প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িক ও সংবাদপত্র: দিগ্দর্শন (সূচী)

       ১৮১৮ সালটি সাময়িক পত্রের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বছরের এপ্রিল মাসে ( ১২২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখে ) প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাময়িক পত্র,‘দিগ্দর্শন’। এটি ছিল একটি মাসিক পত্রিকা এবং সম্পাদক ছিলেন জোশুয়া মার্শম্যানের পুত্র জন ক্লার্ক মার্শম্যান,যার উল্লেখ ‘ভূমিকা’তে আগেই করা হযেছে। প্রকাশক ছিলেন শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস। ‘দিগ্দর্শন’-এর ২৬টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল তিনটি বিভিন্ন সংস্করণে। বাংলা সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল ১-২৬ সংখ্যা; ইংরেজি-বাংলা সংস্করণে ১-১৬ সংখ্যা এবং ইংরেজি সংস্করণে ১-১৬ সংখ্যা। ‘দিগ্দর্শন’কে অনেকে সংবাদপত্র হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন; কিন্তু সংবাদ পত্র বলতে যা বোঝায় ‘দিগ্দর্শন’ তা ছিল না,এতে সংবাদ তেমন পরিবেশিত হত না। তখন খুব বেশি লোকের বাংলা ভাষা জ্ঞান ছিল না,ডাকেরও সমস্যা ছিল। এই সব কারণে পত্রিকাটির প্রচার তেমন ছিল না। ২৬টি সংখ্যা মোট ছাপা হযেছিল ১০৬৭৬ কপি অর্থাৎ প্রতি সংখ্যা গড়ে মাত্র ৪০০ টি। ‘দিগ্দর্শন’ সচিত্র ছিল না এবং এতে মূলতঃ পাঠ্য পুস্তকে বর্ণিত বিষয়েরই আলোচনা থাকত। বিষয়বস্তু ছিল পদার্থ বিদ্যা,প্রাণীবিদ্যা,ভূগোল,সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি। ভাষা ও বিষয় বস্তুর একটু নমুনা দেখা যাক :

       “অনুমান হয় পাঁচশত বৎসর গত হইল চুম্বকপাথরের গুণ প্রথম জানা গেল তাহার গুণ এই যে তাহাকে কোন লৌহে ঘষিলে সে সর্বদা দুই কেন্দ্রে অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ ভাগে থাকে সেই লৌহ কোম্পাসের মধ্যে দিলে সমুদ্রে কিম্বা মৃত্তিকার উপরে যে কোন স্থানে কোন লোক থাকে সেই কোম্পাসের দ্বারা পৃথিবীর সকল ভাগ সে জানিতে পারে।”
পৃষ্ঠাটির একটি প্রতিলিপি দেওয়া হল। লক্ষণীয় বিষয় হল সে সময়ে রচিত বাক্যে কোন যতি চিহ্ণ থাকত না। এটা ইংরেজি ভাষার দেখাদেখি পরে ব্যবহৃত হতে থাকে।

        ২য় খণ্ড-১৩ ভাগ-১৮২০ জানুয়ারি সংখ্যায় ‘চীন দেশের মহাপ্রাচীর বিষয়ে’ লেখা হয়েছে : “এই প্রাচীর চীন দেশের সকল হইতে আশ্চর্য্য এবং প্রায় পৃথিবীর মধ্যেই আশ্চর্য্য ঐ প্রাচীর দ্বারা তাতার দেশ হইতে সে দিকে চীন দেশের রক্ষা হয়।” ‘দিগ্দর্শন’ দীর্ঘস্থায়ী না হলেও প্রথম পত্রিকা হিসাবে নিশান হাতে দিক দর্শানোর ভূমিকায় অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।

       ‘দিগ্দর্শন’ প্রকাশের একটা অন্য ইতিহাস আছে। সে সময়ে প্রশাসকেরা ইংরেজী সংবাদপত্রকে খুব ভাল চোখে দেখত না। সেজন্য ‘দিগ্দর্শন’কে সংবাদপত্রের পরিবর্তে পরীক্ষামূলকভাবে মাসিক পত্র হিসাবে প্রকাশ করা হয়েছিল। ‘দিগ্দর্শন’ প্রকাশের পরেও যখন কোন আপত্তি উঠল না,তখন মিশনারিরা অন্য নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বের করতে মনস্থ করেন। ইংল্যাণ্ডের প্রাচীনতম সংবাদপত্র Mirror of News-এর নামানুসারে এর নাম ‘সমাচার দর্পণ’ রাখা সাব্যাস্ত হয়।

       ‘দিগ্দর্শন’-এর প্রকাশনা শুরু হয় ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে। বিষয়বস্তু নির্বাচনের ধরণ বোঝাবার জন্য          এখানে ১ম ও ২য় সংখ্যার বিষয়সূচী তুলে ধরা হল:

১ম খণ্ড-১ম ভাগ-১৮১৮ এপ্রিল
আমেরিকার দর্শন বিষয়
বলুন দ্বারা সাদলর সাহেবের আকাশভ্রমণ
হিন্দুস্থানের সীমার বিবরণ
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্ররায়ের বিবরণ
হিন্দুস্থানের বাণিজ্য
শঙ্কর তরঙ্গের কথা
১ম খণ্ড-২য় ভাগ-১৮১৮ মে
উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরিয়া ইউরোপ হইতে ভারতবর্ষে প্রথম আসিবার কথা
ভারতবর্ষের স্বাভাবিক বৃক্ষ
ইংলণ্ডের বাদশাহের পৌত্রীর মৃত্যু বিবরণ
কোমিল্লার পাঠশালার বিষয়
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় বাহাদুরের কথা।

        রেভারেণ্ড লঙ ‘দিগ্দর্শন’কে সংবাদপত্র ব’লে উল্লেখ করলেও এতে কোন সংবাদ থাকত না। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা যে কোন সংবাদপত্রকেই খুব ভাল চোখে দেখত না; তাদের মতে সংবাদপত্র ছিল উগ্র ও অশালীন ভাষায় রচিত। তখন যে কটি সংবাদপত্র প্রকাশিত হত সবই ছিল ইংরাজি ভাষায়। ১৭৯৯ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে ওয়েলেসলি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করে একটা আইন প্রণয়ন করেন। এই আইন অনুসারে প্রকাশের আগে বিষয়বস্তু সেক্রেটারিকে পাঠিয়ে অনুমোদন নিতে হত এবং ছাড়পত্র পেলে তবেই তা মুদ্রিত হতে পারত। একবার একটি কৌতুকপ্রদ ঘটনা ঘটে। ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে সংবাদ-পরীক্ষক বেলী সাহেব ‘মর্ণিং পোস্ট’ কাগজের একটি সংবাদ প্রকাশ করতে নিষেধ করেন,কিন্তু পরিচালক ও সম্পাদক হিটলী সাহেব তা উপেক্ষা করে খবরটি ছাপিয়ে দেন। হিটলী জানিয়ে দেন যে আইনটি ইউরোপিয়ানদের ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য। কিন্তু তার মা এদেশীয় এবং তার জন্মও এদেশে ; অতএব তার জন্য আইনটি প্রযোজ্য নয়। যুক্তিটির যথেষ্ট সারবত্তা ছিল। যেহেতু একই আইন দু’ক্ষেত্রে ভিন্ন ভাবে প্রয়োগ করা যায় না; সেজন্য গভর্ণর জেনারেল লর্ড হেস্টিংস আইনটি রহিত করার সিদ্ধান্ত নেন। মিশনারিদের উদ্দেশ্য ছিল একটি বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করা,কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কোন ভাবেই যেন রাজরোষে না পড়তে হয়,সেজন্য পরীক্ষামূলক ভাবে ‘দিগ্দর্শন’ সংবাদপত্রটি মাসিক পত্রিকা আকারে প্রকাশিত হতে থাকে। এতে তাই সংবাদ তেমন কিছুই ছিল না,ছিল কিছু প্রবন্ধ। সম্পাদক মার্শম্যান সাহেব এপ্রিল ও মে মাসের দুটি কপি গভর্ণমেণ্টকে পাঠিয়ে দেন। যখন কোন আপত্তি হল না,তখন বিলাতের প্রাচীন সংবাদপত্র ‘Mirror of News’-এর অনুকরণে মার্শম্যান একটি নতুন সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশ করেন। ‘সমাচার দর্পণে’র কপি হাতে পেয়ে লর্ড হেস্টিংস এটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। তখন ‘সমাচার দর্পণ’ চালিয়ে যাওয়ার এবং ‘দিগ্দর্শন’ তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ‘দিগ্দর্শন’-এর শেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল দুটি লেখা – ‘হিন্দুস্থানের অবশিষ্ট ইতিহাস (১৭৬০ অব্দ পর্যন্ত)’ এবং ‘দিগ্দর্শনের শেষ অভিধান’।

       ‘দিগ্দর্শন’-এর লেখকদের মধ্যে ছিলেন ডঃ কেরী,মিঃ ওয়ার্ড,ডঃ মার্শম্যান ও তার পুত্র মিঃ মার্শম্যান প্রভৃতি মিশনারিরা। এছাড়া ছিলেন রামমোহন প্রমুখ এদেশীয় পণ্ডিত ব্যক্তিগণ। রামমোহন রায়ের লিখিত ‘অয়স্কান্ত অথবা চুম্বকমণি’,‘মকর মৎস্যের বিবরণ’,‘বলুন’,‘প্রতিধ্বনি’ ইত্যাদি প্রবন্ধ প্রথম ‘দিগ্দর্শনে’ই প্রকাশিত হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে কেদারনাথ মজুমদার জানিয়েছেন – “১৮৫৪ অব্দে জনৈক মিশনারিসাহেব স্কুল বুক সোসাইটির দ্বারা বঙ্গ-বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগের জন্য ‘বঙ্গীয় পাঠ্যাবলী’ নামে এক পুস্তক প্রকাশ করেন। আমরা মিলাইয়া দেখিয়াছি সেই প্রবন্ধগুলি ও ‘দিগ্দর্শনে’র প্রবন্ধগুলি এক ।” ‘দিগ্দর্শনে’র ৭ম সংখ্যায় ‘ছাপা কর্ম্মের উৎপত্তির বিবরণ’ নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এতে ছাপাখানার সে সময়ের ইতিহাস বিবৃত রয়েছে। মুদ্রণ শিল্পে সমসাময়িক প্রচেষ্টা ও বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্যম সম্বন্ধে জানতে এ প্রবন্ধটি গুরুত্বপূর্ণ। সুযোগ পেলে প্রসঙ্গান্তরে এটি উদ্ধৃত করা যাবে।
‘দিগ্দর্শনে’র মলাট দুটি ভাষায় ছাপা হত,ইংরাজি ও বাংলা। নীচে এটির একটি নমুনা দেওয়া হল।

দিগ্দর্শন
অর্থাৎ
যুব লোকের কারণ সংগৃহীত নানা উপদেশ।
ইংরেজি এপ্রিল – ১৮১৮ লাং মার্চ ১৮১৯
এবং
ইংরেজি জানুয়ারি লাং এপ্রিল ১৮২০।

 

DIGDURSHAN
or the
Indian youth’s Magazine
from April 1818 to March 1819
and from
January to April 18
20

        এদেশে প্রথম পত্রিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রে ডাঃ যোশুয়া মার্শম্যান ও তার বড় ছেলে জন ক্লার্ক মার্শম্যানের অবদান অপরিসীম। ডাঃ মার্শম্যান শ্রীরামপুরে ১৮৩৭ সালের ৫ই ডিসেম্বর এবং মিঃ মার্শম্যান বিলাতে ১৮৭৭-এর ৮ই জুলাই পরলোক গমন করেন।
     এখানে ‘দিগ্দর্শনে’র বাংলা সংস্করণের প্রথম সংখ্যার একটি পৃষ্ঠার প্রতিলিপি দেওয়া হল।

দীপক সেনগুপ্ত

 

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।



Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।