প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

পুরানো সাময়িকী ও সংবাদপত্র

অগাস্ট ১৫, ২০১৬

 

হিতবাদী

দীপক সেনগুপ্ত


     ‘হিতবাদী’ একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র; প্রকাশিত হয় ১২৯৮-এর ১৭ই জ্যৈষ্ঠ (১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে মে)। পত্রিকাটির সম্বন্ধে খুব বিশদ ভাবে কিছু জানা যায় নি। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন –

“ সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘হিতবাদী’ নামটি দ্বিজেন্দ্রবাবুরই [ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ] সৃষ্টি, এবং ‘হিতং মনোহারি চ দুর্লভং বচঃ’ এই Motto-টিও তিনিই বলিয়া দেন। হিতবাদীর জন্মকালে পাঁচজন একত্র মিলিয়া এক বৈঠক বসিয়াছিল; তথায় আমিও ছিলাম, দ্বিজেন্দ্রবাবুও ছিলেন। সেই সময়েই ঐ নাম ও Motto পরিগৃহীত হয়। সুতরাং এক হিসাবে দ্বিজেন্দ্রবাবুই ঐ কাগজের জন্মদাতা বলিতে হইবে। সেই বৈঠকে শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে সম্পাদক হইতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু সম্পাদক হইয়া কাগজের উন্নতিকল্পে আমি বিশেষ কিছুই করিতে পারি নাই, এবং ঐ পদও আমি অধিক দিন রাখিতে পারি নাই, ....।”

রবীন্দ্রনাথ ‘হিতবাদী’তেই লিখেছেন -

“আমাদের হিতবাদী ব’লে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বেরোচ্চে। একটি বড় রকমের কম্পানি খুলে কাজে প্রবৃত্ত হওয়া যাচ্ছে। ২৫০০০ টাকা মূলধন। ২৫০ টাকা করে প্রত্যেক অংশ এবং এক-শ অংশ আবশ্যক।
“ কৃষ্ণকমল বাবুকে প্রধান সম্পাদক, আমাকে সাহিত্য-বিভাগের সম্পাদক এবং মোহিনীকে (মোহিনীমোহন চট্টোপাধ্যায়) রাজনৈতিক সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়েছে। বঙ্কিম, রমেশ দত্ত প্রভৃতি অনেক ভালো ভালো লোক লেখায় যোগ দিতে রাজি হয়েছেন। যাই হোক, ইতিমধ্যে দু’তিন মাসের লেখা আমার হাতে জড় না হলে আমাকে ভারি মুস্কিলে পড়তে হবে। আবার, কথা হয়েছে প্রতি সংখ্যায় একটা করে ছোট গল্প থাকবে। তোমাকে এই সঙ্কটের সময় আমার সহযোগিতা করতে হচ্ছে। গুটিকতক বেশ ছোট ছোট লঘুপাঠ্য সাহিত্য প্রবন্ধ পাঠাতে হচ্ছে। যত ছোট হয় তত ভালো অতএব সময়াভাবের ওজর ঠিক খাটবে না। বালকে [‘বালক’ নামক পত্রিকায়] তুমি যেমন বসন্ত উৎসব পাঠশালা প্রভৃতি পাড়াগাঁয়ের চিত্র দিয়েছিলে সেগুলি বড় ভালো জিনিস হয়েছিল কিন্তু আমি তোমাকে ফরমাস করতে চাইনে। তুমি তোমার কর্মস্থানেরও চিত্র দিতে পার কিম্বা যা ইচ্ছা লিখতে পার। এই প্রসঙ্গে আর একটা খবর দেওয়া আবশ্যক - লেখকেরা কাগজের অংশ থেকে কিছু পরিমাণে পারিতোষিক পাবেন। যাই হোক লেখা আমাকে যত শীঘ্র সম্ভব পাঠাবে।”

চিঠিটি রবীন্দ্রনাথ তার বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে পাঠিয়েছিলেন লেখা পাঠাতে আবেদন করে।

কৃষ্ণকমল ছেড়ে দেবার পর পত্রিকাটির দুর্দিন ঘনিয়ে আসে। শুরু হবার পাঁচ মাস পরে রবীন্দ্রনাথও সাহিত্য-সম্পাদকের পদ ছেড়ে দেন। সম্ভবত: ১২৯৮-এর জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। যথেষ্ট গুণীজনের আনুকূল্যে পত্রিকাটির যাত্রা শুরু হলেও এত দ্রুত কেন এটি দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সেটা বোঝা কঠিন। রবীন্দ্রনাথ ‘হিতবাদী’ ছেড়ে নতুন প্রকাশিত ‘সাধনা’ পত্রিকায় মনোনিবেশ করেন। শ্রীশচন্দ্রকে লেখা পত্র থেকে পরিষ্কার যে রবীন্দ্রনাথ প্রথমে যথেষ্ট আগ্রহ ও গুরুত্বের সঙ্গে হিতবাদী পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদনায় মন দিয়েছিলেন। শোনা যায় পত্রিকাটির পরিচালনা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। যাই হোক, এই অবস্থায় কবিরাজ উপেন্দ্রনাথ সেন, চন্দ্রোদয় বিদ্যাবিনোদ ও অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেন এবং অক্লান্ত পরিশ্রম করে পত্রিকাটিকে একটি প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রে পরিণত করেন। তাহার সম্পাদনায় ‘হিতবাদী’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৮৯৪-এর ২১শে মে তারিখে। কালীপ্রসন্নের উদ্যোগে ‘হিতবাদী’র একটি দৈনিক সংস্করণ কিছুদিনের জন্য বেরিয়েছিল। ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে নভেম্বর বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে প্রতিহত করার আহ্বান জানান হয়েছে। পত্রিকার অন্য একটি সংখ্যায় যুবসমাজের কাছে আবেদন করা হয়েছে যাতে তারা অত্যাচারী পুলিশের মেয়েকে বিয়ে না করে।

সাহিত্য-বিভাগের সম্পাদক পদে রবীন্দ্রনাথ পাঁচ মাস থাকলেও, তারই মধ্যে ‘দেনা পাওনা’, ‘পোস্টমাস্টার’ প্রভৃতি কয়েকটি বিখ্যাত ছোটগল্প ‘হিতবাদীতে’ প্রকাশ করেন| ছোটগল্প ছাড়া প্রবন্ধও এতে প্রকাশিত হয়েছে| ‘হিতবাদী’ তাই শুধু সংবাদপত্র হিসাবেই শেষ হয়ে যায় নি, একটি সাহিত্য পত্রিকাও হয়ে উঠেছিল| দুঃখের বিষয় ‘হিতবাদী’র পত্রিকার কোনো ফাইল রক্ষিত না হওয়ায় আজ আর এই পত্রিকার হদিস পাওয়া যায় না|

সেকালের জনপ্রিয় লেখক যোগেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন ‘হিতবাদী’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন| প্রায় নব্বই বছর বয়সে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র ১৯৫৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর সংখ্যায় তার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। ‘হিতাবাদী’ পত্রিকায় একজন লোক চেয়ে বিজ্ঞাপন বেরোলে যোগেন্দ্রকুমার সেখানে আবেদন পাঠান এবং পত্রিকার সহকারী সম্পাদক সখারাম গণেশ দেউস্কর তার পূর্ব পরিচিত হওয়ায় তিনি চাকরিটি পেয়েও যান। যোগেন্দ্রকুমারের স্মৃতিচারণ – “...... মস্ত বড় কাগজ, তা প্রায় টেবিলটার (তিন ফুট x আড়াই ফুটের কম নয়) সমান, গোলাপি বর্ণের কাগজ ছিল। ...... স্বত্ব কিনে নিলেন ঝামাপুকুরের যোগেন্দ্রনাথ বসু। ইনিও বেশী দিন চালাতে পারলেন না। কিনে নিলেন কলুটোলার উপেন্দ্রনাথ সেন। ইনি বিখ্যাত সি কে সেনের ছেলে। তখন কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ এলাহাবাদ থেকে একটি ছোট সাপ্তাহিক চালাচ্ছিলেন। উপেনবাবু অনুরোধ করে চিঠি দিলেন, হিতবাদীর দায়িত্ব নিতে। যোগ দিলেন এসে কাব্যবিশারদ, উনিই হলেন সম্পাদক।

“তখনকার কাগজে সম্পাদকের নামোল্লেখ অবশ্য প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু মুদ্রাকরের নাম থাকতেই হবে।
“তখন তিনটি সাপ্তাহিকের মধ্যে লড়াই চলত খুব। হিতবাদী, বঙ্গবাসী ও বসুমতী। এ ওকে একটু খোঁচা, ও একে একটু টিপ্পনী, সে লিখেই হোক আর কার্টুন এঁকেই হোক, নরমে গরমে চলত ভাল।”

সাক্ষাৎকারটিতে একটি উপভোগ্য ও কৌতুকপ্রদ গল্পের অবতারণা করেছেন যোগেন্দ্রকুমার। এটি যেহেতু ‘হিতবাদী’র সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাই উল্লেখ করা যেতেই পারে। তার বর্ণনায় কাহিনীটি শোনা যাক –

“ কুসুমকুমারী নামে এক ব্রাহ্মিকা ছিলেন। ব্রাহ্মরা একটু আলোকপ্রাপ্ত ত তখন! সিটি কলেজের হেরম্ব মৈত্রও ব্রাহ্ম। তাঁর সঙ্গেই কুসুমকুমারীর বিয়ের সব ঠিকঠাক। অনেকদিন থেকে কোর্টশিপও চলছে। কিন্তু হঠাৎ উপেন মজুমদার বলে এক ব্রাহ্মের সঙ্গে কুসুমকুমারীর বিয়ে হয়। বিষয়টা গেল সহ্যের সীমা অতিক্রম করে।
“ ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন কাব্যবিশারদ। কোকিল, বসন্ত এমনি সব নামে। সেবারে লিখলেন ‘কুসুম’ নামে কবিতা। তার এক জায়গায় লিখলেন –
‘আজি গণপতি গলে
কাল বিষ্টু পদতলে।’
তোমরা মানেটা বুঝলে ? হেরম্ব মানে গণপতি আর উপেন্দ্র মানে বিষ্ণু। আর এক জায়গায় লিখলেন –
‘আজি হেরম্বের ভোগ্য
কাল উপেন্দ্রর যোগ্য।’
“ আর যায় কোথায়। কুসুমকুমারীরা রেগে মানহানির মামলা করলেন হাইকোর্টে। বিচারে কাব্যবিশারদের ন’মাস জেল হয়ে গেলে। অনেকে বললেন, ক্ষমা চাইলেই ব্যাপারটা যখন মিটে যায়, তখন জেলে যাওয়ার কি দরকার। কিন্তু কাব্যবিশারদ ক্ষমা চাইলেন না। পাঁচ মাস জেল ভোগের পর সম্ভবত: সপ্তম এডওয়ার্ডের অভিষেক উপলক্ষে অনেক বন্দীর সঙ্গে মুক্ত হয়ে আসলেন। এর ফলটা অবশ্য একদিক থেকে ভাল হয়ে গেল; হিতবাদী তখন পঁচিশ হাজারে উঠল। দাম ছিল দু’পয়সা। ... হিতবাদীর সর্বাধিক প্রচার পঁয়ষট্টি হাজার পর্যন্ত উঠেছিল। ... ‘হিতবাদী’ প্রধানত: কংগ্রেসেরই কথা বলত। মন্ত্র তার বন্দে মাতরম।”

কাব্যবিশারদের মৃত্যুর কাহিনীও শুনিয়েছেন যোগেন্দ্রকুমার। অদ্ভুত সে কাহিনী। একবার অসুস্থ হলে, ডাক্তারের পরামর্শে সমুদ্রযাত্রা করেন তিনি। গেলেন জাপানে। ফেরার সময় অসুস্থ হয়ে এক শিখের আতিথ্য গ্রহণ করেন। পেটের অসুখের মধ্যেও প্রচুর খাওয়া দাওয়া করেছিলেন। চীন সমুদ্রে জাহাজের কেবিনে বসে লিখতে লিখতেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তার দেহটি বাক্সে পুরে সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই শেষ হয় ‘হিতবাদী’র সম্পাদকের জীবন।

কাব্যবিশারদের মৃত্যু হয় ১৯০৭ সালের ৪ঠা জুলাই। এর পর সখারাম গণেশ দেউস্কর, জলধর সেন প্রমুখ লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাহিত্যিক ‘হিতবাদী’ পরিচালনা করেছিলেন। ‘হিতাবাদী’র শেষ সংখ্যা কবে বেরিয়েছিল সেটা বলা শক্ত। সম্ভবত কালীপ্রসন্নর মৃত্যুর পরে খুব বেশিদিন পত্রিকাটি চলে নি।

‘হিতবাদী’ পত্রিকা সম্বন্ধে রাজা বিনয়কৃষ্ণ দেববাহাদুর তার ‘কলিকাতার ইতিহাস’ গ্রন্থে [১৩১৪ বঙ্গাব্দে প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত] যা লিখেছেন কিছুটা পুনরুক্তি হলেও সেটা এখানে তুলে দিচ্ছি –

“ঐ একখানি সংবাদপত্র প্রকাশ করিবার উদ্দেশ্যে একটি জয়েন্ট স্টক কোম্পানির সৃষ্টি হইল, এবং তাঁহাদের যত্নে ‘হিতবাদী’ প্রচারিত হইল। সুপ্রসিদ্ধ সংস্কৃত পণ্ডিত কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য ইহার সম্পাদক হইলেন। শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ খ্যাতনামা লেখকগণ ইহার নিয়মিত লেখক ও পৃষ্ঠপোষক হইলেন। কিন্তু এই কারবার লাভবান না হওয়ায় কিছুদিন পরে ইহা কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদকে বিক্রয় করা হয়। তিনিই ইহার বর্তমান সম্পাদক। তাঁহার সুদক্ষ পরিচালনার গুণে হিতবাদী ৩০ হইতে ৪০ সহস্র গ্রাহক সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইয়াছে। পণ্ডিত কালীপ্রসন্ন নানা বিষয়ে সুপণ্ডিত। তিনি কেবল বাংলা গদ্য রচনাতেই সুদক্ষ নহেন, পদ্য রচনাতেও সুনিপুণ। তিনি কেবল সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত নহেন, ইংরাজিতেও সুশিক্ষিত।”

‘হিতবাদী’ পত্রিকার কোনো সংখ্যাই দেখার সুযোগ আমার হয় নি। আগেই বলা হয়েছে যে এ পত্রিকার ‘ফাইল’ ঠিকমত রক্ষিত হয় নি। যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে তা সবই বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় উল্লেখিত ও পরিবেশিত খবর থেকে সংগৃহীত হয়েছে। ‘হিতবাদী’ সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক বেশ কিছু কাহিনী জানা যায় ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত জলধর সেনের ‘স্মৃতি-তর্পণ’ থেকে। তা থেকে কিছু এখানে উদ্ধৃত করছি। হয় ত পত্রিকার নানা বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশিত রচনার বিষয় ও ধরণ এটা থেকে প্রত্যক্ষভাবে বিশদ জানা যাবে না, তবে জলধর সেনের বর্ণনা নিঃসন্দেহে সুখপাঠ্য।

“ যখন আমি ‘সন্ধ্যা’ অফিসে আড্ডা দিতাম – সে সময় একদিন প্রাতঃকালে দেউস্কর মহাশয় ‘সন্ধ্যা’ অফিসে উপস্থিত হন এবং আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বললেন, উপেনবাবু (স্বর্গীয় কবিরাজ উপেন্দ্রনাথ সেন মহাশয়) আমাকে তলব করেছেন। অকস্মাৎ উপেন-দাদার তলব – আমি কারণ জানতে চাইলাম। সখারাম বললেন, সন্ধ্যার পর তাঁর সঙ্গে দেখা করলেই কারণ জানতে পারব। সখারাম আর কিছুই বললেন না।
“ সন্ধ্যার পর ‘হিতবাদী’ অফিসে গেলাম। শ্রীমান মনোরঞ্জন বাবাজী আমাকে সঙ্গে নিয়ে উপেনদাদার বৈঠকখানায় হাজির করে দিলেন। সেখানে উপেনদাদা ও তাঁর বড় ভাই দেবেনদাদা বসে ছিলেন। উপেনদাদা কাজের লোক ; ভূমিকা বা ভণিতা না করে তিনি সোজাসুজি বলে বসলেন, “দেখ জলধর, তোমাকে হিতবাদীর ভার নিতে হবে।” আমি ত অবাক – এ কি প্রস্তাব। আমি বললাম, “আমার দ্বারা হবে না দাদা!” তাই নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক হোলো। অবশেষে আমি বললাম, “আপনারা যদি সখারামের উপর সম্পূর্ণ ভার দেন, তা হ’লে আমি তাঁকে সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি।” উপেনদাদা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “ভেবে দেখি। তুমি কাল একবার এসো।” পরের দিন গেলাম। তিনি বললেন, “তোমার প্রস্তাবেই সম্মত হলাম। আজ থেকেই কাজ আরম্ভ করে দাও।” তাঁর আদেশে সেই দিন থেকেই আমি ‘হিতবাদী’র সেবক হলাম। সখারাম হলেন কর্ণধার, আর যোগেন্দ্রবাবু, মণীন্দ্রবাবু, পাঁচুবাবু, মনোরঞ্জন, আর আমি হলাম সেবক।
“ এইখানে বিশারদ-দাদার [ কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ ] কথা একটু বলি। বিশারদ-দাদা বিচিত্র-কর্ম্মী মানুষ ছিলেন। তিনি শুধু সাংবাদিক ছিলেন না, আমাদের দেশের অসংখ্য কাজের বোঝা তিনি তাঁর সুস্থ সবল মস্তকে তুলে নিয়েছিলেন এবং তিনি তার কোন একটিকেও অবহেলা করেন নাই – তাঁর কর্ত্তব্যবোধ এমনই প্রখর ছিল।
“ কিন্তু মানুষের শরীর ত! বিশারদ-দাদা তাঁর শরীরের দিকে মোটেই চান নাই। তার ফল এই হোল, অমন যে স্বাস্থ্য, অমন যে তীক্ষ্ণ প্রতিভা, অমন যে অতুলনীয় কার্য্য-দক্ষতা – অত্যধিক পরিশ্রমে, অবিশ্রান্ত মস্তিষ্ক চালনায় তিনি অবশষে অবসন্ন হয়ে পড়লেন, এত পরিশ্রম তাঁর সইল না।
“ বন্ধুবান্ধবদের সনির্বন্ধ অনুরোধে তিনি বিশ্রাম লাভের জন্য সমুদ্রযাত্রা করলেন। অমন কর্ম্মী পুরুষ কি বিনা কাজে বেশি দিন চুপ করে থাকতে পারেন – বিশারদ-দাদা গৃহাভিমুখী হলেন। সমুদ্রের মধ্যেই তাঁর চির বিশ্রাম লাভ হোলো। সাগরের নীলাম্বুতলে আমাদের বিশারদ-দাদার নশ্বর দেহ সমাহিত হোলো। পড়ে রইল তাঁর ‘হিতবাদী’; পড়ে রইল তাঁর পুত্র মনোরঞ্জন, পড়ে রইল তাঁর অসংখ্য অসমাপ্ত কাজ – বিশারদ-দাদা সাধনোচিত ধামে চলে গেলেন।
***** ***** *****
“ সেবার সুরাটে কংগ্রেসের অধিবেশন হবার ব্যবস্থা হয়েছিল ; সভাপতি মনোনীত হয়েছিলেন সার রাসবিহারী ঘোষ। কলকাতা থেকে অনেক প্রতিনিধি সুরাটে গিয়েছিলেন; সুরেন্দ্রনাথ যে গিয়েছিলেন সে কথা না বললেও চলে; উপেনদাদাও গিয়েছিলেন।
“ যেদিন কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হবার কথা, সেদিন অপরাহ্ণে আমরা তাড়িতবার্ত্তার দিকে চেয়ে ছিলাম। তখন ‘দৈনিক হিতবাদী’ খুব জোরে চলছে। সন্ধ্যার একটু পূর্ব্বে তার এলো – কংগ্রেস ভেঙ্গে গিয়েছে , দক্ষযজ্ঞের ব্যাপার হয়েছে, লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক প্রমুখ একদল এই দক্ষযজ্ঞের নেতা ইত্যাদি ইত্যাদি। অতএব আদেশ করা হয়েছে, তিলকের এই কার্য্যের তীব্র নিন্দা করতে হবে। এই আদেশ শুনে হিতবাদীর কর্ণধার, মারাঠাসন্তান সখারাম একেবারে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন –“আমার উপর যতক্ষণ হিতবাদীর ভার আছে, ততক্ষণ তিলক মহারাজের বিরুদ্ধে এক লাইনও লেখা হবে না, তাতে আমার কার্য্য ত্যাগ করতে হয় তাও করব।” তিনি তখনই সে কথা তারযোগে উপেনদাদাকে জানালেন।
“ সাতটা বাজলো, আটটা, ন’টা হয়ে গেল – সখারামের তারের জবাব আর আসে না। আমরা মহাসঙ্কটে পড়লাম। পরদিন প্রাতঃকালে যথারীতি ‘দৈনিক হিতবাদী’ বাজারে দিতে হবে ত!
“ দশটার একটু আগেই তারের জবাব এলো। তার মর্ম্ম এই যে, কার্য্যত্যাগই মঞ্জুর হোলো। তাঁহাদের ফিরে না আসা পর্য্যন্ত আমাকে কাগজ চালাতে হবে। তাই হোলো। দুই দিন পরে সুরেন্দ্রবাবু, উপেনদাদা প্রভৃতি ফিরে এলেন। নূতন কোন ব্যবস্থাই তাঁরা করলেন না; সেই তারের খবর “জলধর কাগজ চালাক” – ঐখানেই শেষ। কিন্তু তা চলল না! তখন –
“মরা গাঙে বান ডেকেছে,
জয় মা বলে ভাসাও তরী।” [ মূল কবিতার দু’লাইন একটু অন্য রকম ]।
“ তখন সুরেন্দ্রনাথের অমর লেখনী ‘বেঙ্গলী’র পৃষ্ঠায় অনল বর্ষণ করতে লাগল। আমার ধাতুতে অনল ত ছিলই না, উত্তাপও হয় ত ছিল না। আমি এ দামোদরের বানের সঙ্গে পেরে উঠব কেন? হিতবাদী বলতে লাগলেন “চালাও তরী – কিন্তু ধীরে।”
“ সর্ব্বনাশ! হিতবাদীর পরম শুভানুধ্যায়ীরা বলতে আরম্ভ করলেন, হিতবাদীর সুর নরম হয়ে গিয়েছে। সে কথা শুনেও চুপ করে রইলাম। তার পরে অভিযোগ হতে লাগল, আমি বিশারদের বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ করেছি। যে বিশারদ দাদাকে আমি গুরুর মত ভক্তি করি, আমার দ্বারা তাঁর বৈশিষ্ট্য ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, এ অভিযোগ আমি সহ্য করতে পারলাম না – আমি তখন বিশারদ দাদার উদ্দেশ্যে প্রণাম করে তাঁহার হিতবাদীর সেবা হ’তে অবসর গ্রহণ করলাম। এইখানে বলা কর্ত্তব্য যে, আমি যতদিন হিতবাদীর সেবায় নিযুক্ত ছিলাম , ততদিন দেবেনদাদা, উপেনদাদা, তাঁহাদের পুত্রগণ ও শ্রীমান মনোরঞ্জনের নিকট থেকে যে অনুকম্পা লাভ করেছিলাম, সে কথা আমি কোনদিন ভুলব না।
“ তার পর যাঁহারা হিতবাদীর ভার নিলেন, তাঁহারা হিতবাদীর বৈশিষ্ট্যকে অতিক্রম করে গেলেন। তার ফলে হিতবাদীর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ উপস্থিত হোলো। কে সম্পাদক, তা আদৌ প্রমাণ হোলো না, হাতে-কলমে ধরা পড়লেন নিরীহ মুদ্রাকর – নীরদবাবু। তাঁকে মাস কয়েকের জন্য কারাদণ্ড ভোগ করতে হোলো। আর ‘দৈনিক হিতবাদী’র জামিন তলব হোলো। এইবার হিতবাদীর কর্ত্তারা সত্যসত্যই বিশারদ-দাদার বৈশিষ্ট্য রক্ষা করলেন ; তাঁরা স্পষ্ট বললেন, দৈনিক হিতবাদী বন্ধ করতে হয় তাও করব, জামিন দেব না। তাই হোলো; জামিন দেওয়া হোলো না দৈনিক হিতবাদী বন্ধ হয়ে গেল। সাপ্তাহিক হিতবাদী এখনও চলছে।
“ স্বর্গীয় দেবেন্দ্রদাদা ও উপেন্দ্রদাদা আমার প্রতি যে কেমন সদয় ছিলেন তার একটা দৃষ্টান্ত না দিলে আমি তাঁদের স্মৃতি-তর্পণ শেষ করতে পারছিনে।
“ আমি প্রতি দিন একটার সময় ‘হিতবাদী’ অফিসে যেতাম। আমার ফিরতে রাত ১২!১টা বেজে যেত। আর সকলে সন্ধ্যার পরই চলে যেতেন। আমি একা থাকতাম। আমি তখন শ্রীমান রাধিকাপ্রসাদ সান্যালের বাসা ছেড়ে স্কটিশ চার্চেস কলেজের পেছনে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় থাকতাম। সব দিন রাত্রিতে আমার আহার হত না। অত রাত্রে আহার্য্য দ্রব্য থাকলেও খেতে ইচ্ছা করত না, সুতরাং উপবাসেই কাটতো। পথশ্রম আমি গ্রাহ্য করতাম না, কলুটোলা থেকে হেদুয়া – এমন কিছু দীর্ঘ পথ নয়।
“ হিতবাদী আপিস যে ফুটপাথে তার অপর দিকেই কবিরাজ সেন মহাশয়দিগের প্রকাণ্ড অট্টালিকা। ফুটপাথের উপরেই তার বিস্তৃত বারান্দা। সেখান থেকে আমাদের আপিস বেশ দেখা যায়। এক দিন রাত্রি দশটা সাড়ে দশ টার সময় উপেনদাদা সেই বারান্দায় বেড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি ‘হিতবাদী’ আপিসের দিকে পড়লো। তিনি দেখলেন – আমি একলা বসে কি লেখাপড়া করছি। তখনই লোক পাঠিয়ে তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। দেবেনদাদা তখন সেই বারান্দায় বসেছিলেন। আমি যেতেই উপেনদাদা বল্লেন – জলধর, তুমি এখনও বাড়ী যাওনি। আমি বললাম – এখনো ত সময় হয় নি, আমি ১২!১টার কমে যাইনে। তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন – রাত ১২!১টা পর্য্যন্ত না খেয়ে থাক ? আর তার পর ? এই গ্যাঁড়াতলা দিয়ে বাসায় যাও ? ভয় করে না ?
“ আমি বিনীতভাবে বললাম – অনেক দিনই রাত্রে অনাহারে কাটাতে হয় দাদা। আর, পথের কথা যা বলছেন, - আমি গ্যাঁড়াতলা দিয়ে যাই নে, বরাবর কলুটোলা দিয়ে গিয়ে মেডিকেল কলেজের সামনে কলেজ স্ট্রীট ও সেখান থেকে বরাবর কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট ধরে হেদোয় যাই।
“ তিনি বললেন, না, না! অমন করে একলা যেও না – গাড়ী করে যেও। তোমার সে গাড়ী-ভাড়া আমিই রোজ দেব। আমি হেসে বললাম – দাদা, ভুলে যাচ্ছেন – আমি হিমালয়-ফেরত। তিনি আমার কথায় বাধা দিয়ে বললেন – আরে, না, না। শেষে গুণ্ডার হাতে প্রাণ হারাবে নাকি ?
“ তার পরে দেবেনদার দিকে চেয়ে বল্লেন – আচ্ছা দাদা – আমিই না হয় নানান ধান্ধায় ঘুরে বেড়াই। তুমি ত বাড়ীতেই থাকো! এই যে ভদ্রলোকের ছেলেটি সেই দুপুর বেলায় আসে আর রাত ১২টা ১টায় যায় – এর দিকে কি একবারও চেয়ে দেখ না। দেখো, আজ থেকে রোজ রাত্তির ন’টার সময় হিতবাদী অফিসে জলধরের খাবার পাঠিয়ে দেবে। ভুলে যেও না।
“ দেবেনদা বললেন – সত্যি অন্যায় হয়েছে জলধর। আমার শরীর ভাল নয় তা তো জানো - সব দিক দেখে উঠতে পারিনে।
“ তারপর যতদিন ‘হিতবাদী’তে ছিলাম, রাত ন’টার সময় আমার খাবার আসতো। কিন্তু আমি গাড়ী-ভাড়ার পয়সাও নিইনি, গাড়ী-ভাড়া করেও বাড়ী আসিনি।
“ কয়েকদিন পরে উপেনদা আমাকে ডেকে বললেন – কই হে জলধর – তুমি তো গাড়ী-ভাড়ার পয়সা নাও না। আমি সে কথার উত্তর না দিয়ে নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তিনি তখন ‘হিতবাদী’র ম্যানেজারকে ডেকে আদেশ দিলেন – এই মাস থেকে জলধরের কুড়ি টাকা মাইনে বাড়ল।
“ এই অযাচিত স্নেহে সেদিন আমার চোখে জল এসেছিল – আমি একটি কথাও বলতে পারিনি। আজ এতকাল পরে তাঁদের সেই স্নেহ ও অনুগ্রহের কথা স্মরণ করে আবার আমার চোখে জল এল। এই চোখের জলেই আজ তাঁদের দুই ভাইয়ের স্মৃতি-তর্পণ করলাম।”

‘হিতবাদী’ নামেই একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল ১২৭৭ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে| নবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় সেটি ছিল একটি ধর্ম বিষয়ক পত্রিকা|


লেখক পরিচিতি : বহু বছর বি.ই. কলেজে (এখন ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, শিবপুর ( IIEST,shibpur )) অধ্যাপনা করেছেন। কিছুদিন হল অবসর নিয়েএখন সেখানে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে আছেন। অ্যাপ্লায়েড মেকানিক্স নিয়ে গবেষণা করলেও একাধিক বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে - জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরনো কলকাতার সংস্কৃতি, ইত্যাদি। অবসর সময়ে 'অবসরে'র সঙ্গে সময় কাটান।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.



অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।