পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

জুলাই ৩০, ২০১৬
সাহিত্য
দীপক সেনগুপ্ত
‘সাহিত্য’ পত্রিকার জন্ম ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুম’ নামক পত্রিকা থেকে। ১২৯৬ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে (জুলাই, ১৮৮৯ ) ‘সাহিত্য কল্পদ্রুমে’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। স্বত্বাধিকারী ছিলেন ‘বসুমতী’ খ্যাত উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং সম্পাদক শিবাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য। উপেন্দ্রনাথ কিন্তু সম্পাদকের কাজে খুশি ছিলেন না, এ কারণেই হয় ত শিবাপ্রসন্ন পদত্যাগ করেন। এই সময়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দৌহিত্র ( বড় মেয়ে হেমলতার পুত্র ) সুরেশচন্দ্র সমাজপতির সঙ্গে উপেন্দ্রনাথের যোগাযোগ হয়। সুরেশচন্দ্রের একটি রচনা থেকেই এ প্রসঙ্গে বিশদ ভাবে জানা যাবে। কিয়দংশ এখানে উদ্ধৃত করি –
“১২৯৬ সালে উপেন্দ্র বাবু ৩ নং বিডন স্কোয়ার হইতে ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুম’ নামক একখানি মাসিকপত্রের প্রচার করেন। কলিকাতা হাইকোর্টের প্রসিদ্ধ উকীল শ্রীযুত শিবাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য মহাশয় ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুমে’র সম্পাদক ছিলেন। ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসে ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুম’ প্রকাশিত হয়। শিবাপ্রসন্নবাবু চারি পাঁচ মাস ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুমে’র সম্পাদক ছিলেন। তাহার পর তিনি সম্পাদকের দায়িত্ব পরিত্যাগ করেন। বোধ হয়, অগ্রহায়ণ মাসে ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুম’ আমার চোখে পড়ে, এবং আমি উপেনবাবুর সহিত পরিচিত হই। উপেন্দ্রবাবুর অনুরোধে, এবং বর্তমানে পাটনা হাইকোর্টের বিখ্যাত উকীল, আমার অগ্রজতুল্য সুহৃৎ শ্রীযুত মথুরানাথ সিংহের প্রেরণায়, আমি ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুমে’র সম্পাদকের পদ গ্রহণ করি। আমার সহিত ‘কল্পদ্রুমে’র কোনও আর্থিক সম্বন্ধ ছিল না। প্রথম বর্ষের ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুম’ নয় মাসে সমাপ্ত হয়। চৈত্র মাসে প্রথম খণ্ড শেষ করিয়া আমি বৈশাখ হইতে বর্ষ-গণনার ও নাম পরিবর্ত্তনের ব্যবস্থা করি, এবং ‘কল্পদ্রুম’ বর্জ্জন করিয়া ‘সাহিত্য’ নাম রাখি। কিন্তু ডাকঘরে ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুমে’র নামে ষ্ট্যাম্পের টাকা জমা ছিল। এই জন্য প্রথম তিন মাস ‘সাহিত্যে’র মলাটে ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুমে’র নামও রাখিতে হইয়াছিল। ১২৯৭ সালেও উপেন্দ্রনাথ ‘সাহিত্যে’র স্বত্বাধিকারী ছিলেন। ১২৯৭ সালের শেষভাগে উপেনবাবু ‘সাহিত্যে’র স্বত্ব ও স্বামিত্ব ত্যাগ করেন। আমি ১২৯৮ সাল হইতে ‘সাহিত্যে’র স্বত্বাধিকারী হই। আমাকে ‘সাহিত্য’ দিবার পর, বোধ হয়, ১২৯৮ সালে, উপেন্দ্রবাবু আবার ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুমে’র প্রচার করিয়াছিলেন। সে পর্য্যায়ে সাহিত্য-পরিষদের একনিষ্ঠ সেবক ব্যোমকেশ মুস্তোফী ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুমে’র সম্পাদক হইয়াছিলেন। কিন্তু অল্পকাল পরে উপেন্দ্রবাবু ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুম’ বন্ধ করিয়া দেন।
‘সাহিত্যে’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১২৯৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে ( এপ্রিল ১৮৯০ )। পত্রিকা সম্পাদক হয়ে সুরেশচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত লেখকদের পাশাপাশি সেই প্রজন্মের নতুন লেখকদেরও উৎসাহিত করেছেন, তাদের লেখাও গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছেন। বহু পত্র-পত্রিকা সে সময়ে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন উদ্দেশ্য নিয়ে, বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গী ও মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে। এটা না জানলে হঠাৎ কোনো একটি পত্রিকা কেন প্রকাশিত হল, সেটা স্পষ্ট হবে না। ‘সাহিত্য’ পত্রিকা প্রকাশের মূল উদ্দেশ্য সম্পাদকের রচিত প্রথম সংখ্যার ‘সূচনা’ অংশে বিধৃত হয়েছে। ‘সূচনা’ অংশটি এখানে উদ্ধৃত হল।
“ বাঙ্গালা সাহিত্যের সেবার জন্য, “সাহিত্যের” জন্ম হইল। জাতীয় সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধিসাধন, আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। যাহা কিছু সত্য ও সুন্দর, সাহিত্যে আমরা তাহারই আলোচনা করিব।
“ এদেশে ইংরাজী শিক্ষার প্রভাব, দিন দিন অধিকতররূপে বিস্তারিত হইতেছে। এই শিক্ষার ফলে, আমাদের শিক্ষিত যুবকগণ, নানাবিধ নূতন ভাব ও অভিনব চিন্তার সহিত পরিচিত হইতেছেন। কিন্তু, অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই, আমাদের বাঙ্গালা সাহিত্য, তাঁহাদের সেই চিন্তাশক্তি ও ভাবুকতার ফললাভে বঞ্চিত হইয়া রহিয়াছে। এখন যাঁহারা ইংরাজী শেখেন, তাঁহারা প্রায় বাঙ্গালা পড়েন না; বাঙ্গালা লেখেন না। বাঙ্গালা-সাহিত্যের শৈশব দশায়, যাঁহারা বাঙ্গালা-সাহিত্যের উন্নতির জন্য প্রাণপাত করিয়াছিলেন, এখনও প্রায় তাঁহারাই বাঙ্গালা লেখক। তাঁহারা সাহিত্যক্ষেত্রে যে বীজ বপন করিয়াছিলেন, তাহা অঙ্কুরিত হইয়াছে সত্য, কিন্তু কে তাহাতে জল সেচন করিবে ? তাঁহারা যে কার্য্যের সূত্রপাত করিয়াছেন, কে তাহাকে পূর্ণ পরিণতির দিকে লইয়া যাইবে ? কারণ, তাঁহাদের পরে যাঁহারা বাঙ্গালা লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন, তাঁহাদের সংখ্যা অতি অল্প। কৃতকার্য্য লেখকের সংখ্যা, আবার তদপেক্ষা আরও অল্প।
“ অথচ সেকালের অপেক্ষা, একালে, দেশে চিন্তাশীলের সংখ্যা বাড়িয়াছে, জ্ঞানের জ্যোতিঃ অধিকতর বিকীর্ণ হইতেছে। তথাপি, শিক্ষার অনুপাত অনুসারে ধরিতে গেলে, সেকালের তুলনায়, একালের বাঙ্গালা-সাহিত্যকে অনেক দরিদ্র বলিয়া বোধ হয়। শিক্ষিত যুবকগণের বাঙ্গালা-সাহিত্যে সেরূপ মনোযোগ ও অনুরাগ নাই, এইজন্যই সাহিত্যের এমন দুর্দ্দশা ঘটিতেছে।
“ এখন চিন্তার স্রোত পরিবর্ত্তিত হইয়াছে, প্রাচীন যুগের লেখকগণের মতের সহিত, প্রায়ই বর্ত্তমান নবীন যুগের শিক্ষিত যুবকগণের মতবিরোধ উপস্থিত হয়; কিন্তু দুঃখের বিষয় এই, সাহিত্যের প্রশস্ত ক্ষেত্রে তাহার মীমাংসা হয় না। সুতরাং, প্রাচীন ও নবীন মতের বিরোধে যে শুভফল প্রত্যাশা করা যায়, আমাদের সাহিত্যে, সে শুভফলের সম্ভাবনা নাই।
“ এইজন্য, আমরা শিক্ষিত যুবকগণকে এই নূতন “সাহিত্যের’ আসরে আহ্বান করিতেছি। তাঁহারা পূর্ব্বতন আচার্য্যগণের পদবীর অনুসরণ করুন, আপনাদের শিক্ষার ফল, যাহাতে আমাদের জাতীয়-জীবনে অনুপ্রাণিত হয়, তাহার চেষ্টা করুন।
“ জাতীয়-জীবনের উন্নতি, সাহিত্য-সাপেক্ষ, একথা সর্ব্বাদিসম্মত। দেশের শিক্ষিত যুবকগণ যদি সেই জাতীয়জীবন গঠনের জন্য প্রাণপাত না করেন, তবে আর কে করিবে ?
“ আমাদের দেশের অনেক গণ্য ও মান্য ব্যক্তির নিকট উৎসাহ পাইয়াছি, সাহিত্য-সংসারে সুপরিচিত, অনেক শ্রদ্ধেয় লেখকের সাহায্য পাইয়াছি, এক্ষণে, শিক্ষিত যুবকগণ, “সাহিত্যে”র আসরে অবতীর্ণ হইলে, আমাদের আশা ও উদ্যোগ সফল হয়। আমাদের আশা কি বিফল হইবে ?”
‘সাহিত্য’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১২৯৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। ‘সাহিত্য-কল্পদ্রুম’ থেকে বেরিয়ে এসে ‘সাহিত্যে’র আকার ও আয়তন পরিবর্ধিত হয়েছে। বার্ষিক দু’টাকা মূল্য কিন্তু অপরিবর্তিতই থেকেছে। কার্যালয়ের বদল ঘটেছে বহুবার। প্রথমে ৩ নং বিডন স্কোয়ার থেকে পরে ২৫ বৃন্দাবন মল্লিক লেন, ৫০ নং হরি ঘোষের ষ্ট্রীট, ১৩/৭ বৃন্দাবন বসুর লেন, ৮২ নং সীতারাম ঘোষের ষ্ট্রীট , ২/১ নং রামধন মিত্রের লেন ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে কার্যালয় স্থানান্তরের কারণ জানা যায় নি। প্রথম বর্ষের শেষ সংখ্যায় একটি বিজ্ঞাপন ছিল –
“দ্বিতীয় বৎসরে সাহিত্যের আকার বর্ধিত হইতেছে, সাহিত্য ডিমাই পাঁচ ফর্মা ছিল, ছয় ফর্মা হইবে। কিন্তু মূল্য বাড়িল না। শহর, কি মফঃস্বল, সর্বত্রই অগ্রিম বার্ষিক মূল্য দুই টাকা মাত্র। অগ্রিম মূল্য না পাইলে ‘সাহিত্য’ পাঠান হইবে না।”
পত্রিকার উৎকর্ষ ধরে রেখে নতুন লেখকদের উৎসাহিত করতে সুরেশচন্দ্রের আন্তরিক প্রয়াস জানা যায় তার একটি লেখার কিয়দংশ থেকে –
“সাহিত্য-এর জন্য যে সমস্ত লেখা আমাদের কাছে আসে, সবগুলিই মন দিয়ে পড়তে হয়। নির্বাচনও কঠিন ব্যাপার। আমি যে সমস্ত রচনার মধ্যে বস্তু আছে অথচ প্রকাশের ত্রুটিতে তা দোষযুক্ত, সেইসব ক্ষেত্রে আমি চেষ্টা করি লেখককে ডেকে তার ত্রুটি বুঝিয়ে দিতে। আমার মনে হয়, এমনি করেই অনেক কাঁচা মাটি থেকে পাকা সাহিত্যিক তৈরি হয়।”
এ বিষয়ে তিনি কি বঙ্কিমচন্দ্রের উপদেশই শিরোধার্য করেছেন? কারণ, বঙ্কিমচন্দ্র এক সময় সুরেশচন্দ্রকে বলেছিলেন –
“তোমরা কি ভয়ে লেখকদের লেখা কাটো না? আমি তো বঙ্গদর্শনের অনেক প্রবন্ধ নিজে আবার লিখিয়া দিয়াছি বলিলেও চলে। আমরা যাহা লিখিতাম তাহাই সুন্দর করিয়া লিখিবার চেষ্টা করিতাম। এখন লেখকেরা এদিকে বড় উদাসীন। তোমাদের ‘সাহিত্যে’ও দেখি – অনেক প্রবন্ধ দেখিয়া মনে হয়, একটু অদল বদল করিয়া কাটিয়া ছাঁটিয়া দিলে বেশ হয়। কেন কর না? লেখকেরা কি রাগ করেন? ... বঙ্গদর্শনের আমলে আমাকে বড় খাটিতে হইত। আমি খুব ভাল করিয়া ‘রিভাইজ’ না করিয়া কাহারও কপি প্রেসে দিতাম না।”
নতুন লেখা প্রকাশ করে লেখক তৈরির চেষ্টার সঙ্গে বহু প্রতিষ্ঠিত লেখকদের রচনাও ‘সাহিত্যে’র পাতায় স্থান পেয়েছে। এদের মধ্যে ছিলেন – সখারাম গণেশ দেউস্কর, সরলাবালা সরকার, নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, অক্ষয়কুমার বড়াল, দীনেশচন্দ্র সেন, দীনেন্দ্রকুমার রায়, জলধর সেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, শ্রীশচন্দ্র মজুমদার, বিপিনচন্দ্র পাল, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, নিখিলনাথ রায়, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
যে সব লেখা দিয়ে ‘সাহিত্য’-র প্রথম সংখ্যা শুরু হয়েছিল, সেগুলি হ’ল – ‘সূচনা’, ‘নববর্ষ’, ‘একটি শিশু বালিকার প্রতি’ (কবিতা) –সতীশচন্দ্র ঘোষ, ‘জয়দেব’ (কবিতা) – জ্ঞানেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ‘সুন্দর’ (কবিতা) – নিত্যকৃষ্ণ বসু, ‘স্বার্থ ও পরার্থ’ (কবিতা) – হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, ‘বাঁশী’ (একটি গান) – নলিনীকান্ত মুখোপাধ্যায়, ‘পাশ্চাত্য দর্শন’ (ধারাবাহিক প্রবন্ধ) – যোগেশচন্দ্র ঘোষ, ‘বিষবল্লরী না সঞ্জিবনী?’ (ধারাবাহিক গল্প) – জ্ঞানেন্দ্রনাথ গুপ্ত, ‘রৈবতক কাব্য’ (ধারাবাহিক , সমালোচনা) –হীরেন্দ্রনাথ দত্ত। এখানেও সেই বৈশিষ্ট্যটি চোখে পড়ে, একই লেখক একাধিক লেখা লিখেছেন।
রবীন্দ্রনাথের রচনা পত্রিকা প্রকাশনার প্রথম দিকে কয়েকটি পাওয়া যায়; যেমন – ‘প্রাচীন প্রত্নতত্ব’ (পৌষ ১২৯৮), ‘মেঘদূত’ ( অগ্রহায়ণ ১২৯৮ ), ‘রবীন্দ্রবাবুর পত্র’ ( বৈশাখ ১২৯৯ ), ‘সোনার বাঁধন’ ( কবিতা, আষাঢ় ১২৯৯ ), ‘নব্য লয়তত্ত্ব’ (প্রতিবাদ, আলোচনা) ( ভাদ্র ১২৯৯ ), ‘একটি পত্র’ ( কার্ত্তিক ১২৯৯ ), ‘গান’ ( বৈশাখ ১৩০৩ )। গানটি ছিল ‘উজ্জ্বল করো হে আজি এ আনন্দ রাতি’। ইমন ভূপালী রাগাশ্রিত কাওয়ালি গানটির অবশ্য কোন স্বরলিপি তৈরি হয় নি। লক্ষণীয় যে ‘সাহিত্য’ ১৩৩০-এর বৈশাখ অবধি সচল থাকলেও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ১৩০৩ বৈশাখের পর এই পত্রিকায় আর লেখেন নি।
১২৯৯-এর ফাল্গুন সংখ্যায় লেখকের নামহীন একটি রচনা ‘তর্কবৈচিত্র্য’ প্রকাশিত হয়। লেখকের বক্তব্য রবীন্দ্রনাথের ‘হিং টিং ছট’ কবিতাটি লেখক চন্দ্রনাথ বসুকে লক্ষ্য করে রচিত হয়েছে। ‘তর্কবৈচিত্র্য’ রচনাটি সম্পাদক সুরেশচন্দ্রই লিখেছেন [প্রকৃতপক্ষে নগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রচিত ] এটা ধরে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ একটি পত্র লেখেন। সেটি ‘রবীন্দ্র বাবুর পত্র’ নাম দিয়ে ১৩০০-র বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পাদ টীকায় সম্পাদক প্রশ্ন তুলেছেন –
“রবীন্দ্র বাবু কোন বনিয়াদে আমাদিগকে তর্কবৈচিত্র্যের লেখক স্থির করিলেন? ইহা তাহার কবিজনোচিত স্বপ্ন হইতে পারে, কিন্তু ইহার মধ্যে কবিত্ব কিছুই নাই। ... অগত্যা আমরা তাঁহার পত্র, প্রকাশের উপযুক্ত না হইলেও, প্রকাশ করিলাম। ...... বহুদিনাবধি সাময়িক পত্রের লেখক ও কিয়ৎ পরিমাণে পরিচালক হইয়া রবীন্দ্র বাবু এরূপ বেতালা পত্র লিখিতে কুণ্ঠিত হয়েন না এবং তাহা প্রকাশ করিবার জন্য অনুরোধ করেন, ইহা সাধারণ্যে প্রকাশ করা তাঁহার সম্মানের পরিচায়ক নহে।”
বস্তুতঃ রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে সম্পাদক সুরেশচন্দ্রের ধারণা সব সময় শ্রদ্ধাসূচক নয়। কবিকে তিনি সমালোচনায় বিদ্ধ করতে ছাড়েন নি। এর অনেকগুলিই সম্পুর্ণ অপ্রয়োজনীয় ও দুর্বল যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। উদাহরণ হিসাবে কবির ‘নববর্ষা’ নামক কবিতাটির উল্লেখ করা যায়। কবিতাটি ‘ভারতী’ পত্রিকার আষাঢ় ১৩০৭ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। শ্রাবণ মাসের ‘সাহিত্যে’ এর সমালোচনায় সম্পাদক লিখেছেন –
“ধেয়ে চলে আসে বাদলের ধারা, / নবীন ধান্য দুলে দুলে সারা, / কুলায়ে কাঁপিছে ক্লিন্ন কপোত, / দাদুরী ডাকিছে সঘনে। / গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি, / গরজে গগনে গগনে”। অতি সুন্দর। কিন্তু অবশিষ্ট ভাগ অত্যন্ত সাধারণ; কৃত্রিমতাদুষ্ট ও কেবল শব্দঝঙ্কারে মুখরিত। বিশেষতঃ হৃদয়-ময়ূরের নৃত্য দেখিয়া হাস্য রসের উদ্রেক হয়।”
১৩১৬ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় ‘মাসিক-সাহিত্য সমালোচনা’ বিভাগে সুরেশচন্দ্র লিখেছেন –
“ আজি শ্রাবণ ঘন গহন মোহে / গোপন তব চরণ ফেলে / নিশার মত নীরব ওহে / সবার দিঠি এড়ায়ে এলে।” শ্রাবণের ত ঘন গহনে পরিণত হইল, তাহাও বুঝিলাম। কিন্তু চরণ কি করিয়া ‘গোপন’ হইল তাহা বুঝিতে পারিলাম না। সাপের পা ‘গোপন’ বটে। কিন্তু এ ‘গোপন’ চরণ কাহার? পরে আছে ‘নীলাজ নীল আকাশ’। ‘নীলাজ নীল’ কি বুঝিতে পারিলাম না।” এ ধরণের বহু সমালোচনা ‘সাহিত্যে’ প্রকাশিত হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে সুরেশচন্দ্র কোন রচনায় ব্যবহৃত কিছু কিছু কল্পনাশ্রিত ভাবসমৃদ্ধ শব্দের ব্যবহার পছন্দ করতেন না। এই ‘অস্পষ্টতা’ তার কাছে অর্থবহ মনে হয় নি। শুধু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে নয়, অন্যত্রও এর উদাহরণ দেখা যায়। যেমন ছোটদের ‘মুকুল’ পত্রিকায় ( আষাঢ় ১৩০৬ ) প্রকাশিত একটি রচনা সম্বন্ধে তার সমালোচনা –
“ ‘ইউরিসিমো তারো’ একটি অসমাপ্ত গল্প ; গল্পটির আপাদমস্তক কবিত্বে পরিপূর্ণ ; যথা – “তখনো গ্রীষ্মের দিবসগুলি এখনকার মতই ছিল, এমনই নিদ্রাতুর স্নিগ্ধ নীলবর্ণ ! দিবসগুলি শুধু নিদ্রাতুর নয় আবার নীলবর্ণ ! কি উৎকট ‘কাব্যি’ ! ‘স্বপ্নমুদ্রিত সমুদ্র’ , ‘বসন্তের প্রথম নিশ্বাসের মত’ , ‘চিরনিদ্রিত স্বপ্নসমুদ্রের উপর দিয়া ভাসিয়া চলিল’ ইত্যাদি কবিত্ব বা হেঁয়ালি মুকুলের পাঠকেরা বুঝিতে পারিবে ত ?”
হয় ত ছোটদের জন্য এগুলি কিছুটা বেমানান ঠিকই ; কিন্তু সুরেশচন্দ্র এ ধরণের শব্দ ব্যবহার সাধারণভাবেই পছন্দ করতেন না।
সমালোচকদের মতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, চিত্তরঞ্জন দাশের মত সুরেশচন্দ্রও ছিলেন কিছুটা রবীন্দ্র-বিদ্বেষী। মনে হয় দীর্ঘদিনের চলে আসা সাহিত্য রচনার ধরণ ও প্রকাশভঙ্গীর গতানুগতিকতার মধ্যে হঠাৎ আলোর ঝলকানির মত রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব ও তার রচনায় অলঙ্করণ, ভাব ও কল্পনার অনন্যসাধারণ অভিব্যক্তি অনেকের কাছে বিসদৃশ ঠেকেছে। তার প্রতিভার মূল্যায়নে সময় লেগেছে। এ জন্যই প্রথমে যারা কবির সমালোচনা করেছেন, পরে তারা প্রশংসার ডালি নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। আবার এমন অনেকে ছিলেন যারা রবীন্দ্র-প্রতিভার অনাবশ্যক ও অহেতুক সমালোচনা করে প্রশংসার আলোয় আসতে চেয়েছেন। এ প্রচেষ্টা অবশ্য এখনও সজীব। তবে সুরেশচন্দ্র কোন কোন রচনার জন্য রবীন্দ্রনাথের প্রশংসাও করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ খুব বেশি রচনা না পাঠালেও, ঠাকুরবাড়ির অনেক সদস্যই কিন্তু ‘সাহিত্যে’ লিখেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন –মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ (১ টি), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭টি), ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৬টি), ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৩ টি), বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (৩ টি), প্রজ্ঞা দেবী (২টি) ইত্যাদি। অসংখ্য রচনা প্রকাশ করেছেন দীনেন্দ্রকুমার রায় (৬২ টি), জলধর সেন (২১টি), উমেশচন্দ্র বটব্যাল (৩৫টি), গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী (কবিতা ৪২টি), দেবেন্দ্রনাথ সেন (কবিতা ১০৫টি), মুণীন্দ্রনাথ ঘোষ (৬৩টি), প্রমীলা নাগ (১৭টি), কামিনী রায় (সেন) (৭টি), অক্ষয়কুমার বড়াল (৪৩টি) এবং আরও অনেকে। সংখ্যার বিশদ বিবরণে না যাওয়াই ভাল, অন্যথায় বর্তমান আলোচনাটি নীরস ও তথ্য ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। লক্ষণীয় যে, ঘোষিত নীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সুরেশচন্দ্র নামী লেখকদের সঙ্গে অনামীদেরও যথেষ্ট সমাদর দিয়ে পত্রিকায় স্থান দিয়েছেন।
তবে সুরেশচন্দ্রের পত্রিকায় সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে প্রবন্ধ। বিভিন্ন বিষয়ে বিপুল সংখ্যক প্রবন্ধ নিভৃত বাস করছে ‘সাহিত্যে’র পাতায়। ধারাবাহিক প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। শ্রাবণ ১৩১৯ থেকে শুরু ক’রে মোট ১৮টি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে গিরিশচন্দ্র বেদান্ততীর্থের ‘প্রাচীন শিল্পপরিচয়’ শীর্ষক প্রবন্ধ। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় লিখেছেন ‘কালিদাস ও ভবভূতি’ ১৩১৭ বৈশাখ থেকে শুরু করে মোট ১১টি কিস্তিতে। এরকম আরও রয়েছে। কবিতার পরেই রয়েছে ছোট গল্প। সরোজনাথ ঘোষ ৩০টিরও বেশি গল্প লিখেছেন, এর মধ্যে কয়েকটি রয়েছে অনুবাদ। এ ছাড়া ‘বিদেশী গল্প’ শিরোনামে ২৫টির বেশি গল্প লিখেছেন তিনি। এক সময়ে জনপ্রিয় লেখক হিসাবে পরিচিতি থাকলেও পরবর্তী প্রজন্ম তাকে তেমন ভাবে মনে রাখে নি। সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের অসংখ্য গল্প বিধৃত রয়েছে ‘সাহিত্য’ পত্রিকায়। ছোট গল্পের তুলনায় উপন্যাস অনেক কম প্রকাশিত হয়েছে। হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তার ‘মাধুরী’ বৈশাখ ১৩০০ থেকে ১০টি সংখ্যায় পরিবেশন করেছেন। শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ‘প্রতিশোধ’ ১৩০০-র ভাদ্র থেকে ১৪টি কিস্তিতে বিন্যস্ত। জীবনকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের ‘ন্যায়রত্নের নিয়তি’র বিস্তার ১৩২৬ আশ্বিন থেকে শুরু করে অগ্রহায়ণ ১৩২৭ অবধি। ১৩১০-এর চৈত্র সংখ্যায় কথামৃত-খ্যাত শ্রীম পাঁচটি পরিচ্ছেদে ঠাকুরের কাশীপুর বাগানে অবস্থানের কাহিনী লেখনীবদ্ধ করেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বহু কবিতা ও গান স্থান পেয়েছ পত্রিকায়। ‘কালিদাস ও ভবভূতি’ নামে একটি নাটক বিষয়ের আলোচনা ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছে ১১টি সংখ্যায়। তার রচিত ‘একটি পুরাতন মাঝির গান (আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা)’ রয়েছে আশ্বিন ১৩১৩ সংখ্যাটিতে। ‘মহারাষ্ট্র সাহিত্য’ সম্বন্ধে ধারাবাহিক ভাবে লিখেছেন সখারাম গণেশ দেউস্কর।
গল্প লেখকদের সঙ্গে রয়েছেন জলধর সেন তার সুললিত বর্ণনা সমৃদ্ধ ভ্রমণ কাহিনীর সম্ভার নিয়ে। তবে এই লেখাগুলি প্রায় সবই অধুনা প্রকাশিত একটি গ্রন্থে সহজ লভ্য। শিষ্য দীনেন্দ্রকুমার রায়ের কথা আগেই উল্লেখিত হয়েছে। তার বহু সংখ্যক গল্প ও কিছু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকায়। ভ্রমণ কাহিনীর কথা বলতে গেলে রামানন্দ ভারতীর ‘হিমারণ্য’ বইটির কথা উল্লেখ করতে হয়, কারণ এটি ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্কিত। এ প্রসঙ্গে হিমালয়-পথিক উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লিখেছেন –
“ ...... হঠাৎ একদিন ‘অমৃত’ পত্রিকায় ১৯৭৭ সালের ১০ই জুন তারিখের সংখ্যায় দেখি, সুসাহিত্যিকা শ্রীমতী লীলা মজুমদারের ধারাবাহিক প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক ‘পাকদন্ডী’ শীর্ষক প্রবন্ধের একস্থানে তিনি উল্লেখ করেছেন, তার মাতামহ – পরে যিনি রামানন্দ ভারতী নামে পরিচিত হন – ১৯০০ সালেরও পূর্বে কৈলাস-মানস-সরোবর যাত্রা করেন এবং তৎকালীন ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় তার সেই ভ্রমণবৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের নাম ছিল ‘হিমারণ্য’। আমার অজ্ঞাত এই তথ্যটি পেয়ে তখনি অধুনা-দুষ্প্রাপ্য ‘সাহিত্য’ পত্রিকার পুরাতন সংখ্যাগুলির সন্ধান করি। ‘হিমারণ্য’ রচনাটিও পেয়ে যাই।”
প্রসঙ্গত ‘হিমারণ্য’ রচনাটি ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছে ১৩০৮ বঙ্গাব্দের ‘সাহিত্য’ পত্রিকার বৈশাখ-মাঘ সংখ্যায়। এখন অবশ্য অসমাপ্ত রচনাটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে।
চিত্রকলা সম্বন্ধে সুরেশচন্দ্র সম্ভবতঃ খুবই আগ্রহী ছিলেন। দেশী-বিদেশী বহু ছবি স্থান মুদ্রিত হয়েছে তার পত্রিকায়। মাঝে মাঝে চিত্র-পরিচিতিও প্রকাশিত হয়েছে।
‘সাহিত্য’ সম্পাদক সুরেশচন্দ্র নিজে কি লিখেছেন ? প্রবন্ধ অগ্রাধিকার পেলেও গল্প লিখতেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ। তার গল্পের মধ্যে রয়েছে দুটি বৌদ্ধ গল্প : ‘শোকবিজয়’ এবং ‘লালসা ও সংযম’ (কার্তিক ১২৯৮); আর রয়েছে - ‘প্রভা’ (আষাঢ় ১২৯৯), ‘বড় কে?’ (জ্যৈষ্ঠ ১২৯৮), ‘বন্য মধুপের স্বপ্ন’ ( আশ্বিন-কার্তিক ১৩০০), ‘বাঘের নখ’ (শ্রাবণ ১৩০১) ইত্যাদি। ছোট গল্প লেখা নিয়ে তার একটা নিজস্ব মতামত আছে এবং সেটা তিনি ব্যক্ত করেছেন ‘সহযোগী সাহিত্য’ বিভাগে ‘সাহিত্য’ নামক ‘ছোট গল্প’ বিষয়ক একটি প্রবন্ধে (ভাদ্র ১৩০৬, পৃ ৩১৬)। তার প্রাসঙ্গিক অংশ বিশেষ –
“ আমাদের দেশে এখন বক্তৃতামঞ্চে রসাল ছোট গল্প শুনিতে পাই; সে আশার কথা, সন্দেহ নাই। কিন্তু আবার যখন দেখি, আমাদের যে ছোট গল্প সদাসর্ব্বদা দেখিতে পাই – তাহার প্রধান দোষ অতিবিস্তৃতি – তাহাতে কেবলই ফেনা, তখন বড় আশঙ্কা হয়। সাগর-সলিলে সময় সময় ফেনপুঞ্জ শোভা পায় – তাহাতে নীল জলের শোভা হয়, তাহার উপর রবিকরে ইন্দ্রধনুর বর্ণবৈচিত্র্য বড় মধুর দেখায়; কিন্তু তাহাও সদাসর্ব্বদার জন্য নহে। আবার সাগরের পক্ষে যাহা শোভন, গোষ্পদে তাহা বড় বিসদৃশ দেখায়, - সব জিনিসেরই একটা মানান আছে।”
বক্তব্য স্পষ্টভাবে সংক্ষেপে বলা সুরেশচন্দ্রের একটা বৈশিষ্ট ছিল। এই মন্তব্যটা কি কিছুটা রবীন্দ্রনাথের দিকে ইঙ্গিত করা ?
বহু গল্প ত আছেই, পত্রিকার অপর একটি নিয়মিত আকর্ষণীয় ফীচার ছিল ‘মাসিক সাহিত্য সমালোচনা’। এতে সুরেশচন্দ্র সমকালে প্রকাশিত প্রায় প্রতিটি সাহিত্য পত্রিকা ও প্রকাশিত রচনা সম্বন্ধে তার সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছেন। এটা করতে কি সময় ও শ্রম কাজে লাগাতে হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়। মাসিক-পত্রিকাগুলির মধ্যে ছিল – ‘প্রবাসী’, ‘মানসী ও মর্মবাণী’, ‘ভারতবর্ষ’, ‘ভারতী’, ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’, ‘সাধনা’, ‘অনুসন্ধান’, নব্যভারত’, ‘বান্ধব’, ‘বঙ্গদর্শন’, ‘পূর্ণিমা’, ‘জন্মভূমি’, ‘দাসী’, ‘সখা ও সাথী’, ‘ভিষকদর্শন’, ‘সাহিত্য-পরিষদ পত্রিকা’, ‘বামাবোধিনী পত্রিকা’, ‘প্রদীপ’, ‘উৎসাহ’, ‘চিকিৎসা তত্ত্ব বিজ্ঞান’, ‘বিষ্ণুপ্রিয়া পত্রিকা’, ‘বীনাপাণি’, ‘স্বাস্থ্য’ ‘উদ্বোধন’, ‘আরতি’, ‘সুহৃদ’, ‘মুকুল’, ‘নির্মাল্য’ প্রভৃতি। প্রতিটি পত্রিকার সমালোচনা যে ‘সাহিত্য’-র প্রতি সংখ্যাতেই বেরিয়েছে তা নয়; তবু ভাবতে অবাক লাগে, সম্পাদনার অন্যান্য কাজের মধ্যে এতগুলি পত্রিকা খুঁটিয়ে দেখে তার সমালোচনা, সংক্ষিপ্ত আকারের হলেও, লিখতে সুরেশচন্দ্রকে কি একাগ্র ভাবে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়েছে। এই নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার জন্যই একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা হিসাবে ‘সাহিত্য’ পাঠক সমাজে সমাদৃত হয়েছিল।
সাহিত্যকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে সুরেশচন্দ্র কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশের কথা ভুলে যান নি। জগদানন্দ রায় লিখেছেন –‘গর্জ্জন ও বর্ষণ’ (চৈত্র ১৩০০), ‘জল শোষণ’ (জ্যৈষ্ঠ ১৩০১), ‘নাক্ষত্রিক সংঘর্ষণ’ (আশ্বিন ১৩০৪), ‘কৃত্রিম হীরক’ (শ্রাবণ ১৩০৬) ইত্যাদি। আষাঢ় ১৩০১ থেকে ‘বৈজ্ঞানিক সার সংগ্রহ’ নামে একটি বিজ্ঞান বিষয়ক ফীচার নিয়মিত প্রকাশ করেছেন জগদানন্দ। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর একটি অভিভাষণ ‘আকাশ-স্পন্দন ও আকাশ-সম্ভব জগৎ’ প্রকাশিত হয়েছে বৈশাখ ১৩০২ সংখ্যায়। ১৩১৫-এর মাঘ সংখ্যায় বেরিয়েছে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের রচনা ‘বঙ্গসাহিত্যে বিজ্ঞান’। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী লিখেছেন ‘অধ্যাপক জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার’ (ভাদ্র ১৩০৮); তার ‘বিজ্ঞান শাখার সভাপতির অভিভাষণ’ বেরিয়েছে ১৩২১ বৈশাখ সংখ্যায়।
১২৯৮ বঙ্গাব্দের ১৩ই শ্রাবণ বিদ্যাসাগর মহাশয় পরলোক গমন করেন। সুরেশচন্দ্র ছিলেন বিদ্যাসাগরের জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতার পুত্র। স্বাভাবিক কারণেই সুরেশচন্দ্র মাতামহ বিদ্যাসাগরের মৃত্যুসংবাদে অত্যন্ত শোকাহত হয়েছিলেন। শ্রাবণ সংখ্যায় তিনি জানিয়েছেন –
“বিগত ১৩ই শ্রাবণ মঙ্গলবার, ২!২২ মিনিটের সময়, পূজ্যপাদ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দাদামহাশয় লোকান্তরিত হইয়াছেন। আমার এখন কিছু বলিবার শক্তি নাই। দেশের সকল কাগজপত্রে তাঁহার কথা আলোচিত হইতেছে, আমাদের আত্মীয় ও বান্ধবগণ, “সাহিত্যেও” দাদামহাশয়ের জীবনচরিত লিখিতে অনুরোধ করিয়াছেন। আশা করি, তাঁহারা আমার অবস্থা বুঝিয়া, আপাততঃ আমায় ক্ষমা করিবেন। এই জন্য, সম্পাদকের অনবসর বশতঃ শ্রাবণ মাসের “সাহিত্য” যথাসময়ে প্রকাশিত হয় নাই।”
প্রসঙ্গত ‘বিদ্যাসাগর রচিত “আত্মজীবনচরিতের” কয়েক পৃষ্ঠা’ মুদ্রিত হয়েছে কার্ত্তিক ১২৯৮ সংখ্যায়।
সুরেশচন্দ্র তার পত্রিকায় ১৩০০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে ‘সহযোগী সাহিত্য’ নামে একটি বিভাগ শুরু করেন। এর পরিচয় তিনি নিজেই দিয়েছেন –
“সহযোগী সাহিত্য বলিতে, আমরা পৃথিবীর সকল দেশীয় সমসাময়িক সাহিত্য বুঝি। স্বদেশীয় সাহিত্যের ন্যায় বিদেশীয় সাহিত্যেও এ সময়ের সহযোগী সাহিত্যের অন্তর্গত। স্বদেশীয় সাহিত্য আমাদের সমধিক প্রিয়, কিন্তু বিদেশীয় সাহিত্যও সমধিক শিক্ষণীয়। ...... প্রতি মাসেই স্বদেশীয় ও বিদেশীয় সহযোগী-সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধ ‘সাহিত্যে’ প্রকাশিত হইবে। এ বৎসরের ইহা নতুন ব্যবস্থা।”
সময় ব্যয় করে যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে সুরেশচন্দ্র এই বিভাগটিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন। দেশী ও বিদেশী পত্রিকায় প্রকাশিত নানা রচনাকে ভিত্তি করে বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা ছিল এখানে। ১৩১৬ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেছেন সম্পাদক সুরেশচন্দ্র স্বয়ং। পরে সরোজনাথ ঘোষ, অনন্তপ্রসাদ শাস্ত্রী, মুনীন্দ্রনাথ ঘোষ, পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকও এই বিভাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সুরেশচন্দ্রের উদ্দেশ্য ছিল নতুন লেখক-গোষ্ঠি তৈরি করা, একথা আগেই বলা হয়েছে। সে উদ্দেশ্য প্রথম থেকেই সফল হয়েছে, কারণ, প্রথম বর্ষের শেষেই জানানো হয়েছে –
“প্রতিষ্ঠাপন্ন লেখকগণের মধ্যে অনেকে সাহিত্যে লিখিয়াছেন, ...... আর বোধ হইতেছে আমাদের একটি উদ্দেশ্য সফল হইবে, - অনেক নূতন লেখক সাহিত্যে লিখিতে আরম্ভ করিয়াছেন।”
সুরেশচন্দ্রের আদর্শ ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। পত্রিকা পরিচালনায় মাঝে মাঝে তার উপদেশও গ্রহণ করেছেন সুরেশচন্দ্র। ‘সাহিত্যে’ বঙ্কিমচন্দ্রের তিনটি রচনার কথা জানা যায়। প্রথমটি ১৩০১-এর শ্রাবণ মাসে ‘বঙ্কিমবাবুর কবিতা’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘বর্ষার মানভঞ্জন’ শীর্ষক কবিতাটির মুখবন্ধে দীনেশচন্দ্র সেন জানিয়েছেন –
“এই কবিতাটি হুগলি কলেজে অধ্যয়ন করিবার সময় বঙ্কিমবাবু রচনা করিয়াছিলেন। ইহা আমি আমার পিতৃদেব ঈশ্বরচন্দ্র সেন মহাশয়ের হস্তলিখিত নোটবুকে পাইয়াছি। ......কবিতাটি প্রভাকর বা সাময়িক অন্য কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হইয়াছিল কি না জানি না।”
দ্বিতীয় রচনাটি ‘হিন্দু দর্শনের আলোচনা’ নামে ১৩২৩ অগ্রহায়ণ সংখ্যায় ছাপা হয়। শুরুতেই বলা হয়েছে – “স্বর্গীয় সাহিত্যগুরু বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় মহোদয়ের ইংরেজী প্রবন্ধ হইতে সঙ্কলিত।” শুরুতে প্রবন্ধটি সম্বন্ধে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা কয়েকটি চিঠি সংযোজিত হয়েছে। তৃতীয়টি প্রকাশিত হয়েছে ১৩১৯ কার্ত্তিক সংখ্যায়। ‘হিন্দুর পূজোৎসবের উৎপত্তিকথা’ শিরোনামে প্রবন্ধটির প্রথমেই লিখিত হয়েছে –
“গত ১৮৬৯ খৃষ্টাব্দের ২৬শে জানুয়ারী তারিখে স্বর্গীয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইংরেজী ভাষায় এই সন্দর্ভ লিখিয়াছিলেন; বেথুন সোসাইটির অধিবেশনে পাঠ করিয়াছিলেন। আমরা উহা বাঙ্গলায় ভাষান্তরিত করিয়া দিলাম। বলা বাহুল্য, বঙ্কিমচন্দ্র যখন এই সন্দর্ভ লিখেন, তখন তিনি যুবক ছিলেন। এই বিষয় লইয়া প্রৌঢ়ে তাঁহার মতের পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছিল। বোধ হয়, এই হেতু তিনি পরে এই সন্দর্ভের কোন উল্লেখ করেন নাই।”
জীবনের শেষে বঙ্কিমচন্দ্র ‘নিশীথ রাক্ষসীর কাহিনী’ নামে একটি রচনা লিখতে শুরু করেছিলেন। সেটি শেষ করার আগেই তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় রচনাটি প্রকাশ করার তার ইচ্ছা ছিল বলে জানা যায়।
কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ৪টি রচনা ‘সাহিত্য’তে প্রকাশিত হয়েছে, - ‘বাল্যস্মৃতি’ (মাঘ ১৩১৯), ‘কাশীনাথ’ (ফাল্গুন-চৈত্র ১৩১৯), ‘অনুপমার প্রেম’ (চৈত্র ১৩২০) এবং ‘হরিচরণ’ (আষাঢ় ১৩২১)। ‘বিচিত্রা’-খ্যাত উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন শরৎচন্দ্রের মামা। শরৎচন্দ্র তখন ‘চরিত্রহীন’ লিখছেন। উপেন্দ্রনাথের ইচ্ছে ‘চরিত্রহীন’ ‘সাহিত্যে’ ছেপে বেরোয়। স্বল্পভাষী খেয়ালি শরৎচন্দ্রের আপত্তি অগ্রাহ্য করে তাকে ধরে নিয়ে উপেন্দ্রনাথ হাজির করেছেন সুরেশের বৈঠকখানায়। উপেন্দ্রনাথের মাধ্যমে ‘চরিত্রহীনে’র পাণ্ডুলিপি আগেই হস্তগত হয়েছে সুরেশচন্দ্রের। তিনি কথা দিয়েছিলেন ‘চরিত্রহীন’ তার পত্রিকাতেই ছাপা হবে। বাকিটা উপেন্দ্রনাথের লেখা ‘স্মৃতিকথা’ থেকে দেখে নেওয়া যাক -
.......“ তারপর [সুরেশচন্দ্র ]আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন,“চরিত্রহীন” ‘সাহিত্যে’ যাতে প্রকাশিত হয়, সে বিষয়ে কাল তোমাকে অনুরোধ করেছিলাম; কিন্তু পরে সে বিষয়ে মত বদলেছি। ‘সাহিত্যে’ ও লেখা বার করা চলবে না।”
একটু বিস্মিত হ’য়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন বলুন ত ?”
সুরেশচন্দ্র বললেন, “ও-লেখা ‘সাহিত্যে’ বের হলে ‘সাহিত্য’ উঠে যাবে। ......পয়সা দিয়ে আমাদের দেশে যারা কাগজ কেনে, মেসের ঝিকে হজম করার মতো জোরালো পরিপাকশক্তি এখনো তাদের হয় নি।” বলে উচ্চৈঃস্বরে হেসে উঠলেন।”
পত্রিকার উৎকর্ষ ও সম্মান রক্ষার্থে অতি মনোযোগী সুরেশচন্দ্র সেদিন সাহস করে শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ ছাপেন নি। পরে তিনি বহু চেষ্টা করেছেন লেখাটি ফিরে পেতে। কিন্তু সেটা আর হয় নি। ‘চরিত্রহীন’ পরিশেষে ফণীন্দ্রনাথ পাল সম্পাদিত ‘যমুনা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। মূলতঃ শরৎচন্দ্রই তার লেখা দিয়ে ‘যমুনা’কে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জানুয়ারি ( পৌষ ১৩২৭ ) সুরেশচন্দ্র প্রয়াত হন। ‘সাহিত্য’ সম্পাদনার কাজ যখন তিনি শুরু করেন তখন তার বয়স মাত্র ২০ বছর। ১৭ বছর বয়সে মূল সংস্কৃত থেকে তার অনুবাদ করা ‘কল্কিপুরাণ’ প্রকাশিত হয়। এই কাজটি বিদ্যাসাগর মহাশয় তাকে করতে বলেছিলেন। মাতামহ বিদ্যাসাগরের কাছে দৌহিত্র সুরেশচন্দ্রের শিক্ষালাভ যে বিফলে যায় নি, সুরেশচন্দ্র আমৃত্যু তার প্রমাণ রেখে গেছেন।
সুরেশচন্দ্রের পর ‘সাহিত্য’ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন সাহিত্যিক সাংবাদিক পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘সাহিত্যে’ পাঁচকড়ির অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সুরেশচন্দ্রের সঙ্গে তার দীর্ঘ দিনের পরিচয়। পত্রিকা সম্পাদনায় পাঁচকড়ি ছিলেন বিশেষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। ‘বসুমতী’, ‘বঙ্গবাসী’, ‘হিতবাদী’, ‘জন্মভূমি’, ‘নায়ক’, ‘নারায়ণ’, ‘সন্ধ্যা’ প্রভৃতি বিভিন্ন পত্রিকার সঙ্গে তিনি নানা ভাবে যুক্ত ছিলেন। হিন্দি ভাষায় ভাল বুৎপত্তি থাকায় এক সময়ে হিন্দি দৈনিক ‘ভারতমিত্রের’ সম্পাদনার কাজও করেছেন। তার দায়িত্ব সম্বন্ধে তিনি ছিলেন যথেষ্ট সচেতন। ‘সাহিত্য’ সম্পাদনার কাজ গ্রহণ করে ১৩২৭-এর পৌষ-মাঘ সংখ্যায় ‘সম্পাদকের নিবেদন’ ও ‘মুখবন্ধে’ তিনি লিখেছেন –
“সুরেশচন্দ্র গত ত্রিশ বৎসরে সাহিত্যের যে একটা স্বতন্ত্র ধারার সৃষ্ট করিয়াছিলেন, সে ধারা ও ভাব বজায় রাখিবার জন্য আমরা বিশেষ চেষ্টা করিব। যাহাতে সাহিত্য উচ্চাঙ্গের – উচ্চকোটির মাসিকপত্র ও সমালোচন বলিয়া সমাজে গ্রাহ্য হয়, সে পক্ষে আমার ক্ষুদ্র শক্তি প্রয়োগে ত্রুটি করিব না। ...... আশা আছে, বঙ্গের লেখক সমাজ, সাহিত্যের পুরাতন লেখকগণ আমাদিগকে নানারূপে সাহায্য করিয়া বাধিত করিবেন, এইমাত্র ভিক্ষা।”
‘সাহিত্য’ থেকে অর্জিত অর্থের কিছু অংশ সুরেশচন্দ্রের বিধবা পত্নী ও তার কন্যার সাহায্যার্থেও দান করা হবে, এমন ইচ্ছাও ছিল নতুন সম্পাদকের
...... “বড় বিষম দায়িত্ব ঘাড়ে করিয়া লইয়াছি। একখানি মাসিকপত্রের আয়ের উপর নির্ভর করিয়া সুরেশচন্দ্রের জননী ( পুণ্যশ্লোক বিদ্যাসাগরের কন্যা ) এবং তাঁহার বিধবা পত্নীর প্রতিপালন ভার গ্রহণ করিয়াছি। ...... আমাদের বল-বুদ্ধি-ভরসা বাঙ্গালার বিদ্বজ্জন সমাজ, সাহিত্যের অনুরাগী কাব্যামোদী সকল, তাঁহারা কৃপা না করিলে, পর্য্যাপ্ত অনুকম্পা প্রকাশ না করিলে আমরা এ গুরুভার বহন করিতে সমর্থ হইব না। ......”
‘সাহিত্যে’র প্রকৃতি ও ধারাবাহিকতা সুরেশচন্দ্রের আমলে যেমন ছিল, সেটা বজায় রেখেই পাঁচকড়ি সম্পাদনার কাজ চালিয়েছেন। তার সময়ে ‘বৈঠকী’ নামে একটি বিভাগ যুক্ত হয় পত্রিকায়। এই অংশে সম্পাদক ‘সাহিত্যে’ প্রকাশিত রচনা বা প্রাসঙ্গিক বিষয়ে তার মতামত ও চিন্তাধারা অকপট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। যোগ্যতার অভাব পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল না, কিন্তু তার কিছুটা সংযমের অভাব ছিল। সম্পাদকীয়তে তার অসংযত বক্তব্যকে কেন্দ্র করে তিনি মামলা-মোকদ্দমায় জড়িয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ২৯শে কার্তিক তিনি প্রয়াত হন। ৩৩ বছরেরও বেশি সময় নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সাহিত্যকাশে দীপ্ত ভাবে বিরাজ ক’রে ১৩৩০ বৈশাখ সংখ্যার সঙ্গেই ‘সাহিত্য’ অস্তমিত হয়।
সংযুক্ত প্রতিলিপি –
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।