছড়ান। ইত্যাদি।
জয়পুরী ঘরোয়া শিল্পের দিকেও শোভনা আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ব্যবহৃত বা ছেঁড়া কাগজ দিয়ে তৈরি চুপড়ি, থালা, খেলনা ইত্যাদিকে জয়পুরী ভাষায় বলা হয় ‘ডোমলা’। ‘পুণ্য’ পত্রিকায় এ বিষয়ে তিনি নিবন্ধ লিখেছেন - ‘ছেঁড়া কাগজের ডোমলা’ (মাঘ ১৩০৭)।
শোভনাসুন্দরীর বোন সুনৃতা হেমেন্দ্রনাথের মেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে কম পরিচিত। চিত্রা দেব লিখেছেন –
“তাঁর স্বামী নন্দলাল ঘোষাল ছিলেন বারুইপুরের বিখ্যাত ঘোষাল পরিবারের সন্তান। পরে অবস্থা বিপর্যয়ে তাদের চলে যেতে হয় শ্যামনগরে। সুনৃতার সঙ্গে বাপের বাড়ির যোগ ছিন্ন হয় দারিদ্য ও দূরত্বে। তাঁর যমজ সন্তানের মৃত্যু হয় জন্মের অব্যবহিত পরেই।”
এহেন ভাগ্যহত সুনৃতাও চেষ্টা করেছেন সাহিত্য রচনায়। “সাহিত্যজগতে তাঁর ভীরুকুণ্ঠিত প্রবেশ একটি মাত্র রচনা দিয়ে।” ‘ব্রহ্মে শূলীনাথ’ নামে এই রচনাটি প্রকাশিত হয় ‘পুণ্যে’র ১৩১২ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়।
‘পুণ্যভাণ্ডার’ শীর্ষক রচনায় মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়েছে দৈনন্দিন জীবনের উপযোগী ও সহায়ক কিছু বিষয়। যেমন ‘শ্বেত বস্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের দাগ লাগিলে তাহা উঠাইবার প্রণালী’ ইত্যাদি ।
হিতেন্দ্রনাথ স্বরলিপি প্রকাশ করেছেন তার ‘সাংখ্য স্বরলিপি’ শীর্ষক রচনায়। এটি নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে। স্বরলিপির ব্যাকরণ ব্যাখ্যা করেছেন কার্ত্তিক ১৩০৪ সংখ্যায়। শুরু হয়েছে বাগেশ্রী রাগাশ্রিত রাজা রামমোহন রায়ের গান দিয়ে। বহু গানের স্বরলিপি প্রকাশিত হয়েছে এই বিভাগে। অনেক গানের সুর দিয়েছেন সঙ্গীত শিক্ষক বিষ্ণুপদ চক্রবর্ত্তী। হিতেন্দ্রনাথের ‘গীতিকুঞ্জ’ নামক বিভাগে কবিতা ও গান প্রকাশিত হয়েছে বিপুল সংখ্যায়। ঋতেন্দ্রনাথের কবিতা বের হলেও সংখ্যায় অনেক কম। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরণের রচনা, বিষয়-বৈচিত্র্যে সেগুলিও কম আকর্ষণীয় নয়। ‘পুণ্য’ পত্রিকার লেখকদের কয়েকজনের নাম – মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, শোভনাসুন্দরী দেবী, যামিনীপ্রকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, সখারাম গণেশ দেউস্কর, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, হরিহর শেঠ, দীনেন্দ্রকুমার রায়, হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভূপেন্দ্রবালা দেবী, উমাশশী দেবী, প্রতিভাসুন্দরী দেবী, সুদক্ষিণা দেবী, সুনৃতা দেবী, বিপিনচন্দ্র দাস, কৃষ্ণচন্দ্র গুপ্ত, প্রমথনাথ রায়চৌধুরী, গুরুপ্রসন্ন সোম, বিহারিলাল চক্রবর্ত্তী প্রমুখ। তবে সব সংখ্যা দেখার সুযোগ না হলেও বলা যায় রবীন্দ্রনাথ কিন্তু সেভাবে লেখেন নি ‘পুণ্য’ পত্রিকায়। তার ‘মৃত্যু’ কবিতাটি চোখে পড়ল অগ্রহায়ণ ১৩০৭ সংখ্যায়।
‘পুণ্য’ পত্রিকার ‘সমালোচনা’ বিভাগে নতুন বই ও বিভিন্ন সাময়িক পত্রিকা সম্বন্ধে নিয়মিত আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। আলোচিত পত্রিকার মধ্যে রয়েছে – ‘নব্যভারত’, ‘পূর্ণিমা’, ‘সাহিত্য’, ‘উৎসাহ’, ‘প্রদীপ’, ‘ঋষি’, ‘স্বাস্থ্য’, ‘অন্তঃপুর’, ‘নবপ্রভা’, ‘সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা’ ইত্যাদি।
১৩১২ সালে তিন সংখ্যায় বেরিয়েছে ‘মাইকেল মদুসূদন দত্তের কতিপয় অপ্রকাশিত পত্র’। সম্পাদক জানিয়েছেন –
“এই পত্রগুলি দত্ত মহাশয়ের স্বহস্তে ইংরাজীতে লিখিত এবং স্বাক্ষরিত। আসলপত্রগুলি কোনরূপে আমদের হস্তগত হইয়াছে। আমরা সকল পত্রগুলির বঙ্গানুবাদ ও আসল বাহির করিতে স্বীকৃত রহিলাম।”
‘পুণ্য’ পত্রিকায় যেমন অন্য মাসিক পত্রিকার সমালোচনা রয়েছে, কয়েকটি পত্রিকায় ‘পুণ্য’ পত্রিকাটিও সমালোচিত হয়েছে। প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা ‘সাহিত্যে’ প্রকাশিত ১৩০৫ বঙ্গাব্দের পৌষ-মাঘ সংখ্যার ‘পুণ্য’র সমালোচনার কিছু অংশ –
“ ‘স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে অবলম্বনীয় পন্থা’ শ্রীযুক্ত ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত। লেখক ধর্ম্মহীন শিক্ষার বিরোধী; যে শিক্ষায় স্ত্রীজাতির চরিত্রে পবিত্রতার সঞ্চার হয়, সেইরূপ শিক্ষার পক্ষপাতী। শ্রীযুক্ত ক্ষীরোদচন্দ্র রায় চৌধুরীর ‘মঙ্গলসূত্র’ বৌদ্ধধর্ম্মবিষয়ক সুরচিত প্রবন্ধ। ‘তাম্বরু ও কালীপ্রসন্ন সিংহ’ প্রবন্ধে তানপুরার ইতিহাস কথিত হইয়াছে। লেখক বলিতেছেন –“একজন বিশিষ্ট গায়কের মুখে শুনিয়াছি যে বিখ্যাত মহাভারতের অনুবাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ মহাশয় স্বাভাবিক অলাবুর তুম্বের অনুকরণে কাগজের তুম্ব প্রস্তুত করাইয়াছিলেন। ***** এই হেতু সঙ্গীতের দিক হইতে তাঁহাকে সম্মান দিবার জন্য এই সঙ্গীতপ্রবন্ধের সঙ্গে তাঁহার একটি চিত্রও সর্ব্বসমক্ষে প্রকাশ করিলাম।” –সঙ্গীতের দিক হইতে সিংহ মহোদয়ের সম্মানবিধান করিয়া লেখক আমাদের কৃতজ্ঞতাভাজন হইয়াছেন। কিন্তু পরিশেষে ‘সঙ্গীতসমাজের’ প্রসঙ্গ উত্থাপিত না করিলেই ভাল ছিল। তানপুরা হইতে কালীপ্রসন্ন সিংহের অবতারণা প্রসঙ্গসঙ্গত এবং বিধিসম্মত, কিন্তু কালীপ্রসন্ন সিংহ হইতে তাঁহার বাড়ী, ক্রমে তাহা হইতে সেই বাড়ীর ভাড়াটিয়া সঙ্গীতসমাজ, ক্রমে সঙ্গীতসমাজের প্রসঙ্গে তত্যত্র দ্বন্দকোলাহলের উল্লেখ ও তদুপলক্ষে লেখক মহাশয়ের অযাচিত উপদেশ নিতান্তই খাপছাড়া ও অপ্রাসঙ্গিক হইয়াছে। ...... স্বর্গীয় হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জড়ের সাধারণ গুণ’, “পুষ্পের বিবাহ’, ‘বাঙ্গালা ও আসামী ভাষা অভিন্ন নহে’ প্রভৃতি প্রবন্ধগুলি পাঠযোগ্য। শ্রীযুক্ত ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেবপূজা ও যজ্ঞের উৎপত্তি’ একটি সুরচিত, সুচিন্তিত, প্রত্নতত্ত্ববিষয়ক প্রবন্ধ।”
১৩১০ অগ্রহায়ণ-পৌষ সংখ্যায় হরিহর শেঠ পাঁচটি প্রশ্ন করেছেন। স্পষ্টতঃই পাঠকদের থেকে তিনি উত্তর আশা করেছেন। পঞ্চমটি ছাড়া সবগুলিই বিজ্ঞান ভিত্তিক। এখানে ২য় ও ৫ম প্রশ্ন দুটি তুলে দেওয়া হল। ২য় প্রশ্ন – নির্ব্বাণোন্মুখ প্রদীপ উজ্জ্বলতর হইয়া নিবে কেন ? ৫ম প্রশ্ন – স্বামী স্ত্রীর সম্বন্ধ অতি পবিত্র। অধিকাংশ বঙ্গ রমণী অপরের সাক্ষাতে স্বামীর সহিত কথা বলিতে লজ্জা বোধ করে, মস্তকে কাপড় না থাকিলে কাপড় দেয়। ইহার কারণ কি ? সে সময় কি জন্য লজ্জা আসে ? যদি কোন পাঠিকা অনুগ্রহ পূর্ব্বক এই প্রশ্নটির উত্তর দেন তবে বাধিত হইব।
মাঘ সংখ্যাতেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। ২য় প্রশ্নের উত্তর – “প্রদীপে যতক্ষণ তেল থাকিবে ততক্ষণ সমানভাবে জ্বলিবে। তেল সব পুড়িয়া গেলে শেষে যে তেলটুকু বাতির মধ্যে প্রবেশ করিবে, সেটি খুব শীঘ্র বাতির মধ্যে প্রবেশ করিবে আর যেই শিখায় গিয়া পৌঁছিবে অমনি খুব উত্তপ্ত লম্বা শীশ শুষিয়া লইবে – তাহা হইলে তেল অনেকটা জায়গা ব্যাপ্ত হইয়া যাইবে; আর তেল কম বাতি লম্বা – তাই শীঘ্র বাষ্প হইয়া সমস্তটা একসঙ্গে দপ করিয়া জ্বলিয়া উঠিবে।” ৫ম প্রশ্নের উত্তর – “ অভ্যাসের অত্যাচার।”
এবার পত্রিকার প্রথম দুই বর্ষে প্রকাশিত রচনাগুলি বিশদভাবে উল্লেখ করে পরবর্তী সংখ্যা গুলির কেবল কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধের নাম করব। প্রথমে পত্রিকার প্রথম বর্ষের (১৩০৪ আশ্বিন-১৩০৫ ভাদ্র) কথা। রকমারি খাবারের রন্ধন প্রণালী প্রজ্ঞাসুন্দরী প্রাণভরে লিখে গিয়েছেন। আগে যে সবের উল্লেখ করা হয়েছে তা ছাড়াও ছিল ‘চন্দ্রকণা বা চন্দ্রকান্ত মেঠাই’, ‘বাগদা চিংড়ির কাটলেট’, ‘মেটের দোপেঁয়াজা’, ‘রুইমাছের ঘন্ট’, ‘হিন্দুস্থানী কোপ্তা’, ‘লেডিকেনি’, ‘পটলের দোল্মা’ ও ‘আদার চাটনি’ ইত্যাদি। প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনার মধ্যে রয়েছে – ‘তর্পনতত্ত্ব’ (ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘রমণীর মাতৃত্ব’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘বালক তানসেন’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘মনুসংহিতা ও মাতৃভাব’ (ক্ষিতিন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘মন্দর পর্ব্বত’ (ব্যোমকেশ মুস্তফী), ‘সাংখ্য স্বরলিপির চুম্বক’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘সেন-রাজগণের ইতিহাস’ (নগেন্দ্রনাথ বসু, সাহিত্য পরিষদ পত্রিকার সম্পাদক), ‘মানব হৃদয়ে চিত্রের প্রভাব’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘শাস্ত্রে রমণীর সম্মান ও আত্মরক্ষা’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘স্বামী দয়ানন্দ ও রাজা রামমোহন রায়’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘রামপ্রসাদের নূতন গান’ (স্বরলিপি সহ, হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘যৌবন-বিবাহ’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘জলপথে কাশীযাত্রা’ (?), ‘স্ত্রীশিক্ষা ও সাম্প্রদায়িক বিরোধ’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘কর্ম্মবীর গ্ল্যাডষ্টোন’ (দীনেন্দ্রকুমার রায়), ‘আমিষ ভোজন’ (রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী), ‘যোগীবর পবহারী বাবা’ (গাঁজীপুরের সুপ্রসিদ্ধ গুহাবাসী সাধু – উমাশশী দেবী, শাস্ত্রে রমণীর উচ্চশিক্ষার বিধি’ (?), ‘প্রাচীন ভারতে শিল্পানুরাগ’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘গোবিন্দজীর মন্দির’ [জয়পুরে] (নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) প্রভৃতি।
‘পুণ্যে’র দ্বিতীয় বর্ষেও (১৩০৫ পৌষ – ১৩০৬ অগ্রহায়ণ) প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী তার রান্নার সরঞ্জাম নিয়ে হাজির হয়েছেন। এবার রয়েছে – ‘কাসুন্দি মাছ’, ‘দয়ে বড়া’, ‘নারিকেলের ছাঁচ’, ‘নিমকি’, ‘ডিমের মুলুক্তানি সুপ’, ‘বাল কাসুন্দি’, ‘দুধের হালুয়া’, ‘মাছের দম্পক’, ‘আলুর চপ’, ‘করমচার হিন্দুস্থানী আচার’, ‘আমিলা’, ‘হিন্দুস্থানী বেশনী রুটি’, ‘তেলে বি মর্চা’, ‘গ্রেভিকাটলেট’, কোপ্তা পুডিং’, ‘দুধ কমলা’, ‘কাঁচা আমের ফাকিয়া’, ‘ছানার মজা’, ‘পাঁটার দমেঘন্ট’।
কবিতা লিখেছেন – হিতেন্দ্রনাথ, ঋতেন্দ্রনাথ, প্রিয়নাথ ঘোষাল, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সুধীন্দ্রনাথ, হরিহর শেঠ, ভূপেন্দ্রবালা দেবী, প্রমথনাথ রায় চৌধুরী প্রমুখ। হিতেন্দ্রনাথ কৃত স্বরলিপিতে ‘রাজা রামমোহন রায়ের গান’ ‘কি স্বদেশে কি বিদেশে যথায় তথায় থাকি’ প্রকাশিত হয়েছে। ‘হিন্দুস্থানী চতুরঙ্গ’ নামে স্বরলিপিসহ গান লিখেছেন প্রতিভাসুন্দরী দেবী। সব চেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন হিতেন্দ্রনাথ; বিজ্ঞান বিষয়ক রচনায় এগিয়ে রয়েছেন হেমেন্দ্রনাথ।
প্রবন্ধের মধ্যে রয়েছে – ‘রসায়ন বিজ্ঞানের উপকারিতা’ (হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘পঞ্চভূত’ (রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী), ‘সৌন্দর্য্য ও ঈশ্বরপ্রীতি’ (?), ‘কবি কৃষ্ণমোহন মজুমদার ও বৈরাগ্য সঙ্গীত’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘কর্ম্মণ্যেবাধিকরস্তে’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), জন ষ্টুয়ার্ট মিল ও স্ত্রীস্বাধীনতা’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘নবাবিষ্কৃত ভারতের ইতিহাস’ (নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়), ‘প্রীতি ও স্বার্থপরতা’ (?), ‘স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ে অবলম্বনীয় পন্থা’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘মঙ্গল-সূত্র’ (ক্ষিরোদচন্দ্র রায় চৌধুরী), ‘মানব শরীরে বহির্বায়ুর প্রভাব’ (কৃষ্ণচন্দ্র গুপ্ত), ‘তাম্বুরু ও কালীপ্রসন্ন সিংহ’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘জড়ের সাধারণ গুণ’ (হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘ছাতুবাবুর গান’ (?) (পাদটীকায় লেখা রয়েছে-এই গানটি কলিকাতার প্রসিদ্ধ বাবু আশুতোষ দেব কর্ত্তৃক রচিত। ৺ আশুতোষ দেব সাধারণে “ছাতুবাবু” নামে প্রসিদ্ধ। এ গানটি এ পর্য্যন্ত কোথাও প্রকাশিত হয় নাই), ‘যজ্ঞের উৎপত্তি’ (ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘নব্যবঙ্গে স্ত্রীশিক্ষার সূত্রপাত’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘সনাতন গোস্বামীর পদাবলী’ (প্রিয়নাথ ঘোষাল), ‘ফুলচাঁদ’ (রাজস্থানবাসী জনৈক ধনাঢ্য রাজপুত) (শোভনাসুন্দরী দেবী), ‘’তামাক’ (শ্রীঃ-), ‘জাতীয় সঙ্গীত’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘ব্রিটিশ মিউজিয়াম’ (যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়), ‘রাজা রামমোহন রায়ের ব্রহ্মসঙ্গীত’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘রুষিয়া ও ইংলন্ডের বাণীজ্য’ (শ্রীঃ-), ‘যজ্ঞ ও অগ্নি’ (ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘ব্রাহ্মসমাজ ও স্ত্রীশিক্ষা’ (?), ‘তানসেনের সাধনা’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘ক্রোমোলিথোগ্রাফি’ (হরিহর
শেঠ), ‘আদি মানব কে?’ (উমেশচন্দ্র দাস গুপ্ত), ‘নারী জাতির প্রথম কর্ত্তব্য (গ্র্যান্ট য়্যলেনের মত)’ (কমল কৃষ্ণ সাহা), ‘বর্ব্বর গাথা’ (ক্ষিরোদচন্দ্র রায়চৌধুরী), ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত (পন্ডিত শশধরের সহিত কথোপকথন ও যোগ ও ভক্তি সম্বন্ধে পরমহংসদেবের উপদেশ)’ (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত), ‘ঠাকুর পরিবারে স্ত্রীশিক্ষা’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘বার্ণিয়ারের বিজ্ঞাপনী’ (কেদারনাথ মজুমদার), ‘কাটনি ও জব্বলপুর’ (সরযূবালা দত্ত), ‘ বর্ত্তমান স্ত্রীশিক্ষা’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘ডাক্তার বার্ণাডো’ (সুকুমার রায়চৌধুরী), ‘সিংহল লঙ্কা ও সুহ্মদেশ’ (উমেশচন্দ্র গুপ্ত), ‘ঈশ্বর আরাধনা’ (শ্রীঃ-), ‘পানীয় জল’ (কৃষ্ণচন্দ্র গুপ্ত)।
লক্ষণীয় যে রচনাগুলির মধ্যে চিন্তাধর্মী দার্শনিক প্রবন্ধ ছাড়াও অনেক বিজ্ঞান বিষয়ক লেখাও স্থান পেয়েছে। ‘পুণ্য’ ছিল মূলতঃ ঠাকুর বাড়ির পত্রিকা। বাইরের লেখকদের সংখ্যা খুবই কম। সে সময়ে ঠাকুর পরিবার শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প ও বিবিধ বিষয়ে যে অগ্রগণ্য ভূমিকা গ্রহণ করে পথপ্রদর্শকের কাজ করেছিলেন উল্লিখিত রচনাগুলি থেকে তার কিছুটা আভাস মেলে।
‘পুণ্য’ সম্ভবতঃ মাঝে কিছুদিন বন্ধ ছিল কারণ, প্রথম বর্ষ ১৩০৪-০৫-এ শুরু হয়ে চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ষের পত্রিকা হিতেন্দ্রনাথ ও ঋতেন্দ্রনাথের যুগ্ম-সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ১৩১০-১২ বঙ্গাব্দে।
এবার চতুর্থ ও পঞ্চম বর্ষের পত্রিকা থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য রচনার উল্লেখ করছি। একটা বিষয় লক্ষণীয়। সে যময়ে লেখকের গুরুত্ব বোঝাতে নামের পাশে শিক্ষাগত যোগ্যতার সূচক হিসাবে প্রায়ই প্রাপ্ত ডিগ্রির উল্লেখ করা হত। এরকম একটি উদাহরণ – চতুর্থ বর্ষে ‘আইভির আত্মকথা’ নামক গল্পে লেখকের নাম মুদ্রিত হয়েছে ‘শ্রীনগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এম. এ. বি. এল. এম. আর. এ. এস. এফ. আর. এ. এস. (লন্ডন)’। উমেশচন্দ্র মৈত্রেয় রচিত ‘সোণায় অরুচি’ ছাড়া উপন্যাস তেমন চোখে পড়ে নি।
নতুন কবিতা রচয়িতা হিসাবে যোগ দিয়েছেন জীবেন্দ্রনাথ দত্ত, পঞ্চানন ঘোষ, বিহারীলাল চক্রবর্ত্তী, শ্রীনঃ-, কমলকৃষ্ণ সাহা বি, এল, নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, শিবিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, অজিতকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়।
নতুন রান্নার লেখিকা হিসাবে প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর আধিপত্য ছিল একছত্র; এখন সেখানে যোগ দিয়েছেন আরও কয়েকজন – সুনৃতা দেবী, শ্রীঃ দেবী ও সুদক্ষিণা দেবী। রান্নার তালিকায় রয়েছে – আলুর চিজকেক, আলুর ফ্রেঞ্চ ষ্টু, ইলিস মাছের উল্লাস, চিরঞ্জি কাতরি, জয়পুরী কোর্ম্মা, নামকি পোলাও, পটেটো রিসোল, দোমাছা কারী, তেঁতুলের মোরাব্বা, ডিমের লক্ষ্ণৌয়ি হালুয়া, লাঊএর ট্যামফ্রাডু (পর্ত্তুগীজ খাদ্য), বাদামবাটা দিয়া মাংসের মালাইকারী, ব্রেডিং চপ, বোম্বাই বরফি, সসার স্যালড, হূশনী কারী, কালিয়া জগুরুখ, আমের লক্ষ্ণৌ মরব্বা, আদার মিষ্টি রুটি, কড়াইশুটির সিঙ্গারা, কুল্পির বরফ, কচুর মালপোয়া, কাঁচা পেপে দিয়া মাংসের কোপ্তা, কাঁচা আমের আচার, পাঁকা তেতুলের আচার, লক্ষ্ণৌ পোলাও, সফেদার ফুলপায়েস, চকলেট, চাপাটি ইত্যাদি।
৩য় ও ৪র্থ বর্ষে গল্পের সংখ্যা আগের তুলনায় বেশী। কিছু গল্পের নাম – ‘আইভির আত্মকথা’ (নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়), ‘আনারকলি বা ডালিমকুমারী’ (জয়পুরী গল্প, শোভনাসুন্দরী দেবী), ‘ইউরিশিস’ (জাপানী গল্প, সংজ্ঞা দবী), ‘নির্ম্মলা’ (কমলকৃষ্ণ সাহা), ‘পাকা আম’ (?), ‘পালিতা’ (কমলকৃষ্ণ সাহা), ‘মৎসুয়ানার আয়না’ (জাপানী গল্প, সংজ্ঞা দেবী), ‘অভাগিনী’ (কালিদাস চক্রবর্ত্তী), ‘জয়ন্তী’ (প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী), ‘ভানুমতী’ (শ্রীঃ) প্রভৃতি।
‘পুণ্য’ পত্রিকার অন্যতম সম্পদ এর চিন্তাধর্মী প্রবন্ধ। বেশ কিছু প্রবন্ধের নাম লেখক সহ উল্লেখ করছি ; এ থেকে রচনায় কারা অংশগ্রহণ করেছেন সেটা ছাড়াও বিষয়বস্তুর বৈচিত্র ও গভীরতা থেকে পত্রিকার উৎকর্ষ সম্বন্ধে কিছুটা ধারণা করা সম্ভব হবে। প্রবন্ধের তালিকায় রয়েছে - ‘অলঙ্কার’ (সংস্কৃত অলঙ্কারের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা, লেখক অজ্ঞাত), ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগুণসাগর), ‘আইবুড়োভাত ও বৌভাত’ (ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিভাস্কর), ‘আশ্রম’ (শিবপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়), ‘ঋগবেদ’ (৺ হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘ঋতুবর্ণনা’(নববর্ষা ভরাবর্ষা-সচিত্র) (৺ হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘ “কছবাহ” রাজবংশ’ (নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়), ‘কাশি ও ব্যাসকাশি’ (সচিত্র, হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগুণসাগর), ‘কালিয় নাগ সম্বন্ধে শ্রীমদ্ভাগবৎ ও ৺ বঙ্কিমবাবুর ভ্রান্ত মত’ (ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিভাস্কর), ‘গড়মান্দারণ ও জাহানাবাদের ইতিবৃত্ত’ (হারাধন দত্ত), ‘জাপান ও রুষ সম্বন্ধে কথালাপ’ (ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিভাস্কর), ‘জাপান দেশীয় বৌদ্ধদৈবৎসু’ (সচিত্র) (লেখক অজ্ঞাত), ‘টোড়ি রাগিনী কাহার স্ত্রী’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগুণসাগর), ‘দয়াবতী’ (ব্রহ্মদেশের দয়াবতী মহিলা) (নন্দলাল ঘোষাল), ‘নারিকেলের চাষ, ব্যবসায় ও ব্যাবহার’ (যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এম,এ,বার-এট-ল), ‘নাগ জাতির উৎপত্তি ও বিস্তার’ (প্রাচীন কলকাতা) (ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিভাস্কর), ‘নিরীহ বাঙ্গালী’ (মিসেস সখাবৎ হোসেন), ‘ন্যায়ধর্ম্ম’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগুণাকর), ‘পুঁতির পরদা’ (মনীষা দেবী), ‘পুণ্যক্ষেত্রে লাসা ও যক্ষজাতি’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগুণাওসাগর), ‘ “ব্যাঙ্ক” এর কার্য্যপ্রণালী’ (যোগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এম,এ,বার-এট-ল), ‘যজুর্ব্বেদ’ (৺হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘যোগীগায়ক ইঞ্ছারবস ও নিদ্রাজয়’ (হিতেন্দ্রনাথ কবিগুণসাগর), ‘য়ুরোপীয় সুরকবিগণের সুররচনা পদ্ধতি’ (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘লৌহ’ (রসায়ন, সচিত্র হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘হুগলী বা পাতালপুরী ভোগবতী’ (প্রাচীন কলকাতা) (ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিভাস্কর), ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর ইংলন্ডীয় দন্ডবিধি’ (যোগীন্দ্রনাথ সরকার), ‘কছবাহ রাজবংশ’ (নগেন্দ্রবালা মুখোপাধ্যায় এম,এ,বি,এল), ‘কহাবৎ বা জয়পুরী প্রবচন’ (শোভনাসুন্দরী দেবী), ‘৺ কবিবর বিহারীলাল চক্রবর্ত্তীর অপ্রকাশিত পত্র’ , ‘কিন ও কিন্নরজাতি’ (লেখক অজ্ঞাত), ‘কুচবেহার ও কামরূপ’ (নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এম,এ,বি,এল), ‘গীতগোবিন্দে শ্যামবর্ণ’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগুণসাগর), ‘ “টমকাকার কুটীর” প্রণেত্রী শ্রীমতী হ্যারিয়েট বিচার ষ্টো’ (সুষমা সুন্দরী দেবী), ‘তানসেন ও স্বরসাধন’ (হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগুণসাগর), ‘ব্রাহ্মসমাজের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ তত্ত্বনিধি বি,এ), ‘লৌহ’ (মরিচা) (৺ হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর), ‘শৃণ্বন্তু বিশ্বেঽমৃতস্য পুত্রা’ (ক্ষিতীন্দ্রনাথ তত্ত্বনিধি বি,এ), ‘স্বদেশের উন্নতিকল্পে মহিলাদিগের কর্ত্তব্য’ (মনীষা দেবী), ‘হ্যারিয়েট মার্টিনো’ (সুষমা দেবী) প্রভৃতি।
লক্ষণীয় যে ‘পুণ্যে’র লেখকদের মধ্যে দু’একজন ছাড়া বাকি সবাই ঠাকুর পরিবারের সদস্য এবং কয়েকজন লেখকই প্রায় সব লেখা লিখেছেন। তাদের রচনার উচ্চমান ও জ্ঞানের ব্যাপ্তি মেনে নিলেও লেখকের সংখ্যা বেশী না হলে বিভিন্ন স্বাদের রচনা ও রচনাশৈলী থেকে বঞ্চিতই থাকতে হয়। তবে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের পৌত্রী প্রজ্ঞাসুন্দরী যে উদ্দেশ্য নিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন – “এই পত্রে জনসমাজের উপযোগী সাহিত্য, বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব, সঙ্গীত প্রভৃতি নানাবিষয়ক প্রবন্ধই স্থান লাভ করিবে। এতদ্ভিন্ন ইহাতে গৃহস্থের এবং মানবমাত্রেরই সর্ব্বপ্রধান অবলম্বন আহারের বিষয় প্রতি মাসেই থাকিবে। ইহাতে গার্হস্থ্য ধর্ম্মের অনুকূল শিল্পবিদ্যা প্রভৃতিও অভাব দূর করিবার সাধ্যমত চেষ্টা করিবে ” – সেটা নিশ্চিতভাবেই সফল হয়েছে। তবে রবীন্দ্রনাথ কেন এত কম লিখলেন ?
পত্রিকার প্রতি পৃষ্ঠার উপরে প্রথম দিকে যে প্রকাশের সংখ্যা, সাল এবং মাসের উল্লেখ থাকত, পরে সেটা তুলে দেওয়া হয়েছে ; হয়ত অনিয়মিত প্রকাশনার জন্য। মাঝে মাঝেই যুগ্ম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘পুণ্য’ চলেছিল সম্ভবত: চার-পাঁচ বছর; ১৩১০ থেকে ১৩১২ বঙ্গাব্দ যুগ্মভাবে সম্পাদকের কাজ করেছেন হিতেন্দ্রনাথ ও ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর। নাম লেখা হয়েছে ‘শ্রীহিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগুণসাগর ও শ্রীঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিভাস্কর’। ডাকমাশুল সহ অগ্রিম বার্ষিক মূল্য ছিল তিন টাকা ছ’আনা, প্রতি সংখ্যার মূল্য আট আনা। “ ৩৭৪ নং অপার চিৎপুর রোড, জোড়াসাঁকো, “পুণ্য যন্ত্রে” এবাদত আলি খাঁ কর্ত্তৃক মুদ্রিত ও পুণ্য কার্য্যালয় হইতে সম্পাদক কর্ত্তৃক প্রকাশিত।”
প্রতিলিপির পরিচয় –
চিত্র -১ পত্রিকার একটি সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা।
চিত্র -২ সম্পাদক পরিবর্তনের বিজ্ঞপ্তি।
চিত্র – ৩ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পুণ্য ভান্ডারে’র একটি বিজ্ঞাপন।
চিত্র – ৪ ১৩০৪ ফাল্গুন-চৈত্র সংখ্যায় ‘জলপথে কাশীযাত্রা’ রচনার সঙ্গে মুদ্রিত চিত্র ( কাঠ-খোদাই বা ধাতু খোদাই করে ব্লক তৈরি করা হয়েছে ) ।
চিত্র – ৫ ‘তাম্বুরা’ বাদ্যযন্ত্র বাদনরত এক ব্যক্তি ( পৌষ-মাঘ ১৩০৫ সংখ্যা )।
চিত্র – ১ : পত্রিকার একটি সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা
চিত্র – ২ : সম্পাদক পরিবর্তনের বিজ্ঞপ্তি।
চিত্র – ৩ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পুণ্য ভান্ডারে’র একটি বিজ্ঞাপন।
চিত্র –৪ ১৩০৪ ফাল্গুন-চৈত্র সংখ্যায় ‘জলপথে কাশীযাত্রা’ রচনার সঙ্গে মুদ্রিত চিত্র ( কাঠ-খোদাই বা ধাতু খোদাই করে ব্লক তৈরি করা হয়েছে ) ।
চিত্র –৫ ‘তাম্বুরা’ বাদ্যযন্ত্র বাদনরত এক ব্যক্তি ( পৌষ-মাঘ ১৩০৫ সংখ্যা )।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।