প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

জুন ৩০, ২০১৬

 

অনুসন্ধান

দীপক সেনগুপ্ত


আলোচ্য পত্রিকাটি প্রকাশের উদ্দেশ্য হিসাবে যে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে সেটি যথেষ্ট কৌতূহলোদ্দীপক। সমাজে নানা ধরণের প্রতারক রয়েছেন। এদের সবারই লক্ষ্য অসাধু উপায় অবলম্বনে মানুষকে ঠকিয়ে অর্থ উপার্জন করা। এদের সম্বন্ধে জনসাধারণকে সচেতন করে তুলতে গড়ে তোলা হয় ‘অনুসন্ধান-সমিতি’। নানা ধরণের প্রতারক ও তাদের ব্যবহৃত বিবিধ উপায় সম্বন্ধে প্রচারের মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করা বা তাদের পাশে দাঁড়ানই সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য। ইংরাজি, বাংলা, উর্দু, হিন্দি, পার্সি, গুজরাটি ইত্যাদি বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ পত্রের সম্পাদকদের কাছে আবেদন পাঠান হয়েছে সমিতির চিন্তাধারা ও কর্মসূচী ব্যাখ্যা করে জনগণকে সতর্ক করার চেষ্টায়। কিন্তু সব সময়ে সংবাদপত্রের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচার করে অভীষ্ট সিদ্ধি হয় নি; তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল স্বাধীন ভাবে একটি পত্রিকা প্রকাশ করে কর্মসূচী রূপায়ণকে ত্বরান্বিত করা। এরই ফলশ্রুতি ‘অনুসন্ধান’ পত্রের আত্মপ্রকাশ। এটি প্রথমে ছিল একটি পাক্ষিক পত্রিকা।

প্রথমেই ‘মঙ্গলময় শ্রীহরি’র কাছে নিবেদিত হয়েছে –

“ শত্রুময় সংসারে দিন দিন তোমারই দয়ায়, তোমারই কৃপায় মিত্র মিলিতেছে। তাই সাহস হয়,সৎপথে থাকিলে,নিরাশ্রয়ী হইলেও আশ্রয় পাইব; ভরসা করি,বিপদে পড়িলেও বিপদ সম্পদে পরিণত হইবে। পাপের সংসার;নিয়তই অসত্য, - চারিদিকেই প্রবঞ্চনা ! তাহাতে পড়িয়া সজ্জন হাবুডুবু খাইতেছেন; পাপী আনন্দে নৃত্য করিতেছে। এ লীলা বুঝিবে কে ? লীলা নাই বুঝিতে পারি, ক্ষতি নাই; কিন্তু মনে যাহা ‘কর্তব্য’ বলিয়া ধারণা হইয়াছে,তাহা পালন করিতে প্রাণপণ যত্ন কেন না পাইব ? ”

উপরে সংক্ষেপে যা তুলে ধরা হয়েছে, বিশদ ভাবে সেটাই ব্যাখ্যা করা হয়েছে ‘অনুসন্ধান সমিতি’ ও পত্রিকা প্রকাশনার উদ্দেশ্য হিসাবে। এখানে সম্পূর্ণ লেখাটি তুলে দেওয়া হল। কত ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে সে কালে পত্রিকা প্রকাশ ও প্রচার করা হত তার দৃষ্টান্ত হিসাবে এটি সুখপাঠ্য হবে আশা করা যায়।

“ অনুসন্ধান-সমিতি
“ একবর্ষ মাত্র স্থাপিত হইয়াছে; আজ আনন্দের দিন যে, সে দ্বিতীয় বর্ষে পদার্পণ করিল। জগতের নিয়মই এই যে, বয়সবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কার্য্যক্ষেত্রও বিস্তৃত হইযা পড়ে; সৌভাগ্যের কথা দিন দিন সজ্জনের সহানুভূতি পাইয়া সমিতির কার্যক্ষেত্রও বিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছে। এতদিন সমিতির বিবরণ ইত্যাদির প্রচার জন্য কেবল দেশের সম্পাদকগণই সহায় ছিলেন; তাহাতে দেশের অনেক উপকার হইয়াছে বটে, কিন্তু তাঁহারা নানা কার্য্যে লিপ্ত থাকায় সকল সময় তাঁহাদের দ্বারা আমরা আশানুরূপ ফলপ্রাপ্ত হইতে পারি নাই। অনুসন্ধান-সমিতি গুরুভার বুঝিয়া জুয়াচোরগণের সন্ধানে সর্ব্বদাই তটস্থ আছেন; জুয়াচোরগণ কখন কিরূপভাবে কার্য্য করিতেছে, সেদিকে নিয়তই তাঁহার লক্ষ্য। আর, সেদিকে লক্ষ্য রাখিতে যাইলে কখন কোন ব্যক্তি কিরূপ ভাবে কার্য্য করিতেছে সংবাদপত্রে প্রকাশ করিয়া তাহা সাধারণকে জানান কর্ত্তব্য কিন্তু সকল সংবাদপত্র দ্বারা ঠিকঠাক সময়ে সে কার্য্য হওয়া অসম্ভব; আমরা যে সময়ে রিপোর্ট পাঠাই না কেন,নানা কার্য্যে লিপ্ত সংবাদপত্রে ঠিক সময়ে তাহার আলোচনা হয় না। আর বিলম্বে আলোচনা হেতু তাহাতে অনেকে ঠকিয়া যান ও জুয়াচোর সাবধান হয়। তাছাড়া বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞাপিত দ্রব্যের গুণাগুণ বিচারে অনেক সময় আবশ্যক; কিন্তু সংবাদপত্রে সকল সময়ে তাহারও স্থান মিলে না। এই সকল কারণেই, লোকে যাহাতে আর সামান্যরূপও না ঠকেন-এই আশায় সমিতির মুখপত্র হিসাবে ‘অনুসন্ধান’ প্রকাশিত হইতে চলিল। এখন অনুসন্ধানের উপকারিতা!-অনুসন্ধানের উপকারিতার বিষয়ে চিন্তা করিবার পূর্ব্বে একবার দেখা উচিত, কলিকাতার জুয়াচুরি কত রকমের। আর, কত প্রকারেই বা কলিকাতা ও সরল বিশ্বাসী মফস্বলবাসী প্রতারিত হইতেছেন ? তাহা দেখিলে সহজেই এরূপ পত্রিকার উপকারিতা সাধারণের বোধগম্য হওয়া সম্ভব।”

এরপর পাঠকদের অবগতির জন্য বিভিন্ন ধরণের জুয়াচুরি উদাহরণ সহকারে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেটাও দেখে নেওয়া যাক -

“ কলিকাতার জুয়াচুরি
“ সভ্যতা ও শিক্ষা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জুয়াচুরীরও নানারূপ নূতন নূতন ফন্দী বাহির হইতেছে। আগে চুরি ডাকাতি সব সাদাসিধে রকমের হইত; এখন যতই কঠোর শাসন আসিতেছে, যতই শিক্ষা ও সভ্যতা বাড়িতেছে, ততই তাহার সঙ্গে জুয়াচুরীরও নূতন নূতন কৌশল উদ্ভভ হইতেছে। আমাদের অভিজ্ঞতায় আমরা দিন দিন যে,সকল জুয়াচুরীর বিষয় দেখিতেছি,পূর্ব্বে কেহ তাহা স্বপ্নেও ভাবিতে পারিয়াছেন কিনা,সন্দেহ ! কিন্তু সভ্য জগতের অপার মহিমা !
“ ব্যবসায়ের ভান, লাভের প্রয়োজন দেখাইয়া যে সকল জুয়াচুরী হয়; তাহা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই রূপেই সাধিত হয়। কলিকাতার বসিয়া স্বচক্ষে দেখিয়া যে সকল জুয়াচুরীতে ঠকিতে হয়, তাহাই প্রত্যক্ষ জুয়াচুরী; আর,মফঃস্বলে থাকিয়া বিজ্ঞাপন-মন্ত্রে ভুলিয়া যেরূপে প্রতারিত হইতে হয়, তাহাই পরোক্ষ জুয়াচুরী। কু-ফন খেলা, রাস্তায় সোনা খেলা, ঘণ্টা বাজাইযা নিলাম করা, নবাব সাজা প্রভৃতি প্রত্যক্ষ জুয়াচুরী; আর পুস্তক, পত্রিকা, ঔষধ, গাড়ি, চেন প্রভৃতি নানাবিধ ব্যবহার্য্যের বিজ্ঞাপন দিয়া, টাকা গ্রহণ করিয়া তাহা না দেওয়া, এক জিনিস দেব বলিয়া আর এক জিনিস দেওয়াই ঐ দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত। সংক্ষেপতঃ ঐ সকল জুয়াচুরী হইতে সাধারণকে সতর্ক করিতে এবং যেরূপে তাহার প্রতিকার হয়, সেই বিষয়ে চেষ্টা পাইতে ‘অনুসন্ধান সমিতি’র সৃষ্টি।
“ প্রত্যক্ষ যে সকল জুয়াচুরী হইতেছে, তাহার বিষয় ক্রমশঃ প্রকাশ হইলেও হানি নাই; কিন্তু যে সকল পরোক্ষে জুয়াচুরীর বিষয় আমরা এ পর্য্যন্ত সন্ধান পাইতেছি, মোটামুটি তাহার সংক্ষিপ্ত পরিচয় এস্থলে আবশ্যক বোধ করি। প্রত্যেক বিষয়ের আনুপূর্ব্বিক প্রমাণাদির আলোচনার পূর্ব্বে সংক্ষেপে জুয়াচুরীর প্রকার জ্ঞান থাকিলেই লোকের সতর্কতার সম্ভব। - পরোক্ষে কলিকাতার যে সকল জুয়াচুরী হয় তাহাকে আপাততঃ ৮ ভাগে বিভক্ত করা গেল : -
“ ১নং জুয়াচুরী; - ইহারা যে কোন ঠিকানায় যে কোন নামে প্রলোভনপূর্ণ জাঁকাল বিজ্ঞাপন দেয় ও নিজে অপর এক ঠিকানায় বসিয়া পোস্ট অফিসের সহিত বন্দোবস্তে টাকা গ্রহণ করে ও গ্রাহককে বিজ্ঞাপিত দ্রব্যাদি দেয় না। সন্ধানে জানা যায়,তাহারা যে ঠিকানায় বিজ্ঞাপন দেয়, সেখানে সে নামে কোন লোকই নাই; যাহারা সেখানে থাকে, তাহারা নাম ও বিজ্ঞাপিত জিনিসের বিষয় শুনিলে অবাক হয়। সুতরাং লোকে ঠকিয়া প্রতারকের সন্ধানও পায় না।
“ ২ নং জুয়াচুরী; - ইহাদের একটা আড্ডা ও লোক আছে; ইহারা একটি নির্দ্দিষ্ট সময় পর্য্যন্ত কোন জিনিসের লোভপূর্ণ বিজ্ঞাপন দেয় এবং সেই সময়ের মধ্যে যত টাকা হয় সংগ্রহ করিয়া তথা হইতে অন্তর্হিত হয় ও লোকে ঠকিয়া পূর্ব্ব স্থানে সন্ধান পায় না।
“ ৩ নং জুয়াচুরী; - ইহারা জিনিসের ক্রমশঃ অংশমাত্র দিতে দিতে প্রলোভনে লোক ভুলায় এবং দেয় জিনিসের সামান্য অংশ দিয়াই গা-ঢাকা দেয়।
“ ৪ নং জুয়াচুরী; - ইহারা এক জিনিস দিতে চাহিয়া টাকা লয়; কিন্তু জিনিস দেবার সময় তার চেয়ে ঢের খারাপ জিনিস দেয়। যাহারা সততার ভান করে, তাহাদের মধ্যে অনেকেরও এ প্রবৃত্তি আছে। পুস্তক, পত্রিকা, ঔষধ ও নানাবিধ দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিয়তই এ ব্যাপার ঘটিতেছে। বিশেষ সন্ধান না লইলে এ সকল রকমের প্রবঞ্চনা হইতে নিস্কৃতি পাওয়া সহজ নহে।
“ ৫ নং জুয়াচুরী; - ইহারা বড় লোকের দোহাই দেয়; জিনিস খারাপ হইলে টাকা ফেরত দিতে চায়। কিন্তু সন্ধান করিলে সবই ফাকা। ইহাদের বিজ্ঞাপিত পুস্তক, পত্রিকা ও ঔষধের কিছুই গুণ নাই; নানা ওজরে টাকাও ফেরত দেয় ন।
“ ৬ নং জুয়াচুরী; - উপহার বিতরণ ও মূল্য কম। প্রথমতঃ কএকটি লোক সদুদ্দেশ্যে গ্রাহক-সংগ্রহ জন্য এইরূপ বিজ্ঞাপন দেন। তাঁদের দেখাদেখি এখন অনেকে ঐ বৃত্তি অবলম্বন করিয়া অসৎ পথে পদার্পণ করিতেছে। ফলতঃ এরূপ দান, উপহার বা মূল্য কম সম্বন্ধে গৃহীতার একবার বিবেচনা করা উচিত যে, বিজ্ঞাপনদাতা কি সদাব্রত করিতে বসিয়াছে ? সে যে বিজ্ঞাপনের টাকা খরচ করিয়া দান করিতেছে, উপহার দিতে - মূল্য কমাইতে বসিয়াছে, ইহার বা অর্থ কি ? অর্থ কি লোভ দেখাইয়া ঠকান নহে ? কিন্তু কি লোভ মফঃস্বলবাসী এত ঠকিয়াও তাঁহারা বুঝিতেছেন না, এই দুঃখ ! লটারি করিয়া দানও এই শ্রেণীর অন্তর্গত।
“ ৭নং জুয়াচুরী; - কেবলমাত্র ডাকমাশুল লইয়া দান। এহারা ডাকমাশুল বলিয়া টাকা লইয়া যে জিনিস দেয়, ন্যায়মত ধরিতে গেলে সে জিনিসের মূল্য ও মাসুল তদপেক্ষা ঢের কম।
“ ৮নং জুয়াচুরী; - এইরূপ জুয়াচুরী ভ্যালু-পে-এবলে ডাকেই সাধিত হয়; পূর্ব্বোক্ত প্রকারেই জুয়াচোরগণ ‘বিশ্বাস না হয় ভ্যালু-পেএবলে লইবেন’, ইত্যাদি চমক দেখাইয়া বিশ্বাস জন্মাইয়া, যা’ তা’ পাঠাইয়া দেয় ও লোকে ভ্রমে ঠকিয়া মরে।
“ এই সকল ভিন্ন ব্যবসায়ের বাজারেও নানারূপে জুয়াচুরী হইয়া থাকে। কভার বদলাইয়া এক নামের পুস্তক অপর নামের পুস্তক বলিয়া বিক্রয় করা, লেবেল বদলাইয়া এক ঔষধকে অন্য ঔষধ বলিয়া বিক্রয় করা প্রভৃতিও বড় অল্প প্রতারণা নহে। আর,এই সকল নানাবিধ জুয়াচুরীতে দিন দিন লোকের যে কত অনিষ্ট হইতেছে,তাহারও ইয়ত্তা নাই। কিন্তু এই সকল নানা রকমের জুয়াচুরীর বিষয়ে লোকের যদি সংক্ষিপ্ত জ্ঞানও থাকে,তাহা হইলে অনেকেই সতর্ক থাকিতে পারেন। আর সেইরূপে সাধারণকে সতর্ক করিতেই - কে সৎ আর কে অসৎ জানাইতে অনুসন্ধন প্রচারের আবশ্যকতা।
এখন দেশের লোক সহায় হন, সদনুষ্ঠানে উৎসাহ দেন, এই প্রার্থনা।”

এখানে সম্পূর্ণ বক্তব্যটি উধৃত করা হল। এ থেকেই পত্রিকাটির উদ্দেশ্য ও চরিত্র সম্বন্ধে সম্যক অবগত হওয়া যাবে। জনসাধারণ নিশ্চয়ই কিছুটা উপকৃত হয়েছিলেন এবং পত্রিকাটিকে গ্রহণ করেছিলেন; কারণ পত্রিকাটি অন্ততঃ ন’বছর চলেছিল এবং পাক্ষিক থেকে সাপ্তাহিকে পরিবর্তিত হয়েছিল। ( মূল রচনার বানান ও বিরাম চিহ্ণ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে )।

প্রতি বছর শারদীয় উৎসবের আগে সবারই কেনাকাটার একটা পর্ব থাকে। এ সময়েই যে প্রতারকরা বিশেষ তৎপর হয়ে ওঠে সে বিষয়ে পত্রিকা প্রকাশক ও কর্মাধ্যক্ষ যথেষ্ট সচেতন। পূজোর আগে তাই একটি সংখ্যায় প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ –

“ইতিমধ্যেই পূজার বাজারের হ্যান্ডবিল-বিজ্ঞাপন জারি করিতে আরম্ভ করিয়াছে; সুলভা – গাধার দামে হাতি দিতে, এক টাকায় পাঁচ টাকার মাল উপহার দিতে এইরূপ কতই কি প্রলোভন-পূর্ণ বিজ্ঞাপন আজকাল বিলি হইতে আরম্ভ হইয়াছে। যাই হোক, সে সকল বিজ্ঞাপনের নাম আর এখন করিব না। মোটের উপর যেখানে যতই প্রলোভন, সেইখানেই তত প্রতারণা, এই যেন সকলের স্মরণ থাকে।”

বহু লেখকের রচনাই ‘অনুসন্ধানে’ প্রকাশিত হয়েছে। এদের মধ্যে ছিলেন – স্বর্ণকুমারী দেবী (‘ভারতী’); শিবপ্রসন্ন ভট্টাচার্য্য বি, এ, বি, এল; প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় ( ডিটেকটিভ ); তারাকুমার কবিরত্ন (‘নব্যভারত’); কবিবর নবীনচন্দ্র সেন ( ‘মালঞ্চ’) ; পন্ডিত মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি ; শরচ্চন্দ্র সরকার ; হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ( ‘প্রচার’) ; পন্ডিত ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ; দিনেশচন্দ্র সেন বি, এ ; রাজকৃষ্ণ রায় ; হরিসাধন মুখোপাধ্যায় ; ব্যোমকেশ মুস্তোফী ; হরিদাস চট্টোপাধ্যায় এম, এ ; পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় বি, এ ; কামাখ্যাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ; গিরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ; পন্ডিত দামোদর বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যানন্দ, অক্ষয়কুমার বড়াল, বীরেশ্বর পাঁড়ে ; রামদয়াল মজুমদার এম, এ প্রমুখ। তখনকার প্রচলিত রীতি অনুযায়ী অনেক সময়েই লেখকদের নামের পাশে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার পরিচায়ক ডিগ্রি্র উল্লেখ থাকত। আবার যে সব পত্রিকায় লিখে অনেকে খ্যাতিমান হয়েছেন সে সব পত্রিকারও নামের উল্লেখও বন্ধনীর ভিতরে থাকত। লেখকদের মধ্যে অধিকাংশই এখন বিস্মৃতির গর্ভে বিলীন। তবে মোক্ষদাসুন্দরী দেবী ছাড়া আর কোন মহিলার রচনা চোখে পড়ল না। অবশ্য সব সংখ্যার হদিস পাইনি।

কি ধরণের লেখা প্রকাশিত হত ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকায় ? সেকালের বহু পত্রিকাতেই ধর্মবিষয়ক প্রবন্ধ যথেষ্ট সংখ্যায় প্রকাশিত হত। অন্যান্য প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে, সেইসঙ্গে ছিল গল্প, কবিতা, গান, ভ্রমণ কাহিনী এবং উপন্যাসও। কিছু রচনার শিরোনাম – ‘কর্ণগড় রাজবংশ’ , ‘কাব্য ও কামিনী’ , ‘চীনদিগের বিবাহ পদ্ধতি’ , ‘জীবাত্মা ও কামনা’ , ‘দরিদ্রতা’ , ‘পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ , ‘পুষ্কর তীর্থ’ , ‘প্রাচীন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার’ , ‘বাল্মীকি ও হোমার’ , ‘বর্ণমালা রহস্য’ , ‘ভক্তি সঙ্গীত’ , ‘শারদীয়া পূজা’ , ‘সনাতনপুরের সিদ্ধেশ্বর’ , ‘আকাশে তড়িৎ’ , ‘আমাদের বঙ্কিমচন্দ্র’, ‘ইউরোপে এত অশান্তি কেন ?’ ‘চীন পরিভ্রমণ’ , ‘জ্ঞান ও অজ্ঞান’ ইত্যাদি। বেশ কয়েকটি উপন্যাসও রয়েছে পত্রিকাটিতে, যেমন – ‘ঠাকুর ঝি’ (যোগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়) , ‘বিপ্লব’ ( ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ প্রণেতা ) , ‘সুধামুখী’ ( রোহিণীকুমার রায়চৌধুরী ), ‘নিরুপমা’ ( শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ) প্রভৃতি। বহু সংখ্যক গান, কবিতা ও খ্যাতনামা ব্যক্তিদের জীবনী প্রকাশ করেছে ‘অনুসন্ধান’।

‘মতামত’ , ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ শিরোনামে নিয়মিত কয়েকটি বিভাগ ছিল। বর্ণানুক্রমিক সূচীপত্রও প্রকাশিত হয়েছে পত্রিকাটিতে।

আজ থেকে ১২৫ বছর আগে কি ধরণের কবিতা পত্রিকায় প্রকাশিত হত তার একটু আভাস পাওয়া যাবে ১২৯৮ বঙ্গাব্দের ১৫ই শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত বাবু নবকৃষ্ণ রায়ের ‘শাওন-বিরহ’ কবিতা থেকে। কবিতাটিতে ‘ব্রজবুলি’ ও ‘মৈথিলী’ ভাষার ব্যবহার রবীন্দ্রনাথের ‘ভানুসিংহের পদাবলী’র কথা মনে করায়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তর প্রভাবও লক্ষণীয়। প্রসঙ্গতঃ ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৪ সালে ( ১২৯১ বঙ্গাব্দ )। যাই হোক, ‘শাওন-বিরহ’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত হল –

সহিরে,
আওল শাওন ঘন ঘন-গরজন ,
ঝম ঝম বরিখন ঘন জলধারা ;
কহ কব আওব কান্ত হামারা ?
গুরু গুরু দুড়ু দুড়ু , শরদ ক্ষুবধ করে ,
হম সে অবোধা নারী পাগরী পারা ,
কহ কব আওব কান্ত হামারা ?
বিজুরী অনলমুখী , ঘড়ি ঘড়ি চমকত ,
চমকিত চিত বড়ি মোরা ;
কহ কব আওব কান্ত হামারা ?
ভেক ভেকী মক মক , উড়ল নভসী বক ,
জলদ গলহি সিতহারা ;
কহ কব আওব কান্ত হামারা ?
পোখর নদ নদী , ভরল জলদজলে ,
উতরল শৈল-নিঝোরা ;
কহ কব আওব কান্ত হামারা ?
কেলি-কদম-ফুল , ফুটহি সমাকুল ,
করতহি ভঁওরী ভঁওরা ;
কহ কব আওব কান্ত হামারা ?
ডাহুক-ডাহুকী , ডাকত ডুকি ডুকি ,
নাচত ময়ুরী ময়ুরা ;
কহ কব আওব কান্ত হামারা ?
শাওন বাদর , লোর মরি ঝর ঝর ,
ঝরতাহি শাওন ধারা ;
কহ কব আওব কান্ত হামারা ?
বারিদ-কোর মাঝ , গুপত তপন জনু ,
বহি গেল কান্ত মথুরা ;
শ্যাম শ্যাম বলি , কতহি ফুকারব ,
অব রাধা বিরহ-বিধুরা ।

‘অনুসন্ধান’ ছিল পাক্ষিক পত্রিকা। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১২৯৪ বঙ্গাব্দের ১৩ই শ্রাবণ। কার্যাধ্যক্ষ ছিলেন দুর্গাদাস লাহিড়ী। অষ্টম বর্ষ, ১৩০১-এর ২১শে বৈশাখ থেকে এটি সাপ্তাহিকের রূপ নেয়। পত্রিকাটি কতদিন সচল ছিল সঠিক জানা যায় নি। প্রতারণা বিষয়ে জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা মূল উদ্দেশ্য হলেও সাহিত্য-পত্র হিসাবে পত্রিকাটির মূল্যও কিছু কম ছিল না। পাঠকদের চাহিদা নিশ্চয়ই ছিল, কারণ পত্রিকাটি পাক্ষিক থেকে সাপ্তাহিকে রূপান্তরিত হয়েছে এবং অন্যান্য অনেক পত্রিকার নিরীখে আয়ুষ্কালও খুব কম ছিল না।

প্রতিলিপি পরিচয় –
চিত্র ১ ও ২ : পত্রিকার পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক প্রকাশনার আখ্যাপত্রের প্রতিলিপি।
চিত্র ৩ : ১২৯৭ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন।
চিত্র ৪ ও ৫ : পত্রিকায় প্রকাশিত দু’টি ছবি। একটু বড় করে দেখলেই বোঝা যাবে কাঠ খোদাই করে ব্লক
তৈরি করা হয়েছে। ( ছবি বড় করে দেখতে হলে Ctrl key টিপে রেখে + টিপুন)।


চিত্র ১


চিত্র ২


চিত্র ৩


চিত্র ৪

চিত্র ৫



লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।