পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৫
অবোধবন্ধু
দীপক সেনগুপ্ত
‘অবোধবন্ধু’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় ১২৭০ বঙ্গাব্দের বৈশাখ (১৮৬২, মে ? ) মাসে । সম্পাদক ছিলেন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ । পত্রিকাটি সম্বন্ধে ‘সোমপ্রকাশে’র সমালোচনা -
“ অবোধবন্ধু কলিকাতা স্কুল বুক যন্ত্রে মুদ্রিত হইতেছে । আমরা ইহার দুই খণ্ড পাইয়াছি । লেখা মন্দ হইতেছে না । প্রতি খণ্ডের মূল্য অর্দ্ধ আনা।” (৬ই জুলাই ১৮৬৩)
“ অবোধবন্ধু তৃতীয় ও চতুর্থ সংখ্যা । এই চতুর্থ ভাগে হেয়ার সাহেবের জীবন চরিত আছে । লেখা ক্রমশঃ উত্তম হইতেছে।” (৩১শে আগস্ট ১৮৬৩)।
এর পরে পত্রিকাটি কিছুদিন বন্ধ থাকে এবং ১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে (ফাল্গুন ১২৭৩ বঙ্গাব্দ ) পুনঃপ্রকাশিত হয়। ফাল্গুন মাসের সংখ্যাটি ১ম খণ্ড ১ম সংখ্যা হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল । ছ’পংক্তির একটি কবিতা দিয়ে যাত্রা শুরু। কবিতাটি ছিল -
“ স্বদেশের যে প্রকারে হতে পরে হিত
সাধ্যমত চেষ্টা করা সবার উচিত ।
তিল সম হেন কাজ যদি মনে লয়,
তথাচ নিরস্ত থাকা, যুক্তিযুক্ত নয়;
কি জানি সহস্র মাঝে যদি কোন জন
সামান্য সে ক্ষুদ্র কাজে উপকৃত হন।”
এর পরেই সম্পাদক কিছুদিন পত্রিকা প্রকাশ না হবার প্রসঙ্গে লিখেছেন -
“ আরম্ভ
সূর্য্য যেমন অস্তমিত হইলে আর তাহাকে দেখিতে পাওয়া যায় না, সেইরূপ এই অবোধবন্ধু এযাবৎ কাল পর্য্যন্ত পাঠকবর্গের নিকট অদৃশ্যভাবে অবস্থিতি করিতেছিল। এক্ষণে তাহা পুনর্ব্বার সর্ব্বসমীপে উদয় হইতেছে, এবং পূর্ব্বাপেক্ষা প্রখরতর কর বিস্তার করিয়া যাহাতে তমসাচ্ছন্ন অজ্ঞানান্ধ মনকে সমুজ্জল জ্ঞানালোক দ্বারা উদ্দীপ্ত করে তাহাই আমাদের একান্ত বাসনা। শীতকালে যখন শীতের প্রাদুর্ভাব অধিক হয়, যখন শীতল বায়ু বহমান হইয়া সকলকেই কম্পিত করিতে থাকে, তখন যেমন ভানুর তীক্ষ্ণতর কিরণ প্রাণী দেহের শীত নিবারণ করে, সেইরূপ এই অবোধ-বন্ধু, যদ্যপি কোন একটি বালক বালিকা কিম্বা অন্তঃপুরস্থ মহিলাগণের অথবা অল্প বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিব্যূহের অন্তরতম গভীরতম প্রদেশে স্বীয় রশ্মিজাল বিস্তার করত দুশ্ছেদ্য ও অভেদ্য কুসংস্কার ও অজ্ঞানতাকে বিদূরিত করে, তাহা হইলে আমাদের পরিশ্রম ও যত্নের যথেষ্ট পুরস্কার হইবে। এতদ্ভিন্ন এই ক্ষুদ্র অবোধ-বন্ধু যদি ক্ষণকালের নিমিত্ত বিজ্ঞসমাজের চিত্তাকর্ষণ করিতে পারে, আমরা আশাতীত ফল লাভ করিব।”
এটির প্রথম খণ্ড শেষ হয় ১২৭৪-এর মাঘ মাসে; এর পর ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যা প্রকাশিত না হয়ে বৈশাখ থেকে দ্বিতীয় ভাগ (বর্ষ বা খণ্ড নয় ) শুরু হয়। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক যোগেন্দ্রনাথ ঘোষ ; বছর খানেক পরে, ১২৭৫ বঙ্গাব্দের মাঘ মাস থেকে, কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী পত্রিকার স্বত্বাধিকারী হন। এই মর্মে যে বিজ্ঞাপনটি ১২৭৬-এর বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল সেটি হল -
“ ১২৭৬ সাল, ১৫ই বৈশাখ।
আমি ১২৭৫ সালের পৌষ মাসের সংখ্যা অবধি অবোধবন্ধুর সত্বাধিকার শ্রীযুক্ত বাবু বিহারিলাল চক্রবর্ত্তীকে প্রদান করিয়াছি। অতএব গ্রাহকগণ অবোধবন্ধুর সমুদয় প্রাপ্য টাকা এবং যাবতীয় চিঠিপত্র তাঁহার নামে নিম্নলিখিত ঠিকানায় পাঠাইবেন।
কলিকাতা, চিতপুররোড নিমতলা ষ্ট্রীট,
রায়লেন জোড়াবাগান, ৫নং বাটী
শ্রীযোগেন্দ্রনাথ ঘোষ।
অবোধবন্ধুর ভূতপূর্ব্ব সত্বাধিকারী।”
‘অবোধবন্ধু’র ২য় ভাগ শুরু হয় ১২৭৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে। যোগেন্দ্রনাথ দ্বিতীয় ভাগের ১ম সংখ্যার শুরুতেই ‘নব-বর্ষ’ উপলক্ষে লিখেছেন :
“ ১২৭৩ সালের ফাল্গুন মাসে অবোধ-বন্ধু প্রকাশিত হইয়া গত ১২৭৪ সালের মাঘ মাসে তাহার এক বর্ষ পূর্ণ হয়। এক্ষণে নানা কারণ ও অসুবিধাবশতঃ বর্ত্তমান বর্ষের প্রথম মাস হইতে অবোধবন্ধুর দ্বিতীয় বর্ষ আরম্ভ হইল। ইহার ক্ষুদ্র কলেবর পরিবর্ত্তন করা আবশ্যক বোধে আমরা যেরূপ করিবার মানস করিয়াছিলাম তাহা রহিত করিয়া এইরূপ আকারে প্রকাশ করিলাম। .... উপসংহার কালে, যে সকল ভ্রাতা ভগিনী গত বর্ষে আমাদিগকে সাহায্য প্রদান করিয়াছেন, তাঁহাদিগের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। এবং আমার পরম বন্ধু শ্রীযুক্ত বাবু বিহারীলাল মহাশয়ের নাম এস্থলে উল্লেখ না করিয়া থাকিতে পারিলাম না। তিনি অবোধবন্ধুর জন্য এরূপ শারীরিক যত্ন ও পরিশ্রম স্বীকার করিয়াছেন যে অবোধবন্ধু চিরকাল তাঁহার নিকট কৃতজ্ঞতা পাশে বদ্ধ রহিল।”
পত্রিকার নাম পত্রিকার প্রারম্ভে বড় অক্ষরে মাঝে হাইফেন দিয়ে (অবোধ -বন্ধু)লেখা হত, কিন্তু ভেতরের পৃষ্ঠায় যুক্তভাবে অবোধবন্ধু মুদ্রিত হত। ১২৭৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাস থেকে (২য় ভাগ ১ম সংখ্যা ) পত্রিকার কণ্ঠে নিম্নলিখিত শ্লোকটি লেখা থাকত -
“ করবদরসদৃশমখিলং ভুবনতলং যৎপ্রসাদতঃ কবয়ঃ ।
পশ্যন্তি সূক্ষ্মমতয়ঃ সা জয়তি সরস্বতী দেবী ।।”
প্রথম সংখ্যায় (১২৭৩-এর ফাল্গুন) যে লেখা গুলি প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলি হল -
পত্রিকার কণ্ঠদেশের কবিতা, আরম্ভ, বায়ু, ধৈর্য্য (কবিতা), মহত্ত্বের পথ, ব্যাঙ্গের ছাতি, বৃক্ষ পত্রের উক্তি (কবিতা), ধর্ম্মাচার্য্য (ধারাবাহিক প্রবন্ধ)।
তবে পত্রিকার নাম ‘অবোধবন্ধু’ হলেও এবং অনেকে এটিকে ছোটদের পত্রিকা হিসাবে চিহ্নিত করলেও, এই পত্রিকাটি সর্বতোভাবে অবোধ শিশুদের বা বালকদেরও বন্ধু ছিল এ কথা বলা ঠিক হবে না। ‘অপূর্ব্ব পতন’, ‘বিরহিনী’, ‘পতির অত্যাচার’ ইত্যাদি রচনা ছোটদের উপযোগী নয়। ‘অপূর্ব্ব পতন’-এর কিছুটা অংশ দেখে নেওয়া যাক। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১২৭৪-এর আষাঢ় সংখ্যায়।
“ এখন কোথায় সেই পতি প্রতি মতি ,
পতিধ্যান,পতিপ্রাণ,পতিমাত্র গতি ;
হায়রে কোথায় সেই পতি ভালবাসা,
সাধিতে পতির প্রিয় অতৃপ্ত লালসা ?
কেবল কি সে সকল বচন চাতুরী ,
মধু মধু মধুমাখা মিচিরির ছুরী ?
দেখেছিনু যে প্রণয় সে কি সত্য নয় ?
হায় তবে আজো কেন দিন রাত হয়।
কিম্বা সে প্রণয় ছিল বয়স অধীন,
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হয়েছে বিলীন ?
অথবা সে প্রেম ছিল সম্ভোগের কোলে,
সম্ভোগ শৈথিল্যে বুঝি এবে গেছে চলে ?”
উপরের লেখাটি নিশ্চয়ই ছোটদের উপযোগী নয়।
কৃষ্ণকমল ভাট্টাচার্য্য, বিহারীলাল চক্রবর্তী ‘অবোধবন্ধু’-তে নিয়মিত লিখতেন। পত্রিকাটিতে গ্রন্থ সমালোচনাও করা হত এবং এতে ‘বামাগণের রচনা’ নামে একটি বিভাগ ছিল। কৈলাসবাসিনী দেবীর গদ্যে-পদ্যে রচিত ‘বিশ্বশোভা’ গ্রন্থের (১৮৬৯) প্রশংসা এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে পত্রিকাটি পুরোপুরি শিশুপাঠ্য না হলেও রবীন্দ্রনাথের একটি মন্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। পত্রিকাটি যখন প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ তখন নিতান্তই বালক; জীবনস্মৃতিতে কবি লিখেছেন -
“ বাল্যকালে আর-একটি ছোট কাগজের পরিচয় লাভ করিয়াছিলাম। তাহার নাম অবোধবন্ধু। ইহার আবাঁধা খণ্ডগুলি বড়দাদার আলমারি হইতে বাহির করিয়া তাঁহারই দক্ষিণদিকের ঘরে খোলা দরজার কাছে বসিয়া বসিয়া কতদিন পড়িয়াছি। এই কাগজেই বিহারীলাল চক্রবর্তীর কবিতা প্রথম পড়িয়াছিলাম। তখনকার দিনের সকল কবিতার মধ্যে তাহাই আমার সবচেয়ে মন হরণ করিয়াছিল। তাঁহার সেই-সব কবিতা সরল বাঁশির সুরে আমার মনের মধ্যে মাঠের এবং বনের গান বাজাইয়া তুলিত। এই অবোধবন্ধু কাগজেই বিলাতি পৌলবর্জিনী গল্পের সরস বাংলা অনুবাদ পড়িয়া কত চোখের জল ফেলিয়াছি তাহার ঠিকানা নাই । আহা,সে কোন সাগরের তীর ! সে কোন্ সমুদ্রসমীরকম্পিত নারিকেলের বন। ছাগল-চরা সে কোন পাহাড়ের উপত্যকা ! কলিকাতা শহরের দক্ষিণের বারান্দায় দুপুরের রৌদ্রে সে কী মধুর মরীচিকা বিস্তীর্ণ হইত ! আর সেই মাথায়-রঙীন-রুমাল-পরা বর্জিনীর সঙ্গে সেই নির্জন দ্বীপের শ্যামল বনপথে একটি বাঙালি বালকের কি প্রেমই জন্মিয়াছিল !”
কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য ‘অবোধবন্ধু’র অন্যতম প্রধান লেখক ছিলেন। তিনি ‘পল ভার্জিনিয়া’ ফরাসি থেকে অনুবাদ করেছিলেন ‘পৌল ভর্জ্জীনী’ নামে। এটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় ১২৭৫ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যা থেকে। রচনাটি বালক রবীন্দ্রনাথের মনে দাগ কেটেছিল নিশ্চয়ই। তবে বড় হয়েও ‘অবোধবন্ধু’কে তিনি ভোলেন নি। ১৩০১ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যায় ‘সাধনা’ পত্রিকায় তার মন্তব্য :
“ বাঙ্গালা ভাষায় বোধ করি সেই প্রথম মাসিক পত্র বাহির হইয়াছিল যাহার রচনার মধ্যে একটা স্বাদবৈচিত্র পাওয়া যাইত । বর্ত্তমান বঙ্গ-সাহিত্যের প্রাণসঞ্চয়ের ইতিহাস যাঁহারা পর্য্যালোচনা করিবেন তাঁহারা অবোধবন্ধুকে উপেক্ষা করিতে পারিবেন না । বঙ্গদর্শনকে যদি আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের প্রভাতসূর্য্য বলা যায় তবে ক্ষুদ্রায়তন অবোধবন্ধুকে প্রত্যূষের শুকতারা বলা যাইতে পারে।”
আজকাল অভিনেতা ও অভিনেত্রীর উভয়কেই অভিনেতা (actor) হিসাবে উল্লেখ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এই লিঙ্গগত বিভেদ না করার প্রচলন কবে থেকে চালু হয় বলা শক্ত, তবে ‘অবোধবন্ধু’-র সময়েও যে এটি প্রচলিত ছিল সে সম্বন্ধে পত্রিকাটির সম্পাদকের একটি বক্তব্য খুবই কৌতূককর এবং বর্তমান কালের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ :
“আমরা স্ত্রীলোককে গ্রন্থকর্ত্রী না বলিয়া গ্রন্থকার বলিয়াছি তাহাতে পাছে পাঠকবর্গ ভাবেন যে আমরা ব্যাকরণের স্ত্রী-প্রত্যয় প্রকরণ পড়ি নাই, এই আশঙ্কায় এই ভাষ্য লিখিয়া দিতে হইল। আমাদের বক্তব্য এই যে, আজি কালি ইয়ুরোপ ও আমেরিকাতে স্ত্রীজাতি ও পুরুষ জাতির ক্ষমতা লইয়া যে বাদানুবাদ চলিতেছে আমরা সে সম্পর্কে সমকক্ষতার দলভুক্ত । আমাদের বিশ্বাস আছে, সভ্যতার উন্নতি সহকারে স্ত্রী ও পুরুষ ক্রমে সর্ব্বাংশে একরূপ হইয়া উঠিবেক, কেবল সন্তানকে গর্ভে ধারণ এই বিষয়ে যাহা কিঞ্চিৎ বৈলক্ষণ্য থাকুক। আমরা মনে করি যে অন্যান্য বৈলক্ষণ্য কৃত্রিম, অস্থায়ী, অনিত্য, আগন্তুক এবং উভয়ের সুখের ব্যাঘাতক। সুতরাং গ্রন্থ রচনা বিষযে লিঙ্গভেদকর,অনভিপ্রেত বলিয়াই আমরা স্ত্রীপ্রত্যয়ের শরণাপন্ন হই নাই।”
বিহারীলাল ছিলেন সে যুগের একজন নাম করা কবি ; কিন্তু সে রকম স্বীকৃতি ও যশ তার ভাগ্যে জোটেনি । ‘ ভিক্টোরিয়া যুগে বাঙ্গালা সাহিত্য ’ গ্রন্থে তার সম্বন্ধে লেখক হারাণচন্দ্র রক্ষিতের মন্তব্য : “ যশোলাভ সকলের ভাগ্যে ঘটে না। নাম হওয়া বা মান পাওয়া প্রকৃত একটা বরাত।” যাই হোক বিহারীলাল প্রণীত ‘নিসর্গ-সন্দর্শন’, ‘বঙ্গসুন্দরী’, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ইন্দ্রের সুধাপান’, কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য্যের ‘পৌলভর্জ্জীনী’, ‘নেপোলিয়ন বোনাপার্টের জীবন বৃত্তান্ত’ প্রভৃতি রচনা ‘অবোধবন্ধু’-তেই প্রথম প্রকাশিত হয়।
কবি বিহারিলালকে যথেষ্ট শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি তার ‘জীবন স্মৃতি’তে লিখেছেন – “ বিহারী চক্রবর্তী মহাশয় তাঁহার বঙ্গসুন্দরী কাব্যে যে ছন্দের প্রবর্ত্তন করিয়াছিলেন তাহা তিন মাত্রামূলক ..... একদা এই ছন্দটাই বেশি করিয়া ব্যবহার করিতাম।”
কোন সাময়িক পত্রের পরিচয় দিতে গিয়ে তার লেখকের রচনার বিশদ আলোচনা করা হয় ত কাম্য নয়, ‘অবোধবন্ধু’-র সঙ্গে বিহারিলাল এমন ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং তার কবি প্রতিভা তখন এতটাই স্বীকৃতি লাভ করেছিল যে ‘অবোধবন্ধু’ সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে তার কবিতা থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দেওয়া অসঙ্গত হবে না। রবীন্দ্রনাথ যেটির কথা উল্লেখ করেছেন সেই ‘বঙ্গসুন্দরী কাব্যের’ পঞ্চম সর্গের প্রথম ১০টি স্তবক এখানে তুলে ধরা হল। এটি প্রকাশিত হয় ১২৭৬-এর আশ্বিন সংখ্যায়। এ থেকে বিহারিলালের কবিতা ও ‘অবোধবন্ধু’তে প্রকাশিত রচনা সম্বন্ধে স্বল্প হলেও কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে।
“ ছাতের উপরে চাঁদের কিরণে
ষোড়শী রূপসী ললিত বালা,
ভ্রমিছে মরাল, অলস গমনে,
রূপে দশ দিক করেছে আলা । (১ )
বরণ উজ্জ্বল তপত কাঞ্চন
চমকে চন্দ্রিকা নিরখি ছটা,
থুয়ে গেছে যেন তপন আপন,
এমুরতীমতী মরিচি ঘটা । (২ )
সুঠাম শরীর পেলব লতিকা,
আনত সুষমা কুসুম ভরে,
চাঁচর চিকুর নীরদ মালিকা
লুটায়ে পড়েছে ধরণী পরে । (৩ )
হরিণী গঞ্জন চটুল নয়ন
কভু কভু যেন তারকা জ্বলে;
কভু যেন লাজে নমিতলোকন
পলক পড়ে না শতেক পলে; (৪ )
কভু কভু যেন চমকিয়া উঠে
ফুল ফুটে যেন ছড়িয়ে যায়,
মধুকর কুল পাছু পাছু ছোটে
বুঝি পরিমল লোভেই ধায়; (৫ )
কখন বা যেন হযেছে তাহায়
সুধার প্রবাহ প্রবহমান
যেথা দিয়ে যায় অমৃত বিলায়
জুড়ায় জগৎ জনের প্রাণ । (৬ )
আপনার রূপে আপনি বিহ্বল
হেসে চারিদিকে চাহিয়ে দেখে ;
কে যেন তাহারি প্রতিমা সকল
জগৎ জুড়িয়ে রেখেছে এঁকে । (৭ )
আচম্বিতে যেন ভেঙে যায় ভুল,
অমনি লাজের উদয় হয়,
দেহ থর থর, হৃদয় আকুল,
আনত আননে দাঁড়ায়ে রয়। (৮)
আধ ঢুলু ঢুলু লাজুক নয়ন
আধই অধরে মধুর হাসি ;
আধ ফোটো ফোটো হয়েছে কেমন
কপোল-গোলাপ-মুকুলরাশি ! (৯)
আননের পানে সরমবতীর,
স্থির হয়ে চাঁদ চাহিয়ে আছে ;
আসি ধীরে ধীরে শীতল সমীর,
ব্যজন করিয়া ফিরিছে কাছে । (১০)
কেদারনাথ মজুমদার জানিয়েছেন যে বিহারিলাল স্বত্তাধিকারী ও সম্পাদক হবার পর পত্রিকার কলেবর এক ফর্মা বৃদ্ধি পায় এবং মূল্য ধার্য হয় দু’টাকা। গ্রাহক সংখ্যা কিন্তু বেশি হয় নি। ৩য় বর্ষের শেষে দেখা যায় স্থানীয় গ্রাহকদের থেকে আদায় হয়েছে এক’শ আটত্রিশ টাকা আট আনা, মফস্বল গ্রাহক থেকে তেইশ টাকা আট আনা। ডাক মাশুলে খরচ হয়েছে সাইত্রিশ টাকা আট আনা। ২০০ জনের বেশি গ্রাহক সংখ্যা হয় নি। উন্নত মানের হওয়া সত্বেও পত্রিকাটি সম্ভবত বছর চারেক মাত্র চলেছিল।
সংযুক্ত প্রতিলিপি : ১২৭৩-এর ফাল্গুনে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা ।
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।