প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

ডিসেম্বর ৩০, ২০১৬

 

সখা ও সাথী

দীপক সেনগুপ্ত

শিশুসাহিত্যিক ভুবনমোহন রায় সখায় নিয়মিত লিখতেন। ১৩০০ বঙ্গাব্দের বৈশাখে (১৮৯৩-এর মে) তিনি ‘সাথী’ নামে একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ‘সাথী’ চলেছিল মাত্র এক বছর; ১৮৯৩-এর মে থেকে ১৮৯৪-এর এপ্রিল অবধি। স্বল্পস্থায়ী হলেও পত্রিকাটি একটি স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে। সাধারণত নতুন পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে যে ভূমিকা রচিত হয়, ‘সাথী’তে সে রকম কিছু হয় নি, পরিবর্তে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘আবাহন’ নামক কবিতায় উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কবিতাটি ছিল :

“কোথা আছ ভাইটি আমার কোথা আছ বোন,
আয় ছুটে আয় শোনরে এসে “সাথীর আবাহন”।
উপদেষ্টা নয় সে যে ভাই, হাতে নাইক ছড়ি,
নাইক তাহার উচ্চ ধমক - দন্তের কড়মড়ি;
ভা’য়ের মত থাকবে সে যে ধরে হাতে হাতে,
যথায় যাবে তথারবে তোমাদেরি সাথে।
হ’লেও তার দেহখানি ক্ষুদ্র - অতি ক্ষীণ,
সাধ্যমত হিত কথা সে বলবে চিরদিন;
সৎ কাজেতে সহায় হবে যত টুকুন পারে,
মন্দ কাজেতে কাকেও সে যে, যেতে দেবে নারে,
বিপথেতে যে চায় যেতে ধরবে হাতে তার,
বলবে ও ভাই সেথা যেতে পাবে নাক আর;
বলবে তারে সুখের তরে, মন্দ হতে (কি) আছে?
আমোদ প্রমোদ যাহা চাবে, পাবে ‘সাথী’র কাছে;
সঙ্গে রবে সাথী হবে এই ত তার আশা,
ভালবেসে তোমাদের সে পাবে ভালবাসা।”

অল্পবযসী ছেলেমেয়েদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে সম্পাদক ভুবনমোহন রায়ের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। অন্যান্য লেখা ছাড়াও বিজ্ঞান বিষয়ক বেশ কয়েকটি রচনা প্রকাশিত হয়েছে পাঠকদের বিজ্ঞানমনস্ক করে তুলবার প্রয়াসে। শ্রদ্ধেয় সুবিমল মিশ্রের প্রদত্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক বছরে প্রকাশিত ‘সাথী’র ১২টি সংখ্যায় কবিতা-২৪, গল্প-১২, মহাভারত কথা-১, পৌরাণিকী-১, সাধারণ প্রবন্ধ-৯, বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ-১৩, জীবন কথা-১৮, স্থানিক বিবরণ-৫, সচিত্র নাটিকা-১, ইতিকথা-১, গ্রন্থ সমালোচনা-১, বালকদিগের বিশেষ পৃষ্ঠা-৩ এবং ১টি শোক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৩০০ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় একটি মাত্র গ্রন্থ যোগীন্দ্রনাথ সরকার প্রণীত ‘জ্ঞান মুকুল’-এর প্রশংসাসূচক সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে। পরিবেশিত হয়েছে শম্ভুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও যদুলাল মল্লিকের শোক-সংবাদও। তবে ‘সখা’-র আদলে তৈরি হলেও ‘সাথী’-তে কোনো ধাঁধা চোখে পড়ল না। তবে বিজ্ঞান বিষয়ক কিছু মজার খেলা, যেমন - দ্বিজেন্দ্রনাথ বসুর ‘চোখের ধাঁধা’ (ভাদ্র সংখ্যা) বা ‘মনের কথা বলা’ (অগ্রহায়ণ সংখ্যা) ইত্যাদি কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। দেশী ও বিদেশী খ্যাতনামা ব্যক্তিদের বেশ কিছু জীবনীও বেরিয়েছে। লেখকদের মধ্যে ছিলেন – সম্পাদক ভুবনমোহন রায়, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, ত্রৈলোক্যনাথ সান্যাল, যোগীন্দ্রনাথ বসু, বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, বিজয়কুমার সেন, পণ্ডিত তারাকুমার কবিরত্ন, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, লজ্জাবতী বসু (কুমারী) প্রভৃতি। লেডি ডাক্তার সুশীলা দেবীর ‘উদ্ভিদের কথা’ (ফাল্গুন সংখ্যা) ও অমূল্যচরণ বসুর ‘পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ (ভাদ্র ও আশ্বিন সংখ্যা) উপভোগ্য।

যে সব লেখক ‘সখা’-তে লিখতেন তাদের অনেকেই ‘সাথী’-তেও লিখেছেন। ‘সাথী’র মূল্য ছিল চোদ্দ আনা, ‘সখা’র চেয়ে দু’আনা কম।

সখা ও সাথী

‘সখা’র কথা ইতিপূর্বেই ‘অবসরে’ প্রকাশিত হয়েছে। এটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায় ১৮৯৪ সালের মার্চে। এপ্রিল থেকে ‘সখা’ প্রকাশিত হয় নি। আর ‘সাথী’ চলেছিল ১৮৯৪-এর এপ্রিল পর্যন্ত (চৈত্র, ১৩০০)। ‘সাথী’-র সম্পাদক ভুবনমোহন রায় ছিলেন প্রমোদাচরণ রায়ের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও আত্মীয় স্থানীয়। ‘সখা’-তেও ভুবনমোহন লিখেছেন। প্রমোদাচরণের মৃত্যুর পরেও ভুবনমোহন তাকে ভোলেন নি। ‘সখা’র-র সঙ্গে মিলে গিয়ে এবং ‘সখা’কে অগ্রাধিকার দিয়ে ১৩০১-এর বৈশাখ থেকে প্রকাশিত হতে থাকে ‘সখা ও সাথী। পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ভুবনমোহন লিখেছেন –

“যে বয়সে বড় তাহার সম্মান করিতে হয়। সখা, সাথী অপেক্ষা যে বয়সে বড়ো সুতরাং সখাকে সাথীর সমান করা উচিত। বিশেষ প্রমদাচরণ এদেশে এ প্রকার পত্রিকার প্রবর্ত্তক বলিলে হয়। তাই প্রমদাচরণের সম্মান ও স্মৃতিরক্ষার জন্য এবং তাঁহার প্রতি আমাদের হৃদয়ের গভীর শ্রদ্ধাপ্রীতির নিদর্শন স্বরূপ এই সম্মিলিত পত্রিকার নামকরণে তাঁহার সখার নামই প্রথমে দেওয়া হইল। আমরা আশা করি সাথীর গ্রাহকগণেরও এখন কোন ক্ষোভের কারণ নাই।”

অর্থাৎ ‘সাথী’ দ্বিতীয় বর্ষ থেকে ‘সখা ও সাথী’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে।

তবে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১৩০২-এর শ্রাবণ সংখ্যায় ভুবনমোহন সেন রবীন্দ্রনাথের একটি সচিত্র জীবনী প্রকাশ করেছিলেন। এটিই বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের জীবনী। কবির বয়স তখন ৩৪ বছরের কাছাকাছি। তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন আরো ১৯ বছর পর কিন্তু খ্যাতিমান কবি হিসাবে তখনই তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। জীবনীটির কিছু ত্রুটি তুলে ধরে রবীন্দ্রনাথ একটি পত্র লিখেছিলেন; সেটি ভাদ্র সংখ্যায় ‘রবিবাবুর পত্র’ নামে প্রকাশিত হয়। আশ্বিন সংখ্যায় কবির ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্পটিও চিত্র সহকারে প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের রচনা প্রকাশ করতে বহু পত্রিকা সচেষ্ট হয়েছে, এ নিয়ে কিছু মান অভিমানও হযেছে। কিন্তু ১৩০৩ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের প্রতিভাকে স্বীকৃতি জানিয়ে সাময়িক পত্রের গৌরব বৃদ্ধি করার চেষ্টা নিঃসন্দেহে সম্পাদকের দূরদৃষ্টির পরিচায়ক।

‘সখা ও সাথী’ প্রকাশিত হত প্রথমে ১৭ নং মধুসূদন গুপ্ত লেন থেকে এবং পরে ১৩ ওয়েলিংটন স্ট্রীট থেকে। মুদ্রণ কার্য হত ১৭৬ নং বউবাজারের সাথী প্রেসে কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে। লেখকদের মধ্যে ছিলেন ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, জলধর সেন, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী, জগদানন্দ রায়, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়, মনোমোহন সেন, রাজনারায়ণ বসু, মানকুমারী বসু, সখারাম গণেশ দেউস্কর, দীনেন্দ্র কুমার রায় এবং আরও অনেকে। রবীন্দ্রনাথও পত্রিকাটিতে লেখা প্রকাশ করেছেন। ১৩০২-এর ভাদ্র সংখ্যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শকুন্তলা’ এবং ফাল্গুন সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের ‘নদী’ এবং অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’-এর সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছে।

‘কঙ্কাবতী’র স্রষ্টা ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় এক ঘুষখোর দারোগার চরিত্রকে উপজীব্য করে তিন কিস্তিতে ‘সেকালের কথা’ নামে একটি উপভোগ্য গল্প পরিবেশন করেছেন। দিল্লীর অভিজ্ঞতা নিয়ে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন জলধর সেন। কলকাতা চিড়িয়াখানার প্রথম বাঙালী সুপেরিনটেনডেন্ট রামব্রহ্ম সান্যাল ভারতীয় যাদুঘর নিয়ে সচিত্র প্রবন্ধ রচনা করেছেন। ‘সখা’তেও তিনি নিয়মত লিখেছেন। ঐতিহাসিক প্রবন্ধ লেখক হরিসাধন মুখোপাধ্যায় কয়েকটি কিস্তিতে তার এক সময়ে সাড়া জাগানো গোয়েন্দা কাহিনী ‘আশ্চর্য্য হত্যাকাণ্ড’ লিখেছেন। এ ছাড়াও দীনেন্দ্র কুমার রায়, ইতিহাসবেত্তা রমেশচন্দ্র দত্ত, নরেন্দ্রবালা দেবী, সরযূবালা দেবী প্রমুখ লেখক লেখিকারা তাদের রচনা সম্ভার নিয়ে ‘সখা ও সাথী’কে সমৃদ্ধ করেছেন।

‘সখা ও সাথী’ প্রকাশিত হয়েছিল বৈশাখ ১৩০১ থেকে চৈত্র ১৩০৪ পর্যন্ত। এই চার বছরে অনেক নতুন লেখক এসেছেন। পত্রিকাটি হঠাৎ বন্ধ হল কেন ? অনেক পত্রিকার মত এটির বেলাতেও একই জিনিস ঘটেছে। গ্রাহকরা গৃহীত পত্রিকার মূল্য পরিশোধ করেন নি। ১৩০৩-এর বৈশাখ সংখ্যায় ‘বিশেষ দ্রষ্টব্য’ শিরোনামে সম্পাদকের বিশেষ আবেদন বিজ্ঞাপিত হয়েছে –

“এ বৎসর যাহাতে ‘সখা ও সাথী’ সুচারুরূপে প্রকাশিত হয় তাহার জন্য চেষ্টা করা যাইতেছে। বালকবালিকাদের উপযোগী মনোহর গল্প ও উপন্যাস এবং হাস্যোদ্দীপক কবিতা বেশী পরিমাণে দিবার জন্য চেষ্টা করা যাইতেছে। ... যাহাতে ‘সখা ও সাথী’-র দিন দিন উন্নতি হয় তাহার জন্য আমরা বিশেষ চেষ্টা করিতেছি এবং করিব।

“কিন্তু দুঃখের বিষয় অনেক সময় চেষ্টার ত্রুটি না থাকিলেও যাহা করিব স্থির করি অর্থাভাবে তাহা আমরা করিয়া উঠিতে পারিনা। এখনও অনেক গ্রাহকের নিকট ১৩০১ সালের এবং অধিকাংশ গ্রাহকগণের নিকট ১৩০২ সালের মূল্য পাওনা আছে। গ্রাহকবর্গের নিকট বিশেষ অনুরোধ তাহারা স্বীয় স্বীয় দেয় মূল্য এবং ১৩০৩ সালের অগ্রিম মূল্য পাঠাইয়া বাধিত করিবেন।”

অবশ্যই গ্রাহকেরা এই আবেদনে কর্ণপাত করেন নি এবং এর দুঃখজনক পরিণতিতে ‘সখা ও সাথী’ চিরকালের জন্য বিদায় গ্রহণ করে।

যাই হোক, শিশুচিত্ত জয় করার এবং তাদের মনের বিকাশ ও জ্ঞানের প্রসারতা বৃদ্ধির সঙ্কল্পে ব্রতী প্রমদাচরণ ও ভুবনমোহনের প্রচেষ্টা বাংলার শিশুসাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।




চিত্র – ১ : এখানে ‘সাথী’র প্রথম সংখ্যার আখ্যাপত্রের একটি প্রতিলিপি দেওয়া হল।


লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।