প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

নভেম্বর ৩০, ২০১৫

 

ভারতী

দীপক সেনগুপ্ত


রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিলেও ঠাকুরবাড়িতে অন্যান্য যারা গড়ে উঠেছেন,তাদের অনেকেরই সাহিত্য, সঙ্গীত, অভিনয়, সমাজ সংস্কার ইত্যাদিতে গৌরবোজ্বল ভূমিকা রয়েছে। এই পরিবারের সদস্যদের অংশগ্রহণে বিভিন্ন সময়ে একাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। এর দ্বারা সাধারণ পাঠকদের হাতে যেমন নানা ধরণের এবং বিষয়ের লেখা পৌঁছেছে,নতুন লেখক তৈরী করার ক্ষেত্রেও এইসব পত্রিকার অবদানের কথা অস্বীকার করা যায় না। এমনই একটি মাসিক পত্রিকা ‘ভারতী’।

জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহে ‘ভারতী’র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১২৮৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে (১৮৭৭ খৃষ্টাব্দ)। সম্পাদনায় ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর,মূল্য ছিল বার্ষিক তিন টাকা। দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রথমে পত্রিকাটির নাম দিয়েছিলেন ‘সুপ্রভাত’ কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘সুপ্রভাত’ নামটি পছন্দ না হওয়ায় পরিবর্তিত নাম হয় ‘ভারতী’। এমন কি দ্বিজেন্দ্রনাথের প্রচ্ছদ চিত্রণও অনেকের মনের মত না হওয়ায় কাঠে খোদাই করা ব্লকে প্রচ্ছদ তৈরী করে দেন ত্রৈলোক্যনাথ দেব। ‘ভারতী’র পরিচিতি ছিল ঠাকুর বাড়ির পত্রিকা হিসাবে কারণ এর অধিকাংশ লেখাই ছিল ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের দ্বারা রচিত। ‘ভারতী’র প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ১০টি রচনার মধ্যে তিনটিই দ্বিজেন্দ্রনাথের লেখা ; রবীন্দ্রনাথও বাদ পড়েন নি। রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন খুবই কম। ‘ভারতী’তে তার নিজের লেখা সম্বন্ধে বক্তব্য - “এই সময়টাতেই বড়দাদাকে সম্পাদক করিয়া জ্যোতিদাদা ভারতী পত্রিকা বাহির করিবার সংকল্প করিলেন। এই আর-একটা আমাদের পরম উত্তেজনার বিষয় ছিল। আমার বয়স তখন ঠিক ষোলো। কিন্তু আমি ভারতীর সম্পাদকচক্রের বাইরে ছিলাম না। ইতিপূর্বেই আমি অল্পবয়সের স্পর্ধার বেগে মেঘনাদবধের একটি তীব্র সমালোচনা লিখিয়াছিলাম। কাঁচা আমের রসটা অম্লরস,কাঁচা সমালোচনাও গালিগালাজ। অন্য ক্ষমতা যখন কম থাকে তখন খোঁচা দিবার ক্ষমতাটা খুব তীব্র হইয়া উঠে। আমিও এই অমর কাব্যের উপর নখরাঘাত করিয়া নিজেকে অমর করিয়া তুলিবার সর্বাপেক্ষা সুলভ উপায় অন্বেষণ করিতেছিলাম। এই দাম্ভিক সমালোচনাটা দিয়া আমি ভারতীতে প্রথম লেখা আরম্ভ করিলাম। এই প্রথম বৎসরের ভারতীতেই ‘কবিকাহিনী’ নামক একটি কাব্য বাহির করিয়াছিলাম ।”

‘ভারতী’ প্রকাশের উদ্দেশ্য কি ছিল ? প্রথম সংখ্যায় সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘ভূমিকা’য় নিজেই জানিয়েছেন -

“ভারতীর উদ্দেশ্য যে কি, তাহা তাঁহার নামেই স্বপ্রকাশ। ভারতীর এক অর্থ বাণী, আর এক অর্থ বিদ্যা, আর এক অর্থ ভারতের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। বাণিস্থলে স্বদেশীয় ভাষার আলোচনাই আমাদের উদ্দেশ্য। বিদ্যাস্থলে বক্তব্য এই যে, বিদ্যার দুই অঙ্গ, জ্ঞানোপার্জ্জন এবং ভাবস্ফূর্ত্তি। উভয়েরই সাধ্যানুসারে সাহায্য করা আমাদের উদ্দেশ্য। ......

“ অতঃপর আমরা বলিতে চাই যে, যে কারণে ব্রিটানের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা ব্রিটানিয়া নাম ধারণ করিয়াছেন, এবং তাহার বহু পূর্ব্বে এথেন্স নগরের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা মিনার্বা – এথেনিয়া নাম ধারণ করিয়াছিলেন, সেই কারণে ভারতের অধিষ্ঠাত্রীদেবতা সরস্বতী - ভারতী নাম ধারণ করিতে পারেন। সে কারণ কি ? না নামের সহিত ধামের সহিত অকাট্য সম্বন্ধ। আর্য্য-ভাষা মূলসমেত অদ্যাপি কোথায় বিরাজ করিতেছেন ? ভারতে ;

আর্য্য ভাষার অধিদেবতাকে তাই আমরা ভারতী নামে সম্বোধন করিতে পারি। পুনশ্চ, যতপ্রকার বিদ্যা আছে, ভারতভূমি তাবতেরই জন্মভূমি। গণিত, জ্যোতিষ, রসায়ণ, চিকিৎসা, দর্শন, সঙ্গীত, নাটক প্রভৃতি বিদ্যা-সমূহের বীজ প্রথমে ভারত ভূমিতেই অঙ্কুরিত হয়; পরে তাহার ফল দূর দূর দেশে বিকীর্ণ হইয়া, এতদিন পরে তবে তাহা সাধারণ জনগণের ভোগায়ত্ত হইয়াছে। ভারতভূমি বিদ্যার জন্মভূমি, বিদ্যার অধিদেবতাকে তাই আমরা ভারতী নামে সম্বোধন করিতে পারি। এইরূপ যে দিকে দেখা যায় সেই দিকেই ভারতী এবং ভারতের মধ্যে ভাবের প্রগাঢ় মিল দেখিতে পাওয়া যায়; অতএব ইহা মুক্তকণ্ঠে উক্ত হইতে পারে যে, হংসের যেমন পদ্মবন, মহাদেবের যেমন কৈলাস-শিখর, ভারতীর তেমনি ভারতভূমি। কিম্বা পদ্মের মধ্যে যেমন সৌরভ, নক্ষত্রের যেমন জ্যোতি, ভারতের তেমনি ভারতী। ভারত-ভূমিতে যদি জাগ্রত দেবতা অদ্যাপি কেহ বিরাজমান থাকেন তবে তিনি ভারতী। ......

“ আমরা ভাই বন্ধু একত্র হইয়া ভারতীকে আবাহন পূর্ব্বক এই ত প্রতিষ্ঠা করিলাম। এক্ষণে ভারতীর বরপুত্রগণ অগ্রসর হইয়া তাঁহার যাহাতে রীতিমত সেবা চলে, তাঁহার ব্যবস্থা করুন; ভারতীর আশীর্ব্বাদে তাঁহাদের মনস্কামনা পূর্ণ হইবে।”

দ্বিজেন্দ্রনাথের লেখা এ যুগের সাধারণ পাঠকের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয় না। চিন্তামূলক বিষয় নিযে গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাষায় রচনা তৈরীতেই তার ঝোঁক ছিল বেশি। ১২৮৪ থেকে ১২৯০ বঙ্গাব্দ (১৮৭৭-৮৪ খৃষ্টাব্দ) পর্যন্ত সাত বছর সম্পাদক ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ। ১২৯১ বঙ্গাব্দের শুরুতেই (৮ই বৈশাখ,১২৯১) কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যায় ঠাকুর বাড়িতে বিপর্যয় নেমে আসে। কাদম্বরী ‘ভারতী’তে লিখতেন না ঠিকই, কিন্তু তার সাহিত্যানুরাগ ও অনুপ্রেরণা ছিল ‘ভারতী’র চলার পথে অন্যতম পাথেয়।

দ্বিজেন্দ্রনাথ,জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ত ছিলেনই কিন্তু সবাইকে একসঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন কাদম্বরী দেবী। শরৎকুমারীর ভাষায় কাদম্বরী ছিলেন ‘ফুলের তোড়ার বাঁধন’। তার অভাব ভারতী প্রকাশের ক্ষেত্রে ভালভাবেই অনুভূত হয়েছিল,এছাড়া ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে পুলিশি হাঙ্গামা ত ছিলই। সব মিলে পত্রিকাটি বন্ধ হবার উপক্রম হয় এবং বন্ধ হবার খবর ঘোষণাও করা হয় ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র মাধ্যমে। এই দুর্দিনে এগিয়ে আসেন স্বর্ণকুমারী দেবী।

১২৯১ –এর বৈশাখ সংখ্যায় ‘ভূমিকা’তে তিনি লিখেছেন – “আমরা দুঃখের সহিত প্রকাশ করিতেছি পূজনীয় শ্রীযুক্ত দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দাদা মহাশয় বর্ত্তমান বৎসর হইতে এই পত্রিকার সম্পাদকীয় ভার হইতে অবসর গ্রহণ করিলেন। তাহার পরিবর্ত্তে আমরা উক্ত ভার গ্রহণ করিলাম।” অক্লান্ত পরিশ্রমে তিনি পত্রিকাটিকে উজ্জীবিত করে তোলেন। তিনি অবশ্য অকুণ্ঠিত সাহায্য পেয়েছেন মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তির কাছ থেকে। তার সম্পাদনা-কালে পত্রিকার অভিমুখের কি কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল ? এ প্রশ্ন স্বাভাবিক। এ সম্বন্ধে স্বর্ণুকুমারী দেবী নিজেই লিখেছেন –

“ ...... আমরা এখন দেখিতে পাইতেছি মনের যে কয়টি বৃত্তি আছে তাহাদিগের উন্নতি সাধনের নিমিত্ত ভিন্ন ভিন্ন প্রকার মানসিক শিক্ষা আবশ্যক। বিজ্ঞানে জ্ঞানবৃত্তির আর কবিতা, উপন্যাস ইতিহাসে অনুভূতি ও উদযমন [?] বৃত্তির বিশেষ উন্নতির সম্ভাবনা। আমরা যদি আবার প্রকৃতির মধ্যে আমাদের বাস্তবিক অবস্থা বুঝিতে চাই, আমরা যদি প্রকৃতির বাহ্য অবস্থা দেখিয়া সন্তুষ্ট হইতে না চাই, আমরা যদি দৃশ্যমান প্রকৃতির গূঢ়তত্ত্ব অবগত হইতে চেষ্টা করিতে চাই, তবে আমাদের দর্শন শাস্ত্রের আলোচনা করা আবশ্যক। যদি আমাদিগের মন তাহার সীমা কোথায় জানিতে চাহে – তবে আমাদের দর্শনশাস্ত্র অবহেলা করা উচিত নহে। .........

“তবে আমরা এখন হইতে বিজ্ঞানের মাত্রা কিছু বাড়াইতে ইচ্ছা করি – আমাদের মতে বিজ্ঞান শিক্ষার বিশেষ উপকারিতা আছে এবং আজ কাল বিজ্ঞান আলোচনার কতক অনুরাগও দেখা যাইতেছে। ভারতবর্ষীয় মহিলাগণ আজ কাল বিদ্যানুশীলনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন অথচ তাহাদের অনেকের মধ্যে ইউরোপীয় কোন ভাষার সহিত বিশেষ পরিচয় না থাকায় তাহারা বর্ত্তমান কালের বিজ্ঞান শিক্ষা করিতে অপারক [অপারগ] তাহা ছাড়া ইংরাজি জানিয়াও অনেক স্ত্রীপুরুষ অধিক সময় বা অর্থ দিয়া বিজ্ঞান আলোচনা করিতে পারেন না সেইজন্য ভারতীতে সহজ ভাষায় বিবিধ প্রকার বৈজ্ঞানিক বিষয় আলোচনার বিশেষরূপে ইচ্ছা রহিল।”

স্বর্ণকুমারী ছিলেন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক। ঐতিহাসিক ও সামাজিক দু’ধরণের রচনাতেই তিনি মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তার রচিত কয়েকটি উপন্যাস ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে ‘ভারতী’তে। এরকম কয়েকটি উপন্যাস ও তার শুরুর সময় – ‘ছিন্নমুকুল’ (পৌষ ১২৮৫), ‘হুগলির ইমামবাড়ী’ (পৌষ ১২৯১), ‘বিদ্রোহ’ (ভাদ্র-আশ্বিন ১২৯৪), ‘স্নেহলতা’ (‘ভারতী ও বালক’ বৈশাখ ১২৯৬), ‘ফুলের মালা’ (ভাদ্র-আশ্বিন ১২৯৯), ‘কাহাকে’ (বৈশাখ ১৩০৩) ইত্যাদি। পরে অবশ্য গ্রন্থাকারেও এগুলি প্রকাশিত হয়েছে। ‘ভারতী ও বালক’ ১২৯৭ বৈশাখ সংখ্যায় স্বর্ণকুমারী দেবী রচিত ‘পালিতা’ নামক উপন্যাসের পাদটীকায় বিজ্ঞাপিত হয়েছে – “সম্প্রতি আদি ব্রাহ্মসমাজ প্রেস হইতে “স্নেহলতা” নামে একখানি পুস্তক প্রকাশিত হইয়াছে। ইহাতে পাঠক পাঠিকাদিগের মধ্যে কেহ কেহ মনে করিয়াছেন যে ভারতী ও বালকে “স্নেহলতা” শীর্ষক যে উপন্যাসটি ক্রমশঃ প্রকাশিত হইতেছে এই পুস্তকখানি সেই একই উপন্যাস। এটি তাঁহাদের সম্পূর্ণ ভ্রম। এই নব প্রকাশিত স্নেহলতা ও ভারতীর স্নেহলতা এক নহে এবং একজনের লেখাও নহে। এই গোলযোগের জন্য ভারতীর উপন্যাসটির নাম স্নেহলতার পরিবর্ত্তে “পালিতা” দেওয়া হইল।” এ ত গেল উপন্যাসের কথা। এ ছাড়াও স্বর্ণকুমারী ‘ভারতী’তে বহু সংখ্যক গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা লিখেছেন। ১২৯১-এর বৈশাখ থেকে স্বর্ণকুমারী সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন; শ্রাবণ সংখ্যায় ‘বিদেশী ফুলের গুচ্ছ’ নামে কয়েকটি কবিতা প্রকাশিত হয়, সব গুলিই বিদেশের কোন কবি রচিত কবিতার অনুবাদ। তবে এটি আকর্ষণীয় ছিল একটি কারণে – কবিতাগুলির অনুবাদক ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। যে সব কবির কবিতা স্থান পেয়েছে, তারা হলেন – ( মূল রচনায় যেমন ছিল হুবহু সেই নামই রাখা হয়েছে ) – ‘Shelley’, ‘Mrs Browning’, ‘Ernest Myers’, ‘Aubrey Deverr’, ‘Augusta Webster’, ‘P. B. Marston’, ‘Hid’ এবং ‘Victor Hugo’. এখানে ‘Ernest Myers’ রচিত কবিতার অনুবাদটি তুলে দেওয়া হল –

“আমায় রেখ না ধ’রে আর,
আর হেথা ফুল নাহি ফুটে।
হেমন্তের পড়িছে নীহার,
আমায় রেখ না ধ’রে আর।
যাই হেথা হতে যাই উঠে,
আমার স্বপন গেছে টুটে !
কঠিন পাষাণ পথে
যেতে হবে কোন মতে
পা দিয়েছি যবে।
একটি বসন্ত রাতে
ছিলে তুমি মোর সাথে
পোহাল ত, চলে যাও তবে।”

সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ‘ভারতী’তে লেখা প্রকাশ করতেন। শিশুশিক্ষা ও নারীশিক্ষা বিষায়ে তার দুটি লেখা ‘কিণ্টার গার্ডেন’ ও ‘স্ত্রীশিক্ষা’। স্বর্ণকুমারী ‘ভারতী’র সম্পাদনা শুরু করার এক বছর পরেই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সম্পাদনায় ১২৯২-এর বৈশাখে ঠাকুরবাড়ি থেকে আত্মপ্রকাশ করে অর একটি মাসিক পত্রিকা ‘বালক’। রবীন্দ্রনাথ তার ‘জীবনস্মৃতি’তে লিখেছেন – “ বালকদের পাঠ্য একটি সচিত্র কাগজ বাহির করার জন্য মেজবউঠাকুরাণীর বিশেষ আগ্রহ জন্মিয়াছিল। তাঁহার ইচ্ছা ছিল, সুধীন্দ্র, বলেন্দ্র প্রভৃতি আমাদের বাড়ির বালকগণ এই কাগজে আপন আপন রচনা প্রকাশ করে। কিন্তু শুদ্ধমাত্র তাহাদের লেখায় চলিতে পারে না জানিয়া, তিনি সম্পাদক হইয়া আমাকেও রচনার ভার গ্রহণ করিতে বলেন।” কিন্তু নিতান্ত বালক বয়সেই ‘বালক’-এর মৃত্যু হয়। মাত্র এক বছর চলার পর ‘বালক’ ‘ভারতী’র সঙ্গে মিশে ‘ভারতী ও বালক’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে। ১২৯৩ থেকে ১২৯৯ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত এই নামেই পত্রিকা বের হত। ১৩০০ বাংলা বছর থেকে পত্রিকাটি আবার পূর্ব নাম ‘ভারতী’তেই ফিরে আসে।

১৩০২ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় স্বর্ণকুমারী দেবী তার সম্পাদকের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা ঘোষণা করেন। ‘অবসর গ্রহণ’ শীর্ষক একটি বিজ্ঞাপনে তিনি জানান – “এতদিন আমি আমার সাধ্যমত ভারতীর সম্পাদন –কার্য্য নির্ব্বাহ করিয়া আসিয়াছি, এক্ষণে শরীর অসুস্থ হওয়াতে আমার কন্যাদ্বয়ের প্রতি ভারতীর ভার সমর্পণ করিয়া বর্তমান বৎসর হইতে আমি অবসর গ্রহণ করিলাম।”
এই কাজের ভার এর পর ন্যস্ত হয় তার কন্যা হিরণ্ময়ী দেবীর উপর। অপর এক কন্যা সরলা দেবী তখন মহীশূরে শিক্ষকতা করছেন। হিরণ্ময়ী লিখেছেন –“ভাবিলাম একলার নাম না দিয়া যদি দুই ভগিনীর নামে ভারতী চালাই ত নিশ্চয়ই দেখাইবে ভাল। সরলাকে লেখায় তিনিও এ প্রস্তাবে সম্মত হইলেন। আমি অনেকটা আরাম বোধ করিলাম।” এভাবে ছোট বোন সরলা দেবীর নামও যুক্ত হয় ; যুগ্ম-সম্পাদনায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হতে থাকে; যদিও সম্পাদকের কাজ সম্পূর্ণভাবে হিরণ্ময়ী দেবীই দেখাশোনা করতেন। বৈশাখ সংখ্যায় ভূমিকা অংশে হিরণ্ময়ী দেবী চার পংক্তি কবিতা দিয়ে সম্পাদনার কাজ শুরু করেছেন –

“সূর্য্য যবে অস্ত যায় – তার ঠাঁই
ক্ষুদ্র দ্বীপ জ্বলে গৃহমাঝে;
আমিও এ ক্ষুদ্র বল তাই
সমর্পিণু, মা, তোমার কাজে।”

১৩০২-এর বৈশাখ সংখ্যাতেই স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘অবসর গ্রহণে’র বার্তার সঙ্গে ‘নবীন, দূরস্থ সম্পাদকের নিবেদন’ শীর্ষক একটি নিবেদনে সরলা দেবী সুদূর মহীশূর থেকে লিখেছেন –

“আমরা কেন এ সম্পাদনার কাজ গ্রহণ করিলাম ? যোগ্যতর হস্তে যাহা পরিচালিত হইয়া আসিতেছিল, কি ধৃষ্টতায় আমরা তাহার ভার লই ? ধৃষ্টতা নহে, আত্মম্ভরিতা নহে, মাতৃভূমির প্রতি একান্ত অনুরাগে শুধু এ ব্রত গ্রহণে সাহসী হইয়াছি। যখন দেখা গেল পূজনীয়া মাতাঠাকুরাণী ইহা পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেন, আমাদের তরুণ স্কন্ধে তাহার ভার যদি গ্রহণ না করি তবে ইহার সম্পূর্ণ বিলোপ করিতে হইবে, এখন বিবেচ্য হইল এ কর্ত্তব্য একেবারে বিসর্জ্জন দেওয়া ভাল কি আমাদের দুর্ব্বল স্কন্ধে উঠাইয়া লওয়া ভাল। .........”

হিরণ্ময়ী ও সরলা দেবীর এই যুগ্ম-সম্পাদনা চলেছিল তিন বছর - ১৩০২ থেকে ১৩০৪ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত।

হিরণ্ময়ী দেবীর ইচ্ছা রবীন্দ্রনাথ ভারতীর সম্পাদনার কাজ দেখাশোনা করুন। রবীন্দ্রনাথ প্রথমে রাজি না হলেও পরে ভাগ্নীর সনির্বন্ধ অনুরোধ ফেলতে না পেরে রাজি হন। এ প্রসঙ্গে হিরণ্ময়ী লিখেছেন –“... এইরূপে তিন বৎসরকাল আমরা দুই ভগিনী ভারতীর সম্পাদক ছিলাম। আমি কিন্তু ইহার মধ্যে একদিনও মাতুল মহাশয়কে ভারতী গ্রহণের জন্য ভজাইতে ছাড়ি নাই। ক্রমাগত জল ঢালিলে পাথরও ক্ষয় হয় মামা মহাশয়েরও আমার প্রতি করুণার উদ্রেক হইল। তিনি ভারতীর সম্পাদন ভার গ্রহণ করিতে অর্থাৎ লিখিতে ও লেখা নির্বাচন করিতে সম্মত হইলেন। ... এইরূপে পুনরায় ভারতীকে যোগ্য হস্তে সমর্পণ করিয়া আমার সে কি আনন্দ। তবু মামাটির স্বভাব আমার জানা ছিল - বেশিদিন যে এ আনন্দ ভোগ করা আমার ভাগ্যে ঘটিবে না তাহা মনে মনে বুঝিতাম।” হিরণ্ময়ীর আশঙ্কা সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ সম্পাদক পদে ছিলেন মাত্র এক বছর।

‘সাধনা’ পত্রিকা সম্পাদনার অভিজ্ঞতা রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতী’তে কাজে লাগান। তিনি এসে পত্রিকাটির আকারে পরিবর্তন আনেন ও নতুন কিছু বিভাগও সংযুক্ত করেন। বিশেষ করে ‘গ্রন্থ সমালোচনা’ বিভাগটি তার সুচিন্তিত ও মনোজ্ঞ সমালোচনার গুণে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। ‘তার অনেক লেখাই ‘ভারতী’তে বেরিয়েছে; কিন্তু তিনি সম্পাদকের পদে ছিলেন মাত্র এক বছর। লেখা যোগাড় করা, ছাপার কাজ তত্বাবধান করা, প্রুফ দেখা ইত্যাদি কাজ করতে গিয়ে তিনি হাঁপিয়ে ওঠেন। ১৩০৫-এর চৈত্র সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন – “সম্পাদক পদ পরিত্যাগ করিতেছি বলিয়াই যে সকল পক্ষপাতী পাঠক অপরাধ গ্রহণ করিবেন তাঁহারা প্রীতিগুণেই পুনশ্চ অবিলম্বে ক্ষমা করিবেন বলিয়া আমার নিশ্চয় বিশ্বাস আছে। এক্ষণে গত বর্ষ শেষে যে স্থান হইতে ভারতীর মহদ্ভার স্কন্ধে তুলিয়া লইয়াছিলাম বর্ষান্তে ঠিক সেই জায়গায় নামাইয়া ললাটের ঘর্ম মুছিয়া সকলকে নববর্ষের অভিবাদন জানাইয়া বিদায় গ্রহণ করিলাম।”
এক বছর সম্পাদনার পর রবীন্দ্রনাথ ত মুক্ত হলেন। তিনি সম্ভবত মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন ‘বঙ্গদর্শন (নব পর্য্যায়)’ প্রকাশের জন্য। ১৩০৮-এর বৈশাখে তারই সম্পাদনায় এটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ইতিমধ্যে সরলা দেবী মহীশূর থেকে ফিরে এসেছেন। রবীন্দ্রনাথের পর তিনি এককভাবে ‘ভারতী’র সম্পাদনা শুরু করেন; একটানা ন’বছর (১৩০৬-১৩১৪ বঙ্গাব্দ) তিনি এই কাজ করেছেন। ‘ভারতী’কে সর্বাঙ্গসুন্দর করে তুলতে সরলা দেবী প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি নিজেও নানা ধরনের লেখা ভারতীতে প্রকাশ করেছেন। সম্পাদনা সূত্রেই তিনি স্বামী বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে পরিচিত হন। বাঙালী ছাড়াও কিছু অবাঙালী লেখকদেরও রচনা প্রকাশ করেছেন সরলা দেবী। মূল লেখকেরা ইংরাজিতে লিখে দিতেন সরলা সেটা বাংলায় অনুবাদ করে ছাপতেন। এরকম কয়েকটি লেখা – ‘প্রত্যেক মা তার ছেলের জন্য কি করিতে পারে’ ( নিবেদিতা, জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬); ‘বঙ্গমাতার কর্ত্তব্য’ (নিবেদিতা, শ্রাবণ ১৩০৬); ‘পূর্ব্বকালের সমাজশাসন’ ( মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, শ্রাবণ ১৩০৭ ); ‘দক্ষিণ আফ্রিকার ভারতোপনিবেশ’ ( মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, বৈশাখ ১৩০৯ ); ‘জাপানের সনাতন আদর্শ’ ( শিতোকু হোরী, বৈশাখ ১৩১০)। নতুন লেখকদের ছাপার অনুপযুক্ত লেখাও অনেক সময় সম্পাদক ঘষে মেজে ঠিক করে নিতেন ছাপার উপযুক্ত করে, এতে লেখকদের উৎসাহ দান ও লেখক তৈরি, দু’টোই হত।

সরলা দেবী লিখেছেন –

“ভারতীর মধ্য দিয়ে সাহিত্যসেবায়ও একান্তভাবে নিবিষ্ট ছিলুম। নিজের লেখার প্রাচুর্য্য সে সময় ত ছিলই, কিন্তু নিজের লেখার আভরণেই ভারতীর সর্ব্বাঙ্গ ভরে দেবার অভিমান আমার ছিল না। বাণীর একটি সেবকমণ্ডলীকে ভারতীর পার্শ্বে আকৃষ্ট করে সমাদৃত করার লক্ষ্য আমার ছিল। আমার সোফার সামনের দেয়ালে একটি লিস্ট টাঙ্গান থাকত – প্রায় চল্লিশটি নাম, কলকাতায় বা কলকাতার বাইরে যাঁদের বঙ্গসাহিত্য চর্চার ও তাতে কৃতী হওয়ার পরিচয় বা ইঙ্গিতমাত্র কোনরকমে পেয়েছিলুম। পালা পালা করে মাসের মধ্যে একবার করে তাঁদের সঙ্গে আমার পত্রের আদানপ্রদান হত। কুশল-প্রশ্নময় সবিনয় স্মারকলিপি এক একখানি একটি লেখার জন্য। তাঁদের সৌজন্যে তাঁরা কোনদিন আমায় নিরাশ করেন নি।”

বলা বাহুল্য ‘ভারতী’ যে শুধু ‘ঠাকুরবাড়ীর পত্রিকা’ এটা ভাবার আর কোন কারণ ছিল না।

সরলা দেবী প্রত্যেক লেখকের জন্য কিছু পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করেন। ‘জীবনের ঝরাপাতা’ নামক গ্রন্থে এ সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন –

“যে সব লেখকের সহযোগিতায় কাগজখানি গরীয়ান ও স্বত্বাধিকারী লাভবান, সেই লেখকেরা লভ্যাংশের কিছু কিছু পাবে না কেন ? ...... আমি একটা নিয়ম করলুম – ভারতীর প্রত্যেক লেখককেই কিছু না কিছু পারিশ্রমিক উপহার দেব। এখনকার অনেক লোকেদের শুনে আশ্চর্য লাগবে যে, সেকালে এমন লেখকও ছিলেন যাঁরা লিখে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা তাঁদের আত্মসম্মানের পক্ষে হানিজনক মনে করতেন। তাঁদের মত এই – লিখব, সাহিত্যসেবা করব নিজের মনের আনন্দে, তার দরুন অর্থ গ্রহণ কেন ? ... অর্থ গ্রহণে অনিচ্ছুকদের কোন না কোন আকারে বাণীর প্রীতির নিদর্শন পাঠাতুম নববর্ষে বা আশ্বিনে, হয় ত একটি সোনার ফাউন্টেন পেন, হয়ত একখানি ভাল বই।” আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরলা দেবী্র লক্ষ্য ছিল, সেটি হল – সময়ানুবর্তিতা। এ সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন – “ “ভারতী” হাতে নিয়ে মাসিক-পত্রিকাজগতে আরও একটি নতুনত্ব আমি ঢুকিয়েছিলুম, ‘punctuality’ –যথাসাময়িকতা। দেখতুম তখনকার দিনে সাময়িক পত্রিকা কখনই ঠিক সময়ে বেরয় না – বৈশাখের পত্রিকা হয় ত আষাঢ়ে হস্তগত হল, আশ্বিনের অগ্রহায়ণে দেখা দিলে। আমার দৃঢ়পণ হল এই দোষটার সংশোধন করব। করলুমও।”

সরলা দেবী ১৩১২ সালে তেত্রিশ বছর বয়সে হিন্দুস্থান পত্রিকার সম্পাদক ও আইনজীবি রামভজ দত্ত চৌধুরীকে বিয়ে করে লাহোরে চলে যান এবং সেখান থেকেই ‘ভারতী’র সম্পাদনার কাজ চালাতে থাকেন। অত দূরে বসে সম্পাদকের কাজ করার জন্য ‘ভারতী’র প্রকাশ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে স্বর্ণকুমারী দেবী এগিয়ে এসে হাল ধরেন এবং ‘ভারতী’ আবার উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এই পর্বে স্বর্ণকুমারী সম্পাদনা করেছেন ১৩১৫ থেকে ১৩২১ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত। কিন্তু এক সময়ে স্বর্ণকুমারীকে ছেড়ে দিতেই হয়।
১৩২২ বৈশাখ সংখ্যায় ‘বিদায় গ্রহণ’ শিরোনামে তিনি লেখেন – “...... সুরুচি সুশ্লীল সাহিত্যের মধ্য দিয়া জ্ঞানের ক্ষেত্র ও মনের প্রসারতা বৃদ্ধি করাই ভারতীর প্রধানতম কর্ত্তব্য ছিল; আর আনুষঙ্গিক একটি কর্ত্তব্য ছিল , নূতন লেখকদিগকে গড়িয়া তোলা। গুপ্ত প্রতিভাকে ফুটাইয়া তুলিতে ভারতী কোনদিন পরিশ্রম কাতর হয় নাই। যে লেখার মধ্যেই কোন একটু সার পদার্থ মিলিয়াছে তাহাই মার্জিত সুশোভিত আকারে ভারতীর পত্রে স্থান লাভ করিয়াছে।

“যখন এই সম্পাদন ব্রত গ্রহণ করিয়াছিলাম তখন ফলাফল লাভক্ষতি গণনা করিয়া ইহাতে প্রবৃত্ত হই নাই। কর্ম্মের আনন্দই কর্ম্মে উত্তেজিত উৎসাহিত করিয়াছিল। আজ সে উৎসাহ উত্তেজনার দিন ফুরাইয়া গিয়াছে। আজ আমি বড়ই একাকী, বড় অসহায়; আজ শ্রান্ত ক্লান্ত দেহমন একান্তই নিবৃত্তি লোলুপ।
“নবীন সম্পাদক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় আমার স্নেহভাজন আত্মীয়; - তাঁহার প্রতি আশীর্ব্বাদ এই , বিধাতা এ কার্য্যে তাঁহাকে কৃতকার্য্য ও জয়যুক্ত করুন।”

এর পরেই নতুন সম্পাদক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন –

“পূজনীয়া শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবী ভারতীর সম্পাদন ভার আমার হাতে সমর্পণ করিয়াছেন। তাহার এ স্নেহের দান আমি পরম শ্রদ্ধার সহিত মাথায় তুলিয়া লইতেছি। ...... পরিশেষে একটি কথা বলিতে চাই। বঙ্গসাহিত্যে সুপরিচিত আমার পরম বন্ধু শ্রীযুক্ত সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় আমার সহিত একযোগে ভারতীর সম্পাদন-ভার গ্রহণ করিতে স্বীকৃত হইয়াছেন ......”।

মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় দু’জনেই তখন তরুণ লেখক। তারা ‘ভারতী’তে চিত্র যোগ করেন,তাদের সম্পাদনায় সচিত্র ‘ভারতী’ প্রকাশিত হতে থাকে। অনেক পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তখন সাহিত্যিকদের নিয়মিত আড্ডা বসত; ‘ভারতী’র ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়,সুকুমার রায়,প্রেমাঙ্কুর আতর্থী,নরেন্দ্র দেব,হেমেন্দ্র কুমার রায়, নজরুল, অবনীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ সাহিত্যিকদের সম্মিলনে সাহিত্যচক্র উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

১৩৩০ বঙ্গাব্দে স্বামী রামভজের মৃত্যু হলে শোকগ্রস্ত অবস্থায় সরলা দেবী কলকাতায় ফিরে আসেন এবং ‘ভারতী’ সম্পাদনার ভার নিজের হাতে তুলে নেন,হয় ত কিছুটা কাজের মাধ্যমে শোকের হাত থেকে রেহাই পেতে। ছবির প্রকাশ বন্ধ করে দিয়ে পত্রিকাটিকে চিত্র বর্জিত করেন তিনি এবং নানা ভাবে এটির মানোন্নয়নের চেষ্টা করেন। আপ্রাণ পরিশ্রম ও চেষ্টা করেও ‘ভারতী’ কিন্তু আর আগের জৌলুষ ফিরে পায় নি। ১৩৩৩-এর কার্তিক সংখ্যাই পত্রিকাটির শেষ সংখ্যা। ‘ভারতী’ অনেক লেখককে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে। এমন কি রবীন্দ্রনাথ তার ‘বৌ ঠাকুরাণীর হাট’,’চিরকুমার সভা’,’নষ্টনীড়’ ইত্যাদি ‘ভারতী’তেই প্রকাশ করেছেন। শরৎচন্দ্রের ‘বড়দিদি’ লেখাটি ‘প্রবাসী’ থেকে অমনোনীত হয়ে ফেরত এলে সরলা দেবী সেটি ‘ভারতী’তে প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। প্রথম কয়েকটি সংখায় লেখকের নাম না থাকায় লোকে এটিকে রবীন্দ্রনাথের লেখা বলে ধরে নিয়েছিলেন। শেষের সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের নাম ছাপা হলে শক্তিশালী লেখক হিসাবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ ভারতীর পরিবর্তে ‘বঙ্গদর্শন’-এ প্রকাশ করায় রবীন্দ্রনাথের উপর সরলা দেবী যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ১২৮৪ থেকে ১৩৩৩ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে একটানা প্রকাশিত হয়েছিল ‘ভারতী’। তখনো পর্যন্ত এটিই ছিল সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী বাংলা পত্রিকা। পত্রিকাটির সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষ্যে সমসাময়িক লেখিকারা পত্রিকাটিকে মহিলাদের পত্রিকা হিসাবে অভিহিত করেন এবং স্বর্ণকুমারী দেবী রচিত বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধগুলিও যথেষ্ট প্রশংসিত হয়। নতুন লেখক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পত্রিকাটির ভূমিকা সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন। হেমেন্দ্র কুমার রায়ের ভাষায় “ ভারতী আর বাঁচল না। এ দুঃখ আমার আজও যায় নি। কারণ প্রধানতঃ ভারতীকে অবলম্বন করেই সাহিত্যক্ষেত্রে আমি হয়েছিলুম পরিচিত ”।

স্বর্ণকুমারী ‘ভারতী’ সম্পাদনা করেছেন প্রথম পর্যায়ে ১২৯১ থেকে ১৩০১ বঙ্গাব্দ (১৮৮৪-৯৪ খৃষ্টাব্দ) – মোট এগারো বছর এবং পরবর্তী পর্যায়ে ১৩১৫ থেকে ১৩২২ বঙ্গাব্দ (১৯০৮-১৫ খৃষ্টাব্দ) - আরও সাত বছর,মোট আঠারো বছর। বাংলা পত্রিকা সম্পাদনায় মহিলাদের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।

‘ভারতী’-র ১ম সংখ্যায় যে সব লেখা প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলি হল - ভূমিকা; ভারতী (কবিতা ); তত্ত্বজ্ঞান কতদূর প্রামাণিক; মেঘনাথ বধ কাব্য (মাইকেল মধুসূদন প্রণীত ) [আলোচনা ]; জ্ঞান, নীতি ও ইংরাজি সভ্যতা (বকল সাহেব-কৃত ইংলণ্ডীয় সভ্যতার ইতিহাস ); বঙ্গ-সাহিত্য (শ্রীযুক্ত রমেশচন্দ্র দত্ত সি.এস. প্রণীত বঙ্গ-সাহিত্য) [আলোচনা ও সমালোচনা ]; গঞ্জিকা অথবা তুরিতানন্দ বাবাজির আকড়া; ভিখারিণী; স্বাস্থ্য (ধারাবাহিক ); সম্পাদকের বৈঠক।

‘ভারতী’ জীবিত ছিল দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর। যারা সম্পাদক ছিলেন তাদের এক নজরে দেখে নেওয়া যাক। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (শ্রাবণ ১২৮৪-১২৯০ ); স্বর্ণকুমারী দেবী (১২৯১-১৩০১); হিরণ্ময়ী দেবী, সরলা দেবী (১৩০২-১৩০৪); রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৩০৫); সরলা দেবী (১৩০৬ - ১৩১৪); স্বর্ণকুমারী দেবী (১৩১৫-১৩২১); মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় (১৩২২-১৩৩০ ); সরলা দেবী (১৩৩১-আশ্বিন ১৩৩৩ )|

শেষ দিকে ‘ভারতী’র আর্থিক সঙ্কট ঘনীভূত হয়। পঞ্চাশ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে ১৩৩৩-এর বৈশাখ সংখ্যাটি জুবিলি সংখ্যা হিসাবে প্রকাশিত হয়। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় নতুন গ্রাহক হবার জন্য আবেদন বিজ্ঞাপিত হয়। সংকটের মধ্যেও আশ্বিন মাসে বেরোয় শারদীয় সংখ্যা। এটাই সম্ভবতঃ ‘ভারতী’র শেষ সংখ্যা।

‘ভারতী’ প্রথমে ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা নামে পরিচিত হলেও ধীরে ধীরে সেটা কাটিয়ে ওঠে। সে সময়ের বহু লেখক ও কবি এগিয়ে এসেছেন তাদের রচনা সম্ভার নিয়ে নিয়ে। ‘ভারতী’কে আশ্রয় করেই তাদের অনেকে সাহিত্য জগতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথের অজস্র প্রবন্ধ, গান, কবিতা সাধারণের কাছে পৌঁছেছে ‘ভারতীর’ মাধ্যমে। ‘ভারতবর্ষ’ ও ‘প্রবাসী’ ছাড়া আর কোন পত্রিকা এত দীর্ঘকাল সাহিত্যাকাশে স্থায়ী হয় নি। সাময়িক পত্রের একটি বিশেষ উদ্দেশ্য হ’ল নামী লেখকদের রচনা ও বিবিধ বিষয়ের লেখা প্রকাশের মাধ্যমে পাঠকদের সাহিত্যমনস্ক করা এবং তাদের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলতে সাহায্য করা, একই সঙ্গে নতুন লেখকদের সৃজন ক্ষমতাকে স্বীকৃতি জানিয়ে তাদের পরিণত হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া। ‘ভারতী’ এই দুই ক্ষেত্রেই সসম্মানে উত্তীর্ণ।
সংযুক্ত প্রতিলিপি –
চিত্র – ১ : দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পাদনায় পত্রিকার একটি আখ্যাপত্র।
চিত্র – ২ : ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকার একটি আখ্যাপত্র।
চিত্র – ৩ : পত্রিকার পঞ্চাশতম বর্ষ উপলক্ষ্যে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের শুভেচ্ছা বাণী।
চিত্র – ৪ : ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকায় ১২৯৪ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত স্বর্ণকুমারী দেবীর রচিত
পুস্তকের একটি বিজ্ঞাপন।
চিত্র – ৫ : ‘ভারতী ও বালক’ পত্রিকায় ১২৯৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত বাদ্যযন্ত্রের বিজ্ঞাপন।
চিত্র – ৬ : ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের পূজা সংখ্যার প্রারম্ভিক পৃষ্ঠা। সম্ভবত এটাই ‘ভারতী’র শেষ
সংখ্যা।


চিত্র ১


চিত্র ২


চিত্র ৩


চিত্র ৪

চিত্র ৫



চিত্র ৬


লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।