পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
জানুয়ারি ৩০, ২০১৬
অতিথি
দীপক সেনগুপ্ত
পূর্বেই উল্লেখিত হয়েছে যে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বহু সংখ্যক
সাময়িকপত্রের মধ্যে কয়েকটি দীর্ঘস্থায়ী হলেও বেশ কিছু পত্রিকার
আয়ু ছিল নিতান্তই স্বল্প। এ রকমই একটি পত্রিকা ছিল ‘অতিথি’। এটির
প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল মাঘ ১২৮৮ বঙ্গাব্দে। সম্পাদক কে
ছিলেন জানা নেই। মাঘ সংখ্যার পর ফাল্গুন ও চৈত্র সংখ্যা যুগ্মভাবে
প্রকাশিত হয়। মুদ্রিত হয়েছিল ‘ভবানীপুর ওরিএণ্ট্যাল প্রেস, শ্রী
বরদাকান্ত বিদ্যারত্ন দ্বারা’। বৈশাখ সংখ্যা মুদ্রিত হয়েছিল ‘নিউ
মার্কেণ্টাইল প্রেস, ১৬নং ব্রিটিস ইণ্ডিয়ান ষ্ট্রীট, বি বেনার্জি
এবং কোম্পানী দ্বারা’। ১২৮৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক, অগ্রহায়ণ ও পৌষ
সংখ্যার মুদ্রণ ‘১৬নং ব্রিটিস ইণ্ডিয়ান ষ্ট্রীট, এ.এন গঙ্গোপাধ্যায়
এবং কোম্পানী দ্বারা ’। কার্য্যাধ্যক্ষ ছিলেন শ্রীজ্ঞানাভরণ মুখোপাধ্যায়
(কলিকাতা অতিথি কার্য্যালয় ১৬নং ব্রিটিস ইণ্ডিয়ান ষ্ট্রীট )। মূল্য
ধার্য হয়েছিল বার্ষিক দেড় টাকা, ‘পশাদ্দেয়’ দু’টাকা; ষান্মাষিক
চোদ্দ আনা, ‘পশাদ্দেয়’ এক টাকা এবং ত্রৈমাসিক আট আনা, ‘পশাদ্দেয়’
বার আনা। এ ছাড়া বলা হয়েছে ‘মফস্বলের গ্রাহকদের জন্য মাসিক দশ
পয়সা হিসাবে ডাক মাসুল লাগিবেক’।
পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য স্পষ্ট ভাবে লিখিত হয়েছে প্রথম সংখ্যার
প্রথম রচনা ‘অতিথির পরিচয়’ শিরোনামে। সম্পাদকের নাম কোথাও মুদ্রিত
হয় নি। সম্পাদক যিনিই হোন, তার জীবন দর্শন ও কর্মধারা কিছুটা বিচিত্র।
ভ্রাম্যমান সন্ন্যাসীর জীবন ছেড়ে তিনি ‘বঙ্গবাসীগণের’ চেতনা জাগ্রত
করতে পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করেন এবং এই প্রচেষ্টা বিফল হলে
পুনরায় তার সন্ন্যাস জীবনে প্রত্যাবর্তনের সঙ্কল্পও ব্যক্ত করেছেন।
কিছুটা দীর্ঘ হলেও ‘অতিথির পরিচয়’ নামক সম্পূর্ণ রচনাটিই এখানে
তুলে দেওয়া হল। প্রকাশনার উদ্দেশ্য এ থেকেই স্পষ্ট হবে।
“ বঙ্গসমাজে বিবিধ সামাজিক পত্র আছে। প্রত্যেকেরই
এক বা অধিক মুখ্য উদ্দেশ্য আছে। অনেকেই তাহার মধ্যে কৃতকার্য্য
হইয়াছে । তবে কেন আবার এই ক্ষুদ্র পত্রিকাটি বঙ্গের সাহিত্য সমাজে
প্রেরিত হইল ? এ নূতন অতিথি কেন আজি বঙ্গবাসিগণদ্বারে আসিয়া উপস্থিত
হইল ? কি নূতন ভাবে মজিয়া, কি নূতন উদ্দেশ্যে দৃঢ় সঙ্কল্প হইয়া,
অতিথি তুমি আজি বঙ্গবাসিগণ সমক্ষে উপস্থিত হইলে ? এ প্রশ্ন বঙ্গসমাজে
উত্থাপিত হইবে, তাই আজি অতিথি নিজের পরিচয় আপনা হইতেই দিতেছে ।
ব্রিটিস ভারতে আমার জন্ম, চিরদিন বঙ্গসাহিত্য উদ্যানে আমি প্রতিপালিত,
জাহ্ণবীর সিকতাময় তটে নির্জ্জন নিভৃত প্রদেশে আমার পিতার আবাস
স্থান, পিতার নিকট বঙ্গের শোচনীয় অবস্থার কথা অতি কাতর হৃদয়ে শৈশব
হইতেই শ্রবণ করিতাম। যৌবনের প্রথম উদ্যমে পরিব্রাজক অবস্থা অবলম্বন
করিয়া সন্ন্যাসীর বেশে দেশ বিদেশে পর্য্যটন করিয়া বেড়াইয়াছি। কিন্তু
কৈ বঙ্গের মত শোচনীয় অবস্থা কোথাওত দেখি নাই। বঙ্গবাসিগণের অবস্থা
এত শোচনীয় কেন ? ইহার নিগুঢ় তত্ত্ব জনিবার লালসা পরিতৃপ্তির জন্য
বঙ্গের যাবতীয় সাময়িক ও প্রাত্যহিক পত্রিকা পাঠ করিতাম। তাহাতে
জানিতে পারিলাম যে, বঙ্গবাসিগণের মধ্যে অধিকাংশই তাঁহাদের স্বীয়
প্রকৃত অবস্থার বিষয় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ; অতএব তাহাতে আমার সে অভিলাষ
পরিতৃপ্ত হওয়া দূরে থাকুক, সঞ্জাত লালসা এতদূর বর্দ্ধিত হইয়াছে
যে, আর বাহির না হইয়া থাকিতে পারিলাম না ও তাহাতে আর এক নূতন সত্য
দেখিতে পাইলাম যে, বঙ্গে "পরিবর্ত্তন" "পরিবর্ত্তন"
চীৎকার শব্দ পড়িয়াছে। যাহা কিছু পুরাতন ছিল এই স্রোতের মুখে ভাসিয়া
যাইতেছে ও নূতন সৃষ্টির আবির্ভাব হইতেছে। পুরাতন পরিচ্ছেদের বিনিময়ে
নূতন ইংরাজী পরিচ্ছদ আবির্ভূতপ্রায়, ইংরাজের শ্মশ্রু. ইংরাজের
কেশ, ইংরাজী আহার, ‘প্রিয় ব্রাণ্ডি জল’ এই সমস্ত নূতন দ্রব্যের
আধিপত্য বাড়িতেছে। সনাতন বেদান্ত-সম্মত পুরাতন হিন্দুধর্ম্ম আজি
বঙ্গে বিলুপ্তপ্রায় । আমার অন্যান্য ভ্রাতৃগণও প্রায় সকলেই এই
পরিবর্ত্তন স্রোতের অধীন । বোধ হয় যেন স্রোতে তাঁহাদের ভাসাইয়া
লইয়া যাইতেছে, স্বেচ্ছা পূর্ব্বক ভাসিতেছেন না । পরিবর্ত্তন আমারও
আদরের ধন, পরিবর্ত্তনকে আমি ভাল বাসি । কিন্তু আমার সে পরিবর্ত্তন
এরূপ অন্ধ পরিবর্ত্তন নয় । জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত করিয়া যে নূতন
সত্য দেখিতে পাই, সেই সত্যের অনুরোধে যে পরিবর্ত্তন আবশ্যক, সেই
পরিবর্ত্তনই আমার প্রিয় ! তাই আমি বঙ্গের প্রতিবিষয় লইয়া আন্দোলন
করিব । বঙ্গবাসিগণকে দেখাইব, কোনটির পরিবর্ত্তন আবশ্যক, আর কোনটির
পরিবর্ত্তন শুদ্ধ অনাবশ্যক নয় – দূষনীয় । অন্যান্য ভ্রাতৃগণ রাজকীয়
চর্চ্চা লইয়াই অধিক উন্মত্ত, কেহ কেহ বঙ্গে বিজ্ঞান, বঙ্গের পুরাতন
শাস্ত্র লইযা অধিক ব্যস্ত, কিন্তু আমি বঙ্গের সামাজিক প্রথা লইয়া
অধিক বকিব । অতএব আমার মুখ্য উদ্দেশ্য স্বতন্ত্র। যদ্যপি ভক্তিভাজন
জ্ঞানাঙ্কুর সম্পাদক মহাশয়, পুজ্যপাদ হরিদাসের গুপ্তকথা প্রণেতা,
প্রিয়সখা জ্ঞানাঙ্কুর কার্য্যধ্যক্ষ ও অন্যান্য সাহিত্য সংসারে
পরিচিত মহোদয়গণ সাহায্য করিতে প্রস্তুত না হইতেন, আমি তাহা হইলে
এরূপ গুরুতর কার্য্যে কখনই প্রবৃত্ত হইতাম না । আমি অতিথি, আমি
কুলীন গৃহে যাইয়াছি, বাল-বিধবার করুণ খেদোক্তি সকলও বাতায়ন পার্শ্বে
দাঁড়াইয়া শুনিয়াছি, আমি রাজবাটিতেও গিয়াছি, আমি সর্ব্বত্র, সর্ব্বত্রেরই
কথা বলিব । আবার পাছে এসব কর্কশ বিষয় লইয়া বলিতে গেলে, বঙ্গবাসিগণের
কষ্ট হয়, তাই আমার এই পরিব্রাজকের অবস্থায় যে সমস্ত সুললিত মধুর
গল্প শুনিয়াছি, যে সমস্ত অদ্ভুত কাণ্ড দেখিয়াছি, অথবা যে সকল মনুষ্য-জীবনের
বৈচিত্র নয়নপথে পড়িয়াছে, কল্পনার বলে সাজাইয়া বঙ্গবাসী তোমাদের
নিকট গল্প করিব । বীণা বঙ্গের পুরাতন গৌরবের ধন। আমি বীণা বাজাইতে
জানি, পুর্ব্বে অনেক বার আমার পরিব্রাজক অবস্থায় বীণা বাজাইয়া
বঙ্গবাসিগণকে পরিতৃপ্ত করিয়াছি। আজও সেই বীণাশব্দ বঙ্গের মুদ্রাযন্ত্র
হইতে বাহির হইতেছে। সেই পুরাতন কীটদংষ্ট বীণাটিকে তার সংযুক্ত
করিয়া আবার বাজাইতে চেষ্টা করিব। আমি দেখিতেছি, আমার অন্যান্য
ভ্রাতৃগণের মধ্যে প্রায় সকলেরই গর্ব্ব কিছু অধিক, তাঁহাদের দর্শনী
সাধারণ জনসমাজের কষ্টকর । আমি অতিথি, বঙ্গের উন্নতি সাধন ব্রতে
ব্রতী, আমার আবার দর্শনী কি ? তবে পাথেয় ও পরিচ্ছদের জন্য যাহা
ব্যয় হইবে, সেই ব্যয়টি মাত্র আমি লইব । আমি অতিথি, দূরদেশান্তরে
আমার বাস, আমি নিজ হইতে ব্যয় যোগাইতে কেমন করিয়া পারিব ? আমি সংসার
ব্রতে ব্রতী নই, আমার অধিকেই বা প্রয়োজন কি? আর অধিক লইলেই বা
আমার উদ্দেশ্য সফল হইবে কেন ? তাহা হইলে সকলে আমাকে সাদর সম্ভাষণ
কিরূপে করিবে ? দেখি এই জনাকীর্ণ বঙ্গসমাজে বাহির হইয়া দেখি যদি
কৃতকার্য্য হই, পাপ জীবনকে সফল মানিব । যদি বিফল হই,-কে জানে ঈশ্বরের
ইচ্ছা,-আবার যে সন্ন্যাসী সেই সন্নাসীই হইয়া গহন বিজ্ঞানকাননে
বা কল্পনাউদ্যানে নির্জ্জন প্রদেশে শান্ত সমীরণে বিচরণ করিয়া দুঃখ
ভারাক্রান্ত নিরাশ হৃদয়ের কষ্টের লাঘব করিয়া জীবনের অবশিষ্ট কাল
কাটাইব। ”
এর পর ‘বিজ্ঞাপন’ শিরোনামে জ্ঞানাভরণ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন
-
“ বহুতর সাহিত্য-বন্ধুর আগ্রহে ও অনুরোধে অতিথি
সাহিত্য-সংসারে অবতীর্ণ হইল । বাঙ্গালা সাময়িক পত্রের প্রচার সম্বন্ধে
যেরূপ অনিয়ম দৃষ্ট হয়, অতিথির সম্বন্ধে সেরূপ ঘটিবে না, বিশেষ
কারণ আছে । সাহিত্য-সংসারে লব্ধপ্রতিষ্ঠ কতিপয় নির্দ্ধারিত সুলেখকের
ভিন্ন অপর কাহারও প্রবন্ধ ইহাতে প্রকাশিত হইবে না । অতিথি ক্রমশঃ
যাহাতে এক খানি উচ্চদরের সাময়িক পত্র বলিয়া পরিগণিত ও আদৃত হয়
তদ্বিষয়ে ব্যয় ও পরিশ্রমের কিছুমাত্র ত্রুটি হইবে না । জন সাধারণের
সুবিধার জন্য অতিথির মূল্য অধিক করিতে না পারায় এক্ষণে কাগজ, মুদ্রাঙ্কন
ও অন্যান্য অঙ্গ সৌষ্টবের প্রতি অভিলাষমত দৃষ্টি রাখিতে পারিলাম
না । গ্রহণেচ্ছুক মহোদয়গণ পত্র লিখিয়া মূল্য প্রেরণ করিলে, তাঁহাদের
নিকটে যথা সময়ে নিয়মিতরূপে অতিথি প্রেরিত হইবে ।”
রচনার শেষে বা সূচীপত্রে কোথাও লেখকের নাম প্রকাশিত হয় নি। প্রতিটি
সংখ্যায় লেখার সংখ্যা ছিল খুবই কম, বিষয় বৈচিত্রও উল্লেখযোগ্য
নয়। রচনার নাম থেকে বিষয় বস্তু সম্বন্ধে হয় ত কিছুটা অনুমান করা
যাবে এই জন্য প্রথম তিনটি সংখ্যার প্রকাশিত বিষয়ের নাম দেওয়া হল
–
- ১ম সংখ্যা ( মাঘ ১২৮৮) : অতিথির পরিচয়, ভারতে ব্রিটিস শাসন
(ক্রমশঃ), সুরসুন্দরী (ক্রমশঃ), প্রণয় সঙ্গীত (কবিতা)।
- ২য় সংখ্যা ( ফাল্গুন ও চৈত্র ১২৮৮) : ভারতে ব্রিটিস শাসন (ক্রমশঃ),
সুরসুন্দরী (ক্রমশঃ), মধুমাস (কবিতা), বৌদ্ধধর্ম্ম (ক্রমশঃ), অবিদ্যা
(কবিতা)।
- ৩য় সংখ্যা : ( বৈশাখ ১২৮৮) : শিবসংহিতা (ক্রমশঃ), সুরসুন্দরী
(ক্রমশঃ), আমরা এত গরীব কেন ?, অদ্ভুত যোগ, ব্রিটিসরাজ ও হিন্দুধর্ম্ম
(ক্রমশঃ)।
এত সদিচ্ছা ও চেষ্টা সত্বেও ‘অতিথি’ এক বছরের বেশি চলেছিল বলে
মনে হয় না । সম্পাদকের নাম অজ্ঞাতই থেকে গেছে ।
সঙ্গে পত্রিকার একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র ও বিজ্ঞাপনের প্রতিলিপি দেওয়া
হল।
চিত্র ১
চিত্র ২
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।