প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

মে ৩০, ২০১৬

 

বেদব্যাস

দীপক সেনগুপ্ত

 

পূর্বে উল্লেখিত ‘জাহ্ণবী’ পত্রিকার মতই হিন্দু ধর্মের মাহত্ম্য প্রচারের জন্য অনুরূপ একটি পত্রিকা ‘বেদব্যাস’। প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল বৈশাখ ১২৯৩ বঙ্গাব্দে। প্রথম দুটি সংখ্যার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল। সম্ভবত সব কপি নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ায়, দ্বিতীয়বার মুদ্রণের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এ থেকে মনে হয় অনুমিত পাঠক সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা ছিল বেশী। ‘বেদব্যাস’ ‘জাহ্ণবী’ পত্রিকার মত স্বল্পায়ু ছিল না। অন্তত ন’বছর পত্রিকাটি চলেছিল। প্রথম সংখ্যার শুরুতেই পত্রিকার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করা হয়েছে :

“ হিন্দুধর্ম্মের প্রকৃক [প্রকৃত?] মহিমাকীর্ত্তনই বেদব্যসের উদ্দেশ্য। আজ অনেকেই ধর্ম্মের নিগূঢ় রহস্য বুঝিবার জন্য উৎসুক। কিন্তু দুঃখ এই, ধর্ম্মের প্রকৃত ব্যাখ্যা কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় না। অনেকে ভ্রমব্যাখ্যা পড়িয়া বিপথে যাইতেছেন। এ দৃশ্য বড়ই শোচনীয়। মহামহিমাময় পণ্ডিতগণের সাহায্যে শাস্ত্রের যথার্থ ব্যাখ্যা বেদব্যাসে যথানিয়মে প্রকাশিত হইবে। দ্বিতীয়ত, স্থূল-চক্ষে স্মৃতিপূরাণ প্রভৃতির বিরোধ যেখানে উপলব্ধি হইবে, সেখানে তাহার বিশদ মীমাংসা থাকিবে। তৃতীয়ত, হিন্দুর চক্ষে রাজনীতির ফলাফল বিচার হইবে। এই কয়টি গভীর গুরুতর বিষয় লইয়া আমরা কার্য্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইলাম। পত্রিকার আকার আপাতত ক্ষুদ্র হইলেও প্রায় প্রতি মাসে ইহাতে অতিরিক্ত পত্র থাকিবে।”

পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন ভূধর চট্টোপাধ্যায়। তবে ৯ম বর্ষ থেকে পত্রিকার নাম পরিবর্তিত হয়ে নতুন নাম হয় ‘বেদব্যাস ও ব্রাহ্মণ’; ভূধর চট্টোপাধ্যায়ের সহ-সম্পাদক ছিলেন তেজশ্চন্দ্র বিদ্যানন্দ। কার্য-সম্পাদক ছিলেন হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। কোন একটি নির্দিষ্ট স্থানে পত্রিকা মুদ্রিত হয় নি। অনেকবার ছাপাখানার পরিবর্ত্তন ঘটেছে। কযেকটি হল : নিউ গুড হোপ প্রেস, বঙ্গবাসী স্টিম মেশিন প্রেস (২১নং মিরজাফর্স লেন, ৩৪/১ কলুটোলা ষ্ট্রীট); বেদব্যাস যন্ত্র (৩৪নং বেনেটোলা লেন পটলডাঙ্গা); জ্ঞানোদয় প্রেস (নং ৮ টেমার্স লেন); নিউ বাল্মীক প্রেস (১৫৯ মাণিকতলা ষ্ট্রীট); অবনি যন্ত্র (১৩নং মাণিকতলা ষ্ট্রীট); কালিকা যন্ত্র (২৩নং যুগলকিশোর দাসের লেন) ইত্যাদি। বেদব্যাস যন্ত্র প্রেসের বিভিন্ন ঠিকানা পাওয়া গেছে; উল্লিখিত স্থান ছাড়াও আরো দুটি ঠিকানা পাওয়া যাচ্ছে - ৯ নং শম্ভুচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ষ্ট্রীট ও ৬নং কলেজ ষ্ট্রীট বাই লেন।

প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত লেখা ছিল : উদ্দেশ্য (সম্পাদক), শ্রাদ্ধতত্ত্ব (শশধর তর্কচূড়ামণী),  বেদার্থবোধ অতি কঠিন (সত্যব্রত সামশ্রমী), আবাহন (প্রকাশক, ভূধর চট্টোপাধ্যায়), অনুষ্ঠান (বীরেশ্বর পাঁড়ে) ও দেবযান (চন্দ্রশেখর বসু)। অন্যান্য সংখ্যার লেখকদের মধ্যে ছিলেন : নীলকণ্ঠ মজুমদার, কৃষ্ণদাস বেদান্তবাগীশ, চন্দ্রকান্ত ন্যায়লঙ্কার, কালীবর বেদান্তাবাগীশ, সারদাপ্রসাদ স্মৃতিতীর্থ বিদ্যাবিনোদ, কামিনীমোহন শাস্ত্রী সরস্বতী, রজনীকান্ত গুপ্ত, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরচ্চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিমোহন সেন, পরমেশ্বর মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
৫ম বর্ষের শেষে পত্রিকার গ্রাহকমূল্য পাঠানোর জন্য যথারীতি আবেদন প্রচারিত হয়েছে –

“ বেদব্যাসের ৫ম বর্ষ অতীত হইতে চলিল। ষষ্ঠ-বর্ষে পুনরায় নবাকারে ও নব আয়োজনে প্রকাশিত হইবে। অতএব বেদব্যাসের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষীগন যথা নিয়মে বৎসরের প্রারম্ভেই বেদব্যাসের প্রাপ্য বার্ষিক মূল্য দিয়া উৎসাহিত করিবেন। নচেৎ আমরা বড়ই বিব্রত ও দুঃখিত হইব।” 

এ রকম বিজ্ঞপ্তি অনেকবারই প্রকাশিত হয়েছে; যেমন কার্যাধ্যক্ষ জানিয়েছেন –

“ বেদব্যাস পত্র ১৩০০ সনে উপনীত হইয়াছে। দুঃখের বিষয় যে, এখনও ১২৯৯ সনের বেদব্যাস পত্রের মূল্য অনেকের নিকটেই বাকি আছে। কিন্তু গ্রাহকগণ এইপ্রকার মূল্য বাকি রাখিলে, ধর্ম্মমণ্ডলীকে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হইতে হয়। কেননা এখন বেদব্যাস ব্যক্তিবিশেষের সম্পত্তি নহে; বেদব্যাস এখন ধর্ম্মমণ্ডলীর মাসিক পত্র; সুতরাং স্বধর্ম্মপরায়ণ ব্যক্তির দ্বারা ধর্ম্মমণ্ডলীর ক্ষতিজনক কার্য্য হওয়া বড়ই বিস্ময়কর সন্দেহ নাই। .... যাঁহারা পত্রিকা লইতে ইচ্ছা না করেন তাঁহারাও পোস্টকার্ডের দ্বারা আমাদিগকে একবার জানাইবেন। পত্রের দ্বারায় না জানাইয়া কেবল কাগজ ফেরৎ দিলে আমরা গ্রাহকশ্রেণী হইতে নাম কর্ত্তন করিতে পারি না।”  ইত্যাদি।

পত্রিকার চাহিদা হয় ত বৃদ্ধি পেয়েছিল; কারণ “ গ্রাহকগণের বিশেষ দ্রষ্টব্য ”  শিরোনামে কার্যাধ্যক্ষ নিম্নের বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করেছেন -

“ আগামী বর্ষ হইতে বেদব্যাসের আশাতিত গ্রাহক বৃদ্ধি হওয়ায় উৎসাহিত হইয়া, আমরা বেদব্যাসের কলেবর বৃদ্ধি করিতে সঙ্কল্প করিয়াছি। সুতরাং মূল্য সম্বন্ধেও পরিবর্ত্তন করিতে হইল। আগামী বৈশাখ হইতে আর অসমর্থ পক্ষে ১ টাকায় কাউকে বেদব্যাস দেওয়া হইবে না। পূর্ণ মূল্য ২ টাকাই সবাইকে দিতে হইবে। কিন্তু যাঁহারা বেদব্যাসের গ্রাহক আছেন, তাঁহারা যদি আগামী বর্ষের মূল্য, ১৫ই চৈত্র মধ্যে, প্রেরণ করেন, তাহা হইলে তাঁহারাও বরাবর ঐ বার্ষিক ১ টাকা মূল্যেই বেদব্যাস পাইবেন। আর যাঁহারা নূতন গ্রাহক হইবেন, তাঁহারা যদি ৩০ শে চৈত্র মধ্যে, বর্ত্তমান ও আগামে বর্ষের একত্রে ২ টাকা পাঠান তাহা হইলে তাঁহারাও বরাবর ১ টাকাতেই পাইবেন। অসমর্থ গ্রাহকগণের সুবিধার জন্য আমরা এক বৎসর ধরিয়া সামান্য অর্থ ১ টাকা মাত্র গ্রহণ করিয়া মাসে মাসে বেদব্যাস পাঠাইয়া আসিতেছি। আরও দুই মাস সময় দিলাম। এখানে বলিয়া রাখি, যে, এ সময় উত্তীর্ণ হইলে আমরা আর কাহারও অনুরোধ শুনিতে বাধ্য হইব না।” 

‘গ্রাহকগণের প্রতি’  শিরোনামে এ ধরণের আর একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছেন কার্য্যাধ্যক্ষ :

“ পোস্ট অফিসের গোলযোগ বশতঃ আমরা এবারে মাঘ ও ফাল্গুন মাসের বেদব্যাস একত্রে প্রকাশিত করিতে বাধ্য হইলাম। ইংরাজি মাসানুসারে পোষ্টাফিসে, আমাদের প্রতি তিন মাসের অগ্রিম ডাক ব্যয় জমা দিতে হয়। কিন্তু বাঙ্গালা হিসাবে আমাদের কাগজ বাহির হয়। ইংরাজি হিসাবে টাকা দেওয়ায় চৈত্র মাস বাদ পড়িয়া যায়। ঐ এক মাসের জন্য আর দুই মাসের টাকা জমা দিয়া লোকসান স্বীকার করিতে হয। সুতরাং একটু বিলম্ব করিয়া দুই মাসের একত্র বাহির করিতে হইল, তজ্জন্য গ্রাহকগণ ক্ষমা করেন এই প্রার্থনা।”

এই বিজ্ঞপ্তিগুলি বিশদভাবে উল্লেখ করা হ’ল এই জন্য যে এগুলি থেকে তৎকালীন প্রকাশক, কার্যাবলী, প্রচলিত ব্যবস্থা ও পাঠকবর্গের মনোভাবের কিছুটা আভাস মেলে।

পত্রিকাটি ২৪ পৃষ্ঠার কম কখনও হয় নি। পত্রিকার কলেবর সম্বন্ধে বলা হয়েছে –

“বেদব্যাস পত্রিকা প্রত্যেক মাসের সংক্রান্তিতে প্রকাশিত হইবে। বেদব্যাসের আকার সম্বন্ধে কোন নিয়ম থাকিবে না, তবে দুই ফর্ম্মার ন্যূন কখনও প্রকাশিত হইবে না।”

নবম বর্ষে সম্পাদক হিসাবে ভূধর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তেজশ্চন্দ্র বিদ্যাবিনোদের নামও মুদ্রিত হয়েছে। পত্রিকায় গল্প, উপন্যাস, কবিতা কখনও প্রকাশিত হয় নি। ‘সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’ শিরোনামে পুস্তক সমালোচনা মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে খুবই কম। দু’য়েকটি ছাড়া ছবি প্রায় নেই বললেই চলে। তবে মহাপুরুষদের অনেক জীবনী চিত্রসহ প্রকাশিত হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন তৈলঙ্গ স্বামী, স্বামী বিশুদ্ধানন্দ সরস্বতী, স্বামী লক্ষণদাস বাবাজী, রমানন্দ স্বামী প্রভৃতি। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনী ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে।      

‘জাহ্ণবী’ ও ‘বেদব্যাস’ দুটি পত্রিকাই হিন্দু ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হলেও, ‘বেদব্যাস’ যে তুলনামূলক ভাবে দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়েছিল, তার কারণ সম্ভবতঃ ‘বেদব্যাসে’ ধর্ম মূলক প্রবন্ধ ছাড়াও সঙ্গীত, মহাপুরুষদের জীবনী, শিক্ষা, বিবাহিত জীবনের ব্যবহার ও অন্যান্য সামাজিক সমস্যা নিয়েও প্রবন্ধ ও আলোচনা প্রকাশিত হত এবং ‘বেদব্যাস’ পত্রিকাটি ছিল ‘ধর্ম্মমন্ডলী’র মুখপত্র।  



চিত্র – ১ : পত্রিকার একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র।


চিত্র – ২ : পত্রিকার একটি বিজ্ঞাপন।


চিত্র – ৩ : পত্রিকায় মুদ্রিত একটি ছবি। কাঠখোদাই বা ধাতুখোদাই দ্বারা নির্মিত।



লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।