প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র: সংবাদ প্রভাকর(সূচী)

       সেকালের একটি উল্লেখযোগ্য সংবাদপত্র ছিল ‘সংবাদ প্রভাকর’। বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা ও সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে জনসাধারণকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার ক্ষেত্রে পত্রিকাটির ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৩১ সালের ২৮শে জানুয়ারী ( ১৬ই মাঘ ১২৩৭ বঙ্গাব্দ, শুক্রবার ) কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক হিসাবে ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির শিরোভাগে সংস্কৃত কলেজের অলঙ্কার শাস্ত্রের অধ্যাপক পণ্ডিত প্রেমচাঁদ তর্কবাগীশের রচিত দুটি সংস্কৃত শ্লোক থাকত। পাথুরিয়াঘাটার যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুর ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের বন্ধু ও তার কবিতার গুণগ্রাহী । তারই উৎসাহে এবং অর্থসাহায্যে চোরবাগানের একটি মুদ্রাযন্ত্রে মুদ্রিত হয়ে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর প্রথম আত্মপ্রকাশ। পরে ঠাকুরবাড়িতেই পত্রিকাটির জন্য একটি মুদ্রাযন্ত্র স্থাপিত হয় ১২৩৮ সালের শ্রাবণ মাসে। পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক ব্যক্তি । ‘সংবাদ প্রভাকর’ শুধু পাঠক সমাজকে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা নয, নতুন লেখক গোষ্ঠি গড়ে তুলতেও পত্রিকাটির ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ ; এদের মধ্যে ছিলেন : অক্ষয়কুমার দত্ত, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌরীশঙ্কর তর্কবাগীশ, গোপালকৃষ্ণ মিত্র, ধর্মদাস পালিত, হরিমোহন সেন, শম্ভুনাথ পণ্ডিত প্রমুখেরা । সমাজের যে সব গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং সেকালের প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা প্রকাশিত হত তাদের কয়েকজন হলেন : প্রসন্নকুমার ঠাকুর, হরকুমার ঠাকুর, কৃষ্ণচন্দ্র বসু, রাধাকন্ত দেব, জয়গোপাল তর্কালঙ্কার।

      ‘সংবাদ প্রভাকর’ যে জনপ্রিয় হযেছিল তার কারণ সমসাময়িক কালে প্রকাশিত অন্যান্য পত্রিকাগুলিতে যে বিষয়ে এবং যে ভাষায় লেখা প্রকাশ করা হত তার মধ্যে পারস্পরিক বাদানুবাদ সম্বলিত লেখা বাদ দিয়ে অধিকাংশই সাধারণ পাঠকদের সন্তুষ্ট করতে অপারগ ছিল । ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর ভাষা ও বিষয়বস্তু ছিল তুলনামূলক ভাবে প্রাঞ্জল ও মনোগ্রাহী । ১২৫৯ সালের ২রা চৈত্রের পত্রিকায় সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি চিত্তাকর্ষক ঘোষণা প্রকাশিত হয়েছিল । সেটি হল : “হিন্দু কলেজের সুপাত্র ছাত্র শ্রীযুক্ত দীনবন্ধু মিত্র, হুগলি কালেজের ছাত্র শ্রীযুক্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কৃষ্ণনগর কলেজের ছাত্র শ্রীযুক্ত দ্বারকানাথ অধিকারী এই ছাত্রত্রয়ের বিরচিত গদ্য পদ্য পরিপূরিত তিনটি প্রবন্ধ আমরা প্রাপ্ত হইয়াছি, এই সকল রচনার কিছুমাত্র পরিবর্ত্তন ও সংশোধন না করিয়া অবিকল প্রকাশ করনে প্রবৃত্ত হইলাম। আমাদের সহযোগীগণ এবং গুণগ্রাহক গ্রাহকগণ বিশেষাভিনিবেশপূর্ব্বক দৃষ্টি করিয়া যাঁহার রচনা যেরূপে ও যেভাবে উৎকৃষ্ট বোধ করিবেক, তাঁহাকে সেইরূপে সেইভাবে পুরস্কৃত করিবেন । আমরা এ বিষয়ে অগ্রে কোনো কথাই উল্লেখ করিব না।”

       ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর একটি আকর্ষণীয় উপাদান ছিল এতে প্রকাশিত কবিতা । এ ছাড়াও জনমত গঠনের পক্ষে পত্রিকাটির একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল ; শিক্ষা,অর্থনৈতিক সংস্কার ও নগরোন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে প্রকাশিত লেখা জনমানসে যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল । পত্রিকাটি নিয়মিত বিষয় নিয়ে লেখা ছাড়াও মানুষের নিপীড়ন ও দুর্দশার কথাও তুলে ধরত । সেকালের নীলকরদের অত্যাচার সর্বজনবিদিত । ১২৫৮ সালের ২৩শে ফাল্গুনের পত্রিকাটিতে প্রকাশিত একটি খবর : “দুঃখি কৃষাণরা অতিশয় যন্ত্রণা না পাইলে কদাচ এতদূর পর্য্যন্ত আদ্দাস কারণে সাহস বিশিষ্ট হইত না।”

        ১২৩৯ সালে যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুর পরলোক গমন করেন। ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছেন – “সুতরাং ঐ মহাত্মার লোকান্তর গমনে আমরা অপর্যাপ্ত শোক সাগরে নিমগ্ন হইয়া এককালীন সাহস ও অনুরাগ শূণ্য হইলাম। তাহাতে প্রভাকরের অনাদররূপ মেঘাচ্ছন্ন হওন জন্য এই প্রভাকর কর প্রচ্ছন্ন করিয়া কিছুদিন গুপ্তভাবে গুপ্ত হইলেন।” ১৮৩২ সালের ২৫শে মে (১৩ই জৈষ্ঠ্য, ১২৩৯ বঙ্গাব্দ ) ৬৯টি সংখ্যা প্রকাশের পর ‘সংবাদ প্রভাকর’ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

        এর চার বছর পরে ১৮৩৬ সালের ১০ই আগস্ট (২৭শে শ্রাবণ, ১২৪৩ বঙ্গাব্দ ) ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশিত হয় বারত্রয়িকরূপে অর্থাৎ সপ্তাহে তিনদিন এটি প্রকাশিত হত। এর প্রায় তিন বছর পরে ১৮৩৯ সালের ১৪ই জুন (১লা আষাঢ়, ১২৪৬ বঙ্গাব্দ ) পত্রিকাটি দৈনিক হিসাবে প্রকাশিত হতে থাকে । ‘সংবাদ প্রভাকর’-ই বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র । পত্রিকাটি যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হযেছিল এবং পাঠকমহলে আলোড়ন তুলেছিল তাতে সন্দেহ নেই । বেশ কিছু কবিতাও প্রকাশিত হত নিয়মিত । শিবনাথ শাস্ত্রীর লেখা থেকে জানা যায় : “প্রভাকর-এর কবিতা পড়িবার জন্য বাংলাদেশের লোক পাগল হইয়া উঠিল । প্রভাকর বাহির হইলে বিক্রেতাগণ রাস্তার মোড়ে দাঁড়াইয়া ঐ সকল কবিতা পাঠ করিত এবং দেখিতে দেখিতে কত কাগজ বিক্রয় হইয়া যাইত ।”

       নমুনা হিসাবে ১২৬৩ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি পদ্য এখানে তুলে দিচ্ছি। পদ্যটির নাম ‘প্রণয়’।

“ এসো এসো এসো প্রাণ, বোসো এইখানে।
‘ভাল আছি’ বল মুখে, শুনি তাই কাণে।।
ভাল ভাল, ভালোবাসো নাবাসো আমায়।
তুমি যদি ভাল থাক, ভাল থাকি তায়।।
ভাবেতে জানায় যেন, ভালবাস কত।
কেমন সে ভাব তব, হব অবগত।।
ফলেতে কিরূপে তুমি, লুকাবে স্বভাব।
ভাবেতেই বুঝা যায়, ভিতরের ভাব।।
অন্তর হয়েছ তুমি, অন্তরেতে থেকে।
সকলি বুঝিতে পারি, মুখখানি দেখে।।
হাসি হাসি মুখখানি, তাহে কত ঠাট।
হাসির ভিতরে আছে, ফাঁসির কপাট।।
আছ তুমি যদি সেই, প্রেম ছাঁদ ছেদে।
থেকে থেকে, দেখে কেন, প্রাণ উঠে কেঁদে।।
রাখিব তোমায় আর, কেমন করিয়া।
বোধ হয় উড়ে যাবে, শিকল কাটিয়া।।
এত কোরে পুষিলাম, না মানিলে পোষ।
জানিলাম, সে আমার কপালের দোষ।।”

     শোভাবাজারের মহারাজা কমলকৃষ্ণ দেব কবি ঈশ্বরচন্দ্রের গুপ্তের এতটাই গুণমুগ্ধ ছিলেন যে তিনি ঈশ্বরচন্দ্রকে খড়দহে একটা বাগানবাড়ি উপহার দিয়েছিলেন। ‘প্রভাকর’ সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল, তিনি সেকালের বহু কবির পরিচয় পত্রিকার পাতায় লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন। না হলে এরা হয়ত বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যেতেন। এই সব কবিদের মধ্যে রয়েছেন –রামপ্রসাদ সেন, নিধুবাবু ( রামনিধি গুপ্ত ), নিত্যানন্দ দাস বৈরাগী, কেষ্টা মুচী, লালু নন্দলাল, হরু ঠাকুর প্রভৃতি।

      ‘সংবাদ প্রভাকরে’র ১৯ বৎসর পুর্তি উপলক্ষে সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত নিম্নলিখিত প্রাসঙ্গিক খবরটি পত্রিকায় ছেপেছেন –

“ অদ্য আমারদিগের এই পত্রের বয়ঃক্রম ১৯ বৎসর অতীত হইল। বাঙ্গালা ১২৩৭ সালের ১৬ই মাঘ শুক্রবার দিবসে ইহার জন্ম হয়, তৎকালীন শুদ্ধ সপ্তাহে একবার করিয়া প্রকাশ হইত, পরে ১২৪৩ সালের ২৭শে শ্রাবণ বুধবার অবধি ৪৬ সালের ৩০শে জ্যৈষ্ঠ পর্য্যন্ত ক্রমশঃ কয়েক বৎসর বারত্রয়িক রূপে প্রকটিত হইয়া তৎপর দিবসে অর্থাৎ ঐ শকের ১লা আষাঢ় অবধি অদ্য দিবস পর্য্যন্ত যথানিয়মে প্রাত্যহিকরূপে উদিত হইতেছে। যে সকল মাহাশয়েরা মৎপ্রণীত প্রভাকর পত্রের চিরস্থায়িত্ব, উন্নতি এবং সম্মান বৃদ্ধির নিমিত্ত সর্ব্বতোভাবে যত্ন ও সাহায্য করিয়াছেন, আমি যাবজ্জীবন তাহারদিগের নিকট উপকার ঋণে বদ্ধ থাকিয়া কৃতজ্ঞতা প্রকাশে বাধ্য হইব।”

      ‘সংবাদ প্রভাকরে’র একটি আকর্ষণীয় ‘ফীচার’ ছিল বাৎসরিক ক্রোড়পত্র। প্রতি বছর ১লা বৈশাখের পত্রিকায় পূর্ববর্তী বছরের প্রতি মাসের খবরের চুম্বক এই বিভাগে প্রকাশিত হত। এটিতে চোখ বুলালে সে বছরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ঘটনার সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যেত। এটি আকর্ষণীয় হবে মনে করে ১২৬১ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখ বৃহস্পতিবারের ( ১৩ই এপ্রিল ১৮৫৪ ) পত্রিকায় প্রকাশিত “ ১২৬০ সালের সমস্ত ঘটনার সংক্ষেপ বিবরণ ” থেকে প্রতি মাসের মাত্র কয়েকটি সংবাদ এখানে উধৃত করা হল। মূল বানান অবিকৃত রাখা হয়েছে।

        বৈশাখ :

     একৌন্টেন্ট জেনরল মেং লেসিংটন সাহেব এমত চমৎকার নিয়ম প্রকাশ করেন যে অফিসের মধ্যে যিনি সংবাদপত্র পাঠ করিবেন তাঁহার ৫০ টাকা দণ্ড হইবেক। ----- গোয়ালিয়ার একদল সেনা বেতন চাহিবায় তথাকার মহারাজ গোলাঘাতে তাহারদিগের অনেকের প্রাণ নাশ করেন। ----- এতন্নগরে রামগোপাল মল্লিকের ভবনে হিন্দুগণ “হিন্দু মেট্রোপলিটন কালেজ” স্থাপন করেন, তাহার সহিত “শীলস ফ্রি কালেজ” এবং “ডেবিড হেয়ার একাডিমি” সংযুক্ত হয়। ----- “বিদ্যাদর্পণ” নামে একখানা মাসিক পত্র প্রিয়মাধব বসু কর্ত্তৃক প্রকাশিত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ----- একজন পঞ্চাবী গবরনর জেনরেলের গাড়ি ধরিয়া আপনার দুঃখ জানাইতেছিল এই দোষে সে ১৫ টাকা দণ্ড দিয়া এক মাস কারাবাস করে। ----- রসরাজের নামধারী সম্পাদক গঙ্গাধর ভট্টাচার্য্য পরলোক গমন করেন। ----- নকাসীপাড়ার জমিদার কেশবচন্দ্র রায় প্রজাপীড়ন দোষে ছয় মাস কারাবাস করেন। ----- এক জন দুঃখী পথিক ২৭০০ টাকার নোট পথে পাইয়া পুলিসে দেওয়াতে তাহার চতুর্থাংশ পারিতোষিক পাইয়াছে। ----- দুঃখিনী বিধবা ও পালকহীন বালক বালিকাদিগের গ্রাসাচ্ছাদন জন্য আগরপাড়ায় এক সভা স্থাপিত হইয়া চাঁদার দ্বারা ধন সংগৃহীত হয়।

        জ্যৈষ্ঠ :

     আসাম দেশে স্বর্ণখনি আছে এমত জনরব হয়। ----- জলাভাবে সর্ব্বত্র হাহাকার শব্দ উঠে। ----- ইংলন্ডেশ্বরীর জন্মতিথিতে গবর্ণমেন্ট হৌসে ধূম ধাম হয়। ----- ব্রহ্মদেশে অনেক সাহেব ও বাবু লোকেরা মগাই স্ত্রী ক্রয় করত প্রেমদাসী ও সেবাদাসী করিয়াছেন। ----- কলিকাতার পূর্ব্বভাগে এক নূতন খাল খনন হইতেছে তাহার সহিত বেলিয়াঘাটার খালের সংযোগ হইবেক। ----- কলিকাতার এক কামার বাবু স্বীয় বিধবা কন্যার বিবাহ দেবার জন্য গুরুতর আরম্বড় করিয়া কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। ----- হুগলির এমামবাটির নিমিত্ত ১০০০০ টাকায় বৃহদ্ঘন্টা ক্রীত হয়। চারি ক্রোশ পথ হইতে ঐ ঘন্টার ধ্বণি শুনা যায় এবং তাহার ছিদ্রের ভিতর অনায়াসেই দুই জন মনুষ্য একত্রে প্রবেশ করিতে পারে।

         আষাঢ়

     চীন দেশ হইতে রাজবিদ্রোহিতার ভয়ানক সংবাদ আইসে। ----- লেডী ডেলহৌসির মৃত্যু সংবাদ আইসে। ----- সর্ব্বত্রই ওলাউঠা রোগে বহু মনুষ্য হত হয়। ----- খিদিরপুরের নিকট মুদিয়ালী গ্রামে এক ইংরাজী স্কুল স্থাপিত হইয়াছে। ----- বাংলা ভাষা আলোচনার জন্য টাকী নামক গ্রাম এক সভা স্থাপিত হইয়াছে। ----- ঠগীরা কাশীর রাস্তায় এক ভয়ানক দস্যুতা করে। ----- ভাওয়ালপুরের নবাব নিজ মন্ত্রীর প্রাণ নাশ করেন। ----- বাবু রামচন্দ্র মিত্র হিন্দু কালেজের কালেজ ডিপার্টমেন্টের “বাঙ্গালা প্রফেসর” হইয়াছেন। ----- শোণ নদের বক্ষের উপর ২০০ ফিট লম্বা এক সেতু নির্ম্মিত হইতেছে।      

        শ্রাবণ

     শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথ দেবের নবযৌবন দিবসে অধিক যাত্রীর সমারোহ হওয়াতে ভিড়ে ২১ জনের প্রাণ নাশ হয়। ----- বিলাতে আক্সফোর্ড কালেজের সংস্কৃত সাহিত্যের অধ্যাপক ডাক্তার উইলসন সাহেব লোকান্তরিত হয়েন। ----- কলিকাতা পুলিসের সুপারিণ্টেণ্ডেন্টদিগের মাসিক বেতন ৩০০ টাকা নির্দিষ্ট হয়। ----- চট্টগ্রামে অতিরিক্ত নয় লক্ষ মোন লবণ প্রস্তুত করণের অনুমতি হয়। ----- সিরাজ ও স্পাহিনী নগরে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হওয়াতে বহুসংখ্যক ইষ্টকালয় পতিত হয় এবং ১৫০০০ মনুষ্য হত হয়।

         ভাদ্র

     “উইকলি ক্রনিকেল” পত্র খানি আঁতুড়ে প্রাণত্যাগ করিয়াছে। ----- মিসনেরি সাহেবরা শান্তিপুরে এক বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছেন। ----- বাঙ্গালা ভাষার অনুশীলনার্থ জনাই গ্রামে এক সভা স্থাপিত হয়। ----- মাজিষ্ট্রেট মেং ডামন্ড সাহেব ডাক্তার হাববরকে “একগুঁয়ে” বলাতে জরিমানা দেন এবং উচ্চপদ হইতে নিম্নপদে নিযুক্ত হয়েন।

          আশ্বিন

     বিলাত হইতে বাঙ্গাল-ব্যাঙ্কে নূতন রকম নোট আইসে। ----- বড়কর্ত্তা সাহেব ভারতবর্ষের সর্ব্বত্রে রেইলরোড নির্ম্মাণের অনুষ্ঠান করেন। ----- গবর্ণমেন্টের বিদ্যালয়স্থ সমুদয় শিক্ষক ও কর্ম্মকারদিগের পেন্সিয়ান পাইবার নিয়ম নির্দ্দিষ্ট হয়, তন্মধ্যে প্রফেসর এবং প্রধান শিক্ষকেরা ২২ বৎসর কর্ম্ম করিলেই বেতনের অর্দ্ধেক বৃত্তি পাইবেন। ----- আমেরিকা হইতে কয়েকটা সেলাইয়ের কল আইসে। ----- বিধবার বিবাহ বিষয়ে পন্ডিতেরা অনেক বিচার করেন। ----- চীনের অত্যাচারিরা পিকিনের নিকটিস্থ এক প্রধান নগর অধিকার করে। ----- আসামে এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়। ----- দামোদরের জল প্লাবনে জামালপুর প্রভৃতি গ্রাম উচ্ছন্ন যায়।

         কার্ত্তিক

     নিবাধই গ্রামের বালক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রকাশ্য পরীক্ষা ও পারিতোষিক প্রদানের কার্য্য নির্ব্বাহ হয়। ----- চীন দেশের রাজ বিরোধী দল সকল যুদ্ধেই জয় লাভ করত পিকিন প্রভৃতি দেশ হস্তগত করে। ----- আবদুল্লা নামক যবন কর্ণেল লেকিসন সাহেবকে হত করায় পেসোয়ারের রাজকর্মাচারী মাত্রেই অত্যন্ত ভীত হয়েন। ----- মহরমের সময়ে আলিগড়ের হিন্দু মুসলমানে ঘোরতর বিবাদ উপলক্ষ্যে উভয় পক্ষে ৪০ জন হত হয়, শান্তিরক্ষক সে বিষয়ে শান্তি রক্ষা করিতে পারেন নাই। ----- বিলাতে উত্তমরূপে শস্য না হওয়াতে আষ্ট্রিয়া, প্রুসিয়া, ডেনমার্ক এবং ফ্রান্সের কর্ত্তারা স্ব স্ব রাজ্য-জাত-দ্রব্য বিদেশে প্রেরণে নিষেধ করেন। ----- এমত প্রকাশ যে “হিন্দু কালেজ” নাম উঠিয়া “ইউনিবর্ষিটি” নাম হইবে, এবং জুনিয়ার সিনিয়ার দুই অংশে বিভক্ত হইয়া জুনিয়ার অংশে কেবল হিন্দু ও সিনিয়ার অংশে সকল ধর্ম্মাক্রান্ত ছাত্র অধ্যয়ন করিবে। ------ ডারজিলিঙ্গে এবং দিনাজপুরে স্কুল হওনের প্রস্তাব হয়। ----- গ্যাস্পর নামক ইংরাজ প্রতারণা পূর্ব্বক কতিপয় দোকান হইতে দ্রব্য লওনের অপরাধে সাত বৎসরের জন্য দ্বীপান্তরিত হয়েন। ----- রঙ্গপুরের নিকটস্থ কোন ব্রাহ্মণ “আমার মৃত্যুর আর অপেক্ষা নাই” স্ত্রীকে এই কথা বলিয়া শয়ন করিলেন এবং তাঁহার স্ত্রী তৎক্ষণাৎ তাঁহার পার্শ্বে শয়ন করত একত্রে উভয়েই প্রাণত্যাগ করিলেন। ----- পুলিস হইতে এমত ঘোষণা হয় যে সকল বাটীর ৭০ টাকা মাসিক ভাড়া তাহার অধ্যক্ষেরা বাটীর বহির্দ্বারে ভালরূপে আল না দিলে তাঁহারদিগের নামে নালিস হইবে। ----- দিল্লী নগরে ১৫ ব্যক্তি ধৃত হয়, তন্মধ্যে ৪ জন ছদ্মবেশী রুসিয়ান বণিক, গবর্ণমেন্ট তাহারদিগ্যে গুপ্তচর জ্ঞান করিয়াছেন। ----- “ছোট জাগুলিয়া হিতৈষী মাসিক পত্রিকা” নামে এক পত্রিকা প্রকাশ হয়। ----- বহরমপুরে নূতন কালেজ স্থাপিত হয়। -----কোচবেহারের নিকটস্থ পর্ব্বতীয় লোকেরা নীচে আসিয়া অত্যন্ত অত্যাচার করে। ----- শ্যামা প্রতিমা বিসর্জ্জনের সময়ে পুলিসের লোকেরা ঢাকি ঢুলির উপরেও অত্যাচার করিয়াছিল। ----- ডাক্তার ওসানগনসী বিলাত হইতে আসিয়া ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফের বিষয়ে অত্যন্ত মনোযোগী হইয়াছেন। ----- ইন্দরের রাজবাটী হইতে রেসিডেন্টের বাটী পর্য্যন্ত ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ নির্ম্মিত হইবায় উভয় স্থানের ঘটনা উভয় স্থানেই তৎক্ষণাৎ প্রকাশ হইতেছে। ----- রুসিয়ার সেনারা কাবেলের নিকট “খাইবা” নামক স্থানে আগমন করে। ----- সরস্বতীর তীর হইতে বরাকর নদ পর্য্যন্ত বড় রাস্তার মেরামত জন্য রাজ-কোষ হইতে ১৩০০০ টাকা প্রদত্ত হয়।

        অগ্রহায়ণ

     জনৈক সম্ভ্রান্ত রুসিয়ান কলিকাতায় আসিয়া ভরতবর্ষ ভ্রমণের মানস করাতে গবর্ণমেন্ট তাহাতে অসন্তুষ্ট হয়েন। -----কূলপি হইতে সাগর পর্য্যন্ত ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ নির্ম্মাণের আদেশ হয়। -----হুগলী কালেজের ছাত্রেরা একজন চিকিৎসকের প্রার্থনা করেন। ----- যশোহরের কলমকালী গ্রামে এক ইংরাজী বিদ্যালয় স্থাপিত হইয়াছে। ----- ফরাসিরা ডাক্তারখানার নিমিত্ত ফরাসডাঙ্গায় এক বৃহৎ অট্টালিকা নির্ম্মাণ করিয়াছেন। ----- ছোট আদালত ১৫ ডিসেম্বর অবধি ২ জানুআরি পর্য্যন্ত বন্ধ ছিল, গ্রীষ্মকালেও ঐরূপ কয়েকদিন বন্ধ থাকিবে। ----- ওরিয়েন্টল ব্যাঙ্ক হইতে ১২ পরসেন্ট হিসাবে ডেবিডেন্ট দেওয়া হয়। ----- প্রিন্স গোলাম মহম্মাদ ৪০০০ দরিদ্রকে শীত-বস্ত্র সহিত অর্দ্ধমুদ্রা দান করেন। ----- বাবু নীলরত্ন হালদার মহাশয় “শ্রুতিগান-রত্ন” নামে এক প্রকৃষ্ট পুস্তক প্রকাশ করেন। ------ “পাষণ্ডদলন” নামে এক অর্দ্ধ-সাপ্তাহিক সংবাদ পত্র কয়েকবার প্রকাশ হইয়াই প্রাণত্যাগ করে। ----- মক্কার মোল্লা তুর্কীশ্বরকে এমত পত্র লেখেন যে রুসিয়ার সহিত যুদ্ধ হইলে তিনি তাঁহার সাহায্যার্থে ১০০০০০ আরব সৈন্য প্রেরণ করিবেন। ----- কাপ্তেন ওটান সাহেব মরণকালে উইল দ্বারা ৩২০০০০ টাকা দান করিয়া যান, তাহার অর্দ্ধাংশ দারা মান্দ্রাজে এক নূতন বিদ্যালয় স্থাপিত হইবে এবং অর্দ্ধাংশ পেরিন্টেকল একাডিমির অধ্যক্ষেরা পাইবেন।

         পৌষ

     ডেনমার্কের কোন মন্ত্রী ভারতবর্ষের বিবরণ জানিবার জন্য মান্দ্রাজে আগমন করেন। ----- অম্বলায় এক মেডিকেল কালেজ স্থাপনের প্রস্তাব হয়। ----- যিনি বঙ্গদেশের লেপটেনেন্ট গবরণর হইবেন তিনি বৎসরে ৮০০০০ টাকা বেতন পাইবে। ----- বাবু হরচন্দ্র ঘোষ বঙ্গভাষায় “ভানুমতী চিন্তাবিলাস” নামে এক নূতন নাটক প্রকাশ করেন। ----- খিলাতের রাজমন্ত্রী মহম্মদ হোসেন প্রজা কর্ত্তৃক হত হয়েন। ----- বাবু মতিলাল শীল “শীলস ফ্রি কালেজের বাটীতে” হমিওপেথি ডাক্তারখানা স্থাপনের আদেশ করিয়াছেন। ----- মেং কাইট সাহেব বোম্বেনগরে বেলুনে উড়িয়া সমুদ্রে পড়িয়া রক্ষা পাইয়াছেন, গবর্ণমেন্ট তাঁহাকে ব্রিটিসাধিকারের কোন স্থানে আর উড়িতে দিবেন না। ----- এমত জনরব, দিল্লীর বর্ত্তমান বাদসাহ লোকান্তরিত হইলে তাঁহার উত্তরাধিকারিরা ভবিষ্যতে “বাদসাহ” উপাধি প্রাপ্ত হইবেন না এবং তাঁহারদিগের বার্ষিক বৃত্তি ন্যূন হইবে। ----- মিলেটারি বোর্ডের কেরাণী ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ডাকাইতি করণাপরাধে ১৪ বৎসরের জন্য শৃঙ্ক্ষল সহিত কারারুদ্ধ হইয়াছে, তাহার সঙ্গীরা কেহ ৭ কেহ ১০ বৎসরের জন্য কয়েদ হইয়াছে। ----- দক্ষিণেশ্বরের কোন চক্রবর্তী ব্রাহ্মণ কুলীন কন্যা বলিয়া বলপূর্ব্বক এক যবন কন্যার সহিত আপন পুত্রের বিবাহ দেন। -----সংস্কৃত কালেজের সেক্রটরি বিদ্যাসাগর বিদ্যাসাগরের ১৫০ হইতে ৩০০ টাকা বেতন হইয়াছে। -----কোন এক ব্যক্তি একটি পালিত বানর লইয়া সোলপুরের পথে গমন করেন, দস্যুরা পথে তাঁহার প্রাণ নাশ করত শব গোপন করিয়া অর্থ লইয়া প্রস্থান করে, ঐ মৃত ব্যক্তির বানর বৃক্ষাবলম্বন পূর্ব্বক সেই সব দস্যুদলের বাটী দেখিয়া থানায় আসিয়া কাতরতা প্রকাশ করাতে দারোগা তাঁহার সঙ্গে লোক দেন, কপি সেই পুলিসের লোককে শব ও হন্তাদিগ্যে দেখাইয়া দেয়, দুরাত্মারা ধৃত হইয়া হত্যার ব্যাপারে স্বীকার করে, আমার বিবেচনায় ঐ বাদর বাহাদুরকে ডেম্পিয়ার সাহেবের পরিবর্ত্তে প্রদেশীয় পুলিসের সুপ্রেণ্টেডেন্টী পদে নিযুক্ত করাই কর্ত্তব্য ছিল। -----ডাকাইতি দমনীয় কামিসনারের সহিত এমত অনুমতি হয় যে তিনি গোয়েন্দার কথা শুনিয়া হঠাৎ যেন ভদ্রলোকের অপমান না করেন, শমন দিয়া আহ্বান করত ভদ্রতারূপে বিচার করিবেন। ----- ইচ্ছাপুরের বারুদখানার জাঁতা ফাটিয়া ছাদ উড়িয়া যাওয়াতে কয়েকজন আহত ও বিপর্জ্জয় শব্দে দুই জন একেবারে বধির হইয়াছে। ----- নূতন চার্টরের বিধিক্রমে যিনি বঙ্গদেশের গবর্ণর হইবেন, তিনি পাঁচ বৎসরের অধিক কাল থাকিতে পারিবেন না।

         মাঘ

     রাধামাধব মিত্র কর্ত্তৃক এক আনা মূল্যে “রসার্ণব” নামে এক মাসিক পুস্তক প্রকাশ পায়। ----- বাবু তারাচাঁদ চক্রবর্ত্তী মহাশয় যতকাল সজীব থাকিবেন ততকাল বর্দ্ধমানেশ্বর তাঁহাকে ১০০ মুদ্রা মাসিক বৃত্তি প্রদান করিবেন। ----- কৃষ্ণনগরের প্রজারা মৃত জর্জ ব্রোণ সাহেবের স্মরণীয় চিহ্ন স্থাপন জন্য “ব্রোণ দীঘী” নামক এক সরোবর খনন করণের প্রস্তাব করেন। ----- হিন্দু কালেজের হিন্দু মেম্বরদিগের ক্ষমতা অবসান হওয়াতে প্রাতঃস্মরণীয় রসময় দত্ত বাবু এজুকেসন কাউনসেলের একজন মেম্বর হইয়াছেন। ----- ফোর্ট উইলিয়ম কালেজ একেবারে উঠিয়া দিবার অনুমতি হয়। ----- বহরমপুর কালেজের ব্যয় নির্ব্বাহ নিমিত্ত গবর্ণমেন্ট বার্ষিক ২০০০০ মুদ্রা প্রদানে সম্মত হয়েন এবং আর ২০০০০ টাকা চাঁদার দ্বারা সংগৃহীত হইবেক। ----- হাবড়া অবধি বালিরখাল পর্য্যন্ত গঙ্গাতীরস্থ প্রজাদিগকে গবর্ণমেন্ট আপনাপন বাটীতে নূতন গৃহাদি নির্মাণ করণের নিষেধ করেন, ইহার কারণ বোধ হয় এই ঐ সকল স্থান রেইল রোডের জন্য বা সরকারি কার্য্যের নিমিত্ত ব্যবহৃত হইবেক। ----- কোর্ট অফ ডিরেক্টর্সেরা মৃত মহাত্মা বেথুন সাহেবের স্থাপিত কলিকাতাস্থ বালিকা-বিদ্যালয়ের সকল ব্যয় প্রদানে সম্মত হইয়াছেন, এবং লার্ড ডেলহৌসি এমত ব্যক্ত করিয়াছেন যে তিনি যে পর্য্যন্ত ভারতবর্ষে থাকিবেন সে পর্য্যন্ত তাহার সমুদয় ব্যয় স্বয়ং নির্ব্বাহ করিবেন।

          ফালগুন

     যোড়াসাঁকো নিবাসি গূণরাশি পরম ধার্ম্মিক জ্ঞানিবর স্রীযুত বাবু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের সর্ব্বানুজ শ্রীমান বাবু নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের শুভ বিবাহ কার্য্য অতি সমারোহ পূর্ব্বক গত ৩ ফালগুন তারিখে নির্ব্বাহ হইয়াছে। -----বিখ্যাত গায়িকা হীরা বাই সাঙ্ঘাতিক জ্বর রোগে আক্রান্ত হইয়া পরলোকগতা হইয়াছেন। ----- চোরাবাগান নিবাসি বাবু আনন্দচন্দ্র সেন মহাশয় জ্বর রোগাক্রান্ত হইয়া মানব-লীলা সম্বরণ করিয়াছেন। ----- যোড়াসাঁকো নিবাসি বাবু প্রাণকৃষ্ণ মল্লিক মহাশয় নিদারুণ কাশরোগ কর্ত্তৃক আক্রান্ত হইয়া পরলোক গমন করিয়াছেন। -----রেইল রোডের নিমিত্তে কয়েকখানি বাষ্পীয় শকট বিলাত হইতে এখানে আসিয়াছে। ----- শ্রীযুক্ত প্রিন্স গোলাম মহম্মদ বিলাত গমন করিবার পূর্ব্বে রসাপাগলার মসজিদ গৃহে ৪০০০ টাকা দীন দরিদ্র ব্যক্তিগণকে বিতরণ করিয়াছেন। ----রেঙ্গুণের পত্রে ব্যক্ত করে যে ব্রহ্মদেশের যুদ্ধ অনল পুনর্ব্বার প্রজ্বলিত হইবেক, রাজভ্রাতা বহু সৈন্য সংগ্রহ করিয়াছেন। ----- “সংবাদ দীনকর” নামক এক অভিনব সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বাবু কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্ত্তৃক প্রকাশিত হইয়াছে, ইহার মাসিক মূল্য চার আনা মাত্র। ----- বিলাত হইতে যে সংবাদ আসিয়াছে তাহাতে ব্যক্ত করে যে রুসিয়ান ও তুর্কিদিগের মধ্যে তুমুল সংগ্রাম বাধিয়াছে, উভয় পক্ষে বিস্তর হতাহত হইয়াছে, সাইনোপের যুদ্ধে তুর্কিরা সম্পূর্ণরূপে পরাজয় হয়। -----রেবরেন্ড বিলু সাহেবের সহাধর্ম্মিণী রাজপুর বোয়ালিয়ার সহকারী মাজিষ্ট্রেট অনরবিল ইডেন্স নামা নবীন পুরুষের সঙ্গে প্রণয় প্রসঙ্গে ধৃত হওয়াতে সুপ্রিমকোর্টে সেই ব্যভিচার দোষ ঘটিত মোকদ্দমা উপস্থিত হইয়াছিল, তাহাতে প্রধান বিচারপতি প্রতিবাদির ১৫০০০ টাকা দণ্ড করিয়াছেন। ----- যোড়াসাঁকো নিবাসি বিদ্যানুরাগি বহুগুণান্বিত শ্রীযুত বাবু নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় কষ্টম অফিসের আসিষ্টান্ট কালেকটরের পদে অভিষিক্ত হইয়াছেন। ----- দুর্জ্জন তস্করেরা সিন্দূরিয়াপটি নিবাসি বাবু কাশীনাথ মল্লিক মহাশয়ের বাটীর ছাদ ভেদ করত ঘরে প্রবেশ করিয়া ৬০।৭০ হাজার টাকার বহুমূল্য দ্রব্য হরণ পূর্ব্বক পলায়ন করিয়াছে।

         চৈত্র

     অল্প দিবসের মধ্যে কলিকাতা অবধি আগ্রা পর্য্যন্ত ইলেকট্রিক টেলিগ্রাফ নির্ম্মিত হওয়াতে গবরনর জেনরল সাহেব ডাক্তর ওসাগনাসি সাহেবের নিকট বিশেষ বাধ্যতা স্বীকার করিয়াছেন। ----- ১৭ই চৈত্র বুধবার রজনীতে যোড়াসাঁকো দোয়ে হাটাতে বজ্রাঘাতে একজন হত ও দুই জন আহত হয়। ----- সুতানূটির গঙ্গাতীরস্থ ভূমি লইয়া গবর্ণমেন্টের সহিত মৃত মহারাজা রাজকৃষ্ণ বাহাদুরের পুত্রদিগের যে মোকদ্দমা চলিতেছিল, সে মোকদ্দমায় সুপ্রিমকোর্টের বিচারে রাজপুত্রগণ জয়লাভ করিয়াছেন। ----- বর্দ্ধমান জেলায় অনেক ডাকাইতি হয়। ----- জ্ঞানারুণোদয় পত্র পুনর্ব্বার প্রকাশ হওনের কল্পনা হইতেছে। ----- কলিকাতার গঙ্গাতীরস্থ ভূমিতে এক মনোহর উদ্যান হওনের অনুষ্ঠান হইয়াছে। -----কলিকাতা প্রেসিডেন্সি কালেজ স্থাপিত হইয়া যে নিয়মে তাহার কর্ম্ম চলিবে সে নিয়মের আদর্শ প্রকাশ হইয়াছে। ----- বিলাতের নানা স্থানে স্বর্ণ খনি প্রকাশ হওয়াতে স্বর্ণের দাম ন্যুন হইয়াছে। ----- গ্রিস রাজ্যে ভয়ঙ্কর রাজ বিদ্রোহ উপস্থিত হইয়াছে। -----বিলাত হইতে বাঙ্গাল ব্যাঙ্কের জন্য নূতন নোট আসিয়াছে। ----- “চারুচিত্ত রহস্য” নামক এক নূতন মাসিক গ্রন্থ প্রকাশ হইয়াছে। ----- স্থানে স্থানে বাঙ্গালা পাঠশালা স্থাপন করণে গবর্ণমেন্ট সম্মতি দিয়াছেন শীঘ্রই তাহার কার্য্যারম্ভ হইবেক। ----- গবর্ণমেণ্টের অধীনস্থ সমস্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি হইবেক।

        এ ধরণের খবর থেকে ইংরাজ সরকারের শাসন ব্যবস্থা ও বিভিন্ন জনহিতকর কাজ সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা জন্মে।
       স্ত্রী-শিক্ষা বিষয়ে কিছু ব্যক্তি প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন হলেও সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন রক্ষণশীল দলের । ১৮৫১ খ্রীষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল এ প্রসঙ্গে তিনি ‘সংবাদ প্রভাকরে’ লেখেন :

      “রাজকীয় ব্যাপার কাহাকে বলে এদেশের স্ত্রীলোকেরা তার কিছুমাত্র জ্ঞাত নহে, কেবল দাঁটা চচ্চড়ির ভুষ্টিনাশ করত গলাবাজী পূর্ব্বক কোন্দল করিয়া গৃহবিচ্ছেদের সূত্রপাত করতে নিপুণা হইয়াছেন, দেখ দেখি বিলাতবাসিনী কামিনীকূলের কেমন অনন্ত গুণ, তাঁহারা বীরভূমে উদ্ভব হইয়া বীরভোগ্যা হইয়াছেন, সুতরাং বীরা হইয়া বীরত্ব প্রকাশ করিবেন বিচিত্র কি ? দেশ, কাল, আহার ও ভোগ ইত্যাদির গুণে সকলি হইতে পরে। ফলে বঙ্গাঙ্গনাগণের মনের ভাব সেরূপ হওনের আবশ্যক করে না, ইহারা চিরকাল সাড়ী পরিয়া হাঁড়ি ধরিয়া দিনপাত করুক। আমরা তাহাতেই সুখি হইব, তবে সাবকাশ ক্রমে চলিত মত স্বজাতীয় বিদ্যার আলোচন যত দূর পর্য্যন্ত করতে পারে তাহাই ভাল।
       বাঙ্গালির মেয়ে সব, হও বটে কালো ।
       পতিব্রতা ধর্ম সদা, প্রতিজ্ঞায় পালো ।।
       দিশি বিদ্যা যাহা শেখ, সেই মাত্র ভালো ।
       অন্ধকারে অন্ধ থাকো, কায নেই আলো ।।”

     ১২১৮ বঙ্গাব্দে কাঁচড়াপাড়ায় ঈশ্বরচন্দ্রের জন্ম। পড়াশোনায় তার মন ছিল না। দশ বছর বয়সে মাতৃবিয়োগের পর পিতা পুনরায় দারপরিগ্রহ করেন। পিতার আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই সঙ্গীন। ঈশ্বরচন্দ্র জোড়াসাঁকোতে মাতামহের কাছেই থাকতেন। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর এবং মুখে মুখে গান ও কবিতা রচনা করতে পারতেন। পাঁচ বছর বয়সেই তিনি নাকি লিখেছিলেন :

     “রাতে মশা দিনে মাছি
     এই নিয়ে কলকাতা আছি।”

      পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্রের কবিতা ও রচনার ভক্ত। গোপীমোহনই তাকে ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশে উদ্বুদ্ধ করেন।

      সংবাদ প্রভাকর নাম হলেও পত্রিকাটিকে বিদগ্ধ জনেরা সাহিত্য পত্র হিসাবেই গ্রহণ করেছিল। কারণ এতে সংবাদ ছাড়াও কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি প্রকাশিত হত। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, বেশ কিছু লেখককে গড়ে তুলতে ‘সংবাদ প্রভাকর’ ও ঈশ্বরচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল । এ রকম লেখকদের একজন হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত । একটা সময়ে ‘সংবাদ ভাস্কর’ ও ‘সংবাদ রসরাজ’ নামক দুটি পত্রিকার সঙ্গে ‘সংবাদ প্রভাকরের’ বাদানুবাদ লেগেই থাকত। ঈশ্বরচন্দ্র পদ্যে এবং অক্ষয়কুমার গদ্যে প্রত্যুত্তর দিতেন । অক্ষয়কুমারের লেখা পড়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন –“অক্ষয়বাবু দুর্বাবনে মুক্তা ছড়াইতেছেন।” অনেকের মতে পরবর্তীকালে অক্ষয়কুমার সাহিত্য কর্মে গুরু ঈশ্বরচন্দ্রকেও ছাড়িয়ে গেছেন।

      ঈশ্বরচন্দ্রের রচিত গদ্যের একটি বৈশিষ্ট্য হল তার ব্যবহৃত অনুপ্রাসের প্রাবল্য। এ ধরণের রচনা সে কালের পাঠকেরা কি ভাবে গ্রহণ করেছিলেন বলা শক্ত । তবে তার রচনা সাধারণের ভাল না লাগলে তিনি এতটা জনপ্রিয় হতেন না নিশ্চয়ই । একবার তিনি লিখলেন :

     “যদিও প্রভাকর গুণাকর পাঠকদিগের নয়ন নীরজের প্রফুল্লকর না হয় তত্রাচ তাহার স্ব স্ব সৌজন্য জন্য প্রভাকর সম্পাদকের প্রতি ক্রোধাকর না হইয়া কৃপাকর হইবেন।”

      বহুকাল পরে শিবরাম চক্রবর্তির রচনায় অনুপ্রাসের সংযত ব্যবহার অনায়াসে যে লঘু রসের সঞ্চার ঘটাত ঈশ্বরচন্দ্রের লেখায় অনুপ্রাসের অপ্রয়োজনীয় এবং অস্বাভাবিক প্রয়োগ রচনার রসভঙ্গ ঘটাত বলে মনে হয়। তবে সাময়িক পত্র যেহেতু কালের সঙ্গে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গী, সাহিত্য, শিল্প ও সমাজ ব্যবস্থা বিষয়ক বিভিন্ন তথ্য পরবর্তী বেশ কয়েক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী মাধ্যম, অতএব তথ্য লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনে ঈশ্বরচন্দ্রের অনুপ্রাসের কিছু নমুনা ১২৬১ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখে ‘সংবাদ প্রভাকরে’ প্রকাশিত একটি রচনা থেকে উধৃত করা যেতে পারে :

       "এ দিকে যবন সেনারা বাহূবল বিস্তারপূর্ব্বক নগর তোলপাড় করিতে লাগিল। ঝম্প ধ্বনি করিয়া কতই দম্ভ করিতেছে, লম্ফ মারিতেছে, ঝম্প দিতেছে, ভূমিকম্প হইতেছে। হুড হুড হুড হুড - দুড় দুড় দুড় দুড় - গুড় গুড় গুড় গুড় - শুড় শুড় শুড় শুড় - কড় কড় কড় কড় - মড় মড় মড় মড় - হড় হড় হড় হড় - পড় পড় পড় পড় - ঝড় ঝড় ঝড় ঝড় - সড় সড় সড় সড় - চড় চড় চড় চড় - দুম দুম দুম দুম - গুম গুম গুম গুম - দুপ দুপ দুপ দুপ - গুপ গুপ গুপ গুপ - ধর ধর ধর ধর - ঝর ঝর ঝর ঝর - কর কর কর কর - সর সর সর সর - থর থর থর থর - গর গর গর গর - ঘর ঘর ঘর ঘর শব্দে স্থান সকল আচ্ছন্ন হইতে লাগিল । সকল দ্বারেই মহাগণ্ডগোল, সকল দ্বারেই সৈন্যের কোলাহল। ভূতোগত ভয়ঙ্কর কাণ্ড হইয়া উঠিল । ঝনাৎ ঝনাৎ করিয়াই সকল দ্বারে আঘাত করিতেছে - যাহাকেই পাইতেছে তাহাকেই ধরিতেছে - যাহা দেখিতেছে তাহাই হরিতেছে - মারিতেছে – সারিতেছে । পৌরজনেরা সকলেই হারিতেছে - বিপক্ষেরা উঠিতেছে, ছুটিতেছে - সর্ব্বত্রই লুটিতেছে - নির্ভয়ে লড়িতেছে - কখনো নীচে পড়িতেছে - কখনো উপরে চড়িতেছে - মার মার বলিতেছে - চলিতেছে - টলিতেছে - ঢলিতেছে - দলিতেছে - কোপানলে জ্বলিতেছে। এইরূপ যখন সকল দ্বার আক্রমণ করিয়া সকল নগর পরিবেষ্টন পূর্ব্বক দখল করিতে লাগিল, তখন কোনোখানে শন শন শন শন - কোনোখানে টন টন টন টন - কোনোখানে ঝন ঝন ঝন ঝন - কোনোখানে কন কন কন কন - কোনোখানে ফন ফন ফন ফন - কোনোখানে হন হন হন হন - কোনোখানে ভন ভন ভন ভন - কোনোখানে পন পন পন পন - কোনোখানে ঢন ঢন ঢন ঢন - ধ্বনি উত্থিত হইল।"

(টাইপ সেটিং-এর সুবিধার্থে প্রতিটি ধ্বণি-সূচক শব্দের শেষে মূল রচনায় ব্যবহৃত হসন্ত বর্তমান সংকলনে বাদ দেওয়া হয়েছে )।

       ১২৬০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর মাসিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৮৫৯ সালের ২৩শে জানুয়ারী ( ১২৬৫ বঙ্গাব্দের ১০ই মাঘ ) কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত পরলোক গমন করেন এবং তার ছোট ভাই রামচন্দ্র গুপ্ত ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পত্রিকাটির গ্রাহক সংখ্যা তখন অনেক কমে গিয়েছে। এক সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকাটির ম্রিয়মান অবস্থা দেখে ঈশ্বরচন্দ্রের এক খুড়তুতো ভাই মহেশ গুপ্ত খেদ প্রকাশ করে লিখেছিলেন :

       “সাত মেড়াতে জড় হয়ে নষ্ট করল প্রভাকর।
       জন্মে কলম ধরেনিক, রাম হল এডিটর ।।
       আগাপাছা বাদ দিয়ে শ্যাম হল কমাণ্ডর ।”

      স্পষ্টতই রামচন্দ্র গুপ্ত ও সহকারী সম্পাদক শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লক্ষ্য করেই পংক্তি কয়টি রচিত। ‘সংবাদ প্রভাকর’ স্তিমিত হয়ে পড়লেও কতদিন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল সে সম্বন্ধে নির্দিষ্ট কোন তথ্য নেই। তবে মনোমোহন বসু সম্পাদিত ‘মধ্যস্থ’ পত্রিকায় পরিবেশিত একটি সংবাদের সূত্র ধরে দেখা যায় পত্রিকাটি ১২৮১ সালেও জীবীত ছিল। পত্রিকাটি যে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। সম্পাদক ঈশ্বরচন্দ্র প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। ‘সংবাদ প্রভাকর’ ছাড়া তার অন্য কোন আয়ের পথ ছিল না; এ থেকেই সংবাদ পত্রটির প্রচার সংখ্যা অনুমেয়।

     সংযুক্ত প্রতিলিপি পরিচয় -

 চিত্র ১ : ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দ ৫ই ডিসেম্বর ( ২১শে অগ্রহায়ণ ১২৬৭ ) তারিখে প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠার প্রতিলিপি।

 চিত্র ২ : ৬ ই বৈশাখ ১২৬১ তারিখের পত্রিকায় প্রকাশনার তথ্য সম্বলিত বিজ্ঞপ্তি।

 চিত্র ৩ : ১লা বৈশাখ ১২৬১ ( ১৩ই এপ্রিল ১৮৫৪ ) তারিখে প্রকাশিত গ্রাহকদের উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন।

 চিত্র ৪ : ৯ই বৈশাখ ১২৬১ তারিখে প্রকাশিত একটি কৌতূহলোদ্দীপক সংবাদের কিয়দং

 চিত্র ৫ : ৫ই ফাল্গুন ১২৭০ ( ১৬ই ফেব্রুয়ারি ১৮৬৩ ) তারিখে কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারত সম্বন্ধে বিজ্ঞপ্তি।

দীপক সেনগুপ্ত

 

 

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।



Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।