পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র
ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৫
বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহ
দীপক সেনগুপ্ত
১৮৫১ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতায় ‘ভার্নাকুলর এডুকেশন সোসাইটি’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিবিধ বিষয়ে মানুষকে শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টায় ‘বিবিধার্থ সঙ্গ্রহ’ প্রকাশিত হয় ১৮৫১ সালের অক্টোবর মাসে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ৫৫নং পার্ক স্ট্রীটস্থ সম্পাদক ভবন থেকে। বাংলা ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম সচিত্র মাসিক পত্রিকা। ১৬ পৃষ্ঠার এই মাসিক পত্রিকাটি “পুরাবৃত্তের আলোচনা, প্রসিদ্ধ মহাত্মাদিগের উপাখ্যান, প্রাচীন তীর্থাদির বৃত্তান্ত, স্বভাবসিদ্ধ রহস্য ব্যাপার, খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন, বাণিজ্যদ্রব্যের উৎপাদন, নীতি-গর্ভ উপন্যাস, রহস্যব্যঞ্জক আখ্যান, নূতন গ্রন্থের সমালোচন” প্রভৃতি নানাবিধ বিষয়ের আলোচনায়ও পূর্ণ হয়ে প্রকাশিত হত। সম্পাদনায় ছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র । তিনি ‘বঙ্গভাষানুবাদক সমাজ’-এর নিকট থেকে পত্রিকাটির জন্য ৮০ টাকা সাহায্য পেতেন। প্রথম সংখ্যায় সূচনার শেষে সম্পাদক বঙ্গভাষানুবাদক সমাজের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লিখেছেন –‘বঙ্গবাভাষানুবাদক সমাজের আনুকূল্যে এই পত্র স্থাপিত হইল। অতএব এতৎসমাজস্থ মহোদয়গণের নিকট আমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতেছি। উক্ত সামাজস্থ মহাশয়েরা বঙ্গ ভাষাদ্রোহী জনগণের উপহাস সহ্য করত শুদ্ধ পরোপকারার্থে এতদ্দেশীয় ভাষার উন্নতির চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন এবং বিপুলার্থ ব্যয় করিয়া নানাবিধ উত্তম গ্রন্থ সকল প্রস্তুত করাইতেছেন. অতএব ভদ্রসমাজে উহারা অবশ্য সমূহ প্রশংসার পাত্র হইবেন। এবং এতদ্দেশস্থ সকলেই যে ইহাদিগকে ধন্যবাদ করিবেন ইহাতে কোনো সন্দেহ নাই।”
পত্রিকাটির শিরোদেশে লেখা থাকত এই বাক্যটি :
“পুরাবৃত্তেতিহাস-প্রাণিবিদ্যা-শিল্প-সাহিত্যাদি-দ্যোতক-মাসিকপত্র”।
পত্রিকার নামের বানান যে ভাবে লেখা হত টাইপ সেটিং-এ অসুবিধা থাকায় সেটা একটু পরিবর্তন করে লেখা হয়েছে। মূল নামটির বানান পাওয়া যাবে সন্নিবেশিত প্রতিলিপিতে।
১৮৫১ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ ‘বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহ’ পত্রিকা সম্বন্ধে যে বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়েছিল তার কিছুটা অংশ এই রকম :
“........বঙ্গভাষানুবাদক সমাজের আনুকূল্যে উপরোক্ত নামক এক নূতন মাসিক পত্র আগামি আশ্বিন মাসাবধি প্রকটিত হইবেক। যাহাতে বঙ্গদেশস্থ জনগণের জ্ঞানবৃদ্ধি হয় এবং সৎ ও আনন্দ-জনক প্রস্তাব সকল প্রচার করা উক্ত সমাজের মুখ্য কল্প,এবং ইংরাজী ভাষায় ‘পেনি মেগাজিন’ নামক পত্রের অনুবর্ত্তিত এতৎপত্রে তদভিপ্রায় সিদ্ধার্থে অবিরত সম্যক চেষ্টা করা হইবেক। আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলের পাঠযোগ্য করণার্থে উক্ত পত্র অতি কোমল ভাষায় লিখিত হইবেক এবং তত্রত্য প্রস্তাবিত বস্তু সকলের বিশেষ পরিজ্ঞানার্থে তাহাতে নানাবিধ ছবি থাকিবেক। এই পত্রের প্রতি সংখ্যার পরিমাণ ১৬ পৃষ্ঠা এবং ইহার বার্ষিক মূল্য দেড় টাকা নিরূপণ করা গিয়াছে,....... । শ্রী রাজেন্দ্রলাল মিত্র। বিবিধার্থ সঙ্গ্রহ সম্পাদক। শুঁড়া ২ শ্রাবণ, শকাব্দাঃ ১৭৭৩।”
‘বিবিধার্থ সঙ্গ্রহ’ সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের প্রতিক্রিয়া – “ রাজেন্দ্রলাল মিত্র মহাশয় বিবিধার্থ-সংগ্রহ বলিয়া একটি ছবিওয়ালা মাসিকপত্র বাহির করিতেন । তাহারই বাঁধানো একভাগ সেজদাদার আলমারীর মধ্যে ছিল । সেটি আমি সংগ্রহ করিয়াছিলাম । বার বার করিয়া সেই বইখানা পড়িবার খুশি আজও আমার মনে পড়ে । সেই বড় চৌকা বইটাকে বুকে লইয়া আমাদের শোবার ঘরের তক্তপোশের উপর চিত হইয়া পড়িয়া নর্হাল তিমিমৎস্যের বিবরণ, কাজির বিচারের কৌতূকজনক গল্প, কৃষ্ণকুমারীর উপন্যাস পড়িতে পড়িতে কত ছুটির দিনের মধ্যাহ্ণ কাটিয়াছে।”
পত্রিকাটিতে যারা লিখেছেন তারা হলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (পাথুরিয়াঘাটা ), ক্ষেত্রমোহন ভট্টাচার্য, মথুরামোহন তর্করত্ন, কালীপ্রসন্ন সিংহ, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, আনন্দ ঠাকুর, যাদবকৃষ্ণ সিংহ, হরিমোহন সেনগুপ্ত, নবীনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীপতি মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি। মাইকেল মধুসূদনের ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্য ‘বিবিধার্থ-সঙ্গ্রহ’ পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হতে শুরু করে।
‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ সে সময়ে পাঠকদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল কিন্তু পত্রিকাটির গুরুগম্ভীর ভাষা এবং জটিল তত্ত্বগুলি সাধারণের কাছে অনেক সময় দুর্বোধ্য মনে হত। তুলনামূলকভাবে ‘বিবিধার্থ সঙ্গ্রহ’ অনেক সহজ ভাষায় বিবিধ বিষয় পরিবেশন করত। এ কারণে পত্রিকাটি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কেদারনাথ লিখেছেন -তত্ত্ববোধিনীর যখন গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৭০০ হইয়াছিল, ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ বার শত মুদ্রিত হইয়া বার শতই বিলি হইত।”
পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় যে রচনা গুলি ছিল সেগুলি হল : সূচনা; হোমা (হোমা পাখীর ছবি সহ); গ্রাম্য গ্রন্থালয়; জিব্রা শ্রেণীস্থ পশুর বিবরণ (মৃগয়ার ছবি সহ ); শিখ ইতিহাস (কতিপয় শিখের ছবি সহ ) এবং কৌতুককণা (ভৌত বিচার )। ছবিগুলি সব বিলেত থেকে ছাপিয়ে আনা হত। কোন রচনায় লেখকের নাম উল্লেখ করা হয় নি।
অনেকে মনে করেন প্রমদাচরণ সেনের ‘সখা’ মাসিক পত্রিকাতেই প্রথম ‘ড্রপ লেটার’ ( Drop letter) ব্যবহৃত হয়। এটা হয় ত ঠিক নয়, কারণ তার বহু আগেই ‘বিবিধার্থ সঙ্গ্রহ’ পত্রিকাতে এটি ব্যবহৃত হয়েছিল। ভিক্টরীয় যুগে ব্যবহৃত এই রীতি অনুসারে প্রতিটি রচনার আদ্যক্ষরটি বড় আকারের হয় এবং অলঙ্কৃত থাকে এবং পরবর্তী অক্ষরগুলি সাধারণ নিয়মে মুদ্রিত হয়। এখনও মাঝে মাঝে এর ব্যবহার দেখা যায়। সে যুগে প্রথম অক্ষরটি কাঠ খোদাই ব্লকে তৈরী হত এবং অন্যান্য অক্ষর সাধারণ আকারের ধাতু নির্মিত থাকত।
ছয়টি সংখ্যা প্রকাশের পর স্বাস্থ্যের কারণে রাজেন্দ্রলাল সম্পাদনার কাজ ছেড়ে দিলে এই কাজের ভার নেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। ‘নীলদর্পন’ নাটক ইংরাজিতে প্রচার করার অপরাধে পাদরি জেমস লঙ ১০০০ টাকা জরিমানা ও এক মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন (২৪শে জুলাই, ১৮৬১)। এ নিয়ে কালীপ্রসন্ন ১৮৬১ খৃষ্টাব্দের জুলাই সংখ্যায় একটি সমালোচনা প্রকাশ করে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। ভার্নাকুলার লিটারেচার সোসাইটি পত্রিকাটি প্রকাশের জন্য অনুদান বন্ধ করে দিলে পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায় । এ সম্বন্ধে ১৮৬৯ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ‘সম্বাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’ পত্রিকায় যে সংবাদ পরিবেশিত হয় সেটি হল :
“প্যারিবাবু (প্যারীচরণ সরকার ) দেখিলেন এ পত্রে আপন অভিপ্রায়মত প্রস্তাবাদি লিখিলে বেঙ্গল গবর্ণমেন্ট বিরক্ত হইয়া উঠেন তজ্জন্যই তিনি মানে মানে ইহার সম্পাদকীয়তা পরিত্যাগ করেন। বিবিধার্থ সংগ্রহ নামে আর একখানি গবর্ণমেন্ট সংক্রান্ত সংবাদ পত্র ছিল। কিয়দ্দিবসের নিমিত্ত বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয় তাহার সম্পাদক হইয়াছিলেন। সম্পাদক বাবু বিবিধার্থে নীলকরদিগের গ্লানি প্রকাশ করায় গবর্ণমেন্ট যার পর নাই অসন্তুষ্ট হইয়া উঠেন, এবং সেই সূত্রেই বিবিধার্থের বিনাশ হয়।”
সংযুক্ত প্রতিলিপি পরিচয় –
চিত্র ১ – পত্রিকার একটি সংখ্যার আখ্যাপত্র।
চিত্র ২ , ৩ –পত্রিকায় প্রকাশিত দুটি ছবি।
চিত্র ৪ – একটি প্রবন্ধের প্রথম পৃষ্ঠার প্রতিলিপি।
চিত্র ১
চিত্র ২
চিত্র ৩
চিত্র ৪
লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।