বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদ পত্র ‘সমাচার দর্পণ’; কিন্তু বাংলা
ভাষায় বাঙালিদের দ্বারা পরিচালিত প্রথম সংবাদ পত্রের নাম ‘বাঙ্গাল
গেজেটি’। শ্রীরামপুরের নিকটস্থ বহরা গ্রাম নিবাসী গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য
ছিলেন শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের কম্পোজিটর। স্বাধীন ভাবে গ্রন্থ ও
পত্রিকা প্রকাশনার ব্যবসা শুরু করার অভিপ্রায়ে ১৮১৮ সালে কলকাতায়
‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’ নামে একটি মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।
এখান থেকেই ১৮১৮ সালের জুন (?) মাসে সাপ্তাহিক ‘বাঙ্গাল গেজেটি’
প্রকাশিত হতে থাকে।
'বাঙ্গাল গেজেটি'( বা 'বেঙ্গল গেজেট' ) নাম হল কেন? এ
সম্বন্ধে সাময়িকপত্র গবেষক কেদারনাথ মজুমদারের মত হল -"এই
বাঙ্গালা পত্রিকার নাম কেন 'বেঙ্গল গেজেট' রাখা হইয়াছিল
তাহার কোন কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। বোধহয় সেই সময় ইংরেজি
ভাষা ও ভাবের অত্যধিক প্রভাব হেতু শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরাও
সে ভাষা ও ভাবের প্রভাব সহজে অতিক্রম করিতে পারিতেন না।
গঙ্গাধর ভট্টাচার্যও বাঙ্গালার প্রথম সামিয়িক পত্র হিকির
'বেঙ্গল গেজেট'-এর নামের প্রভাব অতিক্রম করিতে পারেন নাই।"
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে ১৭৮০ সালে কলকাতা থেকে
হিকি সাহেবের প্রকাশিত দেশের সম্ভবত প্রথম মুদ্রিত ইংরেজি
সংবাদপত্র হিকির (James Augustus Hicky) গেজেট নামেই সুপরিচিত।
এটি দু'বছর চলেছিল। সংবাদপত্র প্রকাশনায় হিকির অবদানের
কথা স্মরণ করে কলকাতার ‘ডেকার্স লেনে’র নাম পরিবর্তন করে
‘জেমস হিকি সরণি’ রাখা হয়েছে।
'বেঙ্গল গেজেট' পত্রিকাটি সম্বন্ধে দুটি তথ্যগত গরমিল চোখে পড়ে।
প্রথমটি হল কেদারনাথ যাকে গঙ্গাধর ভট্টাচার্য বলেছেন তিনি প্রকৃতপক্ষে
শ্রীরামপুরের গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য। মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজে উল্লেখযোগ্য
উদ্যমের জন্য গঙ্গাকিশোর একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। অবশ্য গঙ্গাকিশোরের
গঙ্গাধর নামেও পরিচিত ছিলেন কি না জানা নেই। প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে
তার সম্বন্ধে কিছুটা আলোচনা করা হবে। দ্বিতীয়তঃ 'বেঙ্গল গেজেট' প্রকাশনার
সময় নিয়েও কেদারনাথের কিছুটা ভিন্ন মত রয়েছে। তার মতে 'বেঙ্গল গেজেট'
বাংলার প্রথম সামিয়কসাহিত্য এবং এটি প্রকাশিত হয় ১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে
(১২২৩ বঙ্গাব্দ)। তিনি মনে করেন 'দিগ্দর্শন' প্রকাশিত হয় 'বেঙ্গল
গেজেটে'র পরে। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন “সেই সময়, ১৮১৬ অব্দে বঙ্গদেশে
প্রথম বাঙ্গালা সাময়িকসাহিত্য ‘বেঙ্গল গেজেট’ পরিচালিত হইতে আরম্ভ
করে। সুতরাং বাঙ্গলার প্রথম সাময়িকসাহিত্য – ‘বেঙ্গল গেজেট’.......
সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, এই প্রথম বাঙ্গালা পত্রিকাখানা একজন বাঙ্গালি
দ্বারা পরিচালিত হইয়াছিল। ইহার দুই বৎসর পরে ১৮১৮ অব্দে মিশনারিগণ
কলিকাতার নিকটবর্ত্তী শ্রীরামপুর হইতে আর একখানা বাঙ্গালা সাময়িকসাহিত্য
পত্র বাহির করিতে আরম্ভ করেন, সে পত্রের নাম ছিল; - ‘দিগ্দর্শন’।”
তার আর একটি মন্তব্য : “প্রথম বাঙ্গালা সাময়িক পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’
জন্মগ্রহণ করিয়া কাল-কবলিত হইলে এক বৎসর কাল বাঙ্গালা ভাষায় আর কোনো
সাময়িক পত্রিকা বাহির হয় নাই। অতঃপর ‘দিগ্দর্শন’ বাহির হয়।”
কিন্তু প্রখ্যাত গবেষক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন 'বাঙ্গাল
গেজেটি' বাঙালি ( গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ) পরিচালিত প্রথম বাংলা
সংবাদপত্র। গঙ্গাকিশোর ১৮১৬ সালে বাংলা বই ছাপার কাজ শুরু করেছেন
ঠিকই কিন্তু 'বাঙ্গাল গেজেটি' ('বেঙ্গল গেজেট') প্রকাশিত হয়েছে ১৮১৮
সালে। সেকালের গবর্ণমেণ্ট গেজেট ঘেঁটে তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছেন যে
'বাঙ্গাল গেজেটি' ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই মে থেকে ৯ই জুলাই তারিখের
মধ্যে কোন একদিন আত্মপ্রকাশ করেছিল। সমকালে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা
'ফ্রেণ্ড-অব-ইণ্ডিয়া' ১৮২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিধাহীনভাবে
লিখেছেন যে 'সমাচার দর্পণ' প্রকাশের (২৩শে মে ১৮১৮) একপক্ষ কালের
মধ্যেই 'বেঙ্গল গেজেট' বেরিয়েছিল। প্রকাশক ও পত্রিকার পরিচালক হিসাবে
গঙ্গাকিশোর ছাড়াও হরচন্দ্র রায়ের নামও পাওয়া যায়। তিনিও ছিলেন শ্রীরামপুর
নিবাসী।
কেদারনাথ মজুমদার তার ‘বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য’ প্রকাশ করেছেন ১৯১৮
সালের কাছাকাছি সময়ে। আলোচ্য পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’ প্রকাশিত হয়েছিল
তার ১০০ বছর আগে। সুতরাং বিভিন্ন সূত্রে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই
প্রকাশনার সময় নির্ধারণ করতে হবে। ব্রজেন্দ্রনাথ যে সব তথ্যসূত্রের
উল্লেখ করেছেন সেগুলি যথেষ্টই নির্ভরযোগ্য। কিন্তু এ প্রসঙ্গে মহেন্দ্রনাথ
বিদ্যানিধি রচিত একতি প্রবন্ধের উল্লেখ করা যেতে পরে; এটি প্রকাশিত
হয়েছিল বৈশাখ ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ‘নব্যভারত’ মাসিক পত্রিকায়। সেখানে
লেখক লিখেছেন – “১২২৫ সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ (১৮১৮, ২৩শে মে) শনিবার,
সমাচার-পত্র-বিভাগে বঙ্গভাষার দ্বিতীয় পুত্র ভূমিষ্ঠ হয়। এই ‘সমাচার
দর্পনের’ও জ্যেষ্ঠ একটি ছিলেন। তাহার নমে ‘বেঙ্গল গেজেট’। তাহার
বয়স ‘দর্পণ’ অপেক্ষা দুই বৎসর অধিক। কেন না ১১২৩ সালে (১৮১৬ খ্রীষ্টাব্দে)
গেজেটের উদ্ভব।” প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৭ খ্রীষ্টাব্দে। যিনি
লিখেছেন তিনিও নিশ্চয়ই কোন তথ্যের ভিত্তিতেই লিখেছেন। অতএব কিছুটা
বিভ্রান্তি রয়েই গেল। তবে কেদারনাথ মজুমদার সম্ভবতঃ মহেন্দ্রনাথ
বিদ্যানিধির প্রবন্ধ থেকেই তথ্য সংগ্রহ করেছেন; কারণ ‘বেঙ্গল গেজেট’
সম্বন্ধে দুজনে একই তথ্য পরিবেশন করেছেন। দু’জনেই গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যর
পরিবর্তে গঙ্গাধর ভট্টাচার্যের নাম উল্লেখ করেছেন। গবেষকরা জানিয়েছেন
যে অনেক অনুসন্ধান সত্বেও 'বাঙ্গাল গেজেটি'র প্রথম সংখ্যা ত দূরের
কথা কোন সংখ্যারই কোন হদিস মেলে নি। এবার গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
সম্বন্ধে দু’একটি কথা।
গঙ্গাকিশোরের জন্ম সময় সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় নি। তবে তিনি ছিলেন
শ্রীরামপুরের নিকটবর্তী বহরা গ্রামের অধিবাসী। প্রচারের সুবিধার
জন্য ব্যাপটিস্ট মিশনারীরা শ্রীরামপুরে মুদ্রাযন্ত্র স্থাপন করলে
গঙ্গাপ্রসাদ সেখানে কম্পোজিটর হিসাবে কাজ শুরু করেন। পরে স্বাধীনভাবে
কাজ করার ইচ্ছায় তিনি কলকাতায় এসে পুস্তক প্রকাশনা ও বিক্রয়ের
ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। তখন কোন বাঙালীরই এদিকে নজর ছিল না। 'সমাচার
দর্পণে'র ৩০শে জানুয়ারি ১৮৩০-এর খবর -
"এতদ্দেশীয় লোকের মধ্যে বিক্রয়ার্থে বাঙ্গালা পুস্তক মুদ্রিতকরণের
প্রথমোদ্যোগ কেবল ১৬ বৎসরাবধি হইতেছে ইহা দেখিয়া আমাদের আশ্চর্য্য
বোধ হয় যে এত অল্প কালের মধ্যে এতদ্দেশীয় লোকেরদের ছাপার কর্ম্মের
এমন উন্নতি হইয়াছে। প্রথম যে পুস্তক মুদ্রিত হয় তাহার নাম অন্নদামঙ্গল
শ্রীরামপুর ছাপাখানার এক জন কর্ম্মকারক শ্রীযুত গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য্য
তাহা বিক্রয়ার্থে প্রকাশ করেন।"
১৮১৬ সালে গঙ্গাকিশোর কলকাতার Ferris and Company Press-এ বাংলা
ভাষার প্রথম সচিত্র পুস্তক 'অন্নদামঙ্গল' ছেপে বের করেন। এ ছাড়া
'গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী', 'লক্ষ্মীচরিত্র', 'বেতাল পঞ্চবিংশতি', 'চাণক্য
শ্লোক' ইত্যাদি ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হওয়ায় পুস্তকগুলির চাহিদা
ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। এরপর গঙ্গাকিশোর কলকাতায় বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস
ও অফিস স্থাপন করেন এবং 'বাঙ্গাল গেজেটি'র প্রকাশনা শুরু করেন।
যাই হোক 'বাঙ্গাল গেজেটি’র সাধারণ মূল্য ছিল এক টাকা ও সডাক মূল্য
দু'টাকা। পত্রিকাটি এক বছর চলেছিল।