অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।


পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

জুলাই ১৫, ২০১৭

 

উপাসনা ও বঙ্গশ্রী

দীপক সেনগুপ্ত

উপাসনা

     বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য ছিলেন একজন নামকরা শিল্পপতি| অসাধারণ কর্মক্ষমতা, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতাকে কাজে লাগিয়ে তিনি তার ব্যবসার পরিধি বহুভাবে বিস্তৃত করেছিলেন| বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিলের সুদক্ষ পরিচালক, কমার্সিয়াল ক্যারিয়িং কোম্পানী, বঙ্গলক্ষ্মী সোপ ওয়ার্ক্‌স, মেট্রোপলিটন ইন্সিওরেন্স কোম্পানী এবং মেট্রোপলিটন প্রিন্টিং অ্যাণ্ড পাবলিশিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ছিলেন এই সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য| কিন্তু তিনি তার জ্ঞান বুদ্ধিকে শুধু ব্যবসার আঙ্গিনায় বদ্ধ করে রাখেন নি| সজনিকান্ত দাসের ভাষায় "বাস্তববাদী মিঃ ভট্টাচার্যের পরিচয় তাঁহার ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানগুলিতে রহিয়া গিয়াছে; কিন্তু আদর্শবাদী ভট্টাচার্যকে আজ কেহ মনে রাখে নাই| নূতনের সংঘাতে প্রাচীন ভারতের কল্যাণকর আদর্শের বিপর্যয় দেখিয়া তাহাকে খেদে ক্ষোভে অশ্রু বিসর্জন করিতে দেখিয়াছি| কিন্তু নিছক অশ্রুবিসর্জনেই তাঁহার অন্তরের জ্বালা প্রশমিত হয় নাই; তিনি তাঁহার আরাধ্য আদর্শের প্রতিষ্ঠায় প্রভূত কর্মশক্তি ও অর্থশক্তিও নিয়োজিত করিয়াছিলেন| তাহারই প্রত্যক্ষ ফল তাঁহার 'কলিকাতা-সংস্কৃত-গ্রন্থমালা'| ভারতবর্ষের প্রাচীন শাস্ত্র-গ্রন্থ প্রচারে ও সংরক্ষণে এই প্রতিষ্ঠান চিরস্মরণীয়।” 

‘উপাসনা’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা ১৩১১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল, সম্পাদক ছিলেন চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়। পরে সম্পাদনা করেছেন সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়। দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়েছিল পত্রিকাটি| প্রথম দিকের সংখ্যাগুলি দেখার সুযোগ হয় নি, তবে পরের দিকে দেখা যাচ্ছে স্বত্বাধিকারী ছিলেন মহারাজ মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী কে.সি.আই.ই এবং সম্পাদক রাধাকমল মুখোপাধ্যায়| পরিচালনার তত্বাবধায়ক ছিলেন উপাসনা সমিতির পক্ষে মুকুন্দলাল বসু বি.এ| দীর্ঘ প্রায় সাতাশ বছর ধরে পত্রিকাটি 'উপাসনা' নামে সাফল্যের সঙ্গে পাঠকদের সাহিত্য পিপাসা তৃপ্ত করেছিল| সম্ভবতঃ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে সম্পাদক  রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে সহ-সম্পাদনায় নিযুক্ত হন সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়| প্রকাশক ছিলেন ১১নং কলেজ স্কোয়ারে স্থিত ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সিণ্ডিকেট| পত্রিকাটির প্রতি সংখ্যার মূল্য ছিল পাঁচ আনা; বার্ষিক মূল্য তিন টাকা| ১৩২৯ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল সিণ্ডিকেটের পরিবর্তিত ঠিকানা হয়েছে ৪৪ডি, পুলিশ হাসপাতাল রোড, ইন্টালী এবং মূল্য ঘোষিত হয়েছে প্রতি সংখ্যা চার আনা ও বার্ষিক সডাক তিনটাকা| সহ-সম্পাদক সাবিত্রীপ্রসন্ন পরে একক ভাবে সম্পাদনার কাজ দেখাশোনা করেছেন এবং এই ভাবেই ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের পৌষ মাস অবধি চলেছিল| 

উপাসনা প্রেস ও পত্রিকার স্বত্ব শিল্পপতি ও বিদ্যানুরাগী সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য কিনে নেন| পত্রিকাটির প্রথমে ও পরে যে কযেকটি সংখ্যা দেখতে পেযেছি তাতে বিষয়বস্তু ও লেখক নির্বাচন এবং প্রকাশনা উন্নত মানের ছিল বলেই মনে হয়| একটি পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে লেখকগোষ্ঠি গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে কেউ প্রতিষ্ঠিত হন আবার কেউ বা বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যান| 'উপাসনা'য় অংশ গ্রহনকারী নবীন লেখকদের অনেকেরই নাম পরে আর শোনা যায় নি| নামী লেখকদের মধ্যে ছিলেন গিরিবালা দেবী, সরোজ নাথ ঘোষ, সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ চন্দ্র বসু বি.এ.(কেম্ব্রিজ), প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, বিপিন চন্দ্র পাল, নিরুপমা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কুমুদ রঞ্জন মল্লিক, পরিমল গোস্বামী, অধ্যাপক বিনয় কুমার সরকার এম.এ., ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণী, হেমলতা দেবী, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, কালিদাস রায় বি.এ., কাজি নজরুল ইসলাম (হাবিলদার নজরুল ইসলাম নামেও লিখেছেন) প্রমুখেরা| সুভাষ চন্দ্র বসু তার অন্যান্য রচনার সঙ্গে লিখেছেন ‘তরুণের আহ্বান’ নামক একটি প্রবন্ধ, যাতে যুগ যুগান্তরের দাসত্ব মুছে ফেলে নতুন দেশ গড়ে তোলার সঙ্কল্পে যুবসমাজ ও তরুণদের কর্তব্য সম্বন্ধে অবহিত করেছেন| রবীন্দ্রনাথ ও দিনেন্দ্রনাথের গান ও স্বরলিপি ছাড়া অন্যদের গান ও স্বরলিপিও প্রকাশিত হয়েছে| বহুল সংখ্যায় কবিতা ছাপা হযেছে পত্রিকায় ; এছাড়া রয়েছে গল্প, উপন্যাস, নাটক, ইতিহাস, বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, বিবিধ সামজিক সমস্যা, পল্লীগ্রামের কৃষকদের নিয়ে আলোচনা ইত্যাদি। মাসিক পত্রিকা এবং পুস্তক সমালোচনার বিভাগটিতে নিয়মিত ভাবে সমকালীন পত্রিকা ও প্রকাশিত নানা গ্রন্থের সমালোচনা ছাপা হয়েছে| আলোচিত পত্রিকাগুলির মধ্যে রয়েছে 'সন্দেশ', 'পরিচারিকা', 'যমুনা', 'ভারতী', ‘মানসী ও মর্ম্মবাণী', 'প্রতিভা', 'পল্লীবাণী' ইত্যাদি| বেশ কয়েকটি সংখ্যায় একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে "ছাত্রদের জন্য স্বল্পমূল্যে উপাসনা বিতরণ করা হইবে| সত্বর নাম রেজিষ্টারী করুন - অগ্রহায়ণ মাস হইতে আমরা এই বিষয়ে বিশেষ ব্যবস্থা করিব| পুরাতন উপাসনা বিক্রয়ার্থে প্রস্তুত আছে|"

রাধাকমল মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনাকালে ১৪২৭ কার্ত্তিক সংখ্যা থেকে পত্রিকার প্রতি সংখ্যার শুরুতে এই তিন লাইন কবিতা মুদ্রিত হত :

"সাগর মাঝে রহিলে যদি ভুলে,  কে করে এই তটিনী পারাপার;
অকূল হতে এসো গো আজি কূলে, দুকূল দিয়ে বাঁধো গো পারাবার
লক্ষ-যুগ পশরা লযে শিরে - বিশ্ব আজি দাঁড়ায়ে ঐ তীরে|"

এর আগে প্রতি সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠার শুরুতে বড় হরফে ‘উপাসনা’ নামের পরেই নিম্নলিখিত কয়েকটি পংক্তি মুদ্রিত হ’ত –

“বিশ্বমানবকে যে উদ্ধার করিবে, তাহার জন্ম হিন্দুসভ্যতার অন্তঃস্থলে। তুমি হিন্দু, তুমি আপনার উপর বিশ্বাস স্থাপন কর, অটল,অচল বিশ্বাসের শক্তিতে তুমি অনুভব কর, তুমিই বিশ্বমানবের ইন্দ্রিয়ের লৌহশৃঙ্খল মোচন করিবে, তুমিই বিশ্বমানবের হৃদয়ের উপর জড়ের ভীষণ পাথরের চাপ বিদূরিত করিবে। হিন্দুসমাজ তোমার জন্মের অন্ধকার-মথুরা, তোমার কৈশোরের মধুবন, তোমার সম্পদের দ্বারকা, তোমার ধর্ম্মের কুরুক্ষেত্র, তোমারি শেষ-শয়নের সাগর-সৈকত।”

সম্পাদকীয় প্রবন্ধে দেশ গঠনের জন্য গ্রামকে উন্নত করার আহ্বান জানান হয়েছে -

"আমাদের সমস্ত আয়োজন যাহাতে সমগ্র দেশে বিপুলভাবে বিস্তৃত হইয়া, আমাদের জাতীয় অবনতি প্রতিরোধ করিতে পারে, তাহার জন্য গ্রামে গ্রামে, মহকুমায় মহকুমায়, জেলায় জেলায়, একনিষ্ঠ কল্যাণকর্ম্মী পল্লেসেবকের প্রয়োজন| পল্লেসেবকের ভাবুকতা, উদ্যম এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের উপরই জাতীয় উন্নতি নির্ভর করিতেছে| এই পল্লী-সেবকদের কল্যাণকর্ম্মে সুবিধা ও সুযোগ বিধানের জন্য দেশের শিক্ষিত ধনী এবং জমিদারবর্গকে মুক্তহস্ত ও সদা সচেষ্ট থাকিতে হইবে|"

১৯১৭ খৃষ্টাব্দে সোভিয়েত দেশে বলশেভিক আন্দোলনের পর শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়| এই নতুন সমাজ ব্যবস্থা সফল করার প্রস্তুতি তখন অন্যান্য দেশেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল| এ দেশের পত্র পত্রিকায় তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়েছিল যথেষ্ট| বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে সেটা ফুটে উঠেছে| এ বিষয়ে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের কয়েক পংক্তি দেখা যেতে পারে - "বলশেভিক গবর্ণমেন্ট আইন করিয়াছে যে বিনাশ্রমে কেহই আহার্য্য পাইবে না| খাদ্যবিভাগ গবর্ণমেন্ট কর্ত্তৃক নিয়ন্ত্রিত| কেহ যে পূর্ব্বপুরুষের সঞ্চিত অগাধ ধনরাশির উপর অলস দেহ এলাইয়া দিয়া, বিলাসের মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকিয়া জীবন যাপন করিবেন সেই পথ বন্ধ হইয়া গিয়াছে| বর্ত্তমানে রুশিয়ায় ধনী নির্ধন নাই| সকলকেই পরিশ্রম করিয়া খাদ্য পাইতে হইবে| পরিশ্রম না কর উপবাসে মরিতে হইবে| দেশের সমস্ত ধন সমস্ত জমি জনসাধারণের সম্পত্তি| যাহার প্রাসাদ তুল্য বিরাট অট্টালিকা আছে, এখন সে একা তাহা ভোগ করিতে পারিবে না|"  সোভিয়েট রাশিয়ায় নতুন সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে দেশ গড়ে তোলার আহ্বান ও তার প্রতিক্রিয়া বহু দেশের চিন্তাবিদদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছিল, সাহিত্যেও এর প্রভাব পড়েছিল যথেষ্ট।
কয়েকটি প্রবন্ধের শিরোনাম থেকে পত্রিকার অভিমুখটি হয়ত অনেকটা স্পষ্ট হবে – ‘বঙ্গ সাহিত্যের যুগ’ (আশুতোষ দাসগুপ্ত মহলানবীশ), ‘নগরের বস্তি সমস্যা’ (সম্পাদক), ‘ভারতীয় নৌ-বাণিজ্য’ (বলাইচাঁদ দত্ত বি-এ), ‘দৈববাদী ও কর্ম্মবাদী’ (শ্রীচৈতন্য), ‘যুগধর্ম্ম ও হিন্দু সভ্যতা’ (নরেশচন্দ্র সেন), ‘আত্মা ও পরমাত্মা’ (কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় বিদ্যারত্ন), ‘বিজ্ঞান ও জীব আত্মার অমরত্ব’ (অতুলচন্দ্র দত্ত), ‘প্যারিসের পাড়ায় পাড়ায়’ (বিনয়কুমার সরকার), ‘শাস্ত্রীয় অনুশাসন ও ঐতিহাসিক যুগ’ (প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী), ‘কাঠের গুঁড়ার ব্যবহার’ (নরেন্দ্রসন্দ্র দেব), ‘হজরত মোহম্মদের মহত্ব’ (মঈনউদদীন হোসায়ন), ‘ভারতের সাধনা’ (হেমন্তকুমার সরকার), ‘বঙ্গসাহিত্যে আভিজাত্য’ (বিমানবিহারী মজুমদার), ‘জাতীয় শিক্ষা-পরিষৎ’ (প্রমথনাথ মুখোপাধ্যায়),’কাব্যের উপাদান’ (অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়),’চাষীর কথা’ (কালিদাসী দেবী), ‘শর্করা বা চিনি প্রস্তুত প্রণালী’ (শ্যামাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়), ‘প্রেততত্ত্ব’ (অতুলচন্দ্র দত্ত বি-এ), ‘তেলা-পোকা’ (‘প্রকৃতি-পর্য্যবেক্ষণ’, সুধাকান্ত রায় চৌধুরী), ‘গীতা ও ভাগবত’ (স্মরজিৎ দত্ত এম-এ), ‘নারীর পূর্ণ বিকাশ’ (মহামায়া দেবী), ‘নারীর শিক্ষা’ (শিশিরা দেবী), ‘কর্ম্মতত্ত্ব’ (স্বামী প্রজ্ঞানানন্দ সরস্বতী), ‘বঙ্গের ভিক্ষুক’ (রাধাচরণ দাস) প্রভৃতি।

মাঝে মাঝে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অথবা বিজ্ঞজনের উদ্ধৃতি ছাপা হয়েছে। যেমন, ‘কলকাতা গেল’ শিরোনামে কালো অলঙ্কৃত বর্ডারের মধ্যে সঙ্কলক ‘সনাতন পরিবেশন করেছেন একটি হতাশা জনক তথ্য –

“একা কলকাতায় বালিকা বিধবার সংখ্যা ১৮২৫৬ আঠার হাজার দুশো ছাপ্পান্ন। ১ থেকে ৪ বছর বয়সের আছে ২৬৯৬ আর ১০ থেকে ১৫ বছরের ১৪৭৪৯ চোদ্দ হাজার সাত শো উনপঞ্চাশটি। এ ছাড়া আর আর বয়সেরও বিধবা আছে। এ নমুনাতেই বোঝা যায় যে হিন্দু বাঙ্গালীদের ভেতর বালিকা বিধবা কত আছে। ধন্য সমাজ!”

বহু সংখ্যক কবিতা প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকাটিতে। কবিতা লিখেছেন – কুমুদরঞ্জন মল্লিক, বনলতা দেবী, নরেশচন্দ্র সেন বি-এস-সি, প্রিয়কান্ত সেনগুপ্ত, অবিনাশচন্দ্র সান্ন্যাল, সাবিত্রী প্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রলাল রায়, মিহিরকুমার মুখোপাধ্যায় এম-এ, মনোরমা দেবী, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার, কালিদাস রায় বি-এ কবিশেখর, শৌরীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, ননীগোপাল জোয়ারদার, শরদিন্দুনাথ রায় প্রমুখ।

‘উপাসনা’ পত্রিকায় অনেকগুলি বিভাগ ছিল। মাঝে মাঝে এগুলির পরিবর্তনও ঘটেছে। বিভাগগুলির মধ্যে ছিল – ‘ভাববার কথা’, ‘পঞ্চামৃত’, ‘পল্লীবার্ত্তা’, ‘বিশ্ববাণী’, ‘আলোচনী’, মাসিক কাব্য সমালোচনা’, ‘পুস্তক সমালোচনা’ প্রভৃতি। এই সব বিভাগে দেশ ও বিদেশের ঘটনা, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, পল্লীকথা, চাষবাস প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে। তবে এসব বিভাগের ধারাবাহিকতা ছিল না। কোন কোন সংখ্যায় কিছু প্রকাশিত হয় নি, এমনও হয়েছে। কোন কোন বিভাগের রচনায় ছিল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও আলোচনা। উদাহরণ স্বরূপ, ‘পঞ্চামৃতে’ প্রকাশিত কয়েকটি বিষয় – ‘জনসাধারণের শিক্ষা’, ‘বাঙালীর অবনতি’, ‘জমি ও জমির খাজনা’, ‘বাংলার লোক-সঙ্গীত’, ‘কৃষকের দারিদ্র্য মোচন’, ‘পারস্য গীতি কবিতা’, স্ত্রীলোক শ্রমজীবীদের সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’, ‘বাবলা’ [গাছ সম্বন্ধে]।
সার্বিক দৃষ্টিতে 'উপাসনা' কোন নতুন পথ বা ধারার সন্ধান দিতে না পারলেও বিভিন্ন বিষয়ে রচনা প্রকাশ করে উৎকর্ষ ও বৈচিত্র বজায় রেখে দীর্ঘকাল ধরে সাহিত্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখতে অবশ্যই সফল হয়েছে|

বঙ্গশ্রী

আগেই বলা হয়েছে, উপাসনা প্রেস ও পত্রিকার স্বত্ব শিল্পপতি ও বিদ্যানুরাগী সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য্য কিনে নেন| 'উপাসনা’ পত্রিকাটিকে তিনি ঢেলে সাজাতে উদ্যোগি হন এবং উপযুক্ত সম্পাদকের খোঁজ করতে থাকেন| ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের ২৬শে চৈত্র সজনীকান্ত দাস 'দৈনিক বসুমতি' পত্রিকায় "বঙ্কিমপ্রসঙ্গ" নামে বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে একটি লেখা প্রকাশ করেছিলেন| লেখাটি সচ্চিদানন্দের প্রশংসা লাভ করে এবং সজনীকান্তকেই তিনি পত্রিকা সম্পাদনার উপযুক্ত বলে বিবেচনা করেন| 'উপাসনা'-র অফিস ও ছাপাখানা তখন ছিল মেট্রোপলিটন প্রিন্টিং অ্য্যণ্ড পাবলিশিং হাউস লিমিটেডের অন্তর্ভুক্ত এবং অবস্থিত ছিল ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দক্ষিণে ৫৬ ধর্ম্মতলা স্ট্রীটে; হেড অফিস ছিল ২৮ নং পোলক স্ট্রীটে| সচ্চিদানন্দ সজনীকান্তকে ডেকে পাঠান এবং ২৮ নং পোলক স্ট্রীটে দু'জনের দেখা হয়| 'উপাসনা'-র সম্পাদক পদ গ্রহণ করতে সচ্চিদানন্দ সজনীকান্তকে অনুরোধ করেন| তখনও কর্মরত সম্পাদক সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের বিকল্প কোন কর্মসংস্থানের সর্তে সজনীকান্ত রাজী হয়ে যান| সম্পাদনা ও পরিচালনার আনুষঙ্গিক বিষয় সম্বন্ধে খসড়া প্রস্তাব তৈরী করতে সজনীকান্ত সাত দিন সময চান| সচ্চিদানদের কাছে তার প্রস্তাব ছিল, 'উপাসনা’ নাম পরিবর্তন করে পত্রিকার নাম 'বঙ্গশ্রী' করতে হবে; সম্পাদকের বেতন হবে মাসিক তিন'শ টাকা; লেখকের দক্ষিণা কলম-পিছু দু'টাকা, তিন-রঙা ও এক-রঙা ছবি যথাক্রমে দশ টাকা ও পাঁচ টাকা; বড় ও ছোট কবিতা পাঁচ টাকা ও দু'টাকা| এক সময়ে 'প্রবাসী'-র প্রুফ-রীডারের অভিজ্ঞতা সজনীকান্ত এখানে কাজে লাগান| সামান্য পরিবর্তন করে সচ্চিদানন্দ সজনীকান্তের প্রস্তাবে রাজী হন| ১৩৩৯-এর ৮ই অগ্রহায়ণ (১৯৩৩-এর ২৪শে নভেম্বর ) সজনীকান্ত সম্পাদকের পদে যোগ দেন| কিরণকুমার রায় হলেন সহকারী-সম্পাদক| সম্পাদক পদে বহু লোক এসেছেন গিয়েছেন কিন্তু কিরণকুমার যেন সহ-সম্পাদক পদে চির বিরাজমান| এ জন্য পরিহাস করে তিনি নিজেই নিজেকে বলতেন - "শাশ্বত সহকারী সম্পাদক, বোঁটারূপে তাঁহার অবস্থান চিরস্থায়ী, ফুলের অর্থাৎ সম্পাদকের পরিবর্তন বারবার ঘটিতে পারে|"   

সম্পাদক পদে সাবিত্রীপ্রসন্নের পরিবর্তে সজনীকান্তের এই আগমনকে তারাশঙ্কর তার "আমার সাহিত্য জীবন"-এ স্পষ্ট করেছেন - "স্টেশন থেকে এসে উঠলাম উপাসনা অফিসে, ধর্ম্মতলা ষ্ট্রীটে| এসে দেখি অভাবনীয ব্যাপার| উপাসনা উঠে যাচ্ছে| সাবিত্রীপ্রসন্ন বিদায় নিচ্ছেন| উপাসনা-র স্থানে বঙ্গশ্রী-র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে| সজনীকান্ত দাস আসর জাঁকিয়ে বসেছেন| চারিপাশে অনেক লোকের ভিড়| কিরণ রায় পুরাতন এবং নতুনের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছেন| তিনিই আমাকে নিয়ে গেলেন সজনীকান্তের কাছে| স্বল্প দুটি কথা বলেই সজনীকান্ত ভিড়ের মধ্যে মধ্যমণির মত জেঁকে বসলেন| আমি পাশের ঘরে সাবিত্রীপ্রসন্নের কাছে গিয়ে বসলাম|"

এবার আসা যাক পত্রিকার ব্যাপারে| ‘বঙ্গশ্রী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩৯-এর মাঘ মাসে। প্রথম সংখ্যায় 'নিবেদন'এ সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য্য পরিবর্তিত নাম 'বঙ্গশ্রী'র স্বপক্ষে লিখেছেন - "শ্রীযুক্ত সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় তাঁহার সম্পাদিত উপাসনা পত্রিকাটি লইয়া একটু বিব্রত হইয়াছিলেন| আমরা উপাসনাকেই আমাদের উদ্দেশ্য সাধনের অনুকূল করিয়া তুলিবার চেষ্টা করিলাম| কিন্তু পুরাতন শিথিল জীর্ণ ভিত্তির উপর নূতন সৌধনির্মাণের চেষ্টা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হইতে লাগিল দেখিয়া আমরা অবশেষে নূতন নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করাই যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করিলাম| আমাদের উদ্দেশ্যের সঠিক সামঞ্জস্য রাখিয়া উপাসনার নাম পরিবর্তন করিয়া 'বঙ্গশ্রী' রাখা হইল| দেশের পুরাতন শ্রীকে ফিরাইয়া আনাই ইহার চেষ্টা হইবে|" একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হঠাৎ একটি সাময়িক পত্রিকা প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা কেন উপলব্ধি করল তার সমর্থনে তিনি আরও বলেছেন - "আমরা ব্যবসায়ী বাঙ্গালী - ব্যবসায়ের শ্রীবৃদ্ধিই আমাদের লক্ষ্য| একটি সাময়িক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করিবার কল্পনা আমরা করিলাম কেন, এই প্রশ্ন অনেকের মনে উদিত হওয়া স্বাভাবিক| বর্তমানের এই পরাজয়, এই ক্ষুদ্রতা, এই অপমানের উর্দ্ধে উঠিতে হইলে, আমাদিগকে পিছনে ফিরিয়া দেখিতে হইবে, আমাদের গৌরবময় অতীতের সহিত, আমাদের বিজয়ী পিতৃপিতামহগণের সহিত মুখোমুখি দাঁড়াইতে হইবে, তাঁহাদের আদর্শ সন্ধান করিয়া বাহির করিতে হইবে| দেশের প্রাচীন রত্নসমূহ যত মূল্যবানই হউক, যুগোপযোগী বেশভূষা পরিয়া আত্মপ্রকাশ না করিলে তাহাদের কোনও মূল্যই লোকে দিবে না| সাময়িক পত্রিকার সাহায্যে প্রচলিত ভাষায় আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইলেই দেশের অতীত বিস্মৃত পরিচয়, আমাদের পূজ্যপাদ পিতৃ-পিতামহগণের আদর্শ আমাদের স্মরণে আসিবে| এই সকল কারণেই সাময়িক পত্রিকা প্রকাশের প্রয়োজন অনুভব করিলাম|"

     'উপাসনা'র বিলুপ্তি ও 'বঙ্গশ্রী'র আত্মপ্রকাশের পরে একটা বিষয় স্পষ্টতই চোখে পড়ে; সেটা হল ‘শনিবারের চিঠি’ খ্যাত সজনীকান্ত দাসের সম্পাদনা কালে বহু নামী লেখকেরা 'বঙ্গশ্রী'তে এসে 'সাহিত্য-আড্ডা' জমিযেছেন এবং লেখা প্রকাশ করেছেন| এই আড্ডাই ছিল 'বঙ্গশ্রী'র প্রাণ| এ বিষযে সম্পাদক সজনীকান্ত তার 'আত্মস্মৃতি'তে লিখেছেন - "পত্রিকা-অফিসে ঢালাও আড্ডা অর্থাৎ শিল্পী ও সাহিত্যিকদের প্রতি যথোপযুক্ত সমাদরের অভাবে আমাদের কালেই বহু জমজমাট পত্রিকার পতন হইয়াছে, অনেকগুলি বিলকুল মরিয়া গিয়াছে| সাহিত্যিকের আড্ডাই সাহিত্য-পত্রিকার প্রাণ; ঢিলাঢালা স্বাচ্ছন্দ্য, তক্তপোষ তাকিয়া তামাক তাম্বুল অবাধ রাজা-উজিরমারী গল্প অথবা তীক্ষ্ণ কথার তরবারীক্রীড়ার মধ্যেই সাহিত্যের আড্ডা স্ফূর্তি লাভ করে| আজকালকার টেবিল-চেয়ার-টেলিফোন-সমন্বিত সাময়িক পত্রিকার আপিসগুলি পাশ্চাত্ত্য আদর্শে নিছক কাঁটায় কাঁটায় ঘড়ি-ধরা ভাবে চালাইতে গিয়া কর্ত্তৃপক্ষ হয়তো ব্যবসায় সাফল্য অর্জন করিতেছেন, কিন্তু ফালতু স্বর্ণখণ্ডরূপ (ক্যাটালিটিক এজেন্ট) আড্ডার অভাবে সাহিত্য-মকরধ্বজে দানা বাঁধিতেছে না, স্বর্ণসিন্দুরেই ব্যর্থ হইতেছে| চুরুট-সহযোগে বাক্‌ ও বাৎ-এর অবাধ সাধনাও প্রয়োজন|"   

'বঙ্গশ্রী'র আড্ডায় কে আসে নি ! তারাশঙ্কর তার 'আমার সাহিত্য জীবন'এ তালিকা দিযেছেন -

"শনিবারের চিঠি-র সজনীকান্তকে ঘিরে নতুন কালের সাহিত্যরথীর সমাবেশ হয় নিত্য-নিয়মিত| গল্পে-গুজবে; হাস্যে-কৌতূকে, আলাপে-আলোচনায়, চায়ে-পানে, সিগারেটে-বিড়িতে, মধ্যে মধ্যে মুড়ি-বোঁদেতে, ভাজা চিনেবাদাম-ছোলাতে মিশিয়ে সরগরম মজলিশ| অধ্যাপক সুকুমার সেন, শ্রীযুক্ত অমূল্য সেন, শ্রীযুক্ত শৈলজানন্দ, স্বর্গীয় রবীন্দ্র মৈত্র, শ্রীযুক্ত সরোজ রায়চৌধুরী, শ্রীযুক্ত নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ বিশী, চিত্রকর শ্রীযুক্ত চৈতন্য চট্টোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত পরিমল গোস্বামী, কবি সুবল মুখোপাধ্যায়, চিত্রশিল্পী অরবিন্দ দত্ত, স্বর্গীয় বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যিক উকিল দেবীদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্যরসিক উকিল জ্ঞান রায় এঁরা প্রায় এ আসরে নিত্যকার যাত্রী ছিলেন| মধ্যে মধ্যে আসতেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র, কবি শ্রীঅজিত দত্ত, বিখ্যাত চিকিৎসক উদার আত্মভোলা শ্রীরাম অধিকারী; কখনো কখনো আসতেন শিল্পী শ্রীযুক্ত যামিনী রায়, শিল্পী শ্রীঅতুল বসু, শ্রীব্রজেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়| শ্রীযুক্ত অশোক চট্টোপাধ্যায় মধ্যে মধ্যে আসতেন এবং আসর জমিয়ে তুলতেন কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই| মধ্যে মধ্যে খাওয়াতেন|"

     তবে সজনীকান্ত জানিয়েছেন, কিছু ব্যক্তির নাম এই তালিকায় নেই| যেমন - "ঢাকাপ্রবাসী মোহিতলাল মজুমদার, ডঃ সুশীলকুমার দে ও ডঃ বটকৃষ্ণ ঘোষ (কলিকাতায় আসিলে), নীরদচন্দ্র চৌধুরী, ডঃ মনোমোহন ঘোষ, কবি কৃষ্ণধন দে, মনোজ বসু, মহাজনপদাবলী-বিশারদ হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী, ডঃ প্রমথনাথ রায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, স্ট্যাটিস্টিশিয়ান যতীন্দ্রমোহন দত্ত, রূপদক্ষ যামিনীকান্ত সেন, 'বৃদ্ধের বচন' খ্যাত যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায়, সটাক শশাঙ্কমোহন চৌধুরী, পক্ষীতত্ত্ববিদ সুধীন্দ্রলাল রয়, কবি হেমচন্দ্র বাগচী, কবি সুধীরকুমার চৌধুরী, ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ও 'কালো রবি' নামে খ্যাত 'নারায়ণে'র বহুনিন্দিত লেখক সত্যেন্দ্রকৃষ্ণ গুপ্ত|"  এ ছাড়া ধূমকেতুর মত উদয় হওয়া কাজি নজরুল ইসলাম ও পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়| দীনেশরঞ্জন দাস, মুরলীধর বসু ও যুবনাশ্ব (মণীশ ঘটক) – ‘কল্লোল’, ‘কালি-কলমে’র সবাই এসে জুটেছিলেন| আসেন নি কেবল অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ও বুদ্ধদেব বসু|      প্রথম দিকে ‘বঙ্গশ্রী’র প্রথম পৃষ্ঠায় বড় হরফে ‘বঙ্গশ্রী’র নামের গায়ে একটি ধানের শীষের ছবি সহ এই শ্লোকটি মুদ্রিত হত –

'বঙ্গশ্রী'তে কি কি বিভাগ থাকবে বা গল্প উপন্যাস ও ধারাবাহিক কি ভাবে বিন্যস্ত হবে সেটা মোটামুটি পরিকল্পনা করেছিলেন সজনীকান্ত| ‘চাঁদের পাহাড়’-এর স্রষ্টা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় 'ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন’ এবং অন্যান্য বিদেশী পত্রিকা ঘেঁটে দেশ-বিদেশের মানুষ, পশু-পাখী ইত্যাদির গল্প লিখেছেন 'বিচিত্র জগৎ' বিভাগে; বিজ্ঞানের বিবিধ বিষয় ও বৈজ্ঞানিকদের নিয়ে ছোটদের উপযোগী করে লিখেছেন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ‘চতুষ্পাঠী’ বিভাগে। একদা বিজ্ঞানের ছাত্র সম্পাদক মহাশয় নিজেই ‘সৃষ্টি রহস্য’ নাম দিয়ে বিজ্ঞান প্রসঙ্গে লিখতে শুরু করেন। পরে এই বিভাগটির নাম হয় ‘বিজ্ঞান জগৎ’ এবং খ্যাতনামা জীবতত্ত্ববিদ বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য্য এটির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায় প্রথম সংখ্যা থেকেই মহিলাদের জন্য একটি পৃথক বিভাগ নির্দিষ্ট করা হয়, এটির নাম ছিল 'অন্তঃপুর' , বিষ্ণুশর্মা ছদ্মনামে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এই বিভাগটি পরিচালনা করেছেন| শুরুতেই লেখা হয়েছে – “ মহিলাদের পক্ষে যাহা শুভ ও কল্যাণকর তাহা প্রকাশ করিবার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা আমরা করিব। শিক্ষা সম্বন্ধীয় প্রবন্ধ, বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ, জীবনী, আলোচনা, সূচী-শিল্প, রন্ধন প্রণালী, গৃহশিল্প। চিত্রাঙ্কণ, সঙ্গীত-শিক্ষা, স্বাস্থ্য-কথা, শিশু পালন প্রভৃতি বহু জ্ঞাতব্য বিষয় বহু পুস্তক ও পত্রিকা হইতে সঙ্কলন করিয়া অন্তঃপুর বিভাগে প্রকাশ করিবার আয়োজন হইতেছে। বঙ্গ-শ্রীর সকল পাঠক পাঠিকাকে এবং নারী সমাজের সকল হিতাকাঙ্ক্ষীকে এই অন্তঃপুরের মর্য্যাদা রক্ষার জন্য আমন্রণ জানাইতেছি।”  
  

সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিষয়ক আলোচনা রয়েছে ‘সন্ধানী’ বিভাগে। এখানে কিরণকুমার রায় ও শশাঙ্কমোহন চৌধুরী এই বিভাগটির তত্বাবধানে ছিলেন। বিখ্যাত লেখকদের বই থেকে বিভিন্ন রচনার অনুবাদ করে বিশেষ বিশেষ দিকের উপর আলোচনা করেছেন, যেমন এস. রাধাকৃষ্ণাণের সুবিখ্যাত বই ‘কল্কি’ থেকে ‘সভ্যতার ভবিষ্যৎ’, উত্তর আমেরিকার হেনরি মর্টন রবিনসনের ‘Why Suicide’ প্রবন্ধ অবলম্বনে ‘আত্মহত্যা’ বিষয়ে লেখা হয়েছে। এই সব বিভাগের রচনা গুলি তথ্য ও জ্ঞানের সুসমৃদ্ধ আকর হিসাবে পরিগণিত হতে পারে। সম্পাদক সজনীকান্ত লিখেছেন – “’বঙ্গশ্রী’র সেই ‘বিচিত্র জগৎ’ ও ‘বিজ্ঞান জগৎ’ আজ পুস্তকাকারে বিধৃত হইয়া বাংলা-সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদরূপে গণ্য হইয়াছে। ‘অন্তুঃপুর’ ও ‘চতুষ্পাঠী’ পুস্তকের স্থায়ী রূপ লয় নাই বলিয়া মনে মনে আমার ক্ষোভ আছে। প্রমাণ সাইজের নূতন সাময়িক পত্রিকা যাঁহারা বাহির করিবেন, তাঁহারা ‘বঙ্গশ্রী’র এই বিভাগগুলি ভাল করিয়া দেখিয়া লইলে উপকৃত হইবেন।”

সজনীকান্ত দাস সাহিত্যিক মহলে ছিলেন অত্যন্ত পরিচিত। তিনিই ছিলেন ‘বঙ্গশ্রী’র প্রাণপুরুষ। স্বাভাবিক ভাবেই তার ব্যক্তিগত প্রয়াসে বহু প্রথিতযশা লেখকের রচনা সম্ভারে পত্রিকা সমৃদ্ধ হয়েছে। মৌলিক গল্প ও কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সম্পাদক ছিলেন অত্যন্ত যত্নবান। তিনি নিজেই লিখেছেন – “সৃষ্টিধর্মী গল্প ও কবিতার নির্বাচনে আমার বিচারবুদ্ধি অতিশয় তীক্ষ্ণ ও সজাগ রাখিয়াছিলাম। আমার বিশ্বাস ছিল, বঙ্গ-বীণাপাণির বীণার ওই দুইটি তারই প্রধান।”
এবার আমরা প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত রচনা একটু বিশদ ভাবে আলোচনা করে নিই।      

প্রথম সংখ্যায় প্রথমেই রয়েছে সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য্যের লেখা ‘নিবেদন’। পত্রিকায় প্রথম প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথের লেখা হয় এরকম ইচ্ছা সজনীকান্তর ছিল, কিন্তু কবির সঙ্গে তার একটা সাময়িক মনান্তরের জন্য প্রয়াত মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর অপ্রকাশিত রচনা ‘ভারতবর্ষের ধর্মের ইতিহাস’ দিয়েই এ স্থানটি পূরণ করেন। এর পর রয়েছে ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তথ্য সমৃদ্ধ লেখা ‘বাংলা দেশের সাধারণ রঙ্গালয়’ ; ‘পৃথ্বীরাজ’ (কবিতা, প্রমথনাথ বিশী); বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বিচিত্র জগৎ’ (মধ্য আফ্রিকার বন্যজন্তু, উদ্যান রচনায় শিল্পীর হাত) ; খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের লেখা ‘মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস’ ; ‘হুইস্‌ল’ (কবিতা, সজনীকান্ত দাস)।

প্রথম সংখ্যায় ‘হুইসল’ কবিতাটির পরের রচনা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাজমোহনের স্ত্রী’। শুরুতেই সম্পাদক মহাশয় একটি ভূমিকায় জানিয়েছেন – “ Rajmohun’s Wife বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস। ইহা কিশোরীচাঁদ মিত্র সম্পাদিত Indian Field নামক সাপ্তাহিক পত্রে ১৮৬৪ সনে প্রকাশিত হইয়াছিল। এ-যাবৎ কেহই এই উপন্যাসখানি চোখে দেখেন নাই। শ্রীযুত শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁহার ‘বঙ্কিম-জীবনী’ (৩য় সং) পুস্তকের ১০৮ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন :- “বঙ্কিমচন্দ্রও একদিন ‘Rajmohun’s Wife’ নামক গল্প ইংরাজি ভাষায় লিখিয়াছিলেন। গল্প শেষ হইবার পূর্ব্বেই তাঁহার ভুল ভাঙ্গিয়াছিল। তিনি ‘Rajmohun’s Wife’ ...... ছাড়িয়া দুর্গেশনন্দিনী লিখিতে প্রবৃত্ত হইলেন।”  শচীশবাবু নিশ্চয়ই Rajmohun’s Wife দেখেন নাই। ইহা পুরা দস্তুর উপন্যাস, ২১টি অধ্যায়, তাহা ছাড়া Conclusion-ও রহিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের লিখিত এই প্রথম উপন্যাসখানির প্রথম ৩টি অধ্যায় ছাড়া বাকী সব অধ্যায়গুলি পাওয়া গিয়াছে। প্রথম ৩টি অধ্যায় পাওয়া না গেলেও বাকী অধ্যায়গুলির দ্বারা উপন্যাসখানির রসগ্রহণে পাঠকদের কোনই বাধা হইবে না।”

     প্রথম সংখ্যায় ‘হুইস্‌ল’ নামে একটি মাত্র কবিতা ছাপা হয়েছে, রচয়িতা সম্পাদক সজনীকান্ত দাস। ধ্বনিমাধুর্যে ছন্দিত কবিতাটি ভাবের রসায়নেও অনুপম। দীর্ঘ সে কবিতাটির কিছু অংশ এখানে তুলে দেওয়া হ’ল।

“ নিঝুম শীতের রাত্রি জড়িমা মাখা
      কুয়াশার ভারে প্রহর হয়েছে ভারী
      গাঢ় হইয়াছে তম
      লেপ-ঢাকা ধরা মূর্চ্ছা-বিবশ যেন।
        ..................
      শয্যায় জেগে বসিল সহসা নারী,
      ঘুম-ভাঙা চোখে কালো শঙ্কার ছায়া।
      চাহিয়া স্বামীর পানে
      শিহরিয়া ভাবে, হঠাৎ একি এ হ’ল,
      কেন করে ভয় ভয়।
      আতঙ্কে দুই চক্ষু বুজিয়া আসে,
      রুদ্ধ দুয়ার বাতায়ন পানে চায়।
      জানলা বন্ধ, দ্বারে অর্গল আঁটা,
      স্বামীর বক্ষে গাঢ় সুপ্তির উঠে পড়ে নিঃশ্বাস।
      কেন তবে হেন ভুল।
      মনে হ’ল তার এখনি সে দেখিয়াছে ....
      না, না, সে ভয়ঙ্কর !
      ভাবিতেও ভয় হয়।
        ...............
      নিদ্রার ঘোরে শুনি এই হুইস্‌ল
      রমণী জাগিয়া বসে,
      রমণী পেয়েছে ভয়।
        ...............
      মনে হয় তার, কেন জানি মনে হয়,
      দূরে কোথা কারা অতিপরিচিত প্রিয় প্রিয়জন ছাড়ি
      যাত্রা করিছে অসীম অজানা পথে,
      আসিবে না ফিরে আর।
      হুইস্‌ল ধ্বনি যেন দৈত্যের বাহু,
      যেন মৃত্যুর কালো সে করাল ছায়া –
      ছিঁড়িয়া লইবে প্রিয় হ’তে প্রিয়জনে।
      দ্রুত কম্পিত তীক্ষ্ণ ধ্বনির মাঝে
      লক্ষ যুগের বিরহ-বেদনা জমাট বাঁধিয়া আছে,
      সে ঘন বেদনা তরল হইয়া শূন্যে তুলিয়া ঢেউ
      দূর হ’তে ক্রমে ছড়ায় দূরান্তরে।
      তীক্ষ্ণ সূচের মত
      অস্থি-মাংস ভেদ করি ক্রমে পশে অন্তরমাঝে;
      রূঢ় মরণের মূক বিচ্ছেদ সম
      প্রিয় ও প্রিয়ের মাঝে রচে ব্যবধান।    .........”

     পরের লেখাটি ‘ম্যালেরিয়া’ (গল্প, সরোজকুমার রায় চৌধুরী)। তার পরে রয়েছে অমূল্যচন্দ্র সেনের ধারাবাহিক রচনা ‘বুদ্ধকথা’। এই লেখাটি সম্বন্ধে সজনীকান্ত তার ‘আত্মকথায়’ লিখেছেন – “অমূল্যচন্দ্রের সঙ্গে আমার পুরাতন পরিচয় ; খৃষ্টধর্ম-প্রভাবিত ডাফ হস্টেলে যে দুই-একজন কালাপাহাড়ী হিন্দু সাহস করিয়া আশ্রয় লইয়াছিলাম ১৯২০ সনে, তিনি [অমূল্যচন্দ্র] তাহাদের অন্যতম। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সাঙ্গ করিয়া তিনি কোথায় কি ভাবে ছিলেন আমার জানা ছিল না। দেখিলাম তিনি বৌদ্ধ ও জৈন-ধর্ম বিষয়ে বিশেষ গবেষণায় লিপ্ত ছিলেন। তিনি ‘বুদ্ধকথা’র সম্পূর্ণ পান্ডুলিপি সহই আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছিলেন – দুই-চারপাতা উল্টাইয়াই অনুভব করিলাম অমূল্যচন্দ্রের কৃপায় একটি অমূল্য রত্ন হাতে পাইয়াছি। বাংলা ভাষায় বুদ্ধকথা এরূপ চমৎকারভাবে আর কখনো লেখা হয় নাই, এমন বিস্তারিত ভাবেও নয়।”
     প্রথম সংখ্যায় এর পরের রচনা একটি গল্প, নাম ‘শ্মশানঘাট’, লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি তখন প্রায় নবাগত। প্রথম ছ’মাসে তার দুটি গল্প ‘শ্মশানঘাট’ (মাঘ ১৩৩৯) ও ‘মেলা’ (বৈশাখ ১৩৪০) প্রকাশিত হয়েছে ‘বঙ্গশ্রী’ পত্রিকায়। মূলতঃ এখান থেকেই তার যাত্রা শুরু। ‘আমার সাহিত্য জীবন’-এ  তিনি লিখেছেন – “এইখানে যাত্রা শুরু হ’ল ‘বঙ্গশ্রী’তে।”  তারাশঙ্করের গল্পের পরে রয়েছে আয়ার্ল্যান্ডের আইরিশ জাতির মধ্যে প্রচলিত একটি গল্প অবলম্বনে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘দের্দ্রিউ’।
     এর পরে বিভাগীয় ফিচার ‘প্রদর্শনী’। বিভিন্ন বিষয় গুলির মধ্যে রয়েছে – ‘অস্ত্র-চিকিৎসায় যুগান্তর’, ‘উভচর বাইসিক্‌ল’, ‘কব্‌জী-বন্দুক’, কল্পতরু জলের কল’, ‘যুদ্ধ সঙ্গীতের অভিনব সংস্করণ’, ‘নাগর-দোলার গাড়ি’, ‘অপরূপ করাভরণ’, ‘সরীসৃপ বাস’। ‘প্রদর্শনী’র পরের রচনা শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের গল্প ‘অভিশাপ’। ‘আর এক দিক’ নামে একটি ছোট ফিচারে আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন ঘটনা বা ব্যক্তির খবর। তবে এ নামের ফিচার যে সব সংখ্যাতেই ছিল তা কিন্তু নয়।
     নলিনাক্ষ সান্যাল ‘ব্যবসায়-বাণিজ্য’ শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে আর্থিক প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন। বিষয় গুলির মধ্যে রয়েছে – ‘বাঙ্গালার আর্থিক প্রগতির নিয়ন্ত্রণ’, ‘বাঙ্গালার
সহিত ভিন্ন প্রদেশের আর্থিক স্বার্থ-সংঘর্ষ’, ‘বাণিজ্য-স্বার্থ-সংরক্ষণে গোলটেবিল বৈঠকের সিদ্ধান্ত’, ‘কেন্দ্রীয় ‘রিজার্ভ-ব্যাঙ্ক’-গঠনের প্রস্তাব’, ‘পাট-রপ্তানী শুল্ক’, ‘ব্যবসায়ে সালতামামী’। এর পরে ছাপা হয়েছে ‘ভারতে জীবন-বীমা’ নামে একটি ছোট কথিকা। এর পরেই রয়েছে নলিনাক্ষ সান্যালের ‘ভারতে রেলগাড়ীর আগমন’ নামক একটি তথ্যপূর্ণ রচনা এবং নরেন্দ্রনাথ সেনের নিবন্ধ ‘চিনির কল’।
     বেলজিয়ান সাহিত্য থেকে কামিল লিমনিয়ের লেখা ‘ভিয়েরীর প্রাণ’ নামক একটি অনুবাদ-গল্প প্রকাশিত হয়েছে। অনুবাদক কিরণকুমার রায়।
     প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত পরবর্তী রচনা মহিলাদের জন্য বিশেষ বিভাগ ‘বিষ্ণুশর্মা’র ‘অন্তঃপুর’। প্রথম সংখ্যাতেই এই বিভাগটির ভূমিকায় মহিলাদের বিদেশী আচার আচরণের অন্ধ অনুকরণ না করে “ ইউরোপের নারীদের যাহা সদগুণ, যে গুণে তাহারা জগতের সকলের কাছে বরেণ্যা হইয়া থাকেন, কেবল তাহাই গ্রহণ করা উচিত ” –এই উপদেশ প্রদান করা হয়েছে। সুলিখিত দীর্ঘ ভূমিকাটিতে নারীদের কাছেও যে সমাজের শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে তার যথাযথ উল্লেখ করা হয়েছে।      এর পর ‘সন্ধানী’ শিরোনামে একটি রচনায় ‘সভ্যতার ভবিষ্যৎ’ আলোচিত হয়েছে। সূচনায় লেখা হয়েছে – “স্যর এস রাধাকৃষ্ণন ভবিষ্যৎ সভতার রূপ সম্বন্ধে তাঁহার সুবিখ্যাত

‘কল্কি’ নামক পুস্তকে আলোচনা করিয়াছেন। এই পুস্তকটি ‘টু-ডে এন্ড টু-মরো’ সিরিজের অন্তর্গত। কোন ভূমিকা না করিয়া আমরা এই পুস্তক হইতে অংশবিশেষের মর্ম্মানুবাদ দিতেছি। ভবিষ্যতের সভ্যতার সম্বন্ধে আমাদের দেশের একজন মণীষীর মতামতের সহিত আমাদের পরিচয় থাকা ভাল – দুর্ভাগ্যের বিষয় তিনি বৈদেশিক ভাষায় তাঁহার মতামত লিখিতে বাধ্য হইয়াছেন।” এই ‘সন্ধানী’ বিভাগটির দায়িত্বে ছিলেন কিরণকুমার রায় ও শশাঙ্কমোহন চৌধুরী।
‘কস্মৈ দেবায় ?’ নামক প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি উপন্যাস ‘বঙ্গশ্রী’-র পূর্বসুরী ‘উপাসনা’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। পুরানো পাঠকদের যাতে অসুবিধা না হয় সেজন্য বঙ্গশ্রী সম্পাদক শুরুতেই লিখেছেন – “শ্রীযুক্ত প্রেমেন্দ্র মিত্রর এই উপন্যাসটি উপাসনায় ধারাবাহিক ভাবে বাহির হইতেছিল – যাঁহারা উপাসনার গ্রাহক ছিলেন তাঁহাদের জন্য উপন্যাসটি সম্পূর্ণ প্রকাশ করিতে আমরা বাধ্য ; অথচ হাঁহারা বঙ্গশ্রীর গ্রাহক হইবেন তাঁহারা একটি খন্ডিত উপন্যাস না পড়িতেও পারেন, এই জন্য এই উপন্যাসের যতটুকু উপাসনায় বাহির হইয়াছে তাহার চুম্বক স্বয়ং গ্রন্থকারকে দিয়া লেখান হইল। এই চুম্বকটি পড়িয়া লইলে বঙ্গশ্রীর পাঠকদের এই উপন্যাসটি বুঝিতে কষ্ট হইবে না।”
বিজ্ঞান ভিত্তিক রচনা ‘সৃষ্টি-রহস্য’ লিখেছেন সম্পাদক নিজে। পরে এটির ভার নিয়েছেন বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। ‘পুস্তক ও পত্রিকা পরিচয়’ বিভাগটি সম্পাদক বরাবর নিজের হাতেই রেখেছেন। প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’ ও ‘ভারতবর্ষে’র ১৩৩৯-এর পৌষ সংখ্যার সমালোচনা| ‘প্রবাসী’ ১৩৩৯ পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘শুচি’ নামক কবিতার সমালোচনা প্রসঙ্গে সম্পাদক সজনীকান্তর মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথ কবিতা রচনায় ‘আধুনিক’ হয়ে উঠতে চাইছেন। এক সময় বহু লেখককে তার [সজনীকান্তর] তীক্ষ্ণ সমালোচনায় শরবিদ্ধ হতে হয়েছে। ‘শুচি’ কবিতাটি সম্বন্ধে তার মূল্যায়ন একটু দীর্ঘ হলেও তার কিছু অংশ এখানে উধৃত হ’ল –
“ সন্ধ্যা-সঙ্গীতের নূতন রবীন্দ্রনাথ তার ‘মহুয়া’ লেখা সমাপ্ত করিয়া হঠাৎ যেদিন ‘শেষের কবিতা’র দুর্ভাগা নিবারণ চক্রবর্ত্তীর কথা স্মরণ করিয়া নিজেকে পুরাতন মনে করিয়া বিচলিত হইয়া উঠিলেন সেদিনই বাংলা সাহিত্যে দুর্দ্দিন আসিয়াছে। রবীন্দ্রনাথকে তখন অতি নূতনে পাইয়া বসিল। পুরাতনের বাধা ছিন্ন করিয়া রবীন্দ্রনাথ অভিনব হইতে চাহিলেন। সুরের ওস্তাদের সুর কাটিল, তাল কাটিল।
“পৌষের প্রবাসীর প্রথম কবিতা ‘শুচি’ পুরাতন রবীন্দ্রনাথের সেই সুর কাটা তালকাটা কবিতা। ভীত সন্ত্রস্ত বাঙালী পাঠক এই গুলিকে গদ্য-কবিতা আখ্যা দিয়া রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তাহাদের পূজাভাব জাগ্রত রাখিবার চেষ্টা করে। কিন্তু আসলে এগুলি কি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং কখনও তাহা প্রকাশ করিয়া বলিতে ভরসা পান নাই। অতি আধুনিক কবিতা সম্বন্ধে তাঁহার ‘পরিচয়ে’র প্রবন্ধেও নয়।
“কিন্তু মজ্জায় মজ্জায় যাঁহার সুর, তিনি চেষ্টা করিলেই আধুনিক হইতে পারিবেন কেন ? ‘শুচি’ কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ যেভাবে শুরু করিয়াছিলেন, পংক্তির পর সুরহীন তালহীন পংক্তি সাজাইয়া মডার্ন হইবার যে বাসনা লইয়া তিনি কবিতা লিখিতে বসিয়াছিলেন, চার লাইন শেষ হইতে না হইতেই তাঁহার সে বাসনা বিফল হইয়াছে - পুরাতন রবীন্দ্রনাথ নূতন-হইবার-প্রয়াসী রবীন্দ্রনাথকে পরাজিত করিয়াছেন ; কবিতাটিতে সুর আসিয়া গিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ শুরু করিয়াছিলেন এইরূপ –

     “রামানন্দ পেলেন গুরুর পদ
       সারাদিন তাঁর কাটে জপে তপে
     সন্ধ্যা বেলায় ঠাকুরকে ভোজ্য করেন নিবেদন,
       তার পরে ভাঙে তাঁর উপবাস।”
     ইচ্ছা করেই সুর কাটানো হইয়াছে। কিন্তু তার পরেই –
     “সেদিন মন্দিরে উৎসব
       রাজা এলেন, রাণী এলেন,
     এলেন পন্ডিতেরা দূর দূর থেকে,”

     “ হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পংক্তি পর্য্যন্ত কবিতাটি সুরে ভরপুর হইয়া আছে। এইরূপ অপরূপ সূক্ষ্ণ rythmএর প্রবাহ বজায় রাখিতে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ পারিতেন বলিয়া বিশ্বাস হয় না। এরূপ কবিতা যে-কোনও দেশের কাব্য-সাহিত্যের সম্পদ বলিয়া গণ্য হইতে পারে। ছন্দের কান যাঁহাদের আছে তাঁহারা একটু নজর দিয়া পড়িলেই খুসী হইতে পারিবেন।”

     সব শেষে রয়েছে ‘সম্পাদকীয়’। এখানে সম্পাদক সজনীকান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন – ‘সংবঙ্গ’ (বিশেষ সংবাদ), ‘ক্যালভিন কুলিজ’ (আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ১৯২৩-২৮), ‘ভারতে অস্পৃশ্যতা’, ‘মিলিত ভাষা’ (বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমানদের জন্য একই বাংলা ভাষা) এবং ‘বার্ণার্ড শ’’।

     চৈতন্যদেব চট্টোপাধ্যায় ও নন্দলাল বসুর আঁকা রঙীন ছবিও মুদ্রিত হয়েছে প্রথম সংখ্যায়। প্রথম সংখ্যাটি ছিল ১২৫ পৃষ্ঠার, ‘প্রবাসী’র থেকেও বড়। এই সংখ্যাটি সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে সজনীকান্তকে কম পরিশ্রম করতে হয় নি।

     দীর্ঘ দিন ধরে চলা একটি পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় প্রকাশিত রচনার আলোচনা করা তো সম্ভব নয়। প্রথম সংখ্যাটির একটু বিশদ পরিচয়ের মাধ্যমে পত্রিকার অভিমুখ হয় ত একটু স্পষ্ট হবে।

     দ্বিতীয় বর্ষের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রদত্ত একটি ভাষণের প্রতিরূপ। রয়েছে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘রাত্রি’ ও ‘দিবারাত্রির কাব্য’। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সুকুমার সেনের মূল্যবান প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’। পরিমল গোস্বামী শুধু লেখক ছিলেন না, ফোটোগ্রাফার হিসাবেও তার খ্যাতি ছিল যথেষ্ট। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে বহু দুঃষ্প্রাপ্য ছবি রয়েছে| তার গৃহীত বহু পুরানো ছবি এখনও প্রসঙ্গক্রমে পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। দ্বিতীয় বর্ষে তিনি লিখেছেন ‘ফোটোগ্রাফির কথা (সচিত্র)’।

     ক্ষিতিমোহন সেনের লেখা ‘তানসেন’ নামক প্রবন্ধটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আকবরের সভাসদ গায়ক তানসেন সম্বন্ধে একটি মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন লেখক। কয়েক পংক্তি –

“ কেহ কেহ বলেন, তার পিতার নাম ছিল মকরন্দ পাণ্ডে। মকরন্দ ছিলেন গৌড় ব্রাহ্মণ। আবার কেহ বলেন, তানসেনের পূর্ব্ব নাম ছিল ভরত মিশ্র বা ত্রিলোচন মিশ্র। গোয়ালিয়রের মহারাজা রামনিরঞ্জন গান শুনিয়া মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে তানসেন উপাধি দেন। ......... বাল্যকালে তানসেন নাকি কিছুকাল বৈজু বাওরার কাছে গান শিক্ষা করেন। যাহা হউক, তাঁহার আসল  গানের গুরু ভক্ত হরিদাস স্বামী। .........”

     অপর একটি রচনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সেটি হ’ল যতীন্দ্রমোহন দত্তের ‘নারীহরণ ও পুলিশ’। যথোপযুক্ত পরিসংখ্যান দিয়ে লেখক তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। রচনাটির প্রথম পরিচ্ছেদটি কৌতূহলোদ্দীপক। এখানে উধৃত করা যেতে পারে –     

“ বঙ্গদেশে নারীহরণ ক্রমশঃই বাড়িয়া চলিয়াছে। মুসলমান কর্ত্তৃক ধর্ষিতা হিন্দু নারীর সংখ্যা হিন্দু কর্ত্তৃক ধর্ষিতা মুসলমান নারীর সংখ্যা অপেক্ষা ১৯ গুণ বেশী। দুর্ব্বৃত্তগণের মধ্যে মুসলমানগণের সংখ্যা হিন্দু অপেক্ষা ৩ গুণ বেশী। এইরূপ হইবার সামাজিক কারণসমূহ হিন্দু ও মুসলমান সমাজের নেতারা চিন্তা করিয়া দেখিবেন। কিন্তু বর্ত্তমানে বাঙ্গালা দেশে অত্যধিক মাত্রায় নারীহরণ বৃদ্ধির কারণ, পুলিশের অকর্ম্মণ্যতায় ও অমনোযোগে, অপরাধী দুর্ব্বৃত্তদিগের পলায়নের সুযোগ।”

     দ্বিতীয় বর্ষে গল্প লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অমলা দেবী, জ্যোতির্ম্ময়ী দেবী, কপিলপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, শান্তা দেবী, মণীন্দ্রলাল বসু, হেমচন্দ্র বাগচী, মনোজ বসু, রামপদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।  প্রবন্ধ লেখকদের মধ্যে রয়েছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধায়, নির্মলকুমার বসু। কবিতা রচয়িতাদের কয়েকজন – প্রমথনাথ বিশী, জগদীশ ভট্টাচার্য্য, সজনীকান্ত দাস, নির্ম্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্রমথনাথ বিশীর এক সময়ের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘পদ্মা’র কিয়দংশ ছাপা হয়েছে দ্বিতীয় বর্ষের পত্রিকায়।

     সজনীকান্ত দাসের মতে – “বঙ্গ-সাহিত্যে ‘বঙ্গশ্রী’র সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দান ডক্টর অমূল্যচন্দ্র সেনের ‘বুদ্ধকথা’, তৎপরেই ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দয়পাধ্যায়ের ‘বাংলা দেশের সাধারণ রঙ্গালয়’ এবং সুকুমার সেনের (অধুনা ডক্টর) ‘বাঙ্গালা সাহিত্য গদ্য’ ও ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’। আমার স্বল্প দুই বৎসরের কার্য্যকালের মধ্যেই ‘বঙ্গশ্রী’র এইগুলি কীর্তি। এই চারখানিই পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়া সাহিত্য-পিপাসুদের জ্ঞান-পিপাসা নিবৃত্ত করিয়াছে।” তার আরও মন্তব্য – “ সুকুমার সেন মহাশয়কে বাংলা গদ্য ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় উদ্বুদ্ধ করিবার কৃতিত্ব আমার| তাঁহার ‘বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য’ পুস্তকাকারে আমিই প্রকাশ করি| তিনি আজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে অন্যতম প্রধান গবেষক| তারাশঙ্কর যেমন মৌলিক সৃষ্টি ব্যাপারে ‘বঙ্গশ্রী’র অক্ষয় কীর্তি, ডক্টর সেন তেমনি গবেষণার ব্যাপারে।”   

  যার কর্মদক্ষতা ও পরিচিতিতে পত্রিকার খ্যাতি শুরু থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল সেই সজনীকান্ত দাস ‘বঙ্গশ্রী’র সম্পাদক হিসাবে মাত্র দু’বছর কাজ করেছিলেন| ১৯৩৫ সালের প্রথম দিকে পত্রিকা মালিক সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা না করেই একটি লেখা মনোনীত করে ছাপতে পাঠিয়ে দেন| এতে স্বাভাবিক ভাবেই সম্পাদক সজনীকান্তর সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়| ঘটনাটি নজরে আনলেও সচ্চিদানন্দ মানতে চান নি| এরপর পদত্যাগ করা ছাড়া সজনীকান্তের আর কোনও উপায় ছিল না| পদত্যাগ পত্র পেশ করলে সেটি গৃহীতও হয় সঙ্গে সঙ্গে| প্রায় ২ বছর ২ মাস কাজ করার পর ১লা মাঘ ১৩৪১ বঙ্গাব্দে (১৫ই জানুয়ারী ১৯৩৫) সজনীকান্ত ‘বঙ্গশ্রী’ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন| তখনও মাঘ সংখ্যাটি প্রেস থেকে বেরোয় নি|     

কর্তৃপক্ষের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সজনীকান্তের সময়ে আগত অনেক লেখকই প্রতিবাদ স্বরূপ 'বঙ্গশ্রী' থেকে সরে এসেছেন| অনেকে সাময়িকভাবে সরে এসে আবার ফিরেও গিয়েছেন| তারাশঙ্কর তার 'জমিদারের মেয়ে' 'বঙ্গশ্রী' থেকে সরিয়ে নিয়ে ‘ধাত্রীদেবতা’ নাম দিয়ে 'শনিবারের চিঠি'তে প্রকাশ করেছেন| 'বিচিত্র জগৎ' থেকে বিভূতিভূষণ চলে গিয়েছেন, ভার নিয়েছেন শিবরাম চক্রবর্তী| নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ 'চতুষ্পাঠী' থেকে বিদায় নিলে এসেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র| দু'মাস বন্ধ থাকার পর গোপাল ভট্টাচার্যের 'বিজ্ঞান জগৎ' হাতে নিয়েছেন মোতাহার হোসেন| সজনীকান্তের ভাষায় - "মিষ্টান্নের দোকান হইতে এক ঝাঁক মাছিকে তাড়াইয়া দিলেও নতুন আর এক ঝাঁককে যেমন ঠেকাইয়া রাখা যায় না, এ ক্ষেত্রেও তাহাই হইল| বিজয়রত্ন মজুমদার, শিশির কুমার মিত্রের সঙ্গে হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি অনেকে আসিয়া জুটিলেন| কেবল চিরন্তন সাব-এডিটর কিরণকুমার রায় বোঁটা-মহিমায় অবিচলিত-অব্যাহত রহিয়া গেলেন|" সজনীকান্তের পরে যুগ্মভাবে সম্পাদনার কাজ করেছেন সুরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও বিজয়রত্ন মজুমদার| তৃতীয় বর্ষের 'বঙ্গশ্রী'তে বিভূতিভূষণ এবং চতুর্থ বর্ষে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ ফিরে এসেছেন|

     তৃতীয় বর্ষে অনেক নতুন লেখকদের নাম লক্ষ্য করা যায়, এদের অনেকেই পরবর্তী কালে নাম করেছেন। এই দলে রয়েছেন – সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, বিমল মিত্র, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, রাধারাণী দেবী, সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীমোহন সেনগুপ্ত, শিবরাম চক্রবর্তী, অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়, ফণীন্দ্রলাল পাল, মন্মথনাথ ঘোষ, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, অনুরূপা দেবী, বিমানবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

     ‘আধুনিকতা’র হাতছানি হয়তো তখনই অনুভব করা গিয়েছিল। কিন্তু ‘বঙ্গশ্রী’ কর্ত্তৃপক্ষ পত্রিকার শুদ্ধতা রক্ষায় ছিলেন আপোষহীন। পত্রিকায় কোন মলিনতার ছাপ তিনি লাগতে দেন নি। তৃতীয় বর্ষের শেষ সংখ্যায় পাঠকদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে –

“ ... কালের এমনই পরিহাস যে, এখন মাতৃস্বরূপিনী রমণীর নগ্নচিত্র আমাদের পণ্যদ্রব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং এমন পাঠকও আছেন, যাঁহারা ওই নিগ্ন চিত্রকেই উপাদেয় বলিয়া মনে করিয়া থাকেন।...... উপন্যাস এবং গল্প-লেখকগণ প্রায়সই এমন হইয়া দাঁড়াইয়াছেন যে, তাঁহাদিগের পক্ষে নগ্নতা বাদ দিয়া কোনও চিত্র অঙ্কিত করা দুঃসাধ্য হইয়া পড়িয়াছে। কাজেই বঙ্গশ্রীর পক্ষে সম্পূর্ণ নগ্নতাহীন গল্প ও উপন্যাস সংগ্রহ করা আপাতত কষ্টকর বটে, কিন্তু নগ্নচিত্র যথাসাধ্য বাদ দিয়া মাসিক পত্রের সাফল্য লাভ করিবার চেষ্টা করা বঙ্গশ্রীর বৈশিষ্ট্য। যাঁহারা মাতৃরূপিনী রমণির নগ্নচিত্র পাইলে পরিতৃপ্ত হন, বঙ্গশ্রী তাঁহাদের অভিলাষ পূরণ করিতে অসমর্থ। ...।”

     “ হইতে আরম্ভ করিয়া শেষ পংক্তি পর্য্যন্ত কবিতাটি সুরে ভরপুর হইয়া আছে। এইরূপ অপরূপ সূক্ষ্ণ rythmএর প্রবাহ বজায় রাখিতে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ পারিতেন বলিয়া বিশ্বাস হয় না। এরূপ কবিতা যে-কোনও দেশের কাব্য-সাহিত্যের সম্পদ বলিয়া গণ্য হইতে পারে। ছন্দের কান যাঁহাদের আছে তাঁহারা একটু নজর দিয়া পড়িলেই খুসী হইতে পারিবেন।”

     সব শেষে রয়েছে ‘সম্পাদকীয়’। এখানে সম্পাদক সজনীকান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন – ‘সংবঙ্গ’ (বিশেষ সংবাদ), ‘ক্যালভিন কুলিজ’ (আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ১৯২৩-২৮), ‘ভারতে অস্পৃশ্যতা’, ‘মিলিত ভাষা’ (বাঙালী হিন্দু ও বাঙালী মুসলমানদের জন্য একই বাংলা ভাষা) এবং ‘বার্ণার্ড শ’’।

     চৈতন্যদেব চট্টোপাধ্যায় ও নন্দলাল বসুর আঁকা রঙীন ছবিও মুদ্রিত হয়েছে প্রথম সংখ্যায়। প্রথম সংখ্যাটি ছিল ১২৫ পৃষ্ঠার, ‘প্রবাসী’র থেকেও বড়। এই সংখ্যাটি সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে সজনীকান্তকে কম পরিশ্রম করতে হয় নি।
     দীর্ঘ দিন ধরে চলা একটি পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় প্রকাশিত রচনার আলোচনা করা তো সম্ভব নয়। প্রথম সংখ্যাটির একটু বিশদ পরিচয়ের মাধ্যমে পত্রিকার অভিমুখ হয় ত একটু স্পষ্ট হবে।

     দ্বিতীয় বর্ষের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রদত্ত একটি ভাষণের প্রতিরূপ। রয়েছে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘রাত্রি’ ও ‘দিবারাত্রির কাব্য’। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে সুকুমার সেনের মূল্যবান প্রবন্ধ ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’। পরিমল গোস্বামী শুধু লেখক ছিলেন না, ফোটোগ্রাফার হিসাবেও তার খ্যাতি ছিল যথেষ্ট। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে বহু দুঃষ্প্রাপ্য ছবি রয়েছে| তার গৃহীত বহু পুরানো ছবি এখনও প্রসঙ্গক্রমে পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। দ্বিতীয় বর্ষে তিনি লিখেছেন ‘ফোটোগ্রাফির কথা (সচিত্র)’।

     ক্ষিতিমোহন সেনের লেখা ‘তানসেন’ নামক প্রবন্ধটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আকবরের সভাসদ গায়ক তানসেন সম্বন্ধে একটি মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন লেখক। কয়েক পংক্তি – “ কেহ কেহ বলেন, তার পিতার নাম ছিল মকরন্দ পাণ্ডে। মকরন্দ ছিলেন গৌড় ব্রাহ্মণ। আবার কেহ বলেন, তানসেনের পূর্ব্ব নাম ছিল ভরত মিশ্র বা ত্রিলোচন মিশ্র। গোয়ালিয়রের মহারাজা রামনিরঞ্জন গান শুনিয়া মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে তানসেন উপাধি দেন। ......... বাল্যকালে তানসেন নাকি কিছুকাল বৈজু বাওরার কাছে গান শিক্ষা করেন। যাহা হউক, তাঁহার আসল  গানের গুরু ভক্ত হরিদাস স্বামী। .........”

     অপর একটি রচনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। সেটি হ’ল যতীন্দ্রমোহন দত্তের ‘নারীহরণ ও পুলিশ’। যথোপযুক্ত পরিসংখ্যান দিয়ে লেখক তার বক্তব্য তুলে ধরেছেন। রচনাটির প্রথম পরিচ্ছেদটি কৌতূহলোদ্দীপক। এখানে উধৃত করা যেতে পারে –
     “ বঙ্গদেশে নারীহরণ ক্রমশঃই বাড়িয়া চলিয়াছে। মুসলমান কর্ত্তৃক ধর্ষিতা হিন্দু নারীর সংখ্যা হিন্দু কর্ত্তৃক ধর্ষিতা মুসলমান নারীর সংখ্যা অপেক্ষা ১৯ গুণ বেশী। দুর্ব্বৃত্তগণের মধ্যে মুসলমানগণের সংখ্যা হিন্দু অপেক্ষা ৩ গুণ বেশী। এইরূপ হইবার সামাজিক কারণসমূহ হিন্দু ও মুসলমান সমাজের নেতারা চিন্তা করিয়া দেখিবেন। কিন্তু বর্ত্তমানে বাঙ্গালা দেশে অত্যধিক মাত্রায় নারীহরণ বৃদ্ধির কারণ, পুলিশের অকর্ম্মণ্যতায় ও অমনোযোগে, অপরাধী দুর্ব্বৃত্তদিগের পলায়নের সুযোগ।”

     দ্বিতীয় বর্ষে গল্প লিখেছেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, অমলা দেবী, জ্যোতির্ম্ময়ী দেবী, কপিলপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য, শান্তা দেবী, মণীন্দ্রলাল বসু, হেমচন্দ্র বাগচী, মনোজ বসু, রামপদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।  প্রবন্ধ লেখকদের মধ্যে রয়েছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধায়, নির্মলকুমার বসু। কবিতা রচয়িতাদের কয়েকজন – প্রমথনাথ বিশী, জগদীশ ভট্টাচার্য্য, সজনীকান্ত দাস, নির্ম্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। প্রমথনাথ বিশীর এক সময়ের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘পদ্মা’র কিয়দংশ ছাপা হয়েছে দ্বিতীয় বর্ষের পত্রিকায়।

     সজনীকান্ত দাসের মতে – “বঙ্গ-সাহিত্যে ‘বঙ্গশ্রী’র সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দান ডক্টর অমূল্যচন্দ্র সেনের ‘বুদ্ধকথা’, তৎপরেই ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দয়পাধ্যায়ের ‘বাংলা দেশের সাধারণ রঙ্গালয়’ এবং সুকুমার সেনের (অধুনা ডক্টর) ‘বাঙ্গালা সাহিত্য গদ্য’ ও ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’। আমার স্বল্প দুই বৎসরের কার্য্যকালের মধ্যেই ‘বঙ্গশ্রী’র এইগুলি কীর্তি। এই চারখানিই পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়া সাহিত্য-পিপাসুদের জ্ঞান-পিপাসা নিবৃত্ত করিয়াছে।” তার আরও মন্তব্য – “ সুকুমার সেন মহাশয়কে বাংলা গদ্য ও সাহিত্যের ইতিহাস রচনায় উদ্বুদ্ধ করিবার কৃতিত্ব আমার| তাঁহার ‘বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য’ পুস্তকাকারে আমিই প্রকাশ করি| তিনি আজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস সম্পর্কে অন্যতম প্রধান গবেষক| তারাশঙ্কর যেমন মৌলিক সৃষ্টি ব্যাপারে ‘বঙ্গশ্রী’র অক্ষয় কীর্তি, ডক্টর সেন তেমনি গবেষণার ব্যাপারে।”

     যার কর্মদক্ষতা ও পরিচিতিতে পত্রিকার খ্যাতি শুরু থেকেই ছড়িয়ে পড়েছিল সেই সজনীকান্ত দাস ‘বঙ্গশ্রী’র সম্পাদক হিসাবে মাত্র দু’বছর কাজ করেছিলেন| ১৯৩৫ সালের প্রথম দিকে পত্রিকা মালিক সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা না করেই একটি লেখা

মনোনীত করে ছাপতে পাঠিয়ে দেন| এতে স্বাভাবিক ভাবেই সম্পাদক সজনীকান্তর সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়| ঘটনাটি নজরে আনলেও সচ্চিদানন্দ মানতে চান নি| এরপর পদত্যাগ করা ছাড়া সজনীকান্তের আর কোনও উপায় ছিল না| পদত্যাগ পত্র পেশ করলে সেটি গৃহীতও হয় সঙ্গে সঙ্গে| প্রায় ২ বছর ২ মাস কাজ করার পর ১লা মাঘ ১৩৪১ বঙ্গাব্দে (১৫ই জানুয়ারী ১৯৩৫) সজনীকান্ত ‘বঙ্গশ্রী’ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন| তখনও মাঘ সংখ্যাটি প্রেস থেকে বেরোয় নি|

কর্তৃপক্ষের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে সজনীকান্তের সময়ে আগত অনেক লেখকই প্রতিবাদ স্বরূপ 'বঙ্গশ্রী' থেকে সরে এসেছেন| অনেকে সাময়িকভাবে সরে এসে আবার ফিরেও গিয়েছেন| তারাশঙ্কর তার 'জমিদারের মেয়ে' 'বঙ্গশ্রী' থেকে সরিয়ে নিয়ে ‘ধাত্রীদেবতা’ নাম দিয়ে 'শনিবারের চিঠি'তে প্রকাশ করেছেন| 'বিচিত্র জগৎ' থেকে বিভূতিভূষণ চলে গিয়েছেন, ভার নিয়েছেন শিবরাম চক্রবর্তী| নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ 'চতুষ্পাঠী' থেকে বিদায় নিলে এসেছেন প্রেমেন্দ্র মিত্র| দু'মাস বন্ধ থাকার পর গোপাল ভট্টাচার্যের 'বিজ্ঞান জগৎ' হাতে নিয়েছেন মোতাহার হোসেন| সজনীকান্তের ভাষায় - "মিষ্টান্নের দোকান হইতে এক ঝাঁক মাছিকে তাড়াইয়া দিলেও নতুন আর এক ঝাঁককে যেমন ঠেকাইয়া রাখা যায় না, এ ক্ষেত্রেও তাহাই হইল| বিজয়রত্ন মজুমদার, শিশির কুমার মিত্রের সঙ্গে হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব, সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি অনেকে আসিয়া জুটিলেন| কেবল চিরন্তন সাব-এডিটর কিরণকুমার রায় বোঁটা-মহিমায় অবিচলিত-অব্যাহত রহিয়া গেলেন|" সজনীকান্তের পরে যুগ্মভাবে সম্পাদনার কাজ করেছেন সুরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও বিজয়রত্ন মজুমদার| তৃতীয় বর্ষের 'বঙ্গশ্রী'তে বিভূতিভূষণ এবং চতুর্থ বর্ষে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ ফিরে এসেছেন|

তৃতীয় বর্ষে অনেক নতুন লেখকদের নাম লক্ষ্য করা যায়, এদের অনেকেই পরবর্তী কালে নাম করেছেন। এই দলে রয়েছেন – সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, বিমল মিত্র, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, রাধারাণী দেবী, সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, প্যারীমোহন সেনগুপ্ত, শিবরাম চক্রবর্তী, অসমঞ্জ মুখোপাধ্যায়, ফণীন্দ্রলাল পাল, মন্মথনাথ ঘোষ, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, অনুরূপা দেবী, বিমানবিহারী মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

‘আধুনিকতা’র হাতছানি হয়তো তখনই অনুভব করা গিয়েছিল। কিন্তু ‘বঙ্গশ্রী’ কর্ত্তৃপক্ষ পত্রিকার শুদ্ধতা রক্ষায় ছিলেন আপোষহীন। পত্রিকায় কোন মলিনতার ছাপ তিনি লাগতে দেন নি। তৃতীয় বর্ষের শেষ সংখ্যায় পাঠকদের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে – “ ... কালের এমনই পরিহাস যে, এখন মাতৃস্বরূপিনী রমণীর নগ্নচিত্র আমাদের পণ্যদ্রব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে এবং এমন পাঠকও আছেন, যাঁহারা ওই নিগ্ন চিত্রকেই উপাদেয় বলিয়া মনে করিয়া থাকেন।...... উপন্যাস এবং গল্প-লেখকগণ প্রায়সই এমন হইয়া দাঁড়াইয়াছেন যে, তাঁহাদিগের পক্ষে নগ্নতা বাদ দিয়া কোনও চিত্র অঙ্কিত করা দুঃসাধ্য হইয়া পড়িয়াছে। কাজেই বঙ্গশ্রীর পক্ষে সম্পূর্ণ নগ্নতাহীন গল্প ও উপন্যাস সংগ্রহ করা আপাতত কষ্টকর বটে, কিন্তু নগ্নচিত্র যথাসাধ্য বাদ দিয়া মাসিক পত্রের সাফল্য লাভ করিবার চেষ্টা করা বঙ্গশ্রীর বৈশিষ্ট্য। যাঁহারা মাতৃরূপিনী রমণির নগ্নচিত্র পাইলে পরিতৃপ্ত হন, বঙ্গশ্রী তাঁহাদের অভিলাষ পূরণ করিতে অসমর্থ। ...।”

     চতুর্থ বর্ষের বঙ্গশ্রীতে লিখেছেন অনেকে ; এদের মধ্যে রয়েছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, মনোজ বসু, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার দেব সরকার, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, মাণিক বন্দোপাধ্যায়, সরোজকুমার রায়চৌধুরী, বিমলচন্দ্র ঘোষ, শুদ্ধসত্ব বসু, অমলা দেবী, প্রতিভা দেবী, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, রেজাউল করিম, যুবনাশ্ব (মণীশ ঘটক), প্রতিমা দেবী, চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়| এই বছরেই শুরু হয়েছে প্রমথনাথ বিশীর ধারাবাহিক উপন্যাস 'জোড়াদীঘির চৌধুরী পরিবার'| বিখ্যাত ব্যক্তিদের সম্বন্ধে আলোচনা সম্বলিত মন্মথনাথ ঘোষের ‘ঈশানচন্দ্র’ অবশ্যাই একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন| ‘সচিত্র বিজ্ঞান জগৎ’ লিখেছেন সুধাংশুপ্রকাশ চৌধুরী| অমূল্যচন্দ্র সেন অনেক সচিত্র বিদেশ ভ্রমণ কাহিনী শুনিয়েছেন; কবিতা লিখেছেন অপূর্ব্বকৃষ্ণ ভট্টাচর্য্য, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, শুদ্ধসত্ত্ব বসু প্রমুখেরা| বৈচিত্র বজায় রাখতে ‘ভারতে ফলিত জ্যোতিষ’ লিখেছেন হাজারীপ্রসাদ দ্বিবেদী| প্রসঙ্গত বলা যায় পত্রিকাটির একটি সাপ্তাহিক সংস্করণ ‘সাপ্তাহিক বঙ্গশ্রী’ নামে প্রকাশিত হত ৯০ নং লোয়ার সারকুলার রোডের কার্যালয় থেকেই| পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপ্তি প্রকাশিত হযেছে – “ যদি কেহ আপনার জন্য প্রত্যেক সংবাদপত্রের সারবস্তু সংগ্রহ করিয়া দেয় আপনি কি সুখী হন না ? ‘সাপ্তাহিক বঙ্গশ্রী’ আপনার জন্য প্রতি সপ্তাহে এই কাজ করিতেছে|”  মূল্য ঘোষিত হয়েছে প্রতি সংখ্যার জন্য এক আনা ও বার্ষিক তিন টাকা|   

     পঞ্চম বর্ষে অনেক প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয়ও লিখেছেন সচ্চিদানদ ভট্টাচর্য্য| ব্যবসায়িক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থেকেও তার বিদ্যোৎসাহিতা, চিন্তার গভীরতা ও বিষবস্তু নির্বাচন প্রশংসার দাবী রাখে| প্রেমেন্দ্র মিত্র, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রমুখেরা ‘চতুষ্পাঠী’ চালিয়েছেন| ‘বিজ্ঞান জগৎ’ উন্মোচন করেছেন শুধাংশুপ্রকাশ চৌধুরী| তারাপদ রাহা লিখেছেন ‘যোগিনীর মাঠ’| গল্প লিখেছেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়| ইউরোপের গল্প ধারাবাহিকভাবে শুনিয়েছেন অমূল্যচন্দ্র সেন| মাণিক বন্দোপাধ্যায় ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন ‘অমৃতস্য পুত্রাঃ’| পুস্তক ও পত্রিকার সমালোচনাও বেরিয়েছে নিয়মিত| দেশ বিদেশের সংবাদ ও আলোচনা নিয়ে বেরিয়েছে ‘সংবাদ ও মন্তব্য’|

     ১০ম বর্ষের 'বঙ্গশ্রী'তে দেখা যাবে পুরানো লেখকদের সঙ্গে লেখা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন অপেক্ষাকৃত নতুন লেখকেরা| তখনই প্রতিষ্ঠিত বা পরে যারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, শুদ্ধসত্ত্ব বসু, অপূর্ব্বকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য, সরোজনাথ ঘোষ, রবিদাস সাহা রায়, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, বাণীকুমার, কালিদাস রায়, দিলীপকুমার রায় প্রভৃতি লেখকেরা| স্পষ্টতই সজনীকান্তের সময়ে 'বঙ্গশ্রী'র যে জৌলুষ ছিল তা অনেকটা ফিকে হয়ে গিয়েছে| সাহিত্যিকদের নিয়মিত আড্ডা বা বৈঠক উঠে যাওয়াই কি এর কারণ? সজনীকান্ত যা পেরেছিলেন তার পরবর্তী সম্পাদকেরা তা তেমন ভাবে পারেন নি| আগেই বলা হযেছে সজনীকান্তের পরে সম্পাদক হযেছেন সুরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও বিজয়রত্ন মজুমদার| কিছুদিন সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য্য নিজেই পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, সম্পাদকীয় লিখেছেন| এর পরে এসেছেন কিরণকুমার রায় এবং সহ-সম্পাদক পদে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়| তবে মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় বেশি দিন টেঁকেন নি। পঁয়ষট্টি টাকা মাস-মাইনেতে ঢূকে দীর্ঘ দু’বছর ধ’রে একই বেতন থাকায় কর্ত্তৃপক্ষের সঙ্গে তার মনোমালিন্য হয় এবং ১৯৩৯ সালের প্রথমেই ইস্তফা দিয়ে চলে যান। পরে এসেছেন রসিকচন্দ্র ভট্টাচার্য্য| সচ্চিদানন্দের মৃত্যু হয় ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দের ২০শে ফেব্রুয়ারী; এর পরে 'বঙ্গশ্রী'র উপর দুর্যোগ নেমে আসে|

     রসিকচন্দ্রের পরে সম্পাদক হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম 'গিরীশ অধ্যাপক' হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত| তিনি ছিলেন একাধারে সাহিত্যিক, অভিনেতা ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সহকারী আইনজীবী| এক সময়ে সচ্চিদানন্দ ভট্টাচার্য্যের শিক্ষকও ছিলেন তিনি| এই হিসাবে সচ্চিদানন্দ-পুত্র দেবেন্দ্রনাথের তিনি ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র| হেমেন্দ্রনাথের সুদক্ষ পরিচালনায় 'বঙ্গশ্রী'র ঋত-শ্রী বহুলাংশে ফিরে আসে| নতুন লেখকদের পাশাপাশি লিখেছেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়, শশিভূষণ দাশগুপ্ত, হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমথনাথ ঘোষ, ইন্দিরা দেবী, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, হাসিরাশি দেবী, গজেন্দ্রকুমার মিত্র, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত প্রমুখ লেখকেরা ; এ ছাড়া হেমেন্দ্রনাথ নিজে ত ছিলেনই| ১৩৫৭ সাল অবধি 'বঙ্গশ্রী' সম্পাদনা করেছেন হেমেন্দ্রনাথ| ১৩৫০-এর মাঘ সংখ্যাটি নট-গুরু গিরিশচন্দ্র ঘোষের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ‘গিরিশ সংখ্যা’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

     হেমেন্দ্রনাথের পর সম্পাদক হন মেট্রোপলিটন ইন্সিওরেন্স কোম্পানীর সেক্রেটারি অমূল্যভূষণ চট্টোপাধ্যায়; তিনি বহু বছর ‘বঙ্গশ্রী’ প্রকাশনায় সহায়তা করেছেন| ঙ্কিন্তু চেষ্টা সত্বেও 'বঙ্গশ্রী'কে বাঁচিয়ে রাখা যায় নি| ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের পরে পত্রিকাটি আর বেরোয় নি| প্রায় একটানা কুড়ি বছর ধরে বহুচিত্র শোভিত 'বঙ্গশ্রী' তার বৈচিত্র ও বর্ণময়তা দিয়ে বঙ্গবাসীকে তৃপ্ত করেছে| ঘাটতি তেমন ছিল না। কিন্তু তবুও যেন সাময়িক পত্রিকা নিয়ে আলোচনা ও নাম উল্লেখের ক্ষেত্রে 'বঙ্গশ্রী' একটু পেছনের সারিতে রয়ে গেছে| সমলালীন 'প্রবাসী' ও 'ভারতবর্ষ'’র কৌলিণ্য ও প্রতিষ্ঠাই কি এর জন্য দায়ী ?
          


চিত্র – ১ : ‘উপাসনা’ পত্রিকার একটি আখ্যাপত্র।।

চিত্র – ২ : ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠার প্রতিলিপি।

    চিত্র – ৩ : ‘বঙ্গশ্রী’তে প্রকাশিত নন্দলাল বসুর আঁকা ‘নীলকন্ঠ’ নামাঙ্কিত ছবি।


   চিত্র – ৪ : প্রখ্যাত শিল্পী দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীর আঁকা ছবি ‘প্রাসাদ ও কুটীর’।       


লেখক পরিচিতি: বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর (IIEST,shibpur) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.