প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

ডিসেম্বর ১৫, ২০১৬

 

পূর্ণিমা

দীপক সেনগুপ্ত

উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা ‘পূর্ণিমা’ (১২৯৪ খ্রিষ্টাব্দ)। এই শতাব্দীর শুরু থেকে অনেক পত্রিকা ও গ্রন্থ ততদিনে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি অনেকের উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছে। পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অনেক নতুন লেখক তাদের লেখা গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ইত্যাদি রচনা প্রকাশে আগ্রহী হয়ে এগিয়ে এসেছেন। মাসিক পত্রিকার সংখ্যাও স্বাভাবিক ভাবেই বৃদ্ধি পেয়েছে। এ রকমই একটি পত্রিকা ‘পূর্ণিমা’। সাধারণের পাঠযোগ্য রচনা প্রকাশ ও প্রচারের মাধ্যমে বাংলাভাষীদের আরও সচেতন করে তোলার ইচ্ছা নিয়েই এই পত্রিকার আবির্ভাব। প্রতি মাসে পূর্ণিমার দিন প্রকাশিত হত বলে নাম রাখা হয়েছে ‘পূর্ণিমা’। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৩০০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। প্রথম সংখ্যার সূচনা শিরোনামে পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য যা ব্যক্ত করা হয়েছে তার কিছু অংশ তুলে দেওয়া হল-

“সকলেরই জীবনে এমন অবসর অনেক থাকে যাহা অতিবাহিত করার জন্য অবলম্বন খুঁজিয়া বেড়াইতে হয়। বালক খেলা করে, প্রৌঢ়ে শাস্ত্র আলোচনা করেন, বৃদ্ধে হরিনাম করেন, কিন্তু যুবায় কি করিবেন ভাবিতে হয়। উপন্যাস বা নভেল পাঠ যুবকের পক্ষে সুখকর বটে; সাধারণে তাহাই করিয়া থাকেন। কিন্তু সে ইংরাজী ভাষায়। দেশীয় ভাষায় সুখপাঠ্য উপন্যাস অতি অল্প, নভেল নাই বলিলেই হয়। ইংরাজীতে এরূপ পুস্তক বিস্তর আছে - এত আছে যে সমস্ত জীবন পাঠ করিলেও নভেল বা উপন্যাস পাঠ সমাপ্ত হয় না। ইংরাজের নভেল বা উপন্যাস পাঠে ইংরাজের সামাজিক গার্হস্থ্য ও ব্যক্তিগত জীবনের বা ধর্ম্মাধর্ম্মের আলোচনা হইতে পারে, কিন্তু স্বদেশের স্বজাতির এ সকল কথাও ত অবশ্য জ্ঞাতব্য; তাহার আলোচনার উপায় কি ? পুরাণে অতি উৎকৃষ্ট উপাখ্যান ও অতি সুন্দর আদর্শ চরিত্রের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিকাংশ ইংরাজীতে শিক্ষিত যুবকের চক্ষে সে সকল অত্যদ্ভুত, অলৌকিক “আজগুবি” ব্যাপার বলিয়া প্রতীত হইয়া থাকে। তাহায় শিক্ষার উপযোগী শ্রদ্ধা হয় না, সুতরাং সে সকল পাঠে স্পৃহাও হয় না। যদি বা কখন স্পৃহা হয়, তবে শ্রদ্ধার অভাবে তাহার যথোচিত মর্ম্মগ্রহ হয় না, এরূপ প্রকৃতির পাঠকেরা অগত্যা হয়, অবসর অপব্যয় করেন, নয় ইংরাজী নভেল বা উপন্যাস পাঠ করিয়াই সময় অতিবাহিত করেন। স্বদেশের জ্ঞাতব্য কথা তাঁহাদের নিকট অপরিজ্ঞাতই থাকিয়া যায়। যাঁহাদের গুরুতর বিষয়ের আলোচনা করিবার ইচ্ছা হয়, তাঁহারা কেহ কেহ ইংরাজী ভাষায় সাময়িক পত্রিকাদি বা বিজ্ঞান দর্শন পাঠ করিয়া থাকেন। ইহাতেও সময়ের সদ্ব্যয় হইয়া থাকে তাহাতে সন্দেশ নাই, কিন্তু সেরূপ কঠিন অধ্যয়নে কয় জনের অনুরাগ দেখা যায় ? পাঠাবস্থায় যুবকদিগের স্বাধীন চিন্তা বা গুরুতর বিষয়ের আলোচনার অবসর থাকে না। কলেজে পাঠ সমাপ্ত করিয়া তাঁহারা অর্থোপার্জ্জনের জন্য যেরূপ ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়েন তাহাতে সখ করিয়া বা জ্ঞানোপার্জ্জনের জন্য গুরুতর অধ্যয়নে তাঁহারা মনোনিবেশ করিতে পারেন না।

“...... আমরা জানি এবং যাঁহারা বঙ্গভাষার বর্ত্তমান পরিপুষ্টির কারণ অনুসন্ধান করিয়াছেন ও করিতেছেন তাঁহারাও জানেন যে প্রবোধচন্দ্রোদয় হইতে আধুনিক নব্যভারত ও সাহিত্য পর্য্যন্ত পত্রিকার প্রচারে কত শত ইংরাজীতে শিক্ষিত যুবকবৃন্দের বিজাতীয় বিতৃষ্ণা ও অবজ্ঞা সত্ত্বেও বঙ্গভাষার প্রতি মতি গতি ফিরিয়াছে – বাঙ্গালা গ্রন্থ পাঠে স্পৃহা হইতেছে – বঙ্গভাষায় রচনা করিতে সাধ হইতেছে – সর্ব্বাধিক সুখের কথা – বঙ্গভাষাকে প্রীতির চক্ষে দেখিতে অভ্যাস হইতেছে। পত্রিকার সৌভাগ্য যত হউক না হউক, বঙ্গভাষার প্রচুর মঙ্গল সাধিত হইতেছে সুতরাং স্বদেশের ও স্বজাতীয় মঙ্গল বই আর কি বলিব।

“......... বস্তুত শিক্ষিত সাধারণ যুবকবর্গের জন্যই দেশীয় ভাষায় মাসিক পত্রিকার প্রকাশ হওয়া আবশ্যক। পত্রিকার উদ্দেশ্য যে কেবল শিক্ষা প্রদান তাহা নহে। লেখক মাত্রেই কিছু এমন বিদ্যা বুদ্ধি সম্পন্ন নহেন যে তিনি পাঠক মাত্রেরই গুরুস্থানীয় হইবার উপযুক্ত পাত্র। লেখক তাঁহার নিজের মনোগত ভাব প্রকাশ করিবেন। পাঠাক তাহায় কিছু জ্ঞাতব্য থাকে গ্রহণ করিবেন, ভুলভ্রান্তি থাকে তাহারও আলোচনা করিবেন। অধিকন্তু যদি পাঠক সহৃদয় হয়েন তবে সে লেখকের ভুলভ্রান্তি সংশোধন করিয়া দিবেন। ফলত: আমাদের পত্রিকার উদ্দেশ্য তাহাই। আমরা সকল বিষয়েরই অনুশীলন করিব, সে অনুশীলনে লেখকের আত্মোন্নতি ত আছেই, পক্ষান্তরে যদি অন্যের সেরূপ অনুশীলন বৃত্তি তাহার দ্বারায় কিঞ্চিন্মাত্রও পরিচালিত হয় তাহাতেও ব্যক্তিগত ও সমাজগত মঙ্গল আছে।

“...... পূর্ণিমায় সকল বিষয়েরই আলোচনা হইবে। যে কোন বিষয়ের রচনা উপাদেয় হইবে, তাহাই ইহাতে প্রকাশিত হইবে। তবে সাধারণের অশুভকর ও অরুচিজনক বিষয় ইহাতে প্রকাশিত হইবে না। রচনাদি নির্ব্বাচনের জন্য ইহার সমিতি গঠিত হইয়াছে, সেই সমিতি কর্ত্তৃক নির্ব্বাচিত হইয়া প্রবন্ধাদি প্রকাশিত হইবে। খ্যাতনামা লেখকদের রচনা সমিতি কর্ত্তৃক পরম সাদরে গৃহীত হইবে। শিক্ষিত যুবকবৃন্দ অনুগ্রহ করিয়া পূর্ণিমায় প্রকাশ করিবার জন্য রচনাদি প্রেরণ করিলে সমিতির অভিলাষ ও উদ্যম সকলি সফল হইবে।”

পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য খুব স্পষ্ট ভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। মূলত যুবকদের বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা এবং বিভিন্ন বিষয়ে রচনা পাঠের মাধ্যমে তাদের অবসর সময় সদর্থক ভাবে কাটানোর উপায় দর্শাবার জন্যই পত্রিকার আবির্ভাব। পত্রিকার সম্পাদকের নাম কোথাও ছাপা হত না। হুগলী থেকে “কার্য্যাধ্যক্ষ যদুনাথ কাঞ্জিলাল” জানিয়েছেন –

“কয়েকজন কৃতবিদ্য ব্যক্তি মিলিত হইয়া ইহার সম্পাদকতার ভার লইয়াছেন, কোন ব্যক্তি বিশেষ ইহার সম্পাদক নহেন। সম্পাদক সমিতির নাম আপাতত: প্রকাশিত হইল না। এই পত্রিকা যাহাতে সকলের সুখপাঠ্য হয় তদ্বিষয়ে বিশেষ যত্ন প্রকাশ করা হইবে। খ্যাতনামা লেখকগণের প্রবন্ধাদি মধ্যে মধ্যে ইহাতে সন্নিবেশিত হইবে। যাহাতে সকল অবস্থাপন্ন লোকেই ইহার গ্রাহক হইতে পারেন তজ্জন্য ইহার অগ্রিম বার্ষিক মূল্য মায় ডাক মাসুল এক টাকা মাত্র ধার্য্য হইল। ইহাতে ৮ পেজী ফরমার ৪ ফরমা অর্থাৎ ৩২ পৃষ্ঠা করিয়া থাকিবে। এরূপ সুলভ মূল্যের কাগজ মফঃস্বল হইতে এ পর্য্যন্ত বাহির হয় নাই। ......”

সম্পাদক মণ্ডলীর নাম প্রকাশ না করলেও যতদূর জানা গিয়েছে এতে ছিলেন সতীন্দ্র দেব রায়, বিষ্ণুপদ চট্টোপাধ্যায় ও ক্ষিতীন্দ্র দেব রায়। তবে আজ থেকে প্রায় ১২০ বছর আগে হলেও প্রতি বছর ১২টি সংখ্যা মাত্র এক টাকায় কি করে গ্রাহকদের কাছে পাঠানো হত ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। অন্যান্য বহু মাসিক পত্রিকার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে গ্রাহকরা নিয়মিত পত্রিকার দেয় মূল্য দপ্তরে পাঠান নি এবং সেজন্য একাধিকবার আবেদনও প্রকাশিত হয়েছে; অনেক পত্রিকা্র প্রকাশ অর্থাভবে বন্ধও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ‘পূর্ণিমা’র ক্ষেত্রে প্রকাশক শ্রীশ্রীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঁশবেড়িয়া) জানিয়েছেন –

“বাঙ্গালী গ্রাহকদের দুর্ণাম আছে, যে তাঁহারা কাগজ লইয়া মূল্য দেন না। কিন্তু পূর্ণিমা দ্বারা তাঁহাদের সকল কলঙ্ক দূর হইয়াছে। অতীব আনন্দের বিষয় সন ১৩১৫ সালের পূর্ণিমার মূল্য কোন গ্রাহকের কাছে বাকী নাই।”

অনেক সময় লেখকদের নাম অগ্রিম জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন ‘সন ১৩১৬ সালের পূর্ণিমায় কাহারা লিখিবেন ?’ এই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে –

“যাঁহারা গত বর্ষে লিখিয়াছেন তাঁহারা ত লিখিবেনই তাহা ছাড়া বর্দ্ধমানাধিপতি মহারাজাধিরাজের প্রাইভেট সেক্রেটারি সুপণ্ডিত শ্রীযুক্ত পশুপতিনাথ চট্টোপাধ্যায় এম. আর. এ. এস, এফ আর এস এ (লন্ডন) মহাশয়ের কৌতূহলোদ্দীপক “ভূ-প্রদক্ষিণ”; “উড়িষ্যার চিত্র”, “ধ্রুবতারা” প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা সুপ্রসিদ্ধ লেখক ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রমোহন সিংহ বি, এ মহাশয়; “পৌরাণিক কথা” প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা প্রসিদ্ধ সুলেখক বাঁকীপুরের গবর্নমেন্ট প্লীডার শ্রীযুক্ত পূর্ণেন্দুনারায়ণ সিংহ এম, এল বি এ মহাশয়; ফরেষ্ট অফিসার রায়সাহেব উপেন্দ্রনাথ কাঞ্জিলাল; সুকবি শ্রীযুক্ত নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য বি, এ এবং অন্যান্য অনেক সুলেখক পূর্ণিমায় লিখিবেন।......”

এ ছাড়া লেখকদের মধ্যে ছিলেন – বিষ্ণুপদ চট্টোপাধ্যায়, সুরেশচন্দ্র সেন, যতীন্দ্রমোহন সিংহ, শিবপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য, চন্দ্রশেখর কর, চুণীলাল সেন, কুমুদনাথ মল্লিক, শ্যামলাল মজুমদার, ব্রজবল্লভ রায়, অচ্যুতচন্দ্র সরকার, ভবভূতি ভট্টাচার্য্য, অক্ষয়চন্দ্র সরকার, আবদুল করিম, উমেশচন্দ্র মৈত্রেয়, শ্রীমতী নগেন্দ্রবালা সরস্বতী, রাজেন্দ্রলাল আচার্য্য, হরিহর শেঠ, ক্ষীরোদচন্দ্র রায় চৌধুরী, মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত, কৃষ্ণধন মুখোপাধ্যায়, কুঞ্জবিহারী সেন প্রমুখ।

কি ধরণের লেখা প্রকাশিত হত ‘পূর্ণিমা’য় ? গল্প কবিতা বাদ দিয়ে কয়েকটি প্রবন্ধের নাম উল্লেখ করা যাক, যা থেকে পত্রিকার দৃষ্টিভঙ্গী ও ভাবনার কিছু আভাস পাওয়া যাবে। যেমন – উড়িষ্যায় মুসলমানের আধিপত্য, কাশ্মীরের ইতিবৃত্ত, কিসে আমাদের পরিত্রাণ সম্ভব?, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ব্রহ্মোপাসনা, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মৃত্যু ও মৃত্যুভয়, চাঁদের কথা, বঙ্গসাহিত্যে পঞ্চম বিদ্যাসুন্দর, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, হুগলী কাহিনী, বারাণসী ও সারনাথে, পরেশনাথ, ভারতে শিষ্টাচার, সমাজের উপর সাহিত্যের প্রভাব ইত্যাদি। অবশ্য এর মধ্যে কয়েকটি ভ্রমণ কাহিনীও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে সেকালের পত্র-পত্রিকায় ধর্ম বিষয়ক রচনা প্রকাশ ছিল খুব স্বাভাবিক বিষয়, প্রায় প্রতিটি পত্রিকাতেই এ ধরণের রচনা কিছু না কিছু প্রকাশিত হত; কিন্তু এখনকার প্রকাশিত পত্রিকায় সাধারণভাবে এগুলি একেবারেই অনুপস্থিত।

প্রথম সংখ্যায় যে রচনাগুলি ছিল সেগুলি হল – ‘পূর্ণিমা’ (পদ্য), ‘ইসারা’, ‘সূচনা’, ‘ভালবাসা’, ‘বেলুনে প্রেম’(একটি বিদেশীয় গল্প), সম্বন্ধ নির্ণয় (পিতা ও পুত্র), ১২৯৯ সন শেষ, সমালোচন। ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় নামের সঙ্গেই মুদ্রিত হত ‘মাসিক পত্রিকা ও সমালোচনী’ কথাটি; অতএব ‘সমালোচন’ বিভাগটি প্রথম থেকেই সূচীপত্রে অন্তর্ভুক্ত ছিল। গ্রন্থ ও পত্রিকা দুয়েরই সমালোচনা প্রকাশিত হত। প্রথম সংখ্যায় সমালোচনার জন্য নির্বাচন করা হয়েছে ৮টি গ্রন্থ – ‘আরক্ত বর্ণপরিচয়’, ‘ভূতের বাপের শ্রাদ্ধ’, ‘ধারাপাত’, ‘কয়লার খনি’, ‘ঘুঘুডাঙ্গায় একবেলা’, ‘ভৌগোলিক বিবরণ’, ‘দুর্গা-প্রদীপ’ (বার্ষিক সংবাদ-পত্র) এবং ‘বাঈজী-সঙ্গীত-হিল্লোল’। এর মধ্যে একমাত্র প্রথম গ্রন্থটির লেখকের নাম কামিনীনাথ তলাপাত্র বলে জানা যায়। অন্য গ্রন্থ গুলির লেখকের নাম সমালোচনায় প্রকাশ করা হয় নি। পঞ্চম গ্রন্থটির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে-‘গ্রন্থকার নাম গোপন করিয়া ভাল করেন নাই’। সমালোচনা পড়ে মনে হয় সমালোচক ইচ্ছা করেই লেখকের নাম প্রকাশ করেন নি। কারণ অজ্ঞাত।

সমালোচনার জন্য গ্রন্থের সঙ্গে মাসিক পত্রিকাও নির্বাচিত হত। যেমন সপ্তদশ বর্ষের ২য় ভাগের ৫ম সংখ্যায় (ফাল্গুন) ‘সমালোচন’ বিভাগে লেখা হয়েছে –

“আমরা সমালোচনার্থ এই সকল মাসিক পত্রিকাগুলি প্রাপ্ত হইয়াছি : অলৌকিক রহস্য, বামাবোধিনী, উপাসনা, মুকুল, কৃষক, সাহিত্য সংহিতা, মহাজন বন্ধু, অর্চ্চনা, পন্থা, সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা (ত্রৈমাসিক)। এই গুলির মধ্যে পাঠক মহাশয় দেখিবেন যে বামাবোধিনী সর্ব্বাপেক্ষা পুরাতন পত্র, ৪৭ বর্ষ চলিতেছে, আর অলৌকিক রহস্য সর্ব্বাপেক্ষা নূতন অর্থাৎ গত বৈশাখে বাহির হইয়াছে। অর্চ্চনা, উপাসনা দুইটি ভগিনী ৫।৬ বৎসরের বালিকা, বাকি কাগজগুলি সকলেই প্রতিষ্ঠিত। মুকুল আমাদের এক বয়সী হইলেও মুকুল-পঞ্চদশী - ভরসা করি আজিও প্রস্ফুটিত হয়েন নাই। সূর্য্যের বরে কুন্তীদেবীর ন্যায় মুকুল চিরযৌবনা বা স্থিরযৌবনা থাকুন। মুকুলের ফুটিয়া কাজ নাই। কাঁচা মিঠে আম কে পাকা খাইতে চাহে ? ......”

এদের মধ্য ‘অলৌকিক রহস্য’ পত্রিকাটি কৌতূহল জনক। এটির উল্লেখ কোথাও পাই নি, ক’বছর চলেছিল জানা নেই।

তখনকার অনেক মাসিক পত্রিকায় ‘পূর্ণিমা’র সুখ্যাতি করে সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। যেমন –

“আট বৎসর ধরিয়া যথা নিয়মে মফস্বল হইতে প্রকাশিত হইতেছে, ইহা গৌরবের কথা। বর্ত্তমান সংখ্যায় শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথামৃত, প্রকৃতই অমৃতের ন্যায় পূর্ণিমার প্রতি পৃষ্ঠায় ক্ষরিত হইতেছে। এই কথোপকথন গুলি যেমন জ্ঞানগর্ভ তেমনি কৌতুহলোদ্দীপক। ‘অন্তিকা’ ছন্দোবন্ধে একটি সুন্দর পল্লীচিত্র, কবিতাটির মধ্যে এমন একটি বর্ণনা সংযম এবং সহানুভূতি প্রকাশিত হইয়াছে, যাহা সমস্ত বিষয়টিকে উজ্জ্বল ও সকরুণ করিয়া তুলিয়াছে।” (‘বসুমতী’, ৪ঠা শ্রাবণ, ১৩০৭)।

উৎকৃষ্ট মানের পত্রিকা ‘সাহিত্য’র মন্তব্য –

“এবারকার পূর্ণিমা সুখপাঠ্য ও শিক্ষাপ্রদ রচনায় পরিপূর্ণ। শ্রীযুক্ত পূর্ণেন্দু নারায়ণ সিংহের “যজ্ঞ” একটি উপাদেয় সন্দর্ভ। লেখকের পান্ডিত্য ও বুঝাইবার প্রণালী প্রশংসনীয়। ...... “অমৃতসরের গুরুদরবার” একটি সুমিষ্ট ভ্রমণ কাহিনী-কেবল বাক্যের ফোয়ারা নয়। লেখক অনেক তথ্যের সন্ধান দিয়াছেন। “মাসিক সাহিত্য সমালোচনায়” গুণগ্রাহী লেখকের উজ্জ্বল মন্তব্য, সূক্ষ বিশ্লেষণ, ও অমূল্য ইঙ্গিত যেমন হিতকারী তেমনি মনোহারী। লেখকের উৎসাহবাণী যেমন রসাল, সাহিত্য বিড়ম্বনার প্রতি তাঁহার লঘুগামী অন্তর্ভেদী ধীক্কারবাণ তেমনি ধারাল। ......” (‘সাহিত্য’, অগ্রহায়ণ, ১৩০৭)।

“মাসিক সাহিত্য সমালোচনায়” আমরা সেই পুরাতন “বঙ্গদর্শনের” আভাস পাইলাম। এ রকম সমালোচনা সাহিত্যের গৌরব বৃদ্ধি করে।” (‘বঙ্গভূমি’, ১৩ই চৈত্র, ১৩০৭)।

“ ‘হুগলী কাহিনী’ বেশ লেখা হইতেছে। ... (‘এডুকেশন গেজেট’, ৩রা শ্রাবণ, ১৩০৮)।

“ ‘পূর্ণিমা’ ভাল মাসিক পত্রিকা। নয় বৎসর কাল ধীরে ধীরে ইহার প্রচার চলিতেছে। ইহাতে জয়ডঙ্কা নাই ; স্পর্ধা মেঘাড়ম্বর নাই ; বেশ নিস্তব্ধে নিরীহ ভাবে কর্ত্তব্য পালন করিয়া যাইতেছে।” (‘বঙ্গবাসী’, ৫ই নাঘ, ১৩০৮)।

মানুষের মূল প্রবৃত্তি সময়ের সঙ্গে অপরিবর্তিতই থাকে। চৌর্য বৃত্তি এরকমই একটি বিষয়। ‘পূর্ণিমা’র সম্পাদক মন্ডলী ১৩১০ সালের ফাল্গুন সংখ্যার (৬ষ্ঠ বর্ষ একাদশ সংখ্যা) ‘অন্তঃপুর’ পত্রিকা সম্বন্ধে এ ধরণেরই একটি অভিযোগ এনেছেন। প্রসঙ্গত ‘অন্তঃপুর’ একটি উল্লেখযোগ্য পত্রিকা, এটি ‘কেবল মহিলাগণ কর্ত্তৃক লিখিত ও সম্পাদিত’। (এই পত্রিকাটি সম্বন্ধে আমার একটি লেখা অবসরে প্রকাশিত হয়েছে)। উক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত ছ’টি রচনার মধ্যে একটি ছিল অসীমা সুন্দরী সোম লিখিত ‘চারিটি আদর্শ রমণী’ নামক একটি প্রবন্ধ। বিতর্ক এটিকে নিয়েই। বিষয়টি কৌতূকপ্রদ। সমালোচকের বক্তব্যের কিছুটা অশ এখানে উদ্ধৃত হল –

“আমরা “চারিটি আদর্শ রমণী” পাঠ করিয়া একেবারে হতবুদ্ধি হইয়াছি। ১৩১০ সালের ফাল্গুনের অন্তঃপুর “চারিটি আদর্শ রমণী” প্রবন্ধ বাহির করিলেন কিন্তু ঠিক এই প্রবন্ধ ১৩০২ সালের পৌষের পূর্ণিমায় (৩য় ভাগ ৯ম সংখ্যা পৌষ ১৩০২) ২৪৪ পৃঃ পকাশিত হইয়াছে। পূর্ণিমায় লেখক ছিলেন শ্রীযুক্ত বাবু যদুনাথ কাঞ্জিলাল আর অন্তঃপুরের লেখিকা দেখিতেছি শ্রীমতী অসীমা সুন্দরী সোম। অন্তঃপুর উন্নতিশীলাদের কাগজ আপনাদের “দেবী” “দাসী” ছাড়িয়া উপাধি গ্রহণ করিয়াছেন – বিশেষ একটি ধর্ম্মের প্রকাশ অনুশীলন করেন ইহাদের দ্বারা এরূপ কাজও সম্ভব ইহা মনে করিয়া আমরা অস্থির হইয়াছি। ঋষিগণ বলিয়া গিয়াছেন সকল গুণের উপর স্বভাব। নীতি শাস্ত্রকারগণ বলিয়াছিলেন গাভীর দুগ্ধের মিষ্টতা যেমন স্বাভাবিক তেমনি স্বভাবও স্বাভাবিক, চলিত কথায় বলে ইল্লৎ যায় ধুলে, স্বভাব যায় মলে। পুরুষ চোরকে পার আছে মেয়ে চোরকে পার নাই। পাঠক মহাশয় এ একেবারে দিনে ডাকাতী। পুং শিক্ষার ফল একদিন “গাওরে জগপতি জগ বন্দনে” দেখাইয়াছি আর স্ত্রী শিক্ষার ফল আজ আদর্শ রমণীতে, সকলই বিধির “নির্বন্ধ”। আমাদের কপাল দোষে সবই বিড়ম্বনায় পরিণত হইতেছে। একেই বলে “গুণ হয়ে দোষ হল বিদ্যার বিদ্যায়”। যাহাহৌক গালি দিয়া আর কি করিব ?......” (উদ্ধৃতির ভিতরের সব বানান অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে)।

সেকালের অনেক পত্রিকার মত ‘পূর্ণিমা’ একই দোষে দুষ্ট। প্রতি সংখ্যার মুদ্রিত পৃষ্ঠার শীর্ষদেশে কোন বছরের কোন সংখ্যা সেটার উল্লেখ না থাকায় একটি নির্দিষ্ট পৃষ্ঠার সঠিক অবস্থান খুঁজে পাওয়া শক্ত। প্রতি মাসের ‘পূর্ণিমা’র পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৩২ এবং ডাকমাশুল সহ প্রতি সংখ্যার অগ্রিম বার্ষিক মূল্য ছিল এক টাকা। এখনকার নিরীখে এই মূল্য অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। অবশ্য এ প্রসঙ্গে হুগলী থেকে পত্রিকা কার্য্যাধক্ষ যদুনাথ কাঞ্জিলাল জানিয়েছেন

–“এরূপ সুলভ মূল্যের কাগজ মফঃস্বল হইতে এ পর্য্যন্ত বাহির হয় নাই।”

পত্রিকা ছাপা হত হুগলীর সাবিত্রী যন্ত্রে। এ সম্বন্ধে ১৩০০ বঙ্গাব্দের

জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় একটি বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে –

“হুগলীর চকে সাবিত্রীযন্ত্র নামে একটি ছাপাখানা স্থাপিত হইয়াছে। ইহাতে বাঙ্গালা ইংরাজি বহু প্রকার নূতন অক্ষর আছে এবং কলিকাতার দরে পুস্তকাদি ছাপান হইতেছে। বিশেষ সুবিধা এই, গ্রন্থকার ইচ্ছা করিলে, প্রুফ সংশোধনের ভার রীতিমত লওয়া হইয়া থাকে। ...”।

শেষের দিকে ‘পূর্ণিমা’ অবশ্য বাঁশবেড়িয়া ‘পূর্ণিমা যন্ত্রে’ শ্রীশ্রীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্ত্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে।

‘পূর্ণিমা’ কতদিন স্থায়ী হয়েছিল সে সম্বন্ধে সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও অন্তত সতেরো বছর চলেছিল সেটা নিশ্চিত।
সংযোজিত হ’ল পত্রিকার একটি আখ্যাপত্র ও প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তি।




চিত্র – ১ : পত্রিকার একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র।



চিত্র – ২ :প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন





লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।