প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৫

 

অবলা বান্ধব

দীপক সেনগুপ্ত


      সত্যযুগে কি ছিল জানা নেই ; কিন্তু কয়েক শতকের ইতিহাস যা পাওয়া যায়, তাতে সমাজে মেয়েদের যে বহু ক্ষেত্রে অধীনতা স্বীকার করে শৃঙ্খলবদ্ধ অবস্থায় থাকতে হয়েছে সেটা মানব জাতির এবং মনুষ্যত্বের অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয়। না ছিল তাদের স্বাধীনতা, না ছিল শিক্ষার অধিকার। স্ত্রীলোক ছিল নীতিবোধশূন্য সামাজিক অনুশাসনে আবদ্ধ যন্ত্রমাত্র। এই নিগঢ়বদ্ধ অবস্থাতেই সংসারের শ্রী বজায় রাখা ও শিশুকে সুস্থ সুন্দর করে মানুষ করার গুরু দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল তাদেরই উপর। কিছু লোক সময়ে সময়ে এর প্রতিবাদ করেছেন, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখিও করেছেন কিন্তু নাগপাশ থেকে কিছুটা মুক্ত হতে সময় লেগেছে দীর্ঘদিন। সমসাময়িক সামাজিক ব্যবস্থা, রীতি ও প্রথাকে লিপিবদ্ধ করে ইতিহাসের উপাদান হিসাবে ব্যাবহারের সুযোগ করে দিতে তৎকালে প্রকাশিত সাময়িক পত্রের একটা বিশিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। কিছু পত্রিকা মূলতঃ মহিলাদের কথা মনে রেখেই প্রকাশিত হয়েছে। ‘বামাবোধিনী পত্রিকা ’; ‘পরিচারিকা’; ‘বঙ্গমহিলা’; ‘অন্তঃপুর’; ‘অনাথিনী’ ইত্যাদির মতই ‘অবলা বান্ধব’ ছিল একটি সহযোগী পত্রিকা।
     পাক্ষিক পত্রিকা ‘অবলা বান্ধব’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালের ২২শে মে (১০ই জৈষ্ঠ্য, ১২৭৬ )। দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় এটি ঢাকায় মুদ্রিত হয়ে লোনসিংহ (অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় অবস্থিত )থেকে প্রচারিত হত। ব্রজেন্দ্রনাথ জানিয়েছেন “সংসারে স্ত্রীলোকের উপযোগিতা ও স্ত্রীশিক্ষার আলোচনা করাই এতৎ পত্রের উদ্দেশ্য।” দ্বারকানাথ কলকাতায় চলে এলে ১৮৭০ সাল থেকে পত্রিকাটি কলকাতা থেকেই প্রকাশিত হতে থাকে।
     পত্রিকাটি সম্বন্ধে অনিন্দিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগৃহীত অধুনালুপ্ত ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-র মন্তব্য ছিল এই রকম : “ স্ত্রীজাতির প্রকৃত মঙ্গল কামনা করেন এমন লোকের সংখ্যা বঙ্গদেশে অতি অল্প আছে। কুলকামিনীদিগকে অবজ্ঞা করা অধিকাংশ লোকেরই প্রকৃতি .......এক্ষণে যে যে বিষয়ে প্রধান লক্ষ্য রাখিয়া অবলাবান্ধব প্রচারিত হইল তাহার উল্লেখ করা আবশ্যক। যাহাতে বঙ্গীয় স্ত্রী সমাজের অবস্থা ক্রমশঃ উন্নত হয়, তাহাদিগের জ্ঞান ও ধর্ম্মের বৃদ্ধি হয় আত্মকর্ত্তব্যব্যাবধারণের ক্ষমতা জন্মে, সামাজিক ও পারিবারিক সুখের বৃদ্ধি হয়.........আত্মার প্রকৃত উন্নতি হয় এবং বিদ্যা বিষয়ে সবিশেষ অনুরাগ জন্মে, তাহার নিয়ত চেষ্টা আলোচনা করিবার জন্যই অবলাবান্ধবের জন্ম হইল। ......অবলাবলীর রচনাবলী প্রকাশ করাও অবলাবান্ধবের এক কর্ত্তব্য পরিগণিত হইবে।”
     পরিণত বয়সে পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী স্মৃতি রোমন্থন করে তার অল্প বয়সের একটি কাহিনী শুনিয়েছেন, যার সঙ্গে ‘অবলা বান্ধব’ জড়িত। যদিও পত্রিকাটির আদর্শ বা উদ্দেশ্যর সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তা হলেও কাহিনিটি উপভোগ্য। শিবনাথের ভাষাতেই সেটি শোনা যাক :
 

    “ সে কালের আর একটা কথা মনে আছে। একটি সুন্দর ফুটফুটে গৌরবর্ণের মেয়ে আমাদের পাশের বাড়ীতে তার মাসির কাছে আসিত। সে আমার সমবয়স্ক। ঐ মেয়ে আসিলেই আমার খেলাধূলা লেখাপড়া ঘুচিয়া যাইত। আমি তার পায়ে পায়ে বেড়াইতাম। আমার পাড়ার বালক বালিকা মিলিয়া ‘চাঁদ চাঁদ কেন ভাই কাঁদ’ প্রভৃতি অনেক খেলা খেলিতাম। তখন সে আমাদের সঙ্গে খেলিত। খেলার ঘটনাচক্রে যদি আমি তাহার সঙ্গে এক দলে না পড়িতাম, আমার অসুখের সীমা থাকিত না। আমি তার হাত ধরিয়া খেলার সঙ্গীদিগকে বলিতাম, “আমি এর সঙ্গে থাকব, তোমরা আমার বদলে এ দল হতে ও দলে আর কারুকে দেও”। বালকেরা আমার অনুরোধ রাখিত না, বকিয়া, ঠেলিয়া, গলা টিপিয়া আমাকে আর এক দলে নিয়া আসিত। ঐ বালিকার বাড়ী আমাদের স্কুলের পথে ছিল। আমি স্কুল হইতে আসিবার সময় তাহার সহিত দেখা করিয়া একটু খেলা করিয়া আসিতাম। ইহার পর আমি যখন কলিকাতায় আসিলাম ও এখানকার পাঠাদিতে ব্যস্ত হইলাম, তখন গ্রামে তাহার বিবাহ হইয়া গেল। সে দূরে শ্বশুরবাড়ী চলিয়া গেল। আর বহু বৎসর তাহার সহিত দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই। পরে বড় হইয়া ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেবার পর গ্রামে গিয়া আবার তাহাকে দেখিলাম। দেখিয়া চমকিয়া উঠিলাম, সে প্রস্ফুটিত পুষ্পসম কান্তি বিলীন হইয়াছে ! সন্তানভারে ও সংসারভারে সে অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে। তাহাকে দেখিয়া মনে যে ভাব হইয়াছিল, তাহা ‘তুমি কি আমার সেই খেলার সঙ্গিনী’  নামে একটি কবিতায় প্রকাশ করিয়াছি। আমার যতদূর স্মরণ হয়, আমার বন্ধু দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় সেই কবিতাটি জোর করিয়া কাড়িয়া লইয়া, তাঁহার ‘অবলা-বান্ধবে’ ছাপিয়াছিলেন। আমি সেটিকে সংগ্রহ করিবার অনেক চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু অবলা-বান্ধবের পুরাতন ফাইল না পাওয়াতে পারি নাই।”
    

উপরের কাহিনীটি থেকে অপর একটি বিষয় পরিস্কার। শিবনাথ শাস্ত্রী স্বয়ং যদি সেই সময়ে তার লেখা সম্বলিত পত্রিকার কপি খুঁজে না পান, তবে তার বহু বছর পরে এই সব পত্রিকার সন্ধান মেলা কতটা দুরূহ, সেটা সহজেই অনুমেয়। পুরানো লেখা বা অন্যান্য প্রাচীন জিনিস সংরক্ষণে আমাদের এই অনীহা ও অনাগ্রহের জন্য বহু পত্রিকা, লেখা এবং লেখক চিরতরে হারিয়ে গেছেন। যাই হোক, পাক্ষিক ‘অবলা বান্ধব’ ৬ষ্ঠ বর্ষে মাসিক আকারে ১২৮১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাস (জুলাই ১৮৭৪ ) অবধি প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। কারণ সেই অর্থাভাব। এর বেশ কয়েক বছর পরে ১২৮৬-তে পত্রিকাটি মাসিক আকারে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল, তবে বেশিদিন স্থায়ী হয় নি। 

প্রতিলিপি পরিচয় –
১২৮৫ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে প্রকাশিত প্রথম সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠা ।


 

 


লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।